১.
আন্দেজের বন্দী নামে সুধাময় করের একটা বই বেরিয়েছিলো সেবা প্রকাশনী থেকে। সুধাময় কর কি রক্তমাংসের মানুষ, নাকি ছদ্মনাম, কে জানে, তবে বইটা বেশ গা ছমছমে। উরুগুয়ের কয়েকজন রাগবি খেলোয়াড় বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আন্দেজের চিলে অংশে আটকা পড়েন। কয়েকজন মারা যান দুর্ঘটনার সময়, কয়েকজন মারা যান শীতে, কয়েকজন মারা যান বরফধ্বসে। রেডিওতে তারা শুনতে পান, তাদের উদ্ধারের চেষ্টা বাতিল করা হয়েছে। হাতের কাছে খাবার বা জ্বালানি না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে মৃত সহযাত্রীদের খাওয়া শুরু করেন। তাদের মধ্যে দু'জন অবশেষে আন্দেজের দুর্গম পথ ধরে ১২ দিন হেঁটে অবশেষে সভ্য জগতের খোঁজ পান। বিস্তারিত জানতে উইকি মারুন।
প্রায় কাছাকাছি পরিস্থিতিতে আমিও পড়েছিলাম এবার মিউনিখে গিয়ে। এ ধরনের কাহিনী বিস্তর লেখা হয়েছে। সেভেন ইয়ারস ইন টিবেট, বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন ... আমাদের বেলায় সেটা ছিলো আধ ঘন্টার মতো।
এই দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী সহসচল মনিরোশেনের কুফাপাওয়ার। এটা ব্যক্তিআক্রমণের মধ্যে পড়ে কি না জানি না, মনির গোধূলি বেজায় অপয়া। সে সাথে থাকলে একটা না একটা দুর্ঘটনায় পড়তেই হয়।
দাওয়াত ছিলো এক জায়গায়। সেখানে নাচ হবে, গান হবে, তারপর খাওয়াদাওয়া হবে। গিয়েছি শেষটার লোভে। নিজে রান্না করে খেলে মানুষ ছোঁচা হয়ে যায়, দাওয়াতের গন্ধ পেলেই গিয়ে হাজির হয়। আমিই বা ব্যতিক্রম হবো কেন? মনিরোশেন যদি সুদূর মানহাইম থেকে একবেলা ভালোমন্দ খাবার লোভে মিউনিখ এসে হাজির হতে পারে, আমার আর দোষ কী?
তবে কুফা মনির গাড়িতে চড়েই শুধায় অন্য কথা, "তীরুদা, নাচবে কে?"
তীরুদা গাড়ি চালাতে চালাতে বলেন, "রোহিণী।"
কুফা মনির নাক কোঁচকায়, "শ্রীলঙ্কান নাকি?"
তীরুদা বলেন, "শ্রীলঙ্কার হবে কেন? বাঙালি মেয়ে। কোলকাতা থেকে এসেছে।"
মনির কথা না বাড়িয়ে ঠেলতে থাকে আমাকে, "ঐ সর, জায়গা দে।"
আমি বিনাবাক্যব্যয়ে চেপেচুপে সরে জায়গা করে দিই। মনির ব্যাকপকেট থেকে মোটাসোটা একটা ব্যাগ থেকে চিরুনি আর পাউডার বের করে। তারপর তীরুদাকে বলে রিয়ার ভিউ মিররটা ঘুরিয়ে দিতে।
তীরন্দাজ নিরীহ মানুষ, কিন্তু এরকম বেয়াড়া অনুরোধ শুনে তিনি ক্ষেপে আগুন হয়ে গেলেন। পরিস্থিতি সামলানোর জন্যে মনিরকে একটা ধমক দিই। মনির ঠাণ্ডা চোখে আমাকে আপাদমস্তক [মানে গাড়িতে বসে যতটা দেখা যায় আর কি] মেপে বলে, "থাউক! তুই পাশে থাকলে পাউডার মাখে কে! সবসময় আমার পাশে পাশে থাকবি।"
কী আর বলবো। পাগলের সুখ মনে মনে।
যাই হোক, বিস্তর হাঙ্গামার পর অনুরোধ আসে, গান গাইতে। সেই এক মাস আগে থেকেই ফ্রাউ পুতুল বলে রেখেছেন, হিমু, একটা গান কিন্তু গাইতেই হবে। না বলতে পারবেন না।
না বলতে চাইওনি। কিন্তু পট করে সচল হাসিব উঠে দাঁড়ান। আমার দিকে একটা আঙুল তাক করে বলেন, "খাবাদার নড়বা না। আজকে আমি গান গামু।"
বদ্দা প্রতিবাদ করে একটা কিছু বলতে চান, হাসিব তাকেও থামিয়ে দ্যান। "কোনো কথা না। আমি গান গামু।"
এবার মুখ খোলে মনির। "হাছিব্বাই ... ।"
এটুকু বলেই তাকে থেমে যেতে হয়। হাসিব তাকেও আঙুল তাক করে কী যেন বলেন গোঁ গোঁ করে। মনির থেমে যায়।
হারমোনিয়াম বাজিয়ে হাসিব ভাই গান ধরেন তারপর। প্রিয় শিল্পী মমতাজের গান, বাড্ডা থানার ওসি আমার দুলাভাই ... ♪♫।
এদিকে তীরুদা এসে আমাকে বলেন, "হিমু চলো রোহিণীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।"
আমার লজ্জা লাগে। আমি একটু লাজুক তো। কেন রে বাবা? কী দরকার এই ক্ষণিকের আলাপের?
একই প্রশ্ন তোলে মনিরও, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন অ্যাঙ্গল থেকে। ফোঁস করে ওঠে সে, "ক্যান রোহানার লগে পরিচয় করায় দিবেন ক্যান?"
আমি শুধরে দিই, "রোহানা নয়, রোহিণী।"
মনির বিষাক্ত চোখে আমার দিকে তাকায়, তারপর কানে আঙুল দ্যায়। হাসিব তখন মাইকের সামনে তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন। আশপাশের লোক গান শুনে বাকরুদ্ধ।
তীরুদা বিরক্ত হয়ে বলেন, "থাক পরে পরিচয় করিয়ে দেবো। মনিরোশেন একটু তফাতে যাক ...।"
মনির আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলে, "তু যাঁহা যাঁহা চলেগা মেরা সায়া সাথ হোওওগা ...!"
আমি চুপচাপ বসে থাকি। দিনটাই খারাপ যাবে, বোঝা উচিত ছিলো আগেই।
এরপর রোহিণী নাচতে আসে। দর্শকরা নিজেদের মধ্যে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিলো হাসিব ভাইয়ের গান শুনে, রোহিণীর ধমক খেয়ে সবাই চুপ করে যায়।
"অ্যাটেএএনশান!" রোহিণী কড়া বকা দেয়। "কেউ নড়বেন না, চড়বেন না, চোখের পাতি ফেলবেন না।"
এই বলে সে নাচতে শুরু করে। কত্থক। রোহিণী আসলেই ভালো নাচে, তার ওপর নেচেছে শিবকে মাটিতে ফেলে তার ওপর দুর্গার প্রলয়নাচন।
মনিরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আধ বিঘা হাঁ করে নাচ দেখছে।
তীরুদা এসে বলেন, "কামানের মতো বড় একটা ক্যামেরা নিয়া ঘুরো, দুয়েকটা ছবিটবি তুলে দাও না মেয়েটারে।"
কী আর করা। উঠে যাই। রোহিণীর অনেকগুলি ছবি তুলি।
রোহিণী টেনশনে পড়ে যায় আমার ছবি তোলার ভঙ্গি দেখে। আমার একটা মাত্র ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স সম্বল, সেটা দিয়ে তো আর মনিরোচিত ছবি তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু সবাই কি আর লেন্স দেখে তার গুণাগুণ বোঝে? রোহিণী নাচের মধ্যেই যতদূর সম্ভব একটু পর পর জামা ঠিকঠাক করে।
নাচ শেষ হবার পর আমরা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই, তীরুদা হন্তদন্ত হয়ে এসে বলেন, "হিমু রোহিণী তোমাকে ডাকে।"
মনির বলে, "আমিও যাবো, আমিও যাবো!"
বিরক্ত লাগে, কিন্তু মনির হতভাগা আমাকে সোশ্যালাইজ করতে দেবে না পণ করেছে। তাকে সঙ্গে নিয়েই রোহিণীর কাছে যাই।
মনির দরজা খুলেই নিজের নাম ঘোষণা করে। "আমি মনিরহো।" বেটা আবার ব্রাজিলের সাপোর্টার।
রোহিণী বলে, কিন্তু হিমু কোথায়?
মনিরের মুখটা কালো হয়ে যায়, আমি ঘরে ঢুকি। রোহিণীর সাথে পরিচিত হয়ে তাকে দেখাই আমার ক্যাননখানা। ছবির কিসিম দেখে রোহিণী আশ্বস্ত হয়। কিছু হুদা প্যাঁচালের পর তার কার্ডখানা আমাকে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, আপনার অবসরে আমাকে একটু পাঠিয়ে দেবেন ছবিগুলো।
মনির হাঁ হাঁ করে তেড়ে আসে তখন। কী কী যেন বলতে চায়। রোহিণী চোখ পাকায়।
আমি বাধ্য হয়ে রোহিণীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মনিরকে টেনে হিঁচড়ে বার করে নিয়াসি। সে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে, বলে, ছাড় ছাড় আমারে, আলাপ বাকি আছে তো!
মনিরকে টেনেটুনে এনে খেতে বসি আমরা। রান্না দারুণ হয়েছিলো, পদও অনেক, হুশহাশ করে খাই সবাই। হাসিব ভায়ের গান শুনে ক্ষুধা কিঞ্চিৎ নষ্ট হলেও রোহিণীর নাচ দেখে আবার ফিরে এসেছে। আর হাসিব লোকটা সেইরকম খেতে পারে। গরুর গোস্তো দিয়ে চপাচপ পোলাও খেতে খেতে বলে, হলের পাশে একটা নাইজেরিয়ান ক্লাব আছে, জানো?
বলি, না।
হাসিব চোখ বুঁজে খেতে খেতে বলেন, "আমার গান শেষে এক কাল্লুমামা হাজির। আমারে কার্ড দিয়া বলে, গুট গেজুঙ্গেন [ভালো গাওয়া হয়েছে], সামনে আমাদের একটা ট্র্যাডিশনাল রেইনড্যান্স আছে, তুমি আইবা নাকি?"
আমি বললাম, আপনি কী বললেন?
হাসিব বলেন, "বুঝতেসি না। তুমি কী বলো? গামু?"
আমি উৎসাহ দিই। বলি, নিশ্চয়ই। আপনাকে দিয়েই হবে।
হাসিব ভাই একটা উদগার তুলে আবার পাতে গরুর গোস্তো নিয়ে এসে বসেন।
মনির গোগ্রাসে পোলাও খেতে খেতে আমাকে শুধু ফরমায়েশ করে চলে, এক্টু বোরহানি আইনা দে। এট্টু পানি আইনা দে। এই হাড্ডিটা ভাংতারি না চাবাইয়া এট্টু লড়ম কইরা দে।
ইচ্ছা করে মনিরের পিঠে কীচকবধী কিল মারি একটা, কিন্তু থেমে যাই সময়মতো।
খাওয়ার পর মনির আবার রোহিণীর সাথে আলাপ করতে যেতে চায়, তীরুদা তাকে ঠেকিয়ে দ্যান। "না ও এখন কারো সাথে কথা বলবে না। ভাগো।"
মনির গজগজ করতে থাকে।
একসময় অনুষ্ঠান শেষ হয়। আমরা আবার তীরুদার বাড়ি ফিরতে থাকি।
গ্যারেজে গাড়ি থামার পর হাসিব দরজা খুলে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দ্যান। বলি, ও হাছিব্বাই, হারমোনিয়ামটা ন্যান!
হাসিব বলেন, আমার জ্বর, জানো না? তুমি নাও!
স্কেল চেইঞ্জার হারমোনিয়াম, বহুত ভারি জিনিস। মনিরের ওজন হারমোনিয়ামের চে কম, বদ্দার হাতেও ভারি জিনিস, তীরুদার হাতে টুকটাক বাজারসদাই। কী আর করা, জগদ্দল ভারি জিনিসটা নিয়ে হাঁটা দিই।
লিফটের সামনে গিয়ে আমরা সবাই ঢুকি, হাসিব এর মধ্যে ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়েন।
তীরুদা বলেন, হাসিব তুমি বরং পরে আসো, এই লিফটে চারজনের বেশি ধরে না।
হাসিব বলেন, এগুলি সব সাম্রাজ্যবাদী জটিলতা। চারজনের জন্য ঠিকাছে, পাঁচজনের জন্য ঠিক্নাই। একটা কথা হইলো?
তীরুদা যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন, হাসিব ততই বক্তৃতা দ্যান। তীরুদা বলেন, তাহলে আমি পরে আসি তোমরা চার জন যাও। হাসিব তাতেও রাজি নন।
শেষমেশ বাধ্য হয়ে তীরুদা লিফটের বোতাম চাপেন।
আর সাড়ে তিনতলায় গিয়ে লিফটটা আটকে যায়। আমাদের গল্পের শুরুটাও সেখানে।
২.
যে গল্পের শুরু এতো বড়, বুঝতেই পারছেন সেটা জলদি শেষ হয়ে যাবে।
লিফট আটকে যেতেই হাসিব ভাই পাগলের মতো বোতাম টিপতে শুরু করলেন। "আরে উঠে না ক্যা? আটকায় গ্যালো ক্যা? আরে হায় হায় রে মলাম রে কী হপে রে!"
তীরুদা কড়া ধমক লাগান, হাসিব তুমি থামবা!
হাসিব ভাই ফোঁস ফোঁস কেঁদে ফেলেন। "অক্টোবরে আমার পানচিনি! ক্যা, আমি মরুম ক্যা? হোয়াই?"
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এই অক্টোবরে? জানতাম না তো!
তীরুদা ইমার্জেন্সি বোতামে চাপ দেন। একটা খড়খড়ে জার্মান কণ্ঠস্বর বলে, আপনেরা চুপচাপ থাকেন। গিয়ানজাম কইরেন না। একটু ধৈজ্জ ধরেন। সাহায্য কামিঙাপ।
একই কথা ইংরেজিতেও বলে তারা।
হাসিব ভাই বলেন, আসবে না। কোনো সাহায্য আসবে না। আমার এক গার্লফ্রেন্ড এইভাবে লিফটে আটকায় ছিলো ছয় মাস। ছয় মাস পর ওরা হাড্ডিগুলি বাইর কর্ছে! আমি এই অল্প বয়সে মরতে চাই না!
আমরা আবারও মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর বয়সের একটা লোক এইভাবে কাঁদছে দেখে ভয় লাগে।
বদ্দা বলে, ছয় মাস আমরা খামু কী?
তীরুদা কড়া ঝাড়ি মারেন। আরে তোমরা থামলা? কীসব রাবিশ বলো? এক্ষণি সাহায্য আসবে। শান্ত হও।
বদ্দা তীরুদার ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে, বাহ চাইল ডাইল মাখন সবই আছে দেখি। পিয়াজ নাই। কাচামরিচ নাই। তারপরও চলে। তেহারির জন্য টাইমিংটাই আসল জিনিস।
আমি বলি, গোস্তো পাবেন কই?
বদ্দা কেমন যেন অদ্ভূত চোখে মনিরকে দ্যাখেন। আগাপাস্তলা।
আমি হঠাৎ ভয় পেয়ে যাই।
মনির দেয়ালে হেলান দিয়ে বলে, তীরুদা আমার খুব বাথ্রুম চাপ্সে।
হাসিব ভাই তেড়ে আসেন, খাবাদার গন্ধ ছাড়বা না!
মনির একটা আঙুল তুলে থামিয়ে দেয় হাসিব ভাইকে। "দ্যাখেন, তাজিমের সাথে কথা বলবেন। পান থেকে চুন খসলে কিন্তু এই লিফট কাঁপিয়ে দিবো!"
বদ্দা আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলেন, লক্ষণ সুবিধার না। মনে হচ্ছে মনিরই প্রথম শহীদ হবে। গোস্তো নিয়া চিন্তা কইরো না। মনিরের গায়ে ত্যালচর্বি কম। গোস্তের স্বাদ খারাপ হবার কথা না।
আমি খুবই ঘাবড়ে যাই।
বদ্দা গলা খাঁকড়ে বলেন, ছয় মাস এই লিফটে আটক থাকতে হলে খাওয়া দাওয়া একটা বড় ইস্যু। তাছাড়া হাগামুতাও একটা ইস্যু হতে পারে। ঘুম একটা বড় সমস্যা হবে। এই ব্যাপারগুলি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
তীরুদা আবার ইমার্জেন্সি বাটনে চাপেন।
আবারও সেই বিদঘুটে মেসেজ। আইতাছি খাড়ান। লইড়েন চইড়েন না।
হাসিব ভাই হাপুশ নয়নে বলেন, মেয়ে দেক্তে সুচিত্রা সেনের মতো! আর মাত্র তিনটা মাস! হে খোদা পরওয়ারদিগার, এ-ই ছিলো তোমার মনে!
মনির জানতে চায়, শালি আছে?
হাসিব ভাই চোখের পানি মুছে ধরা গলায় বলেন, আছে, ক্লাস এইটে পড়ে।
মনিরের মুখটা আলো আলো হয়ে যায়। সে বলে, বেশি না, চার বছর। দেক্তে দেক্তে বড় হয়ে যাবে। বাহ। আলহামদুলিল্লাহ। সাবাশ হাছিব্বাই।
বদ্দা বলেন, আমি প্রস্তাব করছি, খাবারের অভাব শুরু হলে প্রথমে মনিরকে কোতল করা হোক।
হাসিব সাথে সাথে হাত তুলে ভোট দ্যান।
তীরুদা এবার আবার ইমার্জেন্সি বাটনে চাপ দ্যান।
এবার একটা অন্য কণ্ঠস্বর বলে, ছ্যাঙ চু শিয়াওয়ে?
তীরুদা জার্মানে কড়া ঝাড়ি দ্যান। বলেন, আমরা অমুক ঠিকানায় লিফটের ভেতরে আটকা পড়েছি। এখানে বাতাস নেই। লিফটে আমরা পাঁচ জন, তার মধ্যে তিনজনের অবস্থা খুব খারাপ। মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে যাবে। জলদি করেন।
কিন্তু আবারও একই কথা শোনা যায়, ছ্যাঙ চু শিয়াওয়ে?
এবার আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি বলি, এটা কি চীনা ভাষা?
তীরুদা বলেন, মনে হয় ক্রস কানেকশন। হ্যালো, হ্যালো?
কিন্তু ভদ্রলোকের এক জবান, আবারও ভেসে আসে, ছ্যাঙ চু শিয়াওয়ে?
কানেকশন কেটে যায়।
আমি বলি, তীরুদা! লিফট কোম্পানি কাজটা চীনে আউটসোর্স করেনি তো?
তীরুদা আচমকা চুপ মেরে যান। বদ্দা চুপ, মনিরও চুপ।
হাসিব ভায়ের মুখটা কেন যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বদ্দা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, খাইছে। চীন থিকা লোক আইসা উদ্ধার করতে করতে তো ব্যাপক খিদা লাইগা যাইবো। রান্নাপাতির একটা যোগাড় তো করতেই হবে।
মনির বলে, একটু আগেই না খাইলেন গরুর গোস্তো দিয়া পোলাও?
বদ্দা বলেন, "ঐটা আর পেটে কতক্ষণ টিকবে? কাইলকাই ধরো দুপুরের দিকে খিদা লাগবো। তোমার গোস্তো দিয়া তেহারি রানলে খারাপ হয় না।"
মনির বলে, দোস্তো তুই চুপ ক্যা? একটা কিছু ক!
আমি ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে থাকি। আন্দেজের বন্দীর কথাই মনে পড়ছিলো তখন। মনিরের গোস্তো খেতে কেমন হবে কে জানে?
সবাই চুপ করে যায় আবার। আমি সবার ছবি তুলি। ছয় মাস পর বেরিয়ে সচলে পোস্টাবো।
মিনিট পাঁচেক পরেই দরজায় ঘা পড়ে। সেই কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ছ্যাঙ চু শিয়াওয়ে?
এবার তীরুদা কেঁদে ফেলেন। জার্মান লিফট বিগড়েছে, তাকে কি আর চীনারা ম্যানেজ করতে পারবে? লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ে মৃত্যুই কি লেখা ছিলো কপালে?
তীরুদার কান্না দেখে বদ্দাও কাঁদেন। বলেন, একটু পিয়াজ থাকলেই তেহারির টেস্টটা খুইলা যাইতো।
আমি বলি, ভাগ্যিস কোনো আরোহিণী ছিলেন না আমাদের সাথে!
মনির তেড়ে আসে, ঐ তুই আমার রোহিণীরে লয়া কী কস?
বিরক্তই লাগে। লিফটের দেয়ালে জমা হওয়া আমাদের নিঃশ্বাসের বাষ্পে মনির লিখে রেখেছি. মনির + খুকু, সেটার ছবি তুলি। খুকু কে, তা কে জানে?
এমন সময় দরজার বাইরে থেকে বিরাট এক চীনা বক্তৃতা বর্ষিত হয়। আমরা কিচ্ছু বুঝি না, বোকার মতো মুখ চাওয়াচাওয়ি করি।
হাসিব ঝট করে উঠে দাঁড়ান কেবল, তারপর আমাদের চমকে দিয়ে বলেন, উয়ে ছো চ্যান উশু ছিয়াং মা?
দরজার ওপাশ থেকে একটা উল্লসিত জবাব ভেসে আসে।
হাসিব ভাই বলেন, ও আমাদের ঠেলতে বলতেসে। তীরুদা হাত লাগান, ঠেলা দিলে দরজা খুলে যাবে। আমরা আধাআধি আটকায় গেছি। জলদি!
তীরুদা অবাক হয়ে বলেন, তো ঠেলা দাও না কেন?
হাসিব ভাই বলেন, আমার জ্বর। আপনি ঠ্যালেন।
তীরুদা গজগজ করতে করতে দরজায় ঠেলা দেন।
আমাদের অপার স্বস্তিতে ভাসিয়ে দিয়ে লিফট খুলে যায়, করিডোরের বাতাসকেই মনে হয় সাগরের তাজা হাওয়া। এক লিকলিকে চীনেম্যান সেখানে দাঁড়িয়ে, সে আমাদের দেখে হাসিমুখে বলে, ছ্যাঙ চু শিয়াওয়ে?
তীরুদা হামাগুড়ি দিয়ে বের হন, তারপর বের হন বদ্দা। হাসিব ভাই বলেন, আমার জ্বর, আমারে টাইনা বাইর করতে হবে।
মনির আর আমি পেছন থেকে ঠেলে, আর তীরন্দাজ আর বদ্দা সামনে থেকে টেনে হাসিবের কলেবর বার করি লিফটের ভেতর থেকে। মনির তিড়িং করে লাফিয়ে বেরিয়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকি আমি আর সেই জগদ্দল হারমোনিয়াম। কী আর করা, দুটোকেই আমি বয়ে বার করি। কিস্মতে থাকলে কী আর করা?
বিশেষ দ্রষ্টব্য, ছবি পরে যোগ করবো।
মন্তব্য
- তোর এই গল্প পড়লে বোবা লিফটেরও জবান খুইলা যাইবো! তারপর গরগর কইরা নিজেই বয়ান করতে থাকবো আমার ভার্সনের অনুরূপ।
যাউকগা, হাসিব্বাইয়ের পানচিনিতে তোরে দাওয়াত দিছে?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
গল্প পইড়া অনেক কিছু করতে মন চাইলো, ১) গরুর মাংস খাইতে ২)মিস অথবা মিসেস রোহিণীর ফটু দেখতে ৩)হাসিব্বাই আর হিমু ভাইয়ের গান শুনতে
কালকে তো আমি মনিরোশেন ভাইর লেখা পইড়া ঘটনা একরকম ভাবছিলাম, আজকে দেখি নতুন মোচড়। কিন্তু হাছা কোনটা?
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
হা হা.. আগের পর্বটা এবার পড়তে হবে।
মার্ক টোয়েনের 'Cannibalism in the Cars' মনে পড়লো। আর 'রশোমন'। দেখা যাক, অন্যদের বয়ান কেমন হয়।
অপেক্ষায়। হাইইইই্।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
আপনে মিয়া , আর্জেন্টাইন সাপোর্টার; আপ্নের কতায় বিশ্বাস নাইক্যা...
আমি মনিরোশেনের পক্ষেই ভোট দিলাম...
_________________________________________
সেরিওজা
আর্জেন্টিনার কথা যখন আইসাই পড়লো... আমি তাইলে এইদিকেই ভুট দিতেছি।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
সত্যই আর্জেন্টাইন সাপুর্টার ??
তাইলে আমিও, ''এই ভুট মনিরুশেনরে দিলাম...''
''চৈত্রী''
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
নাঃ, একটা রোমহররর্ষক দিকে যেতে যেতেও ব্যাপারটা কাঁচিয়ে দিল চিনে উদ্ধারকারী!
রোহিনীর ফটুক দেখতে চাওয়ার গণদাবীতে আমিও লাইন দিলাম...
গল্পের যেই অংশে গরুটা গাছের মগডাল থিকা আকাশে উড়াল দিছিলো সেইটা বাদ গেছে । ফটুক দিলাম সেইটার -
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
- আপনের রুগ কিঞ্চিৎ ধরা পড়ছে লুল্ছিব্বাই।
আমার পুস্টে যে ফটুকের ইস্কিন শট মার্ছেন সেইটার আরোহী একজন বালিকা, আবার এইখানেও ডাইরেক্ট একটা 'পঙ্খীকাউ' এর ইস্কিন শট মারলেন। এবং এইটাও একটা বালিকা কাউ।
আপনের হঠাৎ 'মহিলা' রেখে 'বালিকা' প্রীতি জেগে ওঠার কারণ কী?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
সেবা থেকে বই বের হবার আগে এই ঘটনায় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কভার স্টোরি হয়েছিল “জীবন যেখানে যেমন” নামে। আমার এডভেঞ্চার প্রীতির শুরু সেখানেই।
...........................
Every Picture Tells a Story
আমাদের বাসায় যেই পিচ্চিটা থাকে- সে আমার উপরে খবরদারি করা মোটামুটিভাবে তার জীবনের লক্ষ্য হিসাবে নিছে। আমি একটু আগে এই লেখাটা পড়তেছিলাম- সে গিয়া মা'কে বলে- "নানু, বড়মামার কি জানি হইছে- সে তো একা একা ঘরের মধ্যে হাসতেছে। মনে হয় জ্বীনে আসর করছে। পীরের কাছে তাবিজ নিয়া দেন।"
তবে আমি খুশি- আমার মতো আরো কিছু ক্লাস্ট্রোফোবিক লোকজনের খোজ পাওয়া গেলো। যারা আমার দুঃখ বুঝবে! আমার লিফটে আটকা পড়ার সর্বোচ্চ ডিউরেশন অবশ্য মিনিট পাঁচেক, কিন্তু তাতে কি! একবার আমার এক বন্ধুর বাসায় এইরকম দাওয়াত খাইতে গিয়া আটকা পড়ছিলাম।
হাসিব্বাইকে পানচিনির আগাম শুভেচ্ছা। মমতাজ আমারও প্রিয় গায়িকা।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
খুবই আনন্দ পেলাম পড়ে।
হাহ হাহ হাহ হাহ হাহ!!
ভালাইছে ... বিয়াপক মউজ পাইলাম ... কিন্তুক কতা সেইটা না, কতা হইলো ... আমিও সুহানের সাথে একমত -
আপনে মিয়া , আর্জেন্টিনার সাপোর্টার; আপ্নের কতায় বিশ্বাস নাইক্যা...
আমি মনিরোশেনের পক্ষেই ভোট দিলাম... [i]
===============================================
ভাষা হোক উন্মুক্ত
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
আহারে, বদ্দার তেহারির কী হইবো !
আন্দেজের বন্দী কতকাল আগে পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম ! পুরান কথাটা মনে করানোর হৈমুনিক টেকনিকটা দারুণ হলো !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
এবারের যু্দ্ধে মনিরোশেন জয়ী হয়েছেন।
এইটা অনেকটা "ন হন্যেতে" আর "লা নুই বেঙ্গলীর" মত হয়ে যাচ্ছে। বিষয় একই কিন্তু কাহিনী ভিন্ন।
আরো দুইটা ভার্সন বাকি আছে যদিও।
++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
আন্দিজের 'জীবন যেখানে যে রকম' বিচিত্রায় (?) পড়েছিলাম। এখনো মনে গেঁথে আছে। আপনি মনে করিয়ে দিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
ব্যাপক মজারু পুস্ট, তয় পরের বার আটকা পড়লে তেহারী রাইন্ধা আওয়াজ দিয়েন, আইসা খায়া যামুনে
ব্রা-জিলের বেইল নাই, ভুট তাই আপনার পক্ষেই দিলাম
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
পোস্ট পড়তে গিয়ে শুরু থেকেই দাঁতগুলো বের হয়ে আসছিল, এই জায়গায় এসে-
ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলাম! হাসিব ভাইয়ের কমেন্টে আরেক দফা অট্টহাসি!
--------------------------------
বানান ভুল থাকলে ধরিয়ে দিন!
নতুন মন্তব্য করুন