ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম, রাত জেগে তাই পড়লাম শহীদুল জহিরের "মুখের দিকে দেখি"।
জহির আমার প্রিয় লেখকদের দলে ঢুকে পড়েছেন একেবারে প্রথম পাঠেই, তাঁর "কোথায় পাবো তারে" গল্পটি যাকে বলে গুরবে কুশতন শব এ আউয়াল, পহেলা রাতেই মার্জার নিধন। খুব আগ্রহ করে বইটা হাতে নিয়ে একটানে পড়ে শেষ করলাম, সেই আনপুটডাউনেবল বইগুলোর একটি এটি। বুক রিভিউ লিখতে বসিনি, বিস্তারিত চুলচেরা বিশ্লেষণের ইচ্ছা বা যোগ্যতা কোনটিই বোধহয় আমার নেই, যা লিখবো সেটি হয়তো র্যানসমনোট হয়ে দাঁড়াবে, মানে কাহিনীর এখান ওখান থেকে কেটে জড়ো করা কিছু, আর বলবো যে জহির অন্য রকম করে আঁকছেন গল্পকে। তাঁর কাহিনীর ভাষা আর ভাষার কাহিনী একে অন্যকে অতিক্রম করে ছুটছে শুধু, চরিত্রগুলোকেও তিনি কাথ ব্লঁশ ধরিয়ে দিয়েছেন হাতে, তারাও ছুটছে সমানে। "মুখের দিকে দেখি" পড়ে মনে হলো, এ এক সন্তর্পণ রেখা অতিক্রমের গল্প। চরিত্রগুলি মাঝে মাঝেই বাস্তবতার রেখা অতিক্রম করে বেড়াতে যায় অবাস্তবের দেশে। বাস্তবতার ভেতরেও তারা রেখা অতিক্রমের খেলায় মেতে থাকে, ক্যাথলিক ফাদার সেলিবেসির কড়ার আর ক্যাসক বিসর্জন দিয়ে রেখা পেরিয়ে প্রোটেস্টান্ট বালিকা প্রেয়সীকে বিয়ে করে, বাঙালি মুসলমান তৃষিত হয়ে ওঠে খ্রিষ্টান প্রেমিকার কণ্ঠলগ্ন যীশুকে চুম্বনের জন্য, মুসলমান যুবতী খ্রিষ্টান প্রেমিককে টেনে আনতে চায় নিজের ধর্মের চৌহদ্দির ভেতরে, মহল্লার সামাজিক বান্দরেরা বিবর্তনের রেখা টপকে স্নেহের টানে ফিরে আসে বান্দরের দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠা চানমিঞার কাছে, চানমিঞার মা খৈমন সাধ্যের রেখা ফুঁড়ে ছেলেকে ভর্তি করায় পয়সাওলা পোলামাইয়াদের ইস্কুল সিলভারডেলে, মামুনের মা মামুনকে কাঠের ভুসি আনতে পাঠিয়ে তাকে ঠেলে দেয় স্থানকালের রেখার ওপারে ... তাই মামুন বছরের পর বছর মামুনুল হাই হয়ে একবার জুলি ক্লার্কের টানে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে হানা দেয়, আবার ওদিকে বছরের পর বছর আব্দুল ওদুদ চৌধুরীর মেয়ের পোষা খরকোস হয়ে চোরাচালানের ট্রলার নিয়ে সীমান্ত রেখা পার হয়ে বার্মা চলে যায় সার আর অক্টেন নিয়ে। সব চরিত্র কখনো এক কখনো অনেক হয়ে ছুটতে থাকে উপন্যাসের সাদাকালো ছকের মধ্যে। নারিন্দার ভূতের গল্লি থেকে বার্মিংহ্যাম পর্যন্ত জহিরের অক্ষরসন্তানেরা রীতিমতো একটা কান্ড করতে থাকে, কখনো র্যাবের কমান্ডার আর কখনো গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্পনির্যাস এসে ভুলিয়ে দেয় কিভাবে কাদের সিদ্দিকি হয়তো রেসকোর্সের ময়দানে নিয়াজির থোতার নিচে ঘুসি মেরে কাঁদিয়ে দিয়ে বলতে পারতেন শুয়ারের বাচ্চা, চুতমারানির পোলা, তোর মায়রে চুদি, আর অরোরার প্রশ্নের জবাবে বলতে পারতেন আই অ্যাম এ বাঙ্গালি উইথ শক্ত হাড্ডি এন্ড লম্বা বিয়ার্ড, মাই নেম ইজ আব্দুল কাদের, আই কাম ফ্রম টাঙ্গাইল, ডুয়িং গুল্লি, ফাইটিং ফর মাই কান্ট্রি --- হু আর ইউ? পাঠকের চোখে মহল্লার বান্দরগুলির হোগার লাল আর রবার্ট ক্লার্কের জ্ঞানধন্য কাঁটাওলা শিমুলের ফুলের লালের ঘোর লাগে ... পাঠক তো আর চানমিঞা নয় যে লাল আর সবুজকে ধূসর দেখবে, পাঠক তো বান্দরের দুদ খেয়ে বড় হয় নাই।
আয়রে তবে ভুলের ভবে অসম্ভবের ছন্দেতে ... সুকুমারের ঐ চরণটাকেই তো জীবনের ধ্রুবতারা করি আমরা অনেকে। জহির আমাদের কাঁধে চড়িয়ে যেন চড়ক মেলা দেখানোর লোভ দেখিয়ে অপহরণ করে অসম্ভবের ছন্দে নাচতে নাচতে ঢুকে পড়েন ঐ ভুলের ভবে।
শহীদুল জহির, আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।
মন্তব্য
- "লেখার দিকে দেখি" - কারণ লেখাটা জম্পেশ হইছে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
অভিবাদন শহীদুল জহির, আর এতসুন্দর করে গুছিয়ে লেখার জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি
------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !
হুমম...
লেখাটা ভালো লাগলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পড়তে হবে।
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
বইটা মনে হচ্ছে না পড়লেই নয়।
.......................................................................................
Simply joking around...
"মুখের দিকে দেখি"র একটা অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পুরোনো ঢাকা, চট্টগ্রাম আর ইউরোপীয়দের অধস্থন-পুরুষ দেশীয় খ্রীষ্টানদের মত সমৃদ্ধ নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পন্ন তিনটি গ্রুপকে একসাথে হাজির করা। খুব গভীর দেখার চোখ আর সংবেদনশীল মন না থাকলে এই গ্রুপগুলোর কালচার, আচরন, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদিকে তুলে ধরা সম্ভব না। দীর্ঘদিন পুরোনো ঢাকা বা চট্টগ্রামে থাকলেই এটা সম্ভব নয়। বাংলা ভাষায় যাদু-বাস্তবতার ঘরানার উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটি আমার মনে হয় সবচেয়ে সার্থক। কারো ভিন্নমত থাকলে জানাবেন।
"কোথায় পাবো তারে" গল্পটিকে আমার কাছে বোর্হেসের বিখ্যাত ছোটগল্প "নদীর তৃতীয় তীর"-এর সাথে তুলনীয় বলে মনে হয়েছে।
শহীদুল জহির অন্ততঃ ইংরেজী ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ কি কেউ নেবেন?
দরকারী পোস্টটির জন্য হিমুর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এক সময় গুগুলে শহীদুল জহিরকে খুঁজতে গিয়ে এ লেখা পড়েছিলাম, ভালো লেগেছিল তখনো।
শহীদুল জহির এক কথায় দূর্দান্ত!!!
পড়ার ইচ্ছা জাগল। কিন্তু কই পাব?
___________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
আজিজ।
=============================
http://www.somewhereinblog.net/blog/mashablog/15105
বহুদিন আগে মুখের দিকে দেখি নিয়ে একটা পোস্টাইসিলাম। হিমুকে ধন্যবাদ এই বইটির আলোচনা করবার জন্য।
*********************************************
নতুন মন্তব্য করুন