বইকে ঘাসপাতার সাথে তুলনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু বইয়ের পৃথিবীর একটা মডেল যদি আমরা করি, তার সাথে ঘাসপাতার মডেলের অনেক সাদৃশ্য থাকবে।
পাঠকদের ঘাসপাতাখোর ডাকার স্পর্ধা আমার নাই। কিন্তু মডেলের দুনিয়ায় বইখোর আর ঘাসপাতাখোরের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
একটু ভেবে দেখি আসুন। পৃথিবীতে পুরোপুরি বা আংশিক তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা অনেক, এবং জীবজগতের বিচিত্র সব "নিশ" তারা দখল করে রেখেছে। গরু আর জেব্রা ঘাস খায়, টাপির আর জিরাফ পাতা খায়, বাঁদর পাতা আর ফল খায়, জলহস্তী পানির নিচের শ্যাওলা থেকে শুরু করে ঘাসপাতা সব খায়, হাতি ঘাস পাতা ছালবাকল সব খেয়ে ফেলে, শামুক শ্যাওলা খায়, ডুগং সামুদ্রিক ঘাস খায়, মাজরা পোকা ধানপাতা খায়, পাণ্ডা শুধু বাঁশ খায়। তেমনি কিছু পাঠক একটু সহজপাচ্য বই পড়েন, কিছু পাঠক অতি উঁচু দরের বই পড়েন, কিছু পাঠক চটি পড়েন, কিছু পাঠক শুধু স্কুলপাঠ্য বই পড়েন, কিছু পাঠক সবই পড়েন।
আবার ধরুন, কোথাও যদি প্রচুর ঘাস থাকে, আর পাতা থাকে নাগালের বাইরে, সেখানে ঘাসখোরের প্রাচুর্য থাকবে, আর পাতাখোরেরা মারা পড়বে। যে শুধু শ্যাওলা খায়, সে ঘাস বা পাতার কদর করবে না। পাণ্ডাকে মেরেধরেও বাঁশ ভিন্ন অপর কিছু খাওয়ানো যায় না। পাতা দিয়ে দুনিয়া সয়লাব করে লাভ নেই যদি দুনিয়া বোঝাই শুধু ঘাসখোর থাকে।
পাঠকের বিভিন্ন পাঠরুচির একটা মডেল বোঝাতে গিয়েই এসব বললাম, কেউ নিজেকে ঘাসখোর বা বাঁশখোর ভেবে মনক্ষুণ্ণ হবেন না। ঘাস হোক আর বাঁশ, পুষ্টি না থাকলে তো সেসব কেউ খায় না। সব বইতেই কিছু না কিছু পুষ্টি আছে, মকসুদুল মুমিন থেকে শুরু করে ইউলিসিস।
যদি হুট করে ঘাসবনে ঘাসের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়, তাহলে কী হতে পারে, আসুন এবার ভেবে দেখি। ঘাসখোরের সংখ্যা স্থির থাকলে মাথাপিছু দ্বিগুণ ঘাস খাওয়ার একটা উপায় হয়। অথবা যেসব ঘাসখোর আগে ঘাসবনের কাছে ঘেঁষতে পারতো না, তারাও গুটি গুটি পায়ে এসে দুই গাল খেয়ে যেতে পারবে।
একইভাবে, বইয়ের দাম যদি কমিয়ে অর্ধেক করা হয়, আগে যে পাঠক একটা বই কিনতে পারতেন, তিনি কিনতে পারবেন দু'টি।
আমাদের দেশে বইয়ের দাম অনেক। জাফর ইকবাল স্যারকেই উদাহরণ হিসেবে ধরি। একটু আগে একটা ওয়েবসাইটে দেখলাম, মুহম্মদ জাফর ইকবালের কেপলার টুটুবি বইটির মূল্য ২০০ টাকা। মেলায় হয়তো সেটা ১৫০ বা ১৬০ টাকায় বিক্রি হবে। যতদূর মনে পড়ে, জাফর ইকবাল স্যারের বইতে ইলাসট্রেশন থাকে না (পুরনো বইগুলো ব্যতিক্রম, হাত কাটা রবিন বা টি রেক্সের সন্ধানেতে চমৎকার ইলাসট্রেশন ছিলো)। বাংলাদেশে লোকে যদিও মোবাইলে কথা বলে কিংবা সিয়েনজিতে চড়ে এক দফাতেই এরকম টাকা খরচ করে ফেলে, কিন্তু যারা বই কিনে পড়ে, তারা অনেকেই বইয়ের জন্যে অনেক কষ্টেসৃষ্টে একটা বাজেট করে। তাদের কাছে দেড়শো টাকা অনেক টাকা। জাফর ইকবাল স্যারের বই যদি চাররঙা হতো, বা রঙিন ইলাসট্রেশন থাকতো, তাহলে এমন একটা দামের পেছনে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেতো। কিন্তু বিনা অলঙ্করণে বা সাদাকালো অলঙ্করণে এই বইগুলো এতো দাম দিয়ে কেন বিক্রি হয়?
উত্তরটা আমাদের জানা। স্যারের বই ছাপা হয় বেশ উন্নতমানের ঝকঝকে মোটা অফসেট কাগজে। অফসেট কাগজ বেশ দামী জিনিস, বইমেলার সিজন কাছে চলে এলে এর দাম স্বাভাবিকের চেয়ে আরো বাড়ে। অফসেটের বদলে নিউজপ্রিন্টে ছাপালে, হার্ডকাভারের বদলে পেপারব্যাক করলে অনেক কম দাম পড়তো। নিচে প্রেস থেকে গতকাল সংগ্রহ করা কাগজের মূল্য একটা স্তম্ভলেখে দেখালাম, তুলনা করে দেখুন।
জার্মানিতে লোকে প্রচুর বই পড়ে। বাসে বা ট্রেনে চড়ে অনেক লোক, তাদের অনেকেই একটা বই খুলে বসে। এখন অবশ্য নেটবুক খুলে সিনেমাও দ্যাখে অনেকে, কিন্তু বই পড়ুয়াদের সংখ্যা কম নয়। জার্মানিতে বইয়ের দাম খুব কম নয়, স্টেশনের স্টল থেকে কিনলে বেস্ট সেলারগুলো আট থেকে পনেরো ইউরোর মধ্যে পড়ে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেনজায় তিন থেকে চার দিন দুপুরের খাবার আর কফির দামের সমান, সে হিসেবে খুব বেশিও নয়। হার্ডকাভার বই লোকে চলার পথে সঙ্গে রাখে না, সেগুলো অবধারিত ভাবেই রেফারেন্স বই। এই বইগুলো সবই পেপারব্যাক, এবং হ্যাঁ, নিউজপ্রিন্টে ছাপা।
আমাদের দেশে এক বসায় শেষ করে ফেলার মতো ৮০ থেকে ১২৮ পাতার বইগুলো কেন আমরা এতো প্রকাণ্ড খরুচে অফসেট কাগজ আর হার্ডকাভারে করি? কেন এতো দামী বানিয়ে ফেলি বইগুলোকে?
আমি কয়েকজন প্রকাশকের সাথে কথা বলে দেখেছি এ ব্যাপারে। একজন জানিয়েছেন, তাঁর প্রেসটি নিউজপ্রিন্টের মতো বাজে কাগজ নিয়ে ডিল করতে পারে না, জাম হয়ে যায়, ধুলা জমে, ইত্যাদি। আরেকজন বলেছেন, নিউজপ্রিন্টে ছাপা বইকে পাঠক কদর করে না। তাছাড়া পেপারব্যাকের প্রতি নাকি একটা সামগ্রিক তাচ্ছিল্য তৈরি হয়ে গেছে দেশের পাঠক সমাজে। দামী অফসেট কাগজে টাইটেনিয়ামকে লজ্জা দেয়ার মতো হার্ডকাভারে না ছাপলে সেই বই লোকে ছুঁয়েও দেখবে না। দামের প্রসঙ্গ উঠলে প্রকাশকরা বলেছেন, বইমেলাতে যাদের বই সবচেয়ে বেশি চলে, সেই হুমায়ূন আহমেদ জাফর ইকবালদের বইয়ের দাম কোনো সমস্যা না, পাঠক তাদের বই কিনবেই। ভাত বা পানির মতো অনেকটা, দাম যতই হোক, লোকে কিনবেই, দরকার হলে অন্য কিছু না কিনে টাকা বাঁচিয়ে এসব কিনবে। একজন বলেছেন, নিউজপ্রিন্টে বই করবো কেন, ওটা তো টিকবেই না, দুইদিনেই ছিঁড়ে শেষ হয়ে যাবে।
শেষ যুক্তিটা দিয়েই শুরু করি। ট্রেনে চড়ে স্লোভাকিয়া যাওয়ার পথে স্টেশন থেকে এগারো ইউরো দিয়ে কেনা ৪৬৪ পাতার টেরি প্র্যাচেটের একটা বই পড়তে পড়তে দীর্ঘ একাকী যাত্রা কাটিয়ে দিয়েছি, বইটা এখনও আমার শেলফে আছে, অক্ষত এবং প্রায় নতুনের মতো কণ্ডিশনে। এ গেলো নিকট অতীতের কথা। দূর অতীতের দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাই আমার বইপাগল বড় ভাই মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে ক্যালেণ্ডারের মোটা কাগজ যত্ন করে কেটে সেটার সাদা দিকটা দিয়ে বইতে মলাট লাগাচ্ছেন, আমি তাঁকে জ্বালাতন করছি একটু পর পর গিয়ে। আহামরি কোনো বই ছিলো না সেগুলো, সেবা প্রকাশনীর বই। বড় ভাইয়া প্রাণান্তকর কষ্ট করে বইগুলো কিনতো, আর সন্তানের মতো যত্ন করে আগলে রাখতো। নিরানব্বুই সালে একবার বাসা পাল্টানোর সময় প্রায় নতুনের মতো রয়ে যাওয়া সেবা প্রকাশনীর ঐ বইগুলোর অনেকগুলো শেলফে রাখার জায়গার অভাবে আমি আর ভাইয়া ঘাড়ে করে নীলক্ষেতে নিয়ে পানির দামে বিক্রি করে দিয়ে এসেছিলাম। আমাদের বাসায় এখনও বুকশেলফের কুলীন বইয়ের পেছনের সারিতে সেবা প্রকাশনীর কিছু নিউজপ্রিন্টের বই রয়ে গেছে, তাতে পোকা ধরেনি, বইগুলো ছেঁড়েনি, জলীয় বাষ্পের কারণে ফেঁপেও যায়নি। যত্ন করলে বই নষ্ট হবে কেন? বাংলাদেশে টেক্সটবুক বোর্ড থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি নিউজপ্রিন্ট বই দেয়া হয় গ্রামের বাচ্চাদের, তারা সেগুলো ব্যবহার করে আবার ফিরিয়ে দেয় স্কুলকে, পরের বছর অন্যের ব্যবহারের জন্যে। কত ঝড়বাদলের মধ্যে তারা ঐ বই বুকে চেপে স্কুলে যায়, কয়টা বই নষ্ট হয়?
আমার কাছে মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবালের বই যাঁরা প্রকাশ করেন, তাঁরা ভালোমতোই জানেন, বহু শিশুকিশোর সারা বছর তাদের টিফিনের পয়সা জমিয়ে এই বইগুলো কেনে। আমি সারাজীবনই বড় ভাইয়ার ঘাড় ভেঙে বই পড়েছি, কিন্তু নিজেও কিছু বই বহু কষ্টে টাকা জমিয়ে কিনেছি। প্রত্যেকদিন রিকশাভাড়া হিসেবে দশ টাকা অ্যালাওয়েন্স পেতাম, সাত বা আটটাকা খরচ হতো, ক্লাস এইটে বৃত্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাকি দুই টাকা ছিলো আমার একমাত্র আয়। ঐ দুই টাকা আমি আইসক্রিম না খেয়ে, চানাচুর না কিনে, চটপটির গাড়ির সামনে শ্বাস বন্ধ করে হেঁটে গিয়ে জমাতাম। সেবা প্রকাশনীর বইগুলোর দাম ছিলো তেরো থেকে আঠারো টাকার মধ্যে, সারা মাস কৃচ্ছ্রতাসাধনের পর একটা বই কিনতে পারতাম। আমার বন্ধুরাও বই কিনতো বলে মাসে একাধিক নতুন বই পড়ার সুযোগ পেতাম, বছরে একবার বড় ভাইয়া ছুটিতে এক ব্যাগভর্তি বই নিয়ে হাজির হওয়ার আগে ওভাবেই আমাকে নতুন বই পড়তে হয়েছে। ভাইয়ার আনা বইগুলোর পেছনেও একই রকম কষ্টকর সঞ্চয়ের গল্প আছে, আমি জানি। সেই বইগুলো ছিলো দামী কাগজে, শক্ত বাঁধাইয়ের, কাজেই ভাইয়াকে আমার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট করতে হতো। ক্লাস নাইনে উঠে বৃত্তির টাকা হাতে পাওয়ার পর সিলেটে একবার বইমেলা হলো, আমি নিজের টাকা দিয়ে কিনেছিলাম টি-রেক্সের সন্ধানে, অনেক দাম দিয়ে। জাফর ইকবাল স্যারের প্রকাশকেরা যদি আমার মতো ক্রেতাদের সাথে কথা বলতেন, তারা হয়তো বইগুলো খামাখা দামী অফসেট-হার্ডকাভারে না ছাপিয়ে পেপারব্যাকই বের করতেন।
জাফর ইকবাল পাথরের ট্যাবলেটে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে খোদাই করে লিখলেও তাঁর পাঠক সেই বই কিনবে। তারপরও কেন তাঁর প্রকাশক ওরকম দামী কাগজে ছাপান বইগুলো? একটা কারণ হতে পারে, তাঁরা লাভের সর্বোচ্চীকরণ করতে চান। তিন ভাগের এক ভাগ দামে বই বিক্রি করে সমান লাভ করতে গেলে তিনগুণ বেশি বই বিক্রি করতে হবে, সেটা করতে গেলে বইমেলার বাইরে যে এগারো মাস, সেই এগারো মাস সারা দেশে সক্রিয় থাকতে হয়। সেটা না করে বইমেলায় যতটুকু লাভ করা যায়, তাঁরা করে নিতে চান। প্রকাশকের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবালের বইয়ের দাম বেশি রাখা হলে অন্য লেখকরা সরাসরি চাপে পড়েন। যে কিশোর কষ্টেসৃষ্টে কিছু টাকা জমিয়েছে, সে জাফর ইকবাল স্যারের বইয়ের পেছনেই সেটা পুরোটা খরচ করে ফেলে বইমেলায়, তার সব বই কেনার পর ঐ কিশোরের হাতে তেমন আর টাকা থাকার কথা নয় যে সে নতুন লেখকের নতুন বই কিনে চেখে দেখবে। তাই বইমেলায় যতই বইয়ের পসরা সাজানো হোক না কেন, সেই মেলায় একেকজন ক্রেতার বাজেট সীমিত, আর সেই সীমিত বাজেটের পুরোটাই ব্যয় হয় দু'তিনজন লেখকের বইয়ের পেছনে। সঞ্চয়ী পাঠক সেই বইগুলো পেপারব্যাকে প্রকাশিত হলে তিনভাগের এক ভাগ দামে কিনতে পারতো, তার বাজেটের টাকা দিয়ে অন্য কিছু বই কিনতে পারতো হয়তো। সেটা আর ঘটে না।
আমি জানি না লেখকরা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামান কি না। জাফর ইকবাল স্যার বাচ্চাদের সামনে উপস্থিত হন নানা কাজে, তিনি বরাবরই তাদের বই পড়তে উৎসাহিত করেন, কাগজে লেখালেখি করে অভিভাবকদের বলেন বাচ্চাদের বই কিনে দিতে। স্যার কি কখনো আমার মতো এক একজন ক্রেতার কথা ভেবে দেখেন, যারা টিফিন না খেয়ে পয়সা জমিয়ে তাঁর বই কিনেছে বা কেনে? কখনও স্যারকে প্রকাশকদের উদ্দেশ্যে বইয়ের দাম কমানোর বা সর্বনিম্নীকরণের আহ্বান জানিয়ে কিছু লিখতে দেখিনি [কারো কাছে লিঙ্ক থাকলে দিয়ে যেতে পারেন, আমি দেখিনি তার মানে এই নয় যে তিনি লেখেননি]। এই ব্যাপারটা নিয়ে তিনি হয়তো আদৌ চিন্তিত নন, কারণ তাঁর একটা আর্থিক স্বার্থও এর সাথে জড়িত।
হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল, দু'জনেই এককালে পেপারব্যাকে লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন "দেবী" আর "নিশীথিনী", জাফর ইকবাল লিখেছিলেন "প্রেত"। যখন অনেক ছোটো ছিলাম, তখন একটা পাতলা নিউজপ্রিন্টে ছাপা প্রায়চটিবই পেপারব্যাক আমার খুব প্রিয় ছিলো, সেটার নাম কপোট্রনিক সুখদুঃখ, সম্ভবত একটাই এডিশন ছিলো সেটার, জাফর ইকবাল স্যারের প্রথম বই।
প্রকাশকদের কাছে অনুরোধ, আপনারা নিউজপ্রিন্টে বই ছাপান। ইয়োরোপের প্রকাশকরা যদি টমাস মান থেকে শুরু করে জে কে রাউলিঙের বই পেপারব্যাকে ছাপতে পারে, আপনারা কেন পারবেন না? নতুন লেখকদের কাছে অনুরোধ, আপনারাও প্রকাশকদের যতটুকু পারা যায় চাপ দিন।
আর জাফর ইকবাল স্যারের কাছে অনুরোধ, আপনি সামনে একটা বই পেপারব্যাকে প্রকাশ করুন। অনেক লেখক-প্রকাশক চাইলেও যে ব্যাপারটা ঘটবে না, আপনি ইচ্ছা করলে সেটা ঘটতে পারে, কমদামে অনেকের কাছে বই পৌঁছে যাওয়ার ঘটনাটা আবার ঘটতে শুরু করতে পারে। নানা অজুহাতে লেখক-প্রকাশক যে চক্রে পাঠককে বন্দী করে এনেছেন, সেটা থেকে বেরিয়ে কম দামে আরো বেশি মানুষের কাছে আরো বেশি বই পৌঁছে যেতে পারে তখন। স্কুল ছুটির পর যে ছেলেটা আইসক্রিম-চটপটি-চানাচুরের প্রলোভন এড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে স্কুলগেটের কাছটা ছুটে পার হয়, সে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দেবে। আমি জানি না এর মূল্য আপনার কাছে আছে কি না, কিন্তু বিশ্বাস করতে চাই, আছে।
এক্দম মনের কথা! সেবার বই আমার চিরকালের আবেগ! ১০০ পাতার এখনকার একটা বইতে ২০-৩০ পাতার বেশি কন্টেন্ট থাকেনা। ফন্ট অতিরিক্ত বড়, পাতার বেশিরভাগ অংশ খালি, অনেক বড় মার্জিন, আগে-পিছনে সাদা পাতা, আর কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাঙ গ্লসি প্রচ্ছদ, লেখক পরিচিতি (হু,আ, টাইপের জন্য অপ্রয়োজনীয়) পাঠককে শুধু ঠকাচ্ছেই না, এটা বিশাল অন্যায়ও।
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
একদম ঠিক
-স্বপ্নাদিষ্ট
=======================
যে জাতি নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না।
সহমত।
_________________
[খোমাখাতা]
'কপোট্রনিক সুখদুঃখ' বইটা সেই কবে ছেলের জন্য কিনেছিলাম। এখনও প্রায় নতুনের মতই আছে।
ধন্যবাদ আপনাকে, একটি প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী পোস্টের জন্য।
খুবই প্রয়োজনীয় লেখা।
ভালো কাগজ, হার্ড কভারের কারণে আমাদের অবশ্বাসের দর্শন বইটির মুদ্রিত মূল্য ছিলো পাঁচশ টাকা। ৩০০ পাতার এই বইটিতে প্রতিফর্মা কাগজের দাম ছিলো পঁচিশ টাকা করে (প্রকাশকের কাছ থেকে জানা)।
হুমায়ূন আহমেদ কিংবা জাফর ইকবালদের বইসহ বইয়ের চলমান সংস্কৃতির কথা আপনি বললেন। হার্ড কভার এবং চকচকে অফসেট। তুচ্ছ একটা কারণ বলেছেন, প্রকাশকরাও বলেন- মানুষ নাকি নিউজপ্রিন্টের মলিন বই নেড়েচেড়েও দেখেনা।
আপনি যদি কম বই ছাপান তাহলে পেপারব্যাক এবং হার্ডকভারের বইয়ে খরচের খুব একটা তারতম্য হয়না। পেপারব্যাক করে দাম কমাতে চাইলে অনেক অনেক অনেক অনেক কপি একসাথে ছাপানোর দরকার। আমাদের দ্বিতীয় সংস্করণও হার্ডকভারেই বের হবার ছিলো। কিন্তু প্রথম এডিশনের সাড়ার কারণে, আমরা পেপারব্যাকে উৎসাহ পেয়েছি, প্রকাশকও আমাদের কথা রেখেছেন। একটা কথা বলে রাখা দরকার, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক ছাড়া কয়টা বই শখানেকের উর্দ্ধে বিক্রি হয়? আর এই কারণেই মেলায় সব বই পেপারব্যাক করতে চাইলেও সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য সম্ভব হবেনা।
এবারের আমাদের বইয়ের কাগজ ফর্মা প্রতি ১৫ টাকা। নিউজপ্রিন্ট না। হোয়াইট প্রিন্ট এবং আমি সহ অন্য অনেকের কাছেই আগের কাগজের যে একটু হলুদাভ এই কাগজ বেশি ভালো লেগেছে, পড়তে আরামও লাগে বেশি।
জাফর ইকবালের অন্তত এই বিষয়ে একটা অবস্থান নেওয়া দরকার। বাংলাদেশের সবকিছুতেই জাফর ইকবাল স্যারকে ডেকে আনার মতো আবদার এটা না বলাই বাহুল্য। তার বই অনেক অনেক বিক্রি হয়, তার বিশাল পাঠকশ্রেনী, প্রকাশকও তার উপর মাতবরী করবেনা। তিনিই কেনো পেপারব্যাক সংস্কৃতির সূচনা করেন না? টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে দুইশটাকা দিয়ে একটা বই কেনার মানে কী, যেখানে বইটা পুরোটা পড়তে এক ঘন্টা থেকে দুই ঘন্টাও লাগেনা?
আর বই ভালো হইলে তার চেহারা কোনো ম্যাটার করেনা।
বইয়ের যত্ন যে করতে জানে না, তাকে স্টেইনলেস স্টিলের পাতে ছাপানো বই দিলেও সে নষ্ট করবে।
খাঁটি কথা!
আমাদের বাসায় ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার একটি কপি আছে,মোটামুটি অবিকৃত অবস্থায়।
আমি ৪-৫ বছর আগে জাফর ইকবাল স্যারের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলাম বইয়ের দামের ব্যাপারে।উনি যা বললেন এ ব্যাপারে নাকি লেখকদের বেশি কিছু করার নেই!লেখকরা প্রকাশকের হাতে বন্দি।
৬ ফর্মা(৯৬পৃষ্ঠা),৮০ গ্রাম অফসেট এর বই মোটামুটি ভাল বাঁধাই ও মুদ্রণে করলেও প্রতি বইয়ের পেছনে ৫০ টাকার বেশি খরচ পড়ার কথা না।তো বাকি টাকা কে খায়?
তিরিশের দশকে (১৯৩৫) যখন অ্যালেন লেন এবং ভি কে কৃষ্ণ মেনন পেঙ্গুইন প্রকাশনা শুরু করেন তখন উদ্দেশ্য ছিল কম খরছে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া। পেপারব্যাকের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল পেঙ্গুইনের হাত ধরেই। আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একটি বইয়ের একাধিক সংস্করণ ছাপা হয়--পেপারব্যাক, হার্ডবাউন্ড, ই-বুক। পাঠক তাঁর পছন্দ ও সামর্থ্য অনুসারে তা সংগ্রহ করেন। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে সে সংস্কৃতি এখনও তেমনভাবে তৈরি হয়নি। যদিও কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স কিছুদিন হল একই বইয়ের একাধিক সংস্করণ বাজারে ছাড়ছে--তবে সেটা কিছু জনপ্রিয় বইয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে। আমি বাংলার বাইরে অনেক হিন্দি, কন্নড় বইয়েরও একাধিক সংস্করণ দেখেছি। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে আরও অগ্রগতি ঘটা দরকার। এমন অনেক পাঠক আছেন যাঁরা পেপারব্যাক বই পছন্দই করেন না--নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে, যাঁর মত ছিল পেপারব্যাক বই কেনা আর বেশ্যাসংসর্গ করা প্রায় সমার্থক। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ মতকে গ্রহণযোগ্য মনে করি না। পাঠকের সামনে তাঁর পছন্দ সামর্থ্য অনুসারে একাধিক সংস্করণ হাজির করা একান্তভাবে প্রয়োজন। এব্যাপারে লেখদেরকেও উদ্যোগী হতে হবে। যাঁরা নতুন লেখক তাঁদের এব্যাপারে মতামত দেওয়ার ক্ষমতা বা সুযোগ হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না। কিন্তু যাঁরা প্রতিষ্ঠিত লেখক তাঁরা অবশ্যই তাঁদের পাঠকের কথা ভাববেন এটা আশা করা অন্যায় হবে না। লেখকের মূল্য পাঠকই নির্ধারণ করেন, লেখককে বেঁচে থাকতে এবং বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেন। তাই পাঠকের কথা ভাবা লেখকের দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। বই বিক্রির মাধ্যমে লেখকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটুক এটাতে পাঠকের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু পাঠকেও বঞ্চিত করার অধিকার লেখকের নেই। অনেকক্ষেত্রেই লেখকদের বলতে শুনি বইটি কী আকারে বাজারে আসে তাতে তাঁদের কোনো হাত নেই। এটা তো দায় এড়িয়ে যাওয়ার কথা। তাঁদের দায় নিতে হবে। জনপ্রিয় লেখকরা যখন বই লেখেন তখন মহৎ কর্ম করার পাশাপাশি অর্থ লাভের মহৎ ইচ্ছাও তাঁদের বলবতী থাকে। রয়্যালটির টাকা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের দায়ও তাঁদেরই নিতে হবে। বর্তমান লেখাটিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি দিকে আলোকপাত করার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
১৯৭৩ সালে আমার বাবার কেনা ইয়া মোটা 'জীবনানন্দ দাশ সমগ্র' সম্পুর্ন নিউজ প্রিন্টে এখনও বহাল তবিয়তে টিকে আছে আমার বুক-শেলফে। কিচ্ছুটি হয়নি। নিউজ-প্রিন্টের পাশাপাশি 'জীবনানন্দ দাশ সমগ্র'কে টিকিয়ে রেখেছে তার ভেতরের মান।
"একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়" আমার কাছে যেটা আছে সেটা ১৯৯২ সালের বইমেলা থেকে কেনা। তুমি যেই পেপারব্যাক নিউজপ্রিন্টের কথা বললা ঐটাও তার একটা মোক্ষম উদাহরণ।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
অত্যন্ত জরুরি একটি প্রসঙ্গের সূত্রপাত করায় লেখককে ধন্যবাদ।
আমি ২০০৭ সালে একটু খোঁজখবর করেছিলাম। সেই লেখাটি আমার আর্কাইভ থেকে নিচ্ছি, তারপরের মন্তব্যে আলোচনায় আসব। তবে পুরোনো হিসাব বলে হয়তো সঠিক হবে না, তবে সেকালে ১৫টাকা ফর্মা বইয়ের দাম ছিল, এখন ২৫ টাকা। এটাও খেয়াল রাখতে হবে। আপাতত সেই হিসাবটি দেখা যাক। :
একটি বইয়ে নিট খরচ কতোঃব্যবসা বোঝার জন্য এখানে একটি বইয়ের নিট খরচ আলোচনা করছি।
ধরা যাক,৬ ফর্মার একটি বই,ছাপা হবে ১০০০ কপি।
খরচ হবে নিম্নরূপঃ
(ভেতরের অংশ)
1. কম্পোজ ৪০০ টাকা ৬ ফর্মা = ২,৪০০ টাকা
2. প্রুফ দেখা (২বার) ২০০ টাকা ৬ ফর্মা = ১,২০০ টাকা
3. পেস্টিং ৩০ টাকা ৬ ফর্মা = ১৮০ টাকা
4. ম্যাটার পেট ১৬০ টাকা ৬ ফর্মা = ৯৬০ টাকা
5. ছাপা ২৫০ টাকা ৬ ফর্মা = ১,৪০০ টাকা
6. কাগজ (ডাবলডিমাই) ১৮০০ টাকা ৬ রীম = ৯,০০০ টাকা
7. (প্রচ্ছদ )
8. ডিজাইন খরচ +পজেটিভ ২০০০ টাকা ২,০০০ টাকা
9. ম্যাটার পেট ১৬০ টাকা ৪ ফর্মা = ৬৪০ টাকা
10. ল্যামিনেশন (গ্লসি) ৭৫ টাকা ১০০০ কপি = ৭৫০ টাকা
11. বাঁধাই ৪.৫ টাকা ১০০০ কপি = ৪৫০০ টাকা
12. প্রচ্ছদের ভেতরের কাগজ ৫০০ টাকা
13. বিবিধ খরচ (যাতায়াত,যোগাযোগ ইত্যাদি) ১,০০০ টাকা
(প্রায়) মোটঃ ২৫ ,০০০ টাকা
(বা প্রতি বই ২৫ টাকা)
একটি বইয়ের বিক্রয় মূল্য কতোঃ
প্রতি ফর্মা ১৫ টাকা হিসেবে বইয়ে বিক্রয়মূল্য উ ল্লেখ করা হয়।
সুতরাং, ৬ ফর্মার বইয়ের দাম দাড়ালো ৯০ টাকা।
বাদ যাবে ৪০ শতাংশ বিক্রেতা কমিশন (মেলায় যদিও ৩০ শতাংশ) = ৩৬ টাকা।
লেখক রয়্যালিটি ১৫ ভাগ = ১৩.৫০ টাকা ।
অতএব,প্রতিটি বই থেকে প্রকাশক পাচ্ছেন (গ্রস লাভ) = ৯০ টাকা -( খরচ ২৫ টাকা + কমিশন ৩৬ টাকা + লেখক কমিশন ১৩.৫০ টাকা) = ১৫.৫০ টাকা।
বই মেলায় পূঁজি উঠে আসবে কতোটি বই বিক্রী হলেঃ
৯০ টাকার একটি বই স্টলে বিক্রী করা হচ্ছে = ৬৩ টাকায়।
লেখকের রয়্যালিটি সহ নীট ইনভেস্ট ছিল ২৫,০০০ টাকা + ১৩,৫০০ = ৩৮, ৫০০ টাকা।
তাহলে মোটামুটি ৬১১টি বই বিক্রী করলে পূজি উঠে আসবে। (আসলে এটি ৬৫০ কপির মতো হবে ,কারন স্টলের ভাড়া সহ আনুষাঙ্গিক খরচ যোগ করা হয়নি)
এখন এই আগের হিসাবকেই যদি নমুনা হিসেবে নেই, তাহলে দেখা যাচ্ছে;
হার্ড কাভারের জায়গায় নিউজপ্রিন্ট পেপারব্যাক করলে খরচ কমছে:
কাগজ (নিউজপ্রিন্ট তখন ৬০০ টাকা রিম ছিল) -৭,২০০ টাকা।
পেপারব্যাক বাঁধাইটা বোধহয় তখন ১টাকায় করা সম্ভব হতো, সেক্ষেত্রে-৩,৫০০ টাকা এবং ল্যামিনেশন এসব বাদ দিলে আরো ১৫০০ টাকার মতো বাদ যাবে।
অর্থাৎ ১২,২০০ টাকা বাদ দেয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রতিটি বইয়ের মূল্য ১২.২০ টাকা কমে আসবে।
বইয়ের ক্ষেত্রে এই মূল্য কমা কি খুব অবদান রাখবে? মানে নিউজপ্রিন্টে পেপারব্যাকে প্রকাশ করা হলে যে মূল্যের তফাৎ হচ্ছে, সেটি বড় কোনো তফাৎ কি তৈরি করতে পারছে?
আমার চোখে পড়ছে, বড় একটা খরচ চলে যাচ্ছে কমিশনে। কিন্তু ওখানে হাত দিলে আবার বাজারজাত করাটা ঝামেলার হবে, এমনিতেই বইয়ের দোকান আজকাল মফস্বলে উঠেই গেছে।
আমার ধারণা, হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবালের এক একটা বই লক্ষ কপির মতো ছাপা হয়। আপনি এক লক্ষ কপির জন্যে এই হিসাবটা আবার করে দেখুন।
খিকজ, আমি আবার পড়তে গিয়ে এখানে শুভংকরের বড় ফাকিটা আবিস্কার করলাম এবারে।
১২.২০ টাকা কিন্তু কমছে প্রোডাকশন কস্টে, এমআরপিতে না। খুচরা বিক্রয় মূল্যে তাই তফাৎটা আরো বড় হবে।
২৫ টাকা খরচের বইয়ের খুচরামূল্য ৯০ টাকা হলে, ঐকিক নিয়মে ১২.৮০ টাকার বইয়ের খুচরামূল্য হতে পারে ৪৬ টাকা। তারমানে অর্ধেক।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ২০০ টাকাই বইয়ের দাম তখন ১০০ টাকায় নেমে আসবে। ২৫ ভাগ কমিশনের পরেও ৭৫ টাকা।
বাহ্, আপনি তো একেবারে ঠিক জায়গায় পয়েন্ট আউট করছেন। এখন তো দেখছি কাগজের দামই প্রোডাকশনের অর্ধেক খরচ, এখানে কাজ করলেই বইয়ের দাম কমানো সম্ভব।
একদম মনের কথাটা আপনি চমৎকার করে লিখে ফেলেছেন ভাইয়া। সেবা প্রকাশনীর বইগুলো কি কষ্ট করে কিনে কিনে পড়তাম তা আবার মনে পড়ে গেলো।
বইয়ের অযথা এইভাবে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার মানসিকতাটা আসলেই খারাপ। অনেকেই হয়তো বলবেন বই সংগ্রহে রাখার কথা। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করেন না তারা যে নিউজপ্রিন্টে ছাপা হলে তারা আরও বেশিসংখ্যক বই সংগ্রহে রাখতে পারবেন।
কম বাজেটের কারণে বইমেলায় যেয়ে ব্যাগভর্তি করে বই কেনা হয় না। বরং বইমেলা শেষে নীলক্ষেত থেকে বইবোঝাই হয়ে বাসায় ফিরি। যেই টাকায় একটা বই বইমেলায় কেনা যায়, অই টাকায় তিনটি ভিন্ন বই নীলক্ষেত থেকে কিনে পড়া যায়। আমার মতো আরও অনেকেই হয়তো এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
ভালো লেগেছে আপনার লেখাটি।
সহমত
অফটপিকঃ সচলের প্রকাশায়তন কি শুধু ই-বুক নিয়ে কাজ করছে? ভবিষ্যতে কি কাগুজে প্রকাশনাতে যাবার কোন পরিকল্পনা আছে?
হ্যারি পটার পড়ছি ফটোকপিতে আর ভারতীয় নিউজ প্রিন্ট। আমার তো মনে হয় না এতে বই পড়তে কারো কোনো সমস্যা হইছে। পরে নিজের সংগ্রহের জন্যে ভালো কপি দাম দিয়ে কিনেছি।
জাফর ইকবাল পাথরের ট্যাবলেটে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে খোদাই করে লিখলেও তাঁর পাঠক সেই বই কিনবে।
সহমত
---------------------
আমার ফ্লিকার
আমার মতে কোনো সিরিয়াস বই ভাল কাগজে (অফসেটেই হতে হবে, এমন নয়) ছাপা হওয়া উচিৎ| তারপর চাহিদা বুঝে পেপারব্যাক সংস্করণ বের করা উচিৎ| ওপরে কেউ একজন পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার কথা বলেছেন দেখলাম| পেঙ্গুইন শুরুতে প্রায় সব বইই হার্ডকভারে ভাল কাগজে ছাপে| পরে মানে বেশ কিছুদিন পরে পেপারব্যাক বের করে| যেমন অরূন্ধতী রায়ের সমস্ত বই আমার কাছে হার্ডকভার, কারণ বেরোলেই কিনে ফেলি| এদিকে ডালরিম্পলের লাস্ট মুঘল বেরোন মাত্র লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কিনেছিলাম, কিন্তু পড়ে আফশোস হল, অত্ত দাম দিয়ে না কিনে পেপারব্যাক বেরোন অবধি অপেক্ষা করা উচিৎ ছিল|
যে সব বই একবার পড়ে ফেলবার পর আর দ্বিতীয়বার পড়ার সম্ভাবনা খুব কম, সেগুলো পেপারব্যাক বের করাই উচিৎ| মাঝে মিত্র ও ঘোষ বেশ কিছু পেপারব্যাক বের করেছিল, আনন্দ আজকাল কিছু কিছু করছে| চর্চাপদ'এর 'সটীক জাদুনগর' আমার কাছে হার্ড কপি আছে, কিন্তু পরে ওঁরা পেপারব্যাক বের করেছেন, এখন সেইটাই পাওয়া যায়| ওঁদের কাছে শুনেছিলাম, মাঝেমধ্যে ২-১ জন কলেজ ইউনির ছাত্র ছাত্রী এসে নেড়েচেড়ে দেখে বইটা খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও নামিয়ে রেখে যেত, বোঝাই যেত বেচারা খুব কেনার ইচ্ছে, কিন্তু বাজেট কুলোচ্ছে না কোনোমতেই ---- সেই দেখেই নাকি ওঁরা ঠিক করেন পরের সংস্করণ পেপারব্যাক করবেন| বইটার চাহিদা খুব|
ডিস্ট্রিবিউশান চেন সত্যিই একটা বিশাল সমস্যা| আমি তো ভেবেছি হয় একটা বাংলা বইয়ের ডিস্ট্রিবিউশান চেন, নয়ত একটা প্রকাশনা সংস্থা, নয়ত দুটোই খুলব|
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় এই লেখার সাথে পুরোপুরি সহমত|
এখন আসি তাত্ত্বিক আলোচনায় , 'বই এর কাগজ এর দাম, কভার এর দাম' দিয়ে বই এর দাম নির্ধারণ করাটা, সিডির/ডিভিডির দাম অনুযায়ী সফটওয়ার এর দাম নির্ধারণ করার মত| একটা বই এর পিছনে একজন লেখক যে ইন্টেলেকচুয়াল ইনপুট দেন| সেটার মূল্যায়ন না হলে পুরো শিল্পটা কেমন যেন 'চ্যারিটি' হয়ে যায়| যেখানে লেখক কেবলমাত্র জনকল্যাণ এর জন্যই লিখছেন...
এছাড়াও মুড়ি মুড়কির এক দর হওয়া তো ভালো কথা নয়...
মেধার মূল্য দিতে তো কোনো আপত্তি নেই। বইয়ের মূল্য = মেধার মূল্য (x) + বস্তুমূল্য (y)। মেধার মূল্যকে অপরিবর্তিত রেখে বস্তুমূল্য যদি কমিয়ে ২২.২২% এ আনা যায়, তাহলে বইয়ের নতুন মূল্য দাঁড়াবে x + 0.22y । সেটা অনেক পাঠকের নাগালের মধ্যে থাকবে।
জাফর ইকবাল একটা বইয়ে যে "ইন্টেলেকচুয়াল ইনপুট" দেন, তার জন্যে তিনি থোক টাকা পান প্রকাশকের কাছ থেকে, মেধার মূল্য সেখানে পরিশোধিত। প্রকাশক তারপর সেই জিনিস নিয়ে কীভাবে লাভ করবেন, সেটা প্রকাশকের সিদ্ধান্ত। প্রকাশক এখন এমন একটা সিদ্ধান্ত বেছে নেন যাতে তার অনেক লাভ থাকে, পরিশ্রম অনেক কম হয়। এর খেসারতটা দিতে হয় এমন একটা পাঠকগোষ্ঠীকে, যারা তাদের রিসোর্স পুরোপুরি ডিপ্লিট করে ফেলে একটা বা দুটো বই কিনতে গিয়েই। পরিস্থিতিটা বই পড়ার যে পরিবেশ নিয়ে আমরা অনেক সময় কথা বলি, তার বিপরীতেই যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে পত্রিকায় অনেক হইচই হয়, বইয়ের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কেউ কোনো টুঁ শব্দ করে না। বইও তো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। কিছু লেখক চাইলে প্রকাশককে এই স্ট্র্যাটেজি পাল্টে বইয়ের প্রসারে কাজে আসবে এমন একটা স্ট্র্যাটেজি নেয়ার জন্যে চাপ দিতে পারেন।
থোক টাকা বাদেও এক্টা রয়েলিটি থাকে লেখকদের। যা বই কত কপি বিক্রি হলো তারউপর পান পুরো বছর ধরে। তবে বেশিরভাগ লেখকের ক্ষেত্রেই প্রকাশকরা আর এইটা দেননা (এক দুইজন ব্যতিক্রম আছেন) । এমযেডআই, হুয়া বা আনিসুল ভায়ের মতো হাতে গোনা কয়েকজন বাদে। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এই তথ্যটা এমযেডআই স্যার বছর দুয়েক আগেও জানতেন না। জানার পর পর উনি পত্রিকায় একটা লেখা দিয়েছিলেন এবং সেই বছর উনি সবসময় যে প্রকাশনা থেকে বই বের করতেন তাঁদের আর বই দেননি। পরের বছরও দেননি। ঃ)
বইয়ের যত্ন যে করতে জানে না, তাকে স্টেইনলেস স্টিলের পাতে ছাপানো বই দিলেও সে নষ্ট করবে।
কথা সত্য।
সময় প্রকাশন থেকে জাফর ইকবালের কিছু বই পেপার ব্যাক আকারে বের হয়েছে-প্রকাশ কাল লেখা দেখলাম অক্টোবার ২০০৯-মূল্য ৪৫ থেকে ৬০ টাকা এর ভেতর।
ওনার যে বইগুলোর পেপারব্যাক সংস্করণ বেরিয়েছে, সেগুলো পেপারব্যাক হিসেবে প্রকাশের বছর দশেক আগে হার্ডকাভারে প্রকাশিত। এখানেও উলটপুরাণ। যেখানে নতুন বই পেপারব্যাকে আর পুরনো বই সমগ্র হিসেবে বা সংগ্রহে রাখার জন্যে হার্ডকাভারে বের হলে পাঠকের সুবিধা হয়, সেখানে নতুন বই বেরোচ্ছে চড়া দামে আর পুরনো বই পেপারব্যাকে।
সময় ২০০৮ এবং ২০০৯ এ জাফর ইকবাল স্যারের প্রথম ৮ টা সায়েন্স ফিকশানের পেপারব্যাক সংস্করণ প্রকাশ করেছে।
প্রাণের কথা বলেছেন হিম্ভাই।
তবে একটি তথ্যে সম্ভবত গণ্ডগোল আছে। গ্রামের বাচ্চাদের(এখন অবশ্য সবখানেই) বিনামূল্যে দেয়া টেক্সটবুক বোর্ডের বইগুলি নিউজপ্রিন্টে ছাপানো নয়(কিংবা এখন ছাপানো হয় না/গ্রামের সরকারি প্রাইমারিতে পড়া শেষ করেছি ১৭বছর আগে, তখনও নিউজপ্রিন্ট ছিল না)।ভাল কাগজে ছাপানো ঝকঝকে নতুন বই দেয়া হয় বাচ্চাদের হাতে।তার উপ্রে এ বছর থেকে ছোট ক্লাশের কিছু বইয়ে[আমি দু একটাতে দেখেছি, সবগুলোতেই কিনা তা এত রাতে মাকে ডেকে কনফার্ম করতে গেলে কিল খাওয়ার সম্ভাবনা আছে] ইলাস্ট্রেশনগুলো রঙিন করা হয়েছে।
জাফর ইকবাল পাথরের ট্যাবলেটে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে খোদাই করে লিখলেও তাঁর পাঠক সেই বই কিনবে।
ঠিক।
মন্তব্য
খাঁটি কথা। পাঁচতারা পোস্ট।
একটি ব্যালেন্সেও আসা যায়, ধরেন প্রকাশক যদি নিতান্তই পেপারব্যাকে ছাপাতে অস্বীকার করেন পয়সার জন্যে বা রেপুটেশন কমে যাবে ওই ভয়ে, তারা একই বইয়ের তিনচারটে এডিশন ছাড়তে পারেন। পেপারব্যাক, সকলের জন্য। আর হার্ড কভার, ঝকমকে চিত্রায়নসমৃদ্ধ, কালেকটরস এডিশন টাইপ কিছু। দুইটি মার্কেটই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এক ধাপ এগিয়ে ইপাব ভার্সনও বের করতে পারে, এক লাফে প্রবাসী মার্কেট ধরে ফেলবে তারা।
..................................................................
#Banshibir.
সাধারণত কয়েক বছর পর পর খুচরা বইগুলোকে একসঙ্গে করে "সমগ্র" ছাপানো হয়, সেগুলো দামি কাগজে হার্ড কাভার করে ছাপানো যায়। যারা বই সংগ্রহে রাখতে চান, তারা সেগুলো কিনতে পারবেন। তবে অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বইয়ের যত্ন যে করে, তার কাছে পেপারব্যাক যা, হার্ড কাভারও তাই। সেবা প্রকাশনীর বাঁধাই তো এমন আহামরি কিছু ছিলো না, কিন্তু সেই সত্তরের দশকের শেষে ভাইয়ার কেনা কুয়াশা সিরিজের বই আমাদের বাসায় অক্ষত এবং পোক্ত অবস্থায় আছে। বইয়ের যত্ন যে করতে জানে না, তাকে স্টেইনলেস স্টিলের পাতে ছাপানো বই দিলেও সে নষ্ট করবে।
ছাপানো বইয়ের যুগ আসলে শেষ হয়ে আসছে। ইলেকট্রনিক বইয়ের একটা চলনসই বিজনেস মডেল দাঁড়িয়ে গেলে ছাপানো বই নিয়ে মাথা ঘামানোও বাদ দিয়ে দেবে লোকে। কিন্তু বাংলাদেশে আমার মতো করে অনেক ছেলেমেয়ে এখনও বই কেনে নিশ্চিত। পরিবর্তন তাদের কাছে পৌঁছাতে আরো এক-দেড় যুগ লেগে যাবে। ততদিন তাদের কাছে কম খরচে বেশি বই পৌঁছাক। প্রচুর কাটতি আছে এমন বইয়ের লেখক যদি সেই ধারায় যোগ দেন, তাঁর দেখাদেখি আরো অনেকে এগিয়ে আসতে সাহস বা সমর্থন পাবে।
ঠিক। পেপারব্যাক প্রয়োজন আছে, আমি বুঝে পাইনা ঢাকার বাইরে লোকে কিভাবে বই কিনে। মফস্বলে বইয়ের দোকান মানেই নোটবই আর সুনীল শীর্ষেন্দুর চোরাই বই। পেপারব্যাকে দেশ ভরিয়ে দেয়া দরকার। সাথে নীলক্ষেত মডেলটা আরো ব্যাপকভাবে চালু করা দরকার। ধরেন আপনি হার্ডকভারই কিনলেন ২০০ টাকা দিয়ে, আর ওই বই দোকানে রিসিট দেখিয়ে আবার বেচা যাবে ৮০ টাকা দিয়ে। দোকান এইবার ব্যবহৃত বই ১২০ টাকায় বেচবে। সুতরাং দোকানে দুইটা শেলফ, আপনার সামনে তিনটি অপশন। অপশন এক, ২০০ টাকা দিয়ে নতুন বই কিনুন এবং ধন্য হউন। অপশন দুই, ২০০ টাকা দিয়ে নতুন বই কিনুন আর পড়ে বেচে দিন ৮০ টাকায় ওই দোকানেই, সো দাম পড়ল ১২০ টাকা। অপশন তিন, অন্য কারো ৮০ টাকায় বিক্রিত বই ১২০ টাকা দিয়ে সেকেন্ডহ্যান্ড বই কিনুন। ঠিকমত মার্কেটিং করতে পারলে দামী বইয়েরও নতুন অ্যাফোর্ডেবল বাজার তৈরী করা যাবে। অপশন এক এবং তিন দিয়ে ব্যক্তিগত কালেকশন গড়া যাবে, অপশন দুই বেছে নিন যদি সেই ইচ্ছা না থাকে।
ঢাকার সবাই খালি এপার্টমেন্ট না বানিয়ে নতুন বিজনেস মডেল দাঁড়া করাতে পারলে বড় ভাল হত।
..................................................................
#Banshibir.
ভালো বলেছেন।
স্কুলে দুপুরে টিফিন না খেয়ে অভুক্ত থাকতাম সেবা প্রকাশনীর একটা বই কিনব বলে (তিন গোয়েন্দা), সেই বই নিউজপ্রিন্টের ছিল, আজ অক্ষত আছে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখসি, আমার মত যারা পেটের ক্ষুধা না মিটিয়ে মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্যে বই পরে তাদের জন্যে বেপারটা আসলেই ভেবে দেখা দরকার, দেশে থাকা অবস্থায় যখন বইমেলাতে যেতাম তখনও দামের বেপারটা আমাকে ভোগাতো, হিমু কে ধন্যবাদ ব্যাপারটা গুছিয়ে সবার সামনে আনার জন্যে
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে এনেছেন। এই লেখাটা জাফর ইকবাল স্যারকে পড়ানোর ব্যবস্থা করা গেলে ভাল হত।
একুশে বইমেলার মাসে মুল্যবান চিন্তা-ভাবনা।
আরেকটু যোগ করি। অফসেট (১০০ গ্রাম) কাগজ; যেগুলোতে এইসব বই ছাপা হয়, সেসব সম্ভবতঃ বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। দেশে এখন এইমানের কাগজ তৈরি হয় কি না
ঠিক জানি না, ৫ বছর আগে তৈরি হতো না। তারমানে বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ এখানে ব্যয় হচ্ছে। দেশী নিউজপ্রিন্টে ছাপালে এটা বাঁচানো যায়। আমার মতে নিউজপ্রিন্ট-অফসেট দুই পদের অপশনই থাকা উচিৎ।
ইন্দোনেশিয়া আর সুইডেন থেকে আসে সম্ভবত।
গত বছরও ফর্মা পিছু পঁচিশ টাকা দাম রাখা হয়েছে বইয়ের। কাগজের দাম ভবিষ্যতে আরো বাড়বে এবং বাড়াই উচিত। প্রকাশকরা কি তাল মিলিয়ে কেবল দাম বাড়াবেন নাকি বিকল্প কোনো মডেল নিয়ে ভাববেন, সেটাই দেখার বিষয়।
সহমত
বইয়ের ফন্ট সাইজ নিয়েও আপত্তি আছে আমার, এত্ত বড় বড় করে ফন্ট দিয়ে বইয়ের আকার খামোখাই বাড়ানো হয়।
------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল
হিমু ভাই,
সেবার বইগুলি এখনও নষ্ট হয়নি। আমার সেলফে সুন্দরমতই সাজানো আছে। আর নিউজপ্রিন্ট বা পেপারব্যাক বলে কখনো তার প্রতি আকর্ষণ কমেনি এতটুকু। আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত, হার্ডকাভারে ১০০ গ্রাম অফসেটে ছাপিয়ে বইগুলোকে দামি করে ফেলার পেছনে ক্রেতার কোনই ভূমিকাই নেই; সবটাই প্রকাশকের প্রসার-জনিত ধান্দা! আপনি টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বই কিনতেন; আর আমি কিনতাম রিকশা-ভাড়ার টাকা বাঁচিয়ে। প্রতিদিন হেঁটে যেতাম স্কুলে। প্রশ্ন হল, আমাদের অভিভাবক কি অর্থসংকটে পড়ে আমাদের পর্যাপ্ত বই কিনে দিতেন না? আসল ব্যাপারটা তা নয় মোটেও; বছরে একটি বা দুটির বেশী বই কিনে দেয়াকে তারা ভয়ানক পাপ বলেই গণ্য করতেন; কারণ এতে সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা আর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে যে!
প্রাঞ্জল আর চিন্তা জাগানিয়া লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ!
কাজি মামুন বলেছেন '"আমাদের অভিভাবক কি অর্থসংকটে পড়ে আমাদের পর্যাপ্ত বই কিনে দিতেন না? আসল ব্যাপারটা তা নয় মোটেও" আপনি ব্যপারটাকে এভাবে উড়িয়ে দিতে পারেন না। আমি অনেক অভিভাবককে দেখেছি যাদের ইচ্ছে থাকা সত্বেও টাকার জন্য বই কিনতে পারেন না । যারা ঠিক মত নিজেদের পেটই চালাতে পারে না তাদের পক্ষে ১৫০ - ২০০ টাকা দিয়ে বই কিনে নিজেদের পেটে লাথি মারার মত বোকামি তারা নিশ্চয়ই করবে না ।
ভাই, আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম; সমাজের একশ্রেণীর অভিভাবকের 'বই-ভীতি'র কথা বলেছিলাম; পোলাপাইনের হাতে পাঠ্যপুস্তক বাদে অন্য বই দেখলেই যাদের চোখ কপালে উঠে, মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, '' ওরে সর্বনাশ!''।
সুতরাং, আপনি কেন যে আমার কথাটার ভুল ব্যাখ্যা করলেন, একটি বিশেষ অভিজ্ঞতাকে অযথাই 'জেনারালাইজ' করলেন, বুঝতে পারলাম না। সমাজে চরম দরিদ্রতার শিকার অসংখ্য লোকের যেখানে অন্ন-বাসস্থানেরই সংস্থান নেই, সেখানে তাদের জন্য বই কেনা তো বিলাসিতা! আমি তো মধ্যবিত্ত সমাজের অভিভাবকদের একাংশের কথা বলছিলাম!
হিমু ভাই, কাগজের ধরণ ছাড়াও একটা ইস্যু আছে, সেটা হল ফন্ট। ফন্ট গুলো প্রয়োজনের তুলনায় বড় হওয়াতে কাগজ বেশি লাগে। এটাও দেখা উচিত বলে মনে হয়।
সব কিছু টাকা ওয়ালাদের হাতে চলে যাচ্ছে । বইটা সহ । আমি নিশ্চিত বাংলাদেশে অনেক পাঠক আছে যাদের ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও শুধুমাত্র পয়সার অভাবে বই কিনতে পারে না। অবস্থা দেখে মনে হয় লেখকদের উদ্দেশ্য শুধুই টাকা পাঠক নয়। এরকম চমতকার একটা বিষয় নিয়ে লেখার জন্য হিমু ভাইকে ধন্যবাদ ।
"দোষ"টা লেখকদের সরাসরি দেয়া উচিত হবে না। পুরো ব্যাপারটা অনেক ধরনের সিলেকশন প্রেশারের ফল। বইকে যদি আমরা একটা অর্গানিজম হিসেবে কল্পনা করি, তাহলে এর বিবর্তন কীভাবে হচ্ছে, কী কী নির্বাচনচাপ (সিলেকশন প্রেশার) এর ওপর কাজ করছে, সেগুলো চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। পর্ব ০২তে লিখবো সেগুলো নিয়ে।
কিপিটাপ
১০০ ভাগ সহমত হিমু ভাই
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আমাদের বাসায় এখনো আছে সেবার বইগুলো। নষ্ট হয়নি। আমিও এখন আর বই কিনতে পারিনা বেশি দামের কারনে। নিউজপ্রিন্টের বইতে তো পাঠকের কোন সমস্যা হয় না, সমস্যা প্রকাশকের।
কেউ কি একটু জাফর ইকবাল স্যারের কাছে পৌছে দিবেন এই লেখাটা?
পেপারব্যাক বইগুলো যত্ন করার মাঝেও যে কত আনন্দ আছে। সত্যি, যারা বই ভালোবাসে, তাদের কাছে প্রতিটা বই সন্তানের মতো।
মেলায় অন্যপ্রকাশের পরেই সবচে বেশি ভীড় থাকে সেবার দোকানে। কাজেই পেপারব্যাকের বই চলে না এটা ভুয়া অজুহাত। তাদের কিন্তু নিউজপ্রিন্ট আর হার্ড কভার দু ধরনের বিজনেস মডেল আছে, সবগুলো বই সব মডেলে চলে না।
তবে হুমায়ূন আহমেদ বা মুজাই এরকম লেখকদের বই গুলো অনেক সময় উপহার হিসেবেও দেয়া হয়, এগুলোর হার্ড কভার এর পাশাপাশি পেপারব্যাক কপিও বের হতে পারে। তাহলে বই ক্রেতার সংখ্যা যে আরো বাড়বে সন্দেহ নাই। মেলায় অনেক সময় নতুন লেখকদের বই দেখি, কিন্তু হার্ড কভারের দাম দেখে দোনমনা করি পয়সা খরচ করব কি করব না। যদি ১৫০টাকা না হয়ে ৫০টাকা দাম হতো আরো অনেক ধরনের বই কিনতাম সন্দেহ নাই। যদি মুজাই এর বই অর্ধেক দামে পেতাম তাহলে বাকিটাকা দিয়ে নবীন কোন লেখকের বই চেখে দেখতাম।
ছাত্রজীবনে কত কাহিনী করে বই কিনেছি, স্বপ্ন ছিল যখন চাকরি করব, বইমেলায় গিয়ে পকেটের চিন্তাভাবনা ভুলে বই কিনব। চাকরি শুরুর পর প্রথম যে বইমেলা এল তখন বাংলা একাডেমির মাঠ থেকে আমি ১০,০০০ মাইল দূরে। কাজেই বইমেলা,কম ই ভরসা।
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
আমি সেবার কথা বলতে পারি। এখন সেবার একেকটা ৫ ফর্মার বই গ্রুপ ভেদে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় পাওয়া যায়। আর ৮ / ৯ ফর্মার বই ৮০ থেকে ১০০ টাকা। বাঁধাইয়ের মান আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। বেশিরভাগ বইগুলোই এখন পড়ার সময়ই পৃষ্ঠা খুলে আসে। ফন্ট সাইজ ১৪ এবং লাইন গ্যাপ দেড় পয়েন্ট মিনিমাম কখনও কখনও দুই। ব্যাপারগুলোর দিকে (নিউজপ্রিন্ট হিসেবে দাম, লেখার ফন্ট (এক সময় আমরা রবিনহুড বা তালিস্মান এর মতো বড় বইও পড়েছি অনেক ছোট ফন্টে এবং লাইন গ্যাপে) এবং অন্যান্য) কাজীদার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় উনি যে উত্তর দিয়েছিলেন আমাকে তার মোদ্দা কথা ছিল এরকম -
১। নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়েছে।
২। পাঠক কমে গিয়েছে আশঙ্কা জনক ভাবে। যেখানে আগে আমাদের বগুড়াতেই শুধু মুসলিম বুক ডিপো মাসুদ রানা ৪০০ কপি নেয়ার পরে প্রায়ই আবার নতুন অর্ডার দিত সেখানে এখন ১৫০ থেকে ২০০ কপি নেয় এবং তারও বেশ কিছু অবিক্রিত অবস্থায় ফেরত দেয়। অন্য বই গুলোর অবস্থান আরও খারাপ। রহস্য পত্রিকা গত বেশ কয়েক বছর ধরেই লসে চলছে। বন্ধ করতে পারছেন না কারন এইটা উনাদের অনেক আগে থেকে চালু একটা নিয়মিত প্রকাশনা। বন্ধ করলে সেটা পুরো প্রকাশনা ব্যবস্থার উপর খারাপ প্রভাব ফেলার সম্ভবনা আছে।
৩। লেখকদের এখন আরো অনেক বেশি টাকা দিতে হয় আগের তুলনায়। একই ভাবে দৈনন্দিন খরচের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও বেড়েছে মেশিন ম্যান, প্লেট মেকার এর বেতন থেকে শুরু করে মেশিন মোছার ছাট কাপড়ের দাম।
৪। সেবা যেহেতু লেখার ব্যাপারে পরনির্ভরশীল, অর্থাৎ তার কোনও মৌলিক লেখা নাই (রহস্য পত্রিকা ছাড়া), মোটামুটি ভাবে ভালো বইগুলো বেশিরভাগই অনুবাদ করা হয়ে গেছে। যেগুলো হয়নি সেগুলো দেখা যায় হয় ততোটা মান সম্পন্ন নয় অথবা কপিরাইট আইনে আওতায় আছে এখন। ৫০ বছর পার হয় নাই। তাই অনেক ছোট বইও অনুবাদ করতে হয়। কিন্তু ৫ ফর্মার নিচে বই করলে কোনওভাবেই খরচে পোষানো যায়না। তাই লাইন গ্যাপ বড় করে হলেও ৫ ফরমা করা হয়।
অন্য ছোটখাট প্রকাশনীগুলোর জন্য (যাদের নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থা নেই) আরেকটা বিষফোঁড়া আছে; নাম হকার সমিতি। এরা যে কি পরিমান খাচ্চর সেটা আমার নিজেরই অভিজ্ঞতা আছে।
তারপরেও বলব, ২০০ টাকার অফসেটের যায়গায় যদি ১০০ টাকাও হয় নিউজপ্রিন্টে, এবং বইমেলায় ২০% কমিশনে পাওয়া যায় তবে তার দাম পড়ে ৮০ টাকা। অর্থাৎ ২০০ টাকা দিয়ে যে কেউ ওরকম আড়াইটা বই কিনতে পারবে। আর বই রাখতে চাইলে যে কোনও বই-ই রাখা সম্ভব।
দেখি, মেলায় যদি সুযোগ পাই তবে জাফর ভাইয়ের মাথায় ঢুকানোর চেষ্টা করব। ধন্যবাদ হিম্ভাইকে বিষয়টা সামনে নিয়ে আসায়।
ভাল বলেছেন। আমাদের আলী সাহেবই কী এখনো ঠিক-- পাঠক কেনে না বলে বই সস্তা হয় না, আর সস্তা হয় না বলেই পাঠক কেনে না !
facebook
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে এনেছেন। ১০০% ভাগ সহমত।
স্যারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি লেখাটা!
----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!
স্যার কী বললেন, সেটা জানার অপেক্ষায় রইলাম।
স্যারের মতামতটাও জানাবেন, সম্ভব হলে।।
সেবার পেপারব্যাক বইগুলো না থাকলে আমার বই জগতে আসা হতো কিনা সন্দেহ। স্কুল বয়সে ক্লাসিক পড়ার সুযোগ দিয়েছিল সেবা প্রকাশনীর নিউজপ্রিন্টে ছাপানো বইগুলো। পচিশ ত্রিশ বছর পার হলেও সেই নিউজপ্রিন্টের বইগুলোর বিরাট একটা অংশ এখনো অক্ষত আছে স্মৃতিজাগানিয়া বই হিসেবে।
সাহিত্যপাঠের চেয়ে সাহিত্যবাণিজ্য অগ্রাধিকার পাওয়াতেই অফসেট পেপারে লেমিনেটিং বাইন্ডিং এর গার্বেজ বইতে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। মুশকিলের কথা হলো কিছু বই আছে (বিশেষ করে উপন্যাস) একবার পড়েই ডাস্টবিনে ফেলে দিলেই চলে। সেই বইগুলোও অফসেট পেপারে ছাপানো হয় লেমিনেটিং বাইন্ডিং করা হয়। পাঠকের দিকটা কেউ চিন্তা করছে না, না লেখক, না প্রকাশক। কিছু বই আছে ভেতরের পাতার চেয়ে মলাটের পুরুত্ব বেশী। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি।
প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা চাইলেই ব্যতিক্রম সৃষ্টি করতে পারে! করবে?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আসল পয়েন্টে ফোকাস করেছেন। "ব্যক্তি" থেকেই ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ আসে। "ব্যক্তি" চাইলেই উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। তারপর ব্যক্তির অনুকরণে "গোষ্ঠি" এতে জড়িত হয়। ধীরে ধীরে সমাজ এবং দেশ।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অসাধারণ লিখেছেন! ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
quote] ফন্ট গুলো প্রয়োজনের তুলনায় বড় হওয়াতে কাগজ বেশি লাগে। এটাও দেখা উচিত বলে মনে হয়।[
সহমত