কাবার্ডের ভেতরে কঙ্কালগুলো (এক)

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বুধ, ০৮/১০/২০০৮ - ১০:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বয়স তো কম হলো না। ৭০-৮০ তো হবেই। কত পাপ করেছি এ জীবনে। প্রায়শ্চিত্তও করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত করতে বেরিয়ে পাপ করে এসেছি এমন ঘটনাও কম নয়। তাই ঠিক করেছি কাবার্ডের কিছু বাছাই করা কঙ্কালকে আলোবাতাস দেখাবো। এলোমেলো, হাতে যেটা ঠ্যাকে সেটা।

প্রথম কঙ্কাল

ছয়জন যাচ্ছি কক্সবাজার। ট্রেনে চিটাগং, সেখানে পতেঙ্গায় কিছুক্ষণ, তারপরে বিকালে কক্সবাজার পৌঁছাবো। সেদিন চিটাগঙে হাফবেলা হরতাল, বেশ নিরিবিলি হবে, আমরা রাতের ট্রেনে চেপে বসেছি। শীতের রাত, আমরা চারজন বামপাশে, আর দু'জন ডানে।

হঠাৎ আমার চোখ গেলো সেই ডানপন্থী এক ভদ্রলোকের দিকে। তিনি ট্রেনের মনোরম ঝাঁকুনির তালে তালে ঢুলছেন, দুলছেন আর হঠাৎ চমকে চমকে জেগে এদিক ওদিক তাকিয়ে চেয়ারের পেছনে একটা খাপ আছে, সেখান থেকে পরম মমতায় একটা কমলা বার বার বার করে শুঁকছেন, নেড়েচেড়ে দেখছেন, তারপর আবার রেখে দিচ্ছেন। তারপর আবারও দোল দোল ঢুলুনি।

কমলা হচ্ছে খোসা ছাড়িয়ে খেয়ে ফেলার জিনিস, আতরের মতো শোঁকার কিছু না, আমার উদ্ধত তরুণ চিত্ত আমাকে তেমনই জানালো। আমি আমার বন্ধু রাশেদকে বললাম, কমলাটা বার করে খেয়ে ফেল। রাশেদ আবার সম্পূরক কুবুদ্ধি দিলো, কমলার বর্তমান বাজার দর যাচাই করে একটা সিগারেট সেটার ক্ষতিপূরণ হিসেবে রেখে দেওয়ার।

উত্তম প্রস্তাব। রাশেদ সিগারেট রেখে কমলা এনে সীটে বসেই খাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু কমলার আগ্রাসী ঘ্রাণ সম্পর্কে সাবধান করে দিলাম। দুটি কোয়া কনসালটেন্সি ফি দিয়ে সে চলে গেলো দূরে। পিছু পিছু আমার বন্ধু মুস্তাকিম আর সাদিক।

যথারীতি সেই ভদ্রলোক চমকে জেগে উঠলেন, তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত ঢোকালেন চেয়ারের ঝোলায়। তারপর রীতিমতো আঁতকে উঠে বার করলেন সিগারেটটা। তারপর সেটা হাতে নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন, "আমার অরেঞ্জ? অরেঞ্জ কোথায় গেলো যে?"

আমার মুখে তখন সদ্যভুক্ত কমলার সুঘ্রাণ। ভদ্রলোক নাকমুখ কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা আমাকেই পাকড়াও করলেন। আমার তখন বয়স কম, কাঁধ পর্যন্ত গজগজে চুল, মুখে অযত্নসম্ভূত দাড়িদুড়ি রেখে চে গেভারার একটা অপভ্রংশ হবার অপচেষ্টায় রত, কিন্তু তিনিও মুশকো রীতিমতো, আমার বিপ্লবী মুখচ্ছবিকে দুটাকা দামও দিলেন না। বললেন, "ব্রাদার, এইখানে যে অরেঞ্জ ছিলো, কোথায় গেলো?"

রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো আমি যেন জেগে উঠলাম বিশ বছর পর। বললাম, "জ্বি, আমাকে কিছু বলছেন?"

এবার ভদ্রলোক চটে উঠলেন, কারণ বাতাসে তখনও ভেসে বেড়াচ্ছে কমলার গন্ধ। উৎস আমার মুখ। তিনি ফাক ইউ ভঙ্গিমায় সিগারেট উঁচিয়ে গর্জে উঠলেন, "এইখানে একটা অরেঞ্জ ছিলো। কে যেন নিয়ে গেছে, আর তার বদলে একটা সিগারেট রেখে গেছে! কে সে?"

আমি খুবই দৃঢ়তার সাথে বললাম, "আচ্ছা!"

এরই মধ্যে রাশেদ-মুস্তাকিম-সাদিক ফিরে এসেছে। গা দিয়ে ভকভক করে কমলার গন্ধ বেরোচ্ছে। অসভ্যের মতো কমলা খেয়েছে শালারা। ভদ্রলোক তড়পে উঠে ওদের ধরলেন। সেই একই জিজ্ঞাসা।

রাশেদ একটা সিগারেট ধরিয়ে সিগারেটটা উল্টেপাল্টে দেখলো, তারপর বললো, "রহস্যজনক।"

এবার ভদ্রলোক পুরো ফেটে পড়লেন। তিনি ফিরে গেলেন চিটাগঙের প্রসিদ্ধ ভাষায়, যা আমি বুঝি না। তবে অরেঞ্জ আর *ুদানি শব্দ দুটি বুঝলাম, চেনা চেনা লাগলো বলে। মিনিট পাঁচেক অনর্গল ভারতীপূজার পর তিনি আবার আমাদের দিকে ফিরলেন। চোখে আগুন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কমলাটার রং কী ছিলো?"

ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, "জ্বি?"

আমি আবারও জানতে চাইলাম, কমলাটার রং কী ছিলো। নিখোঁজ কমলা সম্পর্কে কিছু তথ্য পেলে যে তার একটা হদিশ বার করা যায়, সেটাও জানালাম। ভদ্রলোক আবারও শুরু করলেন চিটাগঙের ভাষায় আপনমনে কথা বলা। বিড়বিড়বিড়।

এক পর্যায়ে সামনের সীটে বসা এক ভদ্রলোক বললেন, "ভাই, আপনার কমলা গ্যাছে গ্যাছে আর পাইবেন না। আর সিগারেট যেইটা পাওয়া গ্যাছে ঐটা আপনি না খাইলে আমারে দিয়া দ্যান।"

আবার গালি। বিড়বিড়বিড়।

কাঁহাতক আর গালাগাল করা যায়? ক্লান্ত হয়ে আবার ঢুলতে লাগলেন বেচারা। হাতে ধরা না ধরানো সিগারেট। একটু পর পর চমকে চমকে ওঠেন, আর রোষকষায়িতলোচনে আমাদের আগাপাশতলা মাপেন।

আমরা নিজেদের মধ্যে কমলার গন্ধ দূর করার জন্য যার যা আছে জ্বালিয়ে নিয়ে বসলাম। আমি ধূমপান করি না, তামাকের গন্ধ অসহ্য লাগে, কিন্তু কমলার গন্ধ ঢাকা পড়বে এই আশায় বসে রইলাম ধোঁয়াখোরদের পাশে।

ঘন্টাখানেক পর রাশেদ প্রস্তাব করলো, একটা কমলা কোন স্টেশন থেকে কিনে আবার ঐ ঝোলায় রেখে দেয়া হোক। কিন্তু আমরা ভেটো দিলাম।

ভাই, আবারও যদি কোনদিন দেখা হয়, আপনাকে আমি দুইটা কমলা কিনে খাওয়াবো। সালাম।

পুনশ্চঃ বহু আগে অন্যত্র প্রকাশিত। সচলরা চাইলে আপনাদেরও কিছু কঙ্কাল মন্তব্যের খাতায় যোগ করতে পারেন।


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

হিমু, আপনি কখনও 'My Name is Earl' দেখেছেন? না দেখে থাকলে একটা এপিসোড অন্ততঃ দেখতে পারেন। আর্লও প্রতি এপিসোডে তার অসংখ্য কঙ্কালের ভিড় থেকে বেছেবুছে একটাকে বার করে, তাতে হাড়মাস লাগিয়ে 'মানুষ' বানিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার একটা চেষ্টা করে, পাদ্রীর কাছে কনফেশনের মনোভাব নিয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে, এবং মন দিয়েই করে! কিন্তু তারপর কি কি যেনো হয়, আর্ল যে কে সেই আর্লই থেকে যায়, কঙ্কালের সংখ্যাও কমে কিনা ঠিক বলতে পারবো না, আর আমরাও তাই পরবর্তী এপিসোডে আর্লের (ঘটলেও ঘটতে পারে) আত্মোন্নতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি হাসি

এক্ষেত্রেও, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম!

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনার শিরোনামটা দুর্দান্ত লাগলো। লেখাটা তো অবশ্যই। আপনারই মতো। চালিয়ে যান।
কোথায় যেন সন্ন্যাসীজী মন্তব্য করেছিলেন, আপনি নাকি আবার কোন কিছুই সমাপ্ত করতে জানেন না ! এখানেও যদি এ রকম কোন দুরভিসন্ধি থেকে থাকে, আগেই জানিয়ে দেন। তাহলে আমরা না হয় এখানে ঢুকলামই না !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍সন্ন্যাসীজী মন্তব্য করেছিলেন, আপনি নাকি আবার কোন কিছুই সমাপ্ত করতে জানেন না !

তেব্র পেরতিবাদ! আমি কোথাও বলিনি অমন কথা! বলেছি, "অজস্র অসমাপ্ত গল্পের লেখক..."

খাড়ান, আমার কথা বিকৃত করে অপবাদ ছড়ানোর দায়ে কেস ঠুকবো আপনার নামে। মানহানি মামলা! ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণটা আগে ঠিক করে নিই...

আছেন নাকি কেউ উকিল, ব্যারিস্টার? হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

পলাশ দত্ত এর ছবি

বয়স তো কম হলো না। ৭০-৮০ তো হবেই।

-এটা কার বয়স?

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

অমিত আহমেদ এর ছবি

ব্রাদার, আপনার সব পোস্টে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে আর ভাল্লাগে না। তাই এইবারে সব একসাথে বলে দিচ্ছি - টাকা হলে আপনার দুই হাত আমি সোনা (স্বর্ণ, উল্টাপাল্টা আইডিয়া পাইয়েন না আবার) দিয়ে মুড়ে দেবো।

চাঁটগার লোকেরা কথায় কথায় "যে" কেনো বলে সেইটা একটা রহস্য যে!


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনে তো দেখি খারাপ ছিলেন... আমি আরো ভালো ভাবছিলাম।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মূলত পাঠক এর ছবি

একটার বদলে দুখানা কমলালেবু কিনে সেরে দেবেন, বিষয় ততো সোজা নয়। ঐ একখানি লেবুর দামের এন পি ভি বার করুন (নেট প্রেসেন্ট ভ্যালু), এত বচ্ছর পর তােত এক ঝুড়ি লেবু হবে। আর তার চেয়েও বড় আশঙ্কা আছে। কে জানে ভদ্রলোক হয়তো লেবুটার বিচি পুঁতে গাছ করতেন, তা থেকে কমলার বাগিচা হত, তাতে করে যে পরিমাণ উপার্জন হত তা ফেরত দেবার কথা ঘুনাক্ষরেও ভাববেন না। তার ওপর যদি কমলাবনের আলোছায়ায় ওনার কিশোরী কন্যা খেলে বেড়াতো আর তা দেখে তিনি যে আনন্দ পেতেন তার খতিয়ান নেওয়া হয় তো সেটা ক্রেডিট কার্ডের বিজ্ঞাপনী ভাষায় হবে "প্রাইসলেস"। খাল কেটে শেষে কুমির নয়, তিমি আনবেন নাকি মশায়?

তার চেয়ে কমলা খান ভুলে যান। আমাদের আলমারিও নাই, কঙ্কালও নাই।

ধূসর মানব [অতিথি] এর ছবি

সিরিয়াল দেখলে ডর করে। কাহানি ঘরঘর কির মত মনে হয়। শ্যাষ নাই......।
তবে এইটা দেখি একপর্ব একপর্ব কাহিনী।

গোপাল ভাঁড় এর ছবি

হ্যাব্বি হইছে।
--------------------------------------------
<ঘ্যাচাত, ঘ্যাচাত, ঘ্যাচাত> - আমার সিগনেচার

--------------------------------------------
বানান ভুল হইতেই পারে........

ভাঙ্গা মানুষ [অতিথি] এর ছবি

আচ্ছা, কমলার রঙ আসলে কী ছিল? চোখ টিপি

তীরন্দাজ এর ছবি

ভাই, আবারও যদি কোনদিন দেখা হয়, আপনাকে আমি দুইটা কমলা কিনে খাওয়াবো। সালাম।

তা আর কখনোই করে ওঠা হয়না! মজার গল্প!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পরিবর্তনশীল এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার কঠিন কোন লেখা পড়লাম। মারাত্নক। মারাত্নক। কংকাল বাইর করার আইডিয়াটা দারুণ লাগল।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আরণ্যক সৌরভ (ঠিকানা নেই, যাচাই করারও দরকার নেই) এর ছবি

প্রথম কয়েকটা লাইন পড়েই বুঝতে পেরেছি অনেক পুরোনো লেখা। হিমু ভাইও ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছে।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

সচলরা চাইলে আপনাদেরও কিছু কঙ্কাল মন্তব্যের খাতায় যোগ করতে পারেন।

জরিপ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকবে জন্য এইটা কি আপনার নতুন কোন জরিপের তরিকা? চিন্তিত

সিরিজের নামটা অসাধারণ লাগল।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

কম্লার বদলে সিরকেট? চিন্তিত
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

যুধিষ্ঠির এর ছবি

খুব ভালো লিখেছেন। সিরিজের ধারণাটাও চমৎকার। পড়ে প্রথমে কি মনে হল জানেন? মনে হল, "আমারও তো ছিলো মনে, এ বেটা কেমনে পেরেছে সেটা জানতে?"। বেশ উপভোগ করলাম। চালিয়ে যান।

রানা মেহের এর ছবি

কঙ্কাল সিরিজ (যদি আদৌ সিরিজ হয়ে থাকে) ভালো লেগেছে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।