কাজেই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে ঈস্টারে মানুষের বসতি শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই বননিধন শুরু হয়, ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তা তুঙ্গে পৌঁছায়, আর ১৪০০ থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে তা পরিশেষিত হয়।
ঈস্টারের বনবিলোপের উদাহরণ সম্ভবত পৃথিবীতে বনবিলোপের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রান্তিক, পুরো বন গায়েব, প্রতিটি প্রজাতির গাছ বিলুপ্ত। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিলো ঈস্টারের মানুষদের ওপর, কাঁচামালের উৎস শেষ, বুনো খাবারের সংস্থান নেই, ফসলের ফলনও কম।
কাঁচামাল শেষ হবার ফলে কাঠের অভাবে থমকে পড়ে মূর্তির পরিবহন ব্যবস্থা, আর সাগরগামী ক্যানো নির্মাণ। ১৮৩৮ সালে এক ফরাসী জাহাজের ক্যাপ্টেন ঈস্টারে নৌকা ভিড়িয়ে পাঁচটি ক্যানোতে চড়ে রসদ যোগাতে আসা কয়েকজন ঈস্টারবাসীর আচরণের বর্ণনায় বলেছিলেন, কিভাবে কাঠ দেখে তারা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ে, বারবার "মিরু" শব্দটি উচ্চারণ করে তারা কাঠ চাইতে থাকে। পরে ক্যাপ্টেন জানতে পারেন, যে কাঠ দিয়ে ক্যানো তৈরি হয় তাকে গোটা পলিনেশিয়াতেই মিরু বলা হয়। ঈস্টারের সর্বোচ্চ পর্বতের নাম "তেরেভাকা", যার অর্থ দাঁড়ায়, "ক্যানো জোটানোর জায়গা"। এককালে এই পর্বতের ঢালেই ছিলো সেইসব বৃক্ষের অরণ্য, যা দিয়ে দ্বীপবাসী এককালে ক্যানো তৈরি করতো। আজও সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাথরের তুরপুণ, বাটালি, ছুরি, আর অন্যান্য কাঠের কাজের যন্ত্রপাতি। কাঠের অভাবে নিশ্চয়ই জ্বালানিতে টান পড়েছিলো, বিশেষ করে ঈস্টারের শীতে বৃষ্টির রাতে, যখন তাপমাত্রা নেমে আসে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। প্রমাণ রয়েছে যে এর পরিবর্তে ঈস্টারবাসীরা বিভিন্ন ঘাস-খড় আর আখের ছোবড়া পোড়াতো। নিঃসন্দেহে এই ডালপালার জন্যে মারাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। ঘরবাড়ির ছাদ ছাওয়ার জন্যে, টুকিটাকি জিনিসপত্র তৈরির জন্যেও নিশ্চয়ই কাঠের অভাব হয়েছিলো। কাঠের অভাবে এককালে মৃতদেহ দাহ করার ঐতিহ্যও মুখ থুবড়ে পড়ে, লোকজন তখন মৃতদেহ মমি করা অথবা সমাধিস্থ করা শুরু করে।
সাগরগামী ক্যানোর অভাবে সামুদ্রিক খাবারের ভরসা ফুরিয়ে যায়। বুনো খাবারের সংস্থানও নেই, কারণ বন বলেই আর কিছু নেই। খাবারের গাদা থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের পর উধাও হয়ে যায় ডলফিনের হাড়গোড়। সেখানে খুঁজে পাওয়া মাছের কাঁটাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসে, যা পাওয়া যায় তা মূলত অগভীর সাগরের মাছ। ডাঙার পাখি পুরোপুরি বিলুপ্ত, সামুদ্রিক পাখিও মূল দ্বীপ ছেড়ে দূরে গিয়ে বাসা বাঁধে।
সেইসাথে কমে ফসলের ফলন। বনবিলোপের ফলে শুরু হয় ভূমিক্ষয়, যার প্রমাণ মিলেছে ফ্লেনলির খুঁজে পাওয়া কাদার স্তরে। পোইকে উপদ্বীপে উৎখননে জানা গেছে, সেখানে পাম গাছের ফাঁকে ফাঁকে চাষাবাদ চলতো, পামের ছায়া মাটিকে রক্ষা করতো রোদ, হাওয়া আর তীব্র বৃষ্টিজনিত ক্ষয় থেকে। পাম গাছ ফুরিয়ে যাবার পর ক্ষয় হয়ে এসব মাটি ঢাল পেরিয়ে গিয়ে ঢেকে দিয়েছে নিচের অনেক ঘরবাড়ি আর আহু কিছুদিন আগেই চট্টগ্রামে এই দৃশ্য দেখেছি আমরা। পোইকে উপদ্বীপ এ কারণেই ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পরিত্যক্ত হয়। পরে আবার সেখানে তৃণভূমি গড়ে ওঠার পর ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেখানে চাষাবাদ শুরু হয়, কিন্তু আবারো পরিত্যক্ত হয় আরেকদফা ভূমিক্ষয়ের পর। মাটি শুষ্কতর হয় গোটা দ্বীপেই, আর মাটির পুষ্টিও ক্ষয় হতে থাকে দ্রুত। চাষীরা আগে কম্পোস্ট তৈরি করতো বনের পাতালতাফলমূল দিয়ে, এসবের অভাবে সারের যোগান দিতেও তারা ব্যর্থ হয়।
এসবের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে ঈস্টারের জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে এক সময় ঈস্টারে দেখা দেয় নরমাংসভোজনমন্তব্য ১। ঈস্টারের বিভিন্ন খাবারের গাদায় পাওয়া গেছে মানুষের ফাটানো হাড়, যেগুলি থেকে মজ্জা বার করে নিয়ে খাওয়া হয়েছে। এমনকি ঈস্টারবাসীদের ভাষাতেও এ সংক্রান্ত প্রমাণ রয়েছে, যাদের অন্যতম জঘন্য গালিটি হচ্ছে, "তোর মায়ের মাংস আমার দাঁতের ফাঁকে আটকে আছে।" দুর্ভিক্ষের প্রমাণ মেলে ঈস্টার জুড়ে ছোট পাথরের এক ধরনের মূর্তির বিস্তার দেখে, যেগুলিকে বলা হয় মোয়াই কাভাকাভা, পাঁজরের হাড় বার করা, বসে যাওয়া গালঅলা মানুষের মূর্তি সেগুলি। ১৭৭৪ সালে এসে ক্যাপ্টেন কুকও ঈস্টারবাসীকে "ক্ষুদে, হ্যাংলা, ভীতু, হতভাগা" বলে বর্ণনা করেছেন। তীরবর্তী নিচু এলাকা, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ বসবাস করতো, সেখানে আবাসস্থলের পরিমাণ কমে আসে ১৪০০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের পরিমাণের ৩০% এ।
ঈস্টারের সর্দার আর পুরোহিতরা তাদের অভিজাত অবস্থা (রীতিমতো নবাবি) ধরে রাখার জন্যে দেবতাদের সাথে বিশেষ যোগাযোগপ্রসূত পবিত্র ক্ষমতার (মানা) বড়াই করতো, জনতাকে প্রতিশ্রুতি দিতো ভালো ফসল ফলনের। নিজেদের এই দাবি টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা বিশাল সব মূর্তিনির্মাণ, আর সে সংক্রান্ত কর্মসংস্থান আর ভোজ দিয়ে লোকজনকে তুষ্ট রাখতো। যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে তাদের এই দাবি টুনকো বলে প্রমাণিত হলো, তখন এক পর্যায়ে ঈস্টারের যোদ্ধাগোষ্ঠী (মাতাতোয়া) ১৬৮০ সালের দিকে এদের হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ঈস্টারের সমাজব্যবস্থা ধ্বসে পড়ে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে। আজও সারা দ্বীপে ছড়িয়ে আছে অবসিডিয়ানের তৈরি বল্লমের ফলাগুলি। এককালে যে জায়গা সংরক্ষিত ছিলো কেষ্টুবিষ্টুদের রাজকুটির হারে পায়েঙ্গার জন্যে, সেখানে পত্তন হলো সাধারণ মানুষের বাড়িঘরের। অনেকে আশ্রয় নিলো পাহাড়ের গুহায়, যার মুখ পাথর দিয়ে সংকীর্ণভাবে তৈরি নিরাপত্তার খাতিরে। এসব গুহায় খুঁজে পাওয়া জিনিসপত্র দেখে বোঝা যায়, সাময়িক আশ্রয় নয়, দীর্ঘসময় বসবাসের জন্যেই এসব গুহা বেছে নেয়া হয়েছে।
সর্দার আর পুরোহিতদের পতনের সাথে সাথে ঈস্টারের ধর্মটিরও পতন হয়। শেষ আহু আর মোয়াইয়ের নির্মাণ হয়েছিরো ১৬২০ সালে (লোকায়ত ইতিহাস), শেষ কয়েকটি মূর্তির মধ্যে একটি ছিলো পারো। উঁচুভূমির ক্ষেতগুলি ১৬০০ থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যে একে একে পরিত্যক্ত হয়। সময়ের সাথে আকারে বাড়তে থাকা মোয়াইগুলি শুধু সর্দারদের মধ্যে প্রতিযোগিতার বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করে না, ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে দেবতাদের প্রতি আরো আকূল আবেদনকেও বোঝায়। ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের পর মোয়াই নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন দ্বীপের বিভিন্ন গোত্র শুরু করে এক ভিন্ন প্রতিযোগিতা, তারা একে একে মোয়াইকে টেনে নামিয়ে ভাংতে থাকেমন্তব্য ২। মোয়াইগুলিকে টেনে নামানোর সময় এক টুকরো পাথরের ওপর সেটাকে ফেলা হতো, যাতে মূর্তিটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়।
ঠিক কতদিন ধরে কী হারে চলেছে এই মূর্তিনিধন, বলা মুশকিল। রগেভেন নেমেছিলেন শুধু একটি মূর্তির সামনে। ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭৪ সালে চারদিন ছিলেন ঈস্টারে, তখন তিনি ভাঙা আর আস্ত, দু'ধরনের মূর্তিই দেখেছেন। দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তির শেষ ইয়োরোপিয়ান সাক্ষ্য ১৮৩৮ সালে। ১৮৬৮ সালে ঈস্টারের একটি মূর্তিও আর দাঁড়ানো ছিলো না। দ্বীপের লোকায়ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, পারো ছিলো শেষ মূর্তি যাকে টেনে নামানো হয় ১৮৪০ সালের দিকে। এক মহিলা তার স্বামীর সম্মানে পারোকে তৈরি করিয়েছিলেন, তার পরিবারের প্রতিপক্ষরা পারোকে টেনে নামিয়ে ধড় বরাবর দু'টুকরো করে ভাঙে।
আহুগুলি থেকেও টেনে আলাদা করা হয় পাথরের স্ল্যাব, তা দিয়ে আহুর পাশেই তৈরি করা হয় ক্ষেতের বেড়া, অথবা কোন সমাধির পরিধি। ফলে যেসব আহু আবার মেরামত করা হয়নি, সেগুলিকে দেখে কিছু পাথরের স্তুপ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। জ্যারেড ডায়মন্ড বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতার,
As Jo Anne Van Tilburg, Claudio Cristino, Sonia Haoa, Barry Rolett, and I drove around Easter, saw ahu after ahu as a rubble pile with its broken statues, reflected on the enormous effort that had been devoted for centuries to constructing the ahu and to carving
and transporting and erecting the moai, and then remembered that it was the islanders themselves who had destroyed their own ancestors' work, we were filled with an overwhelming sense of tragedy.
যেভাবে মিশনারিরা ধর্মান্তর করার পর নষ্ট করেছেন পুরনো ধর্মের নিদর্শনকে, সেভাবেই হয়তো ক্ষমতা হাত বদলের পর ঈস্টারবাসী একে একে ধ্বংস করেছে তাদের পুরনো ধর্মের চিহ্নগুলিকে, যে ধর্ম পালন করতে গিয়ে তাদের পূর্বপুরুষ ঈস্টারের পরিবেশকে ঠেলে দিয়েছে বিপর্যয়ের মুখে।
তবে ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের পর যে ঈস্টারবাসীরা একেবারেই মরে পঁচে গেছে, তা নয়, তারা যতটা পেরেছে, সামলে নেয়ার চেষ্টা করেছে। ঈস্টারে মুরগিপালনের যে আকাশচুম্বি বিস্তার, তা ঘটে এসময়েই। সামরিক মাতাতোয়া গোষ্ঠী প্রবর্তন করে এক নতুন ধর্মের, সৃজনকর্তা দেবতা মাকেমাকে-কে ঘিরে গড়ে ওঠে এই নতুন ধর্ম, যার কেন্দ্র ছিলো রানো কাউ আগ্নেয়গিরিমুখের প্রান্তে ওরোঙ্গো গ্রামে। মূর্তিনির্মাণের বদলে এই নতুন ধর্মের শিল্পিত প্রকাশ ঘটে খোদিতলিপিতে (পেট্রোগ্লিফ)। বিভিন্ন পাথরে, টেনে নামানো মোয়াইয়ের গায়ে তারা খোদাই করেছে নারীর জননাঙ্গ, পক্ষীমানব আর পাখির ছবি। প্রতিবছর ওরোঙ্গো-রীতির অনুসারীরা এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো, ওরোঙ্গো থেকে এক মাইল দূরে ছোট দ্বীপ থেকে গভীর হাঙ্গর-অধ্যুষিত সাগর সাঁতরে পেরিয়ে সামুদ্রিক পাখির ডিম অক্ষত অবস্থায় নিয়ে ফিরতে পারতো যে, সে হতো সে বছরের পক্ষীমানব। ১৮৬৭ সালে এই প্রতিযোগিতার শেষ আয়োজনের সাক্ষী ক্যাথলিক মিশনারিরা।
১৭৭৪ সালে ক্যাপ্টেন কুকের আগমনের পর থেকেই রয়েসয়ে ঈস্টারে পা রাখতে শুরু করে ইয়োরোপীয়রা। হাওয়াই, ফিজিসহ প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপে যা ঘটেছিলো, ঈস্টারেও তা-ই ঘটে, ইয়োরোপের অসুখবিসুখ ছড়াতে শুরু করে দ্বীপে। ১৮৩৬ এ দেখা দেয় গুটিবসন্তের মড়ক। ১৮০৫ সাল থেকে শুরু হয় Blackbirding বা অপহৃত শ্রমিক সংগ্রহ, ১৮৬২-৬৩তে এই অপকর্ম তার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায়, যখন পেরুর দুই ডজন জাহাজে করে ১,৫০০ ঈস্টারবাসীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় (মোট জনসংখ্যার অর্ধেক) পেরুর বিভিন্ন গুয়ানো খনি আর অন্যান্য খনিতে দাস হিসেবে নিলামে বিক্রি করার জন্যে। বেশিরভাগ বন্দীই মৃত্যুবরণ করে, পরে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে বারোজনকে ঈস্টারে ফিরিয়ে দেয় পেরু, যারা আরেকদফা গুটি বসন্ত বয়ে আনে ঈস্টারে। ১৮৬৪তে ক্যাথলিক মিশনারিরা ঈস্টারে আড্ডা গাড়ে। ১৮৭২ সালে ঈস্টার দ্বীপ, স্থানীয় ভাষায় রাপা নুই, এককালের ভূস্বর্গ, মানুষ আর পাখির সুখী আবাসস্থল, পরিণত হয় একশো এগারো জন রুগ্ন ঈস্টারবাসীর বাস করার নিঃস্ব, রিক্ত, ন্যাড়া একটি ভূখন্ডে।
পরবর্তী পর্বে যোগ করবো ঈস্টারকে নিয়ে কিছু বিতর্ক, সমান্তরাল তত্ত্ব, সাম্প্রতিক গবেষণা ও প্রস্তাব, আমার নিজের তুচ্ছাতিতুচ্ছ পর্যবেক্ষণ, আর আমার তৈরি একটি গাণিতিক মডেলের আলোকে সামান্য কপচানো।
-
মন্তব্য ২ "দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান", মনে পড়ে? আমরাও দেখেছি, লেনিন, চসেস্কু, সাদ্দাম হোসেন। আরো দেখবো।
মন্তব্য
পরবর্তী পর্ব নেই কেন!!!!!!!!! ?????????
তৃষ্ণা যে আর ও বেড়ে গেল ? ষষ্ঠ পর্ব কবে পাবো আমরা?
নতুন মন্তব্য করুন