পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্স

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: সোম, ২৩/০৩/২০০৯ - ২:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি ইংরেজি আর হিন্দি ভাষা শিখেছি টিভির কাছে। বলা যেতে পারে, ভাষা দুটোর প্রাণবন্ত অংশ শেখা হয়েছে ওভাবে। অনেক কিছু না বোঝার পর্যায় থেকে আস্তে আস্তে প্রায় সবটুকু রসাস্বাদনের সক্ষমতা পাওয়া যেতে পারে টিভি থেকে, এ কথা আমি নিজের উদাহরণ থেকে বিশ্বাস করি। ট্র্যান্সলেশন, কুৎসিত গ্রামার বই ইত্যাদি হাবিজাবি আমাকে ইংরেজির কিছুই শেখাতে পারেনি, যতটা শেখাতে পেরেছে আমার শৈশব আর কৈশোরের বিটিভি আর টিনটিন।

ঐ আবছা অর্ধেক বোঝা ইংরেজির যুগেই বিটিভিতে শুরু হয় পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্স, রাত আটটার খবরের পর। বিটিভির প্রায় সবকিছুই যেহেতু "শিশুতোষ" ছিলো, ইংরেজি কোন প্রোগ্রামই দেখার বারণ ছিলো না আমাদের, পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্স দেখাও কোন বাধা ছিলো না। বিটিভিতে চমৎকার সব কমেডি শো-র তালিকায় আমি একে সবার ওপরে স্থান দেবো নির্দ্বিধায়। ডিফরেন্ট স্ট্রোকস, মর্ক অ্যান্ড মিন্ডি, স্মল ওয়ান্ডার ... সব কিছুই পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্সের কাছে এসে মলিন। auto ওরকম ভালো লেগেছে কেবল আর তিনটি সিটকম, ক্যারোলাইন ইন দ্য সিটি, চার্লস ইন চার্জ আর হ্যাপি ডেইজ। সিটকম ১৯৮৬ থেকে '৯৩ পর্যন্ত বেশ দাপটের সাথেই চলেছে এবিসি টেলিভিশনে, বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে একটু গ্যাপ দিয়ে। কাহিনী এরকম, ল্যারি অ্যাপলটন আর তার অতিদূরসম্পর্কের তুতোভাই বাল্কি বার্টাকোমুস (ল্যারির ভাষায়, উই আর রিলেটেড বাই রিউমরস) এক অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। বাল্কি এসেছে মিপোস নামে ভূমধ্যসাগরের এক কাল্পনিক দ্বীপদেশে থেকে, যেখানে একটি মাত্র ফোন, একটি মাত্র সড়ক, কেবল রাজপরিবারের বাড়ির ভেতরে টয়লেট আছে, আর বাকিরা জীবিকা নির্বাহ করে ভেড়া চড়িয়ে। মিপোসে জীবন অন্যরকম, মেষপালক বাল্কিও তাই অন্যরকম। ল্যারি আর বাল্কি একজন আরেকজনের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ, ল্যারি অল্পতে নার্ভাস হয়ে পড়ে, সবকিছু খুব সিরিয়াসভাবে নেয়, আর বাল্কি কোনকিছুতেই সহজে কাবু হয় না, কেবল তার সিরিয়াসনেস এমন সব প্রসঙ্গে, যেখানে আমেরিকায় যৌথপরিবারে বেড়ে ওঠা ল্যারির প্রতিক্রিয়া ভিন্ন। ল্যারির কাছে যা কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ আর স্পর্শকাতর, বাল্কি সেগুলোকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়, এবং উল্টোটাও সত্যি। নিজভূমে ল্যারিও এক আগন্তুক, তার অস্থিরতা আর উদ্বেগের কারণে।

এভাবেই একের পর এক পর্ব সামনে এগোয়। দু'জনে কাজ করে একই জায়গায়, একই সমস্যায় পড়ে দু'জনে, কিন্তু সমাধানের চিন্তা করে দু'টি পরস্পর বিপরীত অবস্থান থেকে। শেষ পর্যন্ত প্রতি পর্বেই তাদের সমস্যার সমাধান হয়, ছোট ছোট মোরাল থাকে প্রত্যেক পর্বের শেষে, যেখানে ল্যারি আর বাল্কি দু'জনেই দু'জনের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখে। আর বাকিটা সময় কাটে দমফাটানো হাসির ওপর। চরিত্রগুলোর সংলাপ আর কাজকর্ম সূক্ষ্ম হাস্যরসের খোরাক।

হাস্যরসের মূল উপাদানই নাকি বেদনা। পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্সে এই উপাদান বার বার ঘুরে ফিরে আসে, নিরীহ ছেলেমানুষ বাল্কি যখন কোন কিছুতে হতাশ হয়, তখন একটি শিশুর চোখ দিয়ে যেন হঠাৎ কঠোর পৃথিবীটাকে দেখা যায়। ভুল প্রেমে কাতর বাল্কির কান্নাকে খুব চেনা মনে হয়, ক্রিসমাসের আগে সোফায় বসে ফেলে আসা ঘরের গল্প করতে থাকা বাল্কির চেহারায় নিজের ছায়া দেখতে পাই, বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি নির্দেশ করে বাল্কি যখন জাজের কাছে অনুযোগ করে শুনতে পায়, "ইট হ্যাপেনস", তখন যেন ধাক্কা খেয়ে দর্শক ফিরে আসে শক্ত মাটিতে। বাল্কি একটি শিশুর চোখ যেন চশমার মতো পরিয়ে দেয় দর্শকের চোখে, যার ভেতর দিয়ে সমস্ত পৃথিবীটাই যেন ছোট্ট মিপোসের মতো হয়ে উঠতে চায়, যেখানে প্রত্যেক ক্রিসমাসে একটা কচ্ছপ সাগর থেকে সাঁতরে ফিরে আসে বাল্কির পরিবারের কাছে, যেখানে কোন ক্যামেরা নেই বলে আগুন লাগলে নিকোলাই নামের প্রখর স্মৃতিধরকে সবাই আগে রক্ষা করে, যেখানে মানুষ সবার আগে মানুষকে নিয়ে ভাবে। পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্সের সরু দাগের উঁচুমানের হাস্যরসের মূলে নিহিত যেন ঐ কাল্পনিক মিপোসের বাস্তব অস্তিত্বহীনতার বেদনাটুকুই। যাকে ঘিরে শুধু শিশু হয়ে থাকা যায়, যাকে মনে করে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলা চলে।


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

দেখিনি কখনো এই সিরিজটা, ভালোই হবে আশা করছি, তবে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, ওটা আপনার স্মৃতিচারণের মতো ভালো হবে না।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

মারাত্মক স্মৃতি জাগানিয়া চলুক -
ইউটিউবে পেলাম -

s-s এর ছবি

এটা , দ্য এ টিম আর ম্যকগাইভারের থিম মিউজিকটা আমি প্রায়ই শুনি, আমার খুবই ফেভারিট।

আদৌ কি পরিপাটি হয় কোনো ক্লেদ?ঋণ শুধু শরীরেরই, মন ঋণহীন??

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

নাচের দৃশ্যটা না দিলেই নয় চোখ টিপি

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

খুব বেশি ছোট এবং বোকা ছিলাম, তাই তেমন বুঝতাম না। তবুও প্রচন্ড স্মৃতিজাগানিয়া একটা সিরিজ। "কসিন ল্যারি!" কথাটা মাথায় গেঁথে আছে আজও। দেখতে হবে আবার।

নজমুল আলবাব এর ছবি

আহা, কতকিছু মনে করায়া দিলেন। সেই বিটিভি আর দেখা যাবে না মনে হয়। বিটিভি এখন আরও শিশু হয়েছে। কিঙবা অন্যকিছু।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

কীর্তিনাশা এর ছবি

আহা........

পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য হিমু ভাইকে ধন্যবাদ

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

কতদিন বিটিভি দেখি না। পুরোনো সিরিজগুলো মিস করি খুব। রুটস এর মতো সিরিজ কী বিটিভি আর কখনো দেখাবে? স্মল ওয়ান্ডারের সেই ছোট্ট বুদ্ধিমতি মেয়েটাকে ভুলতে পারি না। পারফেক্ট স্ট্রেনজার যখন দেখায় তখন বোধহয বড় হয়ে গেছি, তেমন মনে নাই।

অমিত এর ছবি

তুইও কি আমার মত গত সপ্তাহে প্রথম দুই সিজন দেখে শেষ করলি না কি ?
১৭ বছর পর মনে হয় দেখলাম। সেই মুগ্ধতা আশাও করি নি। তবুও খারাপ লাগে নি। তবে একটা জিনিস দেখে বেশ আতংক লাগল। ১৭ বছর আগে বাল্কিকে এরকম বিরক্তিকর সরল মনে হয় নি।
ছোটবেলায় যেই বড় বড় মানুষগুলাকে নিষ্প্রাণ জোমবি মনে হত আজ আমি তাদেরই একজন

আনিস মাহমুদ এর ছবি

সেই সময়ের মুগ্ধতাটুকু জিইয়ে রাখার জন্যই আমি আর এটি দেখতে চাই না।

.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...

.......................................................................................
Simply joking around...

আনিস মাহমুদ এর ছবি

অসাধারণ এক সিরিজ ছিল এটা। কোনো এপিসোডই মিস করিনি।

মার্কিনীদের রসবোধ সাধারণত হয় খুব মোটাদাগের। পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্স এক অসাধারণ ব্যতিক্রম। ঘটনার বা কথোপকথনের সূক্ষ্ম টুইস্ট দম-ফাটানো হাসি ছাড়াও ভাবনার খোরাক জাগায় দর্শককে, আবেগে আপ্লুত করে।

অনেকদিন পর আমাকে নিয়ে গেলেন অমল অতীতে। ধন্যবাদ, হিমু।

.......................................................................................
আমি অপার হয়ে বসে আছি...

.......................................................................................
Simply joking around...

তানভীর এর ছবি

মার্কিনীদের রসবোধ সাধারণত হয় খুব মোটাদাগের। পারফেক্ট স্ট্রেইঞ্জার্স এক অসাধারণ ব্যতিক্রম।

মার্কিনীদের রসবোধ সাধারণত হয় খুব মোটাদাগের।- এটা এক ধরণের স্টেরিওটাইপ কথা। 'পারফেক্ট স্ট্রেঞ্জার্সে'র পাশাপাশি 'ফ্রেন্ডস', 'দ্য অফিস', 'দ্যাট সেভেন্টিজ শো', 'সাইনফেল্ড'- এরকম আরো অসংখ্য জনপ্রিয় কমেডি সিটকমের উদাহরণ দেয়া যাবে, যা মার্কিনীদের তৈরী করা।

এনকিদু এর ছবি

T স্থলে ত আর D স্থলে দ বসিয়ে বাল্কির উচ্চারণ গুলো এখনো মনে পড়ে । আরেকটা জিনিস খুব মনে পড়ে, "কাজিন" ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মুশফিকা মুমু এর ছবি

ইসস মনেপড়ে গেল, এটা আমিও দেখতাম, তেমন কিছুই বুঝতাম না কিছু কিছু বুঝতাম কিন্তু দেখে যে কি মজা পেতাম।

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

আলমগীর এর ছবি

ল্যারির বান্ধবী জেনিফার আর ব্যালকির বান্ধবী ম্যারি অ্যানের কথা বললেন না যে? কামড়া-কামড়ির অভ্যাস ছাড়ান দিছেন নাকি চোখ টিপি

মুস্তাফিজ এর ছবি

"আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম..."

...........................
Every Picture Tells a Story

সাদামাটা  এর ছবি

উফ, ক-ত-দিন পর এই মিউজিক শুনলাম, অসাধারণ!!!
ধন্যবাদ হিমু ভাই।

অভ্রনীল এর ছবি

ল্যারি-ব্যাল্কির ড্যান্সটা ছিল দেখার মত... বন্ধুরা মিলে প্রায়ই সেই ড্যান্স দিতাম... আহা কি দিন ছিল!

_______________

এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চলুক

খেকশিয়াল এর ছবি

আমার খুবই প্রিয় একটা সিরিজ পারফেক্ট স্ট্রেঞ্জার্স। না পারতে মিস দিতাম না। এখন আবার ডাউনলোড করে দেখতেসি ফ্রেন্ডরা মিলে।

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

পলাশ দত্ত এর ছবি

শুধু ভয় হয় : এখনো কি ভালো লাগবে আগের মতোন? বড় হয়ে ম্যাকগাইভার দেখে হতাশ হইছিলাম কেনো? ভয় হয়।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

সবুজ বাঘ এর ছবি

ভুইলাই তো গেছিলামগারে.........

স্বপ্নাহত এর ছবি

পারফেক্ট স্ট্রেঞ্জারস দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বইসা থাকতাম। অনেক ছোট ছিলাম বলে কাহিনী বা অন্যকিছু কিছুই সেভাবে মনে নাই। তবে খুব প্রিয় একটা সিরিজ ছিল।

---------------------------------

তাও তো ভারী লেজ উঁচিয়ে পুটুশ পাটুশ চাও!

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।