ঈস্টার দ্বীপ ০১

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: রবি, ৩০/১২/২০০৭ - ১১:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

Bishalpost

ঈস্টার দ্বীপের রহস্যভেদের গল্প বলার আগে ঈস্টারদ্বীপের রহস্যের গল্প বলাই বোধ করি ভালো।

ঈস্টার দ্বীপ প্রশান্ত মহাসাগরে ছোট্ট একটি দ্বীপ, এ কথা আগেই বলেছি। চিলি থেকে প্রায় ২,৩০০ মাইল পশ্চিমে, আর পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জ থেকে ১,৩০০ মাইল পূর্বে অবস্থিত এই দ্বীপটি বর্তমানে চিলির অন্তর্ভুক্ত, স্থানীয়রা একে ডাকে ইজলা দে লা পাস্কুয়া নামে।

ঈস্টারের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু, যা একসময় রীতিমতো রহস্যামোদীদের খোরাক ছিলো, এবং যা থেকে এরিক ফন দানিকেন এবং থর হাইয়ারডালের মতো "গবেষক"রা জন্ম দিয়েছেন বিচিত্র সব তত্ত্বের, হচ্ছে এর সৈকত জুড়ে স্থাপিত বিশালকায় সব পাথরের মূর্তি। মূর্তিগুলির উচ্চতা ৫ মিটার থেকে ১২ মিটার, ওজন ১০ থেকে ২৭০ টন। সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ প্রায় নয়শো মূর্তি সারা দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঈস্টারের আদিবাসীদের কোন ক্রেন ছিলো না, ছিলো না চাকা, যন্ত্র, ধাতব অস্ত্র, ভারবাহী পশু, এক মানুষের পেশীশক্তি ছাড়া অন্য কোন যান্ত্রিক শক্তি তারা কাজে লাগায়নি এই বিশাল মূর্তিগুলি খোদাই, পরিবহন এবং স্থাপনের কাজে।

ওলন্দাজ নাবিক ইয়াকব রগেভেন ১৭২২ সালের ঈস্টার উৎসবের দিনে (৫ এপ্রিল) দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। তিনি যখন দ্বীপে পা দেন, গোটা দ্বীপ জুড়ে রোগাভোগা মানুষ আর সরু কিছু গাছ ছাড়া আর যা তিনি দেখেছিলেন, তা হচ্ছে এই মূর্তিগুলি। ঈস্টারবাসীদের নৌকাগুলির বিশদ বর্ণনা রগেভেন দিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্যমতে সেগুলি ছিলো রীতিমতো পলকা এবং বিপদজনক, বড়জোর দু'জন লোক সেই ফুট দশেক লম্বা নৌকায় বসতে পারে, পাতলা কিছু লতা দিয়ে সে নৌকার তক্তা একটা আরেকটার সাথে জোড়া লাগানো। যে দ্বীপের লোকজন ভালো একটা নৌকা পর্যন্ত বানাতে পারে না, তারা কী করে এমন বিশাল সব মূর্তি দাঁড়া করালো, তা রগেভেন বুঝতে পারেননি। তিনি আন্দাজ করেছিলেন, এসব মূর্তি দাঁড় করাতে গেলে মজবুত কাঠ আর মোটা দড়ি লাগবে, যার কোনটাই ঈস্টার দ্বীপে সে সময় ছিলো না। শুধু তা-ই না, যে দ্বীপে লোকজনের ভালো নৌকা নেই, সে দ্বীপে বসতি কিভাবে গড়ে উঠলো? কী করে, কখন, কোত্থেকে, কারা এসে ঈস্টারে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলো?

তারচেয়ে আরো সূক্ষ্ম চিন্তার উদয় হয় ঈস্টারের ভূপ্রাকৃতিক চারিত্র্য বিশ্লেষণ করলে। এর প্রাকৃতিক সম্পদ ছড়িয়েছিটিয়ে আছে গোটা দ্বীপ জুড়ে: খোদাইপাথরের খনি (কোয়্যারি) আছে পূর্ব প্রান্তে, যন্ত্র তৈরির পাথর দক্ষিণপশ্চিমে, মাছ ধরার জন্য সেরা সৈকত উত্তরপশ্চিমে, সেরা আবাদি জমি দক্ষিণে। এই সমস্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন বেশ জটিল কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সেটা কী করে গড়ে উঠলো এই ন্যাড়া ন্যাংটো দ্বীপে? এইসব মূর্তি খোদাই, বহন, স্থাপনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিভিন্ন কাজে পারদর্শী বিপুল মানবসম্পদ, তারা এই রুক্ষ দ্বীপে কী খেয়ে বেঁচেছিলো, যদি এক মুরগি আর পোকামাকড় ছাড়া আর কোন জীবজন্তু দেখে না থাকেন রগেভেন? যদি জটিল কোন সামাজিক ব্যবস্থা এখানে গড়েই উঠে থাকে, তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিলো?

রুক্ষ, ন্যাড়া, অনুর্বর ঈস্টার দ্বীপে ঘিরে এই "রহস্যের" মনমতো উত্তর যোগানোর জন্য পরবর্তী সময়ের ইয়োরোপিয়রা বিভিন্ন চমকপ্রদ তত্ত্ব হাজির করেছেন। "অসভ্য" পলিনেশিয়রা এমন চমৎতার মূর্তি খোদাই বা স্থাপন করতে পারে, এ কথা মেনে নিতে নারাজ ছিলো অনেকেই। নরওয়ের পরিব্রাজক থর হেয়ারডাল, যিনি স্বীকার করতে চাননি যে পলিনেশিয়রা এশিয়া থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ঈস্টারে বসতি স্থাপন করতে পারে, এক তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন যে দক্ষিণামেরিকার আদিবাসীরাই পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ঈস্টারে বসতি গড়ে তুলেছিলো, আর এ কাজ যেহেতু তারা করতে পেরেছিলো, নিশ্চয়ই অতীতের কোন সমৃদ্ধ জাতি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দক্ষিণামেরিকায় সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিলো! থর হেয়ারডালের বিখ্যাত কন-টিকি অভিযান, নল-খাগড়ার ভেলায় চড়ে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ির চেষ্টা এ তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ঈস্টারের একটি সাধারণ "মোয়াই", মাঝপথে ফেলে রাখাঈস্টারের একটি সাধারণ "মোয়াই", মাঝপথে ফেলে রাখা সুইস শৌখিন প্রত্নতাত্ত্বিক এবং পার্থিব সভ্যতার অপার্থিব উৎস তত্ত্বের প্রবক্তা এরিক ফন দানিকেন সরাসরি দাবি করেছিলেন, ঈস্টারের মূর্তিগুলি ভিনগ্রহের কোন উন্নততর বুদ্ধির জীবের তৈরি, যারা এককালে ঈস্টারে আটকা পড়েছিলো, সময় কাটানোর জন্য এসব মূর্তি গড়েছিলো তাদের উন্নততর যন্ত্রপাতি দিয়ে, তারপর উদ্ধার পেয়ে দ্বীপ ছেড়ে চম্পট দিয়েছিলো। পেছনে পড়েছিলো তাদের মূর্তিগুলি, আর ঈস্টারের রোগাভোগা লোকজন।

ঈস্টারের রহস্য ভেদ হয়েছে বেশ ভালোমতোই, তার গল্প শুরুর আগে ঈস্টারের ইতিহাস নিয়ে কিছু বলবো।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জগুলি সাধারণত প্রবাল দ্বীপ, অথবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট। ঈস্টার দ্বীপ দ্বিতীয় কিসিমের, ত্রিকোণাকৃতির এই দ্বীপটির তিন কোণায় রয়েছে সাগর থেকে উঠে আসা তিনটি মৃত আগ্নেয়গিরি। উত্তর কোণে তেরেভাকা, দুই লক্ষ বছর আগে যার অগ্ন্যুৎপাতে ঈস্টারের ৯৫% ভূমি তৈরি হয়েছে, দক্ষিণ কোণে সবচেয়ে প্রাচীন আগ্নেয়গিরি পোইকে, আর দক্ষিণ পশ্চিমে রানো কাউ।

পলিনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় ঈস্টার অনেক সমতল, আয়তনেও ক্ষুদ্র, মোটে ৬৬ বর্গমাইল, অবস্থান ২৭ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশে। আগ্নেয় ভস্ম আর ক্রান্তীয় অবস্থানের কারণে ঈস্টারের মাটি নিঃসন্দেহে এককালে যথেষ্ঠ ঊর্বর ছিলো।

তবে বসতি স্থাপনকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এমন চমৎকার পরিবেশ অতোটা সুবিধার না-ও হতে পারে। ঈস্টারের আদি বসতিদাররা এসেছে উত্তরপশ্চিম দিক থেকে, যারা মূলত বিষুবীয় অঞ্চলের লোক। তাদের, তাদের শস্য ও পশুপাখির চোখে ঈস্টার যথেষ্ঠ ঠান্ডা একটা জায়গা বলেই বিবেচিত হয়েছিলো, সন্দেহ নেই। এর অন্যতম প্রমাণ, অন্যান্য পলিনেশিয় দ্বীপের সাথে ব্যতিক্রমানুসারে ঈস্টারে নারিকেল গাছ ছিলো না, পরবর্তীতে ইয়োরোপিয়দের হানাদারির পরই কেবল ঈস্টারে নারিকেল গাছ রোপণ করা হয়েছিলো, এবং দেখা গেছে, ঈস্টারের আবহাওয়া নারিকেল গাছের জন্য অনুকূল নয়। ঈস্টারের চারপাশের সাগরও প্রবাল প্রাচীর গড়ে ওঠার মতো ঊষ্ণ নয়, যে কারণে পলিনেশিয় দ্বীপগুলির মতো ঈস্টারে প্রবাল, এবং প্রবালপ্রাচীর নির্ভর ঝিনুক বা মাছ নেই। ঈস্টারের চারপাশের সাগরে মোটে ১২৭ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে, যা কি না ফিজিতে হাজারের ওপরে। আরো একটা সূক্ষ্ম সমস্যা, যা চট করে চোখে পড়ে না, সেটা হচ্ছে, ঈস্টার আক্ষরিক অর্থেই "বায়ুগ্রস্ত" দ্বীপ, ওখানে হাওয়ার বেগ যথেষ্ঠ বেশি, যে কারণে ঠিকমতো পেকে ওঠার আগেই ঈস্টারে রুটিফল গাছের ফল ডাল ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে যায়! কোন সন্দেহ নেই, প্রাচীন বসতিদারদের জন্য এই জায়গা কমবেশি ঝামেলারই ছিলো। মোটের ওপর, এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ঈস্টারে খাবারদাবার অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় কম ছিলো।

গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে বলা যেতে পারে ঈস্টারে মিষ্টি পানির সরবরাহ। বছরে গড়ে ১২৫০ মিমি বৃষ্টিপাত হয় ঈস্টারে, খুব একটা কম নয়, কিন্তু পলিনেশিয়ার তুলনায় বেশ কম। যা বৃষ্টি হয়, তা ঈস্টারের আগ্নেয় মাটিতে চুঁইয়ে চলে যায় নিচে। ঈস্টারে ছোট্ট, অনিয়মিত একটা ঝর্ণা আছে কেবল, আর আছে কিছু কুয়ো। মিষ্টি পানির জন্যে যে ঈস্টারের আদিবাসীদের যথেষ্ঠ খাটতে হতো, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

হেয়ারডাল নিজের সংস্কারের ব্যাপারে গোঁ ধরে ছিলেন বলে ঈস্টারের আদিবাসীদের উৎস নিয়ে অনেক প্রমাণ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। প্রথম কথাই হলো, ঈস্টারের মূর্তিগুলির আদল পলিনেশিয়, এবং এমন ধাঁচের মূর্তি আরো দ্বীপে পাওয়া গেছে, কেবল আকারে অনেক ছোট, এ-ই যা। ঈস্টারবাসীদের মাছ ধরার বঁড়শি, পাথরের যন্ত্রপাতি, হারপুন, প্রবালের তৈরি উকো, সবই মেলে পলিনেশিয়দের সাথে। শুধু তা-ই না, ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭৪ সালে যখন ঈস্টারে কয়েকদিন ছিলেন, তখন তাঁর পাকড়াও করা এক তাহিতিবাসী দিব্যি কথা বলেছে ঈস্টারের লোকজনের সাথে। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, ঈস্টারের ভাষা পূর্ব পলিনেশিয় ঘরানার, যাকে বলা হয় আদি মাঙ্গারেভিয়। শুধু তা-ই না, আদি ঈস্টারবাসীদের খুলির গড়ন মেলে পলিনেশিয়দের সাথে, কঙ্কাল থেকে পাওয়া ডিএনএ থেকে পরিষ্কার দেখা গেছে, পলিনেশিয়দের সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ নয়টি বিশেষ বেস-পেয়ারের লুপ্তি আর তিনটি বিশেষ বেস-পেয়ারের প্রতিস্থাপন সেখানে আছে। এই বৈশিষ্ট্য দক্ষিণামেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে নেই, কাজেই হেয়ারডালের হাইপোথিসিস যে রগে রগে ভুল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া ঈস্টারের ফসল, অর্থাৎ কলা, টারো, মিষ্টি আলু, আখ আর কাগুজে মালবেরি, এগুলি সবই পলিনেশিয় মাল। ঈস্টারের একমাত্র গৃহপালিত প্রাণী হচ্ছে মুরগি, যা কি না পলিনেশিয়া তথা এশিয়া থেকে ছড়িয়েছে।

পলিনেশিয় বিস্তারক বলা হয় মানুষের ইতিহাসে নৌযাত্রার সবচেয়ে চমকপ্রদ অধ্যায়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে পূর্বদিকে কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের বসতি বিস্তৃত হয়েছে, পদ্ধতিটিকে সাধারণত প্রজাতিবিস্তারের ভাষায় বলা হয় আইল্যান্ড হপিং, আমি এর বাংলা করতে চাই দ্বীপতিড়িং। দ্বীপতিড়িং ব্যাপারটা সহজে বোঝা যায়, যদি এর পেছনে যথেষ্ঠ সময়কে বিবেচনা করা হয়। ঝড়ে উপড়ে পড়া নারিকেল গাছ, আর সেই গাছে আশ্রয় নেয়া ইঁদুর, পাখি ও পোকামাকড় যে শয়ে শয়ে কিলোমিটার দূরত্ব সাগরে ভাসতে ভাসতে অতিক্রম করে কোন দ্বীপে গিয়ে ঠেকে বংশবিস্তার করতে পারে, এ রীতিমতো পরীক্ষিত সত্য। মানুষও প্রাগৈতিহাসিককালে এমনই ঘটনার শিকার হয়ে মূল ভূখন্ড থেকে কোন দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, ঐতিহাসিকরা এমনই অনুমান করে থাকেন। তবে পলিনেশিয় বিস্তার এমন কোন অঘটনের শিকার হয়ে ঘটেনি, ঝড়ের কবলে পড়ে পথ হারিয়ে সাগরে ভাসতে ভাসতে কোন দ্বীপে গিয়ে ঠেকেনি অতীতের পলিনেশিয়রা, বরং রীতিমতো পরিকল্পিত অভিযান চালিয়ে তারা প্রশান্ত মহাসাগরের প্রতিটি বাসযোগ্য দ্বীপে বসতি স্থাপন করেছে। ১২০০ খ্রিষ্টপূর্ব সাল পর্যন্ত এশিয়া থেকে পূর্বদিকে দ্বীপগুলিতে বিস্তার থিতু ছিলো নিউগিনির পূর্বে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত। এ সময়ে কৃষিজীবী এবং নাবিক একটি জাতি (ধারণা করা হয় নিউগিনির উত্তরপূর্বে বিসমার্ক দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী এঁরা) অতি দ্রুত পূর্ব দিকের প্রায় হাজারখানেক মাইল সমুদ্র অতিক্রম করে ফিজি, সামোয়া ও টোঙ্গায় বসতি স্থাপন করে। এদেরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে পলিনেশিয়দের পূর্বপুরুষ হিসেবে। এদের সনাক্ত করা হয় একটি নির্ভুল নিদর্শন দিয়ে, যাকে বলা হয় লাপিতা মৃৎকর্ম, একটি বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র তৈরির ধরন। পলিনেশিয়দের না ছিলো ধাতব যন্ত্রপাতি, না ছিলো কম্পাস বা চার্ট, কিন্তু নৌযাত্রায় তারা ছিলো অসামান্য কুশলী জাতি। পেছনে ফেলে আসা বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে পলিনেশিয়দের বিস্তারের যাত্রাকে মোটামুটি নিখুঁতভাবে পুনর্চিত্রায়ন করা হয়েছে। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ, অর্থাৎ মোটামুটি আড়াই হাজার বছরে পলিনেশিয়রা হাওয়াই, নিউজিল্যান্ড ও ঈস্টার দ্বীপের মধ্যবর্তী ত্রিকোণাকৃতি মহাসাগরের সব দ্বীপে বসতি গড়ে তোলে।

কেন ঝড়ের খেয়ালে পথ হারানো নিরুদ্দেশ যাত্রা নয়, কেন পরিকল্পিত অভিযাত্রা, তার সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে এর সবই ছিলো পশ্চিম থেকে পূবে, অর্থাৎ স্রোত ও বাতাসের বিপরীতে। শস্য আর গৃহপালিত পশুর উপস্থিতিও প্রমাণ করে, এ অভিযানগুলি ছিলো বসতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে, যেখানে সাথে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বসতিতে টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় মূল্যবান খাবারের যোগান।

স্রোত আর বাতাসের গতি বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়, ঈস্টারের বসতি স্থাপনের জন্যে মাঙ্গারেভা, পিটকেয়ার্ন আর হেন্ডারসন দ্বীপকে মাঝসোপান হিসেবে ব্যবহার করেছিলো আদি পলিনেশিয়রা। ঈস্টারের ভাষার সাথে মাঙ্গারেভার ভাষার মিল, ঈস্টারে ব্যবহৃত পাথুরে যন্ত্রের সাথে মাঙ্গারেভা আর পিটকেয়ার্নে ব্যবহৃত যন্ত্রের মিল, আর ঈস্টারে পাওয়া কঙ্কালের খুলির সাথে হেন্ডারসনে পাওয়া খুলির সাদৃশ্য দেখে এ অনুমান আরো জোরদার হয়। ১৯৯৯ সালে পুনর্নির্মিত পলিনেশিয় ধাঁচের ক্যানো হোকুক'আ ১৭ দিনে মাঙ্গারেভা থেকে ঈস্টারে এসে পৌঁছেছিলো।

প্রশ্ন জাগতে পারে, একটা ক্ষুদে ক্যানোতে চড়ে আন্দাজে পূর্বদিকে বেরিয়ে পড়ে কী করে একদল লোক মাত্র নয় মাইল চওড়া একটা দ্বীপ আবিষ্কার করে ফেললো? এটা কি একটু বেশি আন্দাজ হয়ে যাচ্ছে না? তেরোশো মাইল দূর থেকে রওনা দিয়ে মোটে নয় মাইল চওড়া একটা অজানা দ্বীপ আবিষ্কার?

সম্ভব। স্থলবাসী সামুদ্রিক পাখি এ কাজটি সহজ করে দেয়। ঈস্টারে একসময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক পাখিগুলির আবাস ছিলো (পরবর্তীতে আবিষ্কৃত কঙ্কাল থেকে আবিষ্কৃত তথ্য), যারা খাবারের সন্ধানে নিজের বাসা ছেড়ে একশো মাইল দূরত্ব পর্যন্ত পাড়ি দেয় কখনো কখনো। সেক্ষেত্রে সাগরের বুকে নয় মাইলের ছোট্ট একটা বিন্দু নয়, বরং দুশো মাইল ব্যাসের একটি বেশ ডবকা এলাকা খুঁজে পাবার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়হিসাব করে দেখলাম, মোটামুটি নয় ডিগ্রী এলাকা

ঈস্টার দ্বীপে চলতি গল্প, যার অনেকগুলিই নিবন্ধিত হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, অনুসারে হোতু মাতু'আ (বড় বাবা) নামে এক সর্দার দু'টি ক্যানোতে চড়ে তাঁর দুই বউ, ছয় ছেলে, আর তাদের বালবাচ্চাসহ ঈস্টারে এসে হাজির হন। এই গল্পের সত্যাসত্য যাচাই করা মুশকিল, কারণ ঘটনার হাজার বছর পর কতটা আসল আর কতটা রং চড়ানো তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আবিষ্কৃত, অধিকৃত এবং বাসযোগ্য হবার পর কি আগের দ্বীপগুলির সাথে ঈস্টারের যোগাযোগ ছিলো কি না। প্রত্নতাত্ত্বিক রজার গ্রীন ঈস্টারে ব্যবহৃত পাথুরে যন্ত্র, আর বসতি স্থাপনের কয়েকশো বছর পর মাঙ্গারেভার কিছু যন্ত্রের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়ে দাবি করছেন, যোগাযোগ ছিলো, যেমনটা ছিলো পলিনেশিয়ার বেশির ভাগ "মূলদ্বীপ" ও "বসতিদ্বীপের" মধ্যে। কিন্তু ঈস্টারে কুকুর, শূকর এবং কিছু পলিনেশিয়ায় চলতি কিছু শস্যের অনুপস্থিতি নির্দেশ করে উল্টোটাই। পরবর্তীতে যদি যোগাযোগই থাকবে, তাহলে পলিনেশিয়দের সংস্কৃতিতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এ শস্য ও প্রাণীগুলি ঈস্টারে থাকার কথা, বরং পরের যাত্রাদেই এদের চলে আসার কথা, যদি হোতু মাতু'আ ইতিমধ্যে এদের নিয়ে না আসেন। আরেকটি জোরালো যুক্তি হচ্ছে, প্রতিটি দ্বীপের পাথরেরই একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংযুক্তি আছে, সেটি সেই দ্বীপের পরিচয় বহন করে। মার্কেসাস, পিটকেয়ার্ন, মাঙ্গারেভা, হেন্ডারসন আর সোসাইটিজ দ্বীপপুঞ্জে এরকম অহরহ এক দ্বীপের জিনিস অন্য দ্বীপে পাওয়া গেছে, কিন্তু ঈস্টারের পাথর অন্য কোথাও, কিংবা অন্য কোন জায়গার পাথুরে যন্ত্র ঈস্টারে পাওয়া যায়নি। এ থেকে অনুমান করা ভুল হবে না, যে হোতু মাতু'আ-র পদার্পণের পর প্রায় হাজার খানেক বছর ঈস্টার দ্বীপ সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো, ইয়াকব রগেভেন তার কূলে জাহাজ ভেড়ানোর আগ পর্যন্ত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হোতু মাতু'আ বা তিনি যিনিই হোন, ঈস্টারে এসেছিলেন কবে?

এ ব্যাপারে বেশ বড় ধরনের বিতর্ক আছে। প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থে ৩০০-৪০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়ের মধ্যে ঈস্টার দ্বীপে বসতি স্থাপন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, যার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়,

  • গ্লটোক্রোনোলজি, বা ভাষার বৈভিন্ন্যের সূত্র ধরে ব্যবহৃত কালনির্ণয় পদ্ধতি,

  • আহু তে পেউ (স্থাপিত মূর্তির মঞ্চগুলিকে আহু বলা হয়, সারা দ্বীপ জুড়ে বিভিন্ন আহু ছড়িয়ে আছে, প্রতিটি আহু ও মূর্তির আলাদা নামও আছে), পোইকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ আর এককালের হ্রদের থিতিয়ে পড়া পলিতে পাওয়া তিনটি চারকোলের নমুনার রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে কালনির্ণয়, যাকে মানুষের হাতে বন ভস্মীকরণের নমুনা হিসেবে ধরা হচ্ছে।

এ সূত্রগুলিকে ক্রমাগত প্রশ্নের সম্মুখীন করা হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। কারণ,

  • গ্লটোক্রোনোলজি দিয়ে নির্ণীত সময়ের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে ঈস্টারের ভাষার ক্ষেত্রে, কারণ এক্ষেত্রে দোভাষী হিসেবে কাজ করেছে তাহিতি ও মার্কেসাসের অধিবাসীরা, যাদের মাধ্যমে সহজেই উপাদানগুলির দূষণ ঘটা সম্ভব।

  • চারকোলগুলি যে পদ্ধতিতে কালনির্ণয় করা হয়েছে, সে পদ্ধতিটি এখন পুরনো এবং কম নির্ভরযোগ্য হিসেবে পরিগণিত, আর এই অঙ্গারের সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যায় না, দাবানলে বা বজ্রপাতেও অনেক সময় অঙ্গার পাওয়া যায়।

পরিবর্তে পুরাপ্রাণীতাত্ত্বিক ডেভিড স্টেডম্যান এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লাউদিও ক্রিস্তিনো ও প্যাট্রিশিয়া ভার্গাস প্রস্তাব করেছেন আনুমানিক ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। তাঁদের অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে ঈস্টারের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান , আনাকেনা সৈকতে পাওয়া কাঠের চারকোল আর মানুষের খাওয়া কাছিমের হাড়। ঈস্টার দ্বীপে ক্যানো ভেড়ানোর মতো খুব বেশি সৈকত নেই, গোটা দ্বীপের চারপাশটাই খুব গভীর, অল্প দুয়েকটা জায়গা বাদে, আনাকেনা তার মধ্যে ক্যানো ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে ভালো সৈকত, ধারণা করা যেতে পারে প্রথম অভিযাত্রীরা এখানেই প্রথম নৌকো ভিড়িয়ে থিতু হয়েছিলো। যে পদ্ধতিতে কালনির্ণয় করা হয়েছে, তা একেবারেই নতুন ও নিখুঁত প্রযুক্তি, যাকে বলা হয় অ্যাক্সিলারেটর ম্যাস স্পেকট্রোমেট্রি বা এএমএস। এই কাল নির্ণয় পদ্ধতিতে এক দফা শুদ্ধিও চালানো হয়েছে, কাছিমের মতো সামুদ্রিক জীবের হাড়ের রেডিওকার্বন ডেটিঙের জন্য মেরিন রিজারভয়ার কারেকশন। কিন্তু এই নিদর্শনগুলিকে শুরুর দিককার বলে ধরে নেয়া হবে কেন? এগুলি কি বসতি স্থাপনের ছয়শো বছর পরের নিদর্শন হতে পারে না?

পারে, কিন্তু কাছিমের হাড়ের সাথে একই বয়সী এমন কিছু সামুদ্রিক পাখির হাড় পাওয়া গেছে, যা খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঈস্টার এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপে, এবং মানুষর পদার্পণই এর একমাত্র কারণ বলে ধরা হয়। এ কারণে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দকেই ঈস্টারের নির্জনতাভঙ্গের সময় বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণ আছে, সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গের আলোকে যদিও। তবে এ নিয়ে এক দফা কপচানোর সুযোগ ছাড়ছি না।


মন্তব্য

সুজন চৌধুরী এর ছবি

জবর
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

বন্যা এর ছবি

ধন্যবাদ হিমু ঈস্টার দ্বীপ নিয়ে লেখার জন্য। খুবই মজার একটা টপিক। বহুদিনের ইচ্ছা থাকলেও এখনও ঈস্টার দ্বীপে যাওয়া হয়ে ওঠেনি, তবে হাওয়াই এর পলিনেশিয়ান কালচারাল সেন্টার এ পলিনেশিয়ানদের বানানো ক্যানুগুলো দেখে হা হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। ৩০ হাজার বছর আগে থেকে নাকি তারা এই মাইগ্রেশন শুরু করেছিল - পলিনেশিয়ানদের পশ্চিম থেকে ক্রমাগতভাবে পূবের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে এই প্রায় ২০-২৫ বছরের যাত্রা এখনও এক বিস্ময় হয়ে আছে। আশা করছি আপনি এ নিয়ে বিস্তারিত লিখবেন। জ্যারড ডায়মন্ড তার কোল্যাপ্স বইতে ঈস্টার দ্বীপ নিয়ে একটা চমৎকার চ্যাপ্টার লিখেছিলেন।

হিমু এর ছবি

এর আদি পর্বটা বোধহয় পড়েননি, ডায়মন্ডের ঐ অধ্যায়ের ওপর ভিত্তি করেই এই সিরিজটা লিখছি।

তবে ঈস্টার নিয়ে আমার নগণ্য, আধুলিতুল্য চিন্তা আছে, যেটা সবশেষে লিখবো। একটা কোর্সে ঈস্টারের ওপর একটা গবেষণা-প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হবে, সেটার কিছু অংশ এখানে তুলে দেবো ভাবছি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দিগন্ত এর ছবি

ভাল লেখা, সাথে মূর্তিগুলোর একটা ছবি পেলে ভাল হয়।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

হিমু এর ছবি

কিছু চমৎকার ছবি সংযোজনের তালে আছি।

সচলদের মধ্যে কেউ যদি ইতিমধ্যে ঈস্টারে ঘুরে আসেন, দয়া করে আমাকে ছবি দিয়ে সাহায্য করুন। কপিরাইটেড ছবি তুলে দিতে চাই না।


হাঁটুপানির জলদস্যু

বন্যা এর ছবি

হিমু, লেন গাও নামে আমার এক বন্ধু শখের ফটোগ্রাফার ( পেশায় আইটিতে কাজ করলেও একেবারে পেশাদারের মতই ছবি তোলে সে) হিসেবে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায় আর ছবি তোলে, ওর সাথে আগে আমিও ঘুরেছি কয়েক জায়গায়। ওর সাইটে বিভিন্ন দেশের ছবি আছে, কিন্তু এখন খুজতে গিয়ে দেখি ঈস্টার এর ছবিগুলোর সাইটটা কাজ করছে না। আমি ইমেইল করেছি, দেখি কখন ঠিক করে দেয়...
ওর সাইটটা দেখতে পারেন, দারুন অনেক ছবি আছে বিভিন্ন দেশের...
http://www.peace-on-earth.org/

হিমু এর ছবি

লেন গাও আসলেই চমৎকার ছবি তোলেন। চিলির ওখানে দেখলাম মোয়াইয়ের ছবি আছে।

বেচারা এখনও বাংলাদেশে যায়নি দেখলাম।


হাঁটুপানির জলদস্যু

ভানু এর ছবি

ঈস্টার দ্বীপ নিয়ে লেখাটা দেখে চমকে উঠেছিলাম, কারণ ঈস্টার দ্বীপ নিয়ে এই গতকালই নেটে বসে পড়ছিলাম। বেশ হচ্ছে, চালিয়ে যান!

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

পরবর্তী পর্বের অপেক্ষা কি খুব দীর্ঘ হবে?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

এতো বড় লেখা দেখে ডরাইছিলাম, কিন্তু পড়ে ভালো লাগলো। কাহিনী সুন্দর, বর্ণনা তথৈবচ।
চালিয়ে যান।

পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঈস্টার দ্বীপের রহস্য নিয়ে উৎস মানুষের কিছু লেখা পড়েছিলাম। অনেকদিন পর আপনারটি পড়লাম। ভালো লাগলো।

সৌরভ এর ছবি

চলুক


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অবনীল এর ছবি

চমৎকার। পরের পর্বের লিংকটা খুজে বের করতে হবে, এখানে থাকলো ভালো হত। মূর্তিগুলো কিভাবে স্থানান্তরিত হলো সেই রহস্যটার ব্যাখ্যা জানতে ইচ্ছে করছে।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

হিমু এর ছবি

"ঈস্টার দ্বীপ" ট্যাগে টিপ দিলে সবগুলো একসাথে দেখতে পাবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।