আমি যে বেশ বুড়ো হয়ে পড়েছি ভেতরে ভেতরে, তার প্রমাণ পাচ্ছি ক'দিন ধরে। রাতে আর পড়তে পারি না। বরং সকালের দিকে মাথাটা একটু টাটকা থাকে। সন্ধ্যের পর একদম হেদিয়ে পড়ি। তখন মন শুধু অন্য কিছু চায়, লেখাপড়া আর ভাল্লাগেনা। আরো নবীন বয়সে সারারাতই জেগে থাকতাম বলতে গেলে, আর এখন রাতে জেগে থাকলে আর চিন্তাভাবনা ঠিকতালে কাজ করে না।
আজ প্রায় কাকভোরেই উঠতে হয়েছে পরীক্ষার ঠ্যালায়। আজকে পড়বো কালকো পড়বো, এমন করে করে মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার ব্যাপারটা পরীক্ষার দিন সকালে এসেই ঠেকেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিকের দিনগুলোতে দায়সারা পরীক্ষা দেয়ার সময় এই অভ্যাসটা এমন গেড়ে বসেছে যে কিছুতেই আর সংশোধন করতে পারছি না। ছ'টার সময় ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম, সময় তো আছেই, না হয় একটু মেইল চেক করি। তারপর ভাবলাম, মেইল দেখলাম আর সচলে একটা ঢুঁ মারবো না? এমন করে করে শেষে সাড়ে সাতটার দিকে ফাইল খুলে বসলাম চোখ বুলানোর জন্য।
থার্মোডাইনামিক্স শেষ পড়েছি ঊনিশশো নিরানব্বুই সালে, শেষ পড়িয়েছি বোধহয় দুই হাজার তিনে। বেমালুম খেয়ে ফেলেছি এর মধ্যে অনেক কিছুই। প্রফেসর শ্মিডের পড়ানোর ধরনটা একটু অন্যরকম, আমরা যেমন পি-ভি প্লেন বা টি-এস প্লেনে এক একটা চক্রিকপ্রক্রিয়া শিখেছি, তিনি পড়ান ই-টি ডায়াগ্রাম ধরে। খুব একটা জটিল কিছু না, সেই পুরনো গ্যাসের গতিতত্ত্ব, কার্নো-স্টার্লিং-এরিকসন-ব্রেটন সাইকেল, মাইক্রোগ্যাসটারবাইন, বের্নুয়ির সমীকরণ ইত্যাদি। ইদানীং অঙ্ক করতে গেলে মাথায় হালকা চাপ লাগে, অনভ্যাসের কারণেই হয়তো। সব শেষ করে দেখি দশটা বেজে গেছে। তখন মনে পড়লো, আজকে না বাস ধর্মঘট?
মোটামুটি বজ্রাহত হবার মতোই ঘটনা, কারণ আমার বাসা থেকে সবচেয়ে কাছের ট্রাম স্টপেজে হেঁটে যেতে লাগে পঁচিশ থেকে তিরিশ মিনিট। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, তাপমাত্রা অবশ্য চড়ে গেছে ওপরে। কী আর করা, হেঁটেই রওনা দিলাম মূল ক্যাম্পাসের দিকে। হু হু বাতাস, হাঁটতেও খারাপ লাগছিলো না তেমন।
হল্যান্ডিশার প্লাৎসে যখন পৌঁছেছি, তখনই হাল্টেষ্টেলে (স্টপেজ) কাঁপিয়ে ঘোষণা এলো, আজ ট্রামও চলবে না।
ক্যামন লাগে এসব শুনলে? আর হল্যান্ডিশার প্লাৎস থেকে ইংশুলে আরো আধঘন্টার চড়াই পথ। পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলে গেলো। ঘড়িতে দেখি আটতিরিশ বাজে, এগারোটার সময় আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
মনে মনে কল্পনার করার চেষ্টা করলাম, আমি আসলে একটা গোলাপি মেঘের ওপর বসে আছি। হাতে ধরা সুরার গেলাস। কাছেই জনৈকা অপ্সরা কুমতলব নিয়ে ওঁত পেতে আছে। ইত্যাদি ...। হুম।
কল্পনায় খুব একটা কাজে দিলো না, গ্যাটম্যাট করে হাঁটা দিলাম আবার। সারা শহরের চেহারা হয়েছে অদ্ভুত, অসময়ে লোকজন গিজগিজ করছে রাস্তার ওপর। সবার চেহারাই খিড়কি পথে প্রেম খাওয়া। একদা ছিলো না জুতা চরণ যুগলে।
কোয়নিগসপ্লাৎসে আপনমনে একটা গালির গানে সুর দিতে দিতে যাচ্ছি, দেখি আমার ভাইভা গ্রুপের আরেক সদস্য স্লাভ বিরস মুখে খুব কষ্টে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। ডাক দিতেই স্লাভ থামলো। ইচ্ছামতো কিছু গালাগালি করে মনের ঝাল মিটিয়ে তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। স্লাভকে বললাম, তুমি পারলে আগে গিয়ে জানাও যে আজ এই অবস্থা, সামান্য দেরি হতে পারে। স্লাভ জানালো, গ্রুপের আরেক সদস্য দিমো ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে, সে জানাবে বলেছে।
ইংশুলেতে হেঁটে যাওয়ার ব্যাপারটা এমনিতে খারাপ লাগার কথা নয়, কিন্তু ভাইভার আগে এইসব ফালতু খাটনি কারই বা ভালো লাগে? প্রফেসর শ্মিড ভয়াবহ ব্যস্ত মানুষ, সম্ভবত গতকাল ফিরেছেন ভারত থেকে। আমাদের পরীক্ষা নিয়ে অন্য কোথাও যাবেন। দেরি করলে আমাদের শুধু পরীক্ষাই পিছাবে না, গ্রেডও জুটবে খারাপ। সম্ভাব্য কী কী ঝাড়ি খেতে পারি তার একটা তালিকা করার পর দেখলাম, আসলেই কপালে দুঃখ আছে। এমনিতেই আরেক কোর্সে দেরি করে যাবার জন্যে একদফা ঝাড়ি খেয়েছি শ্মিডের কাছে, আজকে পরীক্ষায় দেরি করে গেলে কী হয় কে জানে।
শেষ পর্যন্ত দশ মিনিট দেরি করে বসলাম তিনজন। যে জিনিস আমি নিজে প্রায় বছর চারেক পড়িয়েছি অন্যদের, সেটার এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্যাঁচ শ্মিড বার করতে লাগলেন যে টাষ্কি খেয়ে গেলাম। যে প্রশ্ন তিনি দিমো বা স্লাভকে করেন, সেটার উত্তর ঠোঁটের ডগায় চলে আসে, কিন্তু আমার বেলায় এমন বেয়াড়া প্রশ্ন করেন যে সেকেন্ড পনেরো চিন্তা করতে হয়। পাশে বসে আছে প্রোটোকোলান্ট ম্যাথিয়াস, সে ঘ্যাঁসঘ্যাঁস করে কী কী সব লিখে যাচ্ছে প্রোটোকোল পাতার ওপর।
প্রফেসর শ্মিড কোন কাজেই সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নন, পরীক্ষা শেষে দুমদাম করে গ্রেড জানিয়ে দিলেন। ডিপ্লোমআরবাইট, অর্থাৎ থিসিস লেখার সময় আগ্রহ থাকলে যোগাযোগ করতে বললেন, কী বিষয় নিয়ে ইদানীং কাজ করছেন তারও একটা ধারণা দিলেন। তারপর বললেন, যান গিয়ে ফূর্তি করেন। পরীক্ষা শ্যাষ।
আবারও ঘন্টা আধেক হেঁটে গিয়ে সুমন চৌধুরীর ওপর হামলা করলাম। চৌধুরী নানা ভ্যাজালে থাকেন, তাকে বগলদাবা করে গেলাম রেয়াল-এ। রেয়াল বেশ বড়সড় বিভাগ-বিপণী, তবে একটু দূরে বলে কম যাওয়া হয়। রেয়ালে ফোরেলের দাম অন্য যে কোন দোকানের চেয়ে কম বলে ফোরেলে খেতে চাইলে সেখানে যাই। বেশ কিছুদিন আগে একদিন ফোরেলের দাম নিয়ে চৌধুরীর সাথে আলাপ করার সময় কোত্থেকে এক নারীকণ্ঠ শোনা গেলো ঐশীবাণীর মতো, "আপনারা বাঙালি?!"
দেখলাম জনৈকা সুশ্রী মহিলা বেশ অবাক হয়ে দেখছেন আমাদের। মনে মনে বললাম, কপাল ভালো ফোরেলে নিয়ে আলাপ চলছিলো, কোন গরম বিষয়ে নয়। আলাপ করে জানা গেলো, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের। না, মহিলাটা কোনক্রমেই একাকিনী নন, সাথের গোমড়ামুখো টেকো ভদ্রলোকটি তাঁর সঙ্গী, ধরা যাক এই দম্পতির নাম চক্রবর্তী। সেই থেকে কাসেলে উচ্চস্বরে বাংলায় বাজে কথা বলার পরপরই আমি নিজেকে একটা সতর্কবাণী দিয়ে থাকি, "আপনারা বাঙালি?!"
রেয়ালে এতদিন চালের দাম কম ছিলো, সেখানেও দাম চড়চড়িয়ে বেড়ে যাওয়ায় আমরা যার পর নাই ক্ষুব্ধ। সস্তায় ভালো চাল আর কোথায় পাওয়া যায়, তার খোঁজ নেয়ার জন্যে এর আগে এক ছুটির দিনে এক চৈনিক দোকানে হানা দেয়া হয়েছিলো। সেখানে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য নানারকমের জিনিস আছে, যেমন কই মাছ আবিষ্কার করে চৌধুরী রীতিমতো উল্লসিত, কিন্তু চালের মূল্য সেখানে প্রীতিকর নয়। সন্দেহজনক চেহারার কিছু চাল দেখলাম, যাদের বাসমতী বা জেসমিন চাল বলে চালিয়ে দেয়ার একটা অপচেষ্টা করা হয়েছে। বিফল মনোরথে শেষমেশ বর্ধিতমূল্যের চাল খাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে আমরা এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যে এই অনাচারের শোধ নিতেই হবে। কোন জার্মান তরুণীর ওপর এই ঝাল ঝাড়তে পারলে তো কথাই নেই।
মন্তব্য
আর দেরী না করে অনাচারের শোধ নিয়ে নেন।
কি কি করলেন জানায়েন?
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।
চালের দাম তাইলে শুধু বাংলাদেশেই বাড়ে নাই দেখতাছি।
- ঝাল ঝারা প্রকল্পে আমারেও শামিল করিস।
দিনটা একটা অশ্লীলতায় গেছে। শালারা স্ট্রাইক করে চান্স দু'দিন পরে পরেই। বাঙালী হইয়া যাইতাছে!
কবে শুনবি সাদা চামড়ার এক রিয়েলের চাল খাওয়া মহিলা ডেকে জিজ্ঞেস করছে, আরে! আপনারা বাঙালী!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ভাল্লাগ্লো।
সবকিছুরই দাম বাড়ছে। চাল, তেল, আটা, দুধ,....
সবকিছুরই দাম বাড়ছে, কেবল স্কলারশিপ ছাড়া!!!
ফোরেলে= ?
ট্রাউট।
হাঁটুপানির জলদস্যু
নতুন মন্তব্য করুন