পানশালা শিরোনামের একটা সিরিজ লেখা শুরু করেছিলাম অনেক আগে। শিব্রাম চকরবরতি আমার অনেক মানসগুরুদের একজন, তাই পানপ্রেমিক কিছু চরিত্রের মুখে PUN গুঁজে দিয়ে গল্প বলানোর চেষ্টা করেছিলাম ( কিছুদিন আগে সচল মৃদুল আহমেদের "বুক বড়ো" করার গল্পটি যেমন একটি আদর্শ পানশালার গল্প)। অন্যান্য অনেক উদ্যোগের মতোই তা ব্যর্থ হয়েছে। গল্পের মহেঞ্জোদোড়ো থেকে একটা তুলে আনছি আবার সচলের পাঠকদের জন্যে।
ফাকরুল ভাই সেদিন মাতাল হতে চাইছিলেন না বলে হাতি মার্কা বীয়ার নিয়ে বসেছিলেন। কাঁচা জনতা এ বিয়ারের একটা কৌটা শেষ করে টলে যায়, পাকা ফাকরুল তেষ্টা মেটাতে বীয়ার গেলেন। সেদিন ভুল করে মিনারেল ওয়াটার খেয়ে বেচারা আরেকটু হলেই খাবি খেয়ে মরে আর কি। শেষে মাথা চাপড়ে একটু রাম পিলানোর পর তিনি ধাতস্থ হয়ে ভূমিতে ফিরে আসেন।
আমাদের পাশের টেবিলের পাশের টেবিলে, সেই পরশু-পড়শী টেবিলখানায় মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা এক কুচকুচে কালো আদম মনোযোগ দিয়ে পান করছিলেন, বোতলের ঢং আর তরলের রং দেখে মনে হয় পানীয়টি রাম। একনিষ্ঠ রামভক্ত ব্যক্তিটি রসিয়ে রসিয়ে এক একটি রামচুমুক মারছিলেন, আর বিড়বিড় করে কী কী যেন বলছিলেন।
ফাকরুল ভাই আমাকে বলেন, ''আমি ঐ ব্যাটাকে চিনি, ঐ কালাটাকে। চিনি সেই ছোটবেলা থেকে।''
আমিও ফাকরুল ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাতি মার্কা বীয়ারই খাচ্ছিলাম, তবে সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করেছে দেখে বুঝি যে আমার তেষ্টা মিটে গিয়ে নেষ্টাও পেয়ে বসেছে।
ফাকরুল ভাই বলেন, ''ওর জীবনটাই অভিশপ্ত। বেচারা।''
আমি বলি, ''কেন? ওর নাম কি আশফাক?''
ফাকরুল ভাই মাথা নাড়েন।
আমি ভেবে বলি, ''তাহলে কি ইকবাল?''
ফাকরুল ভাই রাজি হন না।
আমি আরো গবেষণা করে উজ্জ্বল মুখে বলি, ''তাহলে কি জনগণের নয়নমণি সুধীর ভাই?''
ফাকরুল ভাই ভেটো দ্যান। বলেন, ''আরে না, ওর নাম আবু লুলু।''
আমি একটু নিরাশ হই। আবু লুলু নামটা খারাপ কিছু নয়। সমস্যা কী এতে?
ফাকরুল ভাই বলেন, ''আবু লুলুর মা আমাদের চট্টগ্রামের মেয়ে। কিন্তু বাপ এদেশী না। আফ্রিকান। সুদানের এক ব্যবসায়ীর ছেলে, আবু লুলু চট্টগ্রামে দারচিনির ব্যবসা করতে এসে প্রেমে পড়ে মরিয়ম বিবির। কিন্তু সে প্রেমে বাগড়া দ্যায় মরিয়ম বিবির বাপ গোলাম ছগীর আর আবুলুলুর বাপ আবু নামরূদ। গোলাম ছগীর বলে, একটা কালা কাফ্রির কাছে সে পরীর মতো মেয়েকে তুলে দিতে পারে না। আর আবু নামরূদ বলে, বেটা লুলু তুমি বিয়ে করতে চাইলে বারো বছরের কচি বালিকা বধূ বেছে নাও, বাইশ বছরের একটা বুড়ি ধুমসীকে বিয়ে করার কারণ কি, যে কি না কথায় কথায় শুধু মুখ খারাপ করে?''
আমি বীয়ারে চুমুক দেই। ''তারপর? তারপর কী হলো?'' আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আবু লুলুর ছেলে আবু লুলু গেলাস ফেলে বোতলে মুখ লাগিয়ে চুকচুক করে রাম খাচ্ছে।
ফাকরুল ভাই বলেন, ''তারপর ফাগুন ফুরিয়ে চৈত্র মাসের একদিন, হিসাব মতে বসন্ত থাকলেও চরম খাইষ্টা গরম পড়েছে, মরিয়ম বিবি ইয়া লম্বা কাফ্রি আবু লুলুর হাত ধরে পালিয়ে যায়। তারা একটা সাম্পানে চড়ে আশ্রয় নেয় কুতুবদিয়ায়। সেখানে তারা মৌলবীর কাছে কলমা পড়ে বিয়ে করে। ছ''মাস বাদেই মরিয়ম বিবির কোল কালো করে জন্মায় এক ছোকরা। আবু লুলু নিজের নামে তার নাম রাখে .. ..।'' নামটা ভুলে যান ফাকরুল ভাই।
আমি খেই ধরিয়ে দেই, ''আবু লুলু?''
ফাকরুল ভাই হাসেন। ''ওফ, তোমাদের কি মেমরি! হবে না ক্যানো, ইয়াং ম্যান তোমরা, আমরা বুড়ো ভাম কিছু মনে থাকে না। .. .. তো আবু লুলু জন্মানোর কয়েকদিন পর আবু নামরূদ কিছু সাতকানিয়ার ডাকাত পাঠিয়ে আবু লুলুকে তুলে নিয়ে যায়, তারপর চট্টগ্রাম থেকে গোলমরিচের ব্যবসা গুটিয়ে ফিরে যায় নিজের দেশ সুদানের সেই আঁশটে গন্ধঅলা বন্দর, দার-এস-সুনামিতে, সেখানে আবু লুলুর সাথে বিয়ে হয় তারই এক মামাতো বোন, একাদশবষর্ীয়া উম্মে রাইসুর সাথে। আর মরিয়ম বিবি এদিকে আশায় আশায় দিন গোনে, একদিন আবু লুলু কুতুবদিয়ায় ফিরে আসবে তারচে কালো সাম্পানে চড়ে, সে আশায় আশায় গান বান্ধে, ও রে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা ... ...। কিন্তু দিন যায়, আবু লুলু আর ফেরে না।''
আমার মনটাই খারাপ হয়ে যায়, দেখি আবু লুলুর বেটা আবু লুলু বোতলটাকে নিঃশেষ করে গেলাসে জিভ ঢুকিয়ে তলানি চাটছে। বলি. ''তারপর?''
ফাকরুল ভাই বলেন, ''তারপর ধীরে ধীরে মরিয়মের আশা ফিকে হয়ে আসে। তার বুকে জন্ম নেয় গভীর অভিমান। হারামজাদা আবু লুলু নিজের দেশে ফিরে গিয়ে আরেকটা শাদী করেছে, তার কোলে একটা কাফ্রি সন্তান গছিয়ে দিয়ে। শুয়ারের বাচ্চা। মনের দুঃখে সে সন্তান আবু লুলুকে নিয়ে বাপ গোলাম ছগীরের কাছে ফিরে আসে। এতদিন পর হারানো কন্যাকে ফিরে পেয়ে গোলাম ছগীর খুশি হন, কিন্তু কোলের কালাটাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেন। নানার আশ্রয়ে বাড়তে থাকে আমাদের আবু লুলু, কিন্তু সুখ তার কপালে সয় না, কয়েক মাস পরই নিদারুণ নিউমোনিয়ায় ভুগে মরিয়ম বিবি আল্লার পেয়ারা হন। নির্দয় নানার কাছে বাড়তে থাকে লুলু।''
আমি বলি, ''তারপর?''
ফাকরুল ভাই নাক মুছে বীয়ার টানেন খানিকক্ষণ। তারপর বলেন, ''তারপর আর কী? গোলাম ছগীর আবু লুলুর ভরণপোষণে ত্রুটি করেন না, কিন্তু তাকে অহর্নিশি সুদানীর পো বলে ডাকেন। আর চাটগাঁয়ের আলোবাতাসে বড় হওয়া কালো লুলুর বুকে সে ডাক শেলসম বিঁধে! গোলাম ছগীরের দেখাদেখি বাড়ির অন্যরাও লুলুকে সুদানীর পো ডাকা শুরু করে, তাদের দেখাদেখি পাড়াপ্রতিবেশী ও মহল্লার লোকজন, ইস্কুলের চাপরাশী থেকে হেডমাস্টার, কলেজের বান্ধবী থেকে শুরু করে কক্সবাজারের সৈকতপতিতা, সবাই আবু লুলুকে সুদানীর পো ডাকতে থাকে। আর কী এক যন্ত্রণা লুলুকে কুরে কুরে খায়। তাই তো ও এই যন্ত্রণা ভুলে থাকতে বারে পড়ে পড়ে মদ খায়।''
আমি ঠিক বিশ্বাস করতে চাই না কথাটা। বলি, ''তাই নাকি?''
অমনি ফাকরুল ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বলেন, ''প্রমাণ চাও, কাফের কোথাকার? যাও না, ওকে গিয়ে একবার সুদানীর পো বলে ডাকো, দ্যাখো ও তোমার কী হাল করে!''
আমি মাতাল আবু লুলুর বাইসেপের দিকে তাকিয়ে বলি, ''না না, অবিশ্বাসের কী আছে, আপনার কথা কি আমি ফেলতে পারি, বলেন?''
ফাকরুল ভাই জবাবে বাদামের চাট মুখে দিয়ে চিবাতে থাকেন।
(মার্চ ১০, ২০০৬)
মন্তব্য
হাহাহাহা...
সুদানীর পো! মুহাহাহাহা...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
ব্যাপক-বিপুল-বিস্তর!!!
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
আহ ........... সেই বিখ্যাত সুদানীর পো!!!!!!!!!!!!!! হা হা হা
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ডি.এফ.আই.ডি, জাইকা, বাংলাদেশের একটা কোলাবোরেটিভ রিসার্চ প্রোজেক্টে কাজ করতাম। আর.এন্ড.ডি ডিভিশনের চীফ "সুধীর দত্ত" এর কাছে আমরা আমাদের দাবী-দাওয়া পেশ করতাম।
তাঁকে সবসময় "সুধীর ভাই" বলে ডাকতাম!!!!!!!!!!! হা হা হা..........
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের সিনিয়র "অ্যাস-ফাক আলী" দুর্দান্ত ক্রিকেটার থাকলেও তার নাম শুনলেই আউট হয়ে যেতেন - স্রেফ রাগে!!! স্লেজিং কি তা তিনি টের পেয়েছিলেন।
বি:দ্র: ফাকরুল ভাইয়ের গয়া ভ্রমণের ইতিহাস পড়লে পাবলিক খুশি হবে।
কী ব্লগার? ডরাইলা?
আবু লুলুর আরো গল্প আসুক। জম্পেশ….
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
ভালো লাগছে গল্পটা...এন্ডিং দিসেন চরম...
---------------------------------
জানিনা জানবোনা... কোন স্কেলে গাইছে কোকিল
গুনিনা আমি গুনিনা...কার গালে কটা আছে তিল
অসাধারনের চেয়ে একটু বেশি...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
খুবই মজা পাইলাম।
ছ্য় মাস পরেই বাচ্ছা, হুম্, তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে বিয়ে করার কারণটা বুঝতে পারছি এখন। আচ্ছা সুদানীর পো যে ডাকতো সেটা খুব দ্রুত ডাকতে হবে নাকি স্পীড কমিয়ে ?
--------------------------------------------------------
নতুন মন্তব্য করুন