১.
'স্বনির্ভরতা।' সুলেমান সাহেব হাসলেন। 'কথাটা হচ্ছে স্বনির্ভরতা।'
বদরুল কিছু বললো না, সুলেমান সাহেবের বাড়িয়ে দেয়া হাতের লাইটারে চুপচাপ সিগারেটটা ধরিয়ে নিলো। সুলেমান সাহেবের হাসিটা তার পছন্দ হচ্ছে না। ভদ্রলোক নিজেও অস্বস্তি নিয়ে হেসে যাচ্ছেন, আর তাকেও অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন।
'চান্দিনা এখন স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে।' বেশ গর্বিত সুরে বললেন সুলেমান।
বদরুল পায়ের ওপর পা তুলে বসলো, কষে সিগারেটের গোড়ায় টান দিচ্ছে সে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেটটা উঁচিয়ে ধরলো, 'এখানে বানানো?'
'হ্যাঁ।' সুলেমান সাহেব আবার হাসলেন, অস্বস্তির হাসি।
'বাহ্।' মাথা নাড়লো বদরুল, তার কাঁচাপাকা চুলগুলো নড়ে উঠলো। 'আপনাদের এই ছোট্ট জায়গার মধ্যে আপনারা তামাক পর্যন্ত ফলান?'
চান্দিনা কোন গ্রহ নয়, এমনকি কোন উপগ্রহও নয়। এটি এবড়োখেবড়ো, বায়ুমন্ডলহীন ছোট্ট একটি গ্রহকণা, যথেষ্ঠ জটিল কক্ষপথে ঘুরছে একটা মাঝারি মাপের তারাকে ঘিরে। চান্দিনার সূর্যটাকে পৃথিবীর লোকজন নাম দিয়েছে জোনাকিতারা। জোনাকিতারা এখন চান্দিনা থেকে দু'শো কোটি মাইল দূরে। চান্দিনায় আসার পথে মহাকাশযান থেকে একবার বদরুল উঁকি মেরে দেখেছিলো গ্রহকণাটিকে। চান্দিনার ব্যাস বড়জোড় কয়েকশো মাইল, জোনাকিতারার আলোয় সেটিকে ধূসর রঙের একটি পাথর ছাড়া আর কিছু মনে হয় নি তার কাছে।
মানুষ সৌরজগত থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েক শতক আগেই, চান্দিনায় মানুষের একটি কলোনি বাস করছে প্রায় পৌনে দু'শো বছর ধরে। বদরুল আলম পেশায় একজন সমাজবিজ্ঞানী। গত দশ বছর ধরে সে সৌরজগতের বাইরে মানুষের এই কলোনিগুলোর ওপর গবেষণা চালিয়ে আসছে। চান্দিনা হবে তার রিসার্চের তালিকায় সপ্তম মানবসমাজ। বদরুলের এই গবেষণা যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি ব্যয়বহুল। অবশ্য ব্যয় নিয়ে বদরুল মাথা ঘামাচ্ছে না, পৃথিবী থেকে তার এই গবেষণার পেছনে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করা হচ্ছে।
সুলেমান সাহেবের অস্বস্তিকর হাসিটা একচুল বিস্তৃত হলো শুধু, চেহারায় অন্য কোন পরিবর্তন হলো না। 'আমাদের জায়গাটা মোটেও ছোট্ট নয়, ডঃ আলম। অবশ্য প্রথম প্রথম বহিরাগতদের তাই মনে হতে পারে। হ্যাঁ, চান্দিনায় সমতল জমি খুব, খুবই কম। আপনাদের নিউইয়র্কের চারভাগের তিনভাগও হবে না। কিন্তু ডঃ আলম, চান্দিনার আয়তন কিন্তু কম নয়। আমরা চাইলেই চান্দিনার মাটি খুঁড়ে এর ভেতর সেঁধিয়ে যেতে পারি। আর পঞ্চাশ মাইল গড় ব্যাসার্ধ ধরে নিলে আমাদের হাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ ঘনমাইল আয়তন রয়েছে। পঞ্চাশ ফিট তফাত রেখে যদি চান্দিনার মাটির ভেতরে বিভিন্ন লেভেলে আমরা বসবাস করা শুরু করি, আমাদের বসবাসযোগ্য জায়গার মাপটা হবে সাড়ে পাঁচ কোটি বর্গমাইল। আপনাদের পৃথিবীর সমান। আর হ্যাঁ, ডঃ আলম, এই জায়গা আমরা কিন্তু এমনি এমনি ফেলে রাখবো না, পুরোপুরি উৎপাদনশীল করে তুলবো।'
বদরুল মনে মনে একটু হোঁচট খেলো, সে এভাবে চিন্তা করে নি। শুকনো গলায় সে বললো, 'হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। চান্দিনা ছাড়া অন্য কোন গ্রহকণায় মানুষের বসতি নেই তো, তাই দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র ছাড়া চিন্তা করতে আমরা ঠিক অভ্যস্ত নই। .. .. যাকগে, আপনাদের কাউন্সিলের সহযোগিতা পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছি।'
সুলেমান সাহেব মাথা নাড়লেন, তার চেহারা থেকে অস্বস্তিটা কিছুতেই দূর হচ্ছে না। বদরুল মনে মনে ভাবলো, ব্যাটা আমার আসাটাকে ভালো চোখে দেখছে না। অবশ্য এ জিনিসটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়, এর আগেও দু'তিনটা কলোনিতে বদরুল এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
'অবশ্য,' সুলেমান সাহেব আবার শুরু করলেন, 'চান্দিনার খুব অল্প জায়গায় এই ধরনের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয়েছে। বুঝতেই পারছেন, আমাদের লোকসংখ্যা খুব একটা বেশি না, তাই প্রয়োজনও পড়েনি। তাছাড়া আমাদের যন্ত্রপাতির ধারণক্ষমতাও খুব বেশি না।'
'বুঝতে পারছি। কিন্তু সুলেমান সাহেব, আমি শিগগীরই কাজ শুরু করে দিতে চাই। আপনাদের কৃষি আর পশুপালনের সেক্টরটা দিয়ে শুরু করবো ভাবছি।'
সুলেমান সাহেব কৌতুক করার চেষ্টা করলেন, 'মানুষ বাদ দিয়ে শুরুতেই পশু? পশু কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ?'
বদরুল হাসলো। 'না না, ব্যাপারটা ঠিক তা না। তবে মাটির নিচে এই কাজগুলো কিভাবে করা হচ্ছে, সেটা দেখার কৌতূহল সামলাতে পারছি না।'
সুলেমান সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। 'আমাদের এখানে গরু-ছাগলগুলো সম্ভবত আপনাদের পৃথিবীর প্রাণীগুলোর চেয়ে আকারে একটু ছোট। আর ধান, গমও খুব একটা বেশি নেই। তবে আমরা প্রচুর ঈস্ট ফলাই। আমাদের এখানে কিছু তুলার প্ল্যান্টেশন আছে, আর তামাক তো দেখতেই পাচ্ছেন। ফলের গাছও দেখতে পাবেন।'
'হুম।' শেষ ধোঁয়াটুকু ছেড়ে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলো বদরুল। 'তাহলে তো আপনাদের স্বনির্ভর বলতেই হচ্ছে। .. .. ভালো কথা, আপনারা তো সব রিসাইকেল করেন, নাকি?'
সুলেমান সাহেব যে একটু চমকে উঠেছেন, সেটা বদরুলের চোখ এড়ালো না। চান্দিনার কাউন্সিলরের চোখ দু'টো সরু হয়ে এলো। তিনি ভারি গলায় বলতে শুরু করলেন, 'হ্যাঁ। আমাদের সবকিছুই রিসাইকেল করতে হয়। বাতাস, পানি, খাবার, খনিজ .. .. যা কিছু আমরা ব্যবহার করি, সবকিছু রিসাইকেল করে আবার কাঁচামালে পরিণত করা হয়। শুধু বেশ খানিকটা শক্তির প্রয়োজন হয়, আর জোনাকিতারার কল্যাণে সেটা আমাদের অঢেল আছে। অবশ্য পুরোপুরি রিসাইকেল করা কখনোই সম্ভব না, খানিকটা অপচয় সব সময়ই হচ্ছে, বুঝতেই পারছেন। প্রতিবছর আমরা সামান্য পানি আমদানী করি শুধু। আর ভবিষ্যতে চাহিদা বাড়লে .. ..,' গলা খাঁকারি দিলেন তিনি, 'আমরা হয়তো খানিকটা তেল আর অক্সিজেনও আমদানী করা শুরু করবো।'
বদরুল পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলো। 'তো সুলেমান সাহেব .. .. কখন থেকে জরিপ শুরু করবো?'
সুলেমান সাহেবের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠতে শুরু করেছিলো, সেটা সামান্য মিইয়ে গেলো প্রশ্নটা শুনে। 'যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ডঃ আলম। কিছু রুটিন কাজ আছে, সেগুলো সেরে।'
বদরুল মনে মনে ভাবলো, কিসের রুটিন কাজ? প্রথমে যখন যোগাযোগ করা হয়েছিলো, তখন তো সুলেমান প্রায় লাফাচ্ছিলো। মহাকাশের কোন এক চিপায় ছোট্ট একটা গ্রহকণা চান্দিনা, তাকে এতো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে কাউন্সিলর খুব গদগদ ভাব দেখাচ্ছিলো। আর এখন ব্যাটা উসখুস করছে খালি।
'যে কাজ নিয়ে আমি এখানে এসেছি, আপনাদের সমাজে আবার কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না তো?' বদরুল বাজিয়ে দেখার জন্যে প্রশ্ন করলো।
সুলেমান সাহেব কোন রকম দ্বিধা না করেই বললেন, 'দেবে। চান্দিনার রীতিনীতি একটু অন্যরকম, বুঝতেই পারছেন। এখানে প্রতিটি চান্দিনাবাসীর নির্দিষ্ট একটি .. ..ইয়ে, কি বলে ... পরিচয় এবং মর্যাদা আছে। হুট করে বাইরের কেউ চলে এলে পরিস্থিতি কিছুটা নাজুক হয়ে পড়তে পারে।'
বদরুল 'পরিচয়' এবং 'মর্যাদা' কথাটার মধ্যে অন্য কিছুর গন্ধ খুঁজে পেলো। 'আপনাদের এখানেও তাহলে সেই প্রাচীন গোত্র বা বংশ রীতি চালু আছে?'
সুলেমান সাহেব ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন। 'খুব ভালো করেই আছে।'
'আপনার কি মনে হয় না ব্যাপারটা কিছুটা অযৌক্তিক?'
সুলেমান সাহেব অবিচলিত গলায় বললেন, 'হয়তো, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় নয়। আমাদের সমাজে এটার দরকার রয়েছে। এখানে বিয়েশাদির ক্ষেত্রে এই গোত্রের প্রথা খুব কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এমনকি চান্দিনাবাসীদের চাকরি আর ব্যবসার ক্ষেত্রেও বংশের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। অনেক কাজ আছে, যেগুলো নির্দিষ্ট কিছু বংশের লোক পুরুষানুক্রমে করে আসছে। এখানে প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্যে একটি নির্দিষ্ট পরিচয় ও দায়িত্ব রয়েছে। তারা সেটা জানে, মেনে নেয় এবং সেটার সাথে মানিয়ে নেয়। এ কারণেই আমাদের এখানে কোন ধরনের দুর্নীতি নেই।'
'সবাই মানিয়ে নেয়?' বদরুল কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো।
সুলেমান সাহেব খুব সম্ভবত 'না' বলার জন্যে মুখ খুলেছিলেন, মাঝপথেই কথাটা গিলে ফেললেন তিনি। তাঁর চেহারা দেখে মনে হলো তিনি মহা অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। 'আপনার বোধহয় বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। তারপর আপনাকে আমি ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করছি।'
বদরুল উঠে দাঁড়ালো, তারপর সুলেমান সাহেবের সাথে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
২.
কোথাও না কোথাও একটা ভ্যাজাল আছে, সুলেমান সাহেবের সাথে আলাপ শেষ করে বদরুল সিদ্ধান্তে পৌঁছুলো। খবরের কাগজ পড়ে তার এই ধারণা আরো বদ্ধমূল হলো।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে কাগজটা নিয়ে বসেছিলো বদরুল। আট পাতার সিনথেটিক কাগজে ছাপানো একটা ট্যাবলয়েড, নাম আজকের চান্দিনা। প্রথম দু'পাতা জুড়ে নানারকম ব্যক্তিগত খবরাখবর, শুভ বিবাহ, জন্ম সংবাদ আর মৃত্যু সংবাদ, কোথায় কোথায় নতুন বাসযোগ্য জায়গা খোঁড়া হচ্ছে তার বিবরণ, জিনিসপত্রের দাম কেমন বাড়লো বা কমলো ইত্যাদি হরেক রকম বিজ্ঞপ্তি। বাকিটুকু নানারকম জ্ঞানগর্ভ রচনা। বদরুল উল্টেপাল্টে দেখলো, নানারকম শিক্ষামূলক প্রবন্ধ আর গল্প-কবিতাও রয়েছে। কিন্তু খবর বলতে যা বোঝায়, অন্তত বদরুল খবর বলতে যা বোঝে, তার কিছুই নেই।
শেষ পাতায় এসে একটা হেডিং-এর ওপর বদরুলের চোখ আটকে গেলো।
দাবি অপরিবর্তিত
গতকালের মতো আজও তার কার্যকলাপে কোন পরিবর্তন ঘটেনি। প্রধান কাউন্সিলর তাঁর দ্বিতীয় দফা আলোচনার পর জানিয়েছেন যে, তার দাবি দাওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, এবং কোন প্রকারেই সেসব দাবি পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
চান্দিনাবাসী তার ইশারায় ওঠবস করবে না বলে আজকের চান্দিনার সম্পাদকমন্ডলী অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
খবরের এ অংশটুকু বদরুল পরপর তিনবার পড়লো। তার কার্যকলাপ, তার দাবি, তার ইশারা।
কার?
বদরুল মনের মধ্যে একটা খচখচানি নিয়ে সে রাতে ঘুমুতে গেলো।
৩.
এর পরের ক'টা দিন বদরুল খবরের কাগজ পড়ার মতো সময়ই পেলো না, কিন্তু সেই খচখচানিটা হঠাৎ হঠাৎ তার মনে পড়ে যেতে লাগলো। ব্যাপারটা কী?
সুলেমান সাহেব বদরুলের সাথে সাথেই আছেন, কিন্তু তিনি দিনকে দিন গুটিয়ে যাচ্ছেন। এখন তিনটা প্রশ্ন করলে হয়তো একটার জবাব দেন, তাও অস্পষ্ট গলায়।
তৃতীয় দিন, (আরো নিখুঁতভাবে বলা যায়, পৃথিবীর বাহাত্তর ঘন্টা সময় পার হবার পর) সুলেমান সাহেব বদরুলকে নিয়ে চান্দিনার এক প্রান্তে চলে এলেন। 'এই অংশটায় শুধু রাসায়নিক শিল্পকারখানা আছে। আমার মনে হয় এটা আপনার কাছে খুব একটা ভালো লাগবে না .. ..।'
সুলেমান কেমন একটা ফ্যাকাসে মুখ করে দ্রুত হাঁটছিলেন, এবার তিনি উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বদরুল কনুইয়ের কাছটায় তাঁর হাত ধরে ফেললো। 'এখানে কী তৈরি করা হয়?'
সুলেমান সাহেব শক্ত মুখ করে মৃদু গলায় বললেন, 'সার। আরো কিছু কিছু জৈব প্রোডাক্ট।'
বদরুল সুলেমান সাহেবের হাত ধরে রেখেই সামনে দেখার চেষ্টা করলো। সামনে চান্দিনার মলিন দিগন্ত, আর সুসজ্জিত পাথরের সারি। এর মাঝখানে অনেকগুলো বিল্ডিং। সুলেমান সাহেব সেই বিল্ডিংগুলোর দিকে পেছন ফিরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
বদরুল ভালো করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'আমি কিন্তু একটা কোয়ার্টার দেখতে পাচ্ছি। ঐ তো, ওখানে।' আঙুল দিয়ে বিল্ডিংগুলোর দিকে দেখালো সে।
সুলেমান সাহেব সেদিকে তাকালেন না।
বদরুল মনোযোগ দিয়ে আরো কিছুক্ষণ দেখলো, তারপর বললো, 'এ তো বিশাল কোয়ার্টার। আমি তো এতোবড়ো বাড়ি এখানে আগে দেখিনি। কারখানা এলাকায় এতো বড় বাড়ি কেন?' এর আগে সে দেখেছে, চান্দিনার সবকিছু তিনটা ভাগে ভাগ করা। কৃষি, শিল্প আর আবাস। কৃষি এলাকায় কোন বাড়িঘর তার চোখে পড়েনি। শিল্প এলাকায় তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
সুলেমান সাহেবের কোন উত্তর না পেয়ে সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো, তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে উল্টোদিকে হাঁটা ধরেছেন। বদরুল প্রায় ছুটতে ছুটতে তাঁর সঙ্গ ধরলো।
'কী ব্যাপার, সুলেমান সাহেব, কোন সমস্যা?' হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো সে।
সুলেমান সাহেব থামলেন না, বিড়বিড় করে বললেন, 'আমি .. .. আমি দুঃখিত। আমি জানি, এমন করাটা অভদ্রতা। কিন্তু .. .. আমার আসলে খুব সমস্যা যাচ্ছে ক'দিন ধরে .. ..।'
'তার দাবি দাওয়া নিয়ে?' বদরুল খোঁচা দিলো।
সুলেমান সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। 'আপনি এ ব্যাপারে কী কী জানেন?'
'যা বললাম তার চেয়ে বেশি কিছু না। আপনাদের খবরের কাগজে এ ব্যাপারে এটুকুর চেয়ে বেশি কিছু লেখেনি।'
সুলেমান বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।
বদরুল কথাটা ধরতে পারলো না। 'কী বললেন? চৌধুরী? সেটা কী?'
সুলেমান সাহেব ভারি একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। 'আমার মনে হয় আপনাকে সব খুলে বলাটাই উচিত ছিলো। ব্যাপারটা .. .. ব্যাপারটা খুবই বাজে, আর .. .. অস্বস্তিকর। আমরা ভেবেছিলাম, আপনি আসার আগেই সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আর আপনার কোন সমস্যাও হবে না .. .. কাজেই জিনিসটা আপনাকে না জানালেও কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু এখন প্রায় এক হপ্তা হয়ে গেলো, সমস্যাটার কোন কিনারা হচ্ছে না। এরপর যে কি হবে, আমি বুঝতে পারছি না। যদি কোন সমাধান না হয়, আপনার বোধহয় চলে যাওয়াটাই ভালো হবে। আমরা চাই না, বহিরাগত কেউ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এখানে থাকুক।'
বদরুল একটু অবিশ্বাসের হাসি হাসলো। 'মৃত্যুর ঝুঁকি? আপনাদের এই নির্ঝঞ্ঝাট ছোট্ট জায়গায়? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।'
চান্দিনার কাউন্সিলরের মুখটা মলিন হয়েই রইলো। 'বুঝিয়ে বলছি। সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে মনে হচ্ছে।' মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি, তারপর বললেন, 'আপনাকে বলেছিলাম না, চান্দিনার সবকিছুই রিসাইকেল করতে হয়?'
'হ্যাঁ।'
'এর মধ্যে .. .. ইয়ে .. .. মানুষের বর্জ্যও রয়েছে।' সুলেমান সাহেবের মুখ কুঁচকে গেলো।
'আমিও ধরে নিয়েছিলাম, এরকম কিছু করা হয়।' বদরুল ব্যাপারটার মধ্যে কোন দোষ খুঁজে পেলো না।
'ওগুলো থেকে পানি তৈরী করা হয়। ডিস্টিলেশানের মাধ্যমে। যা বাকি থাকে, সেগুলো ঈস্টের সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য জৈব প্রোডাক্ট তৈরীতেও এসব .. .. জিনিস ব্যবহার করা হয়। এখানে যে সব কারখানা দেখছেন .. ..,' বুড়ো আঙুল দিয়ে পেছনে দেখালেন সুলেমান সাহেব, 'এখানেই সেসব করা হয়।'
'তো?' প্রথম প্রথম চান্দিনায় এসে বদরুলের পানি খেতে কিছুটা সমস্যা হতো, কারণ পানিটা কোত্থেকে আসছে বুঝতে তার খুব একটা সমস্যা হয় নি। তবে এই অনুভূতিটা কাটিয়ে উঠতে তার সময় লাগেনি। পৃথিবীতেও এভাবেই খাওয়ার অযোগ্য জিনিস থেকে পানি ফিল্টার করা হয়। পদ্ধতিটা প্রাকৃতিক বলে মানুষের ততটা গায়ে লাগে না।
সুলেমান সাহেব যে প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করছেন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। 'নানা চৌধুরী এই কারখানার ইনচার্জ। এখানে যত কাজ আছে, সব তার তত্ত্বাবধানেই হয়। চান্দিনায় মানুষ যখন প্রথম উপনিবেশ গড়ে তুলেছে, তখন থেকেই নানা চৌধুরীদের বংশের লোকজন এই কারখানা চালিয়ে আসছে। নানা চৌধুরীর এক পূর্বপুরুষ, চান্দিনার প্রথম অভিযাত্রীদের একজন, রানা চৌধুরী, আর সে ছিলো .. .. সে ছিলো .. ..।'
'এই কারখানার প্রথম ইন চার্জ।' বদরুল সহযোগিতা করলো।
'হ্যাঁ। আপনি যে কোয়ার্টারটা দেখাচ্ছিলেন, সেটা হচ্ছে চৌধুরী ভিলা। চান্দিনার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়ি এটা। নানা চৌধুরীকে অনেক সুবিধা দেয়া হয়, যা আমরা কখনো পাই না। কিন্তু .. ..,' সুলেমান সাহেব গাঢ় স্বরে বললেন, 'আমরা কখনোই তার সাথে কথা বলি না।'
'কী?'
'নানা চৌধুরী সামাজিকভাবে আমাদের সমকক্ষ হতে চায়।' তিক্ত গলায় বললেন সুলেমান সাহেব। 'সে চায়, তার ছেলেমেয়েরা যেন আমাদের ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে পারে। সে চায়, আমাদের ঘরের বৌরা যেন তার পরিবারের মেয়েদের সাথে মেশে .. .. ছিহ্।'
বদরুল সুলেমান সাহেবের কন্ঠে ঘেন্না ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলো না। ব্যাপারটা তার কাছে এখন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এসেছে। এমনকি খবরের কাগজে নানা চৌধুরীর নামটা পর্যন্ত ছাপা হয়নি!
'আমার ধারণা, তার পেশার কারণে আপনারা নানা চৌধুরীর বংশটিকে কিছুটা নিচু বলে ধরে নিচ্ছেন?' বদরুল ব্যাপারটা খোলাসা করতে চাইলো।
'অবশ্যই। যে লোক মানুষের ইয়ে .. ..।' সুলেমান সাহেব ভাষা হারিয়ে ফেললেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের মিহি ঘাম মুছে তিনি বললেন, 'আপনি পৃথিবীর মানুষ, আপনি বোধহয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝবেন না। আপনার বোঝার কথাও না।'
'একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আপনাদের সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি।' বদরুল সহানুভূতি নিয়ে বললো। পৃথিবীতেও এমন ঘটনার অনেক উদাহরণ আছে। প্রাচীন ভারতে মৃতদেহের সৎকার করতো যারা, তাদেরকেও এমনিভাবে চন্ডাল নাম দিয়ে অস্পৃশ্য করে রাখা হতো। বহু প্রাচীন কালের এশিয়া মাইনরের শুকরপালকদের সামাজিক ইতিহাস জানে বদরুল, সেসব ইতিহাস এখন তার মনে পড়ে গেলো।
বদরুল অবশ্য এটুকু জেনেই চুপ করে রইলো না। 'চান্দিনার লোকজন নিশ্চয়ই তার, মানে, নানা চৌধুরীর এসব দাবি মেনে নেবে না?' কখনো মেনে নেয়া হয় না, সে জানে।
'কখনোই না।' সুলেমান সাহেব খুব জোর দিয়ে বললেন। 'কক্ষণো না।'
'তাহলে?'
'নানা চৌধুরী আমাদের হুমকি দিয়েছে, তার দাবি মেনে নেয়া না হলে সে সব কাজকর্ম বন্ধ করে দেবে।'
'মানে, সে হরতাল করবে?'
'হ্যাঁ।'
'তাতে কি খুব একটা সমস্যা হবে আপনাদের?'
'আমাদের হাতে অনেক খাবার আর পানি মজুদ আছে।' আবার ঘাম মুছলেন সুলেমান। 'নূতন করে তৈরী করার তেমন একটা প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু আমাদের .. .. বর্জ্যগুলো জমতে শুরু করবে। আর একবার জমতে শুরু করলে বিশাল একটা সমস্যা দেখা দেবে।'
'কী রকম?'
'চান্দিনায় অসুখবিসুখ খুব একটা হয় না। একদম শুরু থেকেই কড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিলো। কিন্তু এ কারণেই সমস্যাটা হয়ে গেছে। চান্দিনার মানুষদের প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব কম। বর্জ্যগুলো জমতে শুরু করলে গোটা গ্রহকণায় রোগ জীবাণুর প্রকোপ দেখা দেবে। একবার যদি কোন মহামারী শুরু হয়, আমরা কয়েকদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।'
'নানা চৌধুরী এ কথা জানে?'
'অবশ্যই জানে।'
'তারপরও কি আপনার মনে হয় যে সে হরতাল চালিয়ে যাবে?'
'সে এখন উন্মাদ। সত্যি কথা বলতে কি, সে ইতিমধ্যে কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি যেদিন চান্দিনায় পৌঁছুলেন, তার আগের দিনই সে এই রিসাইকেল করা সে বন্ধ করে দিয়েছে।' সুলেমান সাহেব এমনভাবে নাক কুঁচকালেন, যেন তিনি আকাশে বাতাসে মানুষের পুরীষের গন্ধ পাচ্ছেন। তাই দেখে বদরুলও নিজের অজান্তে জোরে শ্বাস টানলো, তার কাছে কোন আপত্তিকর গন্ধ ধরা পড়লো না।
'এ জন্যেই আমি বলছি, আপনি বরং চলে যান।' সুলেমান সাহেব অনুনয়ের সুরে বললেন। 'আমি জানি, এমন অনুরোধ করাটা অপমানকর, কিন্তু সেটাই আপনার জন্যে মঙ্গলজনক হবে।'
বদরুল কথাটাকে পাত্তা দিলো না। 'বলেন কী? এখনই চলে যাবো? আমি একজন সমাজবিজ্ঞানী, আর এ সব ঘটনাই তো আমার গবেষণার খোরাক। আমি তো রীতিমতো উৎসাহ পাচ্ছি।' একটু থেমে যোগ করলো সে, 'আমি কি নানা চৌধুরীর সাথে কথা বলতে পারি?'
'কোন ভাবেই না।' সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বললেন সুলেমান সাহেব।
'কিন্তু দেখুন, সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে ভালো করে বুঝতে হলে এ নিয়ে দু'পক্ষের সাথেই আলোচনা করতে হবে। এখানে এখন যা ঘটতে যাচ্ছে, তা একেবারেই বিরল একটি ঘটনা। এই বিশ্বের অন্য কোথাও মানুষের বিষ্ঠা নিয়ে এতো টানাটানি হয়নি .. ..', বদরুল উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, 'বুঝতেই পারছেন, আমি চান্দিনা ছাড়া অন্য কোথাও এমন পরিস্থিতি পাবো না। কাজেই বিজ্ঞান আর গবেষণার খাতিরে .. ..।'
'কথা বলবেন?' নাক সিঁটকে রইলেন সুলেমান সাহেব। 'ভিডিফোন হলে চলবে?'
'হ্যাঁ।' স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বদরুল।
'ঠিক আছে। আমি কাউন্সিলে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে দেখবো।' বিড় বিড় করে আরো কীসব যেন বললেন সুলেমান সাহেব, বদরুল বুঝতে পারলো না। খুব সম্ভবত তার রুচি নিয়েই কিছু বলছেন কাউন্সিলর।
৪.
তাঁরা সবাই বদরুলকে ঘিরে বসে আছেন। তাদের শান্ত, সৌম্য ও অভিজাত চেহারাগুলো কী এক নিদারুণ অস্বস্তিতে বিকৃত হয়ে আছে। তাঁদের মাঝখানেই বসে আছেন সুলেমান সাহেব, বদরুলের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছেন না।
প্রধান কাউন্সিলর অনেক বয়স্ক একজন মানুষ। মাথা ভর্তি রূপালী চুল, মুখের চামড়া কুঁচকে রয়েছে, ভদ্রলোক বেশ রোগা। 'আপনি যদি কোনভাবে তাকে প্রভাবিত করতে পারেন, ডঃ আলম, আপনার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে, আমরা খুশি হবো।' থেমে থেমে, নরম গলায় বললেন তিনি। 'কিন্তু, কোনক্রমেই, তাকে এমন কোন ধারণা দেবেন না, যাতে সে ধরে নেয়, আমরা তার কথায় রাজি হবো।'
সমস্ত কাউন্সিল আর বদরুলের মাঝখানে একটা ভারি, অস্বচ্ছ পর্দা ধীরে ধীরে নেমে এলো। বদরুল তার ভেতর দিয়ে কারো চেহারাই দেখতে পাচ্ছিলো না। সে তার সামনের ছোটো রিসিভারটার দিকে ঘুরলো, তারপর সেটা অন করলো।
রিসিভারে বদরুল একটা বিশাল মাথা দেখতে পেলো। শ্যামলা রঙ, চৌকো থুতনি, আর মোটা মোটা ঠোঁট নানা চৌধুরীর মধ্যবয়স্ক চেহারায় একটা শক্তির ছাপ এনে দিয়েছে।
'কে তুমি?' সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ভেসে এলো।
বদরুল নরম গলায় বললো, 'আমার নাম বদরুল আলম। আমি পৃথিবী থেকে এসেছি।'
'অর্থাৎ, একজন বহিরাগত?'
'হ্যাঁ। আমি চান্দিনায় এসেছি বিশেষ কিছু কাজে। আপনি নানা চৌধুরী?'
'নানা জসিম চৌধুরী, আপনার সেবায় নিয়োজিত।' ব্যঙ্গের সুরে বললো নানা চৌধুরী। 'ঝামেলা একটাই, আপাতত কোন সেবা চলছে না। ভবিষ্যতেও চলবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।'
বদরুল আরো নরম গলায় বললো, 'আপনি কি জানেন, চান্দিনা এখন কত বড় বিপদের মুখে রয়েছে? যে কোন মূহুর্তে মহামারী দেখা দিতে পারে। পরিস্থিতি এখন খুব বিপজ্জনক।'
'তাদের পরিস্থিতি বিপজ্জনক।' নিমেষে নানা চৌধুরীর মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। 'আমাকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হোক, আমি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছি।'
'আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি যথেষ্ঠ শিক্ষিত একজন মানুষ, চৌধুরী সাহেব।'
'তো?'
'আমি শুনেছি, আপনার আরামআয়েশের ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি নেই। আপনি চান্দিনার সবচেয়ে বিলাসবহুল বাড়িটিতে বাস করছেন। চান্দিনার যে কোন মানুষের চেয়ে আপনি ভালো খাবার খাচ্ছেন, ভালো কাপড় পড়ছেন। আপনার ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে ভালো শিক্ষা পাচ্ছে।'
'মানলাম। শিক্ষা তারা পাচ্ছে, একেবারে হাড়ে হাড়ে পাচ্ছে।' নানা চৌধুরীর মুখ দেখে মনে হলো সে রাগে ফেটে পড়বে এখন। 'সেই শিক্ষা দেয়ার দায়িত্বে কারা আছে জানো? রোবটরা। যতো অনাথ মেয়ে শিশুদের পাঠানো হয় আমাদের কাছে, যাতে তারা বড় হয়ে আমাদের বাড়ির বৌ হতে পারে। সারা জীবন একা একা থাকে বলে তারা বেশিদিন বাঁচেও না। কেন?' আচমকা রূদ্ধ গলায় বলতে লাগলো নানা চৌধুরী। 'কেন আমাদের বছরের পর বছর একা একা থাকতে হয়? আমরা তো কোন দানব নই যে মানুষের সাথে আমরা মিশতে পারবো না! আমরা কি মানুষ নই? আমাদের কি আর সবার মতো একই রকম অনুভূতি আর অভিলাষ নেই? আমাদের কি আর সবার মতো শখ-আহ্লাদ নেই? আমরা কি যথেষ্ঠ গুরুত্ব আর সম্মানজনক একটা কাজ করি না?'
বদরুলের পেছনে অনেকগুলো চাপা, অস্ফুট আর্তনাদ শোনা গেলো।
নানা চৌধুরী সে আওয়াজ শুনে বললো, 'আচ্ছা, তাহলে কাউন্সিলের লোকজনও এখানে আছে।' তার কণ্ঠস্বরে প্রবল বিতৃষ্ণা ফুটে উঠলো। 'এই যে ভদ্রলোকেরা, আমার কথার জবাব দিন। আমাদের কাজটা কি যথেষ্ঠ গুরুত্ব আর সম্মানজনক নয়? আপনাদের গু থেকে আমরা আপনাদের জন্যেই খাবার তৈরী করি। দোষটা কার বেশি, যে নোংরা জিনিস তৈরী করে, তার, নাকি যে সেই নোংরা পরিশোধন করে, তার? হ্যাঁ?'
কোন জবাব এলো না।
'শুনে রাখুন আপনারা!' ক্ষিপ্ত গলায় বললো নানা চৌধুরী। 'আমি কোনভাবেই হাল ছাড়বো না। মরে যাক, নোংরা কোন অসুখে ভুগে চান্দিনার সব ভন্ড ইতরগুলো মরে যাক! শালাদের গু নিয়ে অনেক ভুগেছি, আর না। দরকার হলে আমি আর আমার পরিবারের সবাই মরবো, কিন্তু আমার দাবি আমি তুলে নেবো না। এখন যেভাবে বেঁচে আছি, তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।'
বদরুল একটু নাক গলালো, 'আপনি তো জন্মের পর থেকেই এ পেশায় নিয়োজিত, তাই না?'
'যদি তাই হয়ে থাকি?'
'এতদিনে আপনি নিশ্চয়ই এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন?'
'কক্ষণো না।' চটে গেলো নানা চৌধুরী। 'আমি এই জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছি। আমার বাবাও বাধ্য হয়েছিলেন, সম্ভবত আমার দাদাও তা-ই। এতদিন আমি বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছি। কিন্তু এখন আমি আমার ছেলেকে দেখছি। আমার একমাত্র ছেলে, অবোধ শিশু মাত্র, তার কোন খেলার সাথী নেই। আমার তবুও একটা ভাই ছিলো, আমরা মিলেমিশে বড় হয়েছিলাম, আমার ছেলেটার তা-ও নেই। আমি এখন আর মুখ বুঁজে সহ্য করবো না। চান্দিনার ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে। .. .. আর শোনো বাইরের লোক, তোমার সাথে আর কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই।'
রিসিভারটা নীরব হয়ে গেলো।
বদরুল উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো, কাউন্সিলের সদস্যদের সবার চেহারা ফ্যাকাসে। সবচেয়ে বেশি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে প্রধান কাউন্সিলরকে। তিনি আর সুলেমান সাহেব বদরুলকে এগিয়ে দিতে এলেন।
'লোকটা বদ্ধ পাগল।' রুদ্ধ গলায় বললেন প্রধান কাউন্সিলর। 'একে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়, আমি কিছু ভেবে পাচ্ছি না।'
বদরুল এই প্রথম খেয়াল করলো, প্রধান কাউন্সিলরের হাতে একটা গ্লাস, তাতে লালচে একটা তরল। তাঁর ধবধবে সাদা স্যুটেও লালচে দাগ দেখা যাচ্ছে। ওয়াইন খেতে গিয়ে ছলকে পড়েছে বোধহয়।
বদরুল আচমকা বলে ফেললো, 'আচ্ছা, নানা চৌধুরীর দাবিগুলো কি খুব অন্যায় কিছু? তাকে সমাজে মিশতে দিলে কী হবে?'
কথাটা বলেই সে বুঝলো, ভুল হয়েছে। সুলেমান সাহেব এক মূহুর্তে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন, 'একজন .. .. বিষ্ঠার ইয়েকে আমাদের সমাজে .. ..।' নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, 'যাকগে, আপনি তো পৃথিবীর লোক।'
হঠাৎ করে বদরুলের মনে পড়লো, বিংশ শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে বিধবা মহিলাদেরকে স্থানীয় মৌলবাদীরা নানাভাবে অত্যাচার করতো, তার মধ্যে একটি হচ্ছে একঘরে করে রাখা। যে প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে তা করা হতো, সেটাকে বলা হতো ফতোয়া জারি করা। পাঁচশো বছর পর নানা চৌধুরীকে একরকম ফতোয়া দিয়েই একঘরে করে রাখা হচ্ছে।
বদরুলের মাথায় একটা সন্দেহ খেলে গেলো। 'আচছা, নানা চৌধুরী কি সরাসরি এই .. .. বিষ্ঠা নিয়ে কাজ করে? মানে, আমি জানতে চাইছি যে, বিষ্ঠার সাথে তার শারীরিক সংস্পর্শ হয় কি না।'
প্রধান কাউন্সিলর আর সুলেমান সাহেব, দু'জনেই শিউরে উঠে চোখ বুঁজলেন।
বদরুল কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো, অতটা ঝামেলা বোধহয় চৌধুরী বেচারাকে করতে হয় না। 'নিশ্চয়ই সব কাজ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি দিয়ে করানো হয়?'
'নিশ্চয়ই।'
'তাহলে নানা চৌধুরীর কাজটা কী?'
'সে যন্ত্রপাতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।' প্রধান কাউন্সিলর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন। 'কাজগুলো কতটা দ্রুত করা হবে, কিভাবে করা হবে, সেগুলো সে দেখে। দিনের একেক সময় একেক রকম পারফরম্যান্স দরকার হয়, সেগুলো সে দেখাশোনা করে। চাহিদা অনুযায়ী সে উৎপাদনের হার পরিবর্তন করে।' তিনি শুকনো, বিষণ্ণ গলায় বললেন, 'আমাদের যদি আরো বেশি জায়গা থাকতো, তাহলে এই গু ঘাঁটার যন্ত্রগুলো আরো বড়, আরো জটিল করে তৈরী করা যেতো, যাতে সরাসরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আমাদের জায়গা নেই। তাই আর খামোকা অপচয় করা হয়নি।'
'কিন্তু তাই যদি হয়,' বদরুল জোর দিয়ে বললো, 'নানা চৌধুরী কেবল নানারকম সুইচ নিয়ে কাজ করে? নিজের হাতে তো তাকে ইয়ে করতে হচ্ছে না?'
'হ্যাঁ।'
'তাহলে চান্দিনার অন্যান্য মানুষের সাথে তার তফাৎটা কী?'
সুলেমান সাহেব দৃঢ় গলায় বললেন, 'ডঃ আলম, আপনি একজন নামকরা সমাজবিজ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ হিসেবে এই ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারবেন না।'
'এই সমস্যার কারণে আপনারা আপনাদের লোকজনের মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছেন?'
'আমাদের আর কিছু করার নেই।' সুলেমান সাহেবের গলায় এমন যন্ত্রণার আভাস ছিলো, বদরুল বুঝলো, গোটা পরিস্থিতিটাই এঁদের জন্যে পীড়াদায়ক, কিন্তু এঁদের আসলেই আর কিছু করার নেই।
বদরুল কিছুটা বিরক্ত হয়ে কাঁধ ঝাঁকালো, 'তাহলে হরতাল ভেঙে দিন। শায়েস্তা করুন নানা চৌধুরীকে।'
'কীভাবে?' প্রধান কাউন্সিলর হাতের গ্লাসটা থেকে সমস্ত ওয়াইন ঢকঢক করে গিলে ফেললেন। 'কে যাবে তাকে শায়েস্তা করতে? তার কাছে কেউ যাবে না। আর যদি দূর থেকে বোমা ফেলে তাকে খতম করে দেয়া হয়, তাতেই বা আমাদের লাভটা কী?'
বদরুল মনে মনে ভাবলো, এরা দেখি শায়েস্তা বলতে খুনজখম ছাড়া আর কিছু বোঝে না। সে ভেবেচিন্তে জিজ্ঞেস করলো, 'নানা চৌধুরীর যন্ত্রপাতিগুলো কীভাবে চালাতে হয় আপনি জানেন?'
প্রধান কাউন্সিলর একটা ছোট কাউচে বসে পড়েছিলেন, নিমেষে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। 'আমি?' হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন তিনি।
'না না না।' বদরুল আর্তনাদ করে উঠলো। 'আমি আপনি বলতে আপনাকে বোঝাইনি। ওটা আসলে বলার জন্যে বলা। চান্দিনার কোন মানুষ কি জানে কিভাবে ঐসব যন্ত্র চালাতে হয়?'
প্রধান কাউন্সিলর কিছুটা শান্ত হলেন। 'কারখানার হ্যান্ডবুকে লেখা আছে, সম্ভবত। কিন্তু এই আপনাকে বলে রাখছি, এসব নিয়ে আমি কক্ষণো মাথা ঘামাইনি। কখনোই না।'
'তাহলে ঐ হ্যান্ডবুক পড়ে, যন্ত্রপাতিগুলো কিভাবে কাজ করে, সেটা শিখে নেয়া যায় না? তাহলে তো নানা চৌধুরী কাজ না করলেও কোন সমস্যা নেই, তার বদলে অন্য কেউ করতে পারে।'
সুলেমান সাহেব আঁতকে উঠলেন। 'কে করবে ঐ কাজ? আমি অন্তত করবো না। কখনোই না।'
বদরুল মনে মনে ভাবলো, পৃথিবীতে এমন ট্যাবু কী কী থাকতে পারে? নরমাংস ভোজন? ঈশ্বরকে গালাগালি করা? সে বিরক্ত গলায় বললো, 'কিন্তু নানা চৌধুরী যদি এখন মারা যেতো, আপনারা কী করতেন? নিশ্চয়ই এই পদে অন্য কাউকে চাকরি দিতেন?'
'তাহলে তার ছেলে আপনাআপনি সেই পদে বহাল হয়ে যেতো। ছেলে না থাকলে অন্যান্য যেসব আত্মীয় আছে, তাদের কেউ। এমনি করেই জিনিসটা বংশানুক্রমে হয়ে আসছে।'
'যদি তার কোন প্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয় না থাকতো?'
'সেরকম কখনো ঘটেনি। সেরকম কখনো ঘটবেও না।' ছেলেমানুষের মতো বললেন সুলেমান সাহেব।
'আর সেরকম কিছু হবার সম্ভাবনা থাকলে,' ভেবে চিন্তে যোগ করলেন প্রধান কাউন্সিলর, 'আমরা কোন শিশুকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম, বড় হয়ে এই কাজ করার জন্যে।'
'আচ্ছা।' বদরুল মহা বিরক্ত হলো। 'সেই শিশুটাকে আপনারা বাছাই করতেন কিভাবে?'
'যেসব শিশুর মা নেই, তাদের মধ্য থেকে। যেভাবে আমরা চৌধুরীদের জন্যে কনে বাছাই করি, সেভাবে।' চটপট জবাব দিলেন প্রধান কাউন্সিলর।
'তাহলে এখনই একগাদা শিশু বাছাই করে ফেলুন। ভবিষ্যতে যাতে নানা চৌধুরীর বিকল্প নিয়ে কোন টানাটানি না পড়ে।' বদরুল চটে গিয়ে বললো।
'অসম্ভব।' প্রধান কাউন্সিলর দৃঢ় গলায় বললেন, 'আমরা কখনোই কনে ছাড়া অন্য কোন ভূমিকায় কোন শিশুকে পাঠাই না। যদি পাঠাতাম, তাহলে ঐ পাগলটার দাবি মেনে নিতে আর কী অসুবিধে ছিলো? আর একটা শিশু ছোটবেলা থেকে ঐ ধরনের পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, জেনেশুনে কিভাবে আমরা একাধিক শিশুকে পাঠাবো? আর পাঠালেই বা কী লাভ? ঐ শিশুকে পেলেপুষে নিজের বিকল্প হিসেবে গড়ে তুলতে লোকটা রাজি হবে কেন? আর, তার বিকল্প হতে গেলে কম করে হলেও পনেরো বছর সময় লাগবে, আমাদের হাতে আর তিন দিন সময়ও আছে কি না আমি জানি না। এখন আমাদের প্রয়োজন কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে, যে রাজি হবে .. ..,' একটু ইতস্তত করে প্রধান কাউন্সিলর প্রথমবারের মতো নানা চৌধুরীর নাম উচ্চারণ করলেন, '.. .. এই চৌধুরীত্ব মেনে নিতে। চান্দিনায় সেরকম কোন লোক আছে বলে আমার মনে হয় না। আর কাউকে জোর করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা তো আর অমানুষ নই।'
কোন লাভ নেই, বদরুল হতাশ হয়ে ভাবলো। কোন লাভ নেই, যদি না .. ..।
বদরুলের মাথায় "যদি না"-এর পর আর কিছু এলো না।
৫.
সেই রাতে বদরুলের চোখে আর ঘুম এলো না।
নানা চৌধুরী এমন কোন মহার্ঘ্য জিনিস চায়নি। মনুষ্যত্বের মূল উপকরণই চেয়েছে শুধু। সঙ্গ, সমাজ। আর তার এই চাহিদাটুকু মেনে নেয়া না হলে তিরিশ হাজার চান্দিনাবাসীকে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে হবে।
একদিকে তিরিশ হাজার চান্দিনাবাসীর কল্যাণ, অন্যদিকে একটি মাত্র পরিবারের দাবি। চৌধুরীদের প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছে, তা সত্যি। কিন্তু সেই অবিচারকে সমর্থন করার শাস্তি নিশ্চয়ই মৃত্যু নয়। মৃত্যু তো এই তিরিশ হাজার মানুষের প্রাপ্য নয়। আর এই যে অবিচার, তার মাপকাঠিই বা কোথাকার? পৃথিবীর? নাকি, চান্দিনার? আর বদরুল আলমের কী ঠ্যাকা পড়েছে বিচার-অবিচার বিচার করার? সে কোথাকার কে?
আর নানা চৌধুরী? এই তিরিশ হাজার লোক মারা গেলেও তার কিছু আসে যায় না। এই তিরিশ হাজার লোকের মধ্যে সেইসব নারী আর পুরুষরা রয়েছে, যাদের বছরের পর বছর ধরে একটি বিশেষ সামাজিক রীতি শেখানো হয়ে আসছে। এখন এই রীতি তারা চাইলেও পরিবর্তন করতে পারবে না। এই তিরিশ হাজার লোকের মধ্যে সেইসব শিশুরাও আছে, যারা গোটা ব্যাপারটার কিছুই বোঝে না।
এক পাশে তিরিশ হাজার, অন্য পাশে একটি বংশ।
বদরুল ভোরের দিকে এসে সিদ্ধান্ত নিলো। মরীয়া একটি সিদ্ধান্ত। সকাল হতে না হতে সে সুলেমান সাহেবকে ফোন করলো।
'সুলেমান সাহেব, আপনি যদি একজন বিকল্পকে খুঁজে বের করতে পারেন, তাহলে নানা চৌধুরী বুঝবে যে আর গোঁয়ার্তুমি করে লাভ নেই, তার মতলব কাজে আসবে না। সে তখন আবার সুড়সুড় করে নিজের কাজে ফিরে যাবে .. ..।'
সুলেমান সাহেব খুব অধৈর্য হয়ে বললেন, 'ডঃ আলম, এ নিয়ে তো গত রাতেই কথা হলো। আপনি তো ভালো করেই জানেন, বিকল্প কেউ নেই।'
'চান্দিনাবাসীদের মধ্যে কোন বিকল্প নেই, আমি ভালো করেই জানি।' বদরুল শান্ত গলায় বললো। 'কিন্তু আমি তো আর চান্দিনাবাসী নই। আমার এ নিয়ে কোন সংস্কার নেই। আমিই বিকল্প নানা চৌধুরী হবো।'
৬.
বদরুল যতোটা না উত্তেজিতো হলো, তাঁরা উত্তেজিত হলেন তার চেয়ে অনেক বেশি। বদরুলকে অন্তত দশবার জিজ্ঞেস করা হলো, সে তার প্রস্তাবে ব্যাপারে সিরিয়াস কি না।
ভোরে উঠে বদরুলের দাড়ি কামানো হয়নি, তার একটু গা গুলাচ্ছিলো। 'হ্যাঁ রে ভাই, আমি সিরিয়াস।' চটে গিয়ে বললো সে। 'আর ভবিষ্যতে নানা চৌধুরী যদি এরকম ঘাউরামি করে, আপনারা যখন খুশি বিকল্প গুবিশারদ আমদানি করে নিতে পারেন। এই দুনিয়ার আর কোথাও মানুষের বিষ্ঠা নিয়ে এমন সংস্কার নেই, ভালো পয়সা দিলে গন্ডায় গন্ডায় নানা চৌধুরী খুঁজে পাবেন।'
যে চিন্তাটা বদরুলকে বিরক্ত করছিলো সেটা আর কিছু না, চান্দিনার কাউন্সিলকে সহযোগিতা করতে গিয়ে সে একজন নির্যাতিত মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অবশ্য, বদরুল নিজেকে মনে মনে প্রবোধ দিলো, একঘরে করে রাখার ব্যাপারটা বাদ দিলে নানা চৌধুরীকে একরকম রাজাবাদশাই বলা যায়। নইলে ব্যাটা যথেষ্ঠ ভালো হালেই ছিলো।
বদরুলকে হ্যান্ডবুকগুলো এনে দেয়া হয়েছে। সেগুলো নিয়ে সে ছয় ঘন্টা কাটিয়ে দিলো। যেহেতু প্রশ্নের জবাব দেয়ার কেউ নেই, কাজেই প্রশ্ন করেও কোন লাভ নেই। বদরুল একবার বইগুলো পড়া শেষ করে ফের গোড়া থেকে শুরু করলো। এই প্রথম সে হাড়ে হাড়ে টের পেলো, নানা চৌধুরীকে যথেষ্ঠ জটিল একটা কাজ করতে হয়।
বদরুল বিড়বিড় করে পড়তে লাগলো, 'যতক্ষণ আটাশ নাম্বার সহনিয়ন্ত্রকের সিগন্যাল লাল থাকবে, ততক্ষণ পনেরো নাম্বার অ্যামিটারের রিডিং জিরো থাকবে। .. .. এখন কথা হচ্ছে, সহনিয়ন্ত্রকটা কী জিনিস?'
'ওখানে নিশ্চয়ই মেশিনের ওপর লেখা থাকবে .. ..।' আমতা আমতা করে বললেন সুলেমান সাহেব। চান্দিনাবাসী অন্যান্য কাউন্সিলরেরা বোকার মতো একে অন্যের দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর যে যার নখের ডগায় মনোনিবেশ করলেন।
৭.
বদরুলকে কারখানার সামনে ছেড়ে দেয়া হলো। চান্দিনার নির্মাণ করপোরেশনের দেয়া একটা ম্যাপ দেখে এগোতে হবে বদরুলকে। হোঁচট খেতে খেতে ম্যাপ হাতে বদরুল এগোতে লাগলো। নানা গলি ঘুপচি ঘুরে, মাটির তলায় বিভিন্ন লেভেল পার হয়ে অবশেষে সে চৌধুরীদের কন্ট্রোলরুমে উপস্থিত হলো।
কন্ট্রোল রুমের অবস্থা দেখে বদরুল আরেকটা হোঁচট খেলো, তবে মনে মনে। এতোগুলো যন্ত্রপাতি থাকবে, সেটা সে বিভিন্ন ক্রমিক সংখ্যার নমুনা দেখেই বুঝে গিয়েছিলো, কিন্তু সেসব যন্ত্র যে দেখতে এতো বিটকেল হবে, সে বুঝতে পারেনি।
হ্যান্ডবুক দেখে দেখে বদরুল আটাশ নাম্বার সহনিয়ন্ত্রক খুঁজে বের করলো। অর্ধবৃত্তাকার একটা ধাতব চাকতি, মাটির মধ্যে গেড়ে বসানো, তার ওপর বিভিন্ন রঙের নির্দেশক বাতি।
বদরুল নিজেকে খানিকটা আÍবিশ্বাস যোগানোর চেষ্টা করলো। কোথাও না কোথাও গাদা গাদা বিষ্ঠা জমে যাচ্ছে, তার সাথে কিছু কলকব্জাও নড়ছে। এখন তাকে শুধু বাঁধাধরা কিছু কাজ করে যেতে হবে, যাতে ময়লাগুলো আর না জমে।
বদরুল শক্ত হাতে একটা লিভার ধরে টান দিলো, হ্যান্ডবুকে প্রথমে তাই করতে বলা হয়েছে। সেকেন্ডের মধ্যে মৃদু একটা গুঞ্জন শুরু হলো। আস্তে আস্তে সেই গুঞ্জন বাড়তে বাড়তে মেঝে কাঁপানো গর্জনে পরিণত হলো।
বদরুল প্রত্যেক ধাপে বই দেখে দেখে কাজ করতে লাগলো। গোটা কন্ট্রোল রুম বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ডায়াল আর ইনডিকেটরের আলোয় উজ্জ¡ল হয়ে উঠলো। ফ্যাক্টরির কোন এক জায়গায় জমে থাকে ময়লার স্তুপ নির্দিষ্ট প্যাসেজ ধরে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলো।
৮.
আচমকা একটা তীক্ষ্ম শব্দে বদরুল চমকে উঠলো, অত্যন্ত পীড়াদায়ক মনোযোগ থেকে সরে আসতে বাধ্য হতে হলো তাকে। না, কোন রকম গন্ডগোল হয়নি, তার হাতের যোগাযোগ মডিউলটি থেকে এই বদখদ শব্দটা বের হচ্ছে।
বদরুল তাড়াহুড়ো করে সেটার রিসিভার অন করলো। মনিটরে নানা চৌধুরীর বিশাল মাথাটা ভেসে উঠলো। তার চোখে বিস্মিত দৃষ্টি। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি থেকে অবিশ্বাস আর বিষণ্ণতা মুছে গেলো।
'ও, এই তাহলে আসল ব্যাপার।' মৃদু, শান্ত গলায় বললো সে।
'আমি পৃথিবী থেকে এসেছি, চৌধুরী সাহেব, আমি চান্দিনার কেউ নই। এই কাজ করতে আমার কোন অসুবিধে নেই।' বদরুল ক্লান্ত গলায় বললো।
'ঠিক। তুমি চান্দিনার কেউ নও। কেন তুমি অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে গেলে?'
'চৌধুরী সাহেব, আমি আপনার পক্ষে। কিন্তু আমাকে এ কাজ করতেই হচ্ছে।'
'তুমি আমার পক্ষে? কেন? আর আমার পক্ষে হলে এ কাজ করছো কেন? তোমার পৃথিবীতে কি মানুষকে আমার মতোই অত্যাচার করা হয়?'
'এখন আর করা হয় না। আপনার সব যুক্তি আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এই চান্দিনার তিরিশ হাজার মানুষের কথাও তো চিন্তা করে দেখা উচিত।'
'চান্দিনার মানুষ আমার দাবি মেনে নিতো।' নানা জসিম চৌধুরী খুব শান্ত গলায় বললো। 'তুমি এসে আমার একমাত্র সুযোগটা নষ্ট করে দিলে।'
'তারা আপনার দাবি মেনে নিতো না।' বদরুল জোর গলায় বললো। 'আর এক অর্থে আপনিই জিতেছেন। তারা জানে আপনার অসন্তোষের কথা। এর আগে তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি যে, চৌধুরী বংশের কেউ কোন কারণে অসন্তুষ্ট হতে পারে।'
'এখন তারা জানলেই বা কী? তারা যেটা করবে, বাইরে থেকে তোমার মতো কাউকে ধরে নিয়ে আসবে।'
বদরুল সজোরে মাথা ঝাঁকালো। এই ব্যাপারটা নিয়ে সে গত কয়েকটি তিক্ত ঘন্টা মাথা ঘামিয়েছে। 'তারা আপনার কথা জানার পর এখন আপনাকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে। তাদের অনেকেই ভেবে দেখবে, যে অবিচার আপনার সাথে করা হচ্ছে, তার কোন যৌক্তিক ভিত্তি আছে কি না। বাইরে থেকে যদি কাউকে ভাড়া করে আনা হয়, তারা ফিরে গিয়ে সমস্ত বিশ্বের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেবে আপনার ওপর এই অত্যাচারের কাহিনী। সমস্ত মানুষ তখন আপনার কথা জানবে, আপনার পক্ষ নেবে।'
'তারপর?' নানা চৌধুরী আশ্চর্য শীতল গলায় প্রশ্ন করলো।
'পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। আপনার ছেলে বড় হতে হতে চান্দিনার পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যাবে। এমনটা আর থাকবে না।'
'আমার ছেলে বড় হতে হতে।' নানা চৌধুরী চিবিয়ে চিবিয়ে বললো। 'তুমি যে ভালো পরিস্থিতির কথা বলছো, আমার ছেলে ছোট থাকতে থাকতেই সেটা আমি সৃষ্টি করতে পারতাম। যাকগে, আমি হেরে গেছি। যাও তুমি এখান থেকে। আমি কাজে ফিরে যাচ্ছি।' তার বিশাল মাথাটা খানিকটা ঝুঁকে পড়লো।
বদরুল প্রচন্ড স্বস্তি আর নিষ্কৃতি বোধ করলো। 'চৌধুরী সাহেব, আপনি এখনই চলে আসুন। আপনার কাজ ফিরিয়ে নিন .. .. আর আপনার সাথে করমর্দন করতে পারলে আমি সম্মানিত বোধ করবো।'
মনিটরে নানা চৌধুরীর ঝুঁকে পড়া মাথাটা পলকে সোজা হয়ে গেলো। তার বিষণ্ণ চোখে এক ধরনের অহংকার ফুটে উঠলো। 'আমাকে অনেক সম্মান দেখিয়েছো তুমি, করমর্দনও করতে চাইছো। শোনো পৃথিবীর মানুষ, নিজের কাজে ফিরে যাও, আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও। তোমার সাথে হাত মেলানোর ইচ্ছে আমার নেই।'
৯.
বদরুল যে পথে এসেছিলো, সে পথেই ফিরে যেতে শুরু করলো, অবশ্যই ম্যাপ দেখে দেখে। বড় আরাম লাগছে তার। শেষ পর্যন্ত সব ঝামেলা শেষ হলো। সারারাত ঘুম হয়নি, প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে তার নিজেকে।
কারখানার এলাকা থেকে বের হবার শেষ করিডোরে এসে বদরুল থমকে দাঁড়ালো। তার সামনে বিশাল একটা কর্ডন, বের হবার কোন উপায় নেই। বের অন্য কোন বিকল্প পথও নেই, সেটা বদরুল জানে।
আচমকা গমগমে একটা আওয়াজ শুনে সে চমকে উঠলো। 'ডঃ আলম, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আমি কাউন্সিলর সুলেমান।'
বদরুল ওপর দিকে তাকালো। আওয়াজটা নিঃসন্দেহে ওপর থেকে আসছে, কিন্তু মাইক বা এরকম কিছু তার চোখে পড়লো না।
বদরুল জবাব দিলো, 'কী ব্যাপার সুলেমান সাহেব, কোন সমস্যা? আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?'
'আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি।' জবাব এলো।
বদরুল নিজের অজান্তেই চেঁচাচ্ছিলো। 'কী ব্যাপার, কোন সমস্যা? এখানে একটা কর্ডন দেখতে পাচ্ছি। নানা চৌধুরী কাজে ফেরেনি?'
'সে কাজে গেছে।' সুলেমান সাহেব থেমে থেমে বললেন। 'দুর্যোগের অবসান ঘটেছে। আপনাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে।
বদরুল মহা বিরক্ত হয়ে বললো, 'আমি তো যেতেই চাচ্ছি। এখানে কর্ডন দিয়েছেন কেন? সরানোর ব্যবস্থা করুন।'
সুলেমান সাহেব থেমে থেমে বললেন, 'ডঃ আলম, আপনাকে এক্ষুণি চান্দিনা ত্যাগ করতে হবে।
'চান্দিনা ত্যাগ করতে হবে?' বদরুল হতভম্ব হয়ে গেলো।
'হ্যাঁ। আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে একটি মহাকাশযান এই মূহুর্তে তৈরী রয়েছে।'
'মহাকাশযান?' বদরুল কিছুই বুঝতে পারছে না। 'আরে ভাই, আমার তো এখনও ড্যাটা সংগ্রহ করা হয়নি।'
'এ ব্যাপারে আপনাকে আমি সহযোগিতা করতে পারছি না। আপনাকে এক্ষুণি মহাকাশযানে চলে যেতে হবে। সেখানে আপনার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রোবটদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হবে। আমাদের অনুরোধ .. .. আমাদের অনুরোধ .. ..।'
একটা ব্যাপার বদরুলের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। 'কী অনুরোধ?'
'আমাদের অনুরোধ, আপনি পথে কোন চান্দিনাবাসীর সাথে দেখা করবেন না, কিংবা কথা বলবেন না। এবং,' সুলেমান সাহেব জোর দিয়ে বললেন, 'ভবিষ্যতে কখনও চান্দিনায় ফিরে আসার চেষ্টা করে আমাদের বিব্রত করবেন না। আপনার যদি ড্যাটা সংগ্রহের নিতান্ত জরুরী প্রয়োজন হয়ে থাকে, আপনার কোন সহকর্মীকে দয়া করে পাঠাবেন। আমরা তাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।'
বদরুল অবসন্ন গলায় বললো, 'বুঝতে পেরেছি।'
বদরুল বুঝতে পেরেছে। এখন সে-ও আরেকজন নানা চৌধুরী। বিষ্ঠা ঘাঁটার যন্ত্রগুলো এখন সে-ও ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। এখন তাকেও একঘরে করা হয়েছে।
এখন সে প্রাচীন ভারতের একজন চন্ডাল, প্রাচীন এশিয়া মাইনরের একজন শুকরপালক, বিংশ শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের একজন বিধবা মহিলা। তার ওপর কঠিন ফতোয়া জারি করা হয়েছে।
বদরুল নির্বিকার গলায় বললো, 'বিদায়।'
সুলেমান সাহেব বললেন, 'আপনাকে মহাকাশযানে পাঠানোর আগে একটা কথা জানাচ্ছি, ডঃ আলম। এই ভয়াবহ দুর্যোগের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করায় চান্দিনার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আপনাকে আমি অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।'
'আপনাকেও ধন্যবাদ।' বদরুল তার কণ্ঠস্বরের তিক্ততা লুকোনোর চেষ্টা করলো না।
(২৮ই জানুয়ারি, ২০০১)
[এ গল্পটি আজিমভের 'স্ট্রাইকব্রেকার' গল্পের ছায়াবলম্বনে লেখা। দ্য অরিজিনাল সায়েন্স ফিকশন স্টোরিজ ম্যাগাজিনের জানুয়ারি, ১৯৫৭ সংখ্যায় সেটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো।]
মন্তব্য
গল্প চমৎকার লাগল। প্রায়রিটিজ-এর দ্বন্দ্ব সত্যিই খুব ইন্টারেস্টিং।
দুর্দান্ত! কাউকে না কাউকে রাস্তায় নামতেই হবে ময়লা পরিস্কারের জন্য।
অনন্ত
প্রথম কয়েক প্যারা পড়েই ধরতে পেরেছি।
কাকস্য পরিবেদনা
আমারো একই অবস্থা।
@হিমু ভাই, অনুবাদ এবং অ্যাডাপ্টেশন, দু'ই ভালো হয়েছে।
চমৎকার!
বেশি জোস!!
------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'
গল্পের বক্তব্য হয়তো একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করবে। তবে খুব ভালো লাগলো। অনেকদিন পরে এরকম গল্প পড়া হলো।
১. কিছু গল্প থাকে ঈশপের গল্পের মতন-- কাহিনী মাধ্যম মাত্র, উপলব্ধিটাই মুখ্য। আবার কিছু গল্প হয় কৌতুকের মতন-- কাহিনীটাই মুখ্য, উপলব্ধি/উদ্দেশ্য খুঁজতে গেলে বিপদ।
আবার কিছু গল্প থাকে ঠিক এই গল্পটার মতন।
২. উপলব্ধির আবার রকম-ফের আছে।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে আমাদের ব্যাচে একটা ছেলে ছিল। ওর কাজই ছিল সব কিছুর মধ্যে একটা (মন্দ) উদ্দেশ্য/উপলব্ধি খুঁজে বের করা। কৃষণ চন্দের গাদ্দার উপন্যাসটা পড়ে মনুষ্যত্ব নিয়ে ওর উপলব্ধি হয় না, ও চিন্তা করে-- কুকুরটার নাম কি ইচ্ছা করে রূমি রাখা হলো জালালুদ্দিনকে হেয় করার জন্য?
সায়ীদ স্যার একদিন বিরক্ত হয়ে ওকে বললেন- তুমি পরিষ্কার রাস্তা বাদ দিয়ে সবসময় নর্দমা দিয়ে হাটো কেন?
কিছু গল্পে ঠিক উপলব্ধিটা অনেক বেশি জরুরী। সম্ভবত এই গল্পেও।
-----------
উত্তরাধুনিক, দক্ষিণাপ্রশ্ন
-----------
চর্যাপদ
মূল গল্পটার বঙ্গানুবাদ পড়েছিলাম অনেক আগে, তবে হিমু ভাই আপনার অনুবাদও চমৎকার।
তারাপ কোয়াস
দারুণ !!
_________________________________________
সেরিওজা
নতুন স্বাদ পেলাম লেখাটিতে।
হিমু তোমার সায়েন্স ফিকশনগুলর মজা হচ্ছে সেগুলার চরিত্রাবলী। এরা এতই সাধারন নাম আর পরিচয় নিয়ে হাজির হয় যে, পড়তে অন্যরকম লাগে।
এইটা অনুবাদ হওয়াতেই কি না জানি না - রসিকতার পরিমান একটু কম বা নেই-ই। আরেকটু রসাল হয় তোমার সায়েন্সফিকশনগুল।
যাহোক গু নিয়ে এত ভাল লেখা আমি ছাড়া আর কেউ লিখতে পারে এটা জানা ছিল না হাহাহাহাহাহা.....ভাল হইছে। ভাল থাকো।
পুনশ্চ: তোমার প্রতিভা নিয়ে দিন দিন আমার দুঃশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে! এত দিকে কিভাবে লেখ?
মুসা'রে নিয়ে পরের লেখার জন্য তিমি মাছের সমান হাঁ করে বসে আছি। (স্যরি, অফটপিক হবার জন্য!)
দারুণ হয়েছে। দুইটা (গুড়) (গুড়)
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
(গুড়) দিয়ে দেখি কেমন লাগে...
দারুণ...এইবার মূল গল্পটা পড়তে হবে।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
সবচেয়ে ভাল লেগেছে বক্তব্যটা। সাবলীল অনুবাদ।
----------------------------------------------------------------------------
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
হ্যাভি ভাল্লাগছে!
লেখার সাবলীল অনুভব লেগে রইল।
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
আমার বাড়ি চান্দিনাতেই(মানে কুমিল্লা'র থানা) এই অধিকার থেকেই প্রশ্ন আমার সবকিছুই রিসাইকেল করতে হয়!!???
এখন মনে হচ্ছে আমি আসলেই চান্দিনায় নতুন। এ এক আজব গ্রহ বটে। আমার ইগো প্রবলেম মারাত্তক টিকিয়া থাকা কষ্টকর হয়ে উঠে তাই। চান্দিনা কি সকলের জন্য বাসসযোগ্য হতেই হবে! এমন কোনো জায়গা কি থাকবে না যেখানে সত্য কে সত্য এবং মিথ্যাকে স্পষ্টরুপে মিথ্যা রুপেই চিহ্নিত করা হবে! জব্বর এক গনতন্ত্র দেখলাম! একরকম হুজুগে তন্ত্রও বটে, মানুষের জন্য আইন নাকি আইনের জন্য মানুষ, এই প্রশ্নটা আবারও করতে ইচ্ছে করছে! আমি চান্দিনায় নতুন, তবে যেখানে নিজেকে নতুনই মনে হতে থাকে সেখানে আমি আবাসন গড়তে পছন্দ করি না! এটা আমার নিরব প্রতিবাদ। আপাতত কঠিনেরেই ভালোবাসিলাম। দৌড়াতে পারি কিনা তা প্রমাণের জন্য অন্তত হেটে দেখাতে হয়, সে সুযোগ এখনো হয় নি। আরো কিছুকাল কাটুক ভিসাযুক্ত হয়ে, যদি গ্রহটা আপন মনে হয় কখনো, তবে স্থায়ী নিবাসের প্রত্যাশা জানিয়ে গেলাম।
কাজী মামুন
নতুন মন্তব্য করুন