১.
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখে হণ্ডুরাসের রাজধানী তেগুসিগালপা থেকে কিছু দূরে কোমায়াগুয়া শহরের কারাগারে আগুন [১] লাগে। পেনিতেনসিয়ারিয়া নাসিওনাল দে কোমায়াগুয়ার সাড়ে আটশো কয়েদীর মাঝে একজন রাজ্যপালকে ফোন করে চিৎকার করে বলে, এই কারাগার সে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেবে।
কেউ কেউ পরে অনুমান করেছে, তার বান্ধবী তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো তার আগের দিন, ১৪ তারিখ, ভালোবাসা দিবসে।
কম্বলে লাগানো আগুন মুহূর্তের মাঝে ছড়িয়ে যায় ব্যারাকে। শুরু হয় চিৎকার, হুড়োহুড়ি, একটু বাতাসের জন্য হাহাকার করা মানুষের আতঙ্কিত ধাক্কাধাক্কি। কারারক্ষীরা দরজা বন্ধ করে আকাশে ফাঁকা গুলি করতে থাকে। অগ্নিসেনারা এসে দাঁড়িয়ে থাকে বদ্ধ দরজার সামনে। ভেতরে তখন মানুষ পুড়ছে, কারাগারের দরজা বন্ধ।
আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসা একজন জানায়, প্রাণ বাঁচাতে বাইরে বেরিয়ে এসে সে দেখতে পায়, কারাকক্ষের গরাদে আটকে জ্যান্ত পুড়ে মরছে মানুষ। আরেকজন বলে, কারারক্ষীরা তাদের শত অনুনয়েও সাড়া দেয়নি, পুড়ে মরতে দিয়েছে, তবু কারাকক্ষের দরজা খোলেনি।
ছয়টা ব্যারাক পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায় সে আগুনে। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে স্নানাগারে ঢুকেছিলো, পানি দিয়ে আগুনের বিরুদ্ধে যুঝতে, লাভ হয়নি। তাদের পোড়া শরীর পাওয়া গেছে সেখানে। কেউ কেউ দেয়াল টপকে ছাদের ধাতব আবরণ সরিয়ে পালাতে চেয়েছে। কেউ পেরেছে, কেউ পারেনি। যারা পারেনি, তাদের পোড়া শরীরগুলো একটা অন্যটার সঙ্গে লেপ্টেছিলো, কমলার খোসার মতো করে ছাড়িয়ে তাদের ব্যাগে পুরে ফরেনসিক অনুসন্ধানের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
হণ্ডুরাসের ঐ কারাগারে কোনো শারীরিক বা মানসিক চিকিৎসার সুবিধা ছিলো না। পাঁচশো জনের জন্যে তৈরি কারাগারটিতে সাড়ে আটশোর মতো কয়েদি ছিলো, প্রত্যেকের খাওয়ার জন্য দিনে ১ ডলারেরও কম খরচ বরাদ্দ ছিলো।
১৫ ফেব্রুয়ারির আগুনে পুড়ে মারা যায় ৩৫৮ জন কয়েদী।
২.
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখে পাকিস্তানের করাচী শহরের বলদিয়া টাউনে আলি এন্টারপ্রাইজ, একটি পোশাক কারখানা, আগুনে [২] ভস্ম হয়। চারতলা কারখানার জানালায় ধাতব গরাদ লাগানো ছিলো, আগুন থেকে পালানোর জন্য কোনো নিষ্ক্রমণপথও ছিলো না। লাফিয়ে নামতে গিয়ে আহত হয় অনেকে, ভেতরে হুড়োহুড়িতে আহত ও নিহত হয় অনেকে। ছাদে ওঠার সিঁড়ির দরজা ছিলো তালা লাগানো। দারোয়ানদের কাছে চিৎকার করে চাবি চেয়েছিলেন ভেতরে আটকা পড়া কর্মীরা, তারা সাড়া দেয়নি।
অতি দাহ্য সব বস্তু দিয়ে বোঝাই ছিলো কারখানার ভেতরটা। দ্রুত বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে ভেতরে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় মানুষ, তারপর তাদের মৃতদেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। কর্মীদের ধারণা, জেনারেটরের ত্রুটি থেকেই আগুন ছড়িয়েছিলো।
বিবিসি সেদিনের খবরে ২৮৯ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে।
৩.
আশুলিয়ায় তাজরিন ফ্যাশনস নামের পোশাক কারখানায় আগুনে এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ স্বীকৃত ১১০ জন মানুষের মৃত্যু (বাস্তবে আরো অনেক বেশি হতে পারে) নিয়ে মিডিয়ায় নানা সংবাদ ও মত প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যবৃন্দ।
খবরের কাগজ থেকে জানতে পারি [৩],
সভায় সংগঠনটির সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘এই ঘটনায় মারা যাওয়া ৫৩ জন শ্রমিকের পরিচয় আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। তাই তাঁদের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। এই দায় আমাদের। আমরা এসব শ্রমিকের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারিনি। এ জন্য জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
আরো জানতে পারি [৪],
গণমাধ্যম নিয়ে সমালোচনার এক পর্যায়ে সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এক পর্যায়ে আলোচনার মূল বিষয়ে আসতে বক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। ... “হন্ডুরাসের জেলে একসঙ্গে ৩৬১ জন ও পাকিস্তানের করাচির একটি ফ্যাক্টরিতে ১৬০ জন মারা গেছে। সেই তুলনায় আমরা অনেক প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি। এগুলো মিডিয়াকে বুঝতে হবে,” বলেন তিনি।
আমরা জানতে পারি, এই সংগঠনের সদস্যরা তাদের কারখানার শ্রমিকদের জীবিত থেকে লাশ হয়ে যাওয়ার জন্যে নয়, বরং লাশের পরিচয় নিশ্চিত করতে না পারার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা জানতে পারি, পোশাক শিল্প মালিকেরা মনের গোপন কোণে নিজের কারখানাটিকে হণ্ডুরাসের কারাগারের সমকক্ষ ভেবে তুলনা করেন, ৩৫৮ সংখ্যাটি ১১০ এর চেয়ে অনেক বেশি, এই ভেবে তৃপ্ত থাকেন।
আমরা আরো বুঝতে পারি, আমাদের পোশাক শিল্প কারখানার একজন শ্রমিকের জীবন হণ্ডুরাসের একটি ঘিঞ্জি কারাগারের কয়েদীর জীবনের মতোই। অন্তত দৈনিক আয় আর অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচার সম্ভাবনার কথা ভাবলে, দু'জনের মাঝে পার্থক্য কোথায়?
আমি তাই হৃদয় নিঙড়ানো শুভাশিস জানাতে চাই হণ্ডুরাস ও করাচীর প্রতি। তারা দেখিয়েছে, আমাদের চেয়েও বড় শুয়োরের বাচ্চা আছে পৃথিবীতে। নাহলে শতাধিক পোড়া গরিবের লাশ নিয়ে আমরা কোথায় যেতাম, কার কাছে মুখ দেখাতাম?
[১] Honduras prison fire victims 'burned up against the bars, stuck to them': দ্য গার্ডিয়ান, ১৬-০২-২০১২
[২] Death toll from Karachi factory fire soars: বিবিসি, ১২-০৯-২০১২
[৩] বিজিএমইএ ক্ষমা চেয়েছে, গণমাধ্যমকেও দুষেছে: প্রথম আলো, ৩০-১১-২০১২
[৪] পোশাক শিল্প মালিকরা দুষছেন গণমাধ্যমকে: বিডিনিউজ২৪ডটকম, ৩০-১১-২০১২
মন্তব্য
গরীব মানুষগুলোর বোধ হয় আসলেই কোন দাম নেই। কারণ ওরা শ্রমিক! কারণ ওরা কাজ করে খায়! মুখ পিটাতে পারে না বলেই ওদের মরতে হয়
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
তথ্যসূত্র ৪ পড়ে শুয়োরের বাচ্চা কতবার বললাম- অগণিত!!
অমানুষ গুলারে বাইন্ধা গলায় ঠেসে ঠেসে টাকা ভরতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত দম না আটকিয়ে পটল তোলে।
facebook
একদম একেবারে সহমত...
সহমত।
সহমত...
শুয়োরের বাচ্চা সবগুলা।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
হ।
..................................................................
#Banshibir.
এইটাই আসল কথা
সূত্রপ্রাপ্ত উদ্ধৃতি
শত-শত মানুষের নৃশংস মৃত্যু/হত্যাকাণ্ড এদের হৃদয় বা বিবেককে নাড়া দেয় না। এরা বরং ‘উত্ত্যক্ত’ হয় !!! কিলবিলানো পোকামাকড় বা মশামাছির ভ্যানভ্যানিতে বা তাদের চটাশ করে মেরে হাতে কয়েক ফোঁটা নোংরা রক্ত লেপ্টে যাওয়ায় যেমনি অনেকে ‘উত্ত্যক্ত’ হয় আরকি!
দুনিয়ার তাবৎ ঘৃণা ও লানৎ তোরই প্রাপ্য। আমি ঘৃণাভরে তোর অস্তিত্ত্বই প্রত্যাখ্যান করছি!
গার্মেন্টসের শ্রমিকরা কি ক্রিমিনাল কয়েদী? ক্রিমিনাল কয়েদীরাও তো মানুষ এবং ঐরকম মৃত্যু তাদেরও প্রাপ্য না। আমাদের শ্রমিকরা কি তাহলে 'মানুষ'ও না???
রাক্ষস-দানব-ডান, খা* বাচ্চা, শু* বাচ্চা, মা*দ - সহ আরো অকথ্য গালাগালি ছাড়া আর কিছুই আসছে না মুখ দিয়ে!
****************************************
"এইযে গার্মেন্টসে আগুন নিয়ে এত প্রচার হচ্ছে এতে কি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছেনা। এতে কি আমাদের গারমেন্তস শিল্পে সুদুরপ্রসারি নেতিবাচক প্রভাব পরবেনা। আমরা আমাদের নেতি বাচক দিকে যতটা উচ্চকিত, ইতিবাচক দিকে অতটা কি?" আমার নিজের কথা না, এক স্বনামধন্য মেডিক্যাল প্রফেসরের উক্তি।
এসব শুনলে মনে হয়, যারা আগুনে পুড়ে মরেছে তারাই বুঝি মরে বেঁচে গিয়েছে। আর আমরা এসব দেখে দেখে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি।
বাড়াবাড়ি বলতে আপনি কি বুঝাচ্ছেন?
১১০ জন বাক্তির (কর্তৃপক্ষ স্বীকৃত সংখ্যা) মৃত্যুর বাপরে আমরা কি কোনো প্রশ্ন করতে পারবনা? ভবিষ্যতে এই ধরনের মৃত্যু ঠেকানোর জন্য বিজিএমইএ বা মালিক পক্ষ কি ব্যবস্থা নিবে সেই ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করা যাবেনা? এই ঘটনা যদি নাশকতামূলক হয়েও থাকে মালিক পক্ষ তার কারখানায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছিল কিনা বা নিতান্তই দুর্ঘটনা হলে দুর্ঘটনা ঠেকানোর কি ব্যবস্থা রেখেছিল, সেই ব্যাপারে প্রশ্ন করা যাবেনা?
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ যখন বলে " আমার কোমরে বাঁধা শার্ট দেখে আমার লাশ সনাক্ত করিও" তখন আসলে ঐ মানুষটার মনের ভেতর কেমন লাগে...... এত সহজে কিভাবে মানুষগুলো নিজেদের মৃত্যুকে সেই মুহুর্তে মেনে নেয়...............
ধুর, ওরা তো আসলে মানুষই নয়, দাস মাত্র......... সস্তা প্রাণের শ্রমদাস!!!!!!!!!!!!!!!!!
শুধু বিত্তবানেরা বেঁচে থাকবে, উল্লাস ভ'রে জীবন উপভোগ করবে গরিবের কাঁধে পা রেখে। গরিবগুলির আর বাঁচা-মরায় পার্থক্য কী? কেবল জীবিত অবস্থাতে ধনীর কাজে লাগলেই হলো।
তামান্না ঝুমু
শেষ পর্যন্ত হয়ত টাকশালগুলোই টিকে থাকবে পৃথিবীতে, খরচ করার জন্য মানুষ থাকবেনা কোথাও।
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
শুধু শুধু শুয়োর নামের একটা প্রানীকে অপমান করলেন এইসব অপ্রাণীদের সাথে তুলনা করে। আপনি আমাকে একটা ঘটনা দেখান যেখানে শুয়োর তার স্বজাতির সাথে এইরকম বেঈমানী করেছে। এই অমানুষগুলোকে বরং হন্ডুরাসের মতো জেলে ভরে বাইরে থেকে আগুন লাগিয়ে দিলে ঠিক হতো।
ফারাসাত
তালার মালিকেরা বড় বর্বর!
কিছু বলতে ইচ্ছা হয় না আজকাল। কি হবে বলে? বলার আগেই আরেকটা লঞ্চ ডুববে, আবার আগুন লাগবে আবার কেউ অমানবিক কিছু বক্তব্য দেবে।
--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।
হুম।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অসাধারণ!
নতুন মন্তব্য করুন