শাকের ভাইকে দেখে মনে হয়, ভাটার টানে তাঁর শরীর থেকে সব মেদমাংস নেমে চলে গেছে গভীর সাগরে, আর ভেতর থেকে জেগে উঠে আকাশ দেখছে তাঁর হাড়গোড়। তেমন স্বাস্থ্যবান তিনি কখনোই ছিলেন না, কিন্তু যতটুকু থাকলে একটা মানুষকে তার চেহারা ধরে চেনা যায়, তার নাম উঠে আসে মুখে, তার সবই যেন ভেসে গেছে ব্যাধির দুরন্ত টানে। অবশিষ্ট সে অস্থিবিব্রত শরীরটুকু নিয়ে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন।
মহুয়া ভাবী আমার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন, তার দৃষ্টির ওপাশে কী ভাবনা চলতে থাকে, আমি বুঝতে পারি না। শাকের ভাইয়ের পাশে বিছানায় বসে তিনি একটা আলতো হাত রেখেছেন শাকের ভাইয়ের হাঁটুর ওপরে, যেভাবে টলোমলো শিশু টেবিলের নিচে ঢুকলে তার মাথার ওপর একটা হাত ভাসিয়ে রাখি আমরা; যেন সে হাতটি সরিয়ে নিলেই চোট পাবেন শাকের ভাই, ভেঙে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবেন।
অসুখ শাকের ভাইয়ের কণ্ঠস্বর থেকেও প্রাণের বহুলাংশ শোষণ করে নিয়ে গেছে। তাই শাকের ভাই যখন ভাঙা গলায় বলে ওঠেন, "কেমন আছো মারুফ?", তখন চমকে উঠে ঘরে অপরিচিত কাউকে খুঁজি নিজের অজান্তেই।
আমি জানি না, এ পরিস্থিতিতে এ প্রশ্নের কী উত্তর আমার দেয়া উচিত। আমি কেমন আছি আসলে? এর উত্তর কি প্রশ্নকর্তা কেমন আছে, তার ওপরও নির্ভর করে না? আমার একটু ঠাণ্ডা লেগেছে, সামান্য জ্বর আছে গায়ে, সকালে কাশছিলাম। আর শাকের ভাইয়ের শরীরের দখল নিয়েছে হিংস্র ক্যান্সার, তিনি কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ পর মারা যাবেন।
মহুয়া ভাবীর শূন্য দৃষ্টিটুকু আমার মুখে এসে বিঁধতে থাকে, তাঁকে এড়িয়ে মুখ নিচু করে আমি বলি, "আছি, শাকের ভাই। আপনি কেমন বোধ করছেন এখন?"
শাকের ভাই ভাঙা গলাতেই হাসলেন। সে হাসিতে প্রাণের ছাপ নেই, প্রাণের প্রতি পরিহাস আছে শুধু। "আমি খুব বিরক্ত বোধ করছি মারুফ। মহুয়া, মারুফকে চা দিও।"
মহুয়া ভাবী মনের মধ্যে কী যেন হিসাব করেন, আমি টের পাই। হয়তো রান্নাঘরে প্লাস্টিকের যে কৌটোয় তিনি চিনি রাখেন, সেটি শূন্য পড়ে আছে। কিংবা গুঁড়ো দুধের টিনের তলানিতে বহুমূল্য কস্তুরীর মতো কিছু দুধ পড়ে আছে চা-পাগল শাকের ভাইয়ের জন্যে। কিংবা হয়তো চায়েরই বন্দোবস্ত নেই ঘরে। আমি তাই প্রয়োজনের চেয়ে দ্রুত বলে উঠি, "ভাবী, আপনি বসেন তো। চা খাবো না এখন।"
কিন্তু মহুয়া ভাবী উঠে দাঁড়ান যন্ত্রের মতো, উঠে দাঁড়িয়েও একটা হাত ছুঁইয়ে রাখেন শাকের ভাইয়ের হাঁটুর ওপর। তারপর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তাঁর মুখের সেই শূন্য অভিব্যক্তিকে পর্দার মতো সরিয়ে ফুটে ওঠে এক আহত, অপমানিত আক্রোশ। তিনি আচমকা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন, "কেন? চা খাবে না কেন?"
আমি মহুয়া ভাবীর মনের ভেতরে চলমান জটিল উদ্বেগের কাছে আত্মসমর্পণ করি নীরবে। চা খেতে না চাওয়ার মধ্যেও যে খানিকটা অপমান লুকিয়ে থাকে। শাকের ভাইয়ের বাসা থেকে চা না খাওয়া কি স্বাভাবিক?
ভাবী হনহন করে বেরিয়ে যান ঘর ছেড়ে।
প্রথমবারের মতো মনে হয়, শাকের ভাইয়ের ঘরের দেয়ালটা একেবারে সাদা। সেই সাদা দেওয়ালে কৃষ্ণকায় চিতার মতো গুঁড়ি মেরে পড়ে থাকা কালো ঘড়িটার বুকে মৃদু টিকটিক শব্দে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে যাচ্ছে একটা বেতো সেকেণ্ডের কাঁটা। শাকের ভাই আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘড়িটার দিকে চেয়ে বললেন, "রাতে খুব যন্ত্রণা করে শালা। টিক টিক, টিক টিক করে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।"
আমি চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ, তারপর বলি, "নামিয়ে ফেলতে বলেন না কেন?"
শাকের ভাই বিছানায় উঠে বসেন কষ্টেসৃষ্টে। "মহুয়া সময় দেখে। ঘড়ি ধরে ওষুধ খেতে হয়। ওর কাছে ঘড়িটার গুরুত্ব ওষুধে। কিন্তু আমার কাছে ওটাকে জল্লাদের মত মনে হয়। আমার সময় চলে যাচ্ছে মারুফ।"
কিছু বলি না, চুপ করে বসে থাকি। মেঝেতে কীসের যেন গুঁড়ো পড়ে আছে, কয়েকটা পিঁপড়ে এসে ঘিরে ধরেছে সেটাকে। তাদের ব্যস্ততার দিকে চোখ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু চোরা চোখে শাকের ভাইয়ের দিকে তাকাই আবার।
শাকের ভাই একটা হাত নাড়েন মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে। "রিয়াজ এসেছিলো, বললো কনসার্ট করবে। আমি বললাম, সময় নাই তো। রিয়াজ শুধু ঘড়ি দেখে।" সরু, খনখনে গলায় হেসে ওঠেন তিনি। "আমি বললাম, আমার সময় ফুরিয়ে গেছে রিয়াজ, আর রিয়াজ গাধাটা কি না শুধু ঘড়ি দেখে।"
আমি বললাম, "কনসার্ট আয়োজন করতে সাত দিনের বেশি কিন্তু লাগবে না শাকের ভাই।"
শাকের ভাই চোখ বুঁজে আবার শুয়ে পড়েন বিছানার ওপর। "আমার সময় শেষ মারুফ। আরো অনেক আগে, আরো অনেক টাকা পেলে সম্ভব হতো। এখন ... আর সম্ভব না।"
শাকের ভাইয়ের শোবার ঘরটা আশ্চর্য শূন্য লাগে। গত বছর এই ঘরে হল্লা করে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখেছি, এ বছরের শুরুতে ক্রিকেট ম্যাচের আগে শাকের ভাই ফোন করে ডেকে এনেছেন, চলে আয় ব্যাটা, একসাথে চিৎকার করি। ঘরটায় টেলিভিশন নেই, শাকের ভাইয়ের কম্পিউটার টেবিলটা ফাঁকা পড়ে আছে, তার ওপর মিহি ধূলোর আস্তর। কার যেন আঙুল দিয়ে কাটা মিহি নকশাও আছে সে ধূলোর ওপর।
ব্যাংককে যাবার আগে সব বিক্রি করতে হয়েছে শাকের ভাইকে। আধচেনা লোকজন তাঁর ঘরে এসে কোলে করে তুলে নিয়ে গেছে পুরনো রঙিন টেলিভিশন, কম্পিউটার। শুধু বইভর্তি শেলফটা অক্ষত রয়ে গেছে। বই বিক্রির টাকা দিয়ে কি আর ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে বিদেশ যেতে পারবে কেউ?
ব্যাংককে কেবল রোগ শনাক্ত করে ফিরতে পেরেছেন শাকের ভাই। ঐ শনাক্তযাত্রার ঢেউয়ে তাঁর সর্বস্ব সঞ্চয়, তাঁর সারা জীবন ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা সংসারটা কাগজের নৌকোর মতো কাঁপতে কাঁপতে ভিজে টুপ করে ডুবে গেছে। শুধু যে টাকা খরচ হয়েছে, তা-ই নয়, শাকের ভাই জেনে ফিরেছেন, তাঁর আয়ু অতি ক্ষীণ সুতোয় ঝুলছে, শেষ একটা চেষ্টা করতে পারেন তিনি, সে চিকিৎসা ধারেকাছে কেবল সিঙ্গাপুরে দেয়া সম্ভব। তার খরচের সাধ্য শাকের ভাইয়ের কল্পনাতেও হয় না। একটি হাসপাতালে তিনি মানুষ হয়ে ঢুকেছিলেন, বেরিয়ে এসেছেন ক্যালেণ্ডারের পাতায় দাগ হয়ে।
মহুয়া ভাবী জ্বলজ্বলে চোখে একটা ট্রে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢোকেন, তাতে এক কাপ চা আর এক বাটি ফুলকপির পকোড়া। তেলেভাজার গন্ধে আমার ভেতরে একটা ছোট্ট ক্ষিদে মস্ত হাঁ করে। শাকের ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই, সেখানে কোনো বিকার নেই, একটা ক্লিষ্ট ক্ষুধামান্দ্যও তাঁর হাড়গোড়ের সাথে উঠে এসেছে মুখের অভিব্যক্তিতে।
মহুয়া ভাবী কেমন একটা ঘোরলাগা মুখে একটা মোড়ার ওপর রাখেন ট্রে-টা, তারপর আবার বসেন শাকের ভাইয়ের পাশে, একই ভঙ্গিতে, একটা হাত শাকের ভাইয়ের হাঁটুর ওপর, আলগোছে। তারপর আবার সেই পুরোনো অচেনা শূন্য চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকেন নির্নিমেষে।
শাকের ভাই ভাঙা গলায় বলেন, "তুমি কোন ভালো খবর আনতে পারোনি, তাই না মারুফ?"
আমি মাথা নিচু করে ফুলকপির পকোড়া তুলে কামড় দিই। মহুয়া ভাবী অসংলগ্নভাবে বলেন, "নাই? আশা নাই কোনো?"
আমাদের পত্রিকায় শাকের ভাইকে নিয়ে দুটো নিউজ হয়েছে, দু'টো কলামও এসেছে, সেগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর যোগাযোগের দায়িত্বটা যেচে নিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী অনেক উঁচুতে বাস করেন, তাঁর কয়েক ধাপ নিচ পর্যন্ত কেবল পৌঁছাতে পারে সাধারণ মানুষ। আমি যে সাধারণ মানুষ, সেই উপলব্ধি নিয়েই আজ ফিরেছি।
চায়ের কাপে চুমুক দিই চুপচাপ, কী বলবো শাকের ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে?
শাকের ভাই চুপ করে আছেন, তাই তস্করের মতো চোখ তুলে একবার তাকাই। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তাঁর চোখ দেখে। কী একটা আশা, কী একটা প্রচণ্ড আকুতি সেখানে, কী এক অসীম ছোট্ট সম্ভাবনার খড় ধরে সেখানে ভাসছে একটা মানুষের আত্মা। চোখে জল চলে আসে, দাঁতে দাঁত চেপে চায়ের কাপে আবার চুমুক দিই।
এক লক্ষ টাকা দিতে পারবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল। নিশাত শাকের, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক, ফুসফুসের পেছনে মেরুদণ্ডের কাছে নীরব আততায়ী ক্যান্সার নিয়ে মারা যাচ্ছেন, তার জন্যে দেশের সরকার এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে পারেন। আর সিঙ্গাপুরে নিয়ে চিকিৎসা করতে গেলে চল্লিশ লক্ষের মতো টাকা লাগবে।
আমি মুখ খোলার পর টের পাই, কোনো শব্দ হচ্ছে না মুখে, আবার এক চুমুক চা খেয়ে বলি, "এক লক্ষ টাকা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।"
মহুয়া ভাবী কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ করেন, শাকের ভাই একটা হেঁচকি তুলে সরু গলায় হাসেন শুধু।
আমি বলি, "রিয়াজের কানেকশন অনেক ভালো শাকের ভাই। আর আমরা তো আছি। পরিচিতদের মধ্যে থেকে দেখছি কী পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়। আর ঈদের পর কনসার্টটা হয়ে গেলে বেশ কিছু টাকা উঠে আসবে ...।"
টের পাই, নিজের কানেই কেমন খাপছাড়া শোনাচ্ছে আমার কথাগুলো। শাকের ভাইয়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহসই পাই না, অভিকর্ষ আমার দৃষ্টি দ্বিগুণ জোরে টেনে ধরে।
শাকের ভাই ভাঙা গলায় হাসতে হাসতে বলেন, "আমাকে কে চেনে মারুফ? কনসার্টে গিয়ে যারা গান শুনবে, তারা আমাকে চেনে না তো। আমি একটা তুচ্ছ লেখক, আমি গল্প লিখি, উপন্যাস লিখি, আমার নামও জানে না অনেকে। আমার গল্পগুলো ওদের নিয়েই, কিন্তু ওরা তো সেগুলোর কথা জানে না। ওরা ঐসব কনসার্টে যাবে না মারুফ। তোমরা খামোকা আর দৌড়াদৌড়ি কোরো না।"
আমি আরেকটা পকোড়া তুলে নিয়ে কামড় দিই, মহুয়া ভাবী ধরা গলায় বলেন, "এক লাখ টাকা দিবে সরকার? এত টাকা চারিদিকে, কত কোটি কোটি টাকার খবর পড়ি কাগজে, আর ওর জন্য মাত্র এক লাখ টাকা দিবে? ও কি ফকির?"
আমি চুপ করে থাকি, মহুয়া ভাবী হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন। "ও কি ফকির? ও কি ভিখারি? ও কি রাস্তার কুকুর? আমার সারাটা জীবন ধরে শুনে আসলাম ও সাহিত্য করে, ও দেশের গুণীজন, সম্বর্ধনা পায়, বিশেষ অতিথি হয়, মানপত্র পায়, আর এখন লোকটা মরে যাচ্ছে ক্যান্সারে, তোমরা ওকে এক লাখ টাকা লিল্লাহ দিবা? ও কি মিসকিন? ও একটা মানুষ না? ও কিছু করে নাই তোমাদের জন্য? আমার সারাটা জীবন ধরে খালি শুনে আসলাম, টাকাপয়সা দিয়ে কী হবে, সুনামটাই বড়, সম্মানটাই বড়! কোনো কিছুর লোভ করলাম না, কোনো আনন্দ করলাম না জীবনে, সাহিত্যিকের সংসার করলাম মুখ বন্ধ করে, তোমরা এই সুনাম দিলা ওকে? এই সম্মান দিলা? এক লাখ টাকা ভিক্ষা দিবা?"
চামারের মতো পকোড়া খেয়ে যাই, টের পাই, একটা কিছু চিবিয়ে চললে চোখে পানি আসে না। শাকের ভাই সরু গলায় ধমক দেন, "থামো মহুয়া, থামো। থামো সোনা! এখন থামো।"
মহুয়া ভাবী হুহু করে কাঁদেন, নিজের দুই হাতে মুখ ঢেকে তার ভেতরে ভেঙে গলে পড়তে থাকেন।
আমি শাকের ভাইকে নিচু গলায় বলি, "শাকের ভাই, আমরা পত্রিকা থেকে সরাসরি একটা অ্যাকাউন্ট খুলে লোকজনকে ডাক দিচ্ছি। কালকেই যাবে নিউজটা। শেষের পাতায় যাবে, তিন কলাম দুই ইঞ্চি। কত পাঠক আপনার, কত মানুষ চেনে আপনাকে ... তারা আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। ঠিকই দাঁড়াবে। মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখেন। আমি বলছি, আমরা হাল ছাড়বো না।"
শাকের ভাই উঠে বসে মহুয়া ভাবীর মাথায় হাত রাখেন। "মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখার বিলাসিতা আমার আর নাই মারুফ। আমার তো ব্যাংকক যাওয়ার পয়সা যোগাড় করতেই বেলুন ফুটো হয়ে গেলো। আমার বন্ধুরাই সবাই ঠিকমত পাশে দাঁড়ালো না, পাঠক এসে দাঁড়াবে? তোমাদের ঐ অ্যাকাউন্টে ছাতা পড়ে যাবে শুধু।"
মহুয়া ভাবী অস্ফূট শব্দ করে কাঁদেন, ক্রমশ তাঁর কান্না আস্তে আস্তে শব্দ পায়। শাকের ভাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে অনুনয় করেন, "কাঁদে না সোনা। এইভাবে কাঁদলে হবে? কত সমস্যা সামনে ... শক্ত হও। শক্ত হও?"
চুপচাপ চা খাই। শাকের ভাইয়ের দেয়ালে কালো ঘড়ির ওপর রুগ্ন কাঁটাগুলো ঘুরতে থাকে, পলেস্টীয় মন্দিরে ঘানির সাথে বাঁধা শিমশোনের মত। মনে হয় একটু পর ঐ হাতগুলো বেরিয়ে এসে এই গোটা ঘরের দৃশ্যটাকে টেনে চুরমার করে নামিয়ে আনবে মেঝেতে।
শাকের ভাইয়ের মিথ্যা সান্ত্বনায় মহুয়া ভাবীর কান্নাটা আস্তে আস্তে ফিকে হয় আসে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে শুনতে পাই শাকের ভাইয়ের ডাক। "মারুফ?"
আমি ত্রস্ত হয়ে বলি, "বস?"
শাকের ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, "আমি কি মারা যাচ্ছি মারুফ?"
শাকের ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা অন্ধ কূপ দেখতে পাই, মনে হয় তার গভীরে বসে তিনি একটা হাত বাড়িয়ে রেখেছেন আমার দিকে, আমাদের দিকে। সেই কূপের ভেতরে বসা শাকের ভাই আবারও বলেন, "আমি কি মরে যাবো মারুফ?"
আমি মাথা নাড়ি, কিন্তু মনের ভেতরে আরেকটা আমি বলে, হ্যাঁ শাকের ভাই! আমরা পারবো না আপনাকে বাঁচাতে। আপনার উচিত হয়নি এই দেশের সাহিত্যিক হওয়া। এখানে কেউ কাউকে টেনে তুলবে না শাকের ভাই। আপনি কেন লেখক হলেন? কেন ঠিকাদারি করলেন না? কেন কাস্টমসে চাকরি নিলেন না? কেন থানার দারোগা হলেন না? কেন জাহাজ ভাঙার ব্যবসা খুললেন না? কী বালটা পেলেন আপনি লেখক হয়ে? এই দেশে তো কেউ বইও পড়ে না। আপনি মরে যান নিশাত শাকের, আমরা আপনার লাশটা কবর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ শহীদ মিনারে রাখবো, সেখানে সর্বস্তরের মানুষ আসবে আপনাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। আপনাকে কবর দিয়ে অফিস ক্যালেণ্ডারে একটা তারিখ দাগিয়ে রাখবো, প্রথম কয়েক বছর আমার ক্যামেরায় তোলা আপনার কয়েকটা সাদা কালো ছবি বড় করে ছাপিয়ে সাহিত্য সাময়িকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলির লেখা ছাপাবো চার কলামে। সেখানে লিখবো, শিল্পীসাহিত্যিকদের বিপদে আপদে কাজে লাগানোর জন্য একটা তহবিল গঠন করা উচিত সরকারের, সময়োচিত পদক্ষেপ নিলে হয়তো নিশাত শাকেরের বহুপ্রজ কলম অকালে থেমে যেতো না। ওগুলো যাতে লিখতে পারি, সে সুযোগ করে দিয়ে আপনি চুপচাপ কাউকে আর জ্বালাতন না করে মরে যান শাকের ভাই। আপনি একটা দম দেয়া লাশ এখন। মরে যান।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকরে বলি, "বস, আপনি বিশ্রাম করেন। আবার আসবো আমি। চিন্তা করবেন না।"
শাকের ভাই ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন কেবল, মহুয়া ভাবীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অন্যমনস্ক ভাঙা গলায় বলেন, "আচ্ছা, এসো।"
আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি, হয়তো প্রয়োজনের চেয়ে একটু দ্রুত বেগে। মহুয়া ভাবী আমার পেছন পেছন আসেন নাক টানতে টানতে, আমি দরজা খুলে বেরিয়ে আসি, পেছনে তিনি ছিটকিনি টেনে দেন। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি দরজার সামনে, শুনতে পাই, ভেতরে ভাবী আবার কাঁদছেন, সেই কান্নার সাথে গুনগুন করে তাঁর ভেতর থেকে শব্দ আর কথা বেরিয়ে আসছে। কী বলছেন, সেটা শুনতে দেয় না দরজার কপাট।
বেরিয়ে আসি শাকের ভাইয়ের নূরজাহান রোডের ছোট্ট বাসাটা ছেড়ে। পরশু ঈদ, ছোটো বড় নানা মাপের গরু-খাসিতে গমগম করছে মোহাম্মদপুর এলাকা, একটু পর পর রাস্তার ওপরই ছোট্টো জটলা। লোকজনের গ্যারেজ থেকে মাঝে মধ্যে গম্ভীর হাঁক দিচ্ছে একাধিক গরু, আরো গরুর গলার দড়ি ধরে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে বাড়ি ফিরছে শ্রান্ত কিন্তু উৎফুল্ল মানুষ। কে একজন জিজ্ঞেস করে, "ভাই কত নিলো?" আরেকটা কণ্ঠস্বর জবাব দেয়, "ষাইট হাজার!" পাশ দিয়ে চলতে চলতে নিচু স্বরে একজন বলে, "ঠকছে রে ঠকছে!"
কয়েক হাজার বছর আগে, ইবরাহিমের ছুরির নিচে একটা ভেড়া পাঠিয়েছিলেন ঈশ্বর।
মন্তব্য
শেষ লাইনেই আসল গল্প!
EDIT: শেষ লাইন না বলে শেষ প্যারা বলা ভালো।
কী অদ্ভুত সুন্দর উপমার ব্যবহার করেছেন এই গল্পটায়। এক কথায় অসাধারণ। শেষ লাইন পড়ে আমার প্রিয় ছোটগল্পকার ও'হেনরীর কথা মনে পড়লো। এ গল্প তিনি পড়লেও অকৃপণ ভাবে প্রশংসা করতেন।
টুইটার
অস্থিবিব্রত, শনাক্তযাত্রা...... অসাধারণ সব শব্দচয়ন!
কি মলিন অনুভূতির একটা গল্প, অথচ শব্দ আর উপমার অলংকারে জ্বলজ্বল করছে।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
অসাধারণ, সিম্পলি !
----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!
চোখে পানি এসে গেল ...অদ্ভুত সুন্দর লিখেছেন।
খুবই চমৎকার।
খুব ভাল লাগল হিমু ভাই। কদিন আগে এক জনকে জিজ্ঞেস করলাম, হজ্জ্ব এ না গিয়ে ৬লাখ টাকায় (আমেরিকা থেকে হজ্জ্ব এ যেতে প্রায় এ পরিমাণ টাকা লাগে) ওনার গ্রামের বাড়ির অনেক কয়টা গরীব পরিবারকে উপার্জনক্ষম করলে কি সোয়াব বেশী হবে না কম? নাকি হজ্জ্ব না করার গুণাহ হবে? কেউ উত্তর দেয়নাই।
কিছুদিন ফেসবুকে অসংখ্য নেকা নেকা পোস্টের মাঝে একটা পোস্টে এরকম একটা গল্প দেখলাম। সবাইকে বলে কয়ে হজ্ব যাত্রার বিদায় নিয়ে আসলে রংপুরে মঙ্গাক্রান্ত এলাকায় খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়া নিয়ে কাহিনী। কিন্তু সেটা শুধুই গল্প। আসলে কখনো কি হয়?
আম্মাকে বললাম আমার কোরবানীর টাকা দিয়ে কাউকে উপার্জনক্ষম করতে সাহায্য করতে, কিন্তু সেরকম লোক খুঁজে পাওয়া নাকি ঝামেলা। দান করলে সবাই সেই টাকা আগে খেয়ে বসে থাকে।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
এইটা সমস্যা হাতে কাঁচা টাকা আসলে অনেকেই সেটা কাজে না লাগিয়ে, খরচ করে ফেলে। এ কারণে, নিজেরাই শেলাই মেশিন জাতীয় টুল কিনে দেওয়া যেতে পারে বা ভকেশনাল ট্রেনিং এ ভর্তি করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ট্রেনিং শেষ হলে একি কায়দায় মূলধনের ব্যবস্থা করা হবে।
গল্প্টার কথা ইন্টারেস্টিং লাগলো, লিঙ্ক পারলে শেয়ার করেন এখানে।
একটু আধটু না, ভয়াবহ সুন্দর লেখা।
খুব ভাল লেগেছে লেখাটা। বাস্তবতা এরকমই।
আসলেই অসাধারন
অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনা। চোখে পানি এসে গেল।
_________________
[খোমাখাতা]
সাধারণ প্লটে বর্ণনা আর লেখনীর গুনে অসাধারণ
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
গল্পটা সুন্দর। তার শেষ বাক্যটা সুন্দরতম...
তবু মনে হচ্ছে, হিমু ভাই চাইলে হতাশাটাকে আরো তীব্র- বিষাদটাকে আরো অনেক দীর্ঘস্থায়ী করতে পারতেন।
চমৎকার!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
শেষ লাইনটাই পুরো গল্প। অসাধারণ।
প্রশংসা করব না। তাতে ভালো লাগার পরশটুকু কমে যাবে। এই অনুভূতি থাক আমার জন্য হিমু ভাই।
মুগ্ধকর একটা গল্প পড়লাম; অত্যন্ত সাহিত্য মূল্য সমৃদ্ধ।
_____________________
Give Her Freedom!
অসাধারণ সমাপ্তি। কবিগুরুর ভাষায়, "শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ।" গল্পের শেষ হলেও মনের ভিতর অনুরণন চলমান।
যদিও অনেকেই বলে ফেলেছেন ... তবুও আবার বলি - অসাধারন ...
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
খুব সুন্দর লেখাটা
ক্যামনে পারেন?
ছাগু পুন্দাইতে পুন্দাইতে এত সুন্দর গল্প লিখতে!! কোনো ছাগুর সাথে দুটো কথা বললেই তো মনটা এমন বিষিয়ে যায়, পরের দুইদিন কোনো সুকুমারবৃত্তি কাছে ঘেষার থই পায় না আমার।
এ গল্পটা পুরাতন বাড়িকেও ছাড়িয়ে গেছে মনে হচ্ছে। এমন উপন্যাস চাই।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
অসাধারণ। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
মনে গল্পের রেশ থেকে যাবে বহুদিন।
সাধারণত খটমটত্বের কারণে হিমুর লেখা এড়িয়ে চলি
কিন্তু এই গল্পটা পড়ে গ্রামীণের চুতিয়া কানেকশনে প্রায় আধঘণ্টা ট্রাই করে লগইন করতে বাধ্য হলাম শুধু এটুকু বলার জন্য যে বহু বহুদিন এরকম গল্প পড়িনি
দ্রোহী, নিয়াজ, বাবুবাংলা, রাজিব, রাসেল, দায়ীন, সাফি, রু, অরিত্র, রিডার, নিটোল, ত্রিমাত্রিক, সুহান, তিথীডোর, কল্যাণ, ঝুমন, তাপস, ঈষৎ, ইমন, অনুপম, ন, স্পর্শ, শমশের, সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
গল্পটা পড়ে শেষ করলাম। অসাধারণ একটা গল্প। জানিন এর রেশ মন থেকে কখন যাবে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
লেখাটা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই পড়েছি। কম্পিউটারে অভ্র ছিল না দেখে মন্তব্য করি নি। অসাধারণ একটা গল্প, এর রেশ থাকবে বহু দিন।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অসাধারণ হইছে।শেষ লাইনে কাপাইয়া দিছেন পুরা।
হুমম...
কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিনা ...
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
উপমার ব্যবহার, টুইস্ট এগুলো ভালো হইছে। কিন্তু স্ট্রাকচারটার একটা খামতি থেকে গেছে মনে হচ্ছে। গরু কেনার টাকার সাথে লেখককে উপকার করতে চাইবার সংযোগটা স্ট্রং মনে হয়নি। একারনে টুইস্টটা অতটা শকিং মনে হয়নি।
ফ্রেট্যাগের পিরামিড দিয়ে বললে বোঝাতে সুবিধা হতে পারে। গল্পে অনেকখানি রাইসিং অ্যাকশন ছিলো। কিন্তু ক্লাইমেক্স খুবই ভেইগ এবং ক্ষণস্থায়ী।
ইন্টারেস্টিং! ফলিং অ্যাকশন আর ডিন্যুমেন্ট অবশ্য এখানে পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়াটাই শ্রেয় মনে হয়েছে। এবারের বইমেলায় আরেকটা বই বের করবো, সেখানে এ গল্পটার পুনর্লিখিত সংস্করণ থাকবে।
আমি চেয়েছি, পাঠক কয়েকটা প্রশ্ন করুন নিজেকে। ইবরাহিমের ছুরি এখানে কোথায়, ভেড়া কে বা কারা, আর কয়েক হাজার বছর আগে পাঠানো একটা ভেড়ার ভূমিকা কি এখন অনেকে পালন করছে কি না। ইবরাহিমের মিথটার আরেকটা দিক হচ্ছে ঈশ্বরনির্দেশিত প্রায়োরিটি, তার সামনে আমাদের এই জীবনের প্রায়োরিটিগুলো মলিন হয়ে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটাও একটা মাত্র বাক্যে পাঠকের মনে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। শুধু গরু কেনার টাকার প্রসঙ্গই নয়, গুণীজনের পাশে রাষ্ট্র যে হাস্যকর আর অপমানকর ভূমিকা নিয়ে এসে দাঁড়ায় (অথবা দাঁড়ায়ও না), সেটা বোধ হয় পরিষ্কার হয়নি। একটু ঘষামাজা করতে হবে প্রকাশের আগে।
মুর্শেদের মন্তব্যের সাথে সহমত। পড়েছি একদম শুরুতেই, এই মন্তব্যের মত একটা কিছু লিখতে চেয়ে ভাষাটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই লেখা হয় নি। পুরো গল্পটা ঘষামাজার দরকার নেই বোধহয়, শেষ লাইনটার আগে পুরো গল্পটাই অনেক ইনভল্ভ করে রেখেছিলো আমাকে, মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়েছি। তবে মনে হয় শেষ লাইনটাতে আম পাঠককে আরেকটু সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
সুযোগ? কীসের সুযোগ? কোথায় ছিলো সুযোগের কথা যখন ঐ চৌধুরী আমার গ্যারেজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো? কোথায় ছিলো সুযোগ যখন ঐ চৌধুরী আমার ক্যারামবোর্ডের গুটি চুরি করেছিলো? কোথায় ছিলো সুযোগ যখন ঐ চৌধুরী গার্লস স্কুলের সামনে চায়ের দোকান উচ্ছেদ করেছিলো? কোথায় ছিলো সুযোগ ...
অন এ সেকেণ্ড থট, থাক সুযোগ দেওনের কাম নাই। যেমনে আছে থাকুক!
আমাদের হাতেই ছুরি, আবার ভেড়াও আমরাই। নিজেরাই নিজেদের গলায় ছুরি চালাচ্ছি, নিজেদের কোরবানি দিচ্ছি। এক হিসাবে ঠিকই আছে - নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে ত্যাগ বা উৎসর্গ করতে বলা হয়েছে না? তাইতো করছি -- নিজের জীবন ও মনুষ্যত্ব (থুক্কু - ভেড়াত্বকে) কোরবানি দিচ্ছিই তো !
এটাই স্বাভাবিক, যদি প্রায়োরিটি মিসপ্লেস্ড হয়ে যায়। যদি ইহজীবন আর তার বাস্তব ও সুস্থ-স্বাভাবিক জৈবিক-নৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক রিকোয়ারমেন্ট বা দাবিদাওয়া থেকে পরজীবন আর তার তাত্ত্বিক প্রায়োরিটি অনেক বেশি জোরালো বা বড় হয়ে যায়, বিশেষ করে যদি সেটা এক্সক্লুসিভ বা জিরো-সাম হয়ে পড়ে। কোরবানির মূল শিক্ষাটা মনে হয় এখানেই। কোরবানিতে এই প্রায়োরিটির পরীক্ষাই নেওয়া হয়। ইব্রাহিম এই পরীক্ষা সরাসরি দিয়েছিলেন, আমরা সেটা একটু ঘুরপথে দেই - নিজের সন্তানের বদলে অন্য মানবসন্তানকে এবং সামগ্রিক ভাবে ইহজীবনের সামগ্রিক কল্যান, সৌন্দর্য ও বাস্তবতাকে আমাদের উপেক্ষার বলি হিসেবে নিবেদন করে।
পরকালটাই আসল জীবন - অসীম ও অনন্ত - সেই তুলনায় এই জীবন নেহাতই একটা চোখের পলক পড়ার সমান ইলিউসরি ট্রাঞ্জিশনাল পিরিয়ড, একটা মিথ্যা মায়া বা মোহ। খুব বেশি হলে, একটা 'পরীক্ষা' মাত্র। কিন্তু যেকোন 'পরীক্ষা'-ও তো আসলে রেজাল্ট-অভিমূখী একরকম ক্ষণিকের টাঞ্জিশন, হাইপোথেটিকাল মোহমাত্র - সত্যিকার অর্থে যাপনীয় বা যাপনযোগ্য কোন অবস্থা নয়। তাহলে সেই আসল তত্ত্ব, ক্ষনিকের ট্রাঞ্জিশনের চূড়ান্ত 'রেজাল্ট' - সেই প্রকৃত যাপিতব্য, স্থায়ী ও অনন্ত জীবন ও বাস্তবতাকে ফেলে মানুষ কেন ইহজীবন নামক একটা অনিত্য, পরাবাস্তব, মোহময় মুহূর্তমাত্রের পিছনে তার আবেগ-নীতি-বিবেককে ইনভেস্ট করবে? এজন্যেই নিত্য পারলৌকিক ঈশ্বরের কাছ থেকে অনন্ত জীবনের প্রলোভনের মুখে, ইব্রাহিমের কাছে ইহজীবনের রক্তমাংসের আপন সন্তানও তুলনায় অবাস্তব আর মূল্যহীন হয়ে যায়।
এখন চার হাজার বছর আগে ইব্রাহিম নিজের পছন্দ মত নিজের প্রায়োরিটি ও বাস্তবতার সংজ্ঞা ঠিক করে নিয়েছিলেন। চার হাজার বছর পরে একবিংশ শতাব্দীর মানুষকেও তাই করতে হবে - নিজের প্রায়োরিটি ও বাস্তবতার সংজ্ঞা ঠিক করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ইব্রাহিমকে ফলো করলে, তারা ঐরকমই হবে - তার চেয়ে খুব বেশি কিছু নয়, তা যতই কম্পিউটার-মোবাইল-গাড়ি-প্লেন দৌড়াক না কেন। আপনার গল্পে সেই প্রায়োরিটি ও বাস্তবতা-বোধেরই একটা সামাজিক চিত্র দেখতে পাচ্ছি আমি। অর্ধ-সহস্রাব্দ আগে ইউরোপে এই প্রায়োরিটি আর বাস্তবতা-বোধ ও সংজ্ঞা বদলাতে শুরু করে। ইউরোপিয় রেনেসাঁর অন্যতম মূল কথা বোধহয় এটাই ছিল। আমাদের চিত্রটা বদলাতে হলে, আমাদেরও মনে হয় ঐরকম একটা রেনেসাঁ লাগবে।
তবে আমার ধারনা, বৃহৎ স্কেলে এই বদলটা একটু কঠিনই হবে, কারন মনোবিজ্ঞানী জুলিয়ান জেইন্স কথিত ইব্রাহিমের যুগের মস্তিষ্কের প্রাচীন বাইক্যামেরাল মানসিকতা থেকে আধুনিক সাব্জেক্টিভ আত্নচেতনা বা মেটাকনশাসনেসে আমাদের (বিশেষত বাঙালি মুসলমানের) ট্রাঞ্জিশনটা এখনো ঠিকমত সম্পন্ন হয়নি বোধহয়। অন্তত প্রাগৈতিহাসিক প্রভাব বা তার রেশটা রয়েই গেছে।
দারুন গল্প ! আপনার কথা মত অনেক প্রশ্নই করে ফেললাম।
****************************************
আপনার সেরাগুলোর একটা হিমুভাই।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
লীলেন্দা, রাতঃস্মরণীয়, তাসনীম ভাই, বাবু আহমেদ, কামরুল হাসান, অরফিয়াস, ময়ূখ, মুর্শেদ, সঙ্গীত, সিমন, আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ!
পাঠককে সুযোগ দেয়াটাই ভালো হয়েছে। লেখক একটাই রাস্তা ডিরেক্ট করে দিলে কী লাভ? এইই ভালো হয়েছে।
স্তব্ধ করিয়ে দেওয়া, লেখাটা।
অসাধারণ!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
আচকমা শেষ হওয়া লাইনটাই গল্পটার মূল শক্তির জায়গা মনে হলো।
দারুন হিমুভাই...
ও কি ফকির, রাস্তার ভিখারি...
ও ফকির না, ফকির আমরা আমাদের বিবেক...
দারুন লাগল হিমু ভাই।
অটঃ হিমু ভাই একটা বাংলা টু বাংলা অভিধানের নাম সাজেস্ট করবেন?
এমনিতে গল্পটা অসাধারণ, কিন্তু লেখক হিমু বলেই প্রত্যাশা আরেকটু বেড়ে যায়|| আমিও মুর্শেদের সাথে একমত| শেষদিকটায় আর অল্প একটু বিস্তৃতি দরকার ছিল|
তা আপনি তো নিয়মিতই লিখছেন, তারমানে শরীর স্বাস্থ্য ভালই আছে নিশ্চয়|
আচ্ছা তাহলে চন্ডীশিরা?
আচ্ছা তাহলে চন্ডীশিরা চন্ডীশিরা??
আচ্ছা তাহলে চন্ডীশিরা চন্ডীশিরা চন্ডীশিরা???
.........
.........
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
প্রশ্নটা আমারও ... চন্ডীশিরা এর কি হলো???? জানতে মন চায় ..
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
গালফোলা কাঁদ কেন, দাঁতে বুঝি বেদনা ?
আপনার বইয়ের অপেক্ষায় থাকবো এই গল্পটির পরিবর্ধিত সংস্করণ পড়ার জন্য।
গল্পটা দারুণ। তবে শেষ অংশটা নিয়ে মুর্শেদভাইয়ের চমৎকার বক্তব্যের সাথে সহমত।
দুর্দান্ত একটা গল্প। উপমা, বর্ণনা পড়তে গিয়ে গায়ে কাঁটা দেয় রীতিমতো। শেষ লাইন দুটো নিয়ে কি আরেকটু ভাবা যায়? এমন কিছু যেন পুরো গল্পে যে ভয়ঙ্কর হতাশা ফুটে উঠেছে সেটা যেন শেষ কয়েক লাইনে পাঠকের মাঝে আর ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায়।
যুধিষ্ঠির, অন্যকেউ, রোমেল চৌধুরী, অন্যকেউ মঈনুল, দ্রোহ, সপ্তর্ষি, দময়ন্তী, অরফিয়াস, তানিম এহসান, কৌস্তুভ, চরম উদাস, আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ!
বহুকাল, বহুকাল পর এত ভালো ছোটগল্প পড়লাম।
চালিয়ে যান।
যারা কুরবানী দেন নাই তারা কত টাকা দান করেছেন ঝাতি জানতে চায়।
অতিথি
যারা কুরবানি দিয়েছেন তারা সকলে হালাল রোজগারে দিয়েছেন কি না তাও ঝাতি জানতে চায় গো ভাইডি।
হক কথা।
অতিথি।
কোন ঝাতি গো, মনুষ্য না বলদ না ছাগল ঝাতি?
চমৎকার, এক কথায় অসাধারণ
কিছু কিছু কথা মনে এত দাগ কাটে।
facebook
মনমাঝি, নৈষাদ, নুপূরকান্তি, স্বাধীন, তারেক অণু, অনেক ধন্যবাদ!
অসাধারণ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
চোখ ভিজে গেল লেখাটা পড়ে।
অসাধারণ।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
মানুষকে বাঁচানোর জন্য টাকা নাই এই দেশের মানুষের। কিন্তু কোরবানীর জন্য টাকার অভাব হয় না। টাকা না থাকলে ধার করে কোরবানী দিতে হয়। নাহলে সমাজে মুখ থাকে না!!!
প্রতি নিয়ত এই অবস্থার সাথে বেঁচে আছি। খুব কষ্ট দিলো লেখাটা।
অসাধারণ হিমু ভাই।
চমেস্কু... অতি চমেস্কু
নতুন মন্তব্য করুন