"নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ার তৃপ্তিটাই অন্যরকম।" বলছিলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যাঁকে এখন থেকে চৌধুরী সাহেব বলাটাই ভালো শোনাবে। পুরো গল্পটা শোনার পর তাঁর আসল নাম নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করাটা শোভন হবে না। আর ... চৌধুরী তাঁর নাম হতেও পারে, না-ও হতে পারে। একটা হোলেও হোতে পারে পরিস্থিত আর কি ... হেঁ হেঁ হেঁ ...।
আমি বা দুলাল কেউই নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ার তৃপ্তি আজও পাইনি। আমরা মায়ের হাতের, ভাবির হাতের, পরিচারিকার হাতের নয়তো খাবারের দোকানের বাবুর্চির হাতের রান্না খেয়েই তৃপ্তি পাই। এমনকি নিজের হাতে রান্না করতে হচ্ছে না, এটা ভেবেই তৃপ্তিতে চোখ বুঁজে আসে।
সাহস করে কথাটা চৌধুরী সাহেবকে বলি। তিনি নিঃশব্দে মুখ ব্যাদান করে হাসেন।
"হ্যাঁ। আমিও আপনাদের মতোই ভাবতাম, এই বছর দশেক আগ পর্যন্তও।"
"বলেন কী?" দুলালের মুখ দিয়ে থুতু বেরিয়ে আসে কথার ফাঁকে। "দশ বছর ধরে নিজের রেঁধে খাচ্ছেন? আপনি তো মহাত্মা!"
চৌধুরী হাসেন মিটিমিটি। "তা বলতে পারেন। স্বপাক আহারের অনেক ভালো দিক রয়েছে। নিজে বেছে, নিজে ধুয়ে, নিজে কুটে রাঁধার যে পরিশ্রম, তাতে আপনার শরীর মন রাঁধা খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অন্যের রান্না হ্যাকথু বলে সরিয়ে রাখা যায়। তাছাড়া নিজে রাঁধলে কিছুদিনের মধ্যেই আপনার হাতের মাপ ফাইন টিউন্ড হয়ে যাবে, শরীরের যতটুকু লাগবে, ততটুকুই দিতে পারবেন। তাছাড়া, রান্না তো খুব উঁচু দরের শিল্প। জীবন যোগানিয়া আর্ট। আপনি আপনার স্বাস্থ্যের ছবি আঁকবেন, মূর্তি গড়বেন, কবিতা লিখবেন পুষ্টি আর তৃপ্তি নিয়ে।"
দুলাল হাত নাড়ে। "একেবারে গজল!"
চৌধুরী আবারও মুখ ব্যাদান করেন। "একদম ঠিক!"
তবে আমি দুলালের সাথে কিছুতেই একমত হতে পারি না। যদিও জানি, চৌধুরীর সাথে তাল মিলিয়ে যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা ধরতে হবে। ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে আর দুলালকে যোগাড় করতে হবে কুড়ি হাজার টাকার বিজ্ঞাপন। মোটে তিন হাজার জোটানো গেছে। সতেরো থেকে চৌধুরী পাঁচ দিলেই আমরা খুশি।
চৌধুরী কিন্তু শুধু ঝুনাই নন, ঝানুও। আমার দিকে ফিরে ওরকম হাসি হাসি মুখ করেই বলেন, "আপনি বোধহয় একমত নন?"
আমি দুলালের লাথি খাই পায়ে, হারামজাদাটা, কিন্তু বলি, "আসলে, অভ্যাস একটা বড় সমস্যা আর কি ...।"
দুলাল রুষ্ট চোখে তাকায়, কিন্তু ও মা, চৌধুরী রীতিমতো বুড়ো আঙুল তুলে কুল সাইন দেখান আমাকে, যে ইঙ্গিত দেখিয়ে একবার ড়্যাব আঙ্কেলের পাল্লায় পড়ে কান ধরে ওঠবোস করেছিলো কী একটা আংরেজি মাধ্যমের কচি কিডস।
"ঠিক বলেছেন!" চৌধুরী হাসেন এবার, খিক করে একটা শব্দ হয়।
আমি দুলালের দিকে তাকাই।
চৌধুরী সোফায় হেলান দেন। আনমনে বলেন, "আসলেই, অভ্যাস একটা বিরাট সমস্যা। বুঝলেন? আমি যেমন শুরুতে বেড়াল না খাওয়াতে পেরে খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। খুব অস্বস্তি লাগতো। এমনিতে রান্নার হাঙ্গামা, তেল ঢালো, মশলা মাখাও, মাছ কাটো, মুরগি ছেলো ... অনেক হাঙ্গামার পর রান্নাবান্না করে যদি বেড়ালই খানিক না খেলো, বেড়ালে মুখই যদি না দিলো, কিভাবে খাবো? ... এ প্রশ্ন জাগতো সবসময়। পরে আস্তে আস্তে অভ্যাস পাল্টেছে। এখন রান্নাও ভালো লাগে, বেড়ালও দরকার হয় না।"
আমি আর দুলাল একজন আরেকজনের মুখ দেখি। কীসের বেড়াল?
চৌধুরী সাহেব আনমনে একটা সব্জির বড়া তুলে নেন কাঁটাচামচে গেঁথে। তারপর কচকচিয়ে চিবিয়ে খাওয়া শুরু করেন। খেতে খেতেই বলেন, "খাবার সময় কথা বলা ঠিক নয় একেবারেই। শ্বাসনালীতে একটা ট্র্যাফিক জ্যাম লেগে যেতে পারে। যাকে বলে বিষম খাওয়া। খেয়ে দেখেছেন কখনো, বিষম?"
দুলাল দুই কামড়ে একটা বড়া চিবিয়ে খেয়ে শেষ করে ফেলেছিলো প্রায়, চৌধুরী সাহেবের কথা শুনে কী একটা বলতে গিয়ে সে প্রায় বিষম খেয়ে মরে আর কি! আমি দুলালের মাথায় চাপড় দেই, সে ছলোছলো চোখে এদিক ওদিক তাকায়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না, আর চৌধুরী সাহেব রীতিমতো ঊরুতে চাপড় মেরে হেসে ওঠেন খিক খিক করে।
আমি না পারি কিছু একটা মুখ পুটে বলতে, না পারি সইতে। চৌধুরী সাহেব আনমনে মাথা দুলিয়ে খানিকক্ষণ হেসে বলেন, "আপনারা বড় আনাড়ি। কেউ বিষম খেলে মাথায় চাপড় দিয়ে লাভ আছে? তাকে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে পাঁজা করে ধরে পাঁজরের ঠিক নিচে হাত বেঁধে চাপ দিতে হয়, যাকে বলে হাইমলিখ প্যাঁচ। উইকিপিডিয়া থেকে দেখে নেবেন আজই।"
রাগে আমার গা জ্বলে যায়, দুলালও দেখি চোখ গরম করে তাকায়।
চৌধুরী হাসি হাসি মুখ করেই আরেকটা সবজির বড়া গাঁথেন কাঁটা চামচে। একটা কামড় দিয়ে চোখ বুঁজে বলেন, "বহুদিন হলো বেড়াল ছাড়া খাচ্ছি। এখন এমনটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। কী বলবো। অবশ্য কাবুল মরে যাবার পর অন্য কোন বেড়াল ওর স্থান নিতে পারতো কি না, আমার সন্দেহ আছে। সব ক্ষতি পূরণ করা যায় না।"
দুলাল জ্বলন্ত চোখে চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে খপ করে খাবলা দিয়ে একটা সব্জির বড়া তুলে নেয়। চিবোতে থাকে, কিছু বলে না। আমি বলি, "কাবুল কে?"
চৌধুরী কাঁটা চামচে গাঁথা বড়া উঁচিয়ে বলেন, "কে নয়, কী। কাবুল আমার পোষা বেড়াল ... ছিলো। প্রায় দশ বছর হলো কাবুল খুন হয়েছে। তারপরই তো রান্নাবান্নার জগতে ঢুকতে হলো আমাকে!"
আমি দুলালের দিকে তাকাই। দুলাল মুখে সব্জির বড়া নিয়ে চোখ গোলগোল করে তাকায় আমার দিকে।
আমি বলি, "কাবুল খুন হয়েছিলো? একটা বেড়ালকে খুন করতে যাবে কে?"
চৌধুরী একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন দেখলাম। কাঁটা চামচ দিয়ে ঘ্যাঁচ করে একটা বড়া এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়ে বললেন, "সে এক বিরাট গল্প। শুনতে চান?"
দুলাল কোঁৎ করে সব্জির বড়ার মন্ড পেটে চালান করে দিয়ে বলে বসলো, "নিশ্চয়ই, কেন নয়?"
চৌধুরী বেশ খুশি হলেন শুনে। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "বেশ। চলুন আমার হেঁসেলে। গল্পগুজব এই বৈঠকখানায় বসে ভালো জমে না!"
চৌধুরী পেছন ফিরতেই আমি দুলালের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচাই।
অম্লান বদনে চৌধুরী দুলালের হাতে কয়েকটা আলু ধরিয়ে দ্যান। "আলুর কিছু ব্যাপার আছে। যদিও চোখে দেখতে, বা চেখে দেখতে একটু কেমন যেন লাগে, কিন্তু আলুর মূল পুষ্টি হচ্ছে এর খোসায়। তবে আলুর খোসা আমি পছন্দ করি না। নিন, ধুয়ে ফেলুন আলুগুলি। তারপর চাক চাক করে কাটুন। মুরগি রান্না হবে।"
দুলালের চেহারাটা কাঁদো কাঁদো হয়ে আসে। আমি প্রমাদ গুনি।
চৌধুরীর কী ক্ষতি করেছি, তা জানি না, কিন্তু তিনি বেছে বেছে কয়েকটা পেঁয়াজ বার করে দ্যান আমাকে। "পেঁয়াজকে শিবরাম একটা গল্পে শতদল বলেছিলেন। আসলেই তাই। নিন, এই যে ছুরি। কুচি কুচি করে কাটুন একেবারে।"
দুলাল দাঁত বার করে একটু।
চৌধুরী একটা কড়াই বসান চুলার ওপর। তারপর শুরু করেন অর্ধনিমীলিত চোখে গল্প।
"কাবুল আমার বড় আদরের বেড়াল ছিলো। অকালে মরে গেলো, আমার স্ত্রীর মতই।"
দুলাল আরেকটু হলেই আলুর সাথে নিজের হাতের তালুও চাক চাক করে কেটে ফেলছিলো আর কি। ঢোঁক গিলে সে বলে, "আপনার স্ত্রী, মানে, উনিও অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন?"
চৌধুরী চোখ খোলেন। "না, তা-ই বললাম নাকি? অকালে মারা গিয়েছিলেন, তবে অল্প বয়সে নয়। চল্লিশ বেয়াল্লিশ হয়েছিলো বয়স। অল্প বয়সে মারা গেলে আমার সুবিধেই হতো।"
আমি বলি, "ফোঁৎ!" তারপর চোখের পানি মুছি।
চৌধুরী সান্ত্বনা দ্যান। "হুঁ, আসলেই দুঃখের ব্যাপার। আমার বয়স তখন আটচল্লিশ। কাবুলের ছয়। আমাদের একেবারে অনাথ করে দিয়ে আমার স্ত্রী মারা গেলেন, হার্ট অ্যাটাক করে। বড় প্রেমময়ী ছিলেন। শুধু রেগে গেলে মারপিট করতেন।"
দুলাল আবারও ভুল পোঁচ চালায় আলুর ওপর। "মারতেন আপনাকে?"
"আমাকে নয়, কাবুলকে।"
"অ।" আমি হতাশ হই।
"তিনি মারা গিয়ে আসলে কাজটা ভালো করেননি।" ফ্রিজ খুলে একটা পোঁটলা বার করেন চৌধুরী।
"কেন?" দুলাল বলে বসে।
"আমার স্ত্রী চমৎকার রান্না করতেন। তাঁর রান্না শুধু সুস্বাদুই নয়, নিরাপদও ছিলো।"
"নিরাপদ? সে কীরকম?" আমি জানতে চাই।
"আমার স্ত্রীর রান্না করা খাবার কাবুলকে খাওয়াতে হতো না। কাবুল অবশ্য খেতো, বেশ তৃপ্তি করে, চেটেপুটেই খেতো, তবে তাকে না খাইয়েও আমি খেতে পারতাম।"
আমার কাছে সবই বড় ধোঁয়াটে মনে হয়।
"আমার স্ত্রী মারা যাবার পর আমি বিপুল শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কয়েকটা দিন কোন রান্না করা খাবার মুখে তুলতে পারিনা। শুধু শুকনো মুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দিই।" চৌধুরী ধরা গলায় বলেন।
"ওফ!" আমি চোখের জল মুছি পেঁয়াজ কুচাতে কুচাতে। একগাদা পেঁয়াজ কুচাতে দিয়েছেন চৌধুরী।
"আমার স্ত্রী যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন আমাদের বাড়িতে তাঁর দেখাশোনা করতে আসে তাঁরই দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়া। তিনিই তখন রান্নাবান্না করতেন। তাঁর রান্না খারাপ ছিলো এমন আমি বলবো না। ভালোই রাঁধতেন।" হাতের পোঁটলাটা একটা গরম পানির গামলায় চুবিয়ে রাখেন চৌধুরী, মুরগির বরফ গলাতে হবে।
"তাই?" আলু ছিলতে ছিলতে বলে দুলাল।
"আপনি তো আলুর মজাটাই মেরে দিচ্ছেন ওভাবে খোসা ছাড়াতে গিয়ে!" চৌধুরী হাঁ হাঁ করে ওঠেন। "ছাল ছাড়াতে গিয়ে তো মাংসই গায়েব করে দিচ্ছেন আলু থেকে! আরো পাতলা করে খোসা ছাড়ান!"
দুলাল থতমত খেয়ে দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়ে আলু ছিলতে শুরু করে।
"তবে, আমার স্ত্রী মারা যান তাঁর রান্না করা এক বাটি স্যুপ খেয়েই।"
আমি আমার আঙুলটাই কুচিয়ে ফেলি আরেকটু হলে। "য়্যাঁ?"
"হুমম। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। এসে দেখি ঘরে ডাক্তার। ডাক্তার আবার আমার স্ত্রীর সেই আত্মীয়া, ফুলি যার নাম, তাঁর পরিচিত। সেই ডাক্তার জানালেন, হার্ট অ্যাটাক।"
"আচ্ছা!" দুলাল ঢোঁক গিলে বলে।
"কাজের বুয়া অবশ্য বলে, ফুলি একটু ভেজেটেবল স্যুপ বানিয়ে খাওয়ানোর সময় নাকি আমার স্ত্রী ধড়ফড় করে মারা যান।"
"বলেন কী?" আমি পেঁয়াজ কুচিয়েই চলি।
"ফুলি অবশ্য আমার খুব যত্ন করতো একদম শুরু থেকেই।" চৌধুরী কাবার্ড থেকে মশলার কৌটো নামানো শুরু করেন।
"ওওওও!" দুলাল গাধাটা আর মানুষ হবে না।
"ফুলি সেদিনই কাজের বুয়াকে বিদায় করে দেয়। বলে এখন তো কাজ কমে গেলো, আমার দেখাশোনা সে একাই করতে পারবে।"
"আচ্ছা!" বলি আমি।
চৌধুরী এলাচ আর দারচিনি বার করেন। "আমার স্ত্রীর সৎকারের পর আমি ঘরে এসে খুব একা বোধ করতে থাকি। বিশেষ করে খাবার সময়। এক বাটি মুড়ি চিবিয়ে শুয়ে পড়তাম রাতে। ফুলি অবশ্য নিজেই বাজার সদাই করে রান্না বান্না করতো, কিন্তু আমার মুখে রুচতো না।"
"শোক জিনিসটা এমনই।" বলি আমি। পেঁয়াজ কুচানো মোটে আদ্ধেকটা শেষ।
চৌধুরী একটা কড়াইয়ে এলাচ আর দারচিনি শুকনো ভাজতে শুরু করেন। "অবশ্য খিদে পেলে আমি হোটেল থেকে খেয়ে আসতাম। তন্দুরি রুটি দিয়ে গরমাগরম ভাজি কিংবা মাংসের ঝোল। হোটেলের খাবার তেমন সুস্বাদু না হলেও, নিরাপদ।"
দুলাল আমার দিকে পাংশু মুখে তাকায়।
"হপ্তাখানেক পরই আমি ফুলিকে বিয়ে করে ফেলি।" বলেন চৌধুরী।
আমি রীতিমতো চমকে উঠি।
"ফুলিই প্রস্তাবটা দেয়। বলে, তার আর কোন আশ্রয় নেই। আমার আশ্রয়ে যদি থাকতেই হয়, তাহলে বউ হয়ে থাকাটাই ভালো। তাহলে পাঁচজনে পাঁচরকম কথাবার্তা বলবে না। আমারও দেখাশোনা করার একজন লোক দরকার। ইত্যাদি।" চৌধুরী খুন্তি দিয়ে এলাচ নাড়তে থাকেন। তারপর বয়াম খুলে কয়েকচামচ ঘি ছাড়েন কড়াইয়ে।
"তারপর?" দুলাল জানতে চায়।
"ছাড়িয়েছেন খোসা? তারপর আবার কী? কাটুন মাপমতো। চাক চাক করে।" চৌধুরী আমার দিকে ফেরেন, "পেঁয়াজ কুচানো হলো?"
আমি সাশ্রুনয়নে তাঁর দিকে কুচানো পেঁয়াজ এগিয়ে দিই। তিনি কড়াইয়ে ভস ভস করে ঢালেন সব। "ফুলি স্ত্রী হিসেবে মন্দ ছিলো না। মোটামুটি সুন্দরী, যুবতী, কথা কম বলতো, সব দিকে চোখা নজর রাখতো, ভালো রান্না করতো ... তবে তার রান্না ভালো হলেও, ঐ যে বললাম, নিরাপদ ছিলো না।"
দুলাল আলু কাটতে থাকে কচকচ করে। "তারপর?"
"বেশিদিন তো আর হোটেলে খাওয়া যায় না। আমি রাতে ঘরে ফুলির রান্না খেতে শুরু করলাম। ফুলি আবার রাতে খেতো না। আমার জন্য খাবার বেড়ে দিয়ে সে শুয়ে পড়তো।"
আমি কিছু বলি না।
"আমার বেশ যত্ন করতো ফুলি, কিন্তু একটাই দোষ ছিলো তার। রাতের বেলা ইনিয়ে বিনিয়ে কেবল নানা ঘ্যানঘ্যান। আমার নাকি বয়স হয়ে গেছে, আমার কিছু হলে সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, ইত্যাদি নানা হাবিজাবি কথা।"
দুলাল আলু কাটতে কাটতে বলে, "বলেন কী?"
"তবে ফুলি ভালোই রান্না করতো।" চৌধুরী কড়াইয়ের ওপর হলুদ, ধনিয়া, জিরা আর মরিচের গুঁড়ো ঢালেন বিভিন্ন মাপের কাঠের চামচ দিয়ে।
"আপনি খেতেন রোজ রাতে?"
"তা খেতাম। তবে আগে কাবুলকে খাইয়ে দেখতাম। কাবুল ... আমার বড় প্রিয় বেড়াল ছিলো সে।"
"কাবুলকে খাওয়াতেন কেন?" দুলাল আলু কেটে একটা বাটিতে রাখে।
"কাবুলেরও তো ক্ষুধাতৃষ্ণা আছে। তাকেও তো খেয়ে পড়ে বাঁচতে হবে। তাই খাওয়াতাম।"
"আপনার স্ত্রী ফুলি তখন কী করতেন?"
"সে শুয়ে পড়তো।"
"হুমমমম।" বলি আমি।
চৌধুরী এবার একটু আদা-রসুনের কুচি দিয়ে খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকেন কড়াইয়ে। "রাতের পর রাত ফুলি কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতো, আমার বীমার কাগজগুলিতে ওকে নমিনি করতে। আমার প্রথমা স্ত্রী কিছুটা মুখ পাতলা ছিলেন, তিনিই নাকি ফুলিকে একবার বিশদ বলেছিলেন সেসব কাগজের কথা।"
"সবাইকে সব কিছু বলতে নেই।" বলি আমি।
"ঠিক।" চৌধুরী এবার গরম পানির গামলা থেকে পোঁটলা তুলে মুরগির মাংস বার করে কড়াইয়ে ছাড়েন। "আপনারা কি কেউ সাত-আট মাস ভালোমতো না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন?"
"নাহ!" দুলাল মাথা নাড়ে।
"হুমমম। ফুলিকে বিয়ে করার আট মাস পর আমি শেষমেশ একদিন বীমার কাগজে ওর সইসাবুদ নিয়ে নমিনি পরিবর্তন করিয়ে আনি। এর আগে নমিনি ছিলেন আমার প্রথমা স্ত্রী, তাই কোন সমস্যা হয়নি। আরো কিছু টুকটাক পরিবর্তন করি বীমায়।"
"বলেন কী?"
"হুঁ। তার দিন আষ্টেক পরই কাবুল মারা যায়।" চৌধুরীর মুখটা ভার হয়ে ওঠে।
আমি মাথা দোলাই।
"সেদিন রাতে দুয়েক গ্রাস খাবার মুখে দিয়েই কাবুল ধড়ফড় করে মারা পড়ে।" চৌধুরী খুন্তি দিয়ে কষানো মশলা মাংসের সাথে মেশাতে শুরু করেন।
দুলাল ঢোঁক গিলে বলে, "তারপর?"
"আমি খুব দুঃখ পাই। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর যেমন দুঃখ পেয়েছিলাম।"
"কাবুলও হার্ট অ্যাটাক করেছিলো?"
"হয়তো।" চৌধুরী কড়াইয়ে লবণ মেপে দিয়ে একটা ঘুঁটুনি দেন আবার।
"বলেন কী?"
"হুমমম। কাবুলকে খেতে না দিয়ে আমি খেলে আমারও হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারতো।"
দুলাল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
"কাবুল বড়ই নিরীহ বেড়াল ছিলো। চুরিদারি তেমন একটা করতো না। ঘরও ময়লা করতো না। শান্তশিষ্ট একটা প্রাণী। তার এমন হার্ট অ্যাটাকে আমার বড়ই দুঃখ হয়।"
"হবারই কথা।" আমি বলি।
"রাগও হয়।" চৌধুরী বলেন।
"হবারই কথা।" দুলাল বলে।
"রাগ কমানোর উপায় কী, জানেন?" চৌধুরী কড়াইটা একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেন।
"কী?"
"মাটিতে শুয়ে পড়া।" চুলার আঁচ কমিয়ে দেন চৌধুরী। "তারপর চোখ বুঁজে দম নিয়ে পড়ে থাকা। এতে করে এই চুলোর মতোই রাগের আঁচ পড়ে আসে।"
"আচ্ছা? আপনি তখন তাই করলেন?"
"হ্যাঁ।"
"তারপর?"
"ফুলি অন্যদিন ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু সেই রাতে সে দেখলাম উঠে এলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখলো। কাবুলকে কষে একটা লাথি মারলো, সে নড়াচড়া করে না দেখে তারপর আমার নাকের কাছে হাত রেখে নিঃশ্বাস পড়ে কি না দেখলো। তারপর আমার বুকে মাথা রেখে শোনার চেষ্টা করলো শব্দ হয় কি না।"
"তারপর?"
চৌধুরী বললেন, "আমি তখন লাফিয়ে উঠে বসলাম।"
দুলাল বললো, "য়্যাঁ?"
চৌধুরী বললেন, "হুঁ। অনেক জোরে হয়ে গিয়েছিলো।"
আমি বললাম, "তারপর?"
চৌধুরী বললেন, "ফুলি আমাকে উঠে বসতে দেখে আঁতকে উঠলো রীতিমতো, তার মুখ সাদা হয়ে গেলো, তারপর বুক চেপে ধরে মাটিতে পড়ে গেলো।"
দুলালও আঁতকে উঠলো, "বলেন কী?"
চৌধুরী বললেন, "হুঁ। হার্ট অ্যাটাক। আলুগুলি কেটেছেন মাপমতো?"
খেতে বসে চৌধুরী বললেন, "মুরগিটা কেমন হয়েছে?"
দুলাল চপচপ করে খেতে খেতে বললো, "বেশ স্বাদ হয়েছে!"
চৌধুরী বললেন, "হ্যাঁ। আমার অবশ্য নিজের রান্না ভালো লাগতে শুরু করেছিলো একটু দেরিতে। খান, আরাম করে খান। বেড়াল খাওয়াতে হবে না।"
আমি ভাত ঝোল দিয়ে মাখতে মাখতে বললাম, "তারপর কী হলো?"
চৌধুরী খাবার ভালোমতো চিবিয়ে গিলে বললেন, "সেই ডাক্তারকে খবর দিলাম। সে-ও তো আমার কথা শুনে আরেকটু হলেই হার্টফেল করেছিলো আর কি। তারপর ফুলির ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে ঘামতে ঘামতে বিদায় হলো। বেচারা। ফুলির সাথে তার বড় ভাব ছিলো।"
দুলাল বলে, "য়্যাঁ?"
চৌধুরী বললেন, "হ্যাঁ। অবশ্য ফুলি ওভাবে মারা যাওয়ায় আমাকে দেখাশোনা করার লোকের দস্তুরমতো অভাব পড়ে। কিন্তু আমি দেখলাম নিজেকে দেখেশুনে রাখার কাজটা খুব একটা কঠিন কিছু না, বিশেষ করে বীমার টাকাটা হাতে এসে যাবার পর।"
"কোন বীমার টাকা?" জানতে চাই আমি।
"ঐ যে, জীবন বীমা? আমার আর ফুলির যৌথ বীমা। একজন মারা গেলে আরেকজন পাওয়ার কথা ছিলো টাকাটা।"
"বলেন কী?" দুলাল হাঁ হয়ে যায়।
"হুমম। প্রথমে কেবল একপেশেই ছিলো বীমাটা। পরে ভেবে দেখেছিলাম, ফুলির হাতের রান্না ভালো হলেও নিরাপদ নয়। ভাবলাম, ওর কিছু হলে আমার তো যাওয়ার একটা জায়গা থাকতে হবে। সেটা যদি শেষমেশ রান্নাঘর হয় তো খরচাপাতির একটা ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। তাই আরো কিছু টাকা যোগ করে বীমায় একটু রদবদল করে নিয়েছিলাম।"
আমি আর দুলাল, একজন আরেকজনের দিকে তাকাই শুকনো মুখে।
চৌধুরী শুধু বিষণ্নমুখে বলেন, "আহ, কাবুল! মুরগির মাংস সে বড় ভালোবাসতো। আমি আজও ভেবে পাই না, কেন সে ওরকম কাঁচা বয়সে হার্ট অ্যাটাক করে মরলো ...।"
মন্তব্য
অ্যা!
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। এ চৌধুরী সে চৌধুরী নন।
হাঁটুপানির জলদস্যু
বাকিটা কই?
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
হা হা হা.. বেড়ালের ব্যাপারে যা চিন্তা করছি, তাই যদি হয় তাহলে দারুন মজার গল্প হবে এটা!!
অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী পর্বের।
কি মাঝি? ডরাইলা?
"কীসের বেড়াল?"
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'
নড়েচড়ে বসলাম। চলুক চলুক।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
শেষ।
হাঁটুপানির জলদস্যু
হুম, আমি যা চিন্তা করেছিলাম তা হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে সেটাও অসাধারণ হয়েছে।
কি মাঝি? ডরাইলা?
ধন্যবাদ! বাকি অসমাপ্ত গল্পগুলিও শায়েস্তা করবো ভাবছি।
হাঁটুপানির জলদস্যু
সে অপেক্ষাতেই আছি।
কি মাঝি? ডরাইলা?
কি রে তুই নাকি দেশ ছাইড়া পালাইছোস?
------------------------------------
আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।
হ। স্যুটকেসের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে পলায়ন।
হাঁটুপানির জলদস্যু
নতুন মন্তব্য করুন