জুন ১৩ ও জুন ১৪, ২০০৭ তারিখে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় এসেছে আবাসন শিল্পের কর্ণধারদের নিয়ে প্রতিবেদন। রিয়েল এস্টেট ও গৃহায়ন শিল্পপতিদের সংগঠন রিহ্যাব অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিজ এর কাছে অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিলেন সাম্প্রতিক বাজেটে ঘোষিত একটি রদ করা রীতি আরো এক বছরের জন্যে চালু রাখতে। রীতিটি হচ্ছে, নির্দিষ্ট হারে কর দিলে জমি বা বাড়ি ক্রয়ে ব্যয়িত টাকার উৎস সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়া হয় না। সোজা কথায়, কালো টাকার মালিকদের নিশ্চন্ত মনে আরো এক বছর জমিজমা ঘরবাড়ি কেনাকাটা করে টাকার রংটা পাল্টে ফেলার সুযোগ দেয়া হোক। অর্থ উপদেষ্টা সাফ না বলেছেন। রিহ্যাবের কর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তাঁদের শিল্প মারাত্মক ধ্বসের মুখোমুখি হতে পারে। তার পরদিন এসেছে আবাসন শিল্পের মোঘল বসুন্ধরার ব্যবসায়িক অপচর্চা নিয়ে কিছু কথা। বসুন্ধরার কর্ণধার বর্তমানে প্রবাসে আছেন, তাঁর সম্পর্কে রাজনীতির পান্ডাদের উৎকোচ প্রদান থেকে শুরু করে পুত্রের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগকে ঘুষ দিয়ে ধামাচাপা দেয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সাম্প্রতিক রিমান্ড জেরায়।
প্রতিবেদন পড়ে যা বোঝা যায় তা হচ্ছে, আবাসন শিল্পের হর্তাকর্তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী (হয়তো ঘুষ হিসেবে প্লট/ফ্ল্যাট/বাড়ির আবেদন নগদ টাকার চেয়ে বেশি), এবং তাঁদের শিল্পের স্ফীতি বহুলাংশে কালো টাকার ওপর নির্ভরশীল। এবং টাকার ব্যাপারে বর্ণবাদী না হতে যে আহ্বান তাঁরা জানিয়েছেন, তা সরাসরি দুর্নীতিবাজদের সহায়তা করবে।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কালো টাকা সাদা করার জন্যে সে টাকা গৃহায়নে বিনিয়োগের সুযোগ চালু করেছিলেন। তার আগে টাকার ধোলাই করতে হতো শিল্পকারখানা খুলে (যেখানো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়)। রাতারাতি ধোপাবাড়ির ঠিকানা বদল হওয়ার কারণে অঢেল কালো টাকার স্রোত ধেয়ে চলে আবাসন শিল্পের দিকে। অর্থনীতির সরল সূত্র অনুযায়ী সীমিত সরবরাহের বিপরীতে বর্ধনশীল চাহিদা অল্প সময়ের মধ্যেই আবাসন শিল্পের পণ্যগুলির মূল্য বাড়িয়ে তোলে দেড় থেকে দুইগুণ।
এর বিপরীতে রয়েছে ডেভেলপারদের পরিবেশউদাসীন কার্যক্রম। তারা অবলীলায় খাল বিল নদী সব দখল করেন, ভরাট করেন, তার ওপরে গৃহায়ন শিল্পের নানা প্রকল্প ঠাঁই গাড়ে। বর্ষায় এক রাতের বৃষ্টিতে এই ঘিঞ্জি ঢাকা শহরকে দেখায় অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া প্রবালতটের মতো। আশুলিয়াতে বর্ষার জলের তোড়ে ডুবে যায় গৃহায়ন প্রকল্পের প্লট তো কোন ছাড়, বিলবোর্ডও।
বর্ষার স্রোতের মতই মানুষ ধেয়ে আসছে নগরের দিকে, নগরায়ন তাই ছড়িয়ে পড়ছে কোন কিছু না ভেবে। চট্টগ্রামে খাল দখল শেষ করে আবাসন শিল্প জিভ বাড়িয়ে চেটে নিচ্ছে পাহাড়গুলিকে। ১২ই জুনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় কি কোন আবাসন শিল্পপতি জীবন্ত সমাধিস্থ হয়ে মারা পড়েছেন? উঁহু, বড়জোর তাঁর কোন বিলাসবহুল গাড়ি নষ্ট হয়েছে এনজিনে পানি ঢুকে।
জলবায়ুর সাম্প্রতিক পরিবর্তন প্রথমেই প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের মতো বদ্বৈপায়ন দেশগুলিতে। ওপরে হিমালয়ের হঠাৎ গলে যাওয়া হিমবাহের জলস্রোত পাহাড় ধ্বসিয়ে বয়ে আনবে পলি, ভাটিতে বাংলাদেশের নদীগুলো ভরাট হয়ে ঘন ঘন বন্যা দেখা দেবে, ঢাকা শহরের কুৎসিত কুপরিকল্পিত কংক্রীটের স্তুপ ডুবে থাকবে এক মানুষ পানির নিচে। কেবল তখনই হয়তো আবাসন শিল্পকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া যাবে, তার আগে নয়।
কেবল ক্রমশ দীর্ঘায়মান “সাময়িক” জলাবদ্ধতাই নয়, নগর বিপন্ন হতে পারে ভূমিকম্প থেকেও। নগরকে কুপরিকল্পনার হাত থেকে রক্ষার কাজে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিরা লুণ্ঠনে সহযোগিতা না করলে এভাবে ধর্ষিত হতো না শহরগুলি। হোক জল, হোক মাটি, নগর নিরাপদ নয় কারো হাত থেকেই। সাভারে শাহরিয়ার টেক্সটাইল আর তেজগাঁয়ে ফীনিক্স ভবন ধ্বসের পর উদ্ধারকার্যের মন্থরগতিই বলে দেয়, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা কতটা অসহায় হয়ে পড়বো।
বাংলায় এক কালে বাঘা নদী ছিলো করতোয়া, যমুনা ছিলো একটা খাল (হয়তো ভরাট হয়ে যেতো বেচারী)। হিমালয়ের গোড়ায় ভূমিকম্প হবার পর ব্রহ্মপুত্রের স্রোত পরিবর্তিত হয়ে করতোয়া-পুনর্ভবা-টাঙনের মতো বিশাল নদীগুলোকে স্রোতরুদ্ধ করে হত্যা করে, আর তাদের জল লুণ্ঠন করে যমুনা হয়ে ওঠে তেজস্বিনী এক বিশাল নদী। কিন্তু নদীর মৃত্যু ঘটায় বিপন্ন হয়ে পড়ে গৌড়ের প্রধান নগর লক্ষণাবতী, নদীর খাতে জন্ম নেয়া জলাশয় পরিণত হয় মশার অভয়াশ্রমে, এবং সুপেয় পানির অভাব আর পতঙ্গের দৌরাত্ম্যে মৃত্যু হয় ঝলমলে নগর লক্ষণাবতীর। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয় না, কিন্তু নিজের সাথে ছন্দ মেলায়, মার্ক টোয়েন বলেছিলেন। ঢাকার অদৃষ্টে কী আছে, কে জানে? ভূমিকম্পেরও প্রয়োজন নেই তার, আবাসন সংস্কৃতিই যথেষ্ঠ।
মুহাম্মদ বখতিয়ার সতেরোজন সেনা নিয়ে কমান্ডো হামলা করে পরাক্রমশালী লক্ষণ সেনকে হটিয়ে দিয়েছিলেন। রাজধানী তো দূরের কথা, ভাতের থালাও রক্ষা করতে পারেননি নদীয়ার রাজা। তবে পালিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলেন। আমাদের আবাসন সংস্কৃতি পা টিপে টিপে এসে ঘিরে ধরেছে আমাদের, দুর্যোগের সময় লক্ষণ সেনের মতো সৌভাগ্য সবার না-ও হতে পারে।
মন্তব্য
ঠিক। পরিস্থিতি যা দাড়াইতাছে চোখে আন্ধার দেখারো সময় থাকবো না।
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
টাকার রং থাকলে সাদা, কালো, লাল, সবুজ টাকা তৈরী হবে। কেউ যদি রংহীন টাকার একটা যুৎসই আইডিয়া বের করতে পারে তাহলেই যদি সমস্যার সমাধান হয়। যদিও টাকার গায়ে লেখা, "চাহিবা মাত্র বাহককে..." মানে দাবী অনুযায়ী কালো-টাকা বলে কিছু নেই।
অধুনা আবাসন সংস্কৃতিটাও একটা মিম গত বিশ বছরে অনেকটা অলক্ষ্যেই তৈরী হয়েছে। এর পেছনে কালো টাকার চেয়ে আমাদের প্রস্তুতির অভাবই বেশী দায়ী। যেমন, বাংলাদেশে হয়তো আরো ২/৩ কোটি মধ্যবিত্ত তৈরী হবে পরবর্তী দশ বছরে, এদের বসবাসের জন্য সেরকম কোন প্ল্যান কি আছে?
নতুন মন্তব্য করুন