১.
কেওকারাডং থেকে ফিরে এসে EXPLORERS' CLUB OF BANGLADESH-এর সদস্যদের নানা বিচিত্র উপসর্গ দেখা দিলো। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খামোকাই শহরময় হেঁটে বেড়ান, কেউ উঁচু বিল্ডিং দেখলে সেটার পাইপ বেয়ে ওঠা যায় না সেটা নিয়ে গুরুতর চিন্তাভাবনা শুরু করে দেন --- সবমিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। তাই এইসব বদ লক্ষণ ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্যে ক্লাব কর্তৃপক্ষকে আরেকটা অভিযানের আয়োজন করার উদ্যোগ নিতেই হলো। এবার আর উল্লম্ব নয়, সমান্তরাল।
ক্লাবের সাপ্তাহিক আড্ডায় এ ব্যাপারে কী করা যায়, তা নিয়ে একদফা তর্কবিতর্ক হয়ে যাবার পর হঠাৎ এক বিকেলে উপস্থিত হলেন ওয়াহেদ ভাই, একা একা ট্রেকিং করা যাঁর বদস্বভাব। তাঁর বিস্তারিত পরিচয় গোপন রেখে বলছি, তিনিই মিলন ভাই আর হিমুর মাথায় নতুন খেয়াল চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় মোটামুটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, ক্লাবের সদস্যরা টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেকিং করতে যাবেন।
ECB সদস্যদের বয়স আট থেকে আটাশির মধ্যে, স্কুলের ছাত্র থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, সবাই আছেন। হিসেব কষার পর পরিস্থিতি দাঁড়ালো এমন, ঈদের রাতে ঢাকা ছাড়লে সব মিলিয়ে দিন পাঁচেক ছুটি সবাই ম্যানেজ করতে পারবেন। এ নিয়েও বিস্তর তর্কবিতর্ক হলো পরবর্তী মিটিঙে। ঈদের রাতের পক্ষেই বেশির ভাগ সদস্য ভোট দিলেন, কারণ এক্ষেত্রে টিকেটের জন্যে তিন মাইল লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে চুলোচুলি করতে হবে না, আর সবাই অর্ধেকটা ঈদ ঢাকায় কাটিয়ে যেতে পারবেন।
সভা শেষে জানা গেলো, চৌদ্দ জনের মতো যাবেন এই যাত্রায়। বাকিরা হয় ছুটি ম্যানেজ করতে পারছেন না (যেমন উচ্ছল), অথবা নতুন বিয়ে করেছেন, শ্বশুরবাড়ির অনুমতি যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব (যেমন শিবলি), অথবা কোন কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছেন (যেমন শান্ত)। কাজেই এঁদেরকে তালাক দিয়ে বাকিরা গাঁটরিবোঁচকা বাঁধা শুরু করলেন।
ঈদের তারিখ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কুতকুত খেলায় সারা দেশের মানুষই সমস্যার মুখে পড়েছিলেন, তবে ইসিবি সদস্যরা এই ঝামেলার মুখোমুখি পড়েন নি। কুঁড়ের বাদশা হিমুর ঘাড়ে টিকেট বুক করার দায়িত্ব পড়েছিলো, সে গড়িমসি করতে করতে ঈদের চাঁদ-এর পাকা দেখা হয়ে গেলো। জানা গেলো, তেরো নয়, বারো তারিখেই ঈদ।
বারো তারিখ রাতে কমলাপুরে বাস কাউন্টারে এক এক করে হ্যাভারস্যাক কাঁধে নিয়ে জড়ো হলেন সবাই। কেওকারাডং-এ অনেকেই একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে নাকানিচোবানি খেয়ে এসেছেন, কাজেই এখানে সবাই যতদূর সম্ভব কম বোঝা নেয়ার ব্যাপারে মন দিয়েছেন। তবুও দেখা গেলো, একেবারেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হ্যাভারস্যাকের ওজনটা নেহায়েত মন্দ হয়নি। এবার সবচে ভারি বোঝা শাহুলের ঘাড়ে, আর সবচে হালকা মিলন ভাই, একটা ডেনিমের জ্যাকেট সম্বল করে বেড়িয়ে পড়েছেন তিনি। আর শেষ পর্যন্ত অভিযাত্রীর সংখ্যা সতেরো, যোগ দিয়েছেন পারভীন আপা, চঞ্চল আর ফাইয়াজ।
রাত সোয়া দশটায় শুরু করে ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছে গেলো বাস। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, দ্রুত কিন্তু নিরাপদ গতিতে ছুটেছে বাস। শুরুতে কয়েকজন প্রেতসংক্রান্ত গল্পগুজব করে রাতের অন্ধকারটাকে একটা সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ক্লাবের কিছু সদস্য যে কোন পরিস্থিতিতে ঘুমিয়ে পড়তে সক্ষম, তাঁরা স্বল্প পরিসরেই চাদর মুড়ি দিয়ে জটিল ঘুম দিয়ে তাজা হয়ে গেছেন। আর যারা নিদ্রাবিলাসী, চার পাঁচটা বালিশ আর শ'খানেক বর্গফুট জায়গা ছাড়া ঘুমাতে পারেন না, তাঁরা ভুগেছেন। আর কয়েকজন অসীম সাহার কিশোর জানে না কবিতার সেই বিষণ্ন কিশোরের মতো অন্ধকারে জেগে জেগে রাত্রির ঘ্রাণ শুঁকে কাটিয়ে দিয়েছেন। আর সারাটা পথ যাচ্ছেতাই রকমের বাজে আধুনিক বাংলা গান শুনতে শুনতে একেকজনের অবস্থা আরো কাহিল, গানের সুর আর কথার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন তাঁরা, এবং এসব গানের গীতিকার ও সুরকারকে হাতের কাছে পেলে কিঞ্চিৎ লাঠ্যৌষধি শাসনম-এর বন্দোবস্ত করা যায় কি না, তা নিয়ে ভেবে দেখেছেন।
এ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটু চোখ এবং পা বুলিয়ে আসা হবে। ক্লাবের অন্যতম হন্টক (যিনি কষা হাঁটতে পারেন) মহাকাশ মিলন ভাই তখন জানালেন, কঙ্বাজারে তিনি কিছু কাজ সেরে যেতে চান, অতএব তিনি অন্যান্যদের সাথে সন্ধ্যেবেলা টেকনাফে মিলিত হবেন --- আসল কথা হচ্ছে সেন্ট মার্টিন মিলন ভাইয়ের আগাপাস্তলা দেখা আছে, রোদে ঘুরঘুর না করে একটু গড়িয়ে নিতে চান তিনি। তবে তাঁর এ প্রস্তাবে গররাজি হবার কিছু নেই, কাজেই মিলন ভাইকে তিনটি চকোলেটসহ বিদায় জানানো হলো। বাস্তবিক, তিনটে থেকে একটা বেছে নিতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু মিলন ভাই কোনটা ফেলে কোনটা বাছবেন বুঝতে না পেরে সবক'টাই গাপ করেছেন।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফের বাস ছাড়লো সাড়ে ছ'টার সময়। একঘন্টা সময় বাস স্টেশনেই পায়চারি করে কাটাতে হলো সবাইকে। তবে এর মধ্যে একটু এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে হালকা হয়ে এসেছেন অনেকেই। সাড়ে আটটা নাগাদ বাস থেকে টেকনাফের সী-ট্রাক ঘাটের কাছে সবাই নেমে পড়লেন। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের রাস্তা একটু খারাপ, কড়া রোদ সরাসরি চোখে পড়ায় অনেকেরই মাথা ধরে আছে, আর এই বাসের আধুনিক বাংলা এবং অত্যাধুনিক হিন্দি গানের অবস্থা আরো খারাপ। পাতলি কমর তিরছি নজর ছাড়া এরা আর কিছু বোঝে না।
সী-ট্রাক টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। ঘাটে নেমে টিকিট কাটার পর সবাই আবার সিদ্ধান্ত নিলেন, হ্যাভারস্যাকগুলোকে মিছিমিছি সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। অতএব সেগুলোকে কয়েকজন গিয়ে হোটেল ভাড়া করে রুমবন্দী করে আসুক, আর বাকিরা ঘাটে বসে ঝিমাক। এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে কয়েকজন তৎক্ষণাৎ একটা স্কাউট দল তৈরি করে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে চড়ে বসলেন। ঘাট থেকে টেকনাফ শহরের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার, এটুকু পথ এত বোঝা নিয়ে হাঁটতে কেউ রাজি নন।
টেকনাফে হোটেল খোঁজাখুঁজির ঝামেলা থেকে রেহাই দিলো মাইক্রোবাসের ড্রাইভার। সে সুড়ুৎ করে বিনা উসকানিতে হঠাৎ একটা সুদৃশ্য হোটেলের সামনে হাজির করলো স্কাউট দলকে, বোঝা গেলো, বিশেষ বন্দোবস্তের অধীনেই তার এই বদান্যতা।
হোটেলের নাম, ধরা যাক, হোটেল অমুক। মাঝবয়েসী হোটেল ম্যানেজার কঠোর চেহারা করে অভ্যর্থনা জানালেন অভিযাত্রীদের। ইকবাল আর শাহেদ ভাই দোতলায় উঠে রূমগুলো ঘুরে ফিরে দেখতে গেলেন, ফরিদ ভাই আর হিমু দর কষাকষির দায়িত্ব নিলেন। এ পর্যায়ে ম্যানেজারের সাথে কিছুটা মন কষাকষিও হলো, কারণ বেচারা কিছুতেই ভাড়া সম্পর্কে মুখ খুলবেন না, বিনা আলাপেই অভিযাত্রীদেরকে তিনি নিজের হোটেলে অতিথি করে রাখতে চান। শুধু তাই না, তিনি জানালেন, সী-ট্রাক সাড়ে দশটার আগে কিছুতেই ছাড়বে না, কাজেই দর কষাকষির জন্যে তাদের হাতে এখনো ঘন্টা দেড়েক সময় আছে। তবে যাই হোক, শাহেদ ভাইয়ের ত্বরিৎ হস্তক্ষেপে দশ মিনিটের মধ্যেই বিভিন্ন আকারের পাঁচখানা রূম রফা হলো ষোলোশো টাকায়। একটা রূমে সব লাগেজ রেখে খানিকটা ফ্রেশ হয়ে আবার ঘাটে ফিরে এলেন সবাই।
এসে সবার আক্কেল গুড়ুম, সী-ট্রাক বোঝাই লোকজন, বসার কোন জায়গা নেই, মোটামুটি আড়াই ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সবাইকে। হিমু আবার কোত্থেকে একটা অর্ধেক লাইফজ্যাকেট যোগাড় করে গায়ে এঁটে বসে আছে, সী-ট্রাকের যাত্রীরা এ নিয়ে কিছুক্ষণ বিমলানন্দ ভোগ করলেন। অবশ্য সাবধানের মার নাই, কখন কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় সী-ট্রাক ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো সেটাকে গদি বানিয়ে হিমু আর চঞ্চল খুবই আরামে ঝিমাচ্ছে, আর বাকিরা হোটেল ম্যানেজারকে কষে বকাবকি করছেন ভুল তথ্য দেয়ার জন্যে। সত্যি সত্যি যদি সাড়ে দশটায় সবাই আসতেন, কপালে বিস্তর ভোগান্তি ছিলো।
নাফ নদীর সৌন্দর্য বর্ণনা আপাতত সিলেবাসের বাইরে। ক্লাবের সদস্যরা কড়া রোদে ভাজা ভাজা হয়ে চঞ্চলের বাইনোকুলার দিয়ে দু'তীরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেন। বাম পাশে মায়ানমার, ডান পাশে বাংলাদেশ। শাহপুরির দ্বীপ আর বদর মোকাম দেখতে দেখতে কাটলো বেশ কিছুটা সময়। নাফ নদীতে বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে বার্মিজ ট্রলার দেখা যাচ্ছে ঘন ঘন। একসময় নদী পেরিয়ে সাগরে পড়লো সী-ট্রাক, বাম পাশে মায়ানমারের সৈকত শেষ হয়ে গেলো হঠাৎ।
সী-ট্রাকের পরিবেশ হয়তো আরো কিছুটা ভালো হতে পারতো, কিন্তু নষ্ট মাইকে ভয়ঙ্কর শব্দ, আর কিছুক্ষণ পর পর জাহাজের সারেঙের সতর্কবাণী শুনতে শুনতে কান বিষিয়ে যাওয়ার যোগাড়। যদিও ডেকে তিলধারণের জায়গাটুকু নেই, সাগর দেখার জন্যে রেলিঙের পাশে ভিড় জমিয়েছে সবাই, নিরাপত্তার খাতিরে রেলিঙের ওপরে না বসার সৎ পরামর্শটিকে ভারি সহিংস ভঙ্গিতে দিয়ে চলছেন সারেঙ ভদ্রলোক। মহাত্মা গান্ধী বেঁচে থাকলে তার সাথে সারেঙের মতের খুবই অমিল হতো, সন্দেহ নেই, সাবমেরিনের ক্যাপ্টেনও বোধহয় অতোটা বদমেজাজি হয় না। ওদিকে সাগরে কিছুক্ষণ পর পর ডাইভ দিচ্ছে ডলফিন, হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক, দু'তিনবার পানির ওপর জেগে থাকা তীক্ষ্ণ ফিন দেখে কয়েকজন সেগুলোকে হাঙরের আলামত হিসেবে শনাক্ত করলেন। চারপাশে অলস উড়ে বেড়াচ্ছে সাদাকালো শঙ্খচিল। মাছ ধরা সাম্পান আর ট্রলার দেখা যাচ্ছে অহরহ। পানির রঙ চারদিকে মিষ্টি নীলচে সবুজ, শুধু যেখানে সমুদ্রে চর জাগছে, সেখানে পানির রঙ ফ্যাকাসে সাদা।
সারেঙের ঝাড়ি খেতে খেতে কাহিল হয়ে একসময় সেন্ট মার্টিনে নামলেন সবাই। হলদে গরম বালি পার হয়ে হুড়োহুড়ি করে বাজারে পৌঁছে খাবার দোকানের সামনে ভিড় জমালেন প্রতিটি অভিযাত্রী। বিশাল আকারের সব গলদা চিঙড়ি, যেগুলোর মধ্যে কোন গলদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, বরং দেখলেই জিভে জলোচ্ছ্বাস হয়, ডালিতে সাজিয়ে বিভিন্ন দোকানে উদ্যোক্তারা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। কেবল দৃষ্টি নয়, পর্যটকদের পকেটের প্রতিও তাদের আকর্ষণ প্রবল, নিউটনের সূত্রকে একটি মাঝারি আকারের কাঁচকলা দেখিয়ে তারা নাগালের বাইরে এমন সব দাম হেঁকে চলেছেন যে চটজলদি মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করছেন সকলে। সে সব মূল্যের কথা শুনে অভিযাত্রীদের জিভের জল চোখে উঠে যাওয়ার শামিল। তবে দুই বিঘত লম্বা একজোড়া নীল গলদা চিংড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার প্রলোভন সামলাতে পারলেন না বরুণদা। চিংড়ি দুটো বয়সে মুরুব্বি, কারণ অনেক বছর না বাঁচলে এদিককার পানিতে গলদা চিংড়ি এতো বড় হতে পারে না।
ঢাকা ছেড়ে আসার পর কারো পেটেই দানাপানি পড়ে নি, খিদেয় অন্তরাত্মা চোঁ চোঁ করছে, কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই চিংড়ির আশা বঙ্গোপসাগরে জলাঞ্জলি দিয়ে সবাই একটি মাছিবহুল ছাউনির নিচে কড়কড়ে ভাত আর কড়া রূপচাঁদা ভাজা খেতে বসে গেলেন। ভাত আর রূপচাঁদার বয়স নিয়ে কয়েকজন সন্দেহ পোষণ করলেও খিদের মুখে আপত্তি করার জোরালো কোন কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো না, কারণ সব দোকানেই মাছগুলোকে জান বাজি রেখে ঘোলা তেলে কষে ভাজা হয়। কেউ কেউ ডাল দিয়ে খাবারে একটু কোমলতা আমদানি করার জন্যে ফরমায়েশ দিলেন। ডাল নামক বস্তুটি আসার পর দেখা গেলো, সেটাতে ডাল, মশলা আর তেল, সব কিছু আলাদা করে শনাক্ত করা যাচ্ছে। ডালের রাঁধুনি অত্যন্ত উদার মনের মানুষ, ডালের সাথে ডালের রেসিপিও সরবরাহ করেছেন তিনি, কোন উপাদান যাতে বোধের অতীত হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন তিনি।
ভাত খেয়ে ডাবের দোকানের সামনে হুটোপুটি করে ডাব খেয়ে সবাই হাঁটা শুরু করলেন দ্বীপের অন্য প্রান্তের দিকে। দ্বীপটির মাঝে বেখাপ্পা শানবাঁধানো পথ, রীতিমতো বিশ্রী দেখতে। অধিবাসীরা উৎসুক চোখে অভিযাত্রীদের পরখ করতে করতে চলেছে। সেন্ট মার্টিনে মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক, এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক অপশক্তির কান্ডকারখানা সেখানে প্রকট, ছোট ছোট নমুনা হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে। দ্বীপের ওদিকটায় প্রবাল সৈকত, প্রাক্তন কথাসাহিত্যিক ও বর্তমান চলচ্চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের একচালা ছিমছাম কুঁড়েটি সেখানে হাঁটু ভেঙে দ হয়ে পড়ে আছে। সৈকতের সে অংশে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি আর হুটোপুটি করে, সেইসাথে স্থিরচিত্রে নিজেদের অক্ষয় করে রাখার স্বাভাবিক প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে আবার সী-ট্রাকের দিকে এগিয়ে চললেন সবাই। পারভীন আপা পানির পোকা, সাগরে শুয়ে একখন্ড প্রবালের ওপর মাথা রেখে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি, তাঁকে প্রায় একরকম ধমকে সাগর থেকে তুলে আনা হলো। ফেরার পথে কয়েকজন হেঁটে ফিরলেন, কয়েকজন ফিরলেন ভ্যানরিকশায় চড়ে।
আবার সী-ট্রাকে চড়তে হবে ভেবেই সবাই মুষড়ে পড়লেন। এবং গোদের ওপর বিষফোঁড়া, সেটাতে চড়ার দশ মিনিটের মধ্যে সী-ট্রাকের প্যাকেজ প্রোগ্রামের শিকার কয়েকজন মানুষ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে ঝগড়া শুরু করলেন। বিকেলের রোদে সবাই সেদ্ধ, পাশে আবার কয়েকজন কাচ্চু খেলোয়াড় খুবই উল্লাসের সাথে তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, আর সামনে এই বিতর্ক --- অতিষ্ট হয়ে খেলাধূলা শুরু করলেন ক্লাবের সদস্যরাও। মনে মনে কোন একটা জন্তুর নাম ভাববেন একজন, বাকিরা দশটা প্রশ্ন (যার উত্তর কেবল হ্যাঁ কিংবা না) করে সেটার পরিচয় উদ্ধার করবেন। এমনি করে গরু, মানুষ, ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি দুরূহ সব জন্তুর নাম উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে সবাই যখন ইস্তফা দিতে যাচ্ছেন, তখন শোনা গেলো টেকনাফ আর বেশি দূরে নেই।
টেকনাফ পৌঁছুতে হবে হেঁটে। সবাই হাত পা খানিকটা খেলিয়ে শুরু করলেন হাঁটা। সাত কিলো পিচের রাস্তা পার হতে দেড় ঘন্টার মতো লাগবে। শেষ বিকেলের খানিকটা আলো তখনও আছে, চঞ্চল তার ক্যামেরা বের করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সী-ট্রাকেও পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফি নিয়ে গলদঘর্ম ছিলো বেচারা। বাকিরা কেউ কেউ গল্পগুজব করতে করতে হাঁটছেন, কেউ ঢিল ছুঁড়ে জংলি বড়ই গাছ থেকে পেড়ে খাচ্ছেন। এমনি করে সন্ধ্যে নেমে এলো, হোটেলে পৌঁছে সবাই বাথরুমে ছুটলেন। সবাই বালি আর নোনা বাতাসে মাখামাখি।
মিলন ভাই হাজির হলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। কঙ্বাজারে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে নিয়েছেন তিনি, সেখানে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কিছু অফিশিয়াল কাজও শেষ করে এসেছেন। ভারি সুখী সুখী চেহারা তাঁর, আর সবার এদিকে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে অবস্থা ভূতের মতো। যাই হোক, হোটেল অমুক সংলগ্ন রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেন সবাই। সেখানে খাবারদাবারের মান নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো, তবে সেন্ট মার্টিনের চেয়ে ভালো। খাওয়াদাওয়া শেষে কেউ কেউ গেলেন নাফের সৈকতে হাঁটতে, কেউ ঘরে ফিরলেন আর কয়েকজন গেলেন পরদিনের জন্যে বিস্কুট আর জেলি কিনতে। মিলন ভাই নাফের পারে বসে কিছুক্ষণ তারা চেনালেন, কিন্তু একই তারা রোজ রোজ দেখে সবাই বিরক্ত, তাছাড়া এক রাতে পাঁচটার বেশি তারা মিলন ভাই কখনোই শনাক্ত করতে পারেননি, তাই সবাই আবার হেঁটে হেঁটে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। হোটেলে ফিরে সবাই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন।
২.
পরদিন সকালে মোটামুটি সবাই হাঁটার জন্যে প্রস্তুত। তবে অনেকে রাতে বাসের সেই বাংলা গানগুলো স্বপ্নে দেখে আঁতকে উঠেছেন, ড়িদয়ে যাতনা তবু করিনি আপোষ --- হবো হবো না আমি তোমার পাপোষ --- ইত্যাদি ইত্যাদি। পারভীন আপা শব্দ হলে ঘুমাতে পারেন না, তাঁর পাশের ঘরে কে নাকি ভোর চারটা পর্যন্ত হৈচৈ করেছে, কাজেই তিনি খুবই ক্লান্ত।
সোয়া ছয়টার মধ্যে নাস্তা আর লবণাক্ত চা (হোটেল অমুকের চিনিও লবণের মতো নোনতা) খেয়ে সবাই পথে নেমে এলেন। চঞ্চলের সৌজন্যে সবার মুখে চকলেট। হোটেল থেকে টেকনাফ বীচ চার কিলো, সবাই জোর কদমে হাঁটা শুরু করলেন। ঈদের ছুটির ভোর, টেকনাফের পথঘাট নির্জন, দীঘল ইঁট বিছানো পথে এক্সপ্লোরারস ক্লাবের সদস্যরাই হেঁটে চলছেন সৈকতের দিকে। পথে খেত থেকে শসা কিনে খেতে খেতে এক ঘন্টার মধ্যে বীচে পৌঁছে গেলেন সবাই। এর মাঝে পুতুল আপা এক স্থানীয় বেয়াদব পিচ্চিকে কড়া শাসন করেছেন, কৌশলে আঞ্চলিক ভাষায় সবাইকে মশলামাখা গালিগালাজ করে যাচ্ছিলো অপোগন্ডটা, আর চঞ্চল বেশ কিছু ছবি তুলেছে।
আকাশের মুখ গোমড়া, সূর্য লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে, সাগরে পদধূলি বিসর্জন দিয়ে সৈকতে একগাদা সাম্পানের সামনে অফিসিয়াল চিত্রগ্রহণের পর সবাই শুরু করলেন হাঁটা। বামে সমুদ্র, ডানে পাহাড়সারি, সামনে আদিগন্ত সৈকত। সবকিছু মিলিয়ে ভারি মনোরম দৃশ্য।
হাঁটতে হাঁটতে বালিতে কাঁকড়ার নকশা আর ঝিনুক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। কাঁকড়ার এই নকশাগুলো নাকি জহুরীরা সংগ্রহ করে নিয়ে যান সোনার গয়না বানানোর জন্যে। আরো খানিকটা হেঁটে দেখা গেলো জেলি ফিশ, সিন্ধুকচ্ছপের খোলা, তন্দ্রাচ্ছন্ন সামুদ্রিক সাপ আর বালিতে চাঁদের গাড়ির ট্র্যাক। উল্টো দিক থেকে ফিরছে মালবোঝাই একটা জীপ, অভিযাত্রীদের ভালো করে দেখতে ড্রাইভার জানালা দিয়ে কোমর পর্যন্ত শরীর বের করে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর অভিযাত্রীদের সঙ্গ নিলো একটা কুকুর। বয়স হয়েছে কুকুটার, শরীরে বেশ কিছু জায়গায় লোম পড়ে গেছে, মাথায় বাসি ক্ষতচিহ্ন। কিন্তু মিলন ভাই বিস্কুট খাইয়ে সেটার সাথে দোস্তি করে ফেললেন, মহা উৎসাহে সবার আগে আগে ছুটতে লাগলো সে। চারুকলার সজীব তার স্কেচের খাতা সাথে নিয়ে এসেছে, কিছুক্ষণ পর পরই খাতা খুলে ধ্যানস্থ হয়ে যাচ্ছে সে। ঘন্টাখানেক হেঁটে সবাই বালির ওপর দাঁড় করানো কয়েকটা সাম্পানে চড়ে বসলেন। ডাব খাওয়ার বিরতি। ডাব আসতে আসতে আধঘন্টার মামলা, এর মধ্যে হালকা গল্পগুজব চলতে লাগলো। পারভীন আপার ঘুম হয়নি রাতে, তিনি খুবই নাজেহাল হয়ে পড়েছেন, একটা চাঁদের গাড়ি থামিয়ে তাঁকে তুলে দেয়া হলো মনখালির উদ্দেশ্যে। বাকিরা আবার শুরু করলেন হাঁটা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলন ভাই চোখের আড়াল হয়ে গেলেন, জোর হাঁটা শুরু করেছেন তিনি, মনখালিতে পৌঁছে পারভীন আপাকে খুঁজে বের করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে, সৈকতের ওপর একটু পর পর ছুটে চলেছে চাঁদের গাড়ি, মাইকে চারদিক কাঁপিয়ে স্থানীয় ভাষায় প্রার্থীদের প্রচার চলছে। একটু পর পর দেখা যাচ্ছে স্থানীয় মহিলাদের, ঝিনুক কুড়িয়ে গুঁড়ো করছেন তারা। পোলট্রি ফিড হিসেবে ঝিনুকের গুঁড়ো খুবই উত্তম।
পথে আরো কয়েক জায়গায় ছোট ছোট বিরতি নিয়ে গল্পগুজব করতে করতে এক সময় দুপুরের খাবারের জন্যে সবাই জড়ো হলেন বড্যিল বাজারে। টেকনাফ থেকে প্রায় ষোল কিলো দূরে জায়গাটা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, আকাশ তখনও বিষণ্ন। এর মধ্যে চঞ্চল একটা কাঁকড়া শিকার করেছে, সেটাকে ভেজে খাওয়ার দুরভিসন্ধি তার। অভিযাত্রীরা বেশ কিছু বিচিত্র নকশাওয়ালা বিশাল সবুজ কাঁকড়া দেখেছেন পথে, তবে সেগুলোকে পাকড়াও করা হয়নি। বড্যিল বাজারে কেউ কেউ হালকা ঘুম দিলেন, সামিয়াকে দেখা গেলো বেশ কিছু শিশু-ফ্যান যোগাড় করে তাদের ন্যায়শিক্ষা বা ফ্যাশনশিক্ষা এই গোছের কিছু একটা লেকচার দিতে, আর এক দোকানে ঢুকে নাজমুল ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন হূলস্থূল খিচুড়ি রান্না করে ফেললেন। এই খিচুড়ি খেয়ে তৎক্ষণাৎ ক্লাবের বাবুর্চি পদে ওয়াহিদ ভাইয়ের পাশাপাশি নাজমুল ভাইকেও আসীন করা হলো।
বড্যিল বাজার পর্যন্ত স্থানীয় জনতা অভিযাত্রীদের যেসব প্রশ্ন করেছেন, সেগুলো হচ্ছে, তারা এদেশের লোক না, মুসলমান না, কেন এত ভালো চাঁদের গাড়ির সার্ভিস থাকতে তারা কষ্ট করে পায়দল চলছেন, তাদের দেশের বাড়ি কোথায়, তারা হেঁটে হেঁটে কতদূর যাবেন ইত্যাদি। ক্লাবের সদস্যাদের শার্টপ্যান্ট পরে হাঁটতে দেখে স্থানীয় মৌলানা আল্লার গজব নেমে এসেছে বলে রায় দিয়ে ফেলেছেন। যদিও অনেকের ধারণা, এটা আসলে স্থানীয় বাকরীতিতে অকুন্ঠ প্রশংসা।
ঢেঁকুর তুলতে তুলতেই আবার সৈকতে নেমে এলেন সবাই। মনখালিতে গিয়ে থামবে গোটা দলটা, আরো অনেক পথ বাকি, মাত্র দুই পঞ্চমাংশ পার হয়েছে। চলতে চলতে কিছুদূর গিয়ে জেলেদের মাছধরা দেখার জন্যে থামলেন সবাই। বিশাল এক জাল সমুদ্রে সাম্পানে করে ফেলে আসা হয়, জোয়ারের সময় সেই জাল ডাঙা থেকে বিশ-পঁচিশজন মিলে টেনে তুলতে হয়। ভারি চমৎকার একটি দৃশ্য, কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন সৈকতে দু'টি মৃত তিমির বাচ্চা পাওয়া গেলো, সবার মনই খারাপ হয়ে গেলো। স্থানীয় জেলেরা লগা মাছ বলে চেনে এদের, ডলফিন আর তিমি মাছ তারা সাধারণত ধরে না, এ দু'টি মাছ নাকি দুর্ঘটনাবশত তাদের জালে ফেঁসে গেছে। এবং আরো মুশকিল হচ্ছে, এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কী আর করা, মৃত তিমিশিশু দুটির পাশে বসে থমথমে মুখে ছবি তুলে, সে দু'টিকে পানিতে বিসর্জন দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন সবাই। শঙ্কর প্রজাতির একটা মাছ আর ক্ষুদে স্কুইড ছাড়া আর তেমন কোন বিশেষ মাছ জেলেদের ঝুড়িতে ওঠেনি।
স্থানীয় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শহীদউল্লাহ সাহেব চাঁদের গাড়িতে করে নির্বাচনী কাজে যাচ্ছিলেন, তিনি নিজের উদ্যোগে শামলাপুরে অভিযাত্রীদের আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে গেলেন। তাঁর রেফারেন্স চিঠিসহ অভিযাত্রীরা আবার হাঁটা শুরু করলেন। কিছুদূর যেতে না যেতেই মোক্তার ভাই মোটর সাইকেলে চড়ে উপস্থিত, শামলাপুরে ট্রেকারদের সহযোগিতা করার দায়িত্ব শহীদউল্লাহ সাহেব এঁকেই দিয়েছেন। শামলাপুরের কাছে সৈকতে তিনি উপস্থিত থাকবেন, এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি দক্ষিণ দিকে চলে গেলেন আবার।
কিছুদূর গিয়ে দেখা গেলো, সামনে গোটা সৈকত টকটকে লাল, যেন কেউ আবীর ছড়িয়ে রেখেছে। কাছে গিয়ে দেখা গেলো হাজারে হাজারে লাল কাঁকড়া গর্ড় ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। অভিযাত্রীদের উপস্থিতি টের পেলো তারা সহজেই, অনেকে বিস্তর ছুটোছুটি করেও তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারলেন না। শাহুল আর চঞ্চল অনেক ছবি তুলেছে এর মধ্যে।
ফরিদ ভাই ঢাউস এক বয়াম জেলি নিয়ে ঘুরছিলেন, সন্ধ্যে নামার আগে আগে ক্যানভাস বিছিয়ে বসে সেটাকে বের করে বিস্কুটে মাখিয়ে খেয়ে নিলেন সবাই। জেলিটাই ফরিদ ভাইয়ের সবচে বড় বোঝা, সেটাকে খতম করায় তিনি আনন্দে একেবারে উলু দিয়ে উঠলেন। আবার হাঁটা শুরু করার পর দেখা গেলো, ভর কমে যাওয়ায় ফরিদ ভাইয়ের বেগ অসাধারণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেলেন তিনি।
সূর্য ডুবে যাওয়ার পর চাঁদের আলোয় কয়েকটা খাল পার হয়ে ঘন্টাখানেক সৈকতে হাঁটার পর মোক্তার ভাইয়ের দেখা মিললো আবার, তাঁর পিছু পিছু শামলাপুর বাজারে পৌঁছালেন সবাই। সৈকতের ভেজা বালিতে হাঁটা মোটামুটি কষ্টসাধ্য কাজ, আর শামলাপুর যেতে হলে ঝুরঝুরে নরম বালির ওপর দিয়ে এক কিলো হাঁটতে হয়। কাজেই হয়রান হয়ে অবশেষে সবাই শামলাপুর পৌঁছে কোনমতে একটা চায়ের দোকানে হ্যাভারস্যাক খুলে বসলেন। আর হ্যাঁ, মিলন ভাই সে দোকানে ভারি তৃপ্ত চকচকে মুখে চা খাচ্ছেন কয়েকজন মুরুবি্বর সাথে। শামলাপুরে মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে, কয়েকজন গেলেন ফোন করতে, বাকিরা স্থানীয় জনতার কৌতূহল নিবারণের ভার নিলেন।
ঢাকায় উৎকন্ঠিত স্বজনদের সাথে যোগাযোগ সেরে ফিরে মিলন ভাইয়ের কাছ থেকে যা জানা গেলো, সেটা হচ্ছে, মনখালিতে বন বিভাগের রেস্টহাউসে রাত্রিনিবাসের বন্দোবস্ত হয়েছে। মিলন ভাই বিকেলে পৌঁছেছেন মনখালিতে, টানা হেঁটেছেন তিনি, স্থানীয় ইমাম তাঁর মেজবান হয়েছেন। পারভীন আপা সেই সকালে মনখালি পৌঁছে জনৈক সাংবাদিকের মেহমান হয়েছেন, তিনি সারাদিন এই এলাকায় শ'দেড়েক শিশু-ফ্যান জুটিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, একটা প্রেস কনফারেন্স পর্যন্ত করে ফেলেছেন। স্থানীয় জনতা তাঁর বেশভূষা দেখে সিদ্ধান্তে এসেছে, তিনি খ্রিষ্টান, এবং তাঁরা মোটেও সন্তুষ্ট নয়, কারণ পারভীন আপার শিশু-ফ্যানদের ভাড়া করা হয়েছিলো নির্বাচনী প্রচারণার কাজে, তারা সেটিতে ইস্তফা দিয়ে পারভীন আপার পিছু পিছু ঘুরেছে সারা দিন। আর হ্যাঁ, মিলন ভাইয়ের দোস্তান সেই কুকুরটাও তাঁর সাথে সাথে মনখালি পর্যন্ত চলে এসেছে।
শামলাপুরের অধিবাসীরা মেরিন ড্রাইভের ব্যাপারে পত্রিকায় জোর লেখালেখির কাতর অনুরোধ জানালেন। তাঁদের অর্থনৈতিক সক্রিয়তা এই পথের কল্যাণে বহুদূর বৃদ্ধি পেতে পারে। এই এলাকায় সামুদ্রিক পণ্যের উৎপাদন প্রচুর, কিন্তু পরিবহনের কাজটি যথেষ্ঠ জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে যথেষ্ঠ পরিমাণে অর্থনৈতিক অগ্রগতি তাঁদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে তাঁরা বিষণ্ন মতামত জানালেন। মনখালিতে পৌঁছানোর জন্যে একটা খাল পার হতে হলো একটা নাজুক চেহারার ডিঙি নৌকোতে চড়ে। পারাপারের আগে মাঝখালে নৌকোটাকে ডানে বামে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সেটার খোলে জমে থাকা পানি ফেলে দেয়া হলো, এই অভিনব দৃশ্য দেখে কয়েকজনের আত্মারাম খাঁচার দরজা ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। এঙ্প্লোরারস' ক্লাব অব বাংলাদেশের সদস্যদের নৌকাভাগ্য খুব একটা ভালো না, এর আগে সাঙ্গু নদীতে রুমাঘাটে তাঁদের কয়েকজন নৌকাডুবির শিকার হয়েছিলেন, তবে এবার উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ছাড়াই তাঁরা পার হয়ে গেলেন, মোক্তার ভাইয়ের সৌজন্যে। শামলাপুরের মানুষেরা মেজবান হিসেবে অসাধারণ, তাঁরা খুব যত্নে অভিযাত্রীদের এগিয়ে দিলেন মনখালি রেস্টহাউস পর্যন্ত, প্রায় দু'কিলো পথ।
রেস্টহাউসে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই প্রায় সবার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লো ক্লান্তি। চলি্লশ কিলো পথ বালির ওপর দিয়ে হেঁটে এসে অনেকেই কাবু। হাতমুখ ধুয়ে এসে ব্যান্ডএইড আর মালিশ নিয়ে বসলেন সবাই। যারা কিছুটা চাঙা, তাঁরা স্থানীয় বাজারে গরম পানির সন্ধানে বেরোলেন, কফি বানিয়ে খাবেন।
রান্না হতে অনেক দেরি, সারাদিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যে বসলেন সবাই। গল্পের পাশাপাশি মালিশও চলতে লাগলো। মিলন ভাই তার সারমেয় সফরসঙ্গিনীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কুকুরটা নাকি তাঁর সব কথা বোঝে এবং মেনে চলে। তবে খাল পার হওয়ার সময় সে নৌকার ওপর ভরসা করে নি, সাঁতরে পার হয়ে এসেছে। কুকুরটার নাম দেয়া দরকার, আর মিলন ভাইকে নামকরণের দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি লুব্ধক অগস্ত্যমুনি গোছের নাম রেখে দেবেন। কিন্তু জানা গেলো মিলন ভাই সেটার নাম লালি রেখে আকিকা দেয়ার খায়েশ পোষণ করছেন। তবে হিমু প্রতিবাদ জানালো, কুকুরটা বাদামী, লাল নয়, কাজেই নাম রাখা হলো বালি। কুকুরের বয়সে বালি অনেক সিনিয়র, অনেকে তাকে বালি আপা ডাকা শুরু করলো।
একসময় আলুভর্তা, মুসুরির ডাল আর ভাত খাওয়ার আহ্বান এলো, সবাই হুড়মুড় করে ছুটে গেলেন। খাওয়াদাওয়ার পর স্থানীয় সাংবাদিক ইনানীর কাছে মোহাম্মদশফিরবিল এলাকায় কানারাজার গুহার রোমহর্ষক গল্প শোনালেন। সেই গুহায় নাকি ভয়ঙ্কর এক অজগর বাস করে, বার্মা মুলুকের এক সময়ের দসু্য কানা রাজার গুপ্তধন সে পাহারা দেয়। পাকিস্তান আমলে তিন সরকারী অফিসার সেই গুহায় ঢুকে স্বচক্ষে সেই সাপকে দেখে এসেছেন। তারপর থেকে সেই গুহায় আর কেউ ঢোকে না। সঙ্গত কারণেই ঠিক করা হলো, অভিযাত্রীদের কেউ সেখানে ঢুকবেন না। পাকিস্তান আমলের অজগর বয়সে সবারই মুরুবি্ব, তাকে না ঘাঁটানোই শ্রেয়।
খাওয়াদাওয়া সেরে হাই তুলতে তুলতে সবাই যে যার স্লিপিংব্যাগের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলেন। ভোর পাঁচটার আগে ক্লাবের অন্যতম দুই নাসিকাবীর শাহেদ ভাই আর বরুণদা ছাড়া কারো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। ফরিদ ভাই এই দু'জনের মাঝে স্যান্ডউইচ হয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলেন, কাজেই সারা রাত ভেড়া, তারা ইত্যাদির পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হলো বেচারাকে।
৩.
পরদিন সকালে হুলস্থূল কান্ড। কারোই ঘুম হয়নি ঠিকমতো, অনেকের সারা গায়ে ব্যথা, আর ফার্নিচার সরাতে গিয়ে নাজমুল ভাই ডান পায়ের নখে ভয়ঙ্কর ব্যথা পেয়েছেন। বখতিয়ার ভাই অস্ত্রোপচার করে তাঁকে মোটামুটি সাইজে আনলেন। যাবতীয় প্রভাতীকর্তব্য সেরে, উপল উপকূল রেস্টহাউস-এর দেনাপাওনা মিটিয়ে, অফিশিয়াল চিত্রগ্রহণের আড়ম্বর সেরে বেরোতে বেরোতে রোদ চড়ে গেলো। আকাশ আজ স্মিতমুখ। আজকের গন্তব্য ইনানী, বাংলাদেশের একমাত্র প্রস্তরসৈকত, এশিয়ার প্রশস্ততম সৈকত।
মনখালি সৈকতে পৌঁছোনোর পথ এক কথায় অপূর্ব। বেশ কয়েকটা লেগুন, পাশে ঝাউবন, লেগুনে বিভিন্ন ধাঁচের মাছধরা নৌকো, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটির গায়ে বর্মী হরফে আঁকিবুকি কাটা, নোঙর করা রয়েছে। এখানে বালি খুব ঝকঝকে, পানির রঙ অদ্ভূত নীল, আর আকাশও সুর মিলিয়েছে সমুদ্রের সাথে। অভিযাত্রীদের ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে উঠলো তাঁদের পায়ের সাথে।
কিছুদূর এগিয়ে ডাব খাওয়ার জন্যে একটা সাম্পানে চড়ে বসলেন সবাই। যুগে যুগে বহু জমিয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ, গোটা বছরের ডাবের দেনা এই সুযোগে মিটিয়ে নিতে চান সবাই। ঢাকায় যেমন ফোস্কাপড়া পিগমি ডাব আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হয়, তেমনটা নয়, খুবই সস্তায় প্রমাণ সাইজের ঝকঝকে ডাব মেলে এখানে। মিলন ভাই আজকে অনেকের টার্গেট। মিলন ভাই নাকি গতদিন মোটেও হাঁটেননি, অন্যেরা চোখের আড়াল হওয়া মাত্র চাঁদের গাড়িতে চেপে বসেছেন, মিলন ভাই নাকি পাঁচটা মাত্র তারার নাম জানেন, এগুলোই কুমীরের ছানার মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখান, মিলন ভাই নাকি জ্বীন সাধনা করেন --- ইত্যাদি ইত্যাদি। মিলন ভাই অবশ্য বালির ওপর শুয়ে শুয়ে বালির সাথে খেলা করছিলেন, তিনি জ্বীনসাধকদের মতো মিটিমিটি হাসেন, কিছু বলেন না।
ডাব খেয়ে পোক্ত হয়ে হাঁটার গতি বাড়ালেন সবাই। বেশ কয়েক কিলো এগিয়ে অভিযাত্রীদের যা চোখে পড়লো, সেটা একটা বিস্ময়, এবং তা পাঠকদের কাছ থেকে গোপন রাখা হলো। কেবল যাঁরা হেঁটে পৌঁছুতে পারবেন, তারাই সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের নাগাল পাবেন, বাকিদের জন্যে ঘেঁচু।
কিছুক্ষণ সেখানে উদাস মনে কাটিয়ে আবার উঠলেন সবাই। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পারভীন আপার সহকর্মী সাংবাদিক মোরশেদ ভাইকে সস্ত্রীক পাওয়া গেলো। যদিও একই দলে যোগ দেয়ার কথা ছিলো, শেষ মূহুর্তে যোগাযোগের অভাবে এঁরা দুজন দলছুট হয়ে পড়েছিলেন। তবে হাল ছাড়েননি তাঁরা, যাচ্ছেন উল্টো, অর্থাৎ হেঁটে হেঁটে কঙ্বাজার থেকে টেকনাফ। পথলব্ধ উপদেশ-পরামর্শ বিনিময় করে দু'পক্ষ দু'দিকে হাঁটা দিলেন। আজ আর গতদিনের মতো তেজ নেই কারো, বার বার বসা হলো বিশ্রামের জন্যে। পুতুল আপা স্থানীয়দের কাছ থেকে বরই কিনে খাওয়ালেন সবাইকে। রাতে ভালো ঘুম না হলে এই কড়া রোদে গতি বাড়ানো মুশকিল। অনেকের পায়ে ফোসকা পড়েছে, সেগুলো ফেটে গিয়ে জ্বলছে ভীষণ। কারো কাফ মাসল, কারো ঊরুর পেশীতে টান লেগেছে। তবে নাজমুল ভাই ব্যান্ডেজ করা পা নিয়েও চমৎকার হাঁটছেন। বালি আর মিলন ভাই নির্বিকার। বালির চারটা পা বলে তার গতিও দ্বিগুণ, আর মিলন ভাই যদিও দ্বিপদ ---।
রূপবতীতে কিছুক্ষণ প্রবাল আর সবুজ পাথরের ওপর কাটিয়ে আবার সবাই এগোলেন, কেউ একটু সামনে, কেউ একটু পেছনে। বালি এখানে খানিকটা ঘুমিয়েছে, স্থানীয় এক প্রৌঢ় তাকে পুষ্যি নিতে চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু সে ট্রেকারদের পিছু ছাড়বার পাত্রী নয়। সবাই হাঁটা শুরুর সাথে সাথে সে ঘুমটুম ফেলে দে দৌড়।
কিছুদূরে একটা বালিয়াড়ি পেরোনোর পর পেছনের দলটার সাথে বীচ প্যাট্রল (বিডিআর)-এর দেখা হলো। তারা দূরের একটা উঁচু টিনশেড দেখিয়ে বললেন, ওটা ইনানী রেস্টহাউস। সজীব আর শাহুল সাগরের মাঝে জেগে থাকা সৈকতসংলগ্ন ছোট্ট একটা ঝিকিমিকি দ্বীপে পদবালি দিয়ে এসেছে এর মধ্যে। ওয়াহিদ ভাই আর হিমু দ্বিতীয় দফা ডাব খাওয়ার তোড়জোড় করছিলেন, তবে ডাব আসতে আসতে সবাই এগিয়ে গেলেন অনেকটা। কী আর করা, শুকনো গলা নিয়ে আবার হাঁটা শুরু হলো।
কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়লো বিচিত্র দৃশ্য। দূরে একটা কিছু পড়ে আছে সৈকতে, তার একটু সামনে আরো একটা কিছু, তার কিছু সামনে আরেকটা। অনেক দূরে একটা কিছুর সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে চঞ্চল আর ফাইয়াজ। সামিয়া খুবই দুঃখ করতে লাগলো, এইভাবে সমানে তিমির বাচ্চা মারা পড়ছে দেখে, তবে আরেকটু এগোতেই বোঝা গেলো, ওগুলো মানুষের বাচ্চা --- যথাক্রমে পারভীন আপা, ইকবাল, শাহেদ ভাই ---। সৈকতে যে যার মতো চিৎপাত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
সেই দূরের টিনশেডটা আসলে বহুদূরে, সেটাকে শুরুতে যেমন ছোট দেখাচ্ছিলো, ঘন্টাখানেক হাঁটার পরও তেমন ছোটই দেখালো। তারপর একসময় যখন সেটা কাছে এলো, তখন জানা গেলো, সেটা আসলে বিডিআর-এর ফাঁড়ি। সবার মেজাজ খারাপ, গলা শুকনো, বিডিআর সদস্যদের শাপান্ত করে, আবার খানিকটা বসে হাঁটা শুরু করতে হলো।
কিছুটা এগিয়ে জনৈক প্রৌঢ়ের সাথে দেখা। তাঁর কাছ থেকে জানা গেলো, অভিযাত্রীদের খবর তিনি পেয়েছেন আগেই, আর ইনানী রেস্টহাউস আরো সামনে। ঐ যে টিনশেড দেখা যাচ্ছে, ওটা পার হলে রেস্টহাউস চোখে পড়বে। ট্রেকাররা ইতিমধ্যে টিনশেডগুলোর স্বভাব বুঝে গেছেন, এরা অনেকক্ষণ যাবৎ দেখা দেয়, কিন্তু ধরা দেয় না। কাজেই আবার গরম মেজাজ নিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটা। হিমুর ঊরুর পেশীতে টান পড়েছে, দশ মিনিট পরপরই বসে পড়তে চাইছে সে, কাজেই মিলন ভাই তার অহমে সুড়সুড়ি দেয়ার জন্যে তার ব্যাগটা কাঁধে তুলে জোর হাঁটা শুরু করলেন। এভাবে তার প্রেস্টিজ হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে দেখে আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটলো সে, মিলন ভাইয়ের হাত থেকে জগদ্দল ব্যাকপ্যাকটা উদ্ধার করা সহজ কথা নয়।
ঘণ্টাখানেক পর যখন ইনানী রেস্ট হাউস চোখে পড়লো, তখন সবাই থামলেন। একটা বড়সড় বিশ্রাম নেয়া হবে। মিলন ভাই, বরুণদা আর শাহেদ ভাই এগিয়ে গেছেন লাঞ্চের খোঁজ নিতে। এই ফাঁকে বিস্কুট দিয়ে ক্ষিদে মারছেন সবাই। বখতিয়ার ভাই সমসাময়িক বাংলা কবিতা এবং ইংরেজি সাহিত্যে এর প্রভাব নিয়ে একটি জটিল তাত্তি্বক আলোচনার সূত্রপাত করতে যাবেন, এমন সময় স্থানীয় জনতা ভিড় করলো সেখানে। বালি রোদে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো, খামোকাই তাকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো একদল বাচ্চাকাচ্চা। এতোদূর হেঁটে হেঁটে সামিয়ার মেজাজ খারাপ, সে উঠে এসে এমন কড়া ঝাড়ি লাগালো যে জনতার ভিড় খুব জলদি জলদি পাতলা হয়ে গেলো। এরই মধ্যে বরুণদা ফিরে এলেন বিস্কিট আর হালকা পানীয় নিয়ে। সামনে কোথাও ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সব দোকান বন্ধ, আর রেস্টহাউসের বাবুর্চি কোন রকমের সহযোগিতা করতে নারাজ। বরুণদা ইনানীতে অফিশিয়াল ক্যাপাসিটিতে এসে ভবিষ্যতে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়ার সংকল্প নিয়েছেন।
বিস্কিট খেয়ে আবার উঠলেন সবাই। সূর্য টলে গেছে অনেকখানি। চাঁদের ত্রয়োদশী চলছে, সমুদ্র বেশ উত্তাল। সমুদ্র আর বাতাসের গর্জনে অবশ্য সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপূর্ব বীচ, আর সন্ধ্যেবেলা পশ্চিমে সূর্য আর পূবে চাঁদ অন্য রকম আলো এনে দিয়েছে সৈকতে। আরো বেশ কিছুদূর হেঁটে, কয়েকটা খাল পার হয়ে একসময় অভিযাত্রীরা পৌঁছালেন সীকিং হ্যাচারিতে। এখানেই রাতে আশ্রয় নেয়া হবে।
হ্যাচারিতে পৌঁছে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে রান্নার তোড়জোড় নেয়া হলো। খাসির বারবিকিউ করার আয়োজন চলছিলো, কিন্তু সাতপাঁচ ভেবে সেটা বাতিল করা হলো। চাল-ডাল-আলু-ডিম কিনে দেয়া হয়েছে হ্যাচারির বাবুর্চি সেলিম ভাইকে, খিচুড়ি হবে রাতে। কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে একদল গেলেন হ্যাচারির অপারেশন দেখতে, একদল জখম হাত পা নিয়ে পড়ে রইলেন।
রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে জলদি জলদি ঘুমুতে গেলেন সবাই। তিরিশ কিলো হাঁটা হয়েছে আজ। পরদিন আরো তিরিশ কিলো। কাজেই উঠতে হবে ভোরে। পুতুল আপা, শিলা আপা, পারভীন আপা আর সামিয়া রইলেন হ্যাচারির গেস্টরুমে, বাকিরা বাইরে ওয়াচহাউসে। ওয়াচহাউসটা একটা গোল দোতলা ঘর, ধূসর সাগর আর মাখনরঙা চাঁদ চোখে পড়ে সেটা থেকে। মোটামুটি ঠান্ডা পড়েছে, স্লিপিংব্যাগ বিছিয়ে আড্ডা মারতে মারতে সবাই ঘুমসাগরে তলিয়ে গেলেন।
৪.
ভোরে অ্যালার্মের একটা ছোটখাটো অপেরা হয়ে গেলো। নানা সুরে, নানা তালে একেক জনের অ্যালার্ম সোচ্চার হয়ে উঠলো। রাত ফুরিয়েছে। চাঁদ আস্তে আস্তে হলদে হয়ে ঢলে পড়ছে সাগরে। অপূর্ব একটা দৃশ্য, একে একে রেশম পোকার মতো ঘুমের গুটি কেটে স্লিপিং ব্যাগ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সবাই।
আজকে সবাই কিঞ্চিৎ টাটকা। আজই কঙ্বাজারে পৌঁছে ঢাকার বাসে চড়ে বসতে হবে। পরদিন সবার অফিস, ইউনিভার্সিটি খোলা। সবকিছু সেরে চটজলদি বেরিয়ে পড়লেন সবাই।
আজ সৈকতে নেমে মিলন ভাই আরো কয়েকটা কুকুরকে দলে জুটিয়ে নিলেন। বালির সাথে ভাব হয়ে গেলো একটার, তার নাম বাঘা। মিলন ভাই অবশ্য আরো তিন চারটাকে টোস্ট বিস্কুটের লোভ দেখাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা মনে করে উল্টো দিকে চোঁ চাঁ দৌড়ে পালালো।
মিলন ভাই, পারভীন আপা, হিমু আর শাহুল আজ একটু পিছিয়ে, বাকিরা পা চালিয়ে এগিয়ে গেছে। চলতে চলতে শুরু হলো গান। লাকি আখন্দ, আজম খান, সুমন চট্টোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক, জিনাত রেহানা, শামশাদ বেগম, জন ডেনভার, লস লোবোস --- কাউকে রেহাই দেয়া হলো না। টানা দেড়ঘণ্টা গাইতে গাইতে আর হাঁটতে হাঁটতে একসময় রেজু খালের ওপর ব্রিজের ধারে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসা হলো। রেজু খালের দু'ধারে দৃশ্যপটের সৌন্দর্যের জন্যে বিশেষণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সামনে খানিকটা পথ বীচ ছেড়ে মেরিন ড্রাইভের জন্যে নিধর্ারিত পথে হাঁটতে হবে। সামনের দলটা একটু এগিয়ে গেছে।
চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে একে একে চোখে পড়লো সেনা প্রকৌশলীদের বুলডোজার, নিমর্ীয়মাণ ম্যারিন ড্রাইভ, স্নিগ্ধ সবুজ সুপারি গাছের সারি, গম্ভীর নীল আকাশ, বাদামি বাঁশের কঞ্চিতে ঘেরা পানের বরজ, পান্নাবরণ ধানের ক্ষেত, বেঁটে পাহাড়ের গায়ে নানা চেহারার হাসিমুখ ঝাউবন, দূরে হলদে সৈকত আর নীল সমুদ্র --- রঙের রায়ট একেবারে, সব মিলিয়ে সব দৃশ্যে স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব, যদিও স্বপ্ন নাকি লোকে সাদাকালো দেখে।
প্যাঁচার দ্বীপ একটা গ্রামের নাম, সেটা পার হয়ে আবার সৈকতে নেমে পড়েছেন অভিযাত্রীরা। পথে স্থানীয় শিশুরা দল বেঁধে তাদের পিছু নিয়েছে, মিলন ভাই তাদের ডেকে জানালেন, বন্ধুরা, তোমরা পপি আপাকে চেনো? বাংলা সিনেমা দেখো নাই? এই যে আপামণিকে দেখছো, ইনি পপি আপার ছোট বোন। ছেলেমেয়ের দল নিজেদের মধ্যে আলাপ করে পটাপট পারভীন আপার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলো, ছবি তুলবে তারা। পপি আপার পরিবারের একজনের সঙ্গ খোদার ইশারায় মিলে গেছে, এ সুযোগ মাঠে মারতে তারা নারাজ। অবশ্য পারভীন আপাও এই মিথ্যাচারে আপত্তি করলেন না, পপিআপারছোটবোনসুলভ গ্ল্যামার আমদানি করে ছবিতে পোজ দিয়ে দাঁড়ালেন। মিলন ভাইও শিশুপাচারকারীদের মতো হাবভাব নিয়ে, একহাতে একটা কাটারি, অন্য হাতে একটা পিচ্চির কব্জি ধরে কয়েকটা ছবি তুললেন। শাহুল আর হিমুর মাথা আশেপাশের দৃশ্য দেখে গরম, তারা সমানে আকাশসাগরঅরণ্যের ছবি তুলছে।
সৈকতে নেমে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পামের বন চোখে পড়লো। এতক্ষণ সৈকতে কোন আবর্জনা চোখে পড়েনি, কিন্তু যতই হিমছড়ি কাছে চলে আসছে, তত বেশি করে অবিবেচক টু্যরিস্টদের উপস্থিতির পরিচয় পেলেন অভিযাত্রীরা। যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে নানা রকম পলি প্যাক, চিপস, বিস্কিট, এমনকি ডিটারজেন্টের প্যাকেট। বিয়ারের খালি কৌটোর কথা না বললেও চলে।
পামের বনের ভেতরে একটা খামার বাড়ি, টু্যরিস্টদের জন্যে তৈরি এবং সজ্জিত করা। সেখানে ডাব পাওয়া এবং খাওয়া গেলো। গলা ভিজিয়ে আবার শুরু হলো হাঁটা। কিছুদূর এগিয়ে দেখা গেলো, সামনের দলটা বালির ওপর মেসেজ লিখে গেছে। সেটা পড়ে জানা গেলো, পেছনের দলটা ঘন্টাখানেক পিছিয়ে পড়েছে, কাজেই তাঁরা জোরে পা চালালেন। পথে দু'এক জায়গায় তাঁরা প্লাস্টিক পেতে বসেছিলেন, কিন্তু তীব্র বাতাসে বালির কণা এত জোরে গায়ে বেঁধে যে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আর এ বালি উড়ে আসে মাটি ঘেঁষে, তাই দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যা নেই, বসলেই ঝামেলা।
আরো ঘণ্টাখানেক পা চালিয়ে কয়েকটা জীপ দেখা গেলো। সেজেগুজে সমুদ্রদর্শনে এসেছেন কয়েকজন ট্যুরিস্ট। তাদের অনেক সামনে হেঁটে চলেছে কয়েকজন, পিঠে হ্যাভারস্যাক। হুম, এক্সপ্লোরারস' ক্লাবের মেম্বার না হয়েই যায় না।
মিলন ভাইকে দূর থেকে সনাক্ত করতে পেরে থেমে পড়লেন অগ্রবর্তীরা। সবাই একসাথে হওয়ার পর একটা লম্বা বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সামনের দলের অভিযাত্রীরা পথে তরমুজ কিনেছেন পিছিয়ে পড়া চারজনের জন্যে, কাজেই পশ্চাদবর্তী দলের সদস্যরা হামলে পড়লেন সেগুলোর ওপর। কিছুক্ষণ সমুদ্রে হাত পা ছুঁড়ে একে একে সবাই এগিয়ে চললেন আবার। এবার মিলন ভাই এগিয়ে গেলেন সামনে, শিলা আপা পিছিয়ে পড়লেন। হিমছড়ি পার হয়ে কক্সবাজারের দিকে এগিয়ে চলতে চলতে চোখে পড়লো অসংখ্য জীপের ট্র্যাক। এবং দুঃখজনকভাবে, অসংখ্য বর্জ্য। এভাবেই মনোরম এই বালুকাবেলাকে নষ্ট করতে করতে এগিয়ে চলছে ট্যুরিস্টভর্তি গাড়িগুলো। প্লাস্টিকের প্যাকেট সৈকতে ছুঁড়ে ফেলতে কারো কোন দ্বিধা নেই।
হিমছড়ি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সৈকতের রূপ খানিকটা একঘেয়ে, লোকালয়ের কারণে কিছুটা বিনষ্টরূপ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই বিশাল বীচের সবচেয়ে নোঙরা অংশটি হচ্ছে হিমছড়ি থেকে কক্সবাজার। তিন দিনের এই অভিযাত্রায় কোন শ্বেতাঙ্গ পর্যটক অভিযাত্রীদের চোখে পড়েনি, যদিও টু্যরিস্ট সীজন এখন তুঙ্গে। অর্থাৎ, সৈকতের মূল সুষমাময় অংশটিতে বহির্বিশ্বের পর্যটকদের চোখ পড়েনি। এই নিয়ে গল্পগুজব করে পথ চলতে চলতে বিকেলবেলা কঙ্বাজারে পৌঁছে গেলো পেছনের দলটাও। বরুণদা অনেক আগে পৌঁছেছেন, জরুরি কাজে তিনি চলে গেছেন চট্টগ্রাম। সবার আগে পৌঁছেছেন বখতিয়ার ভাই। এক এক করে সবাই সৈকত থেকে কক্সবাজার শহরে হোটেল সায়েমানে নজরুল ভাইয়ের রুমে গিয়ে হাজির হলেন। নজরুল ওরফে খোকন ভাই কঙ্বাজারে একটা কার্গো এয়ারলাইন্স-এর পরিচালক, মূলত ইউক্রেনিয়ান ক্রু নিয়েই চলছে তাঁর জেড এয়ারলাইন্স। পুতুল আর শিলা, দুই বোন চলে গেছেন বার্মিজ মার্কেটে, তাঁরা একবারে সন্ধ্যে আটটার সময় বাস কাউন্টারে হাজির হবেন। সবাই গোসল সারতে সারতে সন্ধ্যে হয়ে এলো। গায়ে মৃদু ব্যথা সবারই, খোলা আকাশ ছেড়ে ছাদের নিচে মাথা গুঁজে দেয়ায় সবাই একটা ঘোরের মধ্যে, ভাবখানা এমন, এইটা আবার কী জিনিস?
সন্ধ্যেবেলা খোকন ভাই সবাইকে নিয়ে হাজির হলেন তাঁর বন্ধু সাজ্জাদ ভাইয়ের ক্যাফে 'অ্যাঞ্জেল ড্রপ'-এ। সেখানে কফি খেতে খেতে বাসের সময় হয়ে এলো, হুড়োহুড়ি করে সবাই আবার ছুটলেন বাস কাউন্টারের দিকে। মিনিট পাঁচেক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো বাসটাকে, বাসের যাত্রীদের কাছে সেজন্যে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে একে একে সবাই চড়ে বসলেন। একশো কিলো ট্রেকিং শেষে খানিকটা ক্লান্ত পা নিয়ে ঢাকায় ফিরে চললেন সবাই।
ফেরার রাতে পূর্ণিমা। চারদিকে নরম আলো ছড়িয়ে চাঁদ উঠেছে। আজ সাগরে জোয়ার সবচে জোরালো হবে। সাগরের তীর ছেড়ে আবার ধূলিমলিন ঢাকা শহরে ফিরে চলছেন সবাই। এ ক'দিনে টাটকা নোনা বাতাসে অভ্যস্ত সবাই, ঢাকায় ফিরে আবার সেই ধূলা আর কালো ধোঁয়ায় কী হয় কে জানে!
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
বালি অভিযাত্রীদের সাথে কক্সবাজার পর্যন্ত এসেছিলো। বখতিয়ার ভাই বাস কাউন্টারে যাওয়ার জন্যে রিকশা ঠিক করেছিলেন, সে রিকশার পাশে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিলো। রিকশাওয়ালা গতি বাড়িয়ে দেয়ার পর সে আর বেশিক্ষণ তাল মিলিয়ে ছুটতে পারেনি ক্লান্ত শরীর নিয়ে, পিছিয়ে পড়েছিলো। পরে পর্যটন মোটেলের কাছে সে পারভীন আপাকে খুঁজে বের করেছিলো, কিন্তু পারভীন আপা কুকুর ভয় পান বলে তাকে কাছে ঘেঁষতে দেননি। মন খারাপ করে সেখানেই কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়েছিলো সে। ফরিদ ভাই তাকে শেষ দেখেছেন আরেকদল অভিযাত্রীর সঙ্গ নিতে।
৫.
পাঠকদের জন্যে দু'টি অনুরোধ।
এই অপূর্ব রূপময়ী সৈকতের সানি্নধ্যে যখন যাবেন, দয়া করে এমন কিছু ফেলে আসবেন না, যা জৈবপচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) নয়। প্লাস্টিকের ব্যাগ বা বোতল, চকলেট বা ব্যান্ডেজের খোসা, পানীয়ের ক্যান --- কিছুই না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এক্সপ্লোরারস' ক্লাব অব বাংলাদেশের সদস্যরা তাঁদের ব্যবহৃত প্রত্যেকটি অপচনশীল বর্জ্য নিজেদের সাথে ফিরিয়ে এনে ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। আপনার ফেলে যাওয়া আবর্জনা কিন্তু সৈকতে পড়ে থাকবে বহুদিন। পরবর্তী পর্যটকদের বিরক্তি উৎপাদন করা ছাড়া আর কোন ভূমিকা সেগুলো রাখবে না। নিজের রূপের মতোই নিজের দেশের সৌন্দর্যের প্রতি যত্নবান হোন।
আর, কেউ যদি বালিকে খুঁজে পান, দয়া করে ভালো কয়েকটা বিস্কিট খাওয়াবেন।
মন্তব্য
হিউমারের ব্যবহার রসবোধে উত্তীর্ণ করেছে লেখাটিকে। সবচেয়ে বড় কথা একটানা পড়ার ক্ষেত্রে লেঙড়া চোখ আমার টেরই পেলো না কখন যে এই সৈকতের মতো দীর্ঘ লেখাটিও হেঁটে হেঁটে পাড়ি দিয়ে এসেছে !
প্রশংসা করছি আপনার গদ্য লেখার তুমুল সামর্থকে। ধন্যবাদ। এবং একই সাথে অভিনন্দনও।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
আপনাকেও ধন্যবাদ জানাই এই দীর্ঘ পোস্ট আগ্রহ নিয়ে পড়ার জন্যে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
এই জায়গা গুলোতে
কোনদিন যাওয়া হবেনা আমার
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
এই হাতির বাচ্চাটিকে (বাচ্চা বলা কি উচিৎ হচ্ছে? পোস্টের যা সাইজ) বিশাল সময় নিয়ে তৃতীয়বারের মত গলাধকরণ করলাম।
অসাধারণ এক ভ্রমণবৃত্তান্ত!!!
কি মাঝি? ডরাইলা?
তৃতীয়বারের মতো ধন্যবাদ !
হাঁটুপানির জলদস্যু
দু'তিনটে পর্বে ভাগ করে দিলেই তো আমরা এই হাতির বাচচাটারে খরগোশের বাচচার মতো একটু আরাম করে পড়তে পারি!
= = = = = = = = = = =
ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত
আমরা ঘুচাব তিমির রাত
বাধার বিন্ধ্যাচল।
উঁহু, পর্বের ঝামেলায় আমি আর নাই। যা একবারে লিখেছি তা একবারেই পড়তে দিতে চাই।
হাঁটুপানির জলদস্যু
পর্বের অসুবিধাটা হচ্ছে ভালো হলেও অনীহা চলে আসতে পারে। যে কারণে একই প্দ্ধতিতে এই লেখাটায় আমার বাক্সে নিয়া নিলাম গুরু।
পিচ্চি বয়সে সমুদ্রের স্বাদ/ সাধ নামের একটা নাটক শুনছিলাম রেডিওতে। মেয়েটা সমুদ্র দেখতে না যাইতে পারলে কান্দে আর চোখের পানি জিভ দিয়া চাটে। সমুদ্রের পানি তো লোনা- তাই।
আমার দশাও মনে হয় তেমন। ঘুরাঘুরির ঘটনা লম্বা হইলে বাক্সে ঢুকাই। মন দিয়া অনেকবার পড়ি।
ধন্যবাদ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
সচলায়তনে পড়া আমার দীর্ঘতম পোস্ট, তয় পইড়া শ্যাষ করছি।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
ধাউশ হলেও তরতর করে পড়ে ফেলার মতো লেখা। পুরো লেখাটারই হাসি-হাসি মুখ
অতীব উপাদেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
এটা পড়ে খেয়াল হলো আগের বার পড়বার সময়েও এখানটাতে এসে হেসে উঠেছিলাম।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
এ রকম বেশ কিছু ইনফর্মাল এক্সকারশানের অভিজ্ঞতা আমার আছে। ধরুন বাই সাইকেলে একটানা হাজার খানেক কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া, অন্ধকার রাতে চলন বিল সাইজের বিল পাড়ি দেযা ইত্যাদি। তবে সে সব ছিলো গোর্য়াতুমি করে বাসা থেকে বেড়িয়ে যাওয়া কিংবা স্রেফ চা খেতে খেতে মনে হলো ভাল্লাগছে না এই শহর, এই শব্দ। দুই মিনিটের মাথায় আমি বেড়িয়ে পড়লাম রাস্তায় আর শহর ছেড়ে চলে গেলাম পদ্মার পাড়ে আর বসে রইলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
পরিকল্পিত কিছু না। সে কারণে বিপদেও পরেছি প্রচুর। আমার খুব ইচ্ছে আপনার মতো এ রকম একটা দলের সাথে একটু পরিকল্পিতভাবে এক্সকারশানে যাবো। আমার অনেক বন্ধু হবে সেখানে, একটা নেশাগ্রস্ত পাগলা গ্রুপ। আপনি সেই ঠিকানাটা আর দিলেন না।
- পড়তাছি। তিনে আসছি, আপাততঃ আর ধৈর্যে কুলায়তাছে না। পরে পড়ুম আবার। মজা লাগতাছে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
কালকা রাতে শুরু করছিলাম... মাঝখানে এক ঘুম দিয়া শেষ করলাম এখন।
বিরাট লেখা। তবে লেখাটা ভালো বলেই পড়তে কষ্ট হয় না।
এই পথটা অনেকবার পাড়ি দিছি... কিন্তু পায়ে হেঁটে কখনওই যাওয়া হয়নি। পায়ে হাঁটার আমার দীর্ঘতম অভিজ্ঞতা গাবতলী থেকে মেঘনাঘাট।
আর এই লেখা পড়তে পড়তে আফসোস হইতেছিলো... কারন ঠিক এইসময়ে আমার থাকার কথা ছিলো এরকমই একটা দলের সাথে চাঁপাই নওয়াবগঞ্জে... আম উৎসবে। মিলন ভাইয়েরও যাওয়ার কথা... এস্ট্রোর লোকজনই আয়োজনে। স্রেফ আইলসামির কারনে যাওয়া হইলো না।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হিমু ভাই! পুরনো দুঃখ আবার উসকে দিলেন।
গত বছর অবশ্য সৈকতে সঞ্চারন করে এসেছি।
অনেক ধন্যবাদ, পুরনো দিনের কথা তুলে আনার জন্য।
------
সালেহীন
লেখাটির মূল আকর্ষন ছিলো ছোটো ছোটো সাধারণ ঘটনার অসাধারণ প্রকাশ। যেমন- 'ডালের রাঁধুনি অত্যন্ত উদার মনের মানুষ, ডালের সাথে ডালের রেসিপিও সরবরাহ করেছেন তিনি, কোন উপাদান যাতে বোধের অতীত হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন তিনি।'
অসাধারণ একটা লেখা। এত বড় লেখা এত সুন্দর করে বোধ হয় শুধু ঝোঁকের মাথায়ই একটানে লেখা যায়। খুব ইচ্ছে করে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তে, কিন্তু সময় এবং সুযোগ হয়ে ওঠে না কখনো। লেখাটা পড়তে পড়তে সারাক্ষণই মনে হচ্ছিল অভিযাত্রী দলের সাথে আমিও আছি অভিযানে। সব কিছুই যেনো দেখতে পাচ্ছিলাম নিজের চোখে।
অসংখ্য ধন্যবাদ এত চমৎকার একটা অভিযানে ভার্চুয়াল সঙ্গী করায়।
নতুন মন্তব্য করুন