লোকটার কালোকিষ্টি চেহারা থেকে সমস্ত রক্ত নেমে যায় পলকের মধ্যে। "হুজুর ... হুজুর ...।" বাকি শব্দগুলি বের হয় না তার কাঁপতে থাকা ঠোঁটের ভেতর দিয়ে, কিন্তু মোসলেম খানের বুঝতে বাকি থাকে না, লোকটা কী বলতে চাইছে।
"তুম মুসলিম হো কেয়া?" মোসলেম খান আয়েশ করে স্টেনটাকে অন্যকাঁধে ঝোলায়। লোকটার চোখ সম্মোহিতের মতো স্টেনের নলটাকে অনুসরণ করে শুধু।
"হ্যাঁ হুজুর। হাম মুসলিম হায়।"
"নাম কেয়া? নাম বোলো।"
"ইদরিস, হুজুর।"
মোসলেম খান আপনমনে উচ্চারণ করে ইদরিস নামটাকে। বিভিন্নভাবে। ইদ্রিস। ইদরিস। ইদরিশ।
ইদরিস কাঁপতেই থাকে।
"কেয়া ভাই ইদরিস, অওর কুছ হায় কেয়া তেরে নামকে আগে পিছে?"
"হুজুর?"
"কেয়া তেরা নাম সিরফ ইদ্রিস হায়? অওর কুছ নাহি তেরে নামকে সাথ?"
ইদরিস মনে মনে জিভ কাটে হয়তো, মোসলেম খান স্পষ্ট দেখতে পায়। ইদ্রিসের উচ্চতাটুকু সে মাপে মনে মনে। পাঁচ ফিট এক ইঞ্চি হবে। ওজন কেমন হবে এই শুয়ারের বাচ্চার? চল্লিশ সের? মুরগির মতো সিনা। কুকুরের মতো সিয়া গায়ের রং। এ-ই সম্বল করে বুজদিলরা আজাদী চায়।
"মোহাম্মদ ইদরিস আলি হুজুর।"
"ওয়াহ ওয়াহ। কেয়া খুবসুরৎ নাম হ্যায় ভাই! মোহাম্মদ ইদরিস আলি! কান রওশন হো গায়া মেরা। কাপড়া উতার।"
"হুজুর?"
মোসলেম এবার হাত চালায়। চটাশ করে শব্দ হয়। মোসলেম হাতটা নিজের পাৎলুনের পেছনে মুছে নেয় চট করে। বাংগালটার গাল ভর্তি ঘাম।
"বাত সমঝ মে নাহি আয়া মাদারচওদ? ম্যায়নে কাহা কাপড়া উতার।"
ইদরিস আলি কাঁপা হাতে নিজের গেঞ্জি খুলতে যায়। মোসলেম হেসে ফেলে।
"বানিয়ান উতারকে কেয়া দেখলাওগে? তুমহারা হাড্ডি গিননেকা ওয়াক্ত নাহি হ্যায় মেরে পাস। কাপড়া উতারো বেহেনচোদ কাহিকা।"
ইদরিস আলি লুঙ্গির গিঁটে হাত দেয় কাঁপা হাতে। তার ঠোঁটের কোণে রক্ত।
মোসলেম খান স্টেনের গ্রিপ চেপে ধরে অলস চোখে চারপাশটা দেখে নেয় একবার। ধারেকাছে কোন দর্শকও নেই। মোসলেম বিরক্ত হয়। অন্তত শ'খানেক লোকের দেখা দরকার ছিলো এই দৃশ্য।
ইদরিস আলি লুঙ্গি ফেলে দিয়ে দাঁড়ায়।
মোসলেম খান আটদিন আগে এই এলাকায় অপারেশনে ছিলো। ইদরিস আলির মতোই রোগাপটকা একেকটা শুয়ারের বাচ্চা সেদিন হল থেকে পাকিস্তানী ফৌজের ওপর গুলি করার হিম্মৎ দেখিয়েছে। মোসলেমের ইউনিট ছাড়েনি তাদের। পরদিন যতগুলোকে পেয়েছে, পেছনে মাঠে নিয়ে কবর খুঁড়িয়ে গুলি করে মেরেছে। এক দলের কবর অন্য দল খুঁড়েছে, লাশ তুলে এনে গোর দিয়েছে আরেকদল, নতুন খোঁড়া গোরের মধ্যে গুলি খেয়ে লাশ হয়ে পড়েছে আরেকদল, সেই গোরে মাটি চাপা দিয়েছে আরেকদল। পালে পালে বাঙালি। রোগা, কালো, বেঈমান। রাস্তার কুত্তাগুলি পর্যন্ত ওদের চেয়ে উঁচু দরের পাকিস্তানী।
হাফনাঙ্গা ইদরিস কাঁপতে থাকে এপ্রিলের কটকটে রোদের নিচে দাঁড়িয়ে।
মোসলেম খান ইদরিসের শিশ্ন দেখে মনোযোগ দিয়ে। নাম মোহাম্মদ ইদরিস আলি, বললেই ইয়াকিন যাবার পাত্র সে নয়। এই ইদরিস হিন্দুর দালাল, নাকি নিজেই হিন্দু, সেটা পরখ করে দেখতে হবে আগে।
আরশ থেকে মোসলেম খানের ঈশ্বর নেমে ইদরিসের রুগ্ন কুঞ্চিত শিশ্নের ডগায় ভর করেন মোসলেমের স্টেনের দাপটে। তেসরা এপ্রিল, ঊনিশশো একাত্তর।
.
.
মন্তব্য
গল্পটা চমৎকার আগাচ্ছিল। মুখে একদলা থুতু জমে উঠছিল। কিন্তু গল্পটার হঠাৎ করেই মৃত্যু ঘটল!
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
হিমু সাহেব,
এত উর্দু মেরে দিলেন সেগুলোর তো বাংলা করে দেয়া দরকার। বেশীর ভাগই পরিস্থিতির বিচারে বোঝা গেলেও কয়েকটা বোঝা যায়নি, যেমন:
বুজদিলরা
তুমহারা হাড্ডি গিননেকা ওয়াক্ত নাহি হ্যায় মেরে পাস
আমিও উর্দু জ্ঞানাভাবে পুরো রসাস্বাদনে ব্যর্থ হলাম
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। - হুমায়ুন আজাদ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
দারুন লিখেছেন হিমু ভাই। গল্পটা পড়ার পরে একটা অন্ধ ক্রধাক্রান্ত ছিলাম কিছুক্ষণ। এ ধরনের গল্প মনকে সব সময় নাড়া দিয়ে যায়।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
বেশিরভাগ উর্দূ আন্দাজে বুঝতে পারলাম। গল্পটা দারুন সাজিয়েছেন...
বেশ ভালো লাগল।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
গল্প হলেও "সাজানো গল্প" নয়। একাত্তরে বাংলাদেশে এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে। হয়রানি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে (বস্তুত প্রাণরক্ষার তাগিদে)হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যবয়সী পুরুষ খৎনা করিয়েছিলেন, এরকম অন্তত একটি ঘটনা আমার জানা আছে।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
বীভৎস বাস্তবতা...
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
চমত্কার।
আমার বিবেচনায় শেষ প্যারাটাই পুরো গল্প। ওখানে থামাটা দুর্দান্ত।এর পর গল্প আপনা আপনিই পাঠকের অনুমানে এগুতে থাকবে।
উর্দু বয়ান তোফা ।
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
সব কথা বলে দেয়া এই এক লাইনে।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
একেবারে ঠিক কথা। শেষের লাইনটা বিশেষ করে আমার কল্পনাশক্তিকে আলোড়িত করেছিল। মনে হল একটা নাটকীয় মুহূর্তে হঠাত নাটকটা শেষ হয়ে গেল। তাই শেষ হয়েও যেন মনে হল শেষ হলোনা। ভালো সমাপ্তি। তবে এই লাইনটা উল্লেখযোগ্য:
জোস গপ্পো লিখেছেন হিমুদা।
এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে সেই সময়ে, আমার প্রজন্মের অবশ্য সবটাই বড়দের থেকে শোনা, টিভি দেখে কিছু আর বই পড়ে বাকিটা শেখা। পড়তে পড়তে পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। মোসলেম ব্যাটার সামনে থাকলে শিশ্ন গোড়া থেকে কাইটা দেখায় দিতাম সে কত্তোবড় মুসলিম।
--------------------------------------------------------
সবাইকে ধন্যবাদ জানাই মন্তব্যের জন্যে।
উর্দু সংলাপের বাংলা করে দেয়া যায় আসলে, টীকা হিসেবে। কিন্তু তাতে গল্প ঝুলে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, তাই সে চেষ্টা করিনি আর।
গল্পটা গুছিয়ে লিখতে পারিনি, আবার ফেলে রাখলে হয়তো না-ও লেখা হতে পারতো। ত্রুটিগুলো নির্দেশ করলে উপকৃত হবো।
হাঁটুপানির জলদস্যু
- এর চেয়ে গুছিয়ে লেখার দরকার নেই হিমু।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
বাস্তব ঘটনার চমৎকার গল্প।
..আমিও উর্দু কম বোঝার দলে। ভাবার্থ করেছি নিজের মতো।
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
হিমু থেমেছে । জায়গামতো ।
-------------------------------------
"এমন রীতি ও আছে নিষেধ,নির্দেশ ও আদেশের বেলায়-
যারা ভয় পায়না, তাদের প্রতি প্রযোজ্য নয় "
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
আমিও বলি, এর চাইতে গুছিয়ে লেখার দরকার নেই হিমু!
কী ব্লগার? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন