মস্ত সেই নদী। বর্ষায় প্রমত্তা, শীতে স্নিগ্ধা। সে নদীতে জাহাজ চলে, চলে ছোট ছোট ডিঙিও। সেদিনও দেখলাম দু'টি শিশু আদুল গায়ে একটা ডিঙি বাইতে বাইতে চলছে তীর ঘেঁষে, আর হাঁ করে দেখছে দূরে বড় ইস্টিমারের ডেকে লোকজনের কান্ডবান্ড। ইস্টিমারটাও বুঝি তাদের ভয় দেখানোর জন্যে একবার ভোঁ করে হাঁক দেয়।
ঝিনুক চিরে রেখে গেছে দেশটার অনেকখানি। তাকে পার হতে না পারলে ব্যবসাবাণিজ্য চলে না, আমদানিরপ্তানি সব মাটিতে গড়াগড়ি খায়।
লোকজন একদিন কথা বলাবলি শুরু করলো, ঝিনুক নদীর ওপর দিয়ে সেতু বানাতে হবে।
বাজারে, দোকানে, খেলার মাঠে, বর্ষার দিনে ছাতা মাথায় করে ছিপ ফেলে মাছ ধরার নিস্তব্ধ নিষ্ঠুর খেলা ভেঙে সব জায়গায় লোকের মুখে কেবল সেতুর আলাপ। ঝিনুকের ওপর সেতু হবে? তা-ও কি সম্ভব? এ তো সেই নদী, যাতে জাহাজ ডুবলে তার হদিশ মেলে না, মিললেও তাকে টেনে তোলার সাধ্যি নেই কারো! মানুষের কি এমনই আস্পদ্ধা, যে ঝিনুকের ওপর সেতু বানিয়ে পেরিয়ে যাবে? এ কি মাদারটুলির খালের ওপর সাঁকো বানানো? এ কি ছেলেখেলা?
তারপরেও লোকে চায়ের কাপ থেকে ঠোঁট তুলে ঝিনুক আর সেতু শব্দদু'টো দুর্বিনীত আগ্রহ নিয়ে একই দমে একই বাক্যে ব'কে যায়। কতবড় আস্পদ্ধা ঐ নাম-ভুলে-যাওয়া দেশের লোকের, অ্যাঁ!
এই গুঞ্জন চলতে থাকে আকাশে বাতাসে। মৌমাছি ফুলের ওপর বসে বিরক্ত মুখে সেই গুঞ্জন শুনতে শুনতে মধু খায়, অলস গ্রীষ্মের রাতে একটা ঝিঁঝিঁ আচমকা চুপ করে যায় তার বাড়ির পাশে পঁচার মায়ের কুটিরে পঁচাকে শোনানো পঁচার মা-র ঝিনুকের বুকে সেতুর গল্প শুনে। ঝিনুকের এপারে দাঁড়িয়ে ঢেউ গোণে বেকার যুবকেরা, অন্য পার তো চোখে দেখা যায় না।
ঝিনুকের এ পারে ও পারে দুইপারেই যখন সবার মুখে একই গুঞ্জন, ছিপনৌকার মাঝি থেকে ইস্টিমারের সারেং সবাই যখন চিন্তিত সেতুর আকার, আকৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে, তখন রাজনীতিকরা তাঁদের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ড্রয়িংরূমে বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে ঠিক করলেন, এখন একটা কিছু করা দরকার।
কিন্তু সেই দেশের যা দস্তুর, টুনিসচিবের কাঁধে দায়িত্ব পড়লো এই ঝিনুক সেতু নির্মাণের উপযোগিতা মাপার দায়।
টুনিসচিব যখন হন্তদন্ত হয়ে সেই মাপামাপিতে ব্যস্ত, তখন উল্টোদলের রাজনীতিকরা ময়দানে গলা খাঁকরে বললেন, সেতু হচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু এর নাম সোজাদলের নেতা মরহুম মধু ঢালির নামে কিছুতেই রাখা যাবে না। রাখলে ঘরে ঘরে আগুন জ্বলবে।
টুনিসচিব সবকিছু মেপে জানালেন, ঠিকাছে। সেতু না বানালে সামনে কঠিন দুর্দিন আছে। বানাতে হবে যত জলদি সম্ভব। লোকজনের গুঞ্জন মিথ্যে নয়।
সোজাদলের মন্ত্রী বললেন, মরহুম মধু ঢালি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সোজাদল। দেশ এতে অশেষ উপকৃত হবে।
টুনিসচিবের কাজকর্মের দোষগুণ মাপার দায় চাপলো পাতিসচিবের কাঁধে। তিনিও হন্তদন্ত হয়ে কাজে নেমে গেলেন।
উল্টোদলের নেতারা বললেন, সেতুর নাম মধু ঢালির নামে রেখে জাতির ঘাড়ে একটা কলঙ্কই চাপানো হচ্ছে। মধু ঢালি ছিলো একটি দুষ্টলোক। সে পাশের বাড়ির জামগাছ থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলো। কেন সে জামগাছে চড়েছিলো?
পাতিসচিব জানালেন, টুনিসচিবের কাজ ঘ্যাম ভালো হয়েছে। এমন টুনিসচিব গত কুড়িবছরে একটাই ছিলো, যখন তিনি নিজে টুনিসচিব ছিলেন।
সোজাদলের নেতারা বললেন, আসছেবার আমরা ক্ষমতায় এলে মরহুম মধু ঢালি সেতু বানিয়ে আমরা ঝিনুককে বশ করবো।
পাতিসচিবের কাজের দোষগুণ মাপার দায় চাপলো পুরোসচিবের কাঁধে। তিনিও হন্তদন্ত হয়ে কাজে নামলেন।
উল্টোদলের নেতারা বললেন, জাতি মধু ঢালির নামে সেতু মেনে নেবে না। সেতুর নাম রাখতে হবে অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত রসগোল্লা নির্মাতা আবুল ময়রার নামে। নাহলে আমরণ হরতাল চলবে।
পুরোসচিব জানালেন, পাতিসচিব বেড়ে খেটে কাজ করেছে। লোকটা ভালো।
সোজাদলের নেতারা বললেন, প্রিয় জনগণ, মধু ঢালি সেতু আপনাদের জন্যে আমাদের উপহার।
এবার পুরোসচিবের পরামর্শ নিয়ে মন্ত্রীসভায় প্রকল্পের প্রস্তাব উঠলো। কেউ বললো দাতাদের পয়সায় সেতু হোক, কেউ বললো জনতার পকেট থেকে ট্যাক্স খসানো হোক, কেউ বললেন দুটোই হোক। সেতুর ইনজিনিয়াররা ক্যালকুলেটর বার করে হিসেব করতে লাগলেন, কোন কনট্র্যাকটরের কাছ থেকে কত খাবেন।
উল্টোদলের নেতারা মানববন্ধন করলেন। আবুল ময়রার ছেলে টিভির সামনে কেঁদে বললো, সব লোকে আব্বার রসগোল্লা খাইছে মাগার নাম লইবার চায়না। পত্রিকায় কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আবুলচরিত লিখলেন। সোজাদলের কয়েকজন বুদ্ধিজীবী লিখলেন মধু ঢালির খাবনামা। লিস্টির দুই নম্বরেই ঝিনুকের ওপর সেতুর কথা। এক নম্বরে জামগাছের স্বপ্ন।
দাতারা এসে নানা কাঠি দিতে লাগলো। কেউ বললো সেতু চারগলির হোক। কেউ বললো ছয় গলির হোক। কেউ বললো সেতুর ওপর রেল চড়াও, কেউ বললো সেতুর পাশে ছাপড়া ঘরে দোকান দাও।
তুমুল হট্টগোল বাঁধলো সারা দেশ জুড়ে।
কিন্তু সব বুড়োখোকাছেলেমেয়ে, ময়দানের মোমাছি আর রাতের ঝিঁঝিঁদের তাক লাগিয়ে একদিন ঝিনুকের ওপর সেতুর খাম্বা বসে গেলো। পেল্লায় সে খাম্বা।
প্রধান এসে দেখে গেলেন। তিনি আবার সেনা সমর্থিত, তাই সেনাপতিও এলেন সাথে।
সকলেই খুশি।
হঠাৎ ঘটলো বজ্রপাত। সেতুর সেই খাম্বার চারদিকে একদিন উঠলো অনেক ফিসফাস। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে লোকজন ফিসফিসিয়ে উঠলো, "আবুল লেইছ", "আবুল লেইছ", "আবুল লেইছ" ...।
মাদ্রাসার কামিল পাশ ছাত্র আবুল লেইছ এসে চিৎকার করে উঠলো, "এইখানে খাম্বা গাড়ছে কে?"
সবাই চুপ। চুপ জনতা, চুপ ফুলের ওপর মৌমাছি, চুপ গর্তের ঝিঁঝিঁ, চুপ উল্টোদল, চুপ সোজাদল, চুপ টুনিসচিব-পাতিসচিব-পুরোসচিব। চুপ প্রধান আর তার সমর্থক সেনা।
আবুল লেইছ একটা দড়ি বেঁধে খাম্বা টেনে শুইয়ে ফেললো। তারপর ঝিনুকের পানি তুলে সহিহ কায়দায় কিছুটা খেয়ে বাকিটা কুলকুচি করে ফেললো ঝিনুকের ওপরেই। ঝিনুক সবকিছু আগের মতোই ভাসিয়ে নিয়ে বইতে লাগলো চুপচাপ, কিছু বললো না।
.
.
এ গল্পটি ২০১০ এ প্রকাশিত গল্প সংকলন ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প"-তে অন্তর্ভুক্ত |
মন্তব্য
- আল্লার দেওয়া ঝিনুকের ওপর সেতু বানানো নিয়ে ইসলামে কী বিধি আছে?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
মারাত্মক!!!
গুরুদেবের লেখার মধ্যে আমার একটা প্রিয় লেখা হচ্ছে "তোতা কাহিনী"। আমি পড়ছি ত্রিশ বৎসর ধরে। এদেশের মানুষ পড়ছে হয়তো আশি-নব্বই বৎসর ধরে। আমরা আরো দুইশ'-তিনশ' বৎসর তোতা কাহিনী পড়ে যাব, তবু তার আবেদন ফুরাবে না।
"সেতু সঙ্কট" নিশ্চিতভাবেই "তোতা কাহিনী" নয়, তবে এরমাঝে অমন চিরায়ত গল্পের সম্ভাবনা দেখে আমি মুগ্ধ। প্রিয় হিমু, কখনো যদি আপনার গল্পসংগ্রহ বের করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে "সেতু সঙ্কট"কে একটু পরিমার্জন করে অনায়াসে তাতে অন্তর্ভূক্ত করতে পারবেন।
আর একটি অনুরোধ। নিয়মিত ছোট গল্প লিখে যান। আমার বিশ্বাস, পাঠকরাও আমাকে সমর্থন করবেন।
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অসংখ্য ধন্যবাদ। এই গল্প পড়ে আপনার মাথায় তোতা কাহিনী পাঠস্মৃতি অণুরণিত হয়েছে, এ-ই তো আমার জন্য অভাবনীয়! গল্পসংগ্রহ প্রকাশের যোগ্যতা কখনো অর্জিত হলে আপনার উপদেশ শিরোধার্য করবো।
হাঁটুপানির জলদস্যু
ক্লাসিক!
ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল
_______________
বোকা মানুষ
হিমু ভাই এইটা কী লিখলেন !
আপনার "পলিমেরিক" পইড়া বলছিলাম নিয়মিত ছড়া লিখতে । আমার কথা তুইলা নিতেছি.. ছড়া লেখেন না লেখেন.. গল্প লেইখেন ভাই ।
হ আরো গল্প লিখেন। এমন শানদার গল্প।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
পিঙ্কি গোধূলি, শিমুল, অমিত, মামুন, আকতারভাই, কীর্তিনাশা সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হাঁটুপানির জলদস্যু
ব্লগে তো থাকতেছেই তারিখ... তারপরো তারিখটা লিখে রাইখেন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বস, আপনি পারেন ও বিরল প্রতিভা আপনের...
আগুন লেখছেন...
দারুন হইছে...
হুদাই ফপর দালালি :
পরদিন পুরোসচিব পত্রিকায় প্রকাশিত বিবৃতিতে বললেন - আপনারা যারা মনে করেছেন আবুল লেইছ এই খাম্বা টেনে শুইয়ে ফেলেছে , তারা ভুল বুঝছেন । আমরা মাদ্রাসার ছাত্র আবুল লেইছের চেয়ে কম বড় মুসলমান না । খাম্বাটা একটু ইয়ের মতো লাগছে দেখে আমরাই খাম্বাটা সরিয়ে ফেলেছি , এখানে আবুল লেইছের কোন ক্রেডিট নেই ।
পুরো সচিবের বিবৃতিতে ধন্য ধন্য পড়তে লাগল ।
কী দুর্দান্ত!
আসুন, আমরা বলি, আমিন!
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
Life is what happens to you
While you're busy making other plans...
- JOHN LENNON
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
নতুন মন্তব্য করুন