ভারি ভারি যন্ত্র এখন সাভারের রানা প্লাজায় সক্রিয়। বিশাল সব ক্রেন আর আর্থমুভিং মেশিনসের ইস্পাতের চোয়ালের সামনে স্তুপীকৃত কংক্রিট-ইস্পাত আর তার ফাঁকে ফাঁকে পিষ্ট মৃতদেহ, সেলাইয়ের যন্ত্র, বয়লারের পাইপ আর কাপড়ের স্তুপ সমান অর্থ বহন করছে। এই ধ্বংসস্তুপ সরে যাবে, কিছুদিন পর আবার সবকিছু একটু একটু করে পুরোনো চেহারা ফিরে পাবে, হয়তো পড়ে থাকা ইঁট-বালুর কণার স্তুপ থেকে জেগে উঠে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাসবে একটা ছোট্টো ঘাসফুল। আমরাও আমাদের সব উত্তেজনা বিলিয়ে দেবো নতুন কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার পেছনে।
কিন্তু আমি অনুভব করি, পৃথিবীতে সুখের একমাত্র উপকরণ অ্যাপ্যাথি। চারপাশের জগতকে নির্বিকার অনীহাভরা চোখে দেখে বৈরাগ্যসাধন ছাড়া সুখ মিলবে না। বাংলাদেশের মানুষ হয়ে তাই আমিও জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অসুখী। আমি কারো অভাব দূর করতে পারি না, কার্পণ্যের কারণে কথায় কথায় দান করতে পারি না, কিন্তু অভাবী মানুষের কাতর মুখ আমাকে পীড়া দেয়। প্রতিটি দারিদ্র্যের গল্পই উল্কির মতো করাঙ্ক এঁকে যায় বুকের ভেতরে। আমি বুঝতে পারি, এই উদাহরণগুলোকে কার্পেটের নিচে চাপা না দিয়ে আমি স্বস্তি পাবো না। তাই আমার কার্পেট সময়ের সাথে উঁচু হয়। যখন আর স্নায়বিক চাপ সহ্য করতে পারি না, তখন সরে থাকার চেষ্টা করি, অচেতন হয়ে থাকতে চাই, কাজ হয় না।
সাভার আমাকে শিখিয়ে গেলো, অর্থের অভাব ঐ চাপা পড়া মানুষগুলোর প্রধান সমস্যা নয়। তারা ভিখিরি নয়, তারা কাজ করে জীবনযাপনের জন্যেই এক একটা কারখানার বন্দীশালায় ঢোকে, যাদের সৌভাগ্য আছে, তারা বেরিয়েও আসে। বছর বছর শুধু তাদের কেউ কেউ পুড়ে মরে, কেউ পিষ্ট হয়ে মরে। এই মানুষগুলোর অভাব ভালোবাসার। যারা এদের কাজ দেয়, তাদের এতটুকু ভালোবাসা নেই এই মানুষগুলোর জন্যে। এদের মৃত্যু একটা নুইস্যান্সমাত্র, ভাবমূর্তির গায়ে এক একটা আঁচড়, অর্ডার সামলানোর কাজে একটা বিলম্ব, সংবাদকর্মীদের জন্যে আরেকটা ক্লান্তিকর বিনিদ্র বিট। কোনো নীতিনির্ধারকের চোখে সামান্য অশ্রু টলমল করতে দেখলাম না, বিজিএমইএ নামে প্রমত্ত সংগঠনটির কোনো কাণ্ডারীর পকেটের টিস্যু আর্দ্র হতে দেখলাম না একবারও। দগ্ধ আর পিষ্ট অভাগাদের জন্যে যারা কাঁদে, তাদের কান্না নিরর্থক।
আমি কামনা করি, যারা গত কয়েকটি দিন ধরে অনাত্মীয় এই অভাগাদের প্রাণ বাঁচাতে রক্ত দিয়েছেন, ওষুধ দিয়েছেন, অক্সিজেন দিয়েছেন, কায়িক পরিশ্রম দিয়েছেন, আর দুর্মূল্য ভালোবাসা দিয়েছেন, তাদের হাতে একদিন আমরা বাংলাদেশকে তুলে দিতে পারবো। সাভারের ভার তার আগ পর্যন্ত আমাদের বুকে চেপে থাকবে।
হি হু সেইভস আ লাইফ, সেইভস দ্য ওয়র্ল্ড এনটায়ার। আপনারা আমার চেনা পৃথিবীকে বাঁচান।
মন্তব্য
তাদের হাতে একদিন বাংলাদেশের ভার তুলে দিতে পারব, তার আগ পর্যন্ত সাভারের ভার আমাদের বুকে চেপে থাকবে - । হক কথা বলছেন ভাই।
হিমু, এই রকম করে ভাবার মানুষ দূর্ভাগা বাংলাদেশে বিলীয়মান। আপনার জননীকে শ্রদ্ধা জানাই এই রকম সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য। একদিন নিশ্চয়ই বদলাবে দূঃখিনী বাংলাদেশ।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা শৈশব থেকে শেখায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, উচু-নীচু। তাই এরাও যে ঠিক আমাদেরই মতো মানুষ, ধ্বসে পড়া ভবনের ধ্বংস স্তুপের নীচে ৭২ঘন্টা আটকে থাকতে যে কী কষ্ট...দিনের শেষে এইসব মানুষের কোলে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য যে শিশুটি অপেক্ষায় ছিল সেই শিশুর জন্য যে আর কোন কোল নেই...এই সব কষ্টকে দেখার চোখ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই, সমাজ ব্যবস্থায় নেই। আছে শুধু মুনাফা আর টাকার পাহাড় তৈরী করার অমানবিক শিক্ষা।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
নানান ব্যাপারে বৈদেশিক সাহায্য নেবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে দেশের অফিসিয়ালরা, কিন্তু উদ্ধারকাজে সাহায্য প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় ন্যাশনাল প্রাইড এর ধোয়া তুলে।
ভালোবাসার কথা তো অনেক লেখা হলো। এইবার আসেন ঘৃণার কথা লিখি। মানুষকে এতটা ঘৃণা শিখিয়ে দেওয়া দরকার, যাতে শুয়োরের বাচ্চাদের জীবন আনসাস্টেইনেবল হয়ে যায়।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
- সহমত
বস ড্যাভিড বার্গম্যানের লেখা নিয়া দেখি ব্যাপক তোলপাড় শুরু হইছে, এই ব্যাপারে লেখা চাই। ঘটনা সত্যি না মিথ্যা এই ব্যাপারে কিছু লিখেন। দয়া করে লিখুন, খবরটা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে
আমাদের ভার ক্রমশ বাড়ছে। আশা করি আমরা চাপা পড়বো না।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সুবোধ অবোধ
এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল একদিন আমরা যে ভাঙবোই
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
দেশ মানে কেউ ভোরের স্লেটে লিখছে প্রথম নিজের নাম
হাওয়ায় বুকে দুলছে ফসল একটু বেঁচে থাকার দাম।
এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক এই দাবানল পোড়াক চোখ
আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক।
সাভারের ভার তার আগ পর্যন্ত আমাদের বুকে চেপে থাকুক
সাভার আমাকে শিখিয়ে গেলো, অর্থের অভাব ঐ চাপা পড়া মানুষগুলোর প্রধান সমস্যা নয়। তারা ভিখিরি নয়, তারা কাজ করে জীবনযাপনের জন্যেই এক একটা কারখানার বন্দীশালায় ঢোকে, যাদের সৌভাগ্য আছে, তারা বেরিয়েও আসে।
সেটাই।
জানিনা সেটা কবে সম্ভব হবে তবে বুকে আশা নিয়ে থাকতে হবে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
নতুন মন্তব্য করুন