রক্ষক যখন ভক্ষক ওরফে বেড়ালছানা ওরফে আরো অনেক কিছু

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: রবি, ৩১/০৫/২০০৯ - ২:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কলিমুদ্দির চায়ের দোকানে বসে বসে মাছি তাড়াচ্ছিলাম৷ খুব যে কষ্ট করতে হচ্ছিলো, তা নয়, কারণ মাছিগুলো ল্যান্ড করার মতো উত্‍কৃষ্ট সিঙ্গারা বা আলুপুরি খুঁজে পাচ্ছিলো না, আপনা থেকেই ভেগে যাচ্ছিলো তারা৷ তবে খাসলত বলে কথা, আমার উদাস গালটাকে তেলেভাজা ভেবে যাতে তারা হামলা না করে, সেজন্যেই হাত পা নাড়ছিলাম আর কি৷

প্রোডাকশন আপাতত বন্ধ, কলিমুদ্দি ঝিমুচ্ছে, জুম্মনটা একটা বেঞ্চে লম্বা হয়ে শুয়ে কুকুরের কান্নার মতো একটা সিনেমার গান গাইছে, সুরেশ বসাক গাঁজায় দম চড়িয়ে শিবনেত্র হয়ে বসে আছে এক কোণে৷ জুম্মনের গানের বক্তব্য শুনে আমারই কান লাল হওয়ার দশা, প্রেমিকাকে সম্ভাব্য সকরকম উপায়ে প্রেম নিবেদন করছে প্রেমিক, গানের পদে পদে খাজুরাহো-কোনার্ক গুলিয়ে মেশানো --- ভাবছি এক ধমকে থামিয়ে দেবো বেল্লিকটাকে, আরো ভাবছি আজকাল সিনেমার গানের নামে এসব কD অশালীন ছাঁইপাশ লেখা হচ্ছে, এমন সময় হুড়মুড়িয়ে দোকানে ঢুকলেন... ৷

উঁহু, যা ভাবছিলে তোমরা, তা নয়৷ পিন্টুর মেজমামা নন৷ মেজমামা দিন তিনেক হলো ঢাকার বাইরে গেছেন৷ বান্দরবানে পাহাড় ঠেলতে গেছেন তিনি, শিবলির মুখে শোনা গেছে৷ মেজমামার অনুপস্থিতির কারণে কলিমুদ্দির ব্যবসা হাফ লাটে উঠে গেছে, আর আমরা অতবড় দিলদরিয়া নই যে নিজের পয়সায় চা আর তেলেভাজা কিনে খাবো৷ অগত্যা বেচারা কলিমুদ্দিকে পাড়ার অবশিষ্ট সুধীজনের ওপর ভর করে আর ভরসা করে চলতে হচ্ছে৷ কিন্তু অবশিষ্ট সুধীজনের সংখ্যা কম, বেশির ভাগই বাকির খাতায় নাম টুকিয়ে খায়৷ তাই কলিমুদ্দি নগদের অভাবে খুবই বাটে পড়েছে৷

যা বলছিলাম, হুড়মুড়িয়ে দোকানে ঢুকলেন মনজুর চাচা৷ তাঁর হাতে একটা বোঁচকা, মুখে এক অপূর্ব অভিব্যক্তি, আধাসের রাগ, এক চিমটি দুঃখ আর এক মুঠো বিরক্তির এক বিচিত্র শরবত৷

আমি খানিকটা ঘাবড়ে যাই৷ মনজুর চাচাকে আমরা সবাই সমঝে চলি৷ মিশমিশে কালো ময়দানবের মতো গড়ন তাঁর, দেখলে মনে হতে পারে তিনি এ পাড়ার গুন্ডাসর্দার, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি পণ্ডিত মানুষ, এককালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, যদ্দিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পণ্ডিতদের শিক্ষকতা করার সুযোগ ছিলো৷ অবশ্য তাঁর আচরণ অনেকটা টুলো পণ্ডিতদের মতোই, আমরা অনেকেই শৈশবে তাঁর হাতে মৃদু ঠ্যাঙানি খেয়েছি৷ প্রাচীন শিক্ষকদের মতো আদর্শবাদী লোক তিনি নন, বরং অনেকটা গোঁয়ারগোবিন্দ কিসিমের মানুষ, কোন কিছু তাঁর অপছন্দ হলে গায়ের জোরে সেটাকে দমন করে ফেলতে দ্বিধা করেন না৷ বৈশ্বিক ভালোমন্দের তিনি থোড়াই কেয়ার করেন, নিজের চোখে যেটা ভালো সেটার পালন এবং যেটা মন্দ সেটার দলনই তাঁর মটো৷ এ পাড়ায় অনেকেই তাঁকে ভয় করে চলে৷ তাঁর পাণ্ডিত্যকে হয়তো কেউ পাত্তা দেয় না, কিন্তু পাঞ্জার জোরকে সামলে চলে৷

কলিমুদ্দিও ঘাবড়ে যায় মনজুর চাচার মনজুড়ানো, মানে আত্মা-পানি-করা মূর্তি দেখে৷ সে এক ধমকে জুম্মনের গানটা অফ করে দেয়, সুরেশ বসাককে ঠ্যালা দিয়ে মৌতাত থেকে মুক্ত করে শঙ্কিত চিত্তে হাত কচলাতে থাকে৷ 'কী খাইবেন স্যার?'

'চা দে৷ পুরি দে৷' সংক্ষিপ্ত গর্জনে বলেন মনজুর চাচা৷

আমি যতটা সম্ভব অন্ধকারে মিশে যেতে চাইছিলাম, কারণ এখন তাঁর চোখে পড়লেই একগাদা উপদেশ ধমক আর বলা যায় না, দুয়েকটা চড়থাপড়েরও শিকার হতে পারি, কিন্তু বিধি বাম৷ মনজুর চাচা সোজা আমার সামনে এসে বসে বোঁচকাটা পায়ের কাছে ধপ করে নামিয়ে রাখলেন৷ কেমন একটা ফ্যাঁসফোঁস আওয়াজ ভেসে আসে বোঁচকা থেকে৷ আমি চমকে উঠে পা দুটো সরিয়ে নিই৷

'কেমন আছিস তুই? তোর বাপ কেমন আছে? তোর মা? পড়াশোনা শেষ করেছিস? নাকি এখনো সেকেন্ড ইয়ারেই ঝুলে আছিস? চুলগুলো এমন বেখাপ্পা করে কেটেছিস কেন? সাপের পাঁচপা দেখেছিস? পেঁদিয়ে ফ্যাশন বের করে দেবো হারামজাদা ছেলে --- তোর বাপমা তোকে কিছু বলে না, এমন বখাটা চুলের ছাঁট নিয়ে টো টো করে ঘুরে বেড়াস যে? যা এক্ষুণি মোড়ের দোকান থেকে চুল ছাঁটিয়ে আয় ---৷' ইত্যাদি এমন আরো অনেক কিছু আশঙ্কা করছিলাম৷ কিন্তু তার পরিবর্তে মনজুর চাচা তাঁর প্রকান্ড লোমশ হাতে টেবিলের ওপর একটা চাপড় দিয়ে শুধু বললেন, 'শালা!'

আমি এবার আহত হই৷ শেষ পর্যন্ত গালি দিলেন?

কিন্তু আমার ভুল ভাঙে৷ আমাকে নয়, গালি তিনি অন্য কাউকে দিয়েছেন৷ আমাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে তিনি স্নেহভরে বলেন, 'এই সন্ধ্যেবেলা তেলেভাজার দোকানে একা একা কী করিস?'

আমি মিনমিন করে অনেক অজুহাত দেখাতে চাই, বলতে চাই, আমি তো একা একা ঘোরাফেরার মতো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, আর এই বিশ্বসংসারে কে-ই বা আছে আমার, যাকে সাথে করে এই তেলেভাজার দোকানে বসবো? কিন্তু মনজুর চাচা ঘাস খেয়ে বড় হননি৷ তিনি পেছন ফিরে রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িটা দেখে নিয়ে বলেন, 'সিদ্দিক সাহেবের মেয়েটা তো কলেজে উঠলো, নাকি?'

আমি ঢোঁক গিলে সায় দিই৷ তিনি বিমর্ষ চিত্তে মাথা দোলান৷ 'মেয়েটা দেখতে ভালো, কিন্তু বাপটা একটা মহা চামার৷ একদিন শালাকে ধরে মারবো দুইটা থাপ্পড়!'

আমার মুখ অনিচ্ছাসত্ত্বেও উজ্জ্বল হয়ে আসে, আমি প্রাণপণে আনন্দ গোপনের চেষ্টা করি৷ হক কথা বলেছেন মনজুর চাচা৷ শ্রদ্ধায় গদগদ হয়ে মাথা নাড়ি আমি৷ কিন্তু কেন সিদ্দিক সাহেবের বিরূদ্ধে মনজুর চাচার এই বিরাগ, সেটা আমার বোধগম্য হয় না৷ না হোক, কোন সমস্যা নেই৷ সিদ্দিক চাচার আসন্ন বিপদে আমার মন উলু দিয়ে ওঠে৷

ওদিকে মনজুর চাচা আপন মনে বকে চলেন, 'সেদিন দেখি, হারামজাদা একটা রাস্তার কুকুরকে ইঁট ছুঁড়ে মারছে৷ কুকুরটা ওকে কিছু বলেও নি, তেড়েও আসেনি, চুপচাপ নিরালায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলো, এই ব্যাটা সিমার গায়ে পড়ে একটা আধলা ছুঁড়ে মারলো! --- কুকুরটা মরতেও পারতো!'

আমি মনজুর চাচার কুকুর প্রীতির পরিচয় পেয়ে অভিভূত হই৷ অবোলা জানোয়ারের ওপর এই অত্যাচারের কাহিনী শুনে সিদ্দিক লোকটার ওপর আমার মেজাজ আরো এক পর্দা খারাপ হয়ে যায়৷

মনজুর চাচা হাঁক ছাড়েন জুম্মনের উদ্দেশ্যে, 'অ্যাই, ওর জন্যেও চা পুরি পাঠা৷'

সদুপদেশ বা ধমকধামকের পরিবর্তে এই অযাচিত অনপেক্ষিত খাতির পেয়ে এবার আমি মনে মনে আঁতকে উঠি৷ মনজুর চাচাও কি কোন গাঁজাগুরি গপ্পো ফেঁদে বসবেন? আমার অভিজ্ঞতা বলে, যারা আমাকে সেধে সেধে এই তেলেভাজার দোকানে খাইয়েছে, প্রায় প্রত্যেকের স্টকেই বীভত্‍স সব কাহিনী ছিলো বলার মতো৷ আজও কি ইতিহাস নির্লজ্জের মতো পুনরাবৃত্ত হবে?

যথাসময়ে চা আর আলুপুরি আসে, তবে ইতিমধ্যে মনজুর চাচা সিদ্দিক সাহেবের গোষ্ঠী উদ্ধারের কাজে ব্রতী হন৷ তিনি খোলাসা করেন, কেন সিদ্দিক চাচা সরকারি চাকরি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, ঘুষের পয়সায় ঢাকা শহরের কোথায় কী কী সম্পত্তি কুক্ষিগত করেছেন, কোন কোন সিনেমার অতিরিক্তা এবং কোন কোন ঠোঙানাটকের উপনায়িকার সঙ্গে তাঁর নিষিদ্ধ দহরমমহরম রয়েছে, ইত্যাদি৷ সবশেষে একটি কুইজও আমার সামনে হাজির করেন তিনি, সিদ্দিক সাহেব দেখতে অত বদখদ, কিন্তু তাঁর মেয়েগুলো অমন পরীর মতো সুন্দর কেন?

আমি লজ্জায় লাল হই৷ মনজুর চাচাও আমার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী, ভেবে তাঁর ওপর আমার শ্রদ্ধা বাড়ে৷ চায়ের কাপে মৃদু ভদ্রজনোচিত একটি চুমুক প্রয়োগ করে আমি ততোধিক মোলায়েম গলায় বলি, 'জ্বি, মানে, আমাকে কেন এসব বলছেন চাচা --- আমার কি এসব নিয়ে চিন্তা করা মানায়?'

ভেবেছিলাম, ভদ্রতাবশে এমনই কিছু বলা উচিত, কিন্তু মনজুর চাচা চটে যান৷ চায়ের কাপটায় ফড়াত্‍ করে একটা চুমুক মেরে একটা কিল বসান টেবিলে, পুরিগুলো লাফিয়ে ওঠে৷ 'আহাম্মক কোথাকার! তুই কি দুধের বাচ্চা নাকি? বেশ তো দামড়া হয়েছিস দেখা যাচ্ছে, দিনরাত সিদ্দিকের মেয়ের সাথে টাঙ্কি মেরে বেড়াস, আর আমার সাথে সতীপনা দ্যাখাস? অবশ্যই চিন্তা করবি এসব নিয়ে, বুদ্ধির চর্চা হবে তাতে৷ --- তবে খালি মেয়ে নিয়ে ভাবলে এখন আর দিন চলবে না, মেয়ের বাপকেও খতিয়ে দেখতে হবে বৈকি৷'

আমি সাথে সাথে একমত হই৷ 'জ্বি৷ ঠিক বলেছেন৷'

মনজুর চাচা দুটো পুরি একসাথে মুখে পোরেন৷ 'আমি ঠিকই বলি৷ --- এই সিদ্দিক আমার সর্বনাশ করেছে, আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করেছে! ওকে আমি মেরে পস্তা ওড়াব!'

আমি উত্‍সুক দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করি৷

'কিন্তু সব দোষ ওর ঘাড়ে ফেলাই ঠিক হবে না৷' তিনি চায়ের কাপে আরেকটা অভ্রভেদী চুমুক মারেন৷ 'তোর চাচীরও দোষ কম নয়!'

এবার আমার মাথায় বজ্রপাত হয়৷ এই কালোভূত আলকাতরামুখো সিদ্দিক চাচার সাথে নিজের সুন্দরী রুচিবতী বিদূষী স্ত্রীকে জড়িয়ে মনজুর চাচা কী বলছেন এসব? তাও আবার আমার সাথে?

মনজুর চাচা আমার ফ্যালফ্যাল চাহনি খেয়াল করে দেখেন না, আপনমনে গজগজ করে চলেন, 'তোর চাচী আরেকটা গবেট৷ সুন্দর মেয়েছেলেকে খোদা কোন বুদ্ধিশুদ্ধি দেয় নাই৷ বন্ধুত্ব করবি কর, তাই বলে ঐ চামারটার বউয়ের সাথে?'

আমি এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি৷ যাক, এবার দৃশ্যপটে সিদ্দিক চাচার বউ, কে জানে, হয়তো আমার হবুশাশুড়ির আগমন ঘটেছে৷

'সেই বেটি আবার বেড়াল পালে!' চাচা গর্জে ওঠেন৷ 'অ্যাই, আরো দুই কাপ চা পাঠা!'

জুম্মন চায়ের কেটলির কাছে উড়ে যায়৷

'তোর চাচী, জানিসই তো, খুব চরম স্বভাবের মহিলা, একদিন দেখি ঐ সিদ্দিকের বাড়ি থেকে একটা বেড়াল নিয়ে এসেছে৷ বলে কি না, পুষবে৷ সিদ্দিকের বউ তার সই, তার সই বেড়াল পালে, কী সুন্দর কুচিকুচিকু বেড়ালের বাচ্চা, এখন সেও বেড়াল পালা শুরু করবে৷ আমি গোড়াতেই বোঝানোর চেষ্টা করলাম, দ্যাখো, বেড়াল খুব খারাপ জীব, বদমায়েশ জানোয়ার, এইসব করতে যেও না --- শুনলো না আমার কথা, গোঁয়ার মহিলা! এখন তার শখের মাশুল গুনতে হচ্ছে আমাকে৷'

এ পর্যায়ে আমি একটা ভুল করে ফেললাম, কেন করলাম কে জানে, সবই ওপরওয়ালার ইশারা নিশ্চয়ই৷ বেড়াল আমিও খুব একটা পছন্দ করি না, সুযোগ পেলে কষে লাথি লাগাই, আর এখন মতিভ্রমের কবলে পড়ে এই প্রবল বেড়ালবিদ্বেষী মনজুর চাচার কাছেই বেড়ালের হয়ে ওকালতি করতে গেলাম, 'কেন চাচা, বেড়াল তো নবীজির প্রিয় জীব?'

মনজুর চাচা সটান সোজা হয়ে বসে আমাকে আগাপাস্তলা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেন, তারপর মন্দ্রস্বরে বলেন, 'আমি কি নবীজি?'

আমি ঢোঁক গিলে সাথে সাথে প্রবল প্রতিবাদ করি৷

মনজুর চাচা আমাকে আরো এক দফা খুঁটিয়ে দেখে বলেন, 'তুই কি নবীজির খুব আদর্শ উম্মত? তুইও কি বেড়াল ভালোবাসিস?'

আমি গা বাঁচানোর জন্যে এবার প্রাঞ্জল ভাষায় বেড়ালের বদনাম করি, 'আমি? কক্ষণো না৷ বেড়াল খুবই বদ জানোয়ার!' বেড়ালের প্রতি কোনরকম অনুরাগ দেখাতে গিয়ে ধোলাই খাওয়ার শখ আমার নেই৷

মনজুর চাচা এবার চটে যান, 'তাহলে বেড়ালের মোক্তারি করিস কেন, ইডিয়েট? চুপচাপ কথা শোন, ফালতু কথা বললে এক চড়ে তামশা দেখিয়ে দেবো৷'

আমি সাথে সাথে মুখে একটা আলুপুরি গুঁজে দিয়ে মৌন মেরে যাই৷

মনজুর চাচা গুম হয়ে যান৷ তারপর গলা খাঁকরে চায়ে দু'একটা যাযাবর চুমুক দেন৷ তারপর বলেন, 'তো, তোর চাচীকে বললাম, দ্যাখো, পালতে চাও তো গরু পালো৷ বাড়ির পিছনে জায়গা আছে, গোয়ালঘর বানিয়ে দেবো, গরু পাললে দুধ খাওয়া যাবে, বাজারে পানি-মেশানো দুধের লিটার আটাশ টাকা৷ মহিলা, বিশ্বাস করবি না, একেবারে তেড়ে আসে, বলে বহুত গরুর খেদমত করেছে সে জীবনে, গরু পোষার ইচ্ছা আর তার নাই৷ এ তো পরিষ্কার আমাকেই অপমান! ইচ্ছা করছিলো, চুলের মুঠি ধরে তুলে মারি এক আছাড়, অন্যের বউ হলে তা-ই করতাম, নিজের বউ দেখে সামলে গেলাম৷ তারপর বললাম, তাহলে এক কাজ করো, খরগোশ পালো৷ দেখতে বেড়ালের চেয়ে অনেক সুন্দর, কেমন কুটকুট করে দৌড়ে বেড়ায়, সবচে বড় কথা খরগোশের মাংস খেতে বেশ, বড় বড় টুকরো করে বারবিকিউ করে খাওয়া যাবে৷ তোর চাচী শুনে কপাল চাপড়ায়৷ বলে, শুধু মাংস খাওয়ার জন্যেই যদি লোকে ঘরে জন্তুজানোয়ার পুষতো, তাহলে হাতি কী দোষ করলো? --- শোন মেয়েমানুষের কথা, হাতির মাংস কি খায় কেউ? ইচ্ছা হলো, কিছু বলি, কিন্তু বললাম না৷ খোদা যাকে বুদ্ধিশুদ্ধি দেয় নাই, তার সাথে তর্ক করতে যাওয়া বৃথা৷ তারপর বললাম, চলো মুরগি পালি, ডিমের হালি চৌদ্দ টাকা, মুরগির জোড়া দেড়শো টাকা, মুরগির একটা হারেম খুলে ফেললে আর চিন্তা নেই, এই বাজারে মুরগি খেয়ে বাঁচা যাবে৷ তখন বলে কী শোন, আমি নাকি চাষা, আমার পরামর্শ মতো চললে পাড়ায় আর প্রেস্টিজ নিয়ে বাঁচা যাবে না৷ মুরগি পছন্দ না হওয়ায় কবুতর পোষার বুদ্ধি দিলাম, পাড়ায় সম্মান বাঁচানোর জন্যে বেশ সাহিত্য মিশিয়ে বললাম, চলো পারাবত পুষি৷ এই বুদ্ধিটা ফল দিচ্ছিলো, মাটি করলাম আমি নিজেই৷ তোর চাচী পারাবত শুনে বেশ গলে গিয়েছিলো, খতিয়ে দেখছিলো, পারাবত পোষা ব্যাপারটা প্রেস্টিজের কোন ক্ষতি করতে পারে কি না৷ এর মধ্যে আমি কেন যেন আপনমনে বললাম, জালালী কবুতরের কোর্মা যা স্বাদ! আর যায় কোথায়, তোর চাচী পারলে আমাকে জুতো মেরে বের করে দেয় বাসা থেকে৷ বলে, দূর হও তুমি চোখের সামনে থেকে!'

আমি আঁচ করার চেষ্টা করি, মনজুর চাচা কি গাঁটরিবোঁচকা নিয়ে অভিমানে দেশান্তরী, নিদেন পক্ষে বাসান্তরী হচ্ছেন কি না৷

তিনি বকে যান, আমি এই ফাঁকে আরেকটা পুরিতে মনোনিবেশ করি৷ 'তো, কোনমতে সামলে নিয়ে আমি তাকে আরো সদপরামর্শ দেই৷ বলি, গিনিপিগ পালো, নয়তো হ্যামস্টার, উঁহু, রাজি হয় না, তার নাকি ঘেন্না লাগে৷ চিন্তা কর একবার, বেড়াল ঘেন্না লাগে না, হ্যামস্টার ঘেন্না লাগে৷ তারপর বলি, আচ্ছা চলো তোতা পালি, তোতা পাখি দেখতে ভালো, কথাও বলে ক্যাটক্যাট করে, বেশ হবে৷ তোতা রাজি না হলে ময়না৷ কিন্তু সেগুলোও তার সয় না, তার নাকি কী একটা অ্যালার্জি আছে৷ আমি তো বরং জানতাম, অনেকের বেড়ালে অ্যালার্জি আছে, আর তোর চাচীর অ্যালার্জি তোতাময়নায়! আসল কথা হচ্ছে, মহিলার অ্যালার্জি আমার কথায়৷ আমি যা-ই বলি, কোনটাই তার পছন্দ হয় না৷ শেষে যখন বললাম, চলো কুকুর পালি, একটা ভালো টেরিয়ারের বাচ্চা চাইলে আমার বন্ধু মোফাজ্জল মাগনা দিয়ে দেবে৷ এই কথা শুনে মহিলা স্যুটকেস গোছায়৷ সে নাকি বাপের বাড়ি চলে যাবে, ঐখানে গিয়ে বেড়াল পালা শুরু করবে, তবুও বাড়িতে সে নাপাক কুকুর ঢুকতে দেবে না, খাবলুর মাংস খাওয়ার পর থেকেই মহিলার কুকুরের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে কুকুর খেলে মুগুর দ্রষ্টব্য৷ শুধু তাই না, এখন হয় বাসায় সে বেড়াল নিয়ে থাকবে, নয়তো আমি থাকবো৷ আমাকেও সে টিকতে দেবে না! চিন্তা করে দেখ, কী উগ্র চিন্তাধারা মহিলার! আজ সমাজে সন্ত্রাস বেড়েছে এইসব মহিলার কারণে৷ এরাই যতো নষ্টের গোড়া!'

আমি সমবেদনা জানাই, 'চাচা কি সেই কারণেই বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন?'

মনজুর চাচা সন্তুষ্ট হাসি দ্যান৷ 'পাগল? ঐ বেটির কথায় আমি বাড়ি ছাড়বো? আমিও বাঘের বাচ্চা বাঘ৷ বললাম, ঠিক আছে, পালো বেড়াল, কিন্তু উল্টাপাল্টা দেখলে চামড়া তুলে ফেলবো, সেই চামড়া দিয়ে মানিব্যাগ বানানো হবে৷'

আমি আঁতকে উঠি৷

'উঁহু, বোকা ছেলে,' আমাকে আশ্বস্ত করেন মনজুর চাচা, '--- তোর চাচীর চামড়া নয়, বেড়ালের চামড়া৷ আমি তো আর অত বলদ নই, ওভাবে ঐ খান্ডারনী মহিলাকে তখন চটিয়ে দিয়ে খামাখা ঝামেলায় পড়তে যাবো, হুঁহ! --- তো, শুরু করলো মহিলা বেড়াল পোষা৷' চাচা গুম হয়ে আরেক কাপ চায়ের ফরমাশ দেন৷ 'এটা হচ্ছে ছয় মাস আগের ঘটনা৷'

আমি একেবারে ঘায়েল হয়ে যাই৷ এ তো ইতিহাস! ইতিহাসের জের চাচা আজ পর্যন্ত টেনে চলেছেন?

'এই ছয় মাসে আবার জীবনটা কালি হয়ে গেছে!' হঠাত্‍ সর্পদংশিতলক্ষীন্দরভারেজর্জরিতা বেহুলার মতো কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন পুরুষশার্দুল মনজুর চাচা৷ 'চিন্তা কর এই সিদ্দিকের কী কূটবুদ্ধি, একটা মাদী বিলাই গছিয়ে দিয়েছে তোর চাচীকে৷'

আমি ঠিক ধরতে পারি না, বেড়ালের লিঙ্গের ঠিক কী ভূমিকা থাকতে পারে চাচার মসীলিপ্ত জীবনে৷ মাদীর বদলে মদ্দা দিলে কি সিদ্দিক চাচার সুবিধা হতো কিছু?

'বেড়াল চিনিস তুই?' মনজুর চাচা হঠাত্‍ শুধান৷

আমি মাথা নাড়ি৷ 'হ্যাঁ, চিনি৷ দেখলেই সনাক্ত করতে পারবো৷ বাঘের মতো, খালি গায়ে কোন ডোরা নাই৷ বাঘের মাসি বলে বেড়ালকে৷'

মনজুর চাচা জুলজুল করে খানিকটা দেখেন আমাকে, তারপর বলেন, 'ওভাবে তো বেড়ালকে একটা ছাগলও চিনতে পারবে৷ বেড়ালের স্বভাবচরিত্রের সাথে তোর জানাশোনা আছে? মানে, কতবড় হারামজাদা একটা জানোয়ার, তা জানিস?'

আমি মাথা দোলাই৷ না৷

'শোন তাহলে৷' চোখ বুঁজে শুরু করেন চাচা, তার স্বর আবার কাঁদো কাঁদো হয়ে আসে৷ 'গান্ডেপিন্ডে গিলে শালি৷ সারাটা দিন খায়৷ হালাল যে খাবারটা দেয়া হয়, সেটা তো খায়ই, চুরি করে হারামটাও খায়৷ ফ্রিজটাকে আঁচড়ে কামড়ে ফালাফালা করে ফেলেছে৷ আমার খুব দুধ খাওয়ার শখ, এই বেড়ালি মেহমান হয়ে আসার পর আমার দুধ খাওয়া মাথায় উঠে গেছে৷ মাছ মাংস কিনে এনে দুই মিনিট ফেলে রাখা যায় না, সে সাবাড় করে ফেলে৷ তোর চাচী তাতে কী খুশি, কী যে তার আহ্লাদ তখন, দাঁত বের করে হেসে বলে, দুষ্টু! আর ঐ জানোয়ারটা তখন ল্যাজ নাড়ে, মানে, আরো খামু৷ মাঝে মাঝে পাত থেকে মাছমুরগি থাবা দিয়ে তুলে নিয়ে যায়! এই ছয় মাসে এমন কোন দিন নেই, যেদিন আমার শার্টে লুঙ্গিতে ঝোল উল্টে পড়েনি!'

আমি তন্ময় হয়ে শুনি৷

'খাওয়া চুরি করছে, ভালো, কিন্তু ভদ্রভাবে খা৷ অর্ধেক খেয়ে এঁটোটা যেখানে সেখানে ফেলে যায়৷ কখনো বাথরুমে, কখনো ড্রয়িংরুমে, কখনো শোবার ঘরে৷ সারাটা ঘরে তার ভুক্তাবশেষ৷ মেহমান এসে বসলো সোফায়, তারপর চিত্‍কার দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো৷ কী ব্যাপার, কী ব্যাপার? পেছনে তিন ইঞ্চি কাঁটা বিঁধে গেছে৷ ঘুমাতে গেছি রাতে, কম্বল গায়ে দিতে গিয়ে হাতে কাঁটা ফুটে গেলো৷'

আমি মুখ বিকৃত করি৷

'এই তো গেলো খাওয়ার কথা, খাওয়ার পর যে কাজটা সে করে সেটা শোন? বেড়াল তো আবার হেগে সেই গু লুকিয়ে রাখে৷ সারাটা ঘরে তার সেই গুপ্তধনের সৌরভ৷ কোথায় যে সে কর্মটি করে রাখে, খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় বটে, সেটা আমার বালিশের নিচে, কম্বলে, আমার প্যান্টে৷ তার গুয়ের গন্ধ ঢাকতে গিয়ে আমার এয়ার ফ্রেশনারের পেছনে হাজার হাজার টাকা গচ্চা গেছে৷ তোর চাচীকে বিচার দিলে সে বলে কী শুনবি? বলে আমার নাকি নাকে সমস্যা৷ আর মাঝে মাঝে যে বদ গন্ধটা ঘরে পাওয়া যায়, সেটা নাকি মদের গন্ধ৷ আমি নাকি চুরি করে মদ খাই৷ তুই তো লায়েক হয়েছিস, তুই বল, মদের গন্ধ আর বেড়ালের লাদির গন্ধ এক হলো?'

আমার লায়েকত্বে মনজুর চাচার অগাধ আস্থা দেখে আমি যুগপত্‍ বিস্মিত ও পুলকিত বোধ করি৷ সবক'টা দাঁত বিকশিত করে প্রবল পরাক্রমে এ দুয়ের সাদৃশ্যকে অস্বীকার করি৷ 'কক্ষণো না! মদের গন্ধ কত সুন্দর!'

মনজুর চাচা ভুরু কুঁচকে বলেন, 'খুব লায়েক হয়েছিস দেখছি! তোর বাপকে বলতে হবে কথাটা, পরে কোন এক সময় --- এখন শোন, এই বেড়ালি খেয়ে আর হেগে আমার বাড়িটার ওপর যে অত্যাচার করেছে, এই ছ'টা মাস, একেবারে অবর্ণনীয়৷ অকথ্য আর অশ্রাব্যও বটে৷ কিন্তু তোর চাচী, এমন নিমকহারাম মহিলা, আমার কোন কথা সে কানে নেয় না, সে দিনরাত মশগুল হয়ে থাকে তার বেড়াল নিয়ে৷ আর তোর চাচী এমন কান্ডজ্ঞানহীন, প্রথমে বেড়ালের নাম রেখে বসেছে মন্টু মিয়া, তারপর যেই আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম যে এটা একটা মাদী বেড়াল, তখন নাম পাল্টে রেখেছে৷ পাল্টে আবার নাম দিয়েছে কী শোন, শেহরজাদি! শেহরজাদি না ঘোড়ার ডিম, হারামজাদী একটা! তার শেহরজাদির নামে কোন অভিযোগ সে শুনতে রাজি না৷ আর আমি রেগে গেলে সে বলে, বেড়াল তো আর তোমার মতো বিদ্যার জাহাজ না, মাঝে মাঝে এরকম করবেই, এটা নিয়ে বেশি ঢং করবা না৷ --- চিন্তা কর, লাই দিয়ে দিয়ে কোথায় তুললো সে বেড়ালিটাকে?'

আমিও লাইপ্রাপ্ত সেই মার্জার রাজকুমারীর অবস্থানটা আঁচ করার চেষ্টা করি, যতদূর মনে হয় সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলে, সে মনজুর চাচার বেশ খানিকটা ওপরেই আছে৷

'আর এই আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে সে বদমাশ জানোয়ারটার মাথা পুরোই খেয়েছে৷ চরিত্র বলে আর তার কিছুই রইলো না৷ তাছাড়া দেখতে হবে না, কোন বংশের বেড়াল? সিদ্দিকের বাড়ির বেড়াল তো চরিত্রহীন হবেই, এ আর নূতন কী!'

আমি খুক করে কাশি৷

মনজুর চাচা পাত্তা দেন না৷ 'কয়েক মাস যেতে না যেতেই হারামজাদী একটা হুলো প্রেমিক জুটিয়ে ফেললো৷ সেই খাইষ্টা জীবটা রাতবিরাতে আমার বাড়ির দেয়ালে উঠে যে কী চিত্‍কারটা করতো, ওফ, অসহ্য৷ এক একদিন ইচ্ছা হতো গুলি করে মারি, কিন্তু বন্দুকটা পড়ে থেকে থেকে নলে ময়লা জমে বরবাদ হয়ে ছিলো, তাই কিছু করা যায়নি৷ তোর চাচী, কোথায় হুলোটাকে একটু টাইট দিবে, তা না, সে উল্টে আরো খাতির করে হারামজাদাকে, নাম দিয়েছে বাদশা মিয়া৷ বাদশা মিয়াই বাড়ির বড় কুটুম্ব তখন৷'

আমি বাদশা মিয়ার সাথে নিজের সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করি, সিদ্দিক সাহেবের বাড়ির দেয়ালটার দিকে একবার তাকাই আড়চোখে৷ ওটাতে চড়ে রাতবিরাতে গান গাওয়া কি আমাকে পোষাবে? আর, সিদ্দিক সাহেবের কি আদৌ মরচে ধরা কোন বন্দুক আছে?

'শেহরজাদী আর বাদশা মিয়ার প্রেমের ঠ্যালায় আমার রাতের ঘুম হারাম৷ কুত্তার বাচ্চা বিলাই দুইটা তখন আমার বাসায় খায়, আমার খাটে হাগে, আবার আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচায়৷ চিন্তা করে দেখ, কত্ত বড় সাহস!' মনজুর চাচা চায়ের কাপটা আছড়ে রাখেন টেবিলের ওপর৷

'তারপর?' আমি রূদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করি, বাদশা মিয়ার অমঙ্গল আশঙ্কায় আমার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে৷

'তারপর আর কী? বেড়াল তো আর বেড়ালই৷ বাদশা মিয়া তো পাড়ার বেড়াল, বাদশা শাহজাহান তো আর না৷ তার প্রেম শিগগীরই ফুরালো৷ শেহরজাদি পেটে বাচ্চা নিয়ে আমার বাড়িতেই রয়ে গেলো, বাদশা হারামজাদা ভাগা মারলো৷ আমি তো পারলে বাসায় মিলাদ পড়াই, ভেবেছিলাম, শেষ পর্যন্ত খোদা রহম করলো, এখন আর রাতে সেই হাউকাউ ক্যাচম্যাচ শুনতে হবে না৷ কিন্তু শান্তি মিললো না৷ পেট বাঁধিয়ে ঐ কূলটা বেড়ালিটার মেজাজই পাল্টে গেলো, খালি ফ্যাচফ্যাচ করতো সারারাত, আঁচড়ে কামড়ে আমার ঘরের পর্দাগুলোর হালত্‍ খারাপ করে দিয়েছে জানোয়ারটা৷'

আমি সহানুভূতিসূচক একটা হাসি কপচানোর চেষ্টা করি৷ বাদশা মিয়ার পারফরম্যান্সে কেন জানি না, মনে মনে খুশিই হই, একবার ব্যাটার পিঠও চাপড়ে দিই৷ সার্থকনামা প্রেমিক ব্যাটা৷ এমন বাদশাবৃত্তিতে নিজেকে নিয়োজিত করা যায় কি না, ভাবি আনমনে৷

'ফ্যাকফ্যাক করে হাসিস না এমন, স্টুপিড৷ শোন তারপর কী হলো, অ্যাই ছ্যামরা, আরো দুইটা চা দে তো! --- হ্যাঁ, তোর চাচী আবার এদিকে আরেক কাঠি সরেস৷ সে শেহরজাদির এমন আদরযত্ন শুরু করলো, যেন নাতনি আসছে তার৷ পুষ্টিকর খাবার খাওয়ায়, চান্দে চান্দে ওজন মাপে, কী সব আদিখ্যেতা --- যাক গিয়ে৷ কয়েক হপ্তা আগে বাচ্চা দিয়েছে হারামজাদি৷ চারটা বাচ্চা, দুটো হুলো, দুটো মিনি৷ বাচ্চাগুলো শুরুতে দেখতে ভালোই ছিলো, চোখটোখ ফোটেনি, সারাদিন কুঁইকুঁই করতো, মেঝেতে গড়াতো, মাঝে মাঝে কোলে নিলে চুপচাপ বসে গাঁইগুঁই করতো৷ এমনকি আমারও ভালো লেগেছিলো৷ আর এই সময়টায় শেহরজাদীও বেশ ভদ্র হয়ে গিয়েছিলো, কোন উত্‍পাত করেনি, ভদ্রলোকের মতো বসবাস করেছে৷ আমি ভাবলাম, যাক, সুদিন এলো শেষে৷'

আমি মনজুর চাচার কাহিনীর মোড়ে হোঁচট খাই৷

'কিন্তু বেড়ালের বাচ্চা সারাজীবন বাচ্চা থাকে না৷ খুব জলদি সেগুলোর চোখ ফোটে, তারপর সেগুলো বড় হয়ে যায়, বড় হয়ে সব শুয়োরের বাচ্চা হয়ে যায়৷ বাচ্চাগুলো বড় হতে না হতেই শেহরজাদি হারামজাদি নতুন উদ্যমে তার পুরান কারবার করা শুরু করলো৷ আর বাচ্চাগুলোও তাদের মায়ের দেখাদেখি একই কীর্তি করে৷ ফলটা কী হলো? এখন আমার ঘরে পাঁচটা বেড়াল, তারা চুরি করে, রাক্ষসের মতো খায়, খোক্কসের মতো হাগে, আর উঠতে বসতে আমাকে পেরেশান করে৷' মনজুর চাচা কপালের ঘাম মোছেন৷

আমি কিছু বলার সাহস পাই না, চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিই৷

'তোর চাচীকে বললাম, এটা খুবই খারাপ হলো৷ কেয়ামতের আর বেশি দেরি নাই৷ এক শেহরজাদি চারখান বাচ্চা পয়দা করে বসছে, তাদের মধ্যে দুইটা মাদি৷ ওহ, তোর চাচী তো আবার অপোগন্ডগুলোর নাম দিয়ে ফেলেছে, সুয়োরাণী দুয়োরাণী লালকমল নীলকমল৷ আমি তাকে অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিলাম, যে এই হারে চলতে থাকলে --- সব তো জন্মেছে প্রেম করার জন্যে --- আরো ছয়মাস পর বাড়িতে বেড়ালের সংখ্যা হবে সতেরো, এক বছর পর হবে তেপ্পান্নটা, শেষমেষ আমাদেরকেই বাসা থেকে উচ্ছেদ হতে হবে৷ তোর চাচী এসব হিসাব কানেই নেয় না৷ সে তার সুয়োদুয়োলালুনীলুকে নিয়ে ব্যস্ত৷ আমি সকালে কী খেলাম না খেলাম, কাপড়জামা পড়লাম কি ন্যাংটাই থাকলাম, তা নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ নাই, তার বেড়ালগুলি কী খাবে, সেটা নিয়ে সে ব্যস্ত৷'

আমিও দুশ্চিন্তিত হই৷ বেড়াল এই হারে বাড়ে, জানতাম না৷ কিন্তু চাচার হিসেবে নিশ্চয় ভ্যাজাল আছে, তারণ তা না হলে অ্যাদ্দিনে গোটা দুনিয়া বেড়ালে ছয়লাপ হয়ে যেতো৷ তিনি শুধু নিখুঁত উত্‍পাদনের হিসেবই করেছেন, কিন্তু বাস্তব বড় খুঁতিয়াল৷ শেহরজাদী আর বাদশা মিয়া ভালো খেতে পাচ্ছে, তাই চারখানা পয়দা করে বসেছে৷ এই সুয়োদুয়োলালুনীলুরাও ভালো খেতে পাচ্ছে, তাই আশা করা যায় তারাও বাবামায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে৷ কিন্তু বাস্তবের উদ্বাস্তু বেড়ালরা পথে পথে ঘুরে বেড়ায় আর এঁটোকাঁটা খায়, তারা যে হারে জন্মায় প্রায় সে হারেই মারা পড়ে৷ তাই আমরা এখনো চরে বেড়ানোর জায়গা পাই, নইলে পেতাম না৷

ওদিকে মনজুর চাচা বকে চলেন, 'আমি এবার ঠিক করলাম, আমাকে রুখে দাঁড়াতে হবে৷ তোর চাচী চেতলে চেতুক, আমার কিছুই যায় আসে না৷ আমি করলাম কী, পিচ্চিগুলিকে ঠ্যাং বেঁধে গত পরশু দিন রাতের বেলা চুপচাপ এসে সিদ্দিক হারামজাদার বাড়ির ভেতরে ছুঁড়ে পার করে দিলাম৷ ঐ শালা, ঐ শালার বউ বেড়ালরসিক, বেড়ালের সমঝদার তারা, আর এই বেড়ালের বাচ্চাগুলি হচ্ছে তাদের আসলের ওপর সুদ৷ তাদের ইনভেস্টমেন্টের হাতে হাতে ফল৷ আমি বিচার করে দেখলাম, এগুলি আইনত ন্যায্যত ধর্মত তাদেরই প্রাপ্য৷ সেধে দিলে যে সিদ্দিকের মতো ছোটলোক বেড়ালগুলিকে রাখতে চাইবে না, সেটা আমি স্পষ্ট জানি, তাই চুপচাপ খোদাতালার মতো ছপ্পর ফেড়ে দিয়ে এসেছিলাম৷ তোর চাচী তো পরদিন সকালে উঠে বাড়ি মাথায় করে ফেললো, তারা সোনারা কোথায়, কোথায় তার সাত রাজার ধনেরা৷ আমি এদিকে চুপচাপ পেপার পড়ি আর মনে মনে হাসি৷ বোঝ বেটি, এবার বোঝ মজা৷'

আমি পরের ধাপটা আঁচ করে ফেলি৷

'কিন্তু বেড়াল যে এমন প্রভুভক্ত, আমি জানতাম না৷ আমার ধারণা ছিলো কুকুরই প্রভুভক্ত, বেড়াল একটা নিমকহারাম জীব৷ কিন্তু না৷ বাচ্চাগুলি গতকাল দুপুরেই হেলতে দুলতে এসে হাজির৷ নবাবের বাচ্চার মতো হাবভাব৷ তোর চাচী তো আনন্দে গদগদ৷ ছানা খাওয়ায়, পনির খাওয়ায়৷ বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে মরে যায়, তার স্বামী দিনের পর দিন বেড়ালের এঁটো খেয়ে খেয়ে রাস্তার নেড়ির মতো হাড় জিরজিরে চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তার কোন বিকার নাই, আর বারো ঘন্টার তফাতে বেড়ালের বাচ্চাগুলি নাকি শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে, তাদের ভালো পথ্য দরকার৷ পথে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেতো, হাতেনাতে পথ্য পেয়ে যেতো তারা, কিন্তু কাকে বোঝাবি এ কথা? --- বিকালে আবার সিদ্দিক হারামজাদা লোক পাঠিয়েছে, সে এসে নালিশ করে, বলে আপনাদের বাড়ির বেড়াল আমাদের বাড়িতে গিয়ে খুব উত্‍পাত করেছে, জিনিসপত্র ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়েছে, গোটা ঘর ময়লা করেছে, এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ আমি মিষ্টি করে বললাম, কেন বাবা, তোমার কেন মনে হলো এগুলো আমাদের বেড়ালের কাজ? আমি তো যতদূর জানি, তোমাদের ঘরেই এক কাঁদি বেড়াল আছে! সেই হারামজাদা তখন কী বলে শুনবি? বলে আগে ছিলো, কিন্তু সেগুলোর উত্‍পাত সহ্য করতে না পেরে সবকয়টাকে পাড়ার লোকের কাছে বিলিয়ে দেয়া হয়েছে৷ --- খালি চিন্তা করে দেখ, সিদ্দিকের মাথায় কী চোখা শয়তানি বুদ্ধি৷ নিজে সামলাতে না পেরে সেই ঝামেলা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে! আমি তখন বললাম, দ্যাখো বাবা, তোমাদের বিলানো বিলাই এই ছয়মাস আমার জীবনটা তছনছ করে ফেলেছে৷ ক্ষতি যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা আমারই হয়েছে৷ তার পূরণ যদি করতে হয়, তাহলে সিদ্দিক সাহেবেরই করা উচিত৷ আর আমার বাড়ির বেড়াল তোমাদের বাড়িতে গিয়ে উত্‍পাত করেছে, এটা যেমন বিশ্বাসযোগ্য না, তেমনি গ্রহণযোগ্যও না৷ তারা কেন এত আদরযত্ন ফেলে সিদ্দিকের মতো একটা চামারের কাছে যাবে? আর যদি গিয়ে থাকে, নাড়ির টানে গেছে, কারণ ঐটা তাদের নানীবাড়ি৷ নানীবাড়িতে গিয়ে লোকে একটু আধটু দুষ্টামি করেই, ঐগুলি ধরতে হয় না৷ এখন ফুটো৷'

আমি শুনে যাই৷ সিদ্দিক সাহেব তাঁর মেয়েদের নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন কি না, আঁচ করার চেষ্টা করি৷ এই পাড়ার লোকের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার পদ্ধতিটা খারাপ কিছু না৷

'আমি তারপর ভেবে দেখলাম,' মনজুর চাচা চায়ে একটা প্রকান্ড চুমুক দেন, 'সিদ্দিককে একটা হালকা টাইট দেয়া গেছে --- হাতে না হোক, মুখে --- এবার তোর চাচীর সাথে একটা ফয়সালা হওয়া দরকার৷ মহিলা আশকারা পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠে গেছে৷ আমি তাকে উচিত শিক্ষা দেবো বলে ঠিক করেছি৷ আজকে সে নিউ মার্কেটে গেছে ক্যাটফুড কিনতে৷ আমি এই ফাঁকে সবকয়টা হারামখোরকে দৌড়ঝাঁপ দিয়ে ধরেছি৷ অবশ্য খবিশ জানোয়ারগুলি আমাকে আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে ফেলেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকয়টাকে আমি বস্তায় ভরতে পেরেছি, এখন ডাক্তারের কাছে ইঞ্জেকশন নিয়ে তবে আসছি৷ তোর চাচী ফিরে এসে কোন শেহরজাদি-হারামজাদি সুয়োরাণী-শুয়োরনী দুয়োরাণী-গুয়োরাণী লালকম্বলনীলকম্বল খুঁজে পাবে না৷ সে যদি জিজ্ঞেস করে, তার বেড়াল কোথায়, আমি বলবো বাদশা মিয়ার কাছে খোঁজ করতে৷ অথবা এ পাড়ায় বেড়ালের হর্তাকর্তাবিধাতা, বেড়ালসংস্কৃতির ধারকবাহকরক্ষক ঐ বেড়ালতপস্বী সিদ্দিকের পো-কে জিজ্ঞেস করতে বলবো৷ তবুও তোর চাচী আমাকেই সন্দেহ করবে, আমি জানি, সে আমাকে আরেক দফা আঁচড়ে কামড়ে শেষ করবে, দরকার হলে আমি আরেক দফা ইঞ্জেকশন নেবো৷ --- তবে সে যদি বেশি উত্‍পাত করে, তাহলে আগেই বলে রাখছি, আমার কাছে তার সাইজেরও একটা বস্তা আছে, হ্যাঁ!'

আমি এতক্ষণে মনজুর চাচার পায়ের কাছে পড়ে থাকা বোঁচকাটার দিকে তাকাই৷ সেটা যেন অল্প একটু নড়েচড়ে ওঠে৷ আমি বলি, 'এই ব্যাগে করে নিয়ে এসেছেন নাকি?'

মনজুর চাচা হাসেন ঠা ঠা করে৷ 'হ্যাঁ৷ মজবুত পলিথিনের ব্যাগ৷ তবে পাঁচপাঁচটা বেড়ালকে এরকম একটা ব্যাগে রেখে দিলে দুই মিনিটেই ব্যাগ ফাঁসিয়ে বেরিয়ে যাবে৷ ব্যাগে ভরে আচ্ছামতো পেঁদিয়েছি শালাদের৷ অজ্ঞান হয়ে আছে বোধহয়৷'

আমি শিউরে উঠি৷ বাদশার বংশধরদের এই পরিণতি?

মনজুর চাচা আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করেন৷ 'সে কী? তুই শরীর চোমড়াচ্ছিস কেন? উঁহু বত্‍স, অত নরমটি হলে চলবে না, চরমটি এবং গরমটি হতে হবে! বীরপুঙ্গব না হলে কিছুতেই সংসার করতে পারবি না, বউয়ের ধোলাই খেয়ে অচিরেই ফিট হয়ে যাবি৷ বাঘের মতো নিষ্ঠুর না হলে বেড়ালের কাছে হার মানতে হবে তোকে৷ আর তোকে কেন ছাই উপদেশ দিচ্ছি, আমার তো এ কাজটা করা উচিত ছিলো ছ'মাস আগেই! খামোকা এত ভালো একটা সমাধানকে মাথায় জিইয়ে রেখে এই ছয়ছয়টা মাস বেড়ালের উত্‍পাতে অতিষ্ঠ হতে হলো আমাকে৷' চাচা চায়ে চুমুক দেন ঠাস করে৷ 'আর একটা পরামর্শ দিচ্ছি তোকে শোন, বেড়াল মারতে দ্বিধা করবি না কখনো৷ বিয়েশাদি করলে যতো জলদি সম্ভব বেড়াল মেরে নিজের অধিকার কায়েম করবি, সম্ভব হলে বাসর রাতেই মারবি৷'

নিজের বাসর রাতে করণীয় নৃশংসতার কথা ভেবে আঁতকে উঠি, খানিকটা লজ্জা লজ্জাও লাগে৷ কিন্তু সামলে যাই৷ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি, 'কী করবেন এখন এগুলোকে?'

মনজুর চাচা চুলে হাত চালান৷ 'আমিও এ নিয়েই ভাবছি, বুঝলি? প্রথমে ভেবেছিলাম, গোয়েন্দা গুল মোহাম্মদের ঐ পোষা নেড়ি, ডগি না ভগি --- কী যেন নাম, ওটার সামনে ছেড়ে দেবো সবকটাকে৷ অত্যন্ত তেজী কুত্তা, দুই মিনিটেই পাঁচটাকে সাবড়ে দেবে৷ কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, এতে যেমন অযথা রক্তপাত হবে, পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি হবে, তেমনি ডগির বদহজম হতে পারে৷ মাগনা খেয়ে খেয়ে বেড়ালগুলির যা কেঁদো স্বাস্থ্য হয়েছে, গুরুভোজনে ডগির একটা অনিষ্ট হতেই পারে৷ তাছাড়া, জ্ঞান ফিরে এলে পাঁচটা পাঁচদিকে ছুটবে, ডগি একটাকেও পাকড়ে সাবাড় করতে পারবে না৷ আর পরে ওগুলো বাসায় ফিরে আমার ওপর একহাত দেখিয়ে দেবে৷ তাই আর ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো গেলো না৷'

আমি ঢোঁক গিলি৷

'তারপর ভাবলাম, মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলি৷ হেঁটোয় কণ্টক আর ওপরে কণ্টক৷ ডালকুত্তাদের মাঝে বণ্টক করা না গেলে এটাই পরবর্তী ভালো আইডিয়া, কিন্তু এতে করে আমাকে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে বিস্তর, আর লোকজন দেখে ফেললে উল্টোপাল্টা সন্দেহ করবে৷ আর, কী একটা গল্প পড়েছিলাম, সেখানে এমনই কয়েকটা বেড়াল ভূত হয়ে ফিরে এসে খুব নাকাল করেছিলো নায়ককে৷ শেষটায় বেচারাকে নাকে খত্‍ দিতে হয়েছিলো৷ আমার আর এই বয়সে খত্‍ দেয়া পোষাবে না৷'

'তাহলে?'

'আমি ভাবছি,' চায়ে রসিয়ে রসিয়ে চুমুক দেন চাচা, 'এখান থেকে বাসে করে সদরঘাট যাবো, সেখান থেকে কেরানীগঞ্জের লঞ্চে চড়বো, তারপর এই ব্যাগের সাথে একটা ইঁট বেঁধে ব্যাগটাকে মাঝ বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেবো৷ ঝামেলা শেষ৷ দূরে ফেলে রেখে এলে কোন লাভ নেই, এই হারামিগুলো ঠিক ঠিক রাস্তা চিনে ফিরে আসবে৷ তাই কোন রিস্কে আমি যাচ্ছি না৷ একেবারে নিখুঁত খুন করবো৷ আর হ্যাঁ, পানিতে ফেলার আগে আরেকদফা প্যাঁদাবো শালাদের৷'

'কিন্তু চাচা,' আমি খানিকটা ভেবে বলি, 'চাচী নিউমার্কেট থেকে ফিরে এলে কী বলবেন?'

'কী বলবো? আমি আবার কী বলবো? তার বেড়ালের আয়া নাকি আমি? --- আর আমি জানি ঘটনা কিভাবে এগোবে৷ বেড়ালগুলোর জন্যে তোর চাচী প্রথম কয়েকদিন ভ্যানভ্যান করবে, ফিরে আসতে না পারলে তোর চাচী পেপারে বিজ্ঞাপন দিতে চাইবে, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করতে চাইবে, তখন মারবো এক রামধমক৷ বেড়ালের জন্যে এত দরদ কিসের? ব্যস ঠান্ডা৷ এরপর আমি যেটা করবো, কয়েক জোড়া ভালো পারাবত এনে পোষা শুরু করবো, কয়েকদিন পর তোর চাচী বেড়াল ছেড়ে আপনিই কবুতর কবুল করে নেবে৷' মনজুর চাচা তৃপ্ত হাসি ঝলকান৷ 'দাঁড়া, এক কাজ করিস, মাসখানেক পর যাস বাসায়৷ গিয়ে বলিস, চাচী কবুতরের বারবিকিউ খাবো৷ তারপর দেখিস, তোর চাচী তোকে খুন্তি তুলে কেমন দৌড়ানিটা দেয়, হে হে হে!'

আমি চাচীকে হাড়েমজ্জায় চিনি, খুন্তি চালনায় তাঁর জিঙ্গিজি দক্ষতা আমরা আগেও দেখেছি, তাই এমন কোন বদসুরত্‍ উদ্যোগ নেবার চিন্তা করি না৷

চাচা বিল দিতে দিতে আপনমনে বলেন, 'আমাদের আমলে বেড়ালগুলো শালা এমন বদমায়েশ ছিলো না৷ বাড়িতে থাকতো, কারণ বাড়িতে তাদের রাখা হতো৷ বাড়ির লোকজন তাদের অমন আশকারা দিয়ে মাথায় তুলতো না৷ বেড়ালের কাজ ছিলো ইঁদুর মারা৷ ইঁদুর মারায় গাফিলতি দেখলে লাথি মেরে সেই বেড়ালকে খেদিয়ে দেয়া হতো৷ আর চুরিচামারি করলে তো কথাই নেই, একেবারে ফাঁস লাগিয়ে নিকেশ করে দেয়া হতো৷ আর আমার বাড়িতে এই আমার বুড়া বয়সে বেড়ালের উত্‍পাতে টেকা দায়৷ ইঁদুর মারবে কী, ইঁদুরে বেড়ালে পাশাপাশি বসে আমার পাত থেকে খাবার খেয়ে যায়৷ তুই বল, এরকম মজার মজার মাগনা খাবার পেলে বেড়াল কোনদিন দৌড়ঝাঁপ করে ইঁদুর মারবে? কক্ষণো না৷ আর ইঁদুর মারার ফিটনেসও নাই এই চোট্টার পুতদের৷ খেয়ে খেয়ে খোট্টাদেশের বেড়ালের মতো গতর হয়েছে একেকটার৷ --- আমার কাছে বেড়ালের পরিচয় একটাই, সে ইঁদুরের যম৷ ইঁদুরের হাত থেকে মানুষকে রক্ষাই তার ব্রত৷ সেই রক্ষক যদি ভক্ষক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তাকে বস্তায় ভরে পেঁদিয়ে সেই বস্তাটা পানিতে ফেলে দেয়াটাই সঙ্গত৷ কী বলিস তুই, ঠিক কি না?'

এরকম মারদাঙ্গা মনজুর চাচার সাথে অনৈক্যমতের ঝুঁকি নেয়াটা নিতান্তই মূর্খামি ভেবে আমি ত্বরিত সায় দিই৷ 'জ্বি চাচা৷ দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো৷'

চাচা খুশিতে বাগবাগ হয়ে ওঠেন৷ তিনি গদগদ গলায় বলেন, 'আয় তবে আমার সাথে৷ পলিথিনের ব্যাগটা নে তুই৷ তোরা থাকতে যদি আমাকে কুলিগিরি করতে হয়, তাহলে তো ভারি সমস্যা৷ আমাকে রিকশা ঠিক করে দে একটা৷'

আমি পলিথিনের ব্যাগটা নিয়ে চাচার পেছনে চলতে থাকি৷ চলতে চলতে একটা ভাবনা ঘাই মারে মাথায়৷ পলিথিনের ব্যাগ এখন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, বিশেষ করে যে ধরনের ব্যাগে চাচা এই পঞ্চভূতকে পুরে নিয়ে চলছেন৷ এই ব্যাগ নিয়ে চলাফেরা করতে গেলে চাচা পুলিশের হাতে হেনস্থা হবেন৷ শ'পাঁচেক টাকা জরিমানাও হয়ে যেতে পারে৷

এ নিয়ে চাচাকে সতর্ক করে দেবো ভেবে মুখ খুলেছিলাম, কিন্তু রক্ষকের ভক্ষকে রূপান্তর এবং এ প্রসঙ্গে করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে তাঁর দেয়া মনোজ্ঞ বক্তৃতা শুনে মাথা ঘুরছিলো, এখন তাঁকে পুলিশের মতো নাজুক প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়ে আরো লম্বাচওড়া বক্তৃতা শোনার কোন ইচ্ছা আমার নেই৷

তবে তোমাদের আস্তে করে বলি, মনজুর চাচার আইডিয়াটা খুব একটা খারাপ লাগেনি আমার কাছে৷


রচনাকাল জানুয়ারি, ২০০৪। বছর আড়াই আগে অন্যত্র প্রকাশিত।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হিমু ভাইয়ের লেখা প্রথম গল্প পড়ি এইটা। ও-ই দুই আড়াই বছর আগে...। সেইদিন থেকে পাংখা।
আবার বলি, বাংলা ব্লগে এটা আমার পড়া সেরা একটা গল্প।
আজকে আবার পড়বো ঃ)

হিমু এর ছবি
শকুন্তলা [অতিথি] এর ছবি

হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেলো! এরকম গল্প কি খুব একটা পড়েছি?
মনে হয় না। অসাধারণ। আমার অভিবাদন জানবেন।

হিমু এর ছবি

আপনাকেও প্রত্যাভিবাদন জানাই। ধন্যবাদ।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

মূলত পাঠক এর ছবি

এ তো দুর্ধর্ষ গল্প!!! কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয়, না হলে এক প্যারা বিশেষণ ঢেলে দিতাম !! কী লিখেছেন মাইরি!

হিমু এর ছবি

একটা বিশেষণ বার করলাম ভেবে, অবিশেষণসম্ভব, কিন্তু সেটা কি আর এই তুচ্ছ গল্পের জন্যে খাটে?

পড়ার জন্যে ধন্যবাদ।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

মূলত পাঠক এর ছবি

খুউব খাটে।

রেনেট এর ছবি

বুকিং দিয়ে গেলাম...চা বানাতে যাচ্ছি...খেতে খেতে পড়বো।

পড়া শেষ করলাম। পুরো গল্পটাই মজার, তবে সেই তুলনায় শেষটা সাদামাটা লাগলো। আরো নাটকীয়তা আশা করছিলাম।
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

হিমু এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ রেনেট। নাটকীয়তার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। তবে গল্পটা হয়তো পুরোটাই শেষটুকুর জন্যে উপক্রমণিকা।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

রেনেট এর ছবি

তবে কুকুর খেলে মুগুর গল্পটা আগাগোড়া পুরাই জটিল। এই গল্পটা পড়তে গিয়ে ঐ গল্পটার কথা মনে হচ্ছিল...পরে দেখি পাদটীকা হিসাবে এই গল্পেও আছে হাসি

তবে, এটা সেই ৫ বছর আগের লেখা...এতদিনে আপনার লেখার হাত অনেক পরিপক্ক হয়েছে। নতুন কোন গল্প নামান্না
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

হিমু এর ছবি

এই গল্পে ৪,৮৯১টা শব্দ আছে। যতদূর মনে পড়ে, এটা একটানা লিখে শেষ করা। এখন একটানা কিছু লিখতে গেলেই ক্লান্ত লাগে, আর একবার ছেদ পড়লে সহজে আর এগোতে পারি না। এ কারণে নতুন কিছুই নামানো হয় না। ৪৮৯১টা নতুন শব্দ লেখার কথা ভাবলে মনে হয়, একটু ঘুমাই ...।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

মূলত পাঠক এর ছবি

আপনার এই গল্পের জন্য একটা ছবি পাঠালাম আপনার জি-মেইলের আই ডি-তে (প্রোফাইলে যেটা রয়েছে)। ভালো লাগলে লাগিয়ে দিয়েন।

হিমু এর ছবি

ভালো লাগলো, জুড়ে দিলাম, সেইসাথে জানাই অশেষ ধন্যবাদ।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

ভুতুম এর ছবি

যথারীতি চরম। এইরকম লেখার জন্য পিঠ চুলকানি কাফি না, মাথা-ঘাড় বানায়ে দিতেও রাজি আছি।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অবিশেষণসম্ভব
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মুস্তাফিজ এর ছবি

আমিও বলি অবিশেষণসম্ভব
হাসি

...........................
Every Picture Tells a Story

দ্রোহী এর ছবি

প্রায় দুই বছর পর আবারো পড়লাম গল্পটি। আবারো সেই একই আনন্দ অনুভব করেছি।

সবজান্তা এর ছবি

শেষটা কেন জানি একটু হতাশ করলো। আমি ভাবতেছিলাম বিড়াল নিয়ে কোন টুইস্ট অপেক্ষা করতেছে। তবে লেখাটা বেশ কয়েক জায়গায় পড়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাইছি।

এখন অন্তত আধা কলেবরে হইলেও কিছু গল্প টল্প লেখেন...


অলমিতি বিস্তারেণ

মূলত পাঠক এর ছবি

এখানে দেওয়া লিঙ্ক ধরে গিয়ে সারমেয়সংবাদটাও পড়ে ফেললাম। চমৎকার লাগলো। হাসি

লিখুন না মাঝে মাঝে এরকম!

নিবিড় এর ছবি

ভাল লাগল


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

হাবিব এর ছবি

আগে হিমু ভাই এর স্যাটায়ার ধরনের লেখা বেশি পড়তাম...।।এখন কার হিমু ভাই সব্যসাচী লেখক হয়ে উঠেছেন...।যুগ যুগ ্জীও -হাটুপানির জলদস্যু

প্রাচ্চ্যের ভিন দেশি

দময়ন্তী এর ছবি

গল্পটা ভারী ভাল৷
কিন্তু শেষটা কিরকম মনে হল লেখক একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন, ঠিক কি করবেন ঠিক করতে পারছেন না৷
-------------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

স্নিগ্ধা এর ছবি

লেখাটা চ্রম, কিন্তু শেষটাতে আমিও কিঞ্চিৎ ......

বিশেষ করে, বেড়াল বিসর্জনের পর 'সুন্দরী, রুচিবতী, বিদূষী, চরম স্বভাবের' চাচী'মা ব্যঘ্রপুরুষ মনজুর চাচাকে কী উপায়ে টাইটটা দিলেন, সেটা জানতে মনটা বড়ই আঁকুপাকু কচ্ছিলো মন খারাপ

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

বিমলানন্দিত হলাম

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চলুক

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
এই একাউন্টটি কোন মডারেটরের নয়। এই একাউন্ট থেকে মডারেশন করা হয়না, কিংবা এই একাউন্টের কর্মকান্ডের দায়ভার সচলায়তন নেবে না।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বেড়াল যখন ভয়শুণ্য...
চাচা যখন পীর ...

---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

সিরাত এর ছবি

অফিসে বসে আছি, তাই লেখা বাধ্য হয়ে আবারো ফেভারিটে চলে গেল নিরিবিলিতে মন দিয়ে পড়ার জন্য। হিমু ভাইয়ের দুইখান (এটা আর 'দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা') আর নুরুজ্জামান মানিক ভাইয়ের একখান দারুন লেখা এখনো শ্যাষ করবার পারলাম না। তয় করুম, চিন্তা নাই।

হিমু ভাই, আপনার লেখার দৈর্ঘ্য তো দেখা যায় ব্যাপকভাবে ক্রমহ্রাসমান! নো কমপ্লেইন দো! ব্লগে লেখার মনে হয় একটা অপটিমাল সাইজ আছে যেটা আপনি রপ্ত কইরা নিসেন।

ব্যাক টু ওয়ার্ক! চোখ টিপি

মামুন হক এর ছবি

অবিশেষণসম্ভব বলে আর আঁটানো যাচ্ছেনা ভাই, নতুন কিছু ভেবে বের করতে হবে।
কাল রাতে পড়ে হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসছিল, সকালে পড়ে আবার এক চোট হাসলাম।
কোন শালায় কইছে আপনে আলু দিয়া লেখেন?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।