প্রবাসে দৈবের বশে ০৪৯

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: মঙ্গল, ১৬/০৯/২০০৮ - ৪:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

probashe

১.
সিনেমায় মাঝে মাঝে দেখা যায়, নায়িকার রূপ দেখে নায়কের ভোলাভালা বন্ধুর চশমা ফেটে গেছে। সেদিন বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারের এক বিশিষ্ট গুণীজনের ব্লগ পড়তে গিয়ে আমারও চশমার কাঁচ ফেটে দুই টুকরা।

দোষটা তার বক্তব্যের ঘাড়ে চাপাবো, নাকি চশমার স্ক্রুয়ের অপর্যাপ্ত টর্ক আর মাধ্যাকর্ষণের সমন্বয়ের ওপর, বুঝে উঠতে পারছি না। তবে বিপদটা ঘটেছে হের চৌধুরীর বাড়িতে। ফলে বিনা চশমায় কোনমতে বাসে চড়ে আবার বাড়ি ফিরে শেষ স্পেয়ারটাকে নাকে আঁটাতে হলো। সেটা আবার উপহার পাওয়া, উপহার যিনি দিয়েছেন তিনি সম্ভবত হাতির নাকে মেপে কিনেছেন জিনিসটা। বিশাল সেই চশমা পড়ে মনে হলো একটা উইন্ডশিল্ড নাকে নিয়ে ঘুরছি। ওয়াইপারের অভাবে কিছুটা খালি খালি লাগছিলো যদিও।

তবে একটা ভালো দিকও পাওয়া গেলো। দেশ থেকে শেষ কেনা ফ্যাশনদুরস্ত যে ফ্রেমটা বেশ কয়েকমাস আগে একইরকম স্ক্রুশৈথিল্যের কারণে বিকল হয়ে পড়েছিলো, সেটাকে মেরামত করলাম এই ভাঙা চশমার স্ক্রু খুলে নিয়ে। অনেকে মাঝে পরামর্শ দিয়েছিলেন, অপটিকার (চশমানির্মাতা) এর কাছে গিয়ে চশমা ঠিক করিয়ে আনতে, কিন্তু সামান্য একটা ১.৮ মিলিমিটার স্ক্রু এর জন্য কারো দ্বারস্থ হবো, এই চিন্তাটাই পীড়া দিচ্ছিলো বলে স্পেয়ার দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছিলাম। আবার ঐ মাপের স্ক্রু কোন হার্ডঅয়্যারের দোকানে খুঁজে পাইনি। আজকে আইনঅয়রোগেশেফট থেকে (যা কিনবেন এক টাকা) সূক্ষাতিসূক্ষ্ম স্ক্রু-ড্রাইভারের সেট কিনে এনে পুরনো ফ্রেমটাকে যাকে বলে ইসকুরু টাইট দিলাম। ফলাফল ইতিবাচক।

২.
সেদিন আমার প্রতিবেশিনী ও নতুন বন্ধু উজবেকিস্তানের মেয়ে গুলিয়ার বাসায় পোলাও খাওয়ার দাওয়াত ছিলো। গুলিয়া ভোনহাইম ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তার বাসা পাল্টানোর কাজে আমি এবং তার বন্ধুনি ইরিনা তাকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা করেছি বলেই আমরা আমন্ত্রিত।

উজবেকরা ভালো পোলাও রান্না করে, এমনটা আমিও শুনেছি। গুলিয়া আমার সাথেই বেরিয়ে বাজার করতে এসেছে, কেনাকাটার সময় তার চিন্তামগ্ন হাবভাব দেখে মনে হলো আজকে আর কপালে পোলাও জুটবে না। তুর্কি দোকান থেকে মাংস আর জার্মান দোকান থেকে চাল ও গাজর কেনার পর আফগান দোকানের শরণাপন্ন হতে হলো কোন এক রহস্যময় মশলার খোঁজে, যেটা ছাড়া "পিলো" রান্না করা যাবে না। সমস্যা একটাই, এই মশলার জার্মান নাম সে জানে না। আফগান দোকানি ভদ্রলোক দারি-পশতু-উর্দু-হিন্দি-জার্মানে সমান পারদর্শী, কিন্তু উজবেক ভাষার ব্যাপারে তিনি মাফও চান দোয়াও চান। মশলার ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে শেষমেশ বললাম, তোমরা এই মশলাকে কী নামে ডাকো?

গুলিয়ার উত্তর শুনে কাজটা সহজ হলো, জিরাহ। এই জ হচ্ছে সেই Zানতি পারো না'র Z। জিরা ওরফে কিউমিনের প্যাকেট খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করলাম, এই জিরা সেই িZরাহ নাকি। তারপর জানলাম, এই সেই মহার্ঘ্য মশলা, যা ছাড়া "পিলো" অচল।

যারা উজবেক "পিলো"র সরলতম সংস্করণ রান্না করে খেতে চান, তাদের জন্য রেসিপিটা বলি। তিনজনের মাপে রান্না করা হয়েছিলো, তিনটা নাজমুলহুদা সাইজের পেঁয়াজ আর পাঁচশো গ্রাম গাজর কুচি করুন। ওদিকে পাঁচশো গ্রাম গরুর মাংস টুকরো টুকরো করে একগাদা জিরা দিয়ে কষে মাখান। তারপর তেলে পেঁয়াজ আর গাজর ভাজতে শুরু করুন। কিছুক্ষণ পর মাখানো মাংস দিন। তারপর ঘুঁটতে থাকুন। আমি অবশ্য ঘোঁটার কাজটা গুলিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়ে তার ছিপছিপে ইউক্রেনিয় বান্ধবী (সন্ন্যাসী আসলেই বড় সুখে আছেন) ইরিনার সাথে গুজুর গুজুর খোশগল্প করছিলাম, চারিত্রিক সমস্যা থাকলে যা হয় আর কি। এক পর্যায়ে লবণ দিয়ে আরেক দফা ঘুঁটে আন্দাজমতো চাল বসিয়ে ঢেকে দিন।

জিনিসটা খেতে খারাপ হয় না। আমরা যদিও নানারকম সুগন্ধী মশলা দিয়ে থাকি পোলাওয়ে আলাদা গন্ধ আনার জন্যে, ওদিকে মাংসেও হলুদ-মরিচ-ধনিয়া-আদা-রসুন দিয়ে থাকি, কিন্তু ওসব ছাড়াও বেশ স্বাদু হয় পোলাও, হয়তো জিরার কারণেই।

পোলাও আমরা উজবেকদের কাছ থেকেই পেয়েছি কি না জানি না। ইরিনা দেখলাম জিরার প্রেমে মশগুল, সে নোট করে নিলো, অমুক দিন সে অমুক জায়গায় গিয়ে এই জিনিস কিনে পরীক্ষা করে দেখবে। মনে মনে বললাম, হায়রে ছেরি, চৌধুরীর তেহারি খেলে তো তুই একটা হপ্তা শুধু চামচ শুঁকবি!

৩.
ইরিনা একটা ডিস্কোঠেকেতে কাজ করে সপ্তাহান্তে, তার আমন্ত্রণে এক রাতে আতিথ্য নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে, মধ্যযুগীয় গানবাজনার সাথে মধ্যযুগীয় কস্টিউম পরা লোকজনের মধ্যযুগীয় নাচ দেখতে। তবে আজকে তা নিয়ে লেখার দম পাচ্ছি না, পরবর্তী কোন পর্বে আয়ু-স্বাস্থ্য-ইচ্ছার ত্রিবেণীসঙ্গম ঘটলে লিখে ফেলবো।


মন্তব্য

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

আমারো মনে হয় চারিত্রিক ত্রুটি আছে ... উজবেক বন্ধুনী নিয়া "পিলো" খাইতে ইচ্ছা কর্তাছে দেঁতো হাসি
................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আহ্... বিদেশে থাকার কি সুখ... বড় হইয়া বিদেশে থাকুম... সিদ্ধান্ত নিলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

খেকশিয়াল এর ছবি

নজরুল ভাই আমরা আর কবে বড় হমু ? কবে বৈদেশ যামু মন খারাপ

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অমিত আহমেদ এর ছবি
জিফরান খালেদ এর ছবি

এখন থেকে ইউক্রেন দেশটা বেশ ভাল হয়া গেল...

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

উজবেক পোলাওয়ের কতো যে রেসিপি আছে! একবার আস্ত একখান বই দেখসিলাম এই রেসিপিগুলা নিয়া।

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍ইউক্রেনে অন্তত দশটা দিন যে কাটাইয়া গেসে, সে আবার এইখানে আসার জন্যে উদগ্রীব থাকে - এইটা বহুবার পরীক্ষিত সইত্য। হের লাইগাই তো পইড়া আসি এই দ্যাশে চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। - হুমায়ুন আজাদ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

রায়হান আবীর এর ছবি

গুরু ভিসা পাঠান। আমি আপনার বাসায় যামু...

=============================
তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা!
রাঙ্গা মাটির দেশে যা!
ইতাক তুরে মানাইছে না গ!
ইক্কেবারে মানাইসে না গ!

মূলত পাঠক এর ছবি

বা: খাসা লাগলো পড়ে। লিখতে থাকুন দাদা।

আলমগীর এর ছবি

পোলাও এক্সরাশিয়া অঞ্চল থেকে আসার চান্স বেশী।
লেখা ভাল লাগল।

কীর্তিনাশা এর ছবি

রোজার দিনে পোলাও'র গল্প!! রেগে টং

এমনেই ক্ষিদার জ্বালায় বাঁচি না। হিমু ভাই আপনের উপরে গজব পড়বো কইয়া দিলাম। মন খারাপ

------------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমার এক বন্ধু একবার সপ্তাহ খানেক তাশখন্দে ছিলেন। তার মুখে শোনা উজবেকিস্তান সংক্রান্ত বদনামগুলোর একটা হচ্ছে খাবারের (রান্নার স্টাইল)। এখন আপনাদের কথা শুনে ধন্দে পড়ে গেলাম।

সন্ন্যাসী কি বিষয়ে ইউক্রেনের প্রসংশা করেছেন বুঝতে পারি নাই। বিস্তারিত বুঝিয়ে বলবেন। প্রয়োজনে স্বতন্ত্র পোস্ট দিবেন। নয়তো আমরা যারা ইউক্রেন যাই নাই (বা যাবার সম্ভাবনা নাই), তারা কিভাবে বুঝবো?

তবে অনেক আগে "উদয়ন"-এ পড়েছিলাম ইউক্রেনীয় রান্নার স্বাদ নাকি অপূর্ব। এব্যাপারে সন্ন্যাসীর মত কি? অথবা হিমু কি ইরিনার কাছ থেকে ইউক্রেনীয় স্বাদ (I mean, খাবারের) পেয়েছিলেন?

===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

খেকশিয়াল এর ছবি

পোলাও খাম, উজবেক যাম !

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

দ্রোহী এর ছবি

চশমা ফাটার মত ব্লগার তো হাবিব মহাজন ছাড়া কাউরে দেখি না!!!

আমিও বড় হইলে ইউক্রেন যামু!


কী ব্লগার? ডরাইলা?

স্বপ্নাহত এর ছবি

মন খারাপ

---------------------------------

বিষণ্ণতা, তোমার হাতটা একটু ধরি?

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

সবজান্তা এর ছবি

হুম, হিমু ভাই এর অবস্থা সুবিধার না। সারা লেখার মধ্যে ছড়ায়া ছিটায়া শুধু কয়েকটা মাইয়ার নামই লেখলেন।


অলমিতি বিস্তারেণ

অমিত আহমেদ এর ছবি

আরে তাদের কথা বলার জন্যই তো পোস্ট। রান্না তো উছিলা মাত্র। হে হে হে! বুঝতে হবে, বুঝে ইজি থাকতে হবে।


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হুমমম তেলের বদলে বাটার দিলে আরো ভাল হয় দেঁতো হাসি আমিও রান্না শিখতেসিত তাই টুকিটাকি জানি দেঁতো হাসি
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

শিক্ষানবিস এর ছবি

বৈদেশ কাহিনী শুনতে সবসময়ই ভাল লাগে। এবার তার সাথে ক্ষুধা যোগ হয়েছে। আহ! কতদিন ভালমন্দ খাই না!

তানবীরা এর ছবি

হিমু, পোলাটা আসেও না, দাওয়াতও দেয় না। আমিও হের চৌধুরীর রান্না তেহারী খেয়ে চামচ শুকতে চাইইইইইই, দাওয়াত চাইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

ঐ কথাটা জোস কইছেন, চৌধুরির তেহারী খাইলে তো চামচ শুকবি; খুব মজা পাইছি।
আর আমাগো জিরা খুঁজতে গিয়া এত্তো নাকানি চুবানি খাওয়া লাগল আপানাগো, আহারে !!! তবে পোলাওয়ের মধ্যে জিরার ব্যবহার আগে শুনিনাই। জিনিসটার রেসিপি পইড়া উজবেক বিরিয়ানী বইলা মনে হইতাছে। মাংস, হেন-ত্যান কত কিছু দিসে তো তাই। আমাগো পুলাও তো খালি ঘিয়ে রান্না করা ভাত, আর কিস্‌সু না।
যাই হোক, আপনার নয়া ইউক্রেনীয় বান্ধবীর গপ্পো শুনার অপেক্ষায় রইলাম। তাড়াতাড়ি ত্রিবেনীসংগম ঘটুক সেই প্রার্থনা করি। আপনার উজবেক বান্ধবীটা কি খালি আছে ? তাইলে আওয়াজ দিয়েন বস।

--------------------------------------------------------

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আরেকটা চশমা আছে তো? নাকি আমারটা দিয়া কিছুদিন চলবেন? অবশ্য দুই চোখের গ্লাস দুইজনে ভাগ কইরা নিতে হইবো। চিন্তিত
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

এক পিচ্চিরে তার বাপে জিজ্ঞেস করছে, কী রে বাবা, পোলাও খাবি?
পিচ্চি এই প্রথম পোলাওয়ের নাম শুনছে, সে কয়... আব্বা, আমি পোলাও খামু, মাইয়াও খামু... হো হো হো
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।