১.
পরীক্ষা ছিলো গতকাল। বায়ুটারবাইনের নিয়ন্ত্রণ ও নেটসংযোগের ওপর। পরীক্ষার পরপরই কলোকুইয়ুম, সাথে সাথেই গ্রেড পেয়ে যায় পোলাপান। প্রফেসর হায়ার এর এই ব্যবস্থাটা খুবই ভালো লেগেছে আমার কাছে। ৪৫ মিনিট বা ১ ঘন্টার পরীক্ষা, তার পরপরই খাতা দেখতে দেখতে আলোচনা, ভুলভাল কিছু থাকলে তৎক্ষণাৎ শুধরে দেয়া, যাতে ছেলেপিলে কোন সংশয় নিয়ে পরীক্ষার হল ছেড়ে না বেরোয়। হায়ার সুযোগ পেলেই এই সুব্যবস্থার কথা লোকজনকে জানিয়ে দেন, "ভিয়ার হান্ডেল্ন ডি নোটে ৎসুজামেন মিট ডেন ষ্টুডেন্টেন আউস, হে হে হে!"
আজ পরীক্ষা দিয়েছি সবশুদ্ধু আটজন। ক্লাসের অর্ধেকেরও বেশি ছেলেপিলে শেষ পর্যন্ত আর পরীক্ষা দেয়নি। এক্সট্রা ক্রেডিটের এটাই মজা, ক্লাস করতে চাইলে করো, পরীক্ষা দিতে হবে এমন কোন কথা নেই। তবে পরীক্ষার জন্যে একবার নিবন্ধন করে পরীক্ষা দিতে বসলে তা পাশ করতেই হবে, নইলে ভ্যাজাল।
২.০ পেয়ে মনটা একটু খারাপই ছিলো। ওপেন-বুক পরীক্ষা, প্রায় চারশো পৃষ্ঠার মতো ব্লক ডায়াগ্রাম আর গ্রাফ, তারপরও মনে একটা দুরাশা ছিলো এবার পরীক্ষা ভালো হবে। অদৃষ্টের মন্দপ্রেম ভেবে হেলেদুলে বার হলাম। পরে অবশ্য বাসায় ফিরে আবার নানা ভ্যাজালে পড়ে মন কিছুটা ভালো হলো।
২.
সেদিন এক্সকারশন ছিলো মেয়ারহোফ বলে এক জায়গায়, ১০০ মেগাওয়াটের একটা উইন্ড টারবাইন প্ল্যান্ট সেখানে। ভোরবেলা উঠে সময়মতো হাল্টেষ্টেলে (বাসস্ট্যান্ড) গিয়ে দেখি খাপ্পা চেহারার এক বুড়ি সেখানে বসে গজগজ করছে, সকালে যেমন ভিড় থাকার কথা, তেমনটা নেই। সন্দেহ হচ্ছিলো বলে বুড়িকে জিজ্ঞেস করতেই বুড়ি মহা ক্ষেপে গেলো। "দেখুন এদের কান্ডটা একবার! সময়ের আগেই এসে চলে গেছে! গত বিশ বছর ধরে গরম পড়লেই ব্যাটারা এমনটা করে, সময়ের আগে এসে চলে যায়! বলুন দেখি কেমনটা লাগে! আমি তো বলি এটা কাসেলারফেরকেয়ার্সগেজেলশাফট (KVG, কাসেলের পরিবহন সংস্থার নাম) নয়, কাসেলারফেরষ্পেটুংসগেজেলশাফট (কাসেলের দেরি করিয়ে দেয়া সংস্থা)!"
বুড়ির কথায় সায় দিলাম বিমর্ষ মুখে। "আমার আজকে একটা এক্সকারশন আছে, এখন তো মনে হচ্ছে সময়মতো আর যাওয়া হবে না।"
বুড়ি ঢোলের বাড়ি পেয়ে আরো নাচতে লাগলো। গত বিশ বছরে KVG আরো কী কী কুকর্ম করেছে, তার একটা ফিরিস্তি শুরু হলো। জার্মান বুড়োবুড়িরা মদ না খেলে সাধারণত খুব স্পষ্ট জার্মান বলে, বুঝতে তেমন একটা সমস্যা হয় না, নওজোয়ানরা এক নিঃশ্বাসে অনেক কিছু বলে, তখন প্রায়ই আরেকবার দম নিয়ে বলার অনুরোধ জানাতে হয়।
ফোন করলাম ওলাফ আর ক্রিস্তফকে, দু'জনের কেউই যাচ্ছে না এক্সকারশনে। এদিকে কাউকে না জানালে ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে যাবে সবাই। মুসিবত। ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল ক্যাম্পাসের সামনে পরে ট্রাম থেকে নামতেই উলরিখের ফোন পেলাম, ঊর্ধ্বশ্বাসে বাকিটা পথ ছুটে গিয়ে দেখি বাকিরা তিব্বতী লামাদের মতো গম্ভীর মুখে করে সার বেঁধে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, লেট লতিফের অপেক্ষায়। লজ্জায় মাথা কাটা পড়লো আমার।
বাকিটা সময় অবশ্য ভালোই কাটলো এক্সকারশনে। বিএমডব্লিউতে আগে চড়িনি কখনো, প্রফেসর হায়ার খুব উৎসাহ নিয়ে আমাদের তাঁর গাড়ির নানা কীর্তি শোনাতে লাগলেন। হায়ারের বয়স ষাটের ওপর, কিন্তু দারুণ ড্রাইভ করেন। হাইওয়েতে উঠেই সাঁ করে একশো আশিতে তুলে ফেললেন গাড়ি। উলরিখ আর কায়েস গুজগুজ করে গল্প জুড়ে দিলো। ভিজবাডেন আর কোয়ল্নের বাসাভাড়া নিয়েই আধ ঘন্টা আলাপ শুনতে শুনতে ঘুম দিলাম।
মেয়ারহোফ জায়গাটা পাহাড়ি মালভূমির মতো, যেদিকে চোখ যায় শুধু সরষে ক্ষেত। ফাঁকে ফাঁকে দৈত্যাকৃতি সব টারবাইন, গুণে শেষ করা যায় না। উইন্ড টারবাইনের জন্যে আশেপাশের সব জমি কিনে ফেলার কোন দরকার হয় না, অল্প একটু জায়গা লিজ নেয়া হয় চুক্তির মাধ্যমে, টারবাইন আর কেবল ট্রেঞ্চের জন্যে যতটুকু জায়গা লাগে ততটুকু হলেই বেশ চলে যায়। গ্যালোবার নয়ডর্ফে গিয়ে দেখেছি, মোট ১১ মেগাওয়াটের ৫টা মাত্র টারবাইনের জন্য ২৬টা চুক্তি করতে হয়েছে, মেয়ারহোফে পঞ্চাশটারও বেশি টারবাইন, কয়টা ফেরপেখটুং করতে হয়েছে কে জানে।
এবার আর ওপরে চড়িনি, বাম হাত জখম, নিচে বসে গল্পগুজব করে সময় কাটালাম। কিছু ছবি তুলেছি, সেগুলোও ওয়াশ করা হয়নি। ডিজিটাল ক্যামেরার জন্যে হাহুতাশ করেই দিন কেটে যাবে মনে হচ্ছে। দেখি, ওয়াশ করলে স্ক্যান করে তুলে দেবো।
উলরিখ নিচে নেমে এসে পাকড়াও করলো আমাকে, "ব্যাপার কী? খেলা দেখো নাই ফাইন্যাল? কা নয়েনৎসেন এ তোমাকে দেখলাম না তো।" ইউনিভার্সিটির পার্টি বিল্ডিং হচ্ছে কা নয়েনৎসেন, সেখানে কোন টুর্নামেন্ট হলে সবাই বোতলের কেস নিয়ে জড়ো হয়।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, "আমি স্পেনের সাপোর্টার ছিলাম। ধোলাই খেয়ে মরি আর কি।"
উলরিখ হেসে ফেললো, "আরে ধুর, ভয়ের কী আছে? স্পেনের পোলাপানও তো সেদিন খেলা দেখতে গেছে।"
আমি মনে মনে বললাম, স্পেনের পোলাপানের কিছু হবে না রে, কপালে মাইর থাকলে আমারেই খাইতে হবে। সারাটা জীবনই ফাও গোয়ামারা খেয়ে যাচ্ছি, মাতাল জার্মান সাপোর্টারের হাতে মাইর নাহয় আপাতত না-ই খাইলাম। মুখে বললাম, "জার্মানি খুব বাজে খেলসে। খেলোয়াড়দের ধরে স্পেনে পাঠায় দেয়া দরকার।"
উলরিখ আর সহ্য করতে পারলো না, খেলার আলাপ পাল্টে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো।
৩.
গতকাল পরীক্ষা দিয়ে এসে প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিলো, কিন্তু ঘুমানোর উপায় নাই, আজও পরীক্ষা ছিলো, তার ৯০%ও পড়া বাকি। ঢুলতে ঢুলতে কিছুক্ষণ পড়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর পড়তে বসে দেখি, বহুত জিনিস বাকি, কিছুতেই পুরোটা শেষ করা যাবে না। জোলারটেখনিক, মানে সৌরকৌশল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সৌরতাপ, সৌরবিদ্যুৎ মিলিয়ে একটা খিচুড়ি জিনিস, পড়তে পড়তে সূর্য জিনিসটার উপর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এর মধ্যে আমার ফ্ল্যাটমেট উগো ফেরনান্দেজ আবার রান্নাঘরে গিয়ে শুরু করেছে বিদঘুটে পর্তুগীজ গান। উগো বেশ ভালো হারমোনাইজ করতে পারে, কিন্তু যখন আমি অঙ্ক করছি তখন এই আপদ আর কতক্ষণ ভালো লাগে? একবার ভাবলাম বের হয়ে একটা কড়া ঝাড়ি মারি, পরে ভাবলাম, মানুষ নীরবে সহো। ভাবছি ওকে জরিমানা করবো, রান্নাঘর সামনের শনিবারে ওকে দিয়ে সাফ করাতে হবে। চুদির ভাই এখানে আসার পর থেকে একবারও রান্নাঘরের মেঝে ঝাঁট দেয়নি।
তারপরও মন্দের ভালো হয়েছে পরীক্ষা। পোলাপাইন কেউই পরীক্ষা দিয়ে খুশি না, কিন্তু সবারই এক বক্তব্য, আরো খারাপ হতে পারতো। এতো অসংখ্য তথ্য আছে চিপাচাপায়, যে চাইলেই কঠিন প্রশ্ন করে সবাইকে ফেল করিয়ে দেয়া যায়। সেই তুলনায় বেশ ফেয়ার পরীক্ষা হয়েছে। মোটে দেড় ঘন্টার পরীক্ষা, কিন্তু ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে সবাই, প্রশ্নগুলি ছোট ছোট হলেও অনেক চিন্তা করতে হয়।
আজকে আবার ডিপার্টমেন্টে খাটুনি আছে। বসে বসে পোস্টাচ্ছি, ফোনের অপেক্ষায়। আজকে ঠিক করেছি সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে পূর্ণমাত্রায় টাল হবো। কী আছে দুনিয়ায়?
মন্তব্য
হুম, আপনার লাইফ জুইড়া দেখা যাইতেছে পচুর গিয়ানজাম।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
এত কিছু পইড়া আপনে কী বানাবেন? দেশে শাহিদ মিঞা বিনা জ্বালানীর টার্বাইন বানাইয়া ফালাইছে। মাস চারেক আগেও আরেকজন বানাইছে।
আজ ডেইলি স্টারে দেখলাম দিনাজপুরের শাহেদ হোসেনও আবিষ্কার করে ফেলেছেন জ্বালানী ছাড়া বিদ্যুত উৎপাদনের তরিকা
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ওয়েব ও ব্লগ | ফেসবুক | আমাদের প্রযুক্তি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
- এখন দেখা যাচ্ছে শাহেদ আর শহিদদের সময়। মাহবুবস আর মেহবুবসদের সময় এখনো আসেনি!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
টাল হন ভালো কথা। কিন্তু টোস্ট করবেন কি বিষয়ে?
------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
আমি কখনো টারবাইন দেখনি অমন। তাই লেখা পড়তে পড়তে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব।
পড়াশুনা নিয়ে আসলে বেশি মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করেনা আমার তাই পরীক্ষার কথা শুনে মেজাজ একটু তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছিল বৈকি !! ফাঁকিবাজ ছাত্রদের এই এক সমস্যা।হাঃ হাঃ হাঃ।ভাল কথা কি পড়ছেন আপনি ওখানে ? জার্মান আমি কিচ্ছু বুঝিনা, একবার শিখতে গিয়ে দেখি ইংরেজী ভুলে যাবার দশা।
টাল তো হবেন ভাল কথা পরের দিন হ্যাঙ্গওভারের যন্ত্রনা কি কষ্টদায়ক হবেনা আপনার জন্য ?
উপরের অতিথি লেখকটা আমিই ছিলাম।
নাম লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে মার্জনা করবেন।
সবাইকে ধন্যবাদ।
[ভূঁতেঁরঁ বাঁচ্চাঁ]
হুমমম... আপনেরে রান্নাঘর ঝাঁট দিতে হয়... এখন বুঝছি আমি দেশে ক্যান...
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
ঠিকাছে ! টাল হওয়ার কাহিনী কাল জানাইয়েন্ । তয় একখান কথা .. নজু ভাইয়ের মত "ব্ল্যাকআউট" য্যান না হয়!
আপনার সেদিনকার সেই রিকশাওয়ালা সাথে থাকলে আপনার পড়াশোনা ও বুঝতে সহজ হত, আবার বাস মিস করলে রাইডও মিলতো।
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
কেন জানি লেখাটা পড়তে বেশ আরাম লাগলো।
কি মাঝি? ডরাইলা?
লেখাপড়া না করার একটা দারুণ উপকারীতা আছে... কত বছর পরীক্ষা দেই না... এক যুগ। আহ্... আরামের শেষ নাই।
ঠিকাছে বস... ইচ্ছামতো টাল হন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনি তো মন্তব্যের জবাব দেন না। তাও একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম কি জার্মান ভাষা? যদি তাই হয় তাহলে এতো ত্যাল কই পান??
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
জার্মান না-জানা জনতা বুঝিবে কী উপায়ে?
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ঈশ্বরাসিদ্ধে:
অজ্ঞাতবাস
আপনার সঙ্গে একদিন কথা বলে দেখতে হবে। কথাতেও কি আপনি এতো জার্মান ব্যবহার করেন?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
হুম
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
নতুন মন্তব্য করুন