১.
চিরুনি অর্থ কী, এ জিজ্ঞাসার মোকাবেলা বালক জগদীশচন্দ্র বসু করেছিলেন "ফাড়ুনি" দিয়ে। দেখা বা শোনা নয়, পড়া কথা। জগদীশচন্দ্রের এই বাল্যকালীন প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বাংলা শব্দের মহাদ্রুমের বীজ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে জিজ্ঞাস্য, চিরুনি কি আদপেই ফাড়ুনি? চিরুনিকে ফাড়ুনি বললে কি লোকে চিনবে? যদি শব্দের কাজ হয় ভাবসেতু নির্মাণ, তাহলে ফাড়ুনিতে গিয়ে কি ভাবজট তৈরি হবে না? কিন্তু ফাড়ুনিতে কী নেই, যা চিরুনিতে আছে?
শ্রোতার অভ্যস্ততা।
নতুন শব্দের গ্রহণযোগ্যতা বিচার আমরা নিজেদের গণ্ডি দিয়ে বিচার করি, সেটাই স্বাভাবিক। চিরুনিকে জগদীশচন্দ্র ফাড়ুনি বললেও ফাড়ুনি ভাত পায়নি, আজও আমরা চিরুনি দিয়েই চুল আঁচড়াই। চিরুনির আরেকটা নাম আছে, কাঁকই (কঙ্কতি/কঙ্কতিকা থেকে এসেছে), সেটাও এখন আর খুব প্রচলিত কিছু নয়। তাছাড়া চিরুনি শব্দটার মধ্যে একটা দৃশ্যগুণ আছে; চুলের দুর্ভেদ্য ঝোপঝাড় কোনো এক যন্ত্রে চিরে দেওয়া হচ্ছে, এটা মনের চোখে ভেসে ওঠে। ফাড়ুনি বরং RAKE এর সাথে বেশি মানানসই।
কিন্তু কঙ্কতিকার মতো খটমটে শব্দটার মধ্যে কি এ ছবি অনুপস্থিত? কঙ্কত মানে মাছের ফুলকো (কানকো শব্দটা কঙ্কত থেকেই এসেছে, কিংবা কানকোর সংস্কারসাধন করেই হয়তো তাকে কঙ্কত করা হয়েছে)। মাছের ফুলকোর একটা ছবি বরং দেখি আমরা।
চিরুনি কেন কঙ্কতিকা, সেটা এ ছবিটা থেকে খানিক স্পষ্ট হয়। সময়ের সংঘর্ষে কঙ্কতিকার দাঁত ক্ষয়ে গিয়ে সেটা যখন কাঁকই হয়ে গেলো, কিংবা আমাদের জীবনেও যখন মাছের কানকো একটা আড়ালের বস্তু হয়ে গেলো, কিংবা কানকোর সাথে চিরুনির সাদৃশ্যটুকু যখন কালভারে চাপা পড়লো, তখন এ শব্দগুলোর দৃশ্যগুণ হারিয়ে গেলো। চিরুনি পেলো স্বর্ণপদক, কাঁকই রৌপ্য, ফাড়ুনি পেতল, কঙ্কতিকা সান্ত্বনা পুরস্কার।
এখানে একটা ছবি লুপ্ত হওয়া, বা গুপ্ত হওয়া, বা সুপ্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা বুঝতে পারি, এমন একটা জনগোষ্ঠী ছিলো, যারা মাছের কানকো আর চুলের চিরুনির সাথে সমান পরিচিত ছিলো, এবং এ দুয়ের সাদৃশ্য তারা শব্দে ফুটিয়েছে। প্রকৃতি থেকে আহরণ করা কোনো কিছুর নামকে তারা একটি উদ্ভাবনে রোপণ করেছে। নতুনকে পুরনো বা আপন দিয়ে চেনার কাজটিতে তারা সফল। সময় এ ছবিটাকে মুছে দিয়েছে হয়তো, কিন্তু প্রক্রিয়াটা রয়ে গেছে। বালক জগদীশচন্দ্র "চিরুনির অর্থ" কী, সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে আরেকটি ছবিই মনের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন, চিরুনি হচ্ছে এমন কোনো সাধিত্র, যা দিয়ে কোনো কিছু ফাড়া হয়। ফাড়ুনি বাংলা ভাষায় প্রচলন পায়নি, কিন্তু শব্দের মাঝে দৃশ্যসন্ধানের ইতিহাসে এটা টিকে আছে।
সব শব্দেই কি এ দৃশ্যগুণ আছে, কিংবা থাকা জরুরি? হয়তো আছে, সে দৃশ্য খোঁজার প্রয়োজন বা আগ্রহ আমাদের নেই। এই অনাগ্রহই মূলত নতুন শব্দ নির্মাণের কাজে প্রাথমিক বাধা। বালকমনে এ বাধাটা কাজ করে না, কারণ অনেক কিছুই তার কাছে সমান নতুন, সমান আগ্রহোদ্দীপক। চিরুনি যন্ত্রটা জগদীশচন্দ্র আবিষ্কার করেননি, কিন্তু ফাড়ুনি শব্দটা উদ্ভাবন করে তিনি চিরুনির ধারণাটাকে নতুন করে, নিজের মতো করে আবিষ্কার করেছেন। এ স্পৃহাই নতুন নতুন শব্দের জমিন।
আর জগদীশচন্দ্রের "ফাড়ুনি"-ঘরানা কিন্তু বাংলায় যথেষ্ট প্রচলিত। ডালঘুঁটুনি, নারকেলকুড়ুনি, নিড়ানি, এসব আছেই। সঙ্গে পোট্যাটোপিলারকে ছিলুনি আর বটলওপেনারকে খুলুনি, চিজগ্রেটারকে গুঁড়ুনি, সাথে রুটি বেলার বেলনকেও আদর করে বেলুনি বলি হরদম।
২.
আমরা না দেখলেও, অনেক শব্দের পেছনেই একটা দৃশ্য আছে। ত্রিমাত্রিক সিনেমা দেখার জন্যে যেমন বিশেষ চশমা লাগে, সে ছবিটা দেখার জন্যে মনের চোখে একটা চশমা পরে নিতে হয়, কিংবা ইতিমধ্যে পরে থাকা কোনো চশমা খুলে নিতে হয়। যেমন, কন্দর। কন্দর মানে গুহা। দ্রবণরোধী পাথরের মাঝে যদি সহজদ্রব্য কোনো কিছু থাকে, কিংবা শক্ত পাথরের মাঝে নরম পাথর, সময়ের সাথে পানি সেটাকে ধুয়ে নিয়ে যায়, একটা শূন্যস্থান পড়ে থাকে, তাকেই আমরা বলি গুহা। এ দৃশ্যটা কন্দর শব্দের মধ্যে আছে। "কম" শব্দের অর্থ পানি। কম দীর্ণ করেছে যাকে, অর্থাৎ জল যাকে ভেদ করেছে, সে-ই কন্দর (বহুব্রীহি)। গুহার জন্মের লক্ষ বছরের দৃশ্যটা যেন দ্রুত চালিয়ে শব্দটার উচ্চারণকালের মধ্যে দেখানো আছে কন্দরে। আপনি-আমি কন্দর শব্দটা ব্যবহার করি না, তার মানে এ নয়, যে এ ছবিটার অস্তিত্ব নেই, কিংবা এ শব্দের উদ্ভাবনের পেছনে অতীত পর্বতচারী সমাজের সদস্যদের গভীর পর্যবেক্ষণ নেই। তাঁদের মতো করে দেখার চোখই হয়তো আমাদের গজায়নি এখনও। গুহার ভেতরে আমরা একটা শূন্যস্থান দেখছি, কন্দর শব্দের প্রণেতাসমাজ দেখেছে পানির দীর্ঘমেয়াদী বিদারণকর্ম।
কিংবা ধরুন, কপোত। কম-এর মতো ক-ও বেশ পুরনো শব্দ, এর বহু অর্থের একটি হচ্ছে বায়ু। ক যার পোত, অর্থাৎ বায়ু যার নৌকা, বহুব্রীহিতে পায়রা। শব্দটার মাঝে সূক্ষ্ম কল্পনা আছে, খোদ হাওয়াকেই নৌকা ভেবে পায়রাকে তার যাত্রী ভাবার মতো কবিসুলভ স্পর্ধা আছে। কপোত শব্দটার উদ্ভবের পেছনে ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে, আমি এ ব্যাখ্যাকে সামনে আনছি এর দৃশ্যগুণের জন্যে। এখানেই থেমে না থেকে একে আরো সামনে বাড়ানো যায়। কপোতের পালি, অর্থাৎ কপোত উপবেশনের স্থান হচ্ছে কপোতপালি, ইংরেজিতে যাকে বলে CORNICE (ইতালিয়ান কর্নিচে থেকে নেওয়া), অর্থাৎ কার্নিশ। কার্নিশকে কপোতপালি বললে তাতে বাড়ির কাঠামোর শুষ্কংকাষ্ঠং ভাবটা চলে গিয়ে তারচেয়ে বেশি কিছু ফুটে ওঠে। একটা সমাজের ছবি আমরা পাই, যেখানে লোকে ঘর গড়ার সময় কবুতরের জন্যেও একটা আশ্রয় গড়ে। এ ছবিটা কার্নিশে নেই।
আমরা আরো সামনে বাড়তে পারি। একটা শব্দ উদ্ভাবন করতে পারি, কপোতপালিশূর, অর্থাৎ যার বীরত্বের ক্ষেত্র কার্নিশে, যোগরূঢ়ার্থে শহুরে বানর। পারি না? নিশ্চয়ই পারি। দু'লাইন ছড়াও লিখতে পারি, ছাদের ওপর মাদুর পেতে শুকাচ্ছি আমচুর, সবই খেলো মহল্লার ঐ কপোতপালিশূর।
কপোতপালিশূরের টুকরোগুলো যদি আমরা দেখি, পাবো হাওয়া, নৌকা, বসার স্থান, আর বীর। শহুরে বানর পর্যন্ত পৌঁছানোর কিছুই ওর মধ্যে নেই। গেছোদাদার মতো তাকেও রাণাঘাট-তিব্বত-গেছোবৌদিরান্নাকরছে টপকে খুঁজে পেতে হয়। শহুরে বানর বললে বরং তাকে সহজে চেনা যায়। কিন্তু সহজ কাজ তো শহুরে বানরও পারে, লেখকের কাজ কি আরেকটু কঠিন হওয়া উচিত নয়? তাঁর একটি কাজ দৃশ্যের জন্ম দেওয়া, শব্দে।
৩.
"কুসুমাকর" শব্দটার অর্থ বসন্ত। শব্দটা কখনও প্রয়োগ না করলেও আমাদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। কিন্তু একটা ঋতুকে ফুলের খনি হিসেবে কল্পনা করার মাঝে মনুষ্যত্বের শক্তিটুকুও আঁকা আছে। বসন্তের গর্ভ থেকে কোনো এক অদৃশ্য কর্তা ফুল খুঁড়ে আনছে, এ দৃশ্যের পেছনে প্রাচীন কবির কৃতিত্ব আছে। আমরা এ দৃশ্যটুকু না দেখে পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম, তিনি একটি শব্দে এ ছবি আমাদের উপহার দিলেন। এ দৃশ্য দেখে আমাদের এক পয়সাও লাভ বাড়েনি, কিন্তু কল্পনার চরকায় তেল পড়েছে, যা পয়সা দিয়ে মেলে না, বা প্রচুর পয়সার বিনিময়ে মেলে।
রবীন্দ্রনাথ কেন বড় কবি? নোবেল পেয়েছিলেন বলে? আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ বড় কবি তাঁর "তালগাছ" কবিতাটির জন্যে। ছড়া বলবো না, ওটা কবিতাই। তালগাছ আমার প্রিয় জিনিস, আমি সর্বদাই এর মালিকানাপ্রার্থী, সে কারণেও নয়। কবিতাটা মানুষের জীবনে এক উত্তরণপর্যায়ের দৃশ্য এঁকেছে। একটি শিশুর কল্পনা তাকে উচ্চাভিলাষী করে তুলেছে, তার মন ছুটছে উঁচুতে, বাইরে, দূরে, অগম্যের দিকে, হাওয়ার মতো সুলভ-নিত্য-প্রাপ্যের ভরসায়। যখন সে প্রণোদনা থেমে গেলো, শিশুটি মুখোমুখি হলো রূঢ় সত্যের, টের পেলো, অনেক সীমা তাকে বেঁধে রেখেছে। শিশু মনটি তখন প্রথম মুখোমুখি হলো প্রাপ্তবয়স্কতার প্রথম পাঠের, নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেওয়ার, আত্মপ্রবোধের কঠিন দায়িত্বের। কাজটা সে হইচই-চিৎকার-অভিযোগে করলো না, করলো ভালোবাসা দিয়ে, সীমাকে সে মাতৃজ্ঞান করে নিজের স্থাবরতাকে মেনে নিলো। না বলা ছোট্ট একটা ইঙ্গিতও আছে কবিতায়, যদি নড়তে না পারো, উঁচু হও। মানবসমাজের অভিজ্ঞতার এ গোটা দৃশ্যটা রবীন্দ্রনাথ ফুটিয়েছেন একটা তালগাছের মধ্যে, শিশুপাঠ্য করে। একটা তালগাছের বুকে তিনি নক্ষত্রযাত্রার স্বপ্ন ফুটিয়েও তাকে মাটির সন্তান করে রাখলেন। পৃথিবীর শেষ তালগাছটা যতোদিন সারাদিন ঝরঝর থত্থর কাঁপে পাতা পত্তর করে টিকে থাকবে, রবীন্দ্রনাথ ততোদিন বড় কবি হিসেবে রয়ে যাবেন এ দৃশ্যের জন্যে।
কবিদের কাজটা হয়তো এ জন্যেই গল্পকার-ঔপন্যাসিকের চেয়ে অনেক কঠিন। তাঁরা আমাদের শব্দের খনি। যে কবি নতুন একটা শব্দ তাঁর সহভাষীদের জন্যে দিয়ে গেলেন না, তিনি নিজেকে খননও করলেন না, বোকাখোদা রয়ে গেলেন। আজকাল মাতৃদুগ্ধপান "টেকসই" করার ডাক যারা দেয়, তারা সমাজে যথার্থ যোগ্য কবির অভাব নির্দেশ করে কেবল। শব্দের মাঝে দৃশ্যগুণ সন্ধানের, বা রোপণের কাজ তো আমলোকের নয়, আমলারও নয়, সেটা কবির চারণক্ষেত্র। মহাকাল আমাদের এমন কবি দিক, যিনি শব্দের বসন্ত।
৪.
কৌশলের দুনিয়ায় পৃথিবীকে দু'ভাগ করেছে তাপগতিবিদ্যা। মোটা দাগে দুনিয়া প্রাকতাপগতিবিদ্যা আর উত্তরতাপগতিবিদ্যায় ভাগ করা যায়। মানুষ দীর্ঘদিন পেশীশক্তি (নিজের বা পশুর) অথবা প্রাকৃতিক শক্তির (জল আর হাওয়ার স্রোত) ওপর নির্ভরশীল ছিলো, তাপগতিবিদ্যা তাকে শেখালো, দহনকে চলনের কাজে লাগানো যায়। এ বিদ্যার সূক্ষ্ম দিকগুলো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আত্মস্থ করেছে, উপনিবিষ্ট মানুষেরা এর শিকার হয়েছে। তাপগতিবিদ্যার ফসল তারা পেয়েছে তৈরি পণ্য হিসেবে, যার উৎপাদনে তার ভূমিকা সীমিত, সে কেবল এর নিরুপায় ভোক্তা, কিংবা বড়জোর তোতাপাখি মিস্ত্রি। বস্তুর সরবরাহে তার নিয়ন্ত্রণ নগণ্য বলে শব্দের সরবরাহেও সে কুণ্ঠিত এবং আত্মশক্তিচর্চারহিত থাকে। জলখনিত কন্দরের মতো এক বিকট শূন্যস্থান নিয়ে সে পড়ে থাকে, "অন্য" এসে তাকে পূরণ করবে বলে। এ বিষচক্র কাটানো হয় না বলে আজও বহু যন্ত্র বা যন্ত্রাংশের জন্যে কোনো বাংলা শব্দ নেই।
এঞ্জিন বা মোটরের কথা বাদ দিয়ে খুব প্রাচীন কিছু যন্ত্র বা সাধিত্রের দিকে যাই। লিভার অ্যাকশনের সাথে আমরা বহুবছর ধরে পরিচিত, ঢেঁকি বা সেচযন্ত্র থেকে সেটা স্পষ্ট। কিন্তু লিভারের কোনো বাংলা নেই এখনও। যেমন নেই গিয়ার, লিফট বা ক্রেনের। নেই স্ক্রু, রেঞ্চ, স্প্যানার বা স্ক্রু-ড্রাইভারের। প্রাগতাপগতিবিদ্যা দুনিয়াতেও এগুলো ছিলো, কিন্তু আমাদের সচেতন ব্যবহারে শব্দগুলো এসেছে সরাসরি ইংরেজি থেকে। প্রাকতাপগতিবিদ্যা যুগের ফ্যান্টাসি গল্প হোক, বর্তমানের অ্যাডভেঞ্চার হোক, কিংবা ভবিষ্যতের কল্পবিজ্ঞান হোক, নিজভাষায় এ অতি সাধারণ যন্ত্রগুলো নিয়ে লেখার শক্তিও আমরা অর্জন করিনি এখন পর্যন্ত।
দরকারটা কী? এ প্রশ্নটা অনেকেই বিরক্ত হয়ে করেন। রেঞ্চের বাংলা দিয়ে কী হাতিঘোড়া হবে? রেঞ্চের বাংলা করলে আমরা কি রাতারাতি হাউই খাড়া করে মঙ্গলে চলে যাবো? রেঞ্চকে রেঞ্চ লিখলেই কি না খেয়ে মরবো? চেয়ার-টেবিল-স্টেশন-স্কুল-ব্যাট-বল দিয়ে কি কাজ চলছে না?
গ্লানিটা আসলে যে লোকটা রেঞ্চ দিয়ে কাজ করে, তার নয়। একান্তই লেখকের। কারণ তাঁর কাজ শব্দ নিয়ে। প্রতিবার রেঞ্চ শব্দটা লেখার সময় লেখককে নিজের গোত্রীয় অক্ষমতার মুখোমুখি হতে হয়। কেউ সেটাকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন, যেভাবে প্রতিদিন সহস্রবার আমরা যাচ্ছি। কেউ থেমে গিয়ে এ কাঁটার খোঁচা খেতে পারেন। যিনি খোঁচাটা খাবেন, তিনি একটা নতুন শব্দ নিয়ে আসবেন, তাঁর সহভাষীদের জন্যে উপহার হিসেবে। এ থেকে তাঁর একটা টাকাও বাড়তি লাভ হবে না, দুটো বাড়তি হাততালির শব্দ সাথে নিয়েও তিনি ঘুমাতে যাবেন না। নতুন শব্দগুলো কার্নিশের ওপর ফোটা একটা ছোট্ট নাম-না-রাখা ঘাসফুলের মতো (নাম-না-রাখা আবার কী? ডালিয়ার মতো এর নাম দিন কপোতপালিয়া), সেটা গজায় কারণ সেটা গজাতে পারে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিজের কানে ফিসফিস করে ষড়যন্ত্র করে যায় সেটা ফুটবে বলে।
বালক জগদীশচন্দ্রের স্পৃহা থেকে লিভারের বাংলা আমরা করতে পারি চাড়ুনি। লিভারের মূল ফরাসি ল্যভিয়ে-এর অর্থও তাই, যা দিয়ে চাড় দেওয়া হয়। দোলনার আদলে লিফটকে বলতে পারি তোলনা। ক্রেনের বাংলা করতে পারি ভারকল। গিয়ারের বাংলা করতে পারি দাঁতচাকা। শব্দগুলোর মধ্যে দৃশ্যগুণ আছে কি নেই, তার বিচারের ভার আমাদের সবার হাতে। বরং এরচেয়ে ভালো আরো কোনো শব্দ আসুক, আমাদের কারিগরি শিক্ষার বইগুলোতে এক একটা যন্ত্র কেবল ইংরেজি নামের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ না হয়ে দৃশ্যগুণসম্পন্ন একেকটা নামে ভরে যাক।
সে দিন আসার আগ পর্যন্ত আমাদের গল্প লিখে যেতে হবে। ফ্যান্টাসি গল্পে একটা পাগলাটে মিস্ত্রির জন্যে জায়গা যদি রাখতে চাই, এসব টুকিটাকি যন্ত্রপাতির বাংলা তো লাগবেই। তোমার যন্ত্র যাহারে দিয়াছ, তারে (অন্তত বাংলা নাম ধরে) কহিবারে দ্যাও শকতি।
মন্তব্য
খালি কবিরা বোধহয় এখন আর শব্দ বানায়া কুলাইতে পারবে না; পত্রিকা আর পাঠ্যপুস্তকওয়ালা লাগবে
হ, কিছু ভরা কবি লাগবে। খালি কবি বাজে বেশি।
পত্রিকা ভালো মাধ্যম বটে তবে সেখানে 'দ্বায়িত্ববান' সম্পাদক আর পরিস্থিতির 'স্বীকার' লেখক/সাংবাদিকের সংখ্যা এতো বেশি যে তাতে ভুলভাল শব্দ চাপিয়ে দেবার সম্ভাবিলিটি বেড়ে যায়।
এক কালে পাঠ্যপুস্তক রচনা বা সম্পাদনা করতেন পণ্ডিত লোকজন। তখন সেখানে নতুন শব্দ বানানো আর চালানোর সুযোগ ছিল। হয়তো তারা সেসব কিছু করেছেনও। এখন ঐ কাজগুলো করেন মহাপণ্ডিত লোকজন। তারা নতুন ধারণা, ভাবনা, বিকল্প-সত্য (এই শব্দটা শেখানোর জন্য ট্রাম্পকে ধন্যবাদ) বাজারজাতে আগ্রহী। এই জন্য ছাগল গাছে উঠে আম পেড়ে খায়, অথবা শিশু মিঠাই বা খেলনা চাইবার বদলে ওড়না চায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
খালি কথাটার মানে আপনে গুহার মতো ফাঁকা ধরলেন?
হ, মাইরেন না। কবিনামে খালিমালেপন করতে চাই না, কিন্তু এ খালি এমনই খালি যে "কেউ আছেন" বলে ডাক দিলে প্রতিধ্বনি ভেসে আসে "আমি আমি আমি আমি আমি..."।
নতুন শব্দ উদ্ভাবন বা আবিষ্কার এবং সেটা বাজারজাতকরণের বড় উপায় হচ্ছে সাহিত্য। একটা অপ্রচলিত বা ভুলে যাওয়া বা নতুন শব্দ সেখানে বার বার ব্যবহৃত হতে থাকলে তা পাঠকের মাথায় গেঁথে যেতে বাধ্য। ড্রাগনের বাংলা 'তেজসৃপ' আগে থেকে ছিল কিনা আমার জানা নেই। আমি এই শব্দটা প্রথম দেখি হিমু'র গল্পে। পরে দেখি উইকিপিডিয়াতেও এই শব্দটা ব্যবহৃত হচ্ছে। গল্প পড়ার সময়ই শব্দটা ভালো লেগেছিল, এবং মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। এখন কেউ আমার কাছে ড্রাগনের বাংলা মানে জানতে চাইলে আমি নির্দ্বিধায় 'তেজসৃপ' বলবো।
আমাদের বই না পড়ার অভ্যাস আছে। অডিও-ভিডিও হাতের তালুতে চলে আসায় বই পড়া আরও কমেছে। বৈদ্যুতিন বই পড়ার যন্ত্র লোকে কেনে অন্যকে বলার বা দেখানো জন্য, সেখানে বই পড়ে খুব কম জন। এই জন্য নতুন শব্দ বাজারজাতকরণের জন্য গান, নাটক, চলচ্চিত্র খুব কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। 'পাখাল' বা 'গাতক' শব্দগুলো কি বাংলা ভাষায় আগে ছিল? আমি নিশ্চিত না। তবে হুমায়ুন আহমেদের নাটক এই শব্দগুলোকে আমাদের ব্যবহারের মধ্যে এনে দিয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে সাহিত্যিক নতুন শব্দ হাতড়ে ফিরে সুবিধা করতে না পেরে ভীন ভাষার শব্দে আশ্রয় নেন। এটা এড়ানো যেতো যদি তিনি বিভক্তি-সন্ধি-সমাস-উপসর্গ-অনুসর্গ ইত্যাদি ব্যবহার করে একটা নতুন শব্দ বানিয়ে নিতেন। কিন্তু তিনি তা করতে পারবেন না যদি (ক) তিনি নতুন শব্দ বানানোর বা ব্যবহারের সাহস না রাখেন (খ) তার ব্যাকরণের জ্ঞান ঠন্ঠনে হয়। নাটক লিখুন বা বানান, সিনেমা বানান বা উপন্যাস লিখুন, কবিতা লিখুন বা গান রচনা করুন সবক্ষেত্রে বর্ণ প্রকরণ, শব্দ প্রকরণ, পদ প্রকরণ, বাক্য প্রকরণ, ছন্দ প্রকরণ, রস, বাচ্য, সমার্থ শব্দ ইত্যাদি বিষয়গুলোতে একটু না একটু জানাশোনা থাকতে হবে। লেখাপড়া না জেনে লেখাপড়ার কাজ কি করা যায়!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন শব্দের বাজার আমার মতে দুটো। একটা শব্দলিখিয়েদের মাঝে, আরেকটা শব্দবলিয়েদের মাঝে। দ্বিতীয় বাজারটা সবসময় গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়কে গিয়ে ঠেকে, সেখানে শব্দসমষ্টিও ছোটো। কিন্তু প্রথম বাজারটায় নতুন শব্দের প্রসার জরুরি। সাংবাদিকরা স্লুইস গেট (অনেকে স্লুইসও লিখতে পারেন না, স্লুইচ, সুইস, সুইচ দিয়ে কাজ চালান) না লিখে জলদুয়ার লেখা শুরু করলে শব্দটা দ্রুত সাধারণের কাছে পৌঁছে যাবে। পাঠক হিসেবে তাদের কাছে আমার চাওয়া, একটা প্রচলিত ইংরেজি শব্দ লেখার সময় সেটার এখনও-অপ্রচলিত বাংলা খুঁজতে এবং ব্যবহার করতে যেন তারা পিছপা না হন। যেমন, অমুককে পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে না লিখে পুলিশ সন্নিধানে নেওয়া হয়েছে বলা যায়। প্রথম দিন পড়তে খটোমটো লাগবে, দ্বিতীয় দিন গজগজ করবো "আরে রিমান্ডরে সন্নিধান কয় কা", তৃতীয় দিন বলবো "সাত দিনের সন্নিধান চাইয়া তিন দিনের সন্নিধান পাইলো কা", চতুর্থ দিন সন্নিধানই গ্রহণযোগ্য মনে হবে। বাংলা পঁচিশ কোটি স্বাধীন মানুষের ভাষা, কোনো উপনিবেশের প্রজার ভাষা নয়। এর চর্চা নিয়ে এখনও কুণ্ঠিত-লজ্জিত থাকাই বোকামি। যদি প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো না থাকে, ব্লগে-ফেসবুকে প্রতিস্থাপনীয় শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করা যায়, তখন কেউ না কেউ একটা না একটা চমৎকার বিকল্প যুগিয়ে দেবেন।
অর্ধপ্রাসঙ্গিক: তেজোসৃপ শব্দটা মাথায় আসার সাথে সাথে লিখে ফেলায় "তেজসৃপ" লিখেছিলাম, কিন্তু বানানটা মনে হয় তেজোসৃপ ঠিক হবে (তেজোবৃত্তের মতো)।
তেজোসৃপ শব্দটার কথা জানতামনা। ড্রাগনের প্রতিশব্দ হিসেবে শব্দটা আমার ভীষণ ভাবেই যথার্থ মনে হচ্ছে। কোথাও ড্রাগন প্রসঙ্গ এলে আমি অবশ্যই এই শব্দটা ব্যবহার করবো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সহমত। দায়িত্বটা প্রথম গুচ্ছের লোকদেরই বেশি, সে লেখক হোন আর আর নির্মাতা হোন। কিন্তু তারা কেন ঠেকে যান তার একটা কারণ আমি উপরের মন্তব্যের শেষ অনুচ্ছেদে বলেছি। আর কেন তাদের বাধো বাধো ঠেকে সেটা আপনি বলেছেন। যাদের মগজে উপনিবেশ আছে তাদের দিয়ে স্বাধীন মানুষের ভাষার চর্চ্চা বা উন্নতি কি সম্ভব!
পুনশ্চঃ বানান হিসেবে 'তেজসৃপ' ঠিক, তবে এর উচ্চারণ 'তেজোসৃপ্' হবে। পদের প্রারম্ভে যুক্ত বিশেষণ মুক্ত বিশেষণের ন্যায় ও-কারান্ত উচ্চারিত হবে। যথা, রণবীর (বানান) > রণোবীর্ (উচ্চারণ) অথবা ক্ষীণতনু (বানান) > ক্ষীণোতনু (উচ্চারণ)।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বানানেও তেজোসৃপ হবে। তেজস সন্ধিতে গিয়ে ওকার পাবে। শিরোনাম, মনোসাধ, অয়োজাল, তেজোসৃপ। তেজসের পর স্ত, স্থ, স্প এমন যুক্তব্যঞ্জন থাকলে আবার ওকার বসতো না (উদাহরণের খাতিরে যদি কল্পনা করি: তেজোসৃপের পেটে একটা গ্রন্থি আছে, যেখানে ওর আগুনের কাঁচামাল থাকে, ওটাকে তখন তেজস্থলী বলা যায় ("তেজোস্থলী" নয়))।
পট্টখেল / মসনদবাজী / সিংহাসনের প্রহসন ( GOT) এর বাংলা ডাবিং এ খালিসিকে তেজসৃপের মা বলা হৌক।
জগদীশ বাবুরা বিদেশ থেকে বিজ্ঞানকে দেশে এনেছিলেন, এখানে তাদের কাজ করার প্রনোদনা ছিল, আশা ছিল তাদের কাজ এখানে এগুবে। তাই শব্দসম্ভারের প্রয়োজন ছিল। আব্বাসী বাইতুল হিকমায় অবশ্য আরবীতে শব্ধগঠন না করে মূল ভাষাকে আত্মীকরন করেও কাজ চালানো হয়েছে; এভাবেই আরিস্তাল (এরিস্টোটল), সিন্ধহিন্দ (আর্যভট্টের সিদ্ধান্ত) বা নওবাহার (বাল্খ এর নববিহার) বা প্রমূখ (বারমাখ) হয়েছে।
বলছি প্রনোদনার কথা। সাংবাদিক বা অনুবাদক কেন এই ঝামেলায় যাবে?
যে ধরনের প্রণোদনা থেকে লোকে হেগে শুচু করার "ঝামেলায়" যায়।
যে "হেগেছে" তাই তো বুঝতে পারলো না, সে ছুচুর প্রয়োজন জনবে কি?
আমাদের দরকার বাংলায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আইনের জার্নাল।
সাবাস!
ভাবগম্ভীর লেখার মাঝে হঠাৎ করে প্রথমে ধরতে পারছিলাম না, আপনি কেনু "তালগাছের মালিকানাপ্রার্থী", বুঝতে পেরে হেসেই ফেললাম
চাঁড়ুনি, ভারকল, দাঁতচাকা -শব্দগুলো দারুন!
শুভেচ্ছা
শব্দগল্পদ্রূম শিরোনামের লেখাগুলো বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার বিষয়টি নিয়ে প্রচ্ছন্ন একটি ভাবনা মনের ভেতর বেশ ক' বছর ধরেই পাখা ঝাপটাচ্ছিলো। আপনার লেখা গুলো সেই ভাবনাটাকে আরও উস্কে দিচ্ছে। বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু লিখতে গেলেই বাংলা ভাষায় নিদারুণ এক শূন্যতা টের পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের ভাষা সাহিত্যের ভাষা থেকে ভিন্ন। এখানে বিশেষায়িত শব্দের ব্যবহার বেশি, কিছু শব্দের বা শব্দবন্ধের অর্থের নির্দিষ্টতা অপরিহার্য, রকমারি প্রতিশব্দ কাম্য নয়। স্বাধীনভাবে ভাষান্তর লেখাকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে জটিল এবং বিভ্রান্তিকর করে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, বিজ্ঞানের বড় ঘটনা গুলোতে আমাদের অংশীদার হবার সৌভাগ্য হয় না। যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে আমরা থাকি দর্শক-শ্রোতা হয়ে। নেতৃত্বের ভূমিকায় নেই বলেই চলে। তাই নামকরণের গৌরবময় সুযোগ আমাদের হয় না। যদিওবা কখন কেউ বড় আবিষ্কারে সাফল্য দেখায়, সেখানেও তাকে বিদেশি ভাষাটাকেই মেনে নিতে হয় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু যিনি বিজ্ঞানে মাতৃভাষা বাংলার ব্যাবহারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন, তাঁর নিজের গবেষণা কর্ম নিয়ে বাংলায় লেখালেখি করে এক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়ে রয়েছেন। তিনি তাঁর নিজের আবিষ্কৃত উদ্ভিদের বৃদ্ধি মাপার একটি যন্ত্রের নাম রেখেছেন- ক্রেস্কোগ্রাফ। উদ্ভাবনের পরপরই যে তিনি এই নামটি দিয়েছিলেন তা নয়। প্রথমে নাম দিয়েছিলেন- বৃদ্ধিমান। তার অন্য যন্ত্রগুলোরও বাংলা বা সংস্কৃত নাম দিয়েছিলেন যেমন: কুঞ্চনমান, শোষণমান। কিন্তু বিলেতি কাগজের সমালোচনার মুখে বৃদ্ধিমানের নাম পাল্টে রাখেন ক্রেস্কোগ্রাফ।
বাংলাভাষী বড়ো বিজ্ঞানীদের জন্ম কালেভদ্রে। তাই সদ্যজাত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বাংলায় সরাসরি প্রকাশ হবার ঘটনা আতশকাচ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই দ্বিতীয় ভাষায় পারদর্শিতা যেমন:- ইংরেজি অথবা নিজের ভাষা- বাংলায় ভাষান্তরিত বিজ্ঞানই ভরসা। বিজ্ঞানের জনপ্রিয়, জনগুরুত্বপূর্ণ বা প্রতিষ্ঠিত বিষয় ভাষান্তরে কিছু সফলতা পায়, কিন্তু অগ্রসরপ্রান্তের নতুনত্বর বিজ্ঞানের অনুবাদ বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পারিভাষিক শব্দ সাহিত্যিকের লেখার পাতায় জন্মালেও সেটিকে বাঁচতে হয় গবেষণাগারে, বৈজ্ঞানিক তথ্যের আদান প্রদানের মাধ্যমে, কর্মক্ষেত্রে- যেখানে গবেষক-বিজ্ঞানীগণ কিছু একটা নির্মাণ করছে, ঘটনা ঘটাচ্ছে, নতুন তত্ত্ব প্রস্তাব করছে পুরনো কে বাতিল করছে । এখানেই শেষ নয়, এর পরের ধাপে সে শব্দ কে জায়গা করে নিতে হয় পাঠকের চিন্তা জগতে, ছাত্রদের পড়া টেবিলে, বিশেষজ্ঞদের আলাপচারিতায়। তারপরই না সেই শব্দ দৈনন্দিন ব্যাবহারের উপযুক্ত হয়ে উঠে। ভাষান্তরিত বৈজ্ঞানিক শব্দ সহ-বিজ্ঞানকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য/ব্যবহারযোগ্য করার উদ্যোগটা কেমন হওয়া উচিত সেটা নিয়ে নানারকম বিচ্ছিন্ন ভাবনা মাথায় আসে। সে ভাবনার এখনো গুছিয়ে পরিবেশন করার মত পরিণত হয়ে উঠেনি। তবে একটি বিষয় বেশ জরুরী এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হবে বলে মনে হয়। সেটি হল- নিজের ভাষায় বিজ্ঞানগবেষণা পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশ। জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞান পত্রিকার কথা বলছি না। যে পত্রিকায় সদ্য গবেষণাজাত উপলব্ধির প্রকাশ হবে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সমাজের প্রচলিত নিয়ম কানুন মেনে। বাংলাভাষী সহবিজ্ঞানীদের সাথে গবেষণার ফলাফল, কৌশল ইত্যাদি আদানপ্রদান হবে। সেখানে গবেষণার ফলাফল, নতুন জ্ঞান এবং কৌশল বর্ণনায় নতুন শব্দ বা উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ তৈরী হবে। প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে বাংলায় অনুবাদ করে বাংলাকে বিজ্ঞানের সাবলীল ভাষা করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এমনকি ইংরেজি ভাষার প্রাদুর্ভাবের এই যুগে গবেষকদের মাঝে নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য বাংলা বিজ্ঞানপত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করাও কম দুরূহ ব্যাপার হবে না।
বাংলায় আঞ্চলিক কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের প্রভাবশালী বিজ্ঞান গবেষণা এবং চর্চার পরিসর তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারলে হয়তো বিজ্ঞানে ভাষার দৈন্যতা কাটানোর শুরুটা করা সম্ভব।
বিজ্ঞানের ভাষা- বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষা নিয়ে শব্দগল্পদ্রুমের একটি পর্ব কি আসবে?
আপনার লেখাগুলো বাংলাভাষী গবেষকদের সচেতন করুক এবং সম্মিলিত উদ্যোগে আগ্রহী করে তুলুক, বিজ্ঞানের আলোচনা হোক বাংলাভাষায়।
বিজ্ঞানচর্চার মূল বিষয়টিই যেহেতু গবেষণা নিয়ে যোগাযোগ, কাজেই যোগাযোগপর্বটি আপাতত বাংলায় সম্ভব না, কারণ বাংলায় গবেষণাসাময়িকী বের হয় না। কিন্তু গবেষককে কি কেউ গলা টিপে বলেছে, "খবরদার তুই এইটা নিয়া বাংলায় কিছু কবি না"? বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা কতো কঠিন, সে কথাটাই সবাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেন শুধু। বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা নাহয় পঞ্চাশ বছর ভবিষ্যতের ব্যাপার বলেই ধরে নিলাম, বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলা শুরু হোক আগে। বাংলায় বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলাও কঠিন, কারণ বাঙালি বিজ্ঞানচর্চকরা বাংলায় লেখেন না, বা কম লেখেন, ক্ষেত্রবিশেষে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে ভ্যাঙান। তাঁরা গুণী ও জ্ঞানী মানুষ, তাঁদের বিচরণ যে জগতে, সে জগৎকে বাংলায় চেনানোর কাজটা তো তিব্বত থেকে এসে কেউ করে দেবে না। বিজ্ঞানের পরিভাষা তৈরি একটা নিত্যদিনের কাজ। সেটা বাঙালি বিজ্ঞানীদেরই তো করতে হবে, নাকি? তাঁরা নিজের কাজটায় ফাঁকি দিচ্ছেন বলেই বছর বছর এসে এই "এটা নাই, অমুক করতে হবে" খেদোক্তি সবাইকে করতে বা শুনতে হয়।
সেদিন দেখলাম এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রদের ইংরেজি ভালো না জানলে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে যেতে নিরুৎসাহিত করছেন। এটাই হয়তো বাস্তবতা, এবং তাঁর পরামর্শ একেবারেই নিরর্থক নয়। কিন্তু ছিয়ানব্বই বছর হয়ে গেলো দেশের সবচে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের, স্নাতক পর্যায়ে পড়ানোর মতো পদার্থবিজ্ঞানের বই লেখা হলো না, পরিভাষা তৈরি হলো না? পদার্থবিজ্ঞান কি আর কোনো দেশে লোকে মাতৃভাষায় পড়ে না? শিক্ষকরাই যদি মনে করেন, এটা তাঁদের কাজ নয়, তো কে এগুলো প্রণয়ন করবে?
নিঃসন্দেহে। সেক্ষেত্রে গবেষকেরা ইংরেজিতে লিখে প্রকাশ করুন, তারপর বাংলায় অনুবাদ করিয়ে নিন, তারপর বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশ করুন। অনুবাদকের সাথে তখন পরিভাষা নিয়ে তাঁদের কয়েক ঘণ্টা সময় দিতে হবে, সে আলোচনা থেকেও পরিভাষা সমৃদ্ধ হতে পারে। প্রয়োজনে ব্যবহৃত বাংলা শব্দগুলোর বিপরীতে নির্ঘণ্টে ইংরেজি শব্দগুলোও রাখা হোক। একটা ভিত তৈরি হলে সেটা ক্রমশ ছোটো হয়ে আসবে।
না, কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের কোঠায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কেউ কোনো লেখায় কোনো শব্দের বাংলা খুঁজে না পেয়ে আটকে গেলে তখন ল্যাটিন বা গ্রিক শব্দোপকরণগুলোর মানে খুঁজে (সূত্র ইন্টারনেট) সেগুলোর বাংলা করে নাপিত হয়ে ফোঁড়া কাটার চেষ্টা করতে পারি (যেমন হেমাটোপোয়েসিসের বাংলা করা যায় রুধিরোদ্গম)। শব্দগল্পদ্রুম লিখছি অনেক অনেক বড় পরিসরের একটা ফ্যান্টাসি উপন্যাস লিখে শেষ করার পর এখানে-ওখানে বাংলা শব্দের অভাবে আটকে যাওয়ার তিক্ত উপলব্ধি জমিয়ে, সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভূমিকা এখনও গৌণ।
বলেন কি!!! কবে পাব??
****************************************
অনেক অনেক দিন পর ।
আপনার উপন্যাসটা ফ্যান্টাসি, আপনার এটা লেখাটা ফ্যান্টাসি, নাকি আমাদের এটা পড়ার আশা করাটা ফ্যান্টাসি?
****************************************
নিচতলা থেকে ধার নিলাম:
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
১। কি চমৎকার একটা চলমান লেখা! সময় নিয়ে আবার আসব, চলুক-দৌড়াক।
২। বিজ্ঞান পরিভাষা আর জগদীশ বসুর জন্য এই পর্বের জন্য বিশেষ ভালোবাসা!
দৃষ্টি-আকর্ষণঃ প্রিয় হিমু ভাই, একদম শেষ অনুচ্ছেদের আগের অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
এতে যে অর্থে 'চাঁড়' ব্যবহার করেছেন ওটা 'চাড়' হলে অর্থপূর্ণ হত। একটু দেখবেন কি?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
শামছুপুরাণে ভরসা না করে পুরান দিনের কিছু দলিলাদি ঘাঁটলাম। চাঁড় থেকেই চাড় এসেছে। চাঁড় এসেছে সংস্কৃত চাণ্ড (প্রবলতা) থেকে। তবে "চাড় দেওয়া" আছে চাড়ের ভুক্তিতে, চাঁড়ে নেই। অতএব দিলাম পাল্টে। অসংখ্য ধন্যবাদ।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
শব্দকল্পদ্রুম সিরিজটা পড়লাম, চমৎকার লেগেছে। বিশেষত নতুন শব্দসৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যাগুলো ভাবায়। স্কুল-কলেজে বাংলা পড়ার সময় ধারণা হয় যে ভাষার সবকিছু বোধহয় আগেই করে রাখা, আমরা শুধু সেসব শিখব; আমাদের সৃষ্টি করার কিছু নেই। ইংরেজির ক্রমবর্ধমান শব্দভাণ্ডারের বিপরীতে বাংলার ক্ষয়িষ্ণুতা রোধে ও ভাষাকে সময়োপযোগী রাখতে নতুন শব্দ সৃষ্টিই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
সম্প্রতি উইকিপিডিয়ায় "Rose (color)" নিবন্ধটি অনুবাদ করে "গোলাপি (রঙ)" করতে গিয়ে রঙনাম প্রসঙ্গে বাংলার সীমাবদ্ধতা খেয়াল করলাম। ইংরেজিতে রঙনাম সহস্রাধিক, বাংলাতে অভিধান ঘেঁটে পাই ৫০-৬০টা, তাও সমার্থক ও দ্ব্যর্থবোধকসহ। আমকে জাম বললে ভুল হয়, কিন্তু পিঙ্ককে লাল বললে সেটা আমরা ভুল ধরি না। ফলে সূক্ষ্ণ পার্থক্যের রঙগুলো একই নামে গোঁজামিল দিয়ে চালাচ্ছি। রঙনাম বাংলায় নতুন শব্দ সৃষ্টির বিরাট ক্ষেত্র।
আপনার সময় হলে বাংলা উইকির "গোলাপি (রঙ)" নিবন্ধটি দেখে দেয়ার অনুরোধ রইলো। আর "আলাপ:গোলাপী" পাতায় পিঙ্ক-গোলাপি আলোচনা চলছে, চাইলে পিঙ্কের নতুন প্রতিশব্দ নিয়ে প্রস্তাব করতে পারেন।
পড়ার জন্যে, সেইসাথে চিন্তাজাগানো মন্তব্যের ধন্যবাদ, রেজওয়ান। সিরিজটা চলমান, আরো কয়েকটা পর্ব লেখার ইচ্ছা আছে।
বর্ণবোধ নিয়ে গাই ডয়েচারের "থ্রু দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ গ্লাস" বইয়ের শুরুতে খুব চমৎকার আলোচনা আছে, সুযোগ হলে পড়ে দেখতে পারেন। রং আর ভাষার মাঝে যোগ প্রায় পুরোটাই সাংস্কৃতিক, সম্ভবত এ কারণেই বাংলায় বর্ণবাচক শব্দ সংখ্যায় কম। "হরিৎ" শব্দটা দিয়ে যেমন একই সাথে সবুজ, স্বর্ণাভ আর পিঙ্গল বোঝাতো। আমরা রঙের নতুন নাম তৈরি না করে বরং পরিচিত বস্তুর (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদ্ভিজ্জ) সাথে একটা সংযোগ তৈরি করি (কলাপাতা রং, টিয়া রং, কামরাঙা রং, খয়েরি, কমলা, বেগুনি), এটাও বেশ কার্যকর। জার্মানে দুটো রঙের মাঝামাঝি কোনো রং বোঝানোর জন্যে দুটো নামকে জোড়া লাগানো হয়, যেটার দিকে পাল্লা ভারি সেটা শেষে থাকে (বাংলায় যেমন "নীলচে বাদামি" বা "কমলাটে সবুজ" বা ইংরেজিতে যেমন "ব্লুয়িশ গ্রে" বা "গ্রেয়িশ রেড")। এই সংকর কাঠামো থেকে বেরোতে চাইলে ফল-সব্জির সাথে সাদৃশ্য একটা সহজ বিকল্প হতে পারে। যেমন গোলাপির বিভিন্ন ছটার (Shade এর বাংলা খুঁজে পাইনি এখন পর্যন্ত, এটাও বর্ণবাচক শব্দভাণ্ডার বাড়ানোয় বাংলাভাষীদের কুণ্ঠা নির্দেশ করে) জন্যে অন্য ফুলগুলোর নাম ব্যবহার করা যায় (নয়নতারা রং, করবী রং, দোপাটি রং, বোতামফুল রং)।
ইংরেজিতে রঙের নামগুলো প্রাকৃতিক উদাহরণ থেকে খানিক বিযুক্ত বলে বাংলা বিকল্প খুঁজতে বা তৈরি করতে একটু দ্বিধা বা কুণ্ঠাবোধ হয়। একবার সেটা থেকে বেরোতে পারলে হয়তো কাজ সহজ হয়ে যাবে।
দ্রষ্টব্য: শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু "শিল্প চর্চা" বইতে রঙের বৈভিন্ন্যের মাধ্যমে ছায়া বোঝাতে Shade-এর বাংলা করেছিলেন ছায়াসুষমা, আর রঙের Grade-কে বলেছিলেন পর্দা। বইটি শ্রুতিলিখিত, শিল্পী কানাই সামন্তের সম্পাদনার ভেতর দিয়ে গেছে।
আপনার "অনেক অনেক বড় পরিসরের একটা ফ্যান্টাসি উপন্যাস"-টার কি খবর????
****************************************
প্রথম খণ্ডটার অলংকরণের কাজ চলছে তো চলছেই। ভেবেছিলাম বছরদুয়েক আগেই বের হবে, হলো না নানা কারণে। এভাবে চললে হয়তো কয়েক খণ্ড একসাথে বের করতে হবে। টিনের বাক্সে বারো টাকা করে জমাতে থাকেন।
প্রথম সংস্করণে অলঙ্করণ না হয় একটু কম হলো। অলঙ্করণবিদের মনের মাধুরী মেশানো সম্পূর্ণ কাজ দ্বিতীয় বা তৃতীয় সংস্করণে আসুক। তবু অন্তত প্রথম খণ্ডটা এই জানুয়ারী, ২০১৯-এর ৩১ তারিখের মধ্যে বাজারে ছাড়ুন। সময় গেলে সাধন হবে না।
অটঃ আপনার সাথে থাকতে থাকতে বোধকরি অলঙ্করণবিদ 'চণ্ডীশিরা' রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এই রোগের একমাত্র ওষুধ হচ্ছে লাঠ্যৌষধী। অলঙ্করণবিদকে রগচটা সচলদের কাছে পাঠিয়ে দিন, একবেলাতেই রোগ সেরে যাবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
দিকনির্দেশনামূলক উত্তর দেয়া ধন্যবাদ, বইটা পেলে পড়ে দেখব। এমনিতঃ ইংরেজরা দেখেছি খাদ্য বিষয়ে উৎসাহী, যেমন tea rose, candy pink, chocolate colour। আপনার পদ্ধতিতে ফুল-ফল দিয়ে চেষ্টা করবো। আর শব্দকল্পদ্রুমের পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ফুশা ফুলটার বাংলা করা হয়েছে নটসারস, সে সূত্রে ম্যাজেন্টা রংটার বাংলা প্রস্তাব করা হয়েছে নটসারসী। এভাবেও চেষ্টা করা যেতে পারে।
নন্দলাল বসু Turquoise রংটার বাংলা করেছিলেন কাকডিমে (কাকের ডিমের রং)।
লালের কিছু ছটার জন্যে বাংলায় শব্দ আছে, কিন্তু প্রয়োগ ক্রমশ কমে এসেছে। যেমন, স্কারলেটের বাংলা কস্তা, কিন্তু কস্তাপেড়ে শাড়ির বাইরে এর প্রয়োগ আমার চোখে পড়েনি। আবার মেরুনের বাংলা তুবড়ি, কিন্তু এটা শুধু অভিধানে দেখেছি, প্রয়োগে পাইনি। প্রচলন থেকে ছিটকে পড়া এমন আরও বর্ণনাম শ'খানেক বছর আগের লেখাগুলোয় পাওয়া যেতেও পারে।
ক্রিমসনের বাংলা পেলাম পাকল।
নতুন মন্তব্য করুন