সুখের রূপকথা

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/০৩/২০০৮ - ৫:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সত্তরের কোঠায় পা দিয়েও বেশ টনকোই আছে বুড়োটা, আমার মুখোমুখি বসে, এই ধোঁয়ায় ঢাকা পানশালায়। তার চুলগুলোতে যেন তুষার জমেছে, আর চোখগুলো ঝকঝক করছে বরফ ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করা পথের মতো।

'ওহ, লোকগুলো আহাম্মক বটে!' বললো সে মাথা ঝাঁকিয়ে, আর আমার মনে হলো, এই বুঝি তার চুল থেকে তুষারকণা ঝরে পড়বে। 'সুখ তো কোন যাদুসসেজ নয়, যে রোজ ওর থেকে লোকে এক এক টুকরো কেটে নেবে!'

'ঠিক!' বলি আমি। 'সুখ অত সস্তা মাল না। যদিও .. ..।'

'যদিও?'

'.. .. যদিও এখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, ঘরে আগুনের ওপর আপনার কয়েক চিলতে সুখ শুকোতে দেয়া আছে?'

'আমার কথা আলাদা,' বললো বুড়ো, আর এক ঢোঁক গিলেও নিলো, 'আমি আলাদাই। আমি হচ্ছি সেই লোক, যার একটা ইচ্ছে এখনও পূরণের জন্যে পড়ে আছে!'

আমার মুখটা আগে খুঁটিয়ে দেখে নিলো বুড়ো। 'অনেক আগের কথা,' নিজের দু'হাতে মাথাটাকে সঁপে দিয়ে শুরু করলো সে, 'অনেক আগের। চল্লিশ বছর। তখন আরো চ্যাংড়া ছিলাম, আর ভুগছিলাম জীবনটাকে নিয়ে, যেভাবে লোকে ফোলা গাল নিয়ে ভোগে। বসে ছিলাম সেদিন, এক দুপুরে, তিতিবিরক্ত হয়ে একটা পার্কের বেঞ্চে বসে ছিলাম, এমন সময় পাশে বসে থাকা বুড়োটা বললো, যেন ওর সাথে আমার অনেকক্ষণের আলাপ, তা বেশ তো, আমরাও ব্যাপারটা ভেবে দেখেছি। তোর তিনটে ইচ্ছে পূরণ করা হবে। আমি আমার খবরের কাগজের দিকেই চেয়ে রইলাম, যেন কিছুই শুনিনি। কিন্তু বুড়োটা বকে চললো, ভেবে নে, কী চাই তোর। সবচে' সুন্দরী মেয়েটা, নাকি সবচে' বেশি টাকা, নাকি সবচে' বড় গোঁপ .. .. যা তোর খুশি। কিন্তু শেষতক খুশি হওয়া চাই, বুঝলি? তোর এই ভাল্লাগেনা-ভাব আমাদের আর ভাল্লাগে না। বুড়োটাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, সাদা পোশাকে সান্তা ক্লজ বুঝি। একমুখ সাদা দাড়ি, আপেলের মতো টুকটুকে দু'টো গাল, শিমুলতুলোর মতো ভুরু। পাগলছাগল নয়। বোধহয় বেশ খানিকটা খোশমেজাজি। ব্যাটাকে আগাপাস্তলা খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে আমি আবারও আমার কাগজে মন দিলাম। বুড়োটা বললো, তোর তিনটে খায়েশ নিয়ে তুই কী করবি, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। তবে যদি এ ব্যাপারে আগে থেকে একটু ভেবে রাখিস, তাহলেও কোন ভুল হবে না। দেখিস, তিনটে ইচ্ছে কিন্তু চারটা বা পাঁচটা নয়, ঠিক তিনটে। আর এর পরও যদি তুই অমন ব্যাজার হয়ে থাকিস আর হিংসুটেপনা করিস, তাহলে কিন্তু আমরা তোকে আর সাহায্য করতে পারবো না বাপ। আমি জানি না, আপনি নিজেকে আমার জায়গায় কল্পনা করতে পারছেন কি না। ভাবুন একবার, আমি একটা বেঞ্চে বসে, এই দুনিয়া আর খোদাতালার ওপর চরম বিরক্ত .. .. দূরে ট্রাম যাচ্ছে টিং টিং করে, প্যারেডের পোলাপান হাত পা ছুঁড়ছে আর ট্রাম্পেট ফুঁকছে, আর আমার পাশে বসে বাকোয়াজ করে যাচ্ছে কেবল ঐ ব্যাটা হতচ্ছাড়া!'

'আপনি চটে গেলেন খুব?' বলি আমি।

'চটলাম। আমার মনে হচ্ছিলো, আমি একটা ফাটো ফাটো বয়লার। আর যখন বুড়োটা তার অমন তুলোটে দাদু দাদু মুখটা খুললো, নতুন কিছু বকবার জন্যে, আমি গর্জে উঠলাম, রীতিমতো কাঁপছিলাম রাগে, বেশ তবে, আমি আমার একমাত্র ইচ্ছা, আমার অন্তরের অন্তস্থলের ইচ্ছাটি মুখে বলছি, যাতে করে আপনি, ব্যাটা বুড়ো গাধা, আমাকে আর তুইতোকারি করতে না পারেন .. .. আপনি জাহান্নামে যান! জানি, ওভাবে বলাটা ভদ্র বা মার্জিত নয়, কিন্তু আমি একেবারেই নিরুপায় ছিলাম, ওভাবে না বললে আমি ঠিক রাগে কাবু হয়ে পড়তাম।'

'তারপর?'

'কী তারপর?'

'সে চলে গেলো?'

'ওহ্! .. .. গেলো তো বটেই! উধাও হয়ে গেলো যেন। তখনই। বাতাসে মিলিয়ে গেলো যেন। আমি এমনকি বেঞ্চের নিচেও উঁকি মেরে দেখলাম। সেখানেও ছিলো না ব্যাটা। আর আমি ভ্ভীষণ ভয় পেলাম। এই ইচ্ছে পূরণের ব্যাপারটা তাহলে সত্যি! আর প্রথম ইচ্ছেটা পূরণ করা হয়ে গেছে! বাপ রে! আর যদি সত্যিই ইচ্ছেটা পূরণ করা হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই সেই শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র দাদুটা, যার দাদুই হওয়ার কথা, এখন কেবল চলেই যায়নি, কেবল আমার বেঞ্চ থেকেই উধাও হয়ে যায়নি, গেছে তো গেছে, একেবারে জাহান্নামে! খোদ শয়তানের কাছে! আমি নিজেকে বোঝালাম, গাধামি করো না। জাহান্নাম বলে কিছু নেই, আর শয়তান বলেও নেই অমন কিছু। কিন্তু, এই তিনটে ইচ্ছে কি তবে পূরণের জন্যে রয়েছে? আর, সেই বুড়োটা তো উবে গেছে, যদিও ওভাবে যাক, তেমনটা আমি চাই নি .. .. আমার কালঘাম ছুটে গেলো। হাঁটু কাঁপতে লাগলো আমার ঠকঠকিয়ে। কী করা উচিত আমার? সেই বুড়োটাকে এখুনি আবার এখানে ফিরতে হবে, চাই জাহান্নাম থাকুক আর না থাকুক। আমারই দোষে সে এখন উধাও। এখন আমাকে আমার দ্বিতীয় ইচ্ছে কাজে লাগাতে হবে, তিনটের মধ্যে দু' নম্বরটা, হায় রে, এমনই বলদ আমি! নাকি ব্যাটা যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে, সেখানেই তাকে রয়ে যেতে দেবো, সেই টুকটুকে আপেলের মতো গাল দুটো নিয়ে? আপেলের কাবাব, ভাবলাম আমি, আর কেঁপে উঠলাম। আমার আর কোন গতি ছিলো না। আমি চোখ বন্ধ করলাম, আর ভয়ে ভয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, আমার ইচ্ছে, সেই বুড়োটা আবার আমার পাশে এসে বসুক! ভাবতে পারেন, আমি বছরের পর বছর ধরে, এমনকি এখনো মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে নিজেকে গালমন্দ করি, কেন ওভাবে আমার দ্বিতীয় ইচ্ছেটাকে নষ্ট করলাম, তবে তখন আমি অন্য কোন উপায় দেখিনি, আসলে অন্য কোন উপায় ছিলোও না .. ..।'

'তারপর?'

'কী তারপর?'

'বুড়ো ফিরে এলো?'

'ওহ্! .. .. এলো তো বটেই! তৎক্ষণাৎ। সে আবারও আমার পাশে বসলো, যেন সে অমনই বসে ছিলো। তবে তাকে দেখে বোঝা গেলো, যে সে এমন কোথাও ছিলো, যেখানে কি না খুব ভুগেছে বেচারা, মানে .. .. খুব গরম কোনও জায়গায়। হ্যাঁ, ঠিক তাই। তার সেই ঝোপালো সাদা ভুরু দুটো একটু ঝলসে গেছে, দাড়িটাও কুঁকড়ে আছে একটু, কিনারার দিকে বিশেষ করে। আর তার গা থেকেও সেঁকা হাঁসের মতো গন্ধ বেরোচ্ছিলো। আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে ছিলো বেচারা। তারপর বুকপকেট থেকে একটা চিরুনি বার করে নিজের দাড়ি আর ভুরু আঁচড়ালো সে, আর খোনা গলায় বললো, শুনুন ভাই, কাজটা কিন্তু আপনি ভালো করলেন না। আমি আমতা আমতা করে মাপ চাইলাম, বললাম যে তিনটে ইচ্ছের কথা আমি মোটেও ভেবে দেখিনি, আর নিজের ভুল বুঝতে পেরে তো যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করেছি। তা অবশ্য ঠিক, বললো বুড়ো। এতো অমায়িক মুচকি হাসলো সে, যে আমার চোখে পানি চলে আসার জোগাড়। তবে হয়েছে কি, এখন আপনার কেবল একটি মাত্র ইচ্ছে বাকি, বললো সে, তৃতীয়টা। আশা করি এটার ব্যাপারে আপনি আরেকটু সাবধানে থাকবেন। আমায় কথা দিন, সাবধানে থাকবেন? আমি ঢোঁক গিলে মাথা নাড়লাম, নিশ্চয়ই, কিন্তু আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলুন। এবার বুড়ো হেসে ফেললো। বেশ তো, বাছা, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে, ভালো থাকো। মনমরা হয়ে থেকো না। আর তোমার শেষ ইচ্ছের ব্যাপারে সতর্ক থেকো। আমি এবার খুশি হয়ে বললাম, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আর এরপর বুড়ো চলে গেলো, যেন হাওয়ায় মিশে গেলো একেবারে।'

'তারপর?'

'কী তারপর?'

'সেদিন থেকেই আপনি সুখী?'

'ওহ্! .. .. সুখী?'

আমার পার্শ্ববর্তী উঠে দাঁড়ালো, হুক থেকে নিজের টুপি আর কোট খুলে নিলো, ঝকঝকে চোখে আমাকে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ, তারপর বললো, 'আমার শেষ ইচ্ছেটাকে আমি গত চল্লিশ বছরে আর ঘাঁটাইনি। মাঝে মাঝে অবশ্য মনে হয়েছে, চাই কিছু একটা। কিন্তু না। ইচ্ছেগুলো ততক্ষণই সুন্দর, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের কিছু একটা চাইবার রয়ে যায়। ভালো থাকবেন।'

আমি জানালা দিয়ে চেয়ে দেখলাম, রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে সে। তাকে ঘিরে চারপাশে তুষারকণাগুলো যেন নাচছে। আর আমাকে বলতে একদম ভুলে গেছে সে, বাস্তবিক সে একটু হলেও সুখী কি না। নাকি সে ইচ্ছে করেই আমাকে উত্তরটা দিলো না? স্বাভাবিক, অমনও তো হতে পারে।



মূল জার্মান, এরিখ কেস্টনার-এর ডাস মেয়ারশেন ফম গ্লুয়ক থেকে অনূদিত। প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর ২৬, ২০০৪। পুরনো পোস্ট।

auto


মন্তব্য

অমিত আহমেদ এর ছবি

দূর্দান্ত।
প্রথমেই উল্লেখ করে দেয়া উচিত ছিলো না যে এটা অনুবাদ। আমি পড়তে পড়তে ভাবছলাম হিমু ভাই দুই দিন জার্মানে থেকে জার্মান ভাব ধরেছে। উপমাতেও জার্মানের ছাপ। পরে শেষে এসে টের পেয়েছি।

হিমু এর ছবি

ক্যানো রে ভাই, ক্যাটেগরিতে তো লিখে দিলাম অনুবাদ!


হাঁটুপানির জলদস্যু

অমিত আহমেদ এর ছবি

অত্ত ছোট ফন্ট খেয়াল করি নাই।

উদাস এর ছবি

আসাধারন গল্প। যেমন সুন্দর গল্প তেমনি সুন্দর অনুবাদ। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় ছোটগল্পে যতটা গল্প বলা যায় উপন্যাসে ততোটা কখনই বলা যায় না। কারন উপন্যাসে লেখক একাই বলেন আর পাঠক শুনে যান, আর ছোটগল্পে লেখক হয়তো গল্পটা শুধু শুরু করে দেন, তারপর পাঠক নিজেকই নিজে গল্পটা বলে যান। আনেক আগ্রহ নিয়ে মোপাসা এবং ও'হেনরি এর সংকলন গুলো পড়েছিলাম, কিন্তু দুর্বল অনুবাদের কারনে কোন রসই পাইনি। সচলায়তনের কাছ থেকে এরকম চমত্কার অনুবাদ আরো পাব বলে আশা রাখছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ !

- খেকশিয়াল

নজমুল আলবাব এর ছবি

পড়ে আরামবোধ হয়েছে। অনুবাদ মানেই খটমট কিছু নয় এটা বুঝা গেল। আরও চাই।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

কনফুসিয়াস এর ছবি

অনুবাদ দুরন্ত হয়েছে।
আচ্ছা হিমু ভাই, এইরকম অনুবাদের ঢঙে নিজেরাই গল্প লেখা যায় না? কেমন হয়?
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

হিমু এর ছবি

মমমম ... কেমন হয় বুঝতে পারছি না ... কেউ একজন শুরু করুন, তাহলে বোঝা যাবে। তবে অন্যরকম স্বাদ হবে, তাতে সন্দেহ নেই।


হাঁটুপানির জলদস্যু

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ভাইয়া...হেভী বস হইছে

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

স্বপ্নাহত এর ছবি

জটিল কুটিল লেখা... হেভী বস...

=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
বুকের মধ্যে আস্ত একটা নদী নিয়ে ঘুরি

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ইচ্ছেগুলো ততক্ষণই সুন্দর, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের কিছু একটা চাইবার রয়ে যায়

দুর্ধর্ষ
গল্প এবং অনুবাদ দুটোই

তবে সংলাপ আর বর্ণনাটা মাঝে মাঝে গোল পাকিয়ে যায়
একটু নাড়াচাড়া করে দেবেন

শেখ জলিল এর ছবি

সরস অনুবাদ। ভাল্লাগছে।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

ফারুক হাসান এর ছবি

ভালো লাগলো
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

দ্রোহী এর ছবি

প্রস্তর যুগে পড়া হয়ে গিয়েছিল হিমুর সুবাদে। আবার পড়তে ক্ষতি কি?


কি মাঝি? ডরাইলা?

হিমু এর ছবি

আমি উৎসাহ বোধ করছি আপনাদের প্রতিক্রিয়ায়। সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। দেখি, বিবলিওঠেকে-তে কেস্টনারের গল্পসমগ্র গোছের কিছু পাওয়া যায় কি না, তাহলে আরো কিছু গল্প অনুবাদ করবো সামনে।

যারা "এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী" পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই কেস্টনার-এর ব্যাপারে আরো উৎসাহ বোধ করবেন।


হাঁটুপানির জলদস্যু

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ভাইয়া... শুরু করেন।
দারুণ হবে।
আমারও মাঝে-মধ্যে অনুবাদ করতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু সাহস হয় না।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুবাদ শুনলেই কেমন নিরস নিরস মনে হয়।কিন্তু আপনি তো ভালই ফুটিয়েছেন।
-নিরিবিলি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।