২০০৩ এর জুন মাসে লেখা। আমার ব্লগস্পট ব্লগ রয়েসয়ে এবং সম্ভবত সামহোয়্যার ইনেও প্রকাশিত হয়েছিলো। সচলায়তনে পোস্ট করছি আবারও।
লিটনটা কবিতার দিকে ঝুঁকেছিলো কলেজে উঠেই।
স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠলেই ছেলেমেয়েদের হুট করে অনেক বদভ্যাস গজায়, নানা ফালতু কাজকারবারে জড়িয়ে পড়ে তারা, আবার পরে কালচক্রে সেগুলোকে ছেড়েও দেয়। এরই মাঝে শত টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে সিগারেটটা কিভাবে যেন টিকে যায়, আর প্রেমে পড়াটা প্রায় সবাই ভুলে যায়। আর কবিতা লেখার বাতিক দেখা দেয়া শতকরা আশি ভাগ কিশোরকিশোরীর। তবে লিটনের কবিতা ধরা, আর ছাড়া, দু’টিই ভারি আকস্মিক।
লিটনটা স্কুলে থাকতে ছিলো আস্ত একটা বদমাশ, সিগারেট এমনই কায়দা করে টানতো যে আমাদের দারোয়ানটা পর্যন্ত হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাংলা সিনেমা দেখা ছিলো তার হবি, বেশ কয়েকটা বারে গিয়ে মদও খেয়ে এসেছে বেশ কয়েকবার, তবে সে-ই মদকে খেতো, মদ তাকে খেতে পারেনি কোনদিন; আর মেয়েদের দেখলে, বিশেষ করে নিজের চেয়ে সাত-আট বছরের বড় আপুদের দেখলে, মাথার টেরিটিকে উশকোখুসকো করে উসকে দিয়ে টেরিয়ে তাকিয়ে থাকতো যে ছোকরা, সেই বখা লিটন কলেজের চৌহদ্দির আলোবাতাসে এসে বেমালুম পাল্টে গেলো। কি যেন হলো তার, কি যেন পেয়ে বসলো তাকে, নাকি সে-ই কিছু একটা পেয়ে বসলো, মোটের ওপর, একেবারেই বদলে গেলো লিটন।
হঠাৎ একদিন দেখি তার মুখ ভর্তি দাড়ি।
লিটন আমাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলো শেভের জন্যে। স্কুলের শেষদিকে এসে সবারই একটা গুম্ফপ্রীতি কি শ্মশ্রুপ্রেম জাগে। অনাগত দাঁড়িগোঁফের জন্যে কি আমাদের মন কাঁদেনি? আলবাত কেঁদেছে, কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে একেবারে। কিন্তু হাজার শেভ করেও তাদের হাজির করানো যায়নি। টাকা আর দাড়ি, শিবরাম বলে গেছেন, কামাতে হয়, না কামালে তারা আসেনা। আমরা টাকা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, আম্মার কাছে কিছুক্ষণ ঘ্যানরঘ্যানর করলেই তাদের কিছু পরিমাণে কামানো যেতো, কিন্তু গোঁফ আর দাড়ি, তাদের জন্যে আম্মা কেন, আম্মার চেয়েও উঁচু দরবারে, খোদ আল্লার কাছে ঘ্যানঘ্যান করেও বিশেষ ফল পাইনি আমরা। রবীন্দ্রনাথ, রবিনহুড, শন কোনারি, সবারই দাড়িগোঁফ আছে, শুধু আমাদেরই সেই আমলে ছিলো না। তাই বলে কামানোর ব্যাপারে কামাই দিইনি আমরা। কামিয়ে গেছি সমানে। বৃথা। নাহক পয়সা খরচা করেছি রেজার আর শেভিংফোমের পেছনে, দাড়ি আর গোঁফ আমাদের অনেককেই কাঁচকলা দেখিয়ে চামড়ার গহীন অভ্যন্তরে কোন এক তেপান্তরে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে লুকিয়ে থেকেছে।
ঐ এক লিটন বাদে। গোঁয়ারটা টাকা আর দাড়ি, দেদার কামিয়েছে স্কুলে থাকতেই। কোন এক রংবাজ ভাইয়ের চামুন্ডাগিরি করে ও প্রায়ই টাকাপয়সা কামাতো, নির্বাচন, সে যে মাপেরই হোক না কেন, নির্বাচনের বাতাস গায়ে লাগলেই লিটন মাঝে মাঝে আমাদের কয়েকজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতো, সে বিড়িই হোক কি বিরিয়ানি। আর রোজগারের খানিকটা রোজ সে গালে লাগাতো, মানে শেভ করাতো, একেবারে সেলুনে গিয়ে চেয়ারে চড়ে ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে দাড়ি কামিয়ে আসতো লিটন। আর খোদা তাকে দাড়ি আর গোঁফ দুই-ই ভারি উদার হাতে দিয়েছিলেন। একদিন শেভ না করলে তাকে দেখাতো ফিদেল কাস্ত্রোর মতো। কিন্তু তাজ্জব, দাড়িগোঁফের ব্যাপারে লিটন ছিলো ভারি উদাসীন, এদের আদৌ পছন্দ করতো না সে। নদীর এপার সবসময়ই অন্য পারের দিকে তাকিয়ে উসখুস করে। আমরা যেখানে গোঁফদাড়ির জন্যে হেদিয়ে মরছি, সেখানে সে সেগুলোর জড় উপড়ে ফেলার জন্যে বদ্ধ পরিকর। কেন, আর কিছুই না, মুখে দাড়ি থাকলে নাকি বেজায় চুলকাতে থাকে। আমরা প্রায়ই শুনেছি লিটনকে গজগজ করতে, শেভের পেছনেই নাকি তার সব পয়সা চলে যায়, কিছুই সেভ করতে পারে না সে। যা কামায়, সবটাই কামিয়ে খরচ করতে হয় বেচারাকে। আমরা দাঁত কিড়মিড় করতাম। বিশেষ করে ঐ চুলকানোর কথা শুনলে আমাদের গা চিড়বিড় করতো। আরে, যে গরু দুধ দেয়, সে তো খানিক লাথি ছুঁড়বেই। ওরকম দাড়ি গজালে কি না চুলকে পারে কেউ? চুলকানোর ভয়ে কেউ কি গোঁফদাড়িকে অমন অসম্মান করে? আর আল্লা যাকে দ্যান, তাকে একেবারে চোয়াল ফুঁড়ে দ্যান, আর কেবল দেড়ে চোয়ালেই দাড়ি দ্যান তিনি। আল্লার এই তেলা মাথায় তেল দেয়া আমরা মোটেও পছন্দ করতে পারিনি।
তো, কলেজে একদিন ক্লাস শেষে লিটনের মুখে দাড়ি দেখে আমরা হতবাক। কাস্ত্রোর মতোই গম্ভীর তার চেহারা, মাঝে মাঝে গলার কাছটা চুলকে নিচ্ছে শুধু। আমাদের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। তবে কি লিটনের রোজগার বন্ধ? দাড়ি কামানোর পয়সা নেই তার? নাকি এতদিনে মোচ আর দাড়ির মহিমা বুঝেছে বেক্কলটা? ওরা যে নাপিতখানার মেঝের বদলে ঠোঁটের ছাদে আর চেহারার মেঝে, মানে থুতনিতেই শোভা পায়, সেই দিব্যজ্ঞান লাভ করেছে লিটন এতদিনে?
আমরা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি। কেন, কবে, কীভাবে?
লিটন খুব গোমড়া মুখে শুধু এটুকু জানায় যে, সে এখন থেকে দাড়ি রাখবে, সে যতোই চুলকাতে থাকুক না কেন। চুলকে যেতে সে রাজি, চুলকে যাবে সে। কিন্তু দাড়িরা রয়ে যাবে।
কিন্তু কেন, আমরা জানতে চাই।
লিটন জবাব দেয়, তার ইচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘মোচও রাখবি?’
লিটন বিরক্ত হয়। মোচ ছাড়া দাড়ি, সে তো বারিন্দাবিহীন বাড়ির মতো, জানায় সে সাথে সাথেই। পুরান ঢাকার আদ্যিকালের দালানের মতো অমন দৃষ্টিকটু হতে চায় না সে। আর আব্রাহাম লিংকন তো সে নয়, যে বিনা মোচে দাড়ি শানিয়ে ঘুরে বেড়াবে। আলবাত সে মোচ রাখবে। আর রাখার মতো মোচ যখন তার গজিয়েছে, রাখতে বাধা কী? আর রাখবে না-ই বা কেন? মোচকে মোচন করার কী এমন ঠ্যাকা পড়েছে তার? দাড়িকে দাঁড়াতে দিলে মোচকে কেন মচকে দেয়া হবে?
আমরা লিটনের দাড়ি, এবং মোচ, খুঁটিয়ে দেখে তার সম্ভাব্য আকারআকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলি। ঠিক কেমন নকশায় তারা লিটনের হাড় জিরজিরে চেহারাখানা জুড়ে বসবে, বা দাঁড়াবে, আন্দাজ করার চেষ্টা করি। ফ্রেঞ্চ কাট, প্রিন্স কাট, কুদ্দুস কাট ইত্যাদি ছাঁটের নাম বাতলে দিই লিটনকে। কিন্তু মুখ্যুটা এসব বোঝে না।
আমি খোলাসা করে বলি, ‘তোর মোচ আর দাড়ি কি জোড়া লেগে যাবে, নাকি আলাদা আলাদা থাকবে?’
লিটন একটু ভাবে। মোচ আর দাড়ি জোড়া লেগে গেলে তাদের নিজস্ব সত্ত্বা নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব দেখা দেবে কি না, জানতে চায় সে। আমাদের কাছে কথাটাকে খুব শক্ত মনে হয়, আরো শক্ত লাগে লিটনের মুখ থেকে শুনে। এমন ভাষা তো তার মুখে আগে শুনিনি কখনো। দ্বন্দ্ব বলতে আগে লিটন মারামারিই বুঝতো, অমনই ছিলো তার নিজস্ব সত্ত্বা। এখন তার লব্জ পাল্টে গেছে বিলকুল। আমাদের ভ্যাবলা চোখ দেখে লিটন মাথা নাড়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে, মোচ আর দাড়ির আইডেনটিটি ক্রাইসিস দেখা দেবে কি না, সে পুরনো প্রশ্নটাকে নূতন শব্দে বাঁধিয়ে জানতে চায়। এবারও আমরা আঁধারে থেকে যাই। শিবলি খানিকটা বুঝে ফ্যালে যদিও, সে লিটনকে আশ্বস্ত করে, উঁহু, জোড়া লাগলেও মোচকে মোচ আর দাড়িকে দাড়ি হিসেবে চিনে নিতে আমাদের কোন সমস্যা হবে না। তবে মোচ আর দাড়ির যে সন্ধিপ্রাঙ্গণ, সেই যোজনীটিকে কি মোচের ঝুল হিসেবে গণ্য করা হবে, নাকি দাড়ির শিং, সেটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই, সেটা একান্তই লিটনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। চাইলে সে ওটাকে অন্য কোন নামও দিতে পারে, আপত্তি নেই আমাদের, যদি আকিকা হিসেবে আমাদের খাওয়ানো হয়। জুলফির মতো ওটাকে মোচফি ডাকা যেতে পারে, রেজা গায়ে পড়ে একটা নামও দিয়ে দিতে চায়, আকিকাটাকে এক ধাপ এগিয়ে নেবার লোভে।
লিটন আরো খানিকটা ভেবে জানায়, আপাতত জোড়া লাগুক। কয়েকদিন সেই যুগলবন্দি মোচদাড়িকে বিশেষ পর্যবেক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ফেলে দেখবে সে। যদি যোজনী দুটোর সত্ত্বা নিয়ে বড় কোন ধরনের দ্বন্দ্ব কি দুর্যোগ দেখা দেয়, সে বৃথা কালক্ষেপ না করে সুয়েজ কি পানামা খুঁড়ে একেবারে সাইজ করে দেবে বেটিদের। কেন সে যোজনী দুটোর ওপর স্ত্রীচরিত্র আরোপ করছে, এ প্রশ্নের জবাবে লিটন কাস্ত্রোর চেয়েও গম্ভীর হয়ে বললো, দ্বন্দ্ব কি সংশয় সৃষ্টি একান্তই নারীর ভূমিকা, আর মোচ আর দাড়ির মতো ঘনিষ্ঠ দুই চরিত্রের মাঝে যে দ্বন্দ্বময় কাজকারবার নিয়ে আবির্ভূত হয়, তাকে বেটি না বলাটাই মূর্খামি। আর নারীকে যে নামেই ডাকো না কেন, নামের আড়াল সরিয়ে তাকে ঠিক ঠিক চিনে নিতে কোন সমস্যা নেইকো।
লিটনের মতো পাঁড় বদমাশের মুখে এতো শক্ত বোলচাল শুনে আমরা ঘায়েল হয়ে যাই।
এ কী রাতারাতি পরিবর্তন? দস্যু রতœাকরও এতো চটজলদি বাল্মীকি বনতে পারেননি, নিজাম ডাকাত থেকে নিজাম আউলিয়া হওয়ার পেছনেও যথেষ্ঠ সময় লেগেছে, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানরাও অমন হুট করে দেশপ্রেমিক সাজতে পারেনি, কিন্তু লিটন সেই অসাধ্যকে সাধন করে ছেড়েছে।
পরবর্তী কয়েকদিনে লিটনের মোচ, আর দাড়ির কিছু পরীক্ষামূলক পরিবর্তন ঘটে। দ্বন্দ্বময়ী যোজনীটি কিছুদিন উপ্তাভাবে অবস্থান করে, তারপর একদিন হঠাৎ লুপ্তা হয়ে পড়ে, তারপর আবারও বেশরম আওরাতের মতো গজায়। দাড়িটিও লিটনের চাপা এবং থুতনির বিভিন্ন অঞ্চলে একেকদিন একেক কিসিমে কর্তিত হয়ে শেষ পর্যন্ত আবার সেই কাস্ত্রীয় রূপ ফিরে পায়। আমরা নিজেরাও নানা শাস্ত্রীয় শলাপরামর্শ দিই সেই দাড়ির অস্তিত্বের ব্যাপারে।
‘রাখবি যখন, রাখার মতো করেই রাখ।’ রেজা পরামর্শ দেয়। ‘ঘাসের মতো ছেঁটে রাখ। ঝোপের মতো রাখলে বিচ্ছিরি দেখাবে।’
শিবলি উল্টোদিক থেকে পোঁ ধরে। ‘না না। ওদেরকে তুই নিজের মতো করে বাড়তে দে। আর ভয় কী তোর? তোর দাড়িতে তো আর গোলাপ ফুল ধরবে না যে রোজ রোজ কাঁচি দিয়ে কুচিয়ে দিতে হবে। ওদেরকে তুই প্রাকৃতিক নিয়মে বাড়তে দে।’
আমি খানিকটা মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করি। ‘তা বাড়তে দে, তবে মাঝে মাঝে একটু কাঁচি চালাস। একেবারে বেড়ে গেলে কিন্তু তালেবান কমান্ডারের মতো দেখাবে।’
তবে একটা ব্যাপারে আমরা সবাই একমত হই। ‘নিয়মিত পানি দিস কিন্তু। শ্যাম্পুও করিস। নাহলে কিন্তু ভারি বিশ্রী গন্ধ ছড়াবে। উকুনটুকুনও হতে পারে, মাঝে মাঝে ফিনাইল দিস।’
লিটন শোনে শুধু, কিছু বলে না। তবে তার ভাবসাব দেখে মনে হয়, গোঁফদাড়ি নিয়ে তার কোন সাংঘাতিক গোপন পরিকল্পনা রয়েছে।
মাসখানেক পর লিটনের গোঁফদাড়ির আসল মকসদ আমাদের বোধগম্য হয়। কলেজের “ঢাকঢোল” ম্যাগাজিনে তার একটি আস্ত কবিতা প্রকাশিত হয়।
কবিতাটা পড়ে আমাদের খুব সমস্যা হয়, আর ওটাকে কবিতা হিসেবে মেনে নিতেই আমরা হিমসিম খাই। আমরা ছেলেমানুষ, ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা কিংবা চপল পায় কেবল ধাই কেবল গাই পরীর গান, বড়জোর চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা গোছের কবিতা পাঠ্যপুস্তকে পড়ে অভ্যস্ত। আর লিটন সেখানে তার “কবিতায়” দুঃখকে একটি ফেরেববাজ নারী কাঠঠোকরার সাথে তুলনা দিয়েছে, যে কি না তার হৃদয়ের নরম শাঁসে দিন নেই রাত নেই শুধু ঠোকরায় আর ঠোকরায়, মেঘলা দিনে বিশালবক্ষা কালচেরঙ তরুণী মেঘেরা যখন আকাশে লীলা-লাস্যে ভেসে ভেসে যায়, মাঝে মাঝে বিদ্যুচ্চমকে চোখ মেরে ইশারা করে লিটনকে, তখন নাকি সেই কাঠঠোকরার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়, ঠুকরে নাকি সেই বেটি লিটনকে একেবারে জেরবার করে ছাড়ে, ওদিকে নদীর নরম বাঁকে বালির চড়ায় রোদ পিছলে গিয়ে ঝলকাতে থাকে, যা কি না লিটনকে শুধু কোন এক নারীর জঙ্ঘার কাঞ্চনের কথা মনে করিয়ে দেয়, সেই রোদও নাকি অমন জোরে ঝলকায় না, যতটা ঝলকায় লিটনের হৃদয়ে জলের মতোন নরম কোরকে সেই কাঠঠোকরা হারামজাদির ঠোকরের স্ফূলিঙ্গ ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে আমাদের ম্যাগাজিনের ভারপ্রাপ্ত বাংলা প্রভাষক সেটিকে খুব খাসা এবং পেডিগ্রি কবিতা হিসেবে রায় দিয়েছেন, তিনি লিটনকে আশ্বাস দিয়েছেন, কিছু কবিতাপরায়ণ লিটল ম্যাগাজিনের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন।
আমরা বুঝতে পারি, কবি হবার জন্যেই দাড়ি রেখেছে লিটন। রবীন্দ্রনাথের ছিলো, নির্মলেন্দুর আছে, লিটনেরও থাকবে।
লিটনকে আমরা চেপে ধরি, ‘য়্যাঁ, তুই কবিতা লিখছিস, বলবি না আমাদের? আমরাও নাহয় তোকে হেল্প করতাম। দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। সবার পরামর্শ নিয়ে লিখলে কবিতাটা আরো পোক্ত হতো।’
এতে লিটন ভারি বিরক্ত হয়, কবিতা কোন কালভার্ট কিংবা ঘূর্ণিঝড়আশ্রয়কেন্দ্র নয়, জানায় সে, যে সেটাকে পোক্ত করে গড়তে হবে। অপোক্ত অশক্ত কবিতার ধারই আলাদা। আবলুস কাঠকে পোক্ত হতে হয়, তাই বলে চাঁপা ফুলও পোক্ত হলে কি মানায়? তারপর না কামানো ভুরু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে লিটন জানতে চায়, কখনো শুনেছি কি না আমরা, রবীন্দ্রনাথ কি নজরুল মেহফিল জমিয়ে দশজনের পরামর্শ নিয়ে কবিতা রচেছেন। কিংবা বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সভা ডেকেছেন, নিজেদের কবিতার ওপর লোকজনের পরামর্শ নেয়ার জন্যে। আর, পরামর্শ যদি নিতেই হয়, সে আমাদের মতো কবিত্বের মন্বন্তরে ভোগা রুক্ষশুষ্ক দাড়িকামানো আর দাড়ি-না-গজানো ছেলেপিলেদের পরামর্শ কেন নেবে? সে তার কবিতার ব্যাপারে শামসু ভাই, মহাদেবদা আর নির্মলদার সাথে আলাপ করেছে। তাঁরা যথেষ্ঠ মূল্যবান পরামর্শই দিয়েছেন, যে কারো পরামর্শ নেয়ার দরকার নেই, আপন খেয়ালে ছাইপাঁশ যা মাথায় আসে লিখে যাও। এখন সে সেই পথেই চলছে, কিন্তু তার চলার পথে প্রেরণা যোগায় জীবুদা।
এই শেষোক্ত ব্যক্তিটিকে আমরা প্রথম শোনায় সনাক্ত করতে পারি না, অনেক পরে খেয়াল হয়, নির্ঘাত জীবনানন্দ দাশ। লিটন শুধু কবিতাই লিখছে না, প্রতিষ্ঠিত কবিদের সাথে ভাইবেরাদারি পাতিয়ে একেবারে পারিবারিক করে তুলেছে ব্যাপারটাকে। রবিদা, জীবুদা ছাড়া সে কথাই বলে না। তবে হ্যাঁ, গোঁফদাড়ি ছাড়া ন্যাড়া কবি সে হবে না, কবিই যদি হতে হয় তো উলোঝুলো দেড়েল কবিই সে হবে।
কিন্তু কেন এই সুখের ক্লিনশেভড জীবন ছেড়ে লিটন কবি হতে চায়? লিটনের বিবর্তনের রহস্য নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমরা শুধু নানা প্রশ্নের গোলকধাঁধাঁয় আবর্তিত হতে থাকি, এবং এই ইস্যু নিয়ে ভাবতে ভাবতে আর গজগজ করতে করতে কয়েকজনের দাড়িগোঁফ ঠেলে গজিয়ে ওঠে।
ওদিকে লিটন থামে না, সে কলেজের ম্যাগাজিন আর দেয়ালপত্রিকায় ঠেসে কবিতা লিখতে থাকে, সেগুলোতে নানারকম ইঙ্গিতপূর্ণ ফ্রয়েডীয় হাহাকার আর “অনির্বচনীয়” অথচ “নাতিশীতোষ্ণ” উপমা গিজগিজ করছে। কেউ কেউ লিটনকে খুব উৎসাহ দিতে থাকে, লিটনের কবিতা পড়ে রাতে তাদের ভালো ঘুম হচ্ছে, ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে কোন কিছু পড়ে প্রেরণা লাভ করতে হচ্ছে না, লিটন যাতে চালিয়ে যায়, কুইজ কি সেমেস্টার ফাইন্যাল এলে যাতে ঘাবড়ে গিয়ে তার লেখার ধার হারিয়ে না ফ্যালে। কবিতা রচনাকালীন সময়ে অনেকে তাকে পানতামাক কিনে এন পিঠ চাপড়ে দিয়ে যায় নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে। লিটন অবশ্য এই পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বিকার। সে সমানে ক্যান্টিনের ধূমপাননিষিদ্ধ কোণাটাতে বসে বিড়ি খায় আর জ্বলন্ত তামাকের ফুলকিতে আধপোড়া দাড়িতে হাত বোলায়, আর লিখে যায়। আমাদের কয়েকজন অভিজ্ঞ সহপাঠী সেই সিগারেটের ধোঁয়ায় গাঁজার মৃদু ও মোলায়েম আভাস খুঁজে পায়।
কলেজ জীবন দু’বছরের বেশি কি আর থাকে? আমরা ইন্টারমিডিয়েটপূর্ব আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে এদিকওদিক সুড়সুড় করে ঢুকে পড়ি, আর লিটনটা আমাদের সাথেই ইলেকট্রিক্যাল এনজিনিয়ারিং পড়তে চলে আসে। তার হাবভাব দেখে আমাদের অবশ্য মনে হয়নি সে কলেজ ঝাড়ার পর আদৌ পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু সে বেশ ভালোভাবেই বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় উতরে গেলো। তবে কবিতা সে ছাড়েনি, কিংবা কবিতা তাকে ছাড়েনি। ক্লাস শুরু হওয়ার পর, সার্কিট থিওরি কি ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশনের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে মাঝে মাঝে কাব্যরসের একটা হারামজাদি কাঠঠোকরা মাঝে মাঝে তার মগজের নরম শাঁসে ঠোকরাতে লাগলো। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের রুগ্ন সাহিত্য সাময়িকীটাকে লিটন কবিতা লিখে লিখে সাময়িকভাবে কব্জাই করে ফেললো প্রায়। নিজের নামে, ছদ্মনামে, মাঝে মাঝে আমাদের দু’একজনের নামে জবরদস্ত সব কবিতা লিখে চললো সে। খোঁজ নিলে দেখা যায়, সম্পাদকীয় বাদে বাকিটা ওরই লেখা, নামে বেনামে জমি কেনার মতো করে সে সবটাই জবরদখল করে ফেলেছে। অন্যান্য খুচরো কবি দু’একজন যারা ক্যাম্পাসে ছিলো, তারা এহেন সাহিত্যিক সন্ত্রাসের আক্রমণে কবিতা লেখা ছেড়ে টিউশনি করতে লাগলো সমানে।
শুধু কবিতার কথা বললে ভুল হবে, লিটনের পোশাক, দাড়ি আর মোচের কথাও বলতে হবে সাথে। আগে কলেজে থাকতে লিটন গেঞ্জি আর জিন্স পরতো, দাড়িটা ছিলো চাপদাড়ি। জিন্স সে এখনও পড়ে, তবে জৈষ্ঠ্যের গরমেও গেঞ্জির ওপরে একটা মোটা সুতির পাঞ্জাবী পরে থাকে। বাঙালি কবির যে কেন এই পাঞ্জাবীপ্রীতি, বোঝা মুশকিল। আর তার সেই চাপদাড়ি এখন কলেবরে বর্ধিত হয়ে হাঁপদাড়ি, মানে দেখলেই হাঁপ ধরে আসে। এক বিঘত লম্বা দাড়ি আর ঝুলো গোঁফ নিয়ে লিটন গম্ভীর মুখে লিখে চলে। তাকে এক মাইল দূর থেকে সনাক্ত করা যায় কবি হিসেবে, আর কাছে এলে সে ধারণা আরো পোক্ত হয়। গোঁফদাড়িতে পানি কিংবা শ্যাম্পু লাগানোর মতো কুকীর্তি লিটন করে না, বেড়ালের মতোই নীর-সংসর্গ এড়িয়ে তার দাড়ি শশীকলার মতো বাড়তে থাকে। সেখানে একটা কেমন যেন গন্ধ, মানুষের গায়ে ওরকম গন্ধ হতে পারে সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল, সেই ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন পেট ছেড়ে মুখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।
সহপাঠী কি পাঠিনীরা কবিতার মর্ম অতটা বোঝে না, পুরনো বন্ধুদের অনেকেই কবিতার ঘায়ে কি কবির ঘ্রাণে মূর্ছা গিয়ে মানে মানে কেটে পড়েছে, আমরাই গুটি কয়েক পুরনো কমরেড নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টিকে আছি, কাজেই নূতন কোন সাংঘাতিক কবিতা পয়দা করেই লিটন দৌড়ে চলে আসে আমাদের কাছে, এবং পুরোটা আমাদের শুনিয়ে ছাড়ে। সে এক যন্ত্রণাই বলতে গেলে। কারণ এই কয়েক বছরে তার কবিতা ও দাড়ি ক্লাসিক্যাল জাত ভুলে খানিকটা উত্তরাধুনিকের গলিতে পা রেখেছে। সেগুলো যেমন বিস্বাদ ও বিষাদময়, তেমনি পীড়াদায়ক। আমরা ওর কবিতাগুলো শুনি, আর কলেজ জীবনের সেই বিশালবক্ষা মেঘ কি নারীর জঙ্ঘার মতো নদীর বাঁকে বালির চরকে খুব মিস করি, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। লিটনের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, সে নিজের মনে লিখে যায় আর বকে যায়।
কিছু ঈর্ষাকাতর ছেলেমেয়ে, যারা এ জীবনে কেবল অন্যের কবিতাই মুখস্থ করে এসেছে, নিজে দু’চার পদ রচনার সাহস দেখায়নি, তারা অবশ্যি লিটনের পেছনে লাগে, তাকে “কবিরাজ” উপাধি দিয়ে ক্ষেপাতে চায়, কিন্তু তারা তো আর লিটনকে চেনে না। উল্টে দু’একজন অতি উৎসাহীর নামে লিটন আলগোছে কয়েকটা কবিতা মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয়, এবং সেগুলোতে কাব্য সংক্রান্ত নানা রসের, আদি থেকে অন্ত, এতো সুষম বিন্যাস যে অনেকেই মুখে মুখে সেগুলোকে চর্চা করতে থাকে। ভিকটিমরা অবশ্য অশ্লীল অশ্লীল বলে খানিকটা চেঁচামেচি করেছিলো, কিন্তু তাতে কবিতাগুলোর আবেদন কমেনি।
সেকেন্ড ইয়ারের শেষদিকেই লিটন একগাদা কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। “লৈটনিক” নামে তার প্রথম কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয়, “ব্যাকপ্যাকে ক্যাকটাস” নামে একটা হ্রস্ব ম্যাগাজিনে দীর্ঘ সব কবিতা ছাপাতো লিটন, তারই সম্পাদক বাহাউদ্দিন বাচ্চু ভাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে লিটনের কবিতার বই প্রকাশ করেন। আগে লিটন বলে বেড়াতো, সে এ জীবনে কোন গ্রন্থ প্রকাশ করবে না, ত্রিদিব দস্তিদার আর জৈন মহাবীরের মতো নির্গ্রন্থ হয়ে ঘুরে বেড়াবে, হঠাৎ কেন সে অমনটা করলো আমরা বুঝলাম না, তবে অনেকদিন পর, সেই স্কুলআমলে রংবাজের চামুন্ডাগিরি ছেড়ে দেবার পর এই প্রথম লিটন আমাদের পুরোন ঢাকার বিরিয়ানি খাওয়ালো। আমরা সঙ্গত কারণেই লিটনের এহেন পদক্ষেপকে স্বাগত জানালাম। তবে শিবলি ব্যাপারটার খানিকটা অভ্যন্তরে ঢুকে তদন্ত করে জানালো, এই বাহাউদ্দিন বাচ্চু ভদ্রলোকের একটি বিখাউজ চেহারার মেয়ে আছে, কলকি না ফুলকি এ গোছের কি যেন নাম, সেও খুব কবিতাওয়ালি, এবং তার সাথে লিটনের বেশ কবিতাসংক্রান্ত দহরমমহরম রয়েছে।
বই প্রকাশের পর কিছুদিন ধরে লিটন রোজ আমাদের খবরের কাগজের কাটিং সরবরাহ করতো। একটা ধুমসো রেজিস্টার খাতায় সেসব কাটিং সেঁটে রাখতো সে, আর আমাদের পড়ে শোনাতো। সবই ওর কবিতার সমালোচনা। সেগুলো লিটনের কবিতাগুলোর চেয়েও দুর্বোধ্য। সমালোচনার নামে সেখানে কাদা ছোঁড়াছুঁড়িই করা হয়েছে কেবল, আর মাঝে মাঝে ধান ভানতে শিবের গীতের মতো সমালোচক সাহেবরা নিজের কবিতাকে টেনে এনে সেটার প্রশংসা করেছেন। বেশিরভাগ সমালোচকদের নাম পরশুরামের কচি সংসদের চরিত্রগুলোর মতো, এমন নাম না হলে বোধহয় বাংলা কবিতার সমালোচক হওয়া যায় না। খাজাউদ্দিন লেনিন নামের এক কবিসমালোচক লিখেছেন, লিটন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গণে প্রপার চ্যানেলে আসেনি, সে সিঁদ কেটে ঢুকেছে, তার কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই সিঁদকাঠির কর্কশ কর্ষণচিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন তিনি, সে এক অখদ্দে অনুপ্রবেশকারী, আর সবশেষে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গণ থেকে লিটনকে কানে ধরে বের করে দেয়ার সুপারিশ করেছেন। ওদিকে অধ্যাপককবি রামায়ণ আজাদ এই সমালোচনার সমালোচনা করে লিখেছেন, খাজাউদ্দিন লেনিন একটা বিকৃতমস্তিষ্ক পাঁঠা, গুটি কয়েক অশ্লীল কবিতা ও একটি অপন্যাস ছাড়া কিছুই রচনা করেনি সে, আর যা-ও যৎসামান্য রচনা করেছে, পড়েনি সে মোটেও। ক্লাস সেভেনের ছেলেমেয়েরাও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে খাজা লেনিনের চেয়ে ভালো খোঁজ রাখে। তিনি “খোজা-লেনিন”-এর মতো আকাট নির্বোধ পাগলকে এখনও প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রে মন্তব্য ছাপানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যসম্পাদককে একদফা ভর্ৎসনা করেছেন, আর সবশেষে জানিয়েছেন, লিটনের কবিতাগুলোর কয়েকটি তার ভালো লেগেছে, যা কি না লিটনের জন্যে খুব বড় একটি পাওয়া, কারণ আশি সালের পর নিজের কবিতা ছাড়া আর কারো কবিতাই তাঁর কাছে ভালো লাগেনি। কয়েকটি কবিতা পাঠ করে তিনি অশ্বারোহণের আনন্দ পেয়েছেন, একটি উৎকৃষ্ট মঙ্গোলীয় অশ্ব যখন নিজের খেয়ালে হাঁটতে থাকে, তখন তার আরোহী যেমন আয়েশ ও তৃপ্তি বোধ করে, তারই স্বাদ তিনি চাখতে পেরেছেন লিটনের কবিতায়, কারণ লিটন নিজের কবিতাকে কবিতার মতো করে চলতে দিয়েছে, তার ওপর অযথা বোঝা চাপিয়ে তাকে গাধার মতো শ্লথ করেনি, আবার কবিতার পাছায় চাবুকের চাপড় দিয়ে তাকে খচ্চরের মতো জোরসে ছোটানোর চেষ্টাও করেনি। প্রকৌশল ছাত্রের কাছে এমন সুকৌশল তিনি আশা করেননি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বাংলা কবিতার ওপর তিন চারটা কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি বলে মনে হয়েছে তাঁর কাছে। সবশেষে তিনি আরেকবার লেনিনকে ধুয়ে ছেড়েছেন, নূতন করে প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়ে কিছু সৎ ও সঠিক লেখাপড়া করার পরামর্শ দিয়েছেন, এবং ভবিষ্যতে সংবাদপত্রের সাহিত্যপাতায় এমন কদরুচির সমালোচনা লিখলে তাকে উপর্যুপরি শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছেন।
এ ছাড়াও মৃদুমন্দ আরিফ, দুলকি পারভিন, রামধনু মহলানবিশ আর হেকমুদ্দিন গুলবুতিয়ার লিখেছেন, প্রায় একই রকমের সমালোচনা, তবে বিভিন্ন আলোকে; যেমন মৃদুমন্দ আরিফ লিটনের কবিতায় অযথা যৌনতার নিন্দে করেছেন, স্থানে স্থানে বিভিন্ন বস্তুর ওপর নারীত্ব আরোপ করে সেগুলোর প্রতি শরীরী ভালোবাসা প্রকাশের এই প্রবণতা তাঁর কাছে মোটেও ভালো ঠ্যাকেনি, এতে করে তরুণতর কবিরা নাকি বিভ্রান্ত হতে পারেন। আবার দুলকি পারভিন জায়গামতো লিটনের যৌনতাসম্পর্কিত দ্বিধাবোধের প্রতিবাদ করেছেন, সেগুলোকে খোঁড়া ঘোড়ার সাথে তুলনা দিয়েছেন, তিনি লিটনকে সংস্কারের চৌকাঠ ডিঙিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কথাটি লিখে ফেলে ঘোড়ার কাছ থেকে ক্রাচ কেড়ে নেবার অনুরোধ জানিয়েছেন। রামধনু মহলানবিশের কাছে লিটনের কবিতাগুলোকে বিবর্ণ বলে মনে হয়েছে, যেন কেউ ব্লিচিং পাউডার দিয়ে কেচে লিখেছে কবিতাগুলোকে, শুধু হাহাকারের ধূসর রঙ সেখানে, তিনি জীবনের নানা রঙের দিকে লিটনের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চান। আর ওদিকে হেকমুদ্দিন গুলবুতিয়ার এই নাস্তিক বেদ্বীন কবিকে একশো ঘা দোররা মারার কঠোর আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন আলেম-শায়ের-সমাজের প্রতি, ইশবাল-আবুলআলামওদুদী-গোলামমোস্তফা-ফররুখআহমদ-মিলগোঁজাহিদীর লাজওয়াব শায়েরীগুলো লিটনকে পড়ে দেখবার অনুরোধ জানিয়ে তাকে সত্যের পথে দাওয়াত দিয়েছেন।
তবে লিটন অবিচল। কিছুতেই সে টলে না। তবে গ্রন্থ প্রকাশের পর সমালোচনার তোপের মুখে পড়ে সে তার দাড়িটাকে খানিকটা চাপিয়ে আনলো, সেগুলো প্রায় তার নাভি পর্যন্ত লম্বা হয়ে পড়েছিলো, সেটাকে লিটন একমুঠো দাড়ির জায়েজ চেহারা দিলো। আমরাও খানিকটা নি®কৃতি পেলাম, কারণ লিটনের দাড়িতে এমনই বতু পাঁঠার মতো বিকট গন্ধ, যা কবিদের দাড়িতে মানালেও সমাজে অপাংক্তেয়। কিছু দাড়ির বিলুপ্তিতে গন্ধটারও যদি কিছুটা শক্তিক্ষয় হয়, তবে মন্দ কী?
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে উত্তরোত্তর খারাপ করে করে, থার্ড ইয়ারে শুরুতে একদিন আসামের গৌহাটিতে তরুণকবিমহাসম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে যোগ দিয়ে ফিরে এসে লিটন জানালো, এখানে আর আসামী হয়ে থাকতে চায় না সে, ইলেকট্রিক্যাল এনজিনিয়ার হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার, কবিদের এনজিনিয়ার হওয়া মানায় না, কারণ এনজিনিয়ারগুলি সব চুর। না, চুর সে হবে না, কাজেই শীগগিরই সে বুয়েটে ইস্তফা দিয়ে একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। আমরা যেন তাকে ঠিক সময়ে বিজ্ঞাপন যুগিয়ে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিই।
আমরা কিছু বলি না, বিষণœ চোখে একে অন্যের দিকে তাকাই, বিজ্ঞাপন সংগ্রহের হ্যাপায় পড়তে হবে ভেবে। অবশ্য লিটন সত্যি সত্যি পড়াশোনা ছাড়ে না, একটু ঢিল দেয় মাত্র। ভোরের ক্লাসগুলো ঠিকমতো করে না, স্যাররা তাকে খুঁজতে থাকেন, কই, ঐ দাড়িওয়ালা ছেলেটা কই গ্যালো, আর একজন দাড়িওয়ালা শিক্ষক তো কোর্স থেকে পারলে তাকে নাম কেটে বিদায় করে দ্যান, সবার ধারণা খানিকটা ঈর্ষাকাতর হয়েই স্যারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তগ্রহণ। সেশন্যালে লিটন মাঝে মাঝে আসে, প্রায়ই আসে না, ভাইভার সময় হুড়মুড় করে এসে নামকাওয়াস্তে পরীক্ষা দিয়েই প্রেসে কি পত্রিকা অফিসে ছোটে। তার সম্পাদনাধীন কবিতার পত্রিকা “হঠাৎ কবিতা যদি ঠোকরায়, বেশ তবে, মন্দ কি, ঠোকরাক” বেশ ভালোই চলতে থাকে, কিন্তু লিটনের গ্রেডশীট বি মাইনাসে জর্জরিত হতে থাকে।
থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি এসে লিটন যখন বাংলাদেশ কবি সংসদের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত “কাব্যাধীনতা” পুরস্কারের জন্যে মনোনয়ন পেলো, তখন চারিদিকে বেশ একটা দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। লিটনকে যারা দুচোখে দেখতে পারে না, তারা দুয়ো দুয়ো করতে লাগলো, লিটন নাকি কবি সংসদের হর্তাকর্তাদের তেল মেরে আর ঘুষ দিয়ে এই পুরস্কারের নমিনেশন খরিদ করেছে, নইলে এইসব অখাদ্য কবিতা, যার আবেদন কেবল পাগল আর নিরক্ষরদের কাছেই স্পষ্ট, লিখে কিভাবে সে এমন একটা মাল অর্জন করে? আমরা অবশ্য এ কথাটা মেনে নিতে পারি না, কারণ লিটনের ঘুষ দেয়ার মতো পয়সা নেই, আর তেল দেয়ার মতো বুদ্ধি নেই। কে জানে, হয়তো এবারের পুরস্কার দেয়ার জন্যে খাজাউদ্দিন লেনিনকে মনোনয়ন করা হয়েছিলো, তখন হয়তো অধ্যাপক রামায়ণ আজাদের মতো মুরব্বি গোছের কেউ একজন ভেটো দিয়ে লিটনের ঘাড়েই এই কাব্যাধীনতা পুরস্কারের নমিনেশন চাপিয়ে দিয়েছে। তবে একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে কোন কবিই এ যাবৎকালে এই পুরস্কারের মনোনয়ন হস্তগত করতে পারেননি, বেশ ক’টি পত্রিকায় এ তথ্য প্রকাশিত হয়, ‘ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়’ ভঙ্গিতে। তবে লিটনের অন্তরঙ্গ কিছু সাহিত্যানুরাগী বান্ধবকেও আমরা আবিষ্কার করি, তারা পত্রিকায় পত্রাঘাত করে লিটনকে অভিনন্দন জানায়, তাদের মাঝে দুলকি পারভিনের নাম উল্লেখযোগ্য, তারা জানায় যে বাংলা সাহিত্যে লিটনের আবির্ভাবকে স্বাগত জানানোর জন্যে কাব্যাধীনতা পুরস্কারটি তাকে হস্তান্তর করার চেয়ে চমৎকার কোন উপায় তাদের মাথায় আসছে না। লিটন পুরস্কারটিকে বগলদাবা করে কবিতার দুর্গম পথে তার জিনলাগামছাড়া কলমঘোড়াকে চাবকে চাবকে ছোটাবে, এই তাদের আশা, এই তাদের আশঙ্কা।
এদিকে এতবড় পুরস্কারের নমিনেশন পেয়েও লিটনের কোন ভাবান্তর নেই। সে আগের মতোই মর্জিমাফিক ক্লাসে আসে যায়, মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে তাকে বিড়ির ধোঁয়ার আড়ালে খুঁজে পাওয়া যায়, তবে বেশির ভাগ সময়েই সে হাওয়া। তার দাড়ি এখন আবার বাড়তির দিকে। একদিন অবসরে, কেরুমত্ত অবস্থায় হাজির হয়ে লিটন আমাদের জানালো, সে একাই নমিনেশন পায়নি, আরো দুখানা কবি নমিনেশন পেয়েছে, সুতপা তফাদার আর তির্যক জামশেদ পাহলভি, তাদের কাউকে ডিঙিয়ে এই পুরস্কার বাগানো তারপক্ষে সম্ভব নয়। সুতপা তফাদার নাকি লবিইং করে দফারফা করে ছেড়েছে, আর তার ক্ষেত্রে যৌনতা নাকি শুধু কবিতায় সীমাবদ্ধ নয়, কাজেই পুরস্কার তার পক্ষে হস্তগত করাটাই স্বাভাবিক। আবার তির্যক জামশেদ পাহলভি নাকি তির্যকভাবেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে সুতপা তফাদারকে, কিভাবে এই পুরস্কার তার হাত থেকে সুতপা ছিনিয়ে নেয় তা সে দেখে নেবে, কারণ তার নাকি পলিটিক্যাল ব্যাকআপ খুব ভালো, সমাজতান্ত্রিক মোল্লাবাদ-এর পক্ষে সে তার কবিতায় এককালে অনেক চেঁচামেচি করেছে, আর আরবিফারসিউর্দুপশতু ইত্যাদি জায়েজ ভাষাকে সে নিজের সমাজবাদী কবিতাগুলোয় যথাযথভাবে এস্তেমাল করতে পেরেছে, কাজেই বর্তমান সরকারের আমলে পুরস্কারটা তার হাতে যাওয়াটা স্বাভাবিক, যদি সুতপা তফাদারের পদ্ধতি কাজে না লেগে থাকে। তবে লিটনকে এরা কেউ হিসাবে ধরছে না। খাজাউদ্দিন লেনিন নাকি পত্রিকায় আরেকটা অনলবর্ষী সমালোচনা লিখেছে, লিটনের মতো একটা সিঁদেল কবিকে কাব্যাধীনতা পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করার জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি সেখানে শ্লেষপূর্ণ দুয়োবাদ জানানো হয়েছে, সেইসাথে কাব্যাধীনতা পুরস্কার যে সাংস্কৃতিক অঙ্গণের একটি কলুষিত কলঙ্ক, একটি পুরোপুরি রাজনৈতিক-লবিতান্ত্রিক-সুপারিশজর্জরিত প্রহসনমাত্র, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ হাজির করেছেন তিনি। লেনিন গবেষণা করে দেখিয়েছেন, বিগত যুগের কাব্যাধীনতা পুরস্কারের জন্যে মনোনীত, এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই চুর, বাটপার এবং খাইষ্টা কিসিমের লোক। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, যেমন বছর আটেক আগে তাঁকেও একবার মনোনীত করা হয়েছিলো, কিন্তু আফসোস, তাঁর এই নাজুক হাত কবিতা লেখায় যতোটা দক্ষ, তেলমারায় ততটা নয়, তাই কোন এক অতিশয় পটু বাটপার তৈলমর্দক তাঁকে টপকে সেবার পুরস্কার পকেটে পুরেছিলো, সেইসাথে একজন খাঁটি মালকে পুরস্কৃত করে কাব্যাধীনতা পুরস্কারের সাথে জড়িয়ে থাকা কলঙ্কমোচনের শেষ সুযোগও কর্তৃপক্ষ হাতছাড়া করেছিলো। আর পাশাপাশি তিনি দেশের সচেতন মোল্লাগোষ্ঠীকে অনুরোধ করেছেন লিটনকে মুরতাদ ঘোষণা করার জন্যে। ওদিকে অধ্যাপক রামায়ণ আজাদ তিন মনোনীত প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, কিন্ত এবার তাঁর পক্ষপাত সুতপা তফাদারের প্রতিই বেশি, কারণটা আমরা আঁচ করতে পারি, আর খাজাউদ্দিন লেনিনকে তিনি এবার “বোঁচকামারা” উপাধি দান করে দস্তুরমতো শাসিয়েছেন, এসব প্রলাপ লিখে পত্রিকার মূল্যবান জায়গা নষ্ট করার অপতৎপরতার জন্যে, সেইসাথে খাজা লেনিন কবে কোন কবির কোন কবিতা থেকে দাঁড়িকমাসমেত পংক্তি চুরি করেছে, তার একটা লিস্টি ছাপিয়ে দিয়েছেন।
লিটন দাড়ি হাওয়ায় দুলিয়ে জানালো, এসব নিয়ে সে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না, যদিও দাড়ির জন্যে ইদানীং চাপা খুব ঘামে, তার পত্রিকার কাজ নিয়েই সে ভয়ানক ব্যস্ত, তাছাড়া সামনে টার্ম ফাইন্যাল। এবার পরীক্ষায় তার প্রিপারেশন খারাপ, সে নকল করার ধান্ধায় আছে। খাজাউদ্দিন লেনিনের সমালোচনা পড়েই এই আইডিয়া এসেছে তার মাথায়। কবিতায় না হলেও টার্ম ফাইন্যালে সিঁদ কাটার একটা উদ্যোগ সে নিয়ে দেখতে চায়।
পরীক্ষা যেদিন শুরু হলো, সেদিন আমাদের সবার বিষম খাওয়ার যোগাড়। লিটনের সীটে একটা অপরিচিত ছেলে এসে বসলো, পরনে চাপা গেঞ্জি আর দোনলা প্যান্ট, হিলহিলে শুকনো চেহারা, গাঁজাখোরের মতো ভাঙা চোয়াল, চোখ দুটো লাল। লিটন কি নকল করার সাহস না পেয়ে বেমালুম আরেকটা ছেলেকেই নিজের জায়গায় ফিট করে দিয়ে গেলো? আমরা নূতন ছেলেটাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাই না। এরকম গুলিখোর হিরোইনচিদের পকেটে নাকি প্রায়ই ক্ষুরটুর থাকে, কখন বের করে গলায় পোঁচ বসিয়ে দেয় কে জানে।
কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভারি হুঁশিয়ার। পরীক্ষা শুরুর আগেই একজন এসে ছেলেটাকে খুঁটিয়ে দেখেন, আরেকজন এসে ছোকরার কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চান, ছেলেটাও ভারি বুক ঠুকে একটা লাল রঙের আইডি কার্ড তাঁর হাতে ধরিয়ে দেয়। স্যার সেটা এক নজর দেখে তর্ক করতে থাকেন।
‘এটা তোমার আইডি কার্ড, এই বলতে চাও তুমি?’
ছেলেটা মাথা নাড়ে।
‘এই আইডি কার্ডে যে ছবিটা আছে, সেটা তোমার?’
ছেলেটা আবারো মাথা নাড়ে।
‘তাহলে তোমার মোচ কই, কিংবা তোমার দাড়ি কই?’
ছেলেটা ভাঙা গলায় বলে, ‘স্যার, ফালায় দিছি।’ এবং গলার স্বর শুনে আমরা চিনে ফেলি, এ আমাদেরই লিটন। এ সেই লিটন, যার মোচ আর দাড়ি এখন আর নেই। ক্লাসের মধ্যে একটা হুল্লোড় ওঠে, কিন্তু লিটন ফিরেও তাকায় না। স্যার খুশি মনে তার আইডি ফিরিয়ে দ্যান, লিটন ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকে।
আমাদের মনে কৌতূহল ফেটে পড়ে। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়, আমরা সেই বুকফাটা কৌতূহল চেপে রেখে ঘ্যাঁসঘ্যাঁস করে লিখতে থাকি।
আমাদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই লিটন খাতা জমা দিয়ে গটগটিয়ে বেরিয়ে যায়।
পরীক্ষা শেষ করে আমরা লিটনকে আঁতিপাতি করে খুঁজি, কিন্তু তাকে দেখি না।
পরের পরীক্ষাগুলোও লিটন এমনিভাবে এড়িয়ে এড়িয়ে পার করে। একটু দেরিতে আসে, একটু জলদি বেরিয়ে যায়। আমরা কিছুতেই ওর টিকিটার নাগাল পাই না। ওকে যে মোচ আর দাড়ি ছাড়া অবস্থায় একটু ভালো করে দেখবো, সে উপায়ও নেই, আর ওর নতুন চেহারাটা এমন বিদঘুটে যে রাস্তাঘাটে দেখলে চিনতে পারবো না।
কিন্তু শেষ পরীক্ষার দিন লিটন আমাদের কাছে ধরা পড়ে যায়। যদিও সে প্রথমটায় কাবাডি খেলোয়াড়ের মতো ছুট লাগিয়েছিলো, কিন্তু আমরা ওকে পাকড়ে ফেলে তিনজন মিলে টেনে হিঁচড়ে ক্যান্টিনে নিয়ে যাই। প্রথমটায় ফোঁস ফোঁস করছিলো সে, ‘ছাইড়া দে আমারে’ গোছের কথাবার্তা বলছিলো, কিন্তু ক্যান্টিনে লিটন কয়েক কাপ চা আর আধা প্যাকেট সিগারেট খেয়ে ধাতস্থ হয়, তারপর খবরটা ফাঁস করে। কাব্যাধীনতা পুরস্কার সে পায়নি, সুতপা তফাদার সেটাকে বাগিয়েছে।
আমরা একটু চমকাই, পরীক্ষার ডামাডোলে এসব খবর রাখতে পারিনি কেউ।
‘তুই এই দুঃখে মোচদাড়ি ফেলে দিলি?’ শিবলি গালভর্তি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞেস করে। পরীক্ষার আগে রাত সরস্বতীসাধনার ফল হিসেবে সবার মুখে এখন দাড়িপ্রসাদ, কেবল লিটন বাদে। সেই লিটন, যার মুখে ক্লাস এইট থেকে দাড়ি, যখন আমাদের মুখে দাড়ির কোন চিহ্নও ছিলো না। দাড়ির ব্যাপারে আমাদের গুরু, সেই আদি দাড়িবান, আজ দাড়িকে বিসর্জন দিয়েছে সামান্য একটা পুরস্কার ফসকানোর জন্যে, সামান্যতর একটি নারীর কাছে পরাজিত হওয়ার ক্ষোভে?
লিটন মাথা নাড়ে। না।
‘তাহলে?’ আমরা চমকাই।
লিটন হাতের তেলোয় চোখ মুছে বিড়িতে কষে টান দেয়, তারপর ওর দাড়ির পতনের ইতিবৃত্ত বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে।
পরীক্ষা শুরুর দুদিন আগে দুপুরে লিটনের বাসায় ফোন আসে। বাঙলার কবিরা সাধারণত দুপুরের দিকেই ঘুম থেকে ওঠে, তাই মাহেন্দ্রক্ষণেই করা হয়েছে ফোনটা। লিটন ঘুমভাঙা গলায় ফোন ধরে। ভদ্রতাসূচক হ্যালোৎকার শেষ হবার পর তাকে জানানো হয়, কাব্যাধীনতা পুরস্কারের জন্যে তাকেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। আজ সন্ধ্যেয় শিল্পকলা একাডেমীতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, লিটন যাতে সেখানে একটু সাজসজ্জা করে ঠিক সন্ধ্যে ছ’টায় উপস্থিত থাকে, বিশেষ করে সুগন্ধিটুগন্ধি যাতে ভালো করে মাখে। কবিদের গায়ে একটু আধটু বদগন্ধ থাকেই, কিন্তু মাননীয় পরিবেশমন্ত্রী আজ প্রধান অতিথি, কাজেই শরীরে কোন আপত্তিকর গন্ধ থাকা চলবে না।
লিটন অসময়ে ঘুম ভাঙানোর জন্যে ব্যাটাদের ওপর বিরক্ত হয়, কিন্তু পুরস্কার যখন দিয়েই ফেলেছে, তখন সেটা আনতে না যাওয়াটা অভদ্রতা। কাজেই সে আরো ঘন্টাখানেক বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে গোসল করতে ঢোকে। ঘন্টাখানেক গোসল করে শরীর থেকে গাঁজা, তামাক, কেরু ও ময়লার গন্ধ যখন হালাল সাবান ঘষে প্রায় দূর করে ফেলেছে, তখনই ওর খেয়াল হয় দাড়ির কথা। কি ভেবে দাড়িতে শ্যাম্পু করতে থাকে সে। শ্যাম্পু করতে করতে ওর খেয়াল হয়, ওর দাড়ি প্রায় কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। তখন লিটনের মনে হয়, একটু ছেঁটে যাওয়া উচিত, নইলে পরিবেশমন্ত্রী মাইন্ড করতে পারেন। এই ভেবে সে দাড়িটাকে ছাঁটতে ছাঁটতে আবার চাপদাড়ি বানিয়ে ফেলে।
দাড়ির এই হ্রস্বীকরণের পর, ততক্ষণে ঘন্টাখানেক কেটে গেছে, লিটন আয়নায় তাকিয়ে দেখে, চাপদাড়ির সাথে তার ঝোলা গোঁফ মোটেও মানাচ্ছে না। তখন সে তার জীবনের সেরা ভুলটা করে, মোচে কাঁচি চালায়। সেই ক্লাস টেনে থাকতে শেষ এই কাজ নিজের হাতে করেছিলো লিটন, তারপর কত জল ঘোলা হয়েছে বুড়িগঙ্গার দখল করা জমিতে, লিটন নিজের হাতে মোচে কাঁচি ছোঁয়ায়নি। এতদিনের অনভ্যাসে তার হাত এদিক ওদিক হয়ে যেতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তার ঝোলা গোঁফ পরিণত হয় পাঠান মোচে, সেটার শুঁড়দুটোকে সাইজ করতে গিয়ে তা পরিণত হয় বাঙালি গোঁফে, শুধু তাই না, তা বামে ডানে অসম পরিমাণে রয়ে গিয়ে তার চেহারাটাকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে গিয়ে বান্দরের রুটি ভাগের মতো সেই বাঙালি মোচ পরিণত হয় মারাঠী হাফ-মোচে। তবুও ইমব্যালান্স দূর হচ্ছে না দেখে মরিয়া হয়ে লিটন আবারো কাঁচি চালায়, এবং একসময় নিজের মুখে হিটলারের বাটারফ্লাই অর্জন করে ছাড়ে। তারপর লিটন আবার ভালো করে খুঁটিয়ে দ্যাখে, চাপদাড়ির সাথে বাটারফ্লাই গোঁফে তাকে দেখাচ্ছে স্থানীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিটলার মজনুর মতো। মরিয়া হয়ে লিটন তার মোচকে পুরোপুরি কামিয়ে ফ্যালে, এবং আবিষ্কার করে, যে আব্রাহাম লিংকনকে সে কলেজজীবনে নিগৃহার আঁধারে ছুঁড়ে ফেলেছিলো, সেই আব্রাহাম লিংকনের মতো শুন্যগোঁফদাড়িমাত্র অবস্থা নিয়ে সে বাথরুমে গামছা পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লিংকনের মতো খানদানী চেহারা থাকলেও একটা কথা ছিলো, গাঁজা আর কেরু খেয়ে খেয়ে তার চেহারাটা হয়েছে চিমসে চামচিকার মতো, শুধু দাড়িতে তাকে দেখাচ্ছে সম্প্রতি নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া একজন হাজী সাংসদের মতো। কাজেই বেপরোয়া লিটন সেই আশৈশবলালিত কষ্টার্জিত চাপদাড়িও সাঁ করে কামিয়ে ফ্যালে। অবশেষে দেখা যায়, তার বিরান চোয়ালে এখানে ওখানে কয়েকটা স্টিকিং প্লাস্টার তার এককালের জাঁদরেল গোঁফদাড়ির ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে। শুধু তাই না, তখন বাজে বিকেল পাঁচটা।
যাই হোক, তাড়াহুড়ো করে শেভ করে বেরিয়ে কোনমতে সবচেয়ে পরিষ্কার একটা আধাময়লা পাঞ্জাবীতে ভালো করে ছোট ভাইয়ের পারফিউম ছিটিয়ে, আর কষে বড় ভাইয়ের ডিওডোরেন্ট গায়ে মেখে লিটন যেই না ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, অমনি পড়েছে তার ভাবীর সামনাসামনি। ভাবী “চোও, চোও” বলে চিৎকার করতে করতে ফিট হয়ে যায়, এবং লিটনের দুটো মুশকো ভাই, একটা বড় একটা ছোট, যথাক্রমে ডিওডোরেন্ট ও পারফিউমের মালিক, কোনরকম কথাবার্তার তোয়াক্কা না করে তাকে ইতস্তত মারতে শুরু করে। এক পর্যায়ে লিটন যখন নিজেকে লিটন হিসেবে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তখন বাজে পৌনে ছয়টা, আর কিলঘুঁষি খেয়ে লিটনের নিচের চোয়ালের দুটো দাঁত নড়ে গেছে, বাম চোখে কালসিটে। লিটনের বড় ভাই ছোট ভাইকে মিষ্টি আনতে পাঠাচ্ছিলেন, এতবড় একটা শুভ ঘটনা সেলিব্রেট করার জন্যে, লিটন গোসল করেছে, এবং এই উশকোখুশকো কবিজীবনের ইতি ঘটিয়ে সেজেগুজে বাইরে বেরোচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কীই বা থাকতে পারে? কিন্তু লিটন কোনমতে এরকম গুন্ডাপ্রকৃতির ভাইদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাইরে বেরিয়েছে ট্যাক্সিক্যাব ধরার জন্যে।
ভাগ্যক্রমে লিটন ট্যাক্সিক্যাব পেয়ে যায় মাত্র মিনিট বিশেক খোঁজাখুঁজির পর। ছয়টা বিশে যখন সে শিল্পকলা একাডেমীতে পৌঁছেছে, তখনও প্রধান অতিথি মাননীয় পরিবেশমন্ত্রী আর বিশেষ অতিথি মাননীয় শিল্পপতি আক্কাস আলি মৃধা এসে পৌঁছেননি। আয়োজকরা প্রথম দর্শনে লিটনকে চিনতে পারেননি, লিটন বহুকষ্টে নিজের পরিচয়কে পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, তার জন্যে এমনকি নিজের লেখা একটা বাহান্ন লাইনের কবিতা মুখস্থ বলতে হয়েছে তাকে। সুতপা তফাদার সেখানটায় উপস্থিত ছিলো, সে লিটনকে কোন এক বেঞ্জামিন দিগদর্শী হালদার নামক চাটগাঁইয়া কবি হিসেবে প্রমাণ করার জন্যে একটা বিশ্রী প্রোপাগান্ডা শুরু করেছিলো, কিন্তু সেই কবি আবার আয়োজকদের একজনের বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে যাতায়াত করে বলে লিটন অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। তির্যক জামশেদ পাহলভি অনুষ্ঠানে ছিলো না, তাকে কয়েকদিন আগে যৌথবাহিনী বিনা পারমিটে এক কেস বিয়ার বহন করা এবং একটা বিয়ার অর্ধেকটা খেয়ে কৌটোটাকে যৌথবাহিনীর ভ্যানের ভেতর ছুঁড়ে ফেলার অপরাধে তুলে নিয়ে গিয়ে আচ্ছামতো রগড়ে দিয়েছে। আগামী একমাস সে আদৌ কোথাও নিজের উদ্যোগে চলাফেরা করতে পারবে বলে মনে হয় না। আর এমন বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী কাউকে পুরস্কৃত করে কবি সংসদ যৌথ বাহিনীর কোপানলে পড়তে মোটেও ইচ্ছুক নয়, তির্যক জামশেদ পাহলভির যতোই ব্যাকিং থাকুক না কেন। আর তার ব্যাকিং সম্পর্কেও জালিয়াতির অভিযোগ এনেছেন কবি সংসদের কিছু মাননীয় হোমড়াচোমড়া কর্তাব্যক্তি, কারণ অতোই যদি ব্যাকিং থাকবে, সেনাপুলিশের হাতে এমন কচুয়া ধোলাই খেতে হলো কেন তাকে?
যাই হোক, সোয়া সাতটায় প্রধান ও বিশেষ অতিথিরা এসে পৌঁছানোর পর ভ্যাজাল শুরু হয়। মঞ্চে পর্দা তোলার আগেই লিটন আর সুতপা তফাদারের সাথে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথির পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, কিভাবে তারা তেলতেলে হাসিমুখে করমর্দন করবে এ নিয়ে একটা হালকা রিহার্সাল দেয়া হয়, এবং মাননীয় অতিথিদের জানানো হয় যে লিটনকেই এ বছর কাব্যাধীনতা পুরস্কারের জন্যে নির্বাচন করা হয়েছে। প্রধান অতিথি তখন জানতে চান, লিটন কোন পাট্টি করে। লিটন জানায় যে শব্দটা পাট্টি নয়, পার্টি, আর সে কোন পার্টিই করে না, পার্টি ব্যাপারটা তার আদৌ পছন্দ না। তখন সুতপা তফাদার, যে অত্যন্ত স্বল্পায়তন আর সূক্ষ্ম কবিতা এবং শাড়ি পড়ে অভ্যস্ত, লাফিয়ে উঠে প্রথান অতিথিকে জানায় যে পার্টি তার খুব ভালো লাগে, সে প্রায়ই পার্টিতে যায়, এবং তার আপশোষ হচ্ছে, কেন কোন পার্টিতে সে এখনও মাননীয় প্রধান ও বিশেষ অতিথির দেখা পেয়ে ধন্য হতে পারেনি। অতিথিদ্বয় তখন এই উত্তরে বিশেষ পুলকিত হন, তারা সুতপা তফাদারের সাথে আরো একদফা উষ্ণ করমর্দন করেন, এবং শুধু কর নিয়েই তারা সন্তুষ্ট হন না, পরবর্তীতে করোত্তর কার্যকলাপেও বিশেষ আগ্রহী মনে হয় তাঁদের, সর্বোপরি নিজেদের মধ্যে মিনিটখানেক ফিসফাস করে আয়োজকদের জানান, এই অনুষ্ঠানে তারা থাকবেন, কেবল এবং কেবল যদি মিস সুতপা তফাদারকেই আজকে কাব্যাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়। আর আয়োজকরা যদি লিটনের মতো একটা বেআদব এবং বেদ্বীন, যার কিনা সামান্য দাড়ি পর্যন্ত নাই, তাকেই পুরস্কার দেয়ার ব্যাপারে গোঁ ধরে বসে থাকেন, তাহলে তাঁরা এই দন্ডেই বেরিয়ে যাবেন, হ্যাঁ, প্রধান-বিশেষ-সুতপা এই তিনজনেই বেরিয়ে যাবেন, আর কবি সংসদ তাদের ভবিষ্যত কার্যক্রমকে এখনই খোদা হাফেজ আলহামদুলিল্লা জানাতে পারে, কারণ বেরিয়ে গিয়ে তাঁরা প্রথমেই যে কাজটা করবেন, সেটা হচ্ছে কবি সংসদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এখন যৌথ বাহিনীর যুগ, পান থেকে চুন খসলেই জর্দা মারার আইন হয়েছে, কাজেই কবি সংসদ যাতে নিজেদের ভালোমন্দের কথা খেয়ালে রেখে তাঁদের প্রস্তাব মেনে নেন। লিটন যখন এই হুমকি শুনে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে জানতে চায় দাড়ির সাথে পুরস্কারের কী সম্পর্ক, তখন বিশেষ অতিথি ধমকে ওঠেন, জানান যে দাড়ি রাখা সুন্নত, দাড়ি যার নাই, দ্বীনের সাথেও তার কোন কুটুম্বিতা নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মালাউন কবি পর্যন্ত দাড়ি রেখেছে, আর সেইখানে কোন সাহসে লিটন দাড়ি নিয়ে তর্ক করতে আসে? এরকম একটা নাস্তিক মানুষকে তাঁরা পুরস্কার পেতে দিতে পারেন না। লিটন তখন জানতে চায়, সুতপা তফাদারেরও তো দাড়ি নাই, তাকে কেন পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। তখন প্রধান অতিথি জানান, সুতপা তফাদারের মাশাল্লা অনেক গুণ আছে, দাড়ি নাই তো কী হয়েছে, দাড়ি নাই বলেই তাঁকে দেয়া হয়েছে, তাছাড়া তাঁদের ম্যাডাম নারীদের পুরস্কার দেয়ার ব্যাপারে তাঁদের সবসময় উৎসাহপরামর্শআদেশ দিয়ে থাকেন, কারণ তিনি নিজেও একজন নারী। নারী কবিদের কাব্যাধীনতা পুরস্কার দেয়া হবে, এই ছিলো তাঁদের শহীদ নেতার স্বপ্ন।
তারপর আয়োজকদের সাথে কথা বলে লিটন যখন বুঝতে পারে যে আজ এই দাড়িহীনতার জন্যেই তার প্রাপ্য সম্মান কেড়ে নিয়ে একজন লবিবাজ নির্লজ্জ মহিলাকে পুরস্কার দেয়া হবে, তখন সে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফ্যালে, এবং হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে স্টেজ থেকে নেমে মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁিজ করে শেষ পর্যন্ত সিএনজি স্কুটারে চড়ে বাড়ি ফিরে আসে। এই এক ঘন্টা সে ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্তে আসে, আর পণ করে, আজ থেকে আর দাড়ি সে রাখবে না, কবিতাও লিখবে না। দাড়ি ছাড়া কবি হওয়া সম্ভব, লবি ছাড়া কবি হওয়া ভারি মুশকিল। আজ থেকে দাড়ি, কবিতা, লবিতা সব বাদ।
বাড়ি ফেরার পর থেকে বাকি সময়টা লিটন টার্ম ফাইন্যালের জন্যে ফাটিয়ে পড়াশোনা করেছে।
আমার গুম হয়ে বসে এই কাহিনী শুনি। সেই স্কুল আর কলেজে লিটনের দাড়ি নিয়ে সংগ্রামের দৃশ্য আমাদের চোখে ভাসে। বেচারা। কবিতা আর দাড়ির পেছনে কতো পরিশ্রমই না করেছিলো লিটন। আজ এভাবে তাকে একসাথে সবকিছু খোয়াতে হলো।
আমরা লিটনের পরবর্তী লক্ষ্য নিয়ে ভাবি। কী করবে সে এখন? জানতে চাই আমরা।
লিটন জানায়, সে তার পত্রিকা, “হঠাৎ কবিতা যদি ঠোকরায়, বেশ তবে, মন্দ কি, ঠোকরাক”-এর সম্পাদনার ভার সেদিন খাজাউদ্দিন লেনিনকে উপহার দিয়ে এসেছে। লোকটা ধান্দাবাজ হলেও একেবারে অকৃতজ্ঞ নয়, উপহার পাওয়ার পরদিনই সে সুতপা তফাদারকে নিয়ে একটি ঝাঁঝালো সমালোচনা কলাম লিখে পাঠিয়েছে কাগজে। অবশ্য অধ্যাপক রামায়ণ আজাদ যথারীতি তার প্রতিবাদে আরেকখানা কলাম লিখেছেন, সেখানে একজন কবির কবিতায় যৌনাবেদনের ওপর বেশি জোর দেয়া, আর কবির নিজস্ব যৌনাবেদনকে অবজ্ঞা করা যে কতবড়ো মূর্খামি, তা বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কাব্যাধীনতা পুরস্কার তো শুধু কবিতা দেখেই দেয়া হবে না, কবির নিজস্ব আবেদনও সেই পুরস্কার প্রাপ্তির জন্যে বিচারকদের মানদন্ডে যাচাইকৃত হতে হবে। এরপর বিচারকদের মান, দন্ড ও মানদন্ড সম্পর্কে অধ্যাপক আজাদ একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ লিখেছেন।
আমি জানতে চাই, ‘তাহলে, কী করবি এখন?’
লিটন বিড়িটা শেষ করে এক চুমুকে ঠান্ডা চা গলায় ঢেলে ততোধিক ঠান্ডা গলায় বলে, ‘আগে যা করতাম। সামনে ইলেকশন শুরু হচ্ছে। দেখি পাড়ার বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে। আর, এখন থেকে পাট্টি করবো ঠিক করেছি। এই ছুটির মধ্যেই ব্যবস্থা করে ফেলবো, দোয়া করিস।’
এই বলে গটগট করে বেরিয়ে যায় সে ক্যান্টিন ছেড়ে।
আমরা বুঝলাম, লিটন আবার কামানো শুরু করবে। দাড়ি আর টাকা, এ দুটোর একটা কামানো বন্ধ করলে বাকিটাও আপনাআপনি কামানো বন্ধ হয়ে যায়। আবার যখন কামাচ্ছে লিটন, এবার কামাতেই থাকবে, আর কামাই করবে না।
মন্তব্য
হে হে এইটা পড়ছিলাম লেখার পর পরই। হেভি লাগছে...
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
জোশ!
------ooo0------
বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ...
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
৫-এ ৫!১০০ তে ১০০!!পুরা বিপ্লব।
লিটনের পরবর্তী কাহিনী জানিতে উদগ্রীব।
-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...
এইটা একটা কারবার!!!
হাবিজাবির ভিড়ে এই ফাটাফাটি লেখাটাই খেয়াল করা হয় নাই....
মন্তব্য করলাম...কালকে কি আরো ৩ টা পামু?
দৃশা
পূর্বেই পড়িয়াছিলাম!!তবুও চুলকাতে সমস্যা নাই, তাই না?
__________
কি মাঝি? ডরাইলা?
আগে পড়েছিলাম, কিন্তু তাতেও আবেদন কিছুমাত্র কমেনি।
আমারো তাই।
আগে পড়া, তারপরও আবার পড়ে একই রকম মজা পেলাম।
একেবারে দুর্দান্ত!
ব্যাটা তুই পারিসও!
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
নতুন মন্তব্য করুন