২০১৬ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) সাথে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেডের (বিএইচইএল) একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় [১]। এ চুক্তির আওতায় বাগেরহাটের রামপালে ৬৬০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাচালিত ইউনিটের মাধ্যমে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে চলনতৈরি অবস্থায় বিআইএফপিসিএলের কাছে হস্তান্তর করবে বিএইচইএল।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের উত্তর সীমান্ত থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ বনাঞ্চল এবং বহু বিপন্ন প্রজাতির একমাত্র আবাসভূমি সুন্দরবনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন বিভিন্ন মহল। সুন্দরবন নিয়ে দেশের নাগরিকদের উদ্বেগকে তাচ্ছিল্য করার কিংবা ক্ষতির সম্ভাবনাকে অস্বীকার করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। সুন্দরবনের ওপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্লেষণও এই লেখার আধেয় নয়। আমি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে একটি মহলের প্রচারণার পেছনে কয়েকটি ভুল ধারণা এবং/অথবা মিথ্যাকে ধরিয়ে দিতে চাই কেবল।
সুন্দরবন বাংলাদেশের অন্যতম সুরক্ষাপ্রাচীর। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর যে অমিত শক্তিশালী ঝড় ভূখণ্ডের দিকে ধেয়ে আসে, তার একটি বড় অংশ কাবু হয়ে পড়ে সুন্দরবনের কারণে। সুন্দরবনের ক্ষতি তাই কেবল এর একক জৈবমণ্ডলের জন্যেই নয়, বাংলাদেশের মানুষের জন্যেও এক বড় ও সরাসরি হুমকি। তাই সুন্দরবন প্রসঙ্গে কারোই শৈথিল্য প্রদর্শনের অবকাশ নেই। কোনো নাগরিক যদি সুন্দরবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, সরকারকে সে উদ্বেগ প্রশমনের জন্যে ব্যবস্থা নিতে হবে। রামপাল নিয়ে সরকারের তরফ থেকে নাগরিক উদ্বেগ প্রশমনের জন্যে কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ দেখা যায় নি। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কিছু মৌখিক আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কেবল, যা প্রমাণ করে, সরকারের সংশ্লিষ্ট অংশ তার নিজের দায়িত্ব পালনে উদাসীন বা অপারগ।
কিন্তু এর বিপরীতে জনমনে উদ্বেগ ছড়ানোর জন্যে প্রচুর লেখালেখি চলছে। সেগুলোর বেশির ভাগই যৌক্তিক। কিন্তু একটি অংশ সুন্দরবনের আশু ধ্বংসের চিত্র এঁকে যাচ্ছে ক্রমাগত, যার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সুন্দরবন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নাগরিকদের অজ্ঞতা বা অস্বচ্ছ ধারণা, সেইসাথে কিছু অসত্য আর অপ্রযোজ্য যুক্তি। সেগুলোর খানিক ব্যবচ্ছেদ করাই আমার প্রয়াস।
সুন্দরবন নিয়ে আমরা প্রতিটি মুহূর্তে সজাগ আর উদ্বিগ্ন থাকতে চাই, কিন্তু ভুল বা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে নয়।
সচলায়তনে প্রকাশিত একটি পোস্টে জনৈক অতিথি লেখক সুন্দরবনের ওপর রামপালের কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গবেষণালব্ধ সূত্রসহ আলোচনা করেছেন [২]। পাঠকের আলোচনায় প্রসঙ্গটির কয়েকটি দিক আমাদের সামনে প্রসারিত হয়েছে।
এর মাঝে একটি আগ্রহোদ্দীপক দিক হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভারতীয় কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা থাকায় জনমনে বিরূপ ধারণা। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশ বৈরী মনোভাব পোষণ করে, যার পেছনে সঙ্গত ও অসঙ্গত কারণ রয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যে দরপত্রে অংশ নেয় দুটি কনসোর্শিয়াম ও একটি কোম্পানি [৩], যথাক্রমে:
(১) জাপানের মারুবেনী করপোরেশন ও ভারতের লারসেন এন্ড টুবরো লিমিটেড কনসোর্টিয়াম,
(২) চীনের হারবিন ইলেক্ট্রিক ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড ও ইটিইআরএন এবং ফ্রান্সের আলসটম কনসোর্টিয়াম
(৩) ভারতের কোম্পানি ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেড (বিএইচইএল)।
দরপত্রের বিচারে চীনের হারবিনগোষ্ঠী ভারতের বিএইচইএলের কাছে হেরে যায়। রামপালে চীনের উদ্যোগে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে একটি মহলের তরফ থেকে সুন্দরবন নিয়ে এখন যে অ্যাপোক্যালিপ্সু প্রচার চালানো হচ্ছে, সেটা দেখা যেতো না বলেও অনেকে মনে করেন। চীনের প্রতি তাত্ত্বিক ও আর্থিক কারণে দুর্বল এই গোষ্ঠীটি কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতির ওপর ভারতবিদ্বেষের প্রলেপটি সুচারুভাবে মাখিয়ে জনসমক্ষে উপস্থাপন করায় বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে জনমানসে সুন্দরবনকে ইতিমধ্যে খরচের খাতায় ধরে নেওয়ার একটি প্রবণতা দৃশ্যমান হয়েছে।
সুন্দরবনের সাথে ভারতবিদ্বেষের সেতু হিসেবে একটি কথা এই গোষ্ঠীটি প্রবলভাবে প্রচার করছে। সেটি শুনতে অনেকটা এমন:
ভারতের আদালত (প্রচারান্তরে সুপ্রিম কোর্ট) তো সুন্দরবনে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে দেয় নি। তাহলে ভারত কেন বাংলাদেশের সুন্দরবনে এই কেন্দ্র বানাচ্ছে?
খোঁজ-না-রাখা শ্রোতা/পাঠকের কাছে এ প্রশ্নটির সাথে প্রশ্নের আড়ালে উত্তর আকারে থাকা এক গোপন গভীর ষড়যন্ত্রও উন্মোচিত হয়। নিশ্চয়ই ভারত বাংলাদেশের সুন্দরবন ছারখার করার জন্য এই কাজ করেছে, যেভাবে তারা সানি লিওনকে দিয়ে আমাদের তরুণ সমাজের বাম হাতের পেশী ছারখার করে যাচ্ছে। কারণ দুশ্চরিত্র ভারত তো সারাক্ষণ এগুলোই করে, তাই না? যদিও "সুন্দরবন ধ্বংস করার এই হীন চক্রান্তে" শামিল হওয়ার জন্য কেন "জাপান", "চীন" ও "ফ্রান্স"ও দরপত্রে অংশ নিয়েছিলো, সে ব্যাপারে (বিশেষ করে চীনের ব্যাপারে) মহলটি চুপ থাকে।
"সুন্দরবনে" কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর ব্যাপারে ভারতের আদালতের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি নিয়ে আরো খোঁজ করলে আমরা একটা সাধারণ, আটপৌরে গল্প জানতে পারবো। এই পোস্টের সেটিই উপজীব্য।
ইউনিভার্সাল ক্রিসেন্ট পাওয়ার প্রাইভেট লিমিটেড (ইউসিপিপিএল) নামে একটি বেসরকারি কোম্পানি, যেটি ইউনিভার্সাল সাকসেস এন্টারপ্রাইজ [৪] নামে একটি ব্যবসাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় হুগলি নদীব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলদি নদীর মোহনায় অবস্থিত নয়াচর নামের একটি দ্বীপে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্যে পরিবেশ ছাড়পত্র চেয়ে ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের কাছে ধর্ণা দেয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্রমান্বয়ে মোট ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্যে ইউসিপিপিএলের একটি বোঝাপড়া হয়, এটি তারই প্রথম ধাপ।
পরিবেশ ছাড়পত্রের প্রক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গণশুনানির আয়োজন করে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক বরাবর যাবতীয় তথ্য ও দলিল পাঠায়। সেখানে ২০১২ সালের ৫-৬ মার্চ বিশেষজ্ঞ কমিটি শুনানির তথ্য যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্তে আসেন, প্রস্তাবিত স্থানটি পরিবেশগত দিক থেকে সংবেদনশীল, তাই সরজমিন পরীক্ষা করে দেখতে হবে, নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যাবে কি না। ২০১২ সালের ১০-১২ এপ্রিল তাঁরা নয়াচরে গিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে বলা হয়, নয়াচর হুগলি নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে বলে এটি একাধারে মোহনার পরিবেশ ও হুগলি চ্যানেলের নাব্যতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। এখানে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করলে হুগলির মোহনার পরিবেশ ও নাব্যতা দুটিই ব্যাহত হবে। সেই সাথে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্গমন এই নয়াচরে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদবলয়ের ক্ষতি করলে নয়াচরের গাঠনিক ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে পারে (পোস্টলেখকের নোট: যা আবার ঘুরে ফিরে হুগলি চ্যানেলের নাব্যতাকে প্রভাবিত করবে)।
মোদ্দা কথা, নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র করলে কলকাতা বন্দরে জাহাজ ঢুকতে সমস্যা হবে।
ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটির এই প্রতিবেদনে নয়াচরের সাথে সুন্দরবনের কোনো সম্পর্ক নেই। মাতলা নদীকে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের পশ্চিম সীমান্ত ধরলে সেখান থেকে নয়াচর প্রায় ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। পাঠকের জন্যে গুগল ম্যাপে নয়াচর ও সুন্দরবনের অবস্থান পরিবেশন করা হলো।
নয়াচরের সাথে সুন্দরবনের সম্পর্কের একটি (প্রথম) সূত্র এখানে প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে ম্যানগ্রোভ। ম্যানগ্রোভ বা গরানজাতীয় উদ্ভিদ ক্রান্তীয় সকল উপকূলেই দেখা যায়। নয়াচরে যেমন ম্যানগ্রোভ রয়েছে, তেমনই রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে, তেমনই রয়েছে মহেশখালীতে। সাতক্ষীরা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেসব ভূভাগ জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় আর ভাটার পানিতে জেগে ওঠে, তার সবটুকুই ম্যানগ্রোভের দখলে। পাঠক, এই সূত্রটা একটু স্মরণে রাখুন।
এদিকে সরজমিন হন্তদন্ত তদন্ত শেষে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রতিবেদনের সিদ্ধান্তে জানালেন, মোহনায় গড়ে ওঠা চরে কোনো ধরনের ভারি শিল্প স্থাপন চলবে না। নয়াচর যেমন ছিলো তেমন রেখে দিতে হবে। এটাকে ম্যানগ্রোভের বিস্তার সম্পর্কে জানার জন্যে এক প্রাকৃতিক গবেষণাগার হিসেবে দেখতে হবে। বড়জোর এখানে পরিবেশপর্যটন করা যেতে পারে, নয়তো নোনাপানির ঘের।
সেইসাথে তারা উল্লেখ করেন, এই প্রকল্পের প্রস্তাবে কোথাও বলা নেই যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মোহনায় অবস্থিত এমন একটি চরে স্থাপন করা হবে। অর্থাৎ, ইউসিপিপিএল গোড়াতেই ব্যাপারটা চেপে রেখে কাগজপত্র জমা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটি এই প্রতিবেদন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আমলাদের সামনে ইউসিপিপিএলের প্রতিনিধিদের কাছে উপস্থাপন করে বলেন, আপনারা এটা ভালোমতো পড়েশুনে আবার আমাদের কাছে আসবেন। ইউসিপিপিএলকে বিকল্প জায়গা খোঁজার পরামর্শও তারা দেন।
কিন্তু অচিরেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার একটি পাল্টা কমিটি গঠন করে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটির এই প্রতিবেদনকে নাকচ করে দেন। পাল্টাকমিটি বলে, সবকিছু ঠিকাছে। নয়াচর মোটেও সিআরজেড বা উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ এলাকা নয়। আলবাত বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো চলবে।
পাঠক, এখানে আলগোছে বলে রাখি, উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ এলাকা হচ্ছে ভারতের পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৮৬তে বর্ণিত এলাকা, যা মূলত জোয়ারের সময় ডুবে যায়, আবার ভাটার সময় জেগে ওঠে [৫ এবং ৬]। জোয়ারসীমা থেকে দূরত্ব হিসাব করে এই এলাকাকে আবার চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রথম ভাগ সিআরজেড ১ সবচেয়ে নাজুক।
প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ গুতাগুতির সাথে সামান্য হলেও পরিচিত, তারা জানেন, সরকারের এক অংশের কমিটির সাথে সরকারের অন্য অংশের কমিটির লড়াইকে সংক্ষেপে "লালফিতা পর্ন" বলা যেতে পারে। তার ওপর ভারতে এ ঘটনায় লড়াই আবার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজ্য সরকারের। তাই একটা পর্যায়ে এসে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি বললো, সবই তো বুঝলাম, এইবার তিনমাসের মধ্যে আটখান দলিল দাখিল করেন দেখি। এই আট দলিলে তারা সাত ধরনের বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন আর মামলার বৃত্তান্ত চেয়ে বসেন।
এরপর দিন গেলো, মাস গেলো, কিন্তু প্রকল্পের প্রস্তাবকদের আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। তারা বিবেকের মতো, ঈশ্বরের মতো, তথ্যসূত্রের দাবির মুখে বামাতি বিপ্লবী ভাইদের মতো নির্বাক, মৌন মেরে রইলো।
ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক তিন মাসের মধ্যে জিনিসপাতি না পেয়ে এই প্রকল্পের প্রস্তাব তাদের নথি থেকে ডি-লিস্ট করে দেয়। যদিও তারা ২০১৪ সালের ১০ জানুয়ারিতে একটা চিঠি আর ২১ অগাস্ট একটা তাড়া দিয়ে প্রকল্পের বাপমাদের তাগাদা দিয়েছিলেন, কিন্তু ঐ আট দলিলের ঘায়ে ঘায়েল ইউসিপিপিএল আর সাড়াশব্দ করে নি।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উপকূলীয় এলাকা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এসসিজেডএমএ) সেই ২০০৮ সালে ২৮ জানুয়ারি নয়াচরের কিসিম পাল্টে সিআরজেড-১ থেকে সিআরজেড-৩ করার প্রস্তাব করেছিলো, কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রক সেখানেও দুটো খাটনি ধরিয়ে দেয়। বলা হয়, এসসিজেডএমএ তাহলে নতুন করে নয়াচরের জন্য উপকূলীয় এলাকা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করবে, আর নয়াচরে তীরসুরক্ষা কাঠামো নির্মাণ করতে গেলে তার জন্যে মন্ত্রকের অনুমোদন নিতে হবে।
এই হচ্ছে নয়াচর নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে ভারতের রাজ্য সরকারের (যারা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করাতে চেয়েছিলো) মধুর লালফিতা-পূর্বরাগ। এ একটা ফাইল দিয়ে মারে, তো ও আরেকটা ফাইল দিয়ে মারে।
এদিকে নয়াচরে যেসব জেলেরা মাছ ধরে খান, তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন নি। নয়াচরে তাদের লোনাপানির ঘের রয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়লে সেটা পয়মাল হবে। তাই তারা সোজা চলে গেছেন কলকাতা উচ্চ আদালতে, রিট ঠুকে দিয়েছেন।
পাঠক, ম্যানগ্রোভের পর নয়াচরের সাথে সুন্দরবনের দ্বিতীয় সম্পর্ক এই রিটে রয়েছে। রিটে এই জেলেরা বলেছিলেন, নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়লে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লক্ষ্য করুন, এটা রিটের ভাষ্য, আদালতের বক্তব্য নয়, বা কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন নয়।
রিটের জের ধরে ভারতের জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনাল নয়াচরের জেলে সমবায় সমিতির দাবি পূরণ করে রায় দেন এবং বলেন, যেহেতু নয়াচর নাজুক সিআরজেড ১ এলাকা হিসেবে শ্রেণিকৃত, কাজেই এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চলবে না।
ঘটনা এতটুকুই [৭]।
চীনের হারবিনগোষ্ঠী যখন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো, দেশে ময়দানে নামলো বামপাল গোষ্ঠী। তারা গলা ফাটিয়ে বলে যেতে লাগলো, এবং এখনো বলে যাচ্ছে, ভারতের আদালত সুন্দরবনে বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে দেয় নাই আর ভারত আমাগো সুন্দরবনে আইসা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাইতেছে, সুন্দরবনটারে জ্বালাইয়া কালা বানাইবো, আমি দ্যাশের মালিক আমি এইসব চাই না, হ্যানোত্যানো। তাদের কল্যাণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরু আদালতের গাছে উঠে যাচ্ছে প্রতিদিন। কেন সুন্দরবন জ্বালিয়ে কালো বানানোর জন্যে চীনা হারবিন দরপত্রে অংশ নিয়েছিলো, সে প্রশ্নটা আপাতত চাপা আছে।
ফ্যাক্ট হচ্ছে:
১. ভারতে কেউ "সুন্দরবনে" বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চায় নি, করতে চেয়েছে নয়াচরে, যেটা সুন্দরবন থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে।
২. আমাদের দেশেও কেউ "সুন্দরবনে" বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে না, করছে রামপালে, যেটা মংলা বন্দরেরও উত্তরে, সুন্দরবনের উত্তর সীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে (ক্ষয়ক্ষতি হবে কি হবে না, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত কাম্য)।
৩. নয়াচরে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল হয়েছে কলকাতা বন্দরের হুগলি চ্যানেলে নাব্যতা হারানোর আশঙ্কা থেকে, সুন্দরবনের ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে নয়।
৪. সুন্দরবনের সাথে এই পরিবেশ ট্রাইবুনালের রায়ে নিষিদ্ধ নয়াচর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটির সাথে কেবল দুটো সূত্র জড়িত, এক, "ম্যানগ্রোভ" শব্দটি, দুই, মামলার বাদী জেলেদের রিটে বর্ণিত আশঙ্কা (আমাদের দেশেও রিট ঘাঁটলে "তরুণ সমাজ ধ্বংস" হওয়ার কথা পাওয়া যায়)। আদালতের রায়ে বা বিশেষজ্ঞদের মতামতে নয়াচরের প্রকল্পের সাথে সুন্দরবনের কোনো সংযোগ নেই।
৫. নয়াচরের সাথে একই কষ্টিপাথরে রামপালকে যাচাই করলে দেখা যাবে, রামপাল কোনোভাবেই সিআরজেড ১ বা এমন নাজুক কোনো এলাকা নয়। রামপাল জোয়ারের সময় পানির নিচে তলায় না, ভাটার সময় জেগে ওঠে না।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে কি তাহলে সুন্দরবনে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবে না? আমরা কি সুন্দরবন নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবো না? পান থেকে চুন খসলেই কৈফিয়ত চাইবো না সরকারের কাছে?
নিশ্চয়ই আমরা উদ্বিগ্ন থাকবো, সরকারকে এই প্রসঙ্গে দৌড়ের ওপরে রাখবো, সুন্দরবনের ওপর রামপালের প্রভাব নিয়ে সরকারকে সম্ভাব্য সব রকমের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে মত জানাতে চাপ দেবো, সেগুলো নিয়ে নিত্য কথা বলবো, চিৎকার করবো, প্রয়োজনে রাস্তায় নামবো।
কিন্তু ধান্ধাবাজদের ছড়ানো অসত্যের ওপর ভিত্তি করে নয়। সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্যে মিথ্যুক বামপালের ছাতার নিচে আমাদের মাথা ঢোকাতে হবে কেন?
তথ্যসূত্র:
[১] বিডিনিউজ২৪.ডম: রামপালে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি
[২] সচলায়তন.কম: আসেন সুন্দরবনকে ধ্বংস করি
[৩] দৈনিক ইত্তেফাক: রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভেল-এর সাথে চুক্তি মার্চে
[৪] www.usel.biz
[৫] ভারতের পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন, ১৯৮৬
[৬] উপকূলীয় নিয়ন্ত্রণ এলাকা প্রজ্ঞাপন, ১৯৯১
[৭] নয়াচরে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে ভারতের জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনালের পূর্ণাঙ্গ রায়
মন্তব্য
আপনার ম্যানগ্রোভের যুক্তি মানলাম, কিন্তু সবাই যে বলছে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তাদের মামারা নির্বংশ হবেন! আশাকরি ২য় পর্বে সে ব্যাপারে কিছু তথ্য পাব।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদে কী কী ক্ষতি হতে পারে, সেগুলো নিয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বিশদ বলতে পারবেন।
তবে রামপালে কোনো কিছু হওয়ার আগেই এদিকে সুন্দরবনে বাঘ মেরে সাফ করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম এ আজিজ কীটনাশক ফুরাডন দিয়ে বাঘ মারার কথা জানিয়ে এই কীটনাশক বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন এখানে।
কিন্তু আমাদের দেশে হুজুগে মাতা যতোটা সহজ, ফুরাডন নিষিদ্ধ করা ততোটাই কঠিন। কোনো বামপালিকে ফুরাডন নিষিদ্ধের জন্যে জনসংযোগ করতে দেখবেন না। দেশের হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা মালিকদেরও এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নাই।
য়্যাকদম!
পুনশ্চঃ লেখাটা 'নিরপেক্ষ' হয়নাই। আপনি ভারতীয় চিত্রনায়িকা সানি লিওনহেতু বাংলাদেশের তরুণসমাজের বামহাত নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন। অথচ, সেই ভারতেরই প্রভাবশালী জনৈক চ্যানেল মালিক কর্তৃক এদেশের তরুণ সমাজের ডানহাতের কি অবস্থা, সেদিকে আলোকপাত করেন নি। ভিন্ন উৎস ব্যাবহারসত্বেও বামপালীদের বক্তব্যপদ্ধতির সঙ্গে ডাক্তার সায়েবের বক্তব্যপদ্ধতির প্রচণ্ড মিল আছে।আপনার এই বামহস্তবাদী মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাই।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ঝাকানাকা গোয়েন্দা কি রামপালে না বামপালে?
...........................
Every Picture Tells a Story
"ভারতে কেউ "সুন্দরবনে" বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চায় নি, করতে চেয়েছে নয়াচরে"
এই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার ছিল । ভালো লিখছেন । তবে অন্যান্য আরো কিছু বিষয়ে বিশদ আলোকপাত করা দরকার ছিল । এক্সপার্টরা তো এই বিষয়ে লেখালেখি একরকম ছেড়েই দিয়েছে বলা চলে । যা দেখতেছি তা কেবল প্রোপাগান্ডা ।
যেমন সরকার তাত্বিক ভাবে সরকার যতই দেখাক রামপাল পরিষ্কার, কোন ভয় নাই, সুন্দরবনের জন্য একটা লংটার্ম রিস্ক রয়েই যাচ্ছে। অন্য কোন ইকোসিস্টেম হলে ভয়টা কম ছিল। নদীভিত্তিক ইকোসিস্টেম হওয়ায় ভয়টা অনেক বেশি । বাংলাদেশের নৌপরিবহন আঈন বেশ ঢিলাঢালা রকমের এবং বেশ বড় ধরনের দুর্ঘটনার ( প্রানহানী এবং পরিবেশের উপর হুমকি ) পরেও এই ঢিলেঢালা ভাবে তেমন পরিবর্তন আসে নি । গত কয়েক বছরের আলোকে জোর দিয়েও বলা যায় ভবিষ্যতেও আরো তেল এবং কয়লা বাহী জাহাজ ডোবার সম্ভবনা আছে । রামপালে কয়লা সরবরাহকারী লাইটার কার্গোর যাতায়াত বেড়ে গেলে সেই সম্ভবনা আরো বাড়বে বই কমবে না ।
পাশাপাশি অ্যাশ এবং ট্রিটেড ওয়াটার পশুরে রিলিজ করার সমস্যাটা তো আছেই ।
সুন্দরবন তো ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। তাদের নীতিমালায় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কিত কোন আলাদা নীতিমালা আছে কি ? নাকি খুব জেনেরিক নীতিমালা ?
মামুনুর রশীদ [ ভবঘুরে শুয়োপোকা ]
========================
mamun babu ২০০১ at gmail.com
হাজার মানুষের ভিড়ে আমি মানুষেরেই খুজে ফিরি
রামপালের যুক্তিগুলা তো দেখি সুন্দরবনের নদীগুলার মতোন। পয়লা দেখতে একই রকম লাগে কিন্তু বৈঠা বাইয়া গেলে দেখা যায় এই নদী সেই নদী নয়; অন্য
হাঁ ভাই, বৈঠা ভাঙা থাকলে নদী ব্যাঁকা।
তবে যত যাই বলেন হিমু ভাই, বামাতিদের এই প্রচারণাটা কিন্তু মোটামুটি হিট। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে বেশ কিছু লোকজন রয়েছে, যাদের নিত্যকার কাজ হল ইনিয়ে বিনিয়ে এমন একটা ধারনা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা যে, বাংলাদেশ মোটেই ভাল নেই। এতদিন তারা আর যাই হোক, বামাতি ছিল না। অনুদাস পালেরা যেই না রামপালে ভারতীয় থাবার নীলনকশা আবিস্কার করে ফেললো, অমনি আমার সেইসব বন্ধুরা কিছুক্ষণ পর পরই এক একজন একটা করে স্ট্যাটাস প্রসব করছে-
"আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের একজন #নাগরিক এবং
সংবিধানের ৭ এর ১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের #মালিক।
আমি রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের তীব্র #প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
বিদ্যুৎ আমিও চাই; কিন্তু #সুন্দরবন ধ্বংস করে আমার বিদ্যুৎ এর দরকার নাই।
.
দয়া করে আপনিও আমার এ প্রতিবাদ আমলে নিন।
.
★★লেখাটা কপি-পেস্ট করে আপনার টাইমলাইনে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলুন - প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশকে রক্ষা করুন।"
বুঝুন ঠ্যালা, শুধু সুন্দরবন নয়, বাংলাদেশও যেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তাকে রক্ষা করার জন্য আকুল আবেদন।
কয়েকজনকে পাল্টা অনুরোধ জানিয়ে বললাম-
"যারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন #নাগরিক এবং সংবিধানের ৭ এর (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার একজন #অংশীদার ও #মালিক । এবং সেই অধিকার বলে যারা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ তৎপরতার তীব্র #প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি:
রাষ্ট্রের অংশীদার ও মালিক হিসেবে আপনার কাছে সচেতনতাও আশা করছি। বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের উপর নির্ভর না করে, কেবলমাত্র অসত্য তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে গুজব ছড়ানোটা কি সংবিধান অনুমোদন করে? যাদের অতীত দেখলেই বুঝবেন, ব্যর্থতা ছাড়া যাদের কোন প্রাপ্তি নাই, তাদের কথায় 'চিলে কান নিল বলে চিলের পেছনে ছোটা' কি সচেতন নাগরিকের দায়িত্বশীলতার মধ্যে পড়ে?
সুন্দরবন আমাদের
রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রও আমাদের।"
কিন্তু কিসের কি যে কে সেই।
সুন্দরবনের ওপর আপনার বন্ধুদের ঔনারশিপ যে জেগে উঠেছে, সেটা মন্দের ভালো দিক। একটু কষ্ট করে ওনাদের এই লেখাটা পড়তে দিয়ে কীটনাশক ফুরাডন নিষিদ্ধ করার জন্যেও জোর গলায় আওয়াজ তুলতে বলুন।
ঐ কমিটিতে সরব কর্মী আমার বন্ধু এ্যানি ফেইসবুকে আমাকে ইঙ্গিত করে একটা পোস্ট দিয়েছে। হাতের কাছে হিমুর লেখা পেয়ে গেলাম। সুতরাং সচলায়তনে এসে পড়বার জন্য একটা লিংক ও টিজার দিয়ে দিলাম। অনেক ধন্যবাদ হিমু।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
রামপাল বামপালের দ্বিতীয় পর্বে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের কী ধরণের ক্ষতি হতে পারে এই বিষয়ে আলোকপাত করবেন। অনেক ধন্যবাদ।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, সেটা নিয়ে আমি কিছু লিখতে চাই না (এলেমের অভাবে)। যারা বাস্তুতন্ত্র বা কয়লাজনিত দূষণ নিয়ে লেখাপড়া করেছেন, বা এ ব্যাপারে যাদের কাজের অভিজ্ঞতা আছে, তারা সচলায়তনে এ নিয়ে লিখতে পারেন। কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাঁচ হ্যাপা (ছাই, কার্বন ডায়োক্সাইড, সালফার ডায়োক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড/ডায়োক্সাইড, কণাবর্জ্য) নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করলে আরো ভালো হয়। চুনাপাথর দিয়ে সালফার সরানো হলে উপজাত জিপসাম ব্যবস্থাপনাও আরেকটা হ্যাপা হতে পারে, সেটা নিয়েও আলোচনা কাম্য।
আমি রামপাল নিয়ে বামপালদের প্রচারণার কয়েকটি ভুল এবং/অথবা অসত্য পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করতে চাই কেবল।
হিমু ভাই, ভালো লিখেছেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহে আমার ফেসবুকে মানুষের গতিবিধি দেখে মনে হয়েছে যে রামপাল = সুন্দরবন ধ্বংস এই ন্যারেটিভ আখেরে ঠিক/বেঠিক, যাই হোক, সেট হয়ে গেছে। আনু মোহাম্মদ গং এর প্রপ্যাগান্ডা সফল। যেই কারনে যে কোন বিশেষজ্ঞদের কোন লেখা (যদি আসেও) থেকেও বাংলা ট্রিবিউন গোলাম মর্তূজার লেখা থার্ড ক্লাস কলাম এখন বেশী দামী। সেই সাথে আনু মোহাম্মদ গং এর প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঘেরাও করতে গিয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষও তাদের জন্য একটা সিম্প্যাথি তৈরি করে ফেলেছে।
যাই হোক, সরকারও মনে হচ্ছে জেদ ধরেই রেখছে যে 'কাম হেল অর হাই ওয়াটার' তারা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়েই ছাড়বে। সেটা আটকানো সম্ভব নয়। তবে আপনি চিনাবাদামদের বখাট্য যুক্তির উত্তর দিতে যে এই লেখা লিখছেন, এতে কোন কাজ হবে না। বিষয়টা এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে কয়েক বছর পরে যদি এমনও দেখা যায় যে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভালো চলছে, সুন্দরবনও বহাল তবিয়তে আছে, তাও দেখবেন বেশীরভাগ মানুষজন সেই বিদ্যুৎ ভোগ করতে করতেই 'সরকার কারো কথা শুনলো না, সুন্দরবনটা ভারতের প্ররোচনায় ধ্বংস করেই ফেললো' বলতে বলতে গম্ভিরভাবে মাথা ঝাকাচ্ছে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। পাকনা কথা না বলে ইবাদতবন্দেগি বেশি করে করুন, স্রষ্টার তুষ্টি অর্জন করুন।
হেহে, আসলেই, পৃথিবী তো ধ্বংস হয়েই গেছে। আমরা এখনও টের পাই নাই আরকি, বেসিকালি সিক্সথ সেন্সের ব্রুস উইলিসের মত অশরীরী আত্মা হয়ে টিকে আছি।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...
"খাচ্ছি দাচ্ছি, ঝাঁকের কই ঝাঁকেই মিশে যাচ্ছি"
কিন্তু ঝাঁকছাড়া বেয়ারা কইও তো কিছু আছে।
হিমু ভাই, এই যে নয়াচরের উদাহারণ আসলো, সেখান থেকে আমরা জানতে পারলাম ভারতীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয় থেকে গঠিত কমিটি সরজমিনে গিয়ে নয়াচর পর্যবেক্ষন করেন এবং তাদের মতামত দেন। বাংলাদেশে কি এমন কাজটি করা হয়েছে? বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয় কি রামপালে বিুদৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেখানকার পরিবেশের কি কি ক্ষতিকর দিক আছে তা স্টাডি করে রিপোর্ট করেছে? নাকি তার আগেই সেখান থেকে মানুষকে উচ্ছেদ করে প্রজেক্টের কাজ শুরু করে দিয়েছে? EIA রিপোর্ট দাখিলের সময় বলছে এই রিপোর্ট করার আগেই সরকার জমি অধিগ্রহণ শুরু করেছে। EIA রিপোর্ট জমা হয়েছে অক্টোবর ২০১৩ সালে আর ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছে ২০১০ থেকে! এছাড়া এ লেখাটি http://kathakata.com/archives/789 EIA রিপোর্টে কি কি অনিয়ম করা হয়েছে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে।
আমার মনে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের ভয় হলো আসলে অজ্ঞতা এবং ‘অবিশ্বাস।’ এই যে বামাতিরা নানান ভুল কিংবা মিথ্যে তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্র্রান্ত করছে সেটি আমরা গ্রহণ করছি কারণ আমাদের অজ্ঞতার কোন সীমা পরিসীমা নেই, এর সাথে ভারত বিদ্বেষ তো আছেই। অন্যদিকে অবিশ্বাসের বিষয়টিও হেলাফেলার নয়। আমাদের এখানে সবকিছুতেই দু-নাম্বারি দিয়ে সম্ভব। এই যে বলা হলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশে দূষণ সহনীয় মাত্রায় রাখা হবে তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? ইনড্রাষ্টিয়াল কাজের সাথে যুক্ত থাকার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি ‘দেশের একেবারে নামকরা প্রতিষ্ঠানও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট না করেই শিল্পকারখানা থেকে নানান দূষিত পানি সরাসরি পরিবেশে ছেড়ে দেয়! এগুলো যাদের দেখার কথা তারা কেউ সেটি দেখে না। ঠিক দেখে না বললে ভুল হবে, বছর শেষে তারা তাদের পাওনা বুঝে ফেলে এগুলো তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। সারা বাংলাদেশেই চিত্রটা এমন, ফলে সরকার যতই বলুক তারা সব ’সহি’ ভাবে করবে বাস্তবতা সেটা কে বিশ্বাস করতে বলে না।
((বি.দ্র: প্রিয় মডু ভাইসকল, আমার একাউন্ট থেকে মন্তব্য ঘরে দেখছি কোন লিংক যুক্ত করার অপশন নেই! এবং গত দুমাসে আমার করা কোন মন্তব্যই প্রকাশ পায়নি ঠিকি কিন্তু আমার অপ্রকাশিত মন্তব্যের ব্লগগুলো তে অন্যরা মন্তব্য করলে মেইল পাই! ঠিক কি কি কারণে এটি হতে পারে জানাবেন আশা করি।)
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
রামপাল নিয়ে সরকার প্যান্টের ওপর আন্ডারওয়্যার পরেছে কয়েক বার। সেটা প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যা। সেটা থেকে কীভাবে "রামপাল = সুন্দরবন ধ্বংস" এই অনুসিদ্ধান্তে আসছেন অনেকে, সেটা স্পষ্ট নয়। সরকার যদি ইআইএ রিপোর্টের পর জমি অধিগ্রহণ করতো, তাহলে কি রামপাল তাদের চোখে নিরাপদ হয়ে যেতো?
আপনার দেওয়া লিঙ্ক থেকে ইআইএ প্রণেতাদের কাজের ওপর বিপিডিবি আর এনটিপিসির প্রভাব বিস্তার বিষয়ে সন্দেহের কথা জানতে পারলাম। পোস্টলেখক যদি তথ্যসূত্র দিয়ে এ সন্দেহকে সাবস্ট্যানশিয়েট করতে পারতেন, তাহলে ভালো হতো। সেটা করা না গেলে গোণায় ধরা যাবে কি?
সরকারকে অবিশ্বাসের অধিকার তো সবার আছে। কিন্তু "আমি সরকারকে বিশ্বাস করি না অতএব সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে", এটা যুক্তি হিসাবে খুব শক্ত কিছু না। সুন্দরবন তো কারো বদদোয়ায় ধ্বংস হবে না, তার একটা ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া আছে। সেটা ব্যাখ্যা করা জরুরি, এবং সেইসাথে এটাও প্রমাণ করা জরুরি যে ঐ প্রক্রিয়া ঠেকানোর সাধ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রওলাদের নাই। যদি সেই ব্যাখ্যা কেউ দিতে না পারেন, তাহলে "সুন্দরবন ধ্বংস হবে" কথাটা ধোপে টিকবে না।
সরকারের প্রতি অবিশ্বাসকে মনেটাইজ করাও প্রিয় বামপালি ভাইদের একটা লক্ষ্য হতে পারে। রামপাল কেন্দ্র চালু হলেও যাতে এটাকে নাজুক জায়গা বানিয়ে চাপ দিয়ে দুটো খেয়েপরে থাকা যায়, সে বন্দোবস্তও করা যেতে পারে। যেহেতু বামপালিদের একটা বড় অংশ নানা এনজিওর লুঙ্গির নিচে মাথা ঢুকিয়ে রেখেছেন, ওনারা চাইলে রামপালের আশপাশে পাবলিকের স্বার্থে পাবলিক চালিত পরিবেশ পর্যবেক্ষণ কার্যকলাপ চালানোর নাম করে বিদেশ থেকে ফান্ড এনে আরেকটু আরামে বিপ্লব করতে পারেন। যদি ইতোমধ্যে কোনো বামপালি ভাই এই আইডিয়া কেউ কাজে লাগিয়ে না থাকেন, তাহলে কাজে লাগিয়ে কামিয়াব হন। ফাইন্ডার্স ফি হিসাবে আমার হক্কের ৫% দিয়ে আপনার গ্রামের বাংলা মাধ্যম স্কুলে একটা ছোটো গ্রন্থাগার করে দিয়েন।
অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটার জন্যে। এটা খুব খুব প্রয়োজন ছিলো
অনেক নতুন তথ্য পেলাম এখানে। অধিকাংশ মানুষ, এমনকি যারা আনু শাহের আন্দোলন সমর্থন করছে তারাও বোধহয় এই তথ্যগুলো জানে না।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
যারা আমার মত এক্কেবারে ছা পোষা তাদের জন্য এত বিস্তারিত জানা কষ্টকর । কাজেই বামপাল বলেন আর যাই বলেন যে দেশে সরকার কখনই মানুষের হতে পারে নি সে দেশে সরকার বিরোধিতা অটোমেটিক সমর্থন পেয়ে যায় ।
আনু সাহেবরা কিন্তু বাশখালি ( চীন ) আর রুপপুর ( রাশিয়া ) এই দুই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে । কাজেই শুধুই ভারত বিদ্বেষ থেকে আন্দোলন হচ্ছে সেটা মনে হয় সরলীকরণ দোষে দুস্ট।
হত ২০ তারিখে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম - যদিও আমি এসব আন্দোলনের সাথে নেই তবুও আন্দোলনকারীদের একজনের অনুরধে যাওয়া । ওখানে যেয়ে দেখলাম নেতারাও বেশ চিন্তিত যে আন্দোলনটা ভারত বিরধিতায় রুপ নিচ্ছে । একজন সরাসরি বলেই দিলেন এমনটা তারা কখনই আশা করেন নি বা পরিকল্পনাও ছিল না । আর আজকে কাগজে দেখলাম বিম্পি জামাত সুন্দরবন নিয়ে আন্দলনে নামবে ।
কাজেই সরকারের উচিৎ হবে অবিলম্বে ঘাউড়ামি বাদ দিয়ে আগে মানুষকে সব তথ্য উপাত্ত জানানো । এটা নিয়ে বালেরকেল্লা নতুন কোন কান্ড করুক সেটা কেউ চাইবে না ।
আপনার লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ । অনেক কিছু জেনেছি । শেয়ার করছি - আশা করছি আন্দোলনকারীরা এটা পড়ে দেখবে, মন্তব্য করবে ।
দুনিয়া ভাই, ভারতবিরোধিতা জায়গামতো করলে তো কোনো সমস্যা নাই। ইন ফ্যাক্ট, বামপালিরা ইংরেজি ভাষায় রামপালবিরোধী একটা লেখা পেয়ে যাকে খালু মানছে, সেই জয় শারদা সাহেব পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের উচিত হবে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা [সূত্র]। তিনি এ-ও বলছেন, এটা করা গেলে ভারতীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি ইউটিলাইজেশন বাড়বে (এখন ৫৮% হয় ওখানে)। রামপালের বদনাম করে জয় শারদা আঙ্কেলের আরেকখানা লেখা শেয়ার দিয়ে বামপালি ভাইয়েরা মাসের পর মাস কেঁদে গড়াচ্ছেন। এদিকে তিনি যে নিজদেশের কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উন্নতির জন্যেই বাংলাদেশে কারখানা না বানিয়ে ভারতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনার বুদ্ধি দিচ্ছেন, সেটা নিয়ে ইংরেজিতে-কাঁচা মতলববাজ চেরিপিকার বামপালি ভাইয়েরা য়্যা-কে-বা-রে চুপ।
বিশ্বব্যাঙ্ক বাংলাদেশে পাটশিল্প গোটানোর জন্য টাকা ধার দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাট কারখানার প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়েছিলো দশকখানেক আগে, মনে আছে? এই বামপাল আন্দোলনও সেই একই বেনিয়াদের মুৎসুদ্দিবৃত্তি মাত্র। উদ্দেশ্য: বাংলাদেশকে নিজস্ব শক্তি অবকাঠামো দাঁড় করাতে না দিয়ে পরমুখাপেক্ষী বানিয়ে রাখা। সুন্দরবন বামপালি ভাইদের একটা উছিলা মাত্র। সুন্দরবন নিয়ে ওনাদের এতো মাথাব্যথা থাকলে এই বন উজাড় করে চিংড়ি ঘের হয় কীভাবে? সুন্দরবনের নাকের ডগায় মংলা বন্দরে জ্বালানি পরিশোধন কেন্দ্র আর সিমেন্ট কারখানা হয় কীভাবে? সুন্দরবন কি একটা খামার যে ইচ্ছামতো ওখান থেকে সম্পদ আহরণ করা যাবে?
নতুন মন্তব্য করুন