১.
অশেষ স্বলেহনের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি সহজে যূথচিন্তনের সুযোগও ফেসবুক খোলা রেখেছে। পরিভাষা নিয়ে চিন্তার জন্যে আগ্রহী কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়া এমনই এক যূথচিন্তনের জায়গায় সেদিন একটি প্রশ্ন দেখে থমকে গেলাম: "জেলিফিশের বাংলা কী হতে পারে?"
জেলিফিশকে বাংলায় উপকূলীয় অঞ্চলের বাঙালিরা কী বলে ডাকেন, জানি না। চট্টগ্রামের দুয়েকজন বন্ধুকে শুধিয়ে কোনো সদুত্তর পেলাম না, তাঁরাও একে জেলিফিশ হিসেবেই চিনেছেন এবং গ্রহণ করেছেন। বরিশালের লোককে উপকূলীয় ঠাউরে এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে ঘণ্টায় অষ্টাশি কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা শের-এ-বাংলা গোছের ঝাড়ি খেতে হলো, কারণ বরিশাল বিভাগীয় শহর, জীবনানন্দ-তপনরায়চৌধুরী-্আবুলহাসানের দেশ, ভাষিক কৃষ্টির দুনিয়ায় কলকেতার সমকক্ষ; উপকূলীয় হচ্ছে ঐ ভোলার মনুরা। ভোলার কাউকে চিনি না বলে ভূগোলের কাছে হেরে গিয়ে গুগোল করলাম, কিন্তু সে কেবলই লম্বাটে হতে চায়। মাফলেষুকদাচনী সে অনুসন্ধান মুলতুবি দিয়ে শেষটায় ভাবতে বসলাম। জেলির মতো অর্ধস্বচ্ছ থকথকে জিনিসের মধ্যে পাঙক্তেয় জিনিস ভেবে পেলাম শুধু মোরব্বা। এখন জেলিফিশকে যদি মোরব্বা মাছ ডাকি, সেটা কি পরিভাষা প্রণয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হবে?
না। জেলিফিশকে মোরব্বা মাছ ডাকলে ঘুরে ফিরে আবারও নিজেকে ইংরেজের অভিজ্ঞতার অংশ করে ফেলা হয়। মোরব্বা মাছ বড়জোর জেলিফিশের দুর্বল অনুবাদ হতে পারে, পারিভাষিক বিকল্প নয়। "জেলিফিশ" নামটাই এসেছে ইংরেজিভাষী জেলের অভিজ্ঞতা থেকে। প্রথমত, এটা "ফিশ"ই নয় (এদের "জেলি" বা "সি জেলি" বলা হয় এখন), দ্বিতীয়ত, এটা কেবলমাত্র ডাঙায় তুললে জেলির মতো থকথকে দলার চেহারা নেয়। পানির নিচে জেলিফিশের আকার বেশ মনোহর, প্রায়শই ছাতার মতো। ঐ ছাতায় কম্পন তুলে জেলিফিশ চলাফেরা করে, আর ছাতা থেকে বটের ঝুরির মতো নেমে আসা ঝুরিগুলো দিয়ে সে এটাসেটা ধরে খায়। কিন্তু জেলিফিশের সক্রিয়, স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক চেহারাটি ইংরেজিভাষী জেলের কাছে পাত্তা পায়নি। ওদিকে ইয়োরোপে প্রাণিবিজ্ঞান চর্চা করতে গেলে কমপক্ষে একটি ধ্রুপদী ভাষা, গ্রিক বা লাতিন, স্কুলে শিখতে হতো (এখনও অনেক ইয়োরোপীয় দেশে এটা পূর্বশর্ত), তাই বিজ্ঞানীরা এর নাম ধার করলেন গ্রিক উপকথা থেকে: গর্গনদের তিন বোনের একজনের নামে, মেডুসা। জেলিফিশকে ইংরেজের টিনের চশমা পরে দেখতে গেলে তাই সঙ্গে ধার করতে হয় তার খাদ্যরুচি, অথবা তার শাস্ত্ররস।
"রে" গোষ্ঠীর মাছকে বাংলায় নির্বিচারে "শাপলাপাতা" মাছ ডাকা হয়। মান্টা রে সেখানে বড় শাপলাপাতা মাছ, যেটার মণের দর ওপরের দিকে, আর স্টিং রে হয়তো ছোটো শাপলাপাতা মাছ, যেটা আরো সস্তা। নামটা সুন্দর, এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাথে সরাসরি অনুরণন তোলে "গুবরে পোকা" বা "অক্টোপাস"-্এর মতো (পূর্বশর্ত: শাপলার পাতা চিনতে হবে)। মান্টা রে-কে শাপলাপাতা ডাকার অর্থ বাংলাভাষী অঞ্চলের জন-অভিজ্ঞতার সমুদ্রে নোঙর ফেলে একে স্থাণু করা। সেটা "রশ্মিমাছ" বলে করা যায় না, শুধু বিদেশি ঢেঁকুরের দেশি প্রতিধ্বনি তোলা হয়।
পরিভাষা প্রণয়ন এ কারণেই অন্য ভাষার শব্দকে যান্ত্রিকভাবে বাংলায় অনুবাদ নয়, বরং ভিন্ন কিছু। জেলিফিশকে মোরব্বা মাছ না ডেকে শাপলাপাতার দেখানো পথে "ছাতাঝুরি" ডাকা যায়, কিংবা "কাঁপনছাতি"। ভাবছেন, জুইতের হয় নাই? তাহলে দেখুন নিচে।
এখানে স্মর্তব্য, জেলিফিশকে উপকূলীয় অঞ্চলের বাঙালি কী নামে ডাকেন, সেটার খোঁজ সবার আগে নেওয়া জরুরি। শাপলাপাতার মতোই মিষ্টি কোনো নাম হয়তো ইতিমধ্যে চালু আছে। তবে "হোগায়নিশান" পাখির নামের কথা মাথায় রেখে এ পথে সাবধানে হাঁটতে হবে।
২.
ইঁদুর তাড়ানো যায়, গর্ত তাড়ানো যায় না।
সাবেক উপনিবেশগুলোর ক্ষেত্রে এ কথাটা একটু বেশিই খাটে। ইংরেজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তার খোঁড়া গর্তগুলো বিরাট শূন্যস্থান হয়ে আমাদের সমাজে আর মগজে রয়ে গেছে। এ গর্তগুলো বোঁজানো হয়নি বলে একটা মজবুত ভিত্তি আর আমাদের পাওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। এ গর্তে যা-ই ঢালা হয়, ইঁদুরের শরীরের প্রস্থে ঢালাই হয়ে বেরিয়ে আসে। যাদের দায়িত্ব ছিলো গর্তগুলো বোঁজানোর, তারা ঐ গর্তেই ওম পেয়ে তৃপ্ত নিষ্কর্মে মশগুল থেকেছেন। ফলে এক ইঁদুরের জায়গায় আরেক ইঁদুর হাজির হলেও তার কোনো সমস্যা হয় না, ফুঁড়ে খাওয়ার পুরো অবকাঠামোই সে তৈরি পায়।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বহুলাংশে এখনও ইংরেজি। শেখানোর কৌশলে, এবং শিক্ষকের অদক্ষতার কারণে দেশের একটি বড় অংশের মানুষ (সনদের স্তর নির্বিশেষে) ইংরেজি পড়ে আর শুনে ঠিকমতো বুঝতে অপারগ, লিখে আর বলে বোঝাতেও। ইংরেজি এখনও কার্যত আমাদের "রাজভাষা", এখনও এ ভাষায় আদালতের কার্যক্রম চলে। ইংরেজি শেখার পেছনে আমাদের যে শারীরিক ও মানসিক চাপ আছে, তার ভগ্নাংশটুকুও বাংলা শেখার পেছনে নেই, কারণ প্রয়োজনীয় সময়-সম্পদ-সাধ্য ইংরেজি শিক্ষার পেছনে খরচ হয়ে যায়। তাই পরপর দু'টি রাষ্ট্রভাষায় আমরা ধরা খেয়ে যাই। মাতৃভাষায় কাঁচা হওয়া বেদনাদায়ক, এবং সে বেদনা অনুভবেও আমরা অপারগ হয়ে পড়ছি প্রতিদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললে যত্রতত্র নির্বিকার ভুল বানান আর অশুদ্ধ বাক্যগঠন দেখে যে কেউ মনে করবেন, দেশে বাংলা ভাষার কোনো অভিভাবক নেই। এর চাপ পরিভাষার ক্ষেত্রে সবচে প্রকট। আমরা ইংরেজিতে যা শিখি, সেটা ইংরেজি-না-বোঝা বাংলাভাষীকে বোঝানোর পথ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতি সরু, বা অনুপস্থিত।
পত্রিকায় অহরহ ইংরেজি খবরের বঙ্গানুবাদে এ খামতিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রতিদিন। কোনো ভাষায় আধেক বোধগম্যতা দুটি কারণে বিপজ্জনক। প্রথমত, এটি থেকে ভক্তি আর হীনমন্যতার দুটি শাখা জন্মায়, যা আত্মশক্তিকে প্রতিদিন ক্রমশ ক্ষইয়ে দেয়। ইংরেজিতে যে কাঁচা, অনুবাদ করে খবর সরবরাহের চাপে সে তখন নির্ভর করে সবচে-সরল-বাক্যে-সংবাদ-পেশ-করা ইংরেজিভাষী সংবাদমাধ্যমের ওপর। এ নির্ভরতা এক সময় তার কাছ থেকে যাচাইয়ের ইচ্ছা ও সক্ষমতা, দুটোই কেড়ে নেয়। অনেক সংবাদ মাধ্যমে সাংবাদিক ভাইয়েরা হয়তো এ কারণেই ডেইলি মেইলের মতো তৃতীয় শ্রেণীর ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড থেকে খবর বাংলা করে দিচ্ছেন আজকাল। একটা সময় পার হলে এভাবে বাংলাভাষী মানুষও ইংরেজিভাষীর ঢালা আবর্জনার ভোক্তায় পরিণত হন।
শেষ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষাটা আমাদের ভিটেয় ইংরেজের খুঁড়ে রেখে যাওয়া দুটি মস্ত, পরস্পরযুক্ত গর্তের একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে (অপরটি আমলাতন্ত্র)। আমরা এ ভাষায় জ্ঞানসমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়াই, এবং কোঁচড়টা ভরে গেলে পরমতাচ্ছিল্যে এ ভাষায় যে অপারগ, তার দিকে করুণাভরে ফিরে চাই। সেদিন এক এনজিওকর্মী বড় ভাইয়ের কাছে শোনা গল্পে জানলাম, যিনি পুষ্টিবিজ্ঞানে লেখাপড়া করে দক্ষ হয়ে ওঠেন, তিনি যখন গ্রামের মানুষকে খাবারের এটাসেটা বোঝাতে যান, তখন "আয়রন অ্যাবজর্পশন" ছাড়া কথা বলতে পারেন না। জ্ঞান আহরণের জন্যে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু সুফলার্থীর কাছে সে জ্ঞান পৌঁছে দিতে গেলে পরিভাষার গুরুত্ব এখন অতীতের চেয়েও অনেক বেশি। কারণ ২০১৮ সালে একজন জ্ঞানী মানুষ এ জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে যতো দেরি করবেন, তৃতীয় শ্রেণীর ট্যাবলয়েডি আবর্জনার স্তুপ ভোক্তার সামনে ততো উঁচু হতে থাকবে।
দ্বিতীয় যে বিপদটি, সেটির মাত্রা আরেকটু সূক্ষ্ম। প্রথম দেখায় তাকে আমোদজনক বলে ভ্রম হতে পারে। যেমন কিছুদিন আগে বিডিনিউজ২৪.কমে প্রকাশিত একটি খবরের [সূত্র] একাংশে পড়লাম:
"স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, আসিয়া এর আগেও শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তার কথিত প্রেমিক ও প্রেমিকের আন্টিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।"
কিংবা ইউপিএল থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত আবদুল কাইয়ূম খানের লেখা "A Bittersweet Victory: A Freedom Fighter's Tale" এর প্রথম সংস্করণে
পৃষ্ঠা ৪০, ফুটনোটে লেখা আছে,
"Quazi Nooruzzaman, A Sector Commander Remembers the Bangladesh Liberation War 1971, Dhaka: Writer’s Ink, 2010. Colonel M. A. G. Osmany’s shotguns were deposited by a nephew after he had crossed over to India. Osmany had sent a special message for this purpose. He was complying with the orders of the Pakistan Army even after he had fled the country."
এখানে প্রথম উদ্ধৃতিটি স্পষ্টতই গ্রাম্য চিত্তের চিন্তনকাম চরিতার্থ করার জন্যে, আর দ্বিতীয়টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে ওসমানীর আচরণকে বোঝার জন্যে ইতিহাসবিশ্লেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দু'টি উদ্ধৃতিই আমাদের সামনে অভিন্ন সমস্যা হাজির করে। জনৈকা পলায়নপরায়ণা আসিয়ার প্রেমিকের আন্টির খবরটি অনুবাদ করতে গিয়ে বিডিনিউজ২৪.কম-এর নিউজ ডেস্ক ভাইয়া "আন্টি"র অনুবাদ করতে গিয়ে স্পষ্টত আটকে গিয়ে সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত আন্টিই রেখে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে ও ভাষায় স্বজনকাঠামো বা কিনশিপ ইংরেজের সমাজ ও ভাষা থেকে ভিন্ন। বাংলায় আন্টির বহু রকম আছে, খালা-ফুপু-মামী-চাচী-মাওই। আসিয়ার প্রেমিকের কেমন আন্টিকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না, কিন্তু যদি আসতো-যেতো? তাহলে কী হতো, সেটা দ্বিতীয় উদাহরণে স্পষ্ট। ওসমানী যে "নেফিউ"কে দিয়ে তাঁর শটগানটি থানায় জমা করিয়েছিলেন বলে আবদুল কাইয়ূম খান কর্নেল নূরউজ্জামানের বইকে সূত্র মেনে আমাদের জানালেন, এ কি ভাতিজা নাকি ভাগ্নে, অথবা শালির পুত নাকি শালার ছাও? যাচাইয়ের জন্যে যদি আমরা আজ খোঁজ নিতে বেরোই, তাহলে ইংরেজি "নেফিউ" শব্দটা প্রথমেই আমাদের অনুসন্ধানের পরিধি বাড়িয়ে দেবে (ধন্যবাদ আসিয়া, আমাদের জীবনে এমন হোমিওপ্যাথিক মাত্রার ক্ষীণ প্রভাব রাখার জন্যে)। ইংরেজি আর বাংলার প্রকাশসূক্ষ্মতা বা নুয়্যান্স ভিন্ন (ইংরেজি এদিক থেকে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে, কিন্তু স্বাজন্যবাচক শব্দের দিক থেকে বাংলা এগিয়ে), যথাযথ পরিভাষার অভাব একটা পর্যায়ে গিয়ে কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এটিই দ্বিতীয় বিপদ, মোটাদাগের ইংরেজির কাছে সূক্ষ্মদাগের বাংলার, বা মোটাদাগের বাংলার কাছে সূক্ষ্মদাগের ইংরেজির কণ্ঠ চাপা পড়ে যাওয়া।
(দুটো পরিস্থিতি ভাবুন। প্রথমত, কেউ যদি ইংরেজিতে লেখেন, "মাই কাজিন বকুল...", তাহলে প্রয়োজনে এ অচিনলিঙ্গনামা বকুলের সন্ধানে লেখকের আট রকমের স্বজনের খোঁজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গল্পে এমন একটা সমাজ তৈরি করলেন যেখানে মামীর ছোট বোন ছেলেদের পাত্রী হিসেবে প্রথম পছন্দ, কিংবা ফুপার ছোটো ভাই মেয়েদের পাত্র হিসেবে। কেবল ঐ গল্পের খাতিরে তখন "মামীর বোন" বা "ফুপার ভাই"-এর একটি একক স্বাজন্যবাচক শব্দ দরকার হতে পারে, যেটি বাংলায় এখনও নেই।)
৩.
ফ্যান্টাসি গল্প - রচনা বা পাঠ - শেষ পর্যন্ত অচেনাকে চিনতে নেমে আপনাকে চেনার যাত্রা। নিজেকে ভিনভাষায় চেনার মধ্যে গ্লানি আছে, সে গ্লানি মোচনের চেষ্টায় আনন্দও আছে। শব্দগল্পদ্রুম লিখতে গিয়ে বারবার সে গ্লানিটুকু সামনে চলে আসে, নইলে আনন্দটুকুর সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটানো মুশকিল। ফ্যান্টাসির জগৎ যেহেতু চেনা পৃথিবীর কাল্পনিক বিকল্প, তার গাঁথুনিতেও তাই বারবার চেনা শব্দের কল্পনাখনিত বিকল্প গুঁজতে হয়। গল্পের কোনো চরিত্রকে সাগরে ফেলে দিয়ে তার পাছুতে বিষাক্ত ছাতাঝুরির হুল ফুটিয়ে তাকে চৈতন্যপ্রমাদের আবছা জগতে ঠেলে দেওয়া, কিংবা তার পাতে সদ্য ঝলসানো প্রকাণ্ড এক আটঠ্যাঙার টুকরো তুলে দেওয়া, কিংবা বরফে জমাট হ্রদে গর্ত খুঁড়ে তেলচুকচুকে সায়রভুলু শিকারে ঠায় বসে থাকা দুই বাচাল চরিত্রকে মেরুভালুকের তাড়া খাওয়ানোর পেছনে আমোদটুকু তখন ভাগ করে নেওয়া যায়, যখন জেলি-অক্টোপাস-সিল এর পারিভাষিক বিকল্পের খোঁজ করার খানাখন্দভরা রাস্তাটুকু ধরে পাঠকও খানিকটা হাঁটেন। একটা অনুপস্থিত শব্দের পায়ের ছাপ ধরে এগোলে হঠাৎ এক বিচিত্র নতুন জগতের দোর খুলে যায়; সে জগতের মাটি আপনার মৃৎশিল্পী হয়ে ওঠার অপেক্ষায়, তার লোহা আর কয়লা অধীর আগ্রহে পড়ে থাকে আপনার কামারশালার জন্যে। প্রতিদিনের আটপৌরে ইংরেজি শব্দের বাংলা বিকল্প সন্ধান এক রোমাঞ্চকর অভিযান, নতুন বছরে তাতে ঝাঁপ দিন হাত-পা মেলে।
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
মন্তব্য
নতুন বছরের শুভেচ্ছা!
যূথচিন্তন শব্দটা মনে ধরেছে। ব্রেইনস্টর্মিং শব্দ শুনলে প্রায়ই আমার মনে হত, এটার বাংলা কি হতে পারে। আমার মাথায় আগে 'মস্তিষ্ক ঝড়' ছাড়া কিছু আসে নি।
ঔপনিবেশিক নারকেলমন, নিজের ভাষার ওপর শ্রদ্ধা আর দক্ষতার অভাব (এরা অন্য কোন ভাষা জানে ভালো করে এরকম না) বাংলা শব্দ বাড়ার প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করে। সেদিন বাংলা ট্রিবিউনের একটা খবর পড়ছিলাম। পড়ে মনে হচ্ছিলো খবরটাতে ইংরেজি শব্দের সংখ্যা বাংলা শব্দের সংখ্যা থেকে বেশি। এভাবে চলতে থাকলে বাংলা ভাষা দীর্ঘমেয়াদে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
জেলিফিশ = "ছাতাঝুরি"
নুয়্যান্স = প্রকাশসূক্ষ্মতা
এমনকি পাঠক হিসেবে হলেও আপনাদের চেষ্টায় সামিল হওয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেকে যুক্ত করার, যুক্ত থাকার সুযোগ পাচ্ছি - ভাল লাগে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
গ্যালারি (গ্যালারির বাংলা কী হতে পারে?) ছেড়ে চলে আসুন ময়দানের কাদায়। দর্শক থেকে হয়ে উঠুন গোলে গোলে গোলীয়ান। অলমতি বিস্তরেণ।
দ্র.: আপনি তো ছবি তোলেন। বেশ কিছুদিন আগে আলাপ চলছিলো ঐ যূথচিন্তনের দাওয়ায়, লেন্সের বাংলা কী হতে পারে সেটা নিয়ে। একটা পরামর্শ এসেছিলো, "কোরক", সেটা একক লেন্স নিয়ে। কিন্তু ক্যামেরার লেন্স একটা সামষ্টিক ব্যবস্থা, এর ক্ষেত্রে ভিন্ন শব্দ প্রয়োজন (জার্মানে যেমন "লিনজে" আর "অবিয়েক্টিভ")। লেন্স যেহেতু ক্যামেরার চোখ, "দৃক" বলা যায়। ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্স হবে আয়তদৃক, জুমলেন্স হবে দূরদৃক, ফিশাই লেন্স হবে মীনদৃক, ম্যাক্রোলেন্স হবে অণুদৃক। এ নিয়ে আপনিও ভেবে কিছু যোগ করতে পারেন মনে হয়।
(১) আপনি এখানে যে প্রসঙ্গে বলতে চাইছেন, তাতে গ্যালারির বাংলা দর্শকাসন চলতে পারে মনে হয়।
(২) ক্যামেরাতে লেন্স বলতে যা আমরা বুঝাই তা একগুচ্ছ লেন্স-এর সমন্বয়ে গঠিত একটা যন্ত্র। এইরকম যন্ত্র - পাশাপাশি বসানো অন্ততঃ ২ টি লেন্সএর সমন্বয়ে গড়া - বাইনোকুলার। চোখ-এর ভূমিকা পালন করার সুবাদে, অভিধানে বাইনোকুলার-এর প্রতিশব্দ পাওয়া যায় - দ্বিদৃক। অর্থাত্ লেন্স-জগতে দৃক এসে রয়েছে। এবার আপনি যে রকম বলেছেন সেইভাবে দূরদৃক, মীন্দৃক, অণুদৃক-দের নিয়ে আসার ভার আমাদের উপর।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আচ্ছা, ভাষা আর পরিভাষার মধ্যে তফাৎ কি?
****************************************
বাংলাপিডিয়ার এই পাতাটা বেশ পছন্দ হোল।
http://bn.banglapedia.org/index.php?title=পরিভাষা
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মূল লেখা এবং মন্তব্য আগ্রহ ভরে বেশ কয়বার পড়লাম। আগ্রহোদ্দীপক।
ছাপার অক্ষরের সাথে মানুষের যোগ শুধু ক্ষীণ হয়েই আসা না, সহজলভ্য ছাপার অক্ষরের লেখায় বিদেশি শব্দের ব্যবহারও বেড়েই চলছে। এই অবস্থায় বিকল্প বাংলা শব্দের তৈরীর চেষ্টা কঠিনই বটে। সংবাদ মাধ্যম এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখতে পারত। মনে পড়ে সফিক রেহমান তখনকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক যায়যায় দিনে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের সাথে ‘আভিজাত্যের’ একটা উদ্ভট ধারণা প্রচলন করেন। অথচ অনেক পরেও অনেক জন গুরুত্বপূর্ণ লোককে দেখেছি চমৎকার বাংলায় কথা বলতে। পুলিশের প্রাক্তন আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার তাদের মধ্যে একজন।
কিছু কিছু কাগজ, যেমন বিডিনিউজ২৪.কম আর পাকির আলোতে পারিভাষিক বিস্তারের চেষ্টা চোখে পড়ে। কয়েকটা কাগজের অবস্থা খুব করুণ, বানান ও বাক্যগঠন পড়লে মনে হয় ক্লাস নাইনে উঠতে অপারগ ছেলেমেয়েরা চালায় ঐসব। ফেসবুক দেখলে আবার এই ভ্রম কেটে যায়, ওখানে বড় বড় দিগগজেরা কাপড়কে পাঠ্য আর বইকে পরিধেয় বানিয়ে ঘোরেন-ফেরেন।
কিছুদিন আগে অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহানের একটি বক্তৃতা নিয়ে করা সংবাদ [সূত্র] পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। বেশ আয়াসসাধ্য একটি বিষয় নিয়ে তিনি প্রাঞ্জল বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, একটিমাত্র ইংরেজি শব্দ ছিলো তাতে, "স্লোগান"। সেদিন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর লেখা একটি বই পড়ে জানলাম, পদার্থবিদ সত্যেন বোস নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি বাংলার ওপরও পাঠদান করতেন। আমার মনে হয়, আমাদের একটি সামাজিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে: নিজ ভাষায় প্রকাশ করতে না পারলে কাউকে পাণ্ডিত্যের পূর্ণমূল্য দেওয়া উচিত নয়। আর জনগণের করের টাকায় যাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তারা গণমাধ্যমে বাংলায় বক্তব্য দিতে বাধ্য থাকবেন। এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারলে পরিভাষার ফাঁকগুলো হয়তো দ্রুত ভরাট হতো।
অনেকদিন আগে মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবির একটি ঘাঁটিতে বর্মী সীমান্তসেনারা গোলাবর্ষণ করেছিলো। সাংবাদিকরা বিজিবির এক কর্নেলের সাক্ষাৎকারের শব্দছবি ইউটিউবে তুলে পেশ করেছিলেন। তিনি খুব প্রাঞ্জল বাংলায় বলেছিলেন, "আমরা পাল্টা গোলাবর্ষণ করে তাদের জানিয়ে দিয়েছি, আমরা প্রস্তুত আছি, সুসজ্জিত আছি।" কথাটা শুনে কেন যেন বেশ ভরসা হয়েছিলো লোকটার ওপর, মনে হয়েছিলো এই কর্নেল একাই একটা পাহাড় হয়ে শত্রুর সামনে দাঁড়াতে পারবেন।
ভুলেভালে ভরা পাকিস্তানামলি আমলি/ফৌজি ইংরেজি শুনলে মনে হয় বক্তা কোনো কিছু চুরি করতে এসেছে। সুগঠিত বাংলা বাক্য শুনলে বরং একটু আশ্বাস জাগে।
কয়েকদিন আগে পড়া বই, ইউপিএল থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত আবদুল কাইয়ূম খানের লেখা "আ বিটারসুইট ভিক্টরি: আ ফ্রিডম ফাইটার'স টেল" থেকে প্রাসঙ্গিক একটি অংশ তুলে দিচ্ছি, চিন্তার খোরাক আছে:
আমাদের বলনে চলনে মননে এতো বেশি সংখ্যক বিদেশী শব্দ ঢুকে গেছে, মনে হয় মাছের কাঁটা আর কাঙ্কো জুড়ে রয়েছে দুম্বার মাংস।
আর বিপরীতে বাংলা ভাষার অনেক সুমধুর শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে।
এই কবিতাটা দেখেন, আমরা ছোটবেলায় পড়েছি। কিন্তু এখন এই কবিতার অর্ধেক শব্দও আর ব্যবহৃত হয় না। কদিন পরে লোকজনরে এই কবিতা শোনালে তর্জমা করে দিতে বলবে!
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
মাসুদ রানার এক পর্বে (সম্ভবত "আমিই রানা") কে বা কাহারা (সম্ভবত একটি প্রভাবশালী মহল, কিংবা দুর্বৃত্ত) যেন রানাকে ধরে মুখে অস্ত্রোপচার করে বুড়াধুড়া বানিয়ে দেয়, সঙ্গে স্মৃতিও সম্মোহন করে গায়েব করে দেয়। বেচারা রানা তার জোয়ান শৈলডার সাথে বুড়া চেহারাডা নিয়ে খুউপ বাটে পড়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে। কিন্তু দূরদর্শী অবজেনারেল রাহাত খান এমন পরিস্থিতি আঁচ করে রানাকে আগাম প্রতিষেধক সম্মোহনী ডলা দিয়ে রেখেছিলেন, সেটা তো আর দুর্বৃত্তরা জানতো না। রানা তাই চলতে-ফিরতে ঘুমঘোরে একজোড়া কুঞ্চিত কাঁচাপাকা ভুরু দেখে আর তর্কালঙ্কারের এই ছড়াটা দুই পঙক্তি করে শোনে। এই ছড়াটা এক আত্মজাগরণী মন্ত্র হয়ে ওকে একটু একটু করে মনে করিয়ে দেয়, ও কে কী কেন।
কাজীদা লোকটা (সেবার তৎকালীন লেখকমণ্ডলীসহ) শুধু বস প্রকৃতির লোকই নন, বরং প্রকৃত বস লোক।
হিমু ভাই, ধন্যবাদ চমৎকার লেখাটির জন্য। আমি আপনার এই ধারাবাহিক লেখার এক আগ্রহী পাঠক। নিজের একটা-দুটো ভাবনা এখানে সহভাগ করে নিতে পারি।
নতুন শব্দ যেগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলো কখন ভাষায় স্থান পাবে? শব্দগুলো অভিধানের ভুক্তিই বা কখন হবে? অক্সফোর্ড এর অভিধানে একটা নতুন শব্দ যখন অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাকে কঠিন পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হলো শব্দটা ব্যবহারের ব্যাপকতা কেমন। বাংলা অভিধানের ক্ষেত্রে ভুক্তির ব্যাপারটা কিভাবে হয় জানা নেই, তবে 'ব্যবহারের ব্যাপকতা' সব ভাষাতেই গুরুত্বপূর্ণ। তাই যে নতুন শব্দগুলো তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলো ব্যবহার হওয়া দরকার। এগুলো ব্যবহার করে গল্প, কবিতা, গান হওয়া দরকার। 'ছাতাঝুরি'র মতো একটা চমৎকার দৃশ্যকল্পময় শব্দ হারিয়ে যাবে- যদি গানে, কবিতায়, গল্পকথায় কেউ ব্যবহার না করে। শুধু একটা শব্দকে পরিচয় করানোর জন্যও একটা গান হতে পারে। সেটা আপনার থেকে শুরু হলেও দারুণ হবে!
দ্বিতীয়ত, একটা অনানুষ্ঠানিক বা বিকল্প অভিধান তৈরি করে ফেলা যায় আন্তর্জালে তৈরি হওয়া নতুন শব্দগুলো নিয়ে। সেটা উইকিপিডিয়ার আদলে হতে পারে। সেখানে দুই বাংলার মানুষেরাই থাকবে। নতুন শব্দের প্রস্তাবনা আসবে, সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকবে। তাহলে কবি লেখকেরা সেটার দ্বারস্থ হতে পারবে প্রয়োজনের সময়। আমি যদি 'জেলিফিশ' এর বাংলা চাই, সেখানে ছাতাঝুরি পেয়ে যাব সহজেই।
ধন্যবাদ
অভিধান আসলে কেবলই একটা সংকলন, যেটা সংকলয়িতার চয়ননীতির প্রকাশমাত্র। যেমন, বাংলা একাডেমি থেকে বের হলে সে সংকলনের গায়ে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ছাপ্পড় থাকে, যেটা ভরসা যোগায়। কিন্তু সব অভিধান প্রতিষ্ঠান থেকে বেরোয় না (উদাহরণ, রাজশেখর বসুর চলন্তিকা)। এখন আপনি কোন অভিধানে ভুক্ত হলে নতুন শব্দ "ভাষায় স্থান পেয়েছে" বলে মেনে নেবেন, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করে। যেমন আপনি "সহভাগ" (সম্ভবত to share a thought এ শেয়ারের বিকল্প হিসেবে) বলছেন, এটা আমার জানামতে এখনও কোনো অভিধানে ভুক্ত হয়নি (আমার জানায় ভুল থাকতে পারে)। কিন্তু আপনি তো ঠিকই বলছেন, তাই না?
"ব্যবহারের ব্যাপকতা" অভিধানে ভুক্ত হওয়ার জন্যে একটা জরুরি মানদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা জনগোষ্ঠীর কোন প্রস্থচ্ছেদে? আজ যে কৃষক পঞ্চগড়ে বাস করেন, তিনি প্রতিদিনের জীবনে "ছাতাঝুরি" বা "জেলিফিশ" এড়িয়ে কয়েক দশক কাটিয়ে দিতে পারবেন। শব্দ যে প্রপঞ্চের প্রতিনিধিত্ব করছে, সেটার অংশীদারদের মাঝে ব্যবহারের ব্যাপকতা যদি দাবি করেন, তাহলে অভিধানভুক্ত প্রচুর শব্দই বাদ পড়ে যাবে। আমাদের দেশে কয়জন মানুষ "প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব" শব্দটা ব্যবহার করেন? অভিধানে কিন্তু ভুক্তি আছে। এখন "ছাতাঝুরি"র ভাষিক অংশীদার কারা, সেটার খোঁজ কি অভিধানপ্রণেতা নেবেন? অভিধানের দিকে কাঙালের মতো চেয়ে রইলে ইহজীবনে আর পারিভাষিক বিকল্প পাবো বলে তো মনে হয় না, যদি ওরকম অভিধান লেখকেরা নিজে লিখে না নেন।
হ্যাঁ, সে সম্ভাবনা প্রবল। অভিধানভুক্ত হাজার হাজার শব্দই যেখানে প্রয়োগের অভাবে হাওয়া, সেখানে নতুন শব্দগুলো ভাতে মরারই কথা। দেখি, কী হয়।
বিকল্প অভিধান তৈরি করা যায়, কিন্তু সমস্যাটা অভিধানের অনস্তিত্বে নয়। সমস্যাটা ইংরেজি শব্দের বিকল্পের প্রয়োজন বোধ না করা, বিকল্পের অভাবে অপমানিত বোধ না করা, এবং বিকল্পের সন্ধানে তৎপর না থাকা নিয়ে। কবি-সাহিত্যিকেরা যদি বাংলার ছোটোলাট হয়ে শুধুমাত্র "দ্বারস্থ" হয়ে আমাদের বিকল্প অভিধানকে ধন্য করেন, কোনো লাভ আছে? নতুন শব্দ তো কবি-সাহিত্যিকদের হাত ধরে জন্ম নেওয়ার কথা। তাঁদের বরং এ কাজে হাত লাগিয়ে হাত ময়লা করতে হবে। যেদিন এমন হাত-ময়লা কবি-সাহিত্যিক চোখে পড়বে, সেদিন নাহয় বিকল্প অভিধানের কথা ভাবা যাবে।
দ্রষ্টব্য: মত জানানোর জন্যে শেয়ার অর্থে "সহভাগ" শব্দটা যদি ব্যবহার করেন, তাহলে জানাতে চাই, এর মধ্যে একটা অপ্রয়োজনীয় দ্বিরুক্তি আছে। কারো সাথে কোনো কিছু ভাগ করে নিলে "সহ" আর লাগে না, "সহ" মানেই আপনি সেখানে অংশী (সহোদর, সহমর্মী, সহযোগী)। আমার মনে হয়, টু শেয়ার আ থট উইথ সামওয়ানের বাংলা হতে পারে "কাউকে কোনো ভাবনা জানানো", "কাউকে ভাবনার অংশী করা"। কোনো আধেয় যখন আমরা সামাজিক মাধ্যমে Share করি, আমরা আসলে সেটা প্রচার করি বা ছড়িয়ে দিই। এর আক্ষরিক অনুবাদ হিসেবে "সহভাগ করুন" একটু কেঠো শোনায় না?
গত কয়েকদিন ধরে নদীর মোহনায় আর আরেকটু উজানে Sailfish ধরা পড়ছে [সূত্র ১]। জেলেরা এর নাম দিয়েছেন পাখি মাছ [সূত্র ২]। পৃষ্ঠডানা আর দীর্ঘ চঞ্চুর কারণেই সম্ভবত এমন নাম জুটেছে। যারা বা যিনি এই নামটি রেখেছেন, ইংরেজি নামের সাথে তাদের বা তার পরিচয় নেই, এমনটা অনুমান করা যায়। দেশি জেলেরা যে ধরনের পাল দেখে অভ্যস্ত, তার সাথে এ মাছের পাখনার সাদৃশ্য নেই, বরং পাখির সাথেই তারা মিল খুঁজে পেয়েছেন। ইংরেজি থেকে টুকে এর বাংলা যদি পাল মাছ রাখা হতো, সেটাই বরং অংশীদের কানে খাপছাড়া ঠেকতো।
এই নামটায় একটাই গেরো, ইংরেজিদুরস্ত লোক একে Flying Fish এর সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারে। খবরের কাগজেই এর উদাহরণ মিলবে [সূত্র ৩], যেখানে সাংবাদিক অবলীলায় ফ্লায়িং ফিশের ছবির নিচে সেইলফিশের ছবি (দুটো দেখতে একেবারেই দু'রকম) জুড়ে দুটিকে এক ও অভিন্ন পাখি মাছ লিখে প্রতিবেদন হেঁকেছেন। শব্দ আর ভাষা যে মানুষের চোখে ঠুলি পরাতে পারে, তার জোরালো উদাহরণ এটি।
অভিধানে ফ্লায়িং ফিশের বাংলা ভুক্তি উড়ুক্কু মাছ। আমার একটি লেখায় সেটির ঈষৎ ভিন্ন নাম (উড়কি মাছ) ব্যবহার করেছি।
নতুন মন্তব্য করুন