এমএসএনে আলাপ হচ্ছিলো এক বন্ধুর সাথে। বয়সে বড়, তবে এখনো ছেলেমানুষ। কথায় কথায় জানালেন, দেশের অবস্থা ভালো না।
জিজ্ঞেস করলাম, "কীরকম?"
তিনি বললেন, "লোকে ভাষা ভুলে যাচ্ছে। বিদেশী ভাষায় কথা বলে।"
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। অনেক কথা বলে ফেলি তারপর। কিভাবে বালিকারা এখন তাদের প্রেমিককে "প্রিয়ে" "নাথ" "হৃদয়বল্লভ" প্রভৃতি না ডেকে "জাআন" ডাকে, কিভাবে প্রেমিক প্রেমিকার মানভঞ্জন না করে তাকে "মানানো"র চেষ্টা করে, কিভাবে মিষ্টিমধুর "সোনা" সম্বোধন "বেয়বেহ"তে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক ভাষিক পরিবর্তনের আলাপ উঠে আসে।
তিনি বিরক্ত হন। বলেন, "আরে ধুরো মরা! তাতে আমার কী?"
আমি হকচকিয়ে যাই।
তিনি বলেন, "বাংলা ভাষা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই! আপনি জানেন, চট্টগ্রামের লোক এখন আর চট্টগ্রামের ভাষা বোঝে না?"
আমি হাসি। খুবই স্বাভাবিক। চট্টগ্রামের ভাষা রীতিমতো কঠিন। ফরাসী শিখতে গিয়ে টের পেয়েছি। লিয়াজোঁ জিনিসটা রীতিমতো সেইরকম ঘাপলার। ওয়াহিদুর রহমান যখন অহিদোরঁন হয়ে যায়, তখন একটু সমস্যা তো হবেই।
তিনি আমার হাসির ইমোটিকন দেখে গোস্যা করেন। তারপর খুব গরম গরম কথা বলেন। তার কথা থেকে জানতে পারি, চট্টগ্রামে নাকি কয়েক মাইল ভ্রমণ করলেই শব্দের অর্থ পাল্টে যায়। যেমন, ফুইৎ ন ফাই মানে হচ্ছে সময় পাই না, কিন্তু নদীর এপারে এর অর্থ লোকে ইদানীং বুঝতে পারছে না। খোদ চিটাগাঙেই নাকি এখন লোকে চট্টলার ঐতিহ্যবাহী ভাষা ছেড়ে বাংলা, ডিজুস আর রেডিওটুডের ভাষায় কথা বলা শুরু করেছে। এটা নাকি তাঁরতুনবালান'লার।
আমি ভয়ে ভয়ে প্রস্তাব দিলাম, চট্টগ্রামের ভাষার একটা ব্যকরণ লিখে ফেলতে। অনেকের কাজে দেবে। যারা চাকরি, পড়াশোনা, ভ্রমণ সূত্রে চট্টগ্রামে যান, তাঁরা সাংঘাতিক উপকৃত হবেন।
তিনি ক্ষেপে গেলেন। চিটাগাঙের ভাষার রেজোলিউশন নিয়ে আবারও কথা বললেন কিছুক্ষণ।
আমি বললাম, আপনি জিইসির মোড়কে রেফারেন্স ধরে লিখুন না। বাকিটা কোসাইন সূত্র ধরে বের করে ফেলা যাবে। কস থিটা দিয়ে গুণ করলেই ...।
তিনি এরপর কী কী যেন বলতে লাগলেন চট্টগ্রামের ভাষায়। ভয় পেয়ে বললাম, আচ্ছা শুভরাত্রি।
তবে আমার পরামর্শটা নেহায়েত খারাপ ছিলো না। চিটাগঙের এতো আত্মীয় স্বজন থাকার পরও এ ভাষাটা শুনলে আজো ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকি। বয়স হচ্ছে, দুইদিন পর শেখার শক্তি থাকবে না। একটা ভালো ব্যকরণ বইয়ের অভাবে এতো সুন্দরী চট্টলাবাসিনীর সাথে দু'দন্ড নিভৃতালাপের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি ভাবতেই কান্না পাচ্ছে।
সুধী চাট্টলিক, বিলম্ব নয়। আজই শুরু করুন।
মন্তব্য
চট্টগ্রামগামী এক কোচে চট্টলাবাসীদের কলরবের মাঝে বসে আমার মনে হয়েছিল, আমি এখন অজানা এক ভাষার দেশে এসে পড়েছি।
ভাষাবিদ আমি নই, ভাষার ইতিহাস সম্পর্কেও জ্ঞান নেই সম্যক। কেউ কি আমার বালখিল্য প্রশ্নের জবাব দেবেন: " যে-ভাষার শতকরা ৮০-৯০ ভাগ সাধারণ বাঙালির কাছে অবোধ্য, সেই চট্টগ্রামের ভাষা কি সত্যিই বাংলা ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ, নাকি স্বয়ংসম্পূর্ণ আলাদা একটি ভাষা?"
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
চট্টগ্রামের ভাষায় আরাকানের ভাষার অংশবিশেষ আত্মীকৃত হয়েছে বলে শুনেছিলাম, যেমন সিলেটের ভাষায় অহমিয়ার ছাপ অনেক। চট্টগ্রামের বাক্যরীতির গঠন একটু অন্যরকম, যেমন নেতিবোধক শব্দ ক্রিয়াপদের আগে বসে।
সন্ন্যাসীর প্রশ্নে বলছি, "সাধারণ বাঙালি" শব্দযুগল অযথা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে, কারণ বাংলাদেশের এক প্রান্তের ভাষা আরেক প্রান্তের লোকে শতকরা একশো ভাগ বোঝে না। কোন দেশেই বোধহয় বোঝে না। আমার সহপাঠী ওলাফ ডুসেলডর্ফের লোক, তার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রফেসরই প্রথমবার বোঝে না। দুইবার করে সব কথা বলতে হয় তাকে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
ঠিক বলেছেন। "সাধারণ বাঙালি" বা "অ্যাভারেজ বাঙালি" বলাটা অনুচিত। বলা উচিত ছিলো, চট্টগ্রাম ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের লোকজন।
আমার দুর্বল প্রকাশক্ষমতা প্রায়ই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। আমার কথায় কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। কাউকে মনোকষ্ট দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই বা ছিলোও না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
এক কোর্সে জনৈকা ইউক্রেনিয় সুন্দরী এসে হাজির হয়েছেন। কাজেই আপনি যদি সময় করে মাঝেমাঝে টুকিটাকি মন্ত্রগুপ্তি শেখান ভালোই হয়।
হাঁটুপানির জলদস্যু
পাঠাচ্ছি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
আঁরার হিমুদার বাড়ি খডে??
আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
মূল বাংলার সাথে সিলেট বা চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দূরত্ব পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলো।
সিলেট ও আসাম মিলে আলাদা প্রদেশ ছিলো।
চট্টগ্রামের লোকজন চাকুরি ও ব্যবসার জন্য রেঙ্গুনের সাথেই যোগাযোগ বেশি রাখতো। আরাকানে বাংলা ভাষারই চর্চা হতো। কিন্তু চট্টগ্রামের নিজস্ব শব্দ আছে, উচ্চারণের ঢং-ও আলাদা।
সিলেটের অবশ্য রীতিমত বর্ণ আছে। সিলেটি নাগরি। সে নাগরিতে আগে পুঁথি লেখা হতো। এখন আবার নতুন করে তার চর্চা শুরু হয়েছে বিলেতে।
অক্সফোর্ড থেকে ইংরেজি-সিলেটি অভিধান বেরুবে শীঘ্রি। ব্রিটেনের যে কোনো বড় প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি সিলেটি ভাষার নামও দেখা যায়। বাংলা ও সিলেটি আলাদা ভাষা হিসেবেই এখানে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কারণ সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা বাংলা ঠিকঠাক বুঝতে না পারায় তাদের ভাষার একটা আলাদা গুরুত্ব তৈরি হয়েছে।
লন্ডনে সিলেটি ভাষায় ইন্সটিটিউটও আছে। সেখান থেকে ইংরেজরা সিলেটি ভাষায় গ্র্যাজুয়েট হয়। পুলিশ, সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন কাজের প্রয়োজনে সিলেটি ভাষা শিখে।
সবই প্রয়োজন........................
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
খাইছে!
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
ইংরেজি-সিলেটি অভিধান !!!
দারুণ মজার বিষয় তো।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
খাইছে!
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
তাই নাকি??? খুবই আশ্চর্য খাইলাম???
ওঁয়া হিমু, এগিন কি লেইলা তুঁই? উত্তর চট্টগ্রামোর মানুষ দক্ষিণ চট্টগ্রামোর মাইনষর বাষা এনেই ন বুযে...সাতকাইন্যা গরুচোরগিন কি বাষাত কতা ক, আঁই ফটিকছড়িত্তুন কিসুই ঠার-ন-ফাই।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভাষা আমেরিকার উত্তরের ইংরেজীর মত; খুবই দ্রুত এবং অনেক শব্দচয়নও ভিন্ন। যেমন চট্টগ্রামের এক অংশের মানুষ (উত্তর/দক্ষিণ মনে নাই) করে, খাই ইত্যাদি ক্রিয়ার শেষে একটা এক্সট্রা 'দ্দে' লাগায়, করেদ্দে, খাদ্দে ইত্যাদি, যেটা অন্যরা বলে করের, খার। 'গম আছি' এটা সবাই চট্টগ্রামের ভাষায় 'ভাল আছি' জানলেও এটাও শুধু একটা নির্দিষ্ট অংশের লোকেরা ব্যবহার করে। এইরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।
যত উত্তরে যাওয়া যায় চট্টগ্রামের ভাষার দ্রুততা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। আমার মা-বাবা দুইজন দুইদিকের হওয়াতে এই পার্থক্যগুলা আমি বুঝতে পারি। দক্ষিণের আত্মীয়রা যখন নিজেদের মধ্যে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে তখন সেটা এত দ্রুত হয়, আমি ভাল চট্টগ্রামের ভাষা বুঝলেও আমার কানেও সেটা দুর্বোধ্য চীনা-জাপানী ভাষার মত 'চিং-চিং-টিং-টিং' ঠেকে!
চট্টগ্রাম-নোয়াখালী বর্ডার মিরসরাই-এর কাছে এসে চট্টগ্রামের ভাষায় নোয়াখালী টান শুরু হয়। মিরসরাই তাই চট্টগ্রাম জেলায় হলেও নিন্দুকেরা মিরসরাইবাসীদের আড়ালে এইটি-টুয়েন্টি ডাকে। ভূমির বৈচিত্রের সাথে সাথে ভাষার এই বৈচিত্র ও পরিবর্তন আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় লাগে।
চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক ও আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। আমি যতদূর জানি, ডঃ এনামুল হক চট্টগ্রামের ভাষার বর্ণমালা লিখেছিলেন ও এ ভাষায় সাহিত্যগ্রন্থও রচনা করেছেন, সম্ভবত ব্যাকরণও লেখা হয়েছিল (দুঃখিত কোন সূত্র উল্লেখ করতে পারছিনা , কোন এক অতীতে এ বিষয়ে পড়েছিলাম)। মহাকবি আলাওলের 'পদ্মাবতী' আরাকান ভাষায় লেখা হলেও, এটা চট্টগ্রামের ভাষারই অন্যরূপ। (ডঃ এনামুল হকের 'আরাকান রাজসভায় বঙ্গীয় সাহিত্য' বইটিতে সম্ভবত এর উল্লেখ আছে)
========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"
পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"
কার একটা লেখায় যেনো পড়েছিলাম প্রতি ২৫ মাইল দুরত্বে ভাষা একটু করে নিজেকে বদলায় ।
সিলেটের ভেতরে ও সব জায়গার সিলেটী একরকম নয় । বৃহত্তর সিলেটের ধর্মপাশা তাহিরপুর আর বিয়ানীবাজার গোলাপগঞ্জের শব্দচয়ন উচচারনরীতি এক নয় । সিলেট থেকে ঢাকা আসার পথে মাধবপুর ব্রীজ পেরিয়েই বৃহত্তর সিলেট শেষ,ব্রাম্মনবাড়িয়া তথা বৃহত্তর কুমিল্লার শুরু । সিলেট এবং কুমিল্লার কথ্য ভাষা এক নয় । আমার আগ্রহ ,ঠিক কোন জায়গা থেকে বদলানো শুরু হলো?
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আমার মনে হয় ঠিক ধুম করে বদলায়না; এটাকে বলতে পারেন ওয়াটার কালারের ওয়াশ ইফেক্টের মতো, ধীরে ধীরে একটা আরেক্টার সাথে মিশে যায়, এর অনন্য উদাহরণ হতে পারে চট্টগ্রামের মিরাশরাই কিংবা ব্রাম্মনবাড়িয়া। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি, এই দুই অঞ্চলের মানুষ যেন দুই পাড়ের মানুষের সেতুবন্ধন।
...চট্টগ্রামের ভাষা বেশি ব্যবহার হয়নি, তবে চাটগাইয়া সুরে শুদ্ধ বাংলা বলানো হয়েছে। .........এই কাজটার মধ্যে আন্তরিকতার চাইতে বেশী পাওয়া যায় উপহাস। এই উপহাস মানুষকে আরো দূরে ঠেলে দিয়েছে। কোন ডায়ালগ দূর্বোধ্য হলেই ফানি হয়না বা তাকে মশকরা ডংগে উপস্থাপন করা ঠিকনা। ঠিক সিলেটী বা নন সিলেটী নাট্যকারদেরও দেখি সিলেটী ভাষাটাকে অত্যন্ত কদর্যভাবে প্রেজেন্ট করতে। তবে সম্প্রতি সিলেটি ডায়ালগের এর একটা ভালো প্রকাশ দেখি তারেক মাসুদের 'অনর্যাত্রা'-তে (যদিও ছবিটির মেকিং বা বিষয়বস্তু নিয়ে আমার ভিন্ন মত আছে)।
@ তানভীর আই আপনার বিশ্লেষনী মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমার এই নিয়ে কথা বলতেই একটু ভয় করে; ভয়ের কারন হলো, এই ভাষা বা ডায়ালেক্ট নিয়ে অনেকে অতি মাত্রায় আঞ্চলিক হয়ে উঠেন (ঠিক একই আচরন দেখি অতি জাতীয়তাবাদীদের ভেতরও)। তাও বলি একটু, আমার বাবার দিকের লোকজন উত্তর চট্রগ্রামের আর মায়ের দিকের চাটগাঁ শহরের মধ্যমভাগের। এই দুই অঞ্চলের উচ্চারনগত প্রচুর অমিল আছে, আবার দক্ষিন ভাগের সাথে অমিলটা বেশী (বিশেষ করে সাতকানিয়া, বাশঁখালী, কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া এসব অঞ্চলের সাথে), আবার শহরের মূল অংশের সাথেও পতেঙ্গা বা ফিরিঙ্গি বাজারের মানুষেরও ডায়ালগে রয়েছে প্রচুর তফাত (এসব এলাকার লোক চাটগাইঁয়ার সাথে ইংরেজী শব্দের ব্যবহার করে প্রচুর), এর কারন সম্ভবত একসময় এসব এলাকায় বাণিজ্যিক কারণে প্রচুর ফিরিঙ্গি বা ভিনদেশী বসবাস করতো, যার সংমিশ্রনে এসেছে ভিন্নতা। এমনকি উর্দু, ফারসী, আরাকানি, চাকমা ইত্যাদি ডায়ালগেরও মিশ্রন দেখা যায়; যার ফলে চাটগাইঁয়াদের পাহাড়ী বা বার্মিজ ভাষা বুঝতে তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হয়না। আমার মনে হয় এই বৈচিত্রের অন্যতম কারণ 'চট্রগ্রাম বন্দর', আর বার্মা বা ততকালীন আরাকান যেহেতু চাটঁগার মানুষের বানিজ্যিক যোগাযোগের মূল কেন্দ্র ছিলো তাই আরাকানী মিশেলও প্রচুর। এই ভাষা বৈচিত্র সত্যিই অতুলনীয়, তাই হিমু সাহেবের পরামর্শনু্যায়ী ব্যকরন রচনা সম্ভব না হলেও, একটি 'শব্দ ভান্ডার' রচনা করলে খারাপ হতো না। এতে আমারও সুবিধে হতো এখনো ঠিকভাবে বুঝতে না পারা স্লেংগুলো বুঝতে; বিশেষকরে 'ফোয়ার গেজা দিয়ুম', 'আট্টই দিলি বুঝিবি' জাতীয় স্লেংগুলো বুঝতে! এইতো গেলো বৈচিত্রের কথা, এবার একটু আসা যাক এই ডায়ালগ থেকে যে ভয়ের কারণ তৈরী হয় তা নিয়ে।
দুই ধরনের ভয়ের মাঝে বড় হয়েছি আমার প্রিয় শহরটির কোলে। এক. আমার চাটগাইঁয়া বন্ধুদের অতি আঞ্চলিক মানষিকতা থেকে তৈরী ক্ষোভ, দুই. আমার নন-চাটগাইঁয়া বন্ধুদের নাক উচু মনোভাব। দুটোই ছিলো সমান ভীতিকর অভিজ্ঞতা আমার জন্য। আর এই বিভেদের জন্ম ভাষাকে কেন্দ্র করে। এর প্রভাব যেমন দেখেছি বন্ধুদের উপর, তেমনি দেখেছি আমার শিক্ষকদের মাঝেও। এমনকি ফাইনালি যখন ঢাকাই সেটল হলাম তখনও এর শিকার হয়েছি। একটু উদাহরণ দেয়া যাক, আমার চাটগাইঁয়া বন্ধুদের কাছে নন চাটগাইঁয়ারা ছিলো 'ভইঙ্গা' (কারণ তারা চাটগাইঁয়া বোঝে না বা বোঝার চেষ্টা করেনা, এরকম ধারনা শিক্ষিত- অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণীতেই কম বেশী লক্ষনীয়), আর নন চাটগাইঁয়া বন্ধুদের কাছে চাটগাইঁয়ারা হলো 'ক্ষেত' (কারণ তাদের প্রমিত বাংলায় কথা বললে লোকাল টান আসে)। নন চাটগাইঁয়াদের এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়। চট্টগ্রামের লোকজন জন্মগতভাবেই একটু মনে হয় ঘাড়তেড়া, ভুল হোক আর ঠিক যা বোঝে তাই সই! কিন্তু ভয়ের ব্যাপারটা হলো, নন-চট্টগ্রামবাসীর চট্টলাবাসীর ভাষাকে এই না বুঝতে চাওয়া বা উপেক্ষা করা থেকে যা জন্ম দেয় তা হলো জাতিগত বিভেদ (যা সিলেটিদের বেলায়ও একিরকমভাবে কাজ করে)! এই বিভেদ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝেও দেখেছি। এই জিনিষটাই দৃষ্টিকটূ লাগতো, যখন দেখতাম শিক্ষিত-মার্জিতজনেরা এই ব্যাপারটাকে ভাষা বৈচিত্র হিসেবে না দেখে সংকীর্ণ জায়গা থেকে দেখেন; কিন্তু লক্ষনীয়ভাবে আবার ঢাকা, ময়মনসিং, বরিশাল বা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের লোকাল ডায়ালগকে দেখা হয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে; এর সুন্দর প্রয়োগ দেখেছি ঢাকায় সেটল ডাওন করতে গিয়ে! অনেককেই দেখেছি দ্রুত ঢাকার লোকাল ডায়ালগটা রপ্ত করে নিজের কোমর শক্ত করতে। আমার করা হয়নি, প্রমিত বাংলাই হয়েছে আমার আশ্রয়স্থল। যাইহোক আর যেসব চট্টলবাসী পারেননি নিজেদের মূল স্রোতের সাথে মেশাতে তারা ভোগেন একধরনের কমপ্লেক্সে। নিজেরা চিটাইঙ্গা বলে হুদাই গর্ব করেন, আর অন্যদের গাল দেন 'ভইঙ্গা' বলে। তাই আমার মনে হয় লোকাল ডায়ালগুলো থাকুক ব্যক্তির ব্যবহারে, এমনকি লেখকের লেখনিতেও। কিন্ত যদি কখনো এমন দাবী উঠে 'বাংলা ভাষারই দরকার নাই, আজ থেকে সব কিছুই করা হোক আঞ্চলিক ভাষায়' তাহলে খবর আছে; ঐ জায়গাতেই আমার ভয়! যেমন একিরকম ভয় পেয়েছিলাম লন্ডন এসে, যখন আমার সিলেটি বড় ভাই-চাচা-চাচী বা বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছেন, 'তুমরাতো ঢাখাইয়া মাত মাতো, আমরা মাতি বাংলায় '।
যাইহোক, ধন্যবাদ হিমুকে পোষ্টের জন্য। আশাকরি আমাদের সকলের ভাষা থাকুক ভাষা বৈচিত্র নিয়ে, কিন্তু কখনোই গাছের শাখা যেন মূল গাছকে হত্যা না করে বা মূল গাছ যেন শাখা বলে তাচ্ছিল্য না করে নিজ অংগকে।
আরে ভাই এইটা আপনাকে বলি নাই, এই চিত্রটা আমি দেখেছি ৯০- ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বা চট্টগ্রামে; তবে অবশ্যই সবার ক্ষেত্রে এটা খাটেনা।
ধ্রুব হাসানের মন্তব্যের শেষের অংশটা খুব গুরুত্বপুর্ন ।
প্রমিত বাংলা বনাম কথ্য বাংলার বিতর্কে এই যুক্তিটা আমি তুলে ধরেছি বিভিন্ন সময় । প্রমিত বাংলা আরোপিত এই অভিযোগ তুলে সাহিত্য/মিডিয়াতে কথ্য ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে । অনেকে এটাকে বড় রকমের বিপ্লব বলে ও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন । এতোদিনে সাহিত্য/মিডিয়াকে মানুষের কাছাকাছি আনা গেলো ।
কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায়, আঞ্চলিক ভাষা যে কারো জন্য কথ্য,কারো জন্য অকথ্য! বাংলাদেশের একশ্রেনীর সাহিত্য/মিডিয়াতে কথ্য ভাষা বলে যে আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটা ঢাকা কিংবা যশোর-চাঁপাই(অলৌকিক হাসানের মন্তব্য দ্রষ্টব্য) এর ভাষা । এই ভাষা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করেনা । যেমন সিলেটি,চাঁটগাইয়া কিংবা নোয়াখালির ভাষা নিজ নিজ অঞ্চলের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করলেও তা সমগ্র দেশের নয় ।
তাহলে যখন সামগ্রিক প্রতিনিধিত্বের বিষয় আসে তখন প্রমিত বাংলার বিকল্প কি? প্রমিত বাংলার যে ইউনিফায়েড গ্রহনযোগ্যতা তা তো অন্য কোনো কথ্য ভাষার নেই । কথ্য ভাষার নামে আপনি ঢাকাইয়া কিংবা যশোর-চাঁপাইর ভাষা সাহিত্য ও মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে,সিলেটী ভাষাভাষি হিসেবে আমি তখন আক্রান্ত বোধ করবো । ঐ সাহিত্য তখন আমার প্রতিনিধিত্ব করেনা আর ।
ধ্রুব হাসান একটি বাস্তব উদাহরন দিয়েছেন । আমি সিলেটের মানুষ,সিলেটের মানুষ বলেই আমি বাংলাদেশের মানুষ । সিলেটী আমার মাতৃভাষা ,বাংলা ও আমার ভাষা । আমি আমার ঘরে,আমার সিলেটী বন্ধুদের সাথে সিলেটি কথা বলে যতোই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না কেনো-অন্যদের সাথে মতবিনিময়ের সময় প্রমিত বাংলা ব্যাবহার করাটাই শোভন ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
......ধন্যবাদ এবং সহমত।
ভাষাবিদদের মতে ' চাঁটগাঁইয়া ' একটি ভিন্ন ভাষা, এমনকি এটি বাংলা ভাষার কোন ডায়ালেক্টও নয়।
http://en.wikipedia.org/wiki/Chittagonian_language
চট্টগ্রামের ভাষা শুধুমাত্র উচ্চারণের দিক থেকেই মূল বাংলা থেকে আলাদা এমন নয়, চট্টগ্রামের ভাষায় বাংলা শব্দের প্রতিশব্দই আছে প্রায় আশি ভাগ। ভার্সিটিতে আমরা প্রায়ই মজা করে আমাদের অচাটগাঁইয়া বন্ধুদের চাঁটগাঁইয়া বাক্য বলে তার মানে কী বলতে বলতাম। যেমন, '' হিতি এরার আর উতি ভেঁডার দেইয়েরে ঠার গরি চাইলাম, দেইলাম আতিক্যা উজ্ঞা বুইজ্জা কুইজ্জারতুন গইজ্জাই গইজ্জাই দইজ্জাত পইজ্জে '' ( সে হাসছে আর ও কাঁদছে দেখে ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম, দেখলাম একটা বুড়ো লোক খড়ের গাদা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নদীতে পড়ল।) চট্টগ্রামের ভাষার গানের বিশাল ভাণ্ডার। আব্দুল গফুর হালী, শেফালি ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শিমুল শীল চট্টগ্রামের ভাষায় গান লিখে এবং করে খ্যাতি পেয়েছেন। চট্টগ্রামের ভাষায় রয়েছে সমৃদ্ধশালী '' প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা ''। আমার মা যখন খেপে যেতেন তখন এরকম কত যে প্রবাদ বলে যেতেন। যতদূর জানি এসব প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে একটা বই লেখা হয়েছে। দূর্ভাগ্যক্রমে লেখকের নাম মনে নেই। তবে ' বাতিঘর ' এ বইটা দেখেছিলাম আমি।
তবে শেষ কথা হল, একটা দেশে কয়েকটা ভাষা থাকতেই পারে। বৈচিত্র্যেই তো সৌন্দর্য। চট্টগ্রামবাসীরা বাংলাদেশের বাইরের কেউ নন। বাংলাও আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষার সাহিত্যে, গানে চট্টগ্রামবাসীদের অবদান কম নয়। আমরা বাংলাভাষার চর্চাই করি স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সর্বত্র। তবে দেশের ভেতর কেউ আমার মাতৃভাষাটিকে অবজ্ঞা করলে কষ্টই লাগে। দেশের বাইরে আমি বাংলাকেই সমুন্নত করে ধরব সবার আগে, এটাই জানি এবং বুঝি কারণ আমি বাঙালিও।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
নতুন মন্তব্য করুন