মানুর মা যেমন সেদিন বলছিলেন, "এক দেশে ছিলো একটা রাজা ...।"
মানু চুপ করে শোনে। অনেক গল্পই রাজার গল্প, অনেক গল্পই রাজা দিয়ে শুরু হয়।
মানুর মা বলেন, "রাজার ছিলো দুইটা রাণী। একটা সুয়োরাণী আরেকটা দুয়োরাণী ...।"
মানু চুপ করে থাকে। রাজাদের একটার বেশি রাণী থাকাই দস্তুর। এর আগের গল্পের রাজাটার সাতটা রাণী ছিলো, এই রাজাটার দুইটা। এই রাজাটাকে আরো পাঁচটা বিয়ে করতে হবে।
মানুর মা বলেন, "একদিন রাজার দেশে এলো একটা রাক্ষস, তার হাতে একটা বাঁশি। সেই বাঁশিতে ফুঁ দিলে যে শোনে সে-ই ঘুমিয়ে পড়ে ...।"
অমনি মানু ক্ষেপে ওঠে। "না না না এই গল্পটা আমি শুনবো না আর। এটা আমি আগেও শুনেছি। ঐ রাক্কোসটা সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, তারপর তারপর ঐ যে রাখাল ছেলেটা গিয়ে রাজাকে বলে রাজাবাবু আমি এই রাক্কোসকে জব্দ করবো ... না না না, নতুন গল্প বলতে হবে নতুন গল্প ...।"
মানুর মা হেসে ফেলেন। বলেন, "ওহহো, এটা আগে শুনে ফেলেছে মানুসোনা? আচ্ছা কাঁদে না, কাঁদে না, হাত পা ছোঁড়ে না, বিছানায় ওলটপালট খায় না, বলছি নতুন গল্প, বলছি। এক দেশে ছিলো একটা গোলাপী বাঘ ...।"
সব গল্প মানুর ভালোও লাগে না। তার জেদে মাঝে মাঝে রাজকন্যাকে আবার জাদুর ওষুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে তুলতে হয়, দুষ্টু মন্ত্রীকে কানে ধরে ওঠবোস করাতে হয় একশোবার, টগবগপুরের রাজার ঘোড়াটা দিয়ে দিতে হয় ধুধুনগরের গরীব ঘুড়িওয়ালার ছেলেকে। তারপরেই মানু সন্তুষ্ট হয়ে ঘুমোতে যায়।
মানুর মা একেবারে হাঁপিয়ে ওঠেন এত গল্প বলতে বলতে। মানুর বাবা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের গল্পের বই কিনে আনেন, কিন্তু তাতেও সব পুরনো গল্প। লাইব্রেরি থেকে আনানো বইগুলির গল্প মানুর জন্যে নয়, সেগুলি শুনে তার ভালো লাগে না। মানু ছোট্ট মানুষ, তার জন্যে কেউ গল্প লেখে না।
একদিন মানুর ছোট মামা বেড়াতে এলেন অনেক দূরের দেশ থেকে। মানুর ছোট মামা টিঙটিঙে প্যাঁকাটির মতো দেখতে, কিন্তু মুখে মস্ত গোঁফ, আর অনেক কথা বলেন। মানুর মা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, বললেন, ছোটন, যতদিন এখানে আছিস, মানুকে রোজ রাতে একটা করে গল্প বলবি। আর দিনের বেলা তিনটা করে গল্প লিখে দিবি আমাকে, তুই চলে গেলে ওকে শোনাবো।
মানুর ছোট মামা গম্ভীর মুখে গোঁফে তা দিয়ে বললেন, "তথাস্তু!"
সেদিন রাতে মানু খুব উৎসাহ নিয়ে গল্প শুনতে এলো তার মামার কাছে।
ছোট মামা বললেন, "মানুকুমার, তুমি কি রামকাঙাদের গল্প শুনতে চাও?"
মানু বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনতে চাই চাই!"
ছোট মামা বললেন, "মানুকুমার, তুমি আবার রামকাঙাদের গল্প শুনে ভয় পাবে না তো?"
মানু বললো, "না না না, ভয় পাবো না।"
ছোট মামা বললেন, "ঠিক আছে মানুকুমার! তুমি সাহসী বালক, তোমাকে এই গল্প শোনানো যায়। তবে তুমি আবার তোমার মা-কে এই গল্প বোলো না, তোমার মা খুব ভীতু!"
মানু হাসে, "আচ্ছা বলবো না।"
ছোট মামা বলেন, "তুমি তো জানো মানুকুমার, আমি অনেক দূরের একটা দেশে থাকি। সেই দেশের নাম জামরুলনগর। সেখানে পথের পাশে, মাঠেঘাটেহাটে, নদীর দুই ধারে শুধু জামরুল গাছ! তাই সে দেশের নাম জামরুলনগর।"
মানু অবাক হয়ে শোনে। বলে, "জামরুল ছাড়া ঐ দেশে আর কোন গাছ নেই?"
ছোট মামা বলেন, "জামরুল ছাড়া ঐ দেশে আর কোন গাছ নেই। একটা কামরাঙা গাছ ছিলো, সে বুড়ো হয়ে মারা গেছে কয়েক বছর আগে। আহা, সে বড় ভালো গাছ ছিলো। সবাই তাকে ভালোবাসতো।"
মানুর মনটা খারাপ হয়ে যায় জামরুলনগরের কামরাঙা গাছটার জন্য।
ছোট মামা বলেন, "জামরুলনগরের লোকজন সেই জামরুল খেয়ে বাঁচে। দিন নেই রাত নেই তারা শুধু জামরুল খায়। তাদের পকেটে হাত দিলেই তুমি চার পাঁচটা জামরুল পেয়ে যাবে। তাদের স্কুলব্যাগেও এক ছটাক করে জামরুল থাকে টিফিনের জন্য।"
মানু অবাক হয়ে যায়। বলে, "ওরা আইসক্রীম খায় না?"
ছোটমামা বলেন, "ওরা জামরুলের আইসক্রীম খায়।"
মানু অবাক হয়ে ভাবে লোকগুলির কথা।
ছোটমামা বললেন, "একদিন জামরুলনগরের লোকজন দেখলো, একটা জামরুল গাছের নিচে কী যেন একটা শুয়ে আছে।"
মানু বললো, "কী শুয়ে আছে?"
ছোটমামা বললেন, "সেটা দূর থেকে প্রথমে বোঝা গেলো না। কিন্তু সে এক মস্ত জন্তু! তার মস্তবড় ল্যাজ!"
মানু গুটিসুটি হয়ে শোয়। বলে, "তারপর?"
ছোটমামা বলেন, "তার দুটো ডানাও আছে!"
মানু বলে, "উড়তে পারে?"
ছোটমামা বলেন, "সবাই ভাবলো তা-ই। এত বড়ো জন্তু যদি ওড়ে, তাহলে কী ভীষণ কান্ড!"
মানু বলে, "কেন, ভীষণ কান্ড কেন?"
ছোটমামা বললেন, "উড়তে উড়তে যদি বাথরুম করে?"
মানু ভাবে, তাই তো!
ছোটমামা বলেন, "কেউ সে জন্তুর কাছে যেতে সাহস পাচ্ছিলো না। সবাই ভাবলো, যদি কামড়ে দেয়!"
মানু বললো, "তারপর?"
ছোটমামা বললেন, "জামরুলনগরের রাজা আমাকে এসে বললেন, জনাব, এই পরিস্থিতিতে আপনাকেই একটা কিছু করতে হবে।"
মানু বললো, "রাজা কি তোমার বন্ধু?"
ছোটমামা বললেন, "না, রাজাকে চিনি ছোটবেলা থেকে। খুব ভালো ছেলে। তারপরে কী হলো শোন। ... আমি গিয়ে দেখি, ওটা একটা রামকাঙা!"
মানু বললো, "রামকাঙা কী?"
ছোটমামা বললেন, "রামকাঙা জানো না? রামকাঙা এক অদ্ভুত জন্তু। তার ডানা আছে পাখির মতো, কিন্তু উড়তে পারে না। তার মস্ত লেজ আর ঠ্যাং আছে কাঙারুর মতো, কিন্তু লাফাতে পারে না।"
মানু বললো, "সে তাহলে কিভাবে চলে?"
ছোটমামা বললেন, "সে কেবল ডিগবাজি খায়।"
মানু বললো, "সে ওখানে কী করছিলো?"
ছোটমামা বললেন, "আমিও তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, রামকাঙা! তুমি এখানে কী করো? সে বলে, আমি কামরাঙা খাবো।"
মানু বললো, "কিন্তু জামরুলনগরে তো কামরাঙা নাই, কামরাঙা গাছ তো মরে গেছে!"
ছোটমামা বললেন, "হ্যাঁ, সেটাই তাকে তখন বললাম।"
মানু বলো, "তারপর?"
ছোটমামা বললেন, "দুঃখে রামকাঙা কেঁদে ফেললো। বললো, আমি তাহলে এখন কী খেয়ে বাঁচবো?"
মানু বললো, "রামকাঙারা জামরুল খায় না?"
ছোটমামা বললেন, "না, জামরুল খেলে রামকাঙাদের পেটে অসুখ করে।"
মানু বললো, "তারপর?"
ছোটমামা বললন, "আমি রামকাঙাকে বললাম, কেঁদো না রামকাঙা। কামরাঙা নেই তো কী হয়েছে, তুমি জলপাই খাও। রামকাঙা তখন খুশি হয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে সদর রাস্তা ধরে পাশের রাজ্য জলপাইনগরে চলে গেলো। সেখানে শুধু জলপাই গাছ।"
মানু বললো, "তারপর?"
ছোটমামা বললেন, "তারপর আর কী! রাজা এসে আমাকে বললেন, জনাব, আপনি আমাদের প্রাণ রক্ষা করেছেন। আপনাকে আমি রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব দিতে চাই!"
মানু বললো, "তারপর?"
ছোটমামা বললেন, "আমি বললাম, রাজা, আমি রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব চাই না, একমাস ছুটি দাও বরং। তারপর ছুটি নিয়ে তোমাদের বাসায় এসেছি।"
মানু বললো, "রামকাঙাটা কেমন আছে?"
ছোটমামা বললেন, "রামকাঙাটা ভালো আছে। সে শুধু ডিগবাজি আর জলপাই খায়।"
মন্তব্য
কিন্তু জলপাইনগরে তো দারুন মশার উপদ্রব? শরীফ আদমিরা হোথায় নজীরবিহীন কষ্টে আছেন...রামকাঙা গেল, তারপর কি হলো, হিমু মামা? জলপাই মশারাজের সাথে কোনো রফা হল কি? না কি মশার দৌরাত্মে জামরুল নগরে ফিরে এল কিছু জলপাই গাছ নিয়ে? জামরুলনগরও জলপাই গাছে ভরে গেল?
ডিগাবাজি খায়।
জলপাই খায়।
হা হা।
মুগ্ধ, হিমু ভাই।
আপনাকে আরো একদিন বলেছিলাম এই কথাটা।
আবার বলি, আপনার অসাধারণ সব লেখার মাঝেও পিচ্চিতোষ গল্পগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয়।
এই গল্পগুলো লেখা কখনো বন্ধ করবেন না।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
খুব জোশ হইছে!
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
- ছুঁচোকাহিনীর লগে মিলাছে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
এই পিচ্চিতোষ গল্পগুলো এত মজা লাগে পড়তে!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
বাহ
স্বয়ম
মজা তো
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন