ভোলায় যাবো বোরহানউদ্দিন। দু'ভাবে যাওয়া যেতে পারতো। স্পিডবোট নিয়ে, অথবা ফেরিতে চড়ে। স্পিডবোটের রকমসকম দেখে ভয়ই পেলাম, তাছাড়া যদিওবা যাত্রাটা রোমাঞ্চকর হবে, ঘাটে নেমে টেম্পু-ইশকুটারে চড়ে নাহক হয়রান হওয়া। এমনিতেই বহু ঘাটের পানি খেয়ে হয়রান, আবার সেই স্থলচরভটভটিতে চড়ার কোন মানে হয় না ভেবে ফেরিতে চড়ে যাওয়াই স্থির হলো। ঘাটে নেমে আমার বাহন হবে সেই গনগনে লাল পিকআপটা। বোরহানউদ্দিন যাওয়া তখন কোন ব্যাপারই না।
কীর্তনখোলা নদী বড়ই মনোমুগ্ধকর। তাছাড়া সেই শীতের সময়েও বরিশালের আকাশে মেঘের ঘনঘটা, নদীর এপারে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি, ওপার মেঘাচ্ছন্ন, মাঝে কীর্তনখোলায় চলছে ছোট ছোট নৌকা। এক বাঁকা ডিঙিতে দেখলাম দুই দুঃসাহসী শিশু দাঁড় বেয়ে ছপছপ করে চলছে কোথায় যেন।
কীর্তনখোলা পেরিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে যেতে হয় লাহার হাটে। সেখানেই ভেড়ে ভোলাগামী ফেরি। আমার সঙ্গী একটা কী যেন বই। কিছুক্ষণ ফিসফিস করে বৃষ্টি হয়, তারপর আবার দেখি এক গাল হাসি নিয়ে সূর্য উঠেছে। গাছের পাতা থেকে বিষণ্ন বাঁদরের মতো অলস হয়ে নেমে আসছে ফোঁটা ফোঁটা পানি, রোদ ঝলকাচ্ছে তাদের শরীরে।
লাহার হাটে ফেরি থামে, গোঁ গোঁ করে নেমে আসে ট্রাক আর কাভার্ড ভ্যান। আমি আড়চোখে আকাশকে দেখি, আকাশ গম্ভীর মুখে বুকের ওপর মেঘের আঁচল টানে। সাঁই সাঁই করে বাতাস চালায় হঠাৎ। চোখের সামনেই ফেরিটা খানিক দুলে ওঠে হঠাৎ ঢেউয়ে।
ভোলা যেতে সময় লাগে ফেরিতে। মন্থরগতিতে পিঠে অনেক ট্রাক আর আমার পিকআপটা নিয়ে ঢেউ ঠেলে চলতে তাকে সে। এ বাঁক সে বাঁক পেরিয়ে এক কূলহীন ঢেউয়ের ইয়েতে এনে ফ্যালে সে আমাদের। আমি তো ডানে বামে তাকিয়ে ঢোঁক গিলি।
ভোলায় নামার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়। সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ভোলায় চাকা রাখে পিকআপটা। ভাঙা রাস্তা এড়িয়ে, লোহার পুল পেরিয়ে, একসময় ভোলার চমৎকার জঙ্গলে ছাওয়া রাজপথে উঠে পড়ি। চমৎকার রাস্তা, দু'পাশে বিশাল সব গাছ, সবুজ আর সবুজ সবদিকে, সবরকম ছাঁটের সবুজ দেখতে দেখতে চলতে থাকি মনভোলা হয়ে।
কাজের সময় আবার বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপসে যাই। কাজ শেষে ফেরার পথে অচেনা সরু রাস্তায় নামতে হয়, সেখানে দমকা বাতাসে ঢলে পড়া কচি বাঁশ গাছ সরিয়ে সরিয়ে চলতে হয় আমাদের। একসময় আবার উল্টোদিক থেকে সেই আগের পথকে দেখতে দেখতে ফিরি ফেরিঘাটে।
ফেরি ভিড়তে অনেক দেরি। ঘাটের পাশে একটা দোকানে চা খাই গরম গরম। একটা এক চোখ অন্ধ কুকুর এসে নিঃশব্দে সামনে বসে, তারপর জিভ বার করে হাঁটু চেটে দেয়। কী আপদ। সরে যাই, কুকুরটা ছাড়ে না, সে-ও পরম নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে পেছনে পেছনে এসে বসে। ডাকে না, কোন অভিযোগ করে না, শুধু একটা চোখ মেলে তাকিয়ে থেকে লেজটা নাড়ে অল্পস্বল্প। দোকানদার খলখল করে হাসে। বলে, শয়তান। একটা পুরি কিনে না দিলে নাকি ও পিছু ছাড়বে না। খানিক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে একটা পুরি কিনে উপহার দেই তাকে, সে মাথা সামান্য নেড়ে একটা বোঝাপড়ার স্যালুট দেয়, পুরিটা দুই কামড়ে মুখে পুরে উল্টোদিকে ফিরে হাঁটতে থাকে অভিজাত ঘোড়ার মতো।
দোকানে ইলিশ মাছ চাক চাক করে কাটা, একেবারে টাটকা। দেখে জিভে জল চলে আসে, সেই সকালে কী না কী খেয়েছি। কিন্তু ইলিশ মাছ ভাজার মশলার অবস্থা দেখে সাহস পাই না। জিভের রসকে বশ করে বলি, এখানে মাছের দাম কেমন?
দোকানদার হাসে। বলে, আপনাদের ওখানকার মতো না তো। এখানে হালি বিক্রি হয়।
বলি, হালি কত করে?
দোকানদার শ্রাগ করে। কত আর? সত্তর, আশি?
আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠি। বলে কী? ওরে কে আছিস ভোলায় একটা তাঁবু গেড়ে দে আমাকে!
তাঁবু আর গাড়া হয় না শেষমেশ। ফেরি চলে আসে। আমি আরো এক কাপ চা দিয়ে খিদে মেরে গাড়িতে চড়ে বসি, গাড়িটা চড়ে বসে ফেরিতে, ফেরিটা চড়ে বসে ঢেউয়ের পালকিতে।
ঠুস করে আমার ভোলাযাত্রার গল্প শেষ হয়ে যায় তখনই।
মন্তব্য
ভোলার আঞ্চলিক টান কেমন লাগলো? আমাদের বাসার দারোয়ান চাচা ভোলার। উফ, এত দ্রুত আর এত দুর্বোধ্য ভাবে কথা বলেন!
বরিশালের মতোই তো লেগেছিলো।
bholar golpo mon bholate parlona.
কতোদিন ইলিশ মাছ খাই না...
নতুন মন্তব্য করুন