“তোমাদের তুমি করেই বলি, নাকি?” করমর্দনের সময় টের পেয়েছি, ভদ্রলোকের কব্জিতে সেরকম জোর, কিন্তু তাঁর কণ্ঠটি বড় মোলায়েম আর সুরেলা। জমিদার বংশের লোক, আলিশান প্রাসাদের মতো বাড়ি হাঁকিয়ে থাকেন এই ধুধু পারাবারের মাঝে, হয়তো অবসরে মুগুর আর তানপুরা দুটোই কষে ভাঁজেন। গদোগদো গলায় প্রায় সায় দিয়ে ফেলছিলাম, কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগী দুলালটা সব সৌজন্যের দফা রফা করে দিয়ে ফোঁস করে উঠে বললো, “ক্যান, তুমি কৈরা কৈবেন ক্যান?”
দুলালটা এমনই, হিংসুটে আর হীনমন্য। সারারাত আধোঘুমে বাসযাত্রা শেষে সুনামগঞ্জে নেমেও সে খোশমেজাজেই ছিলো, ইচ্ছামতো পরোটা সাঁটিয়েছে মুরগির গিলা-কলিজা দিয়ে। কিন্তু ঘাটে পৌঁছে বজরার চেহারাটা দেখেই সেই যে মুখ কালো করে বসে আছে, কিছুতেই তাকে আর চাঙা করা যায়নি। দুলালের বৌ দুলারি অবশ্য আমার মতোই সরলচিত্ত ভালো মানুষ, হাঁ করে ঘুরেফিরে বজরার নকশা আর হালচাল দেখে পাঁচ মিনিট পরপর দুলালকে গিয়ে সমাচার ঠুকছিলো সে। পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি তাতে, গোমড়ামুখে বজরার ছাদে বসে নাক খুঁটে আর ভ্যানভ্যান করে যাত্রাপথে আড্ডার আনন্দ মাটি করেছে দুলাল গাণ্ডুটা। নদী, হাওর, মেঘ আর রোদের খেলা, ভাসমান ডিঙির বাজার, জেলেনৌকা, নদীর জলে ঝুঁকে পড়া প্রকাণ্ড হিজল গাছ থেকে গ্রামবাসী শিশুদের ঝাঁপ, কিছুই দুলালের মনে আর দাগ কাটতে পারেনি। বজরার কাঠ খাঁটি সেগুন হতেই পারে না, দরজার হাতলগুলি খাঁটি রূপার প্রলেপ দেওয়া হতেই পারে না, চায়ের সরঞ্জাম আগাগোড়া খাঁটি রূপার হতেই পারে না, কাপ-পিরিচ-চামচ ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মান কারিগরের তৈরি হতেই পারে না, খানসামার উর্দিটা এতো পরিষ্কার কেন, বজরার সারেং ইংরেজি বোঝে কেন, বজরার সুকানির গাল কামানো কেন, বজরার ভেতরে কেন তেলাপোকা নেই, ইত্যাদি বকে বকে আমার আর দুলারির মাথা ধরিয়ে দিয়েছে সে।
নক্রচৌধুরী সাহেবের বাড়ির পেতলবাঁধানো কাঠের গুঁড়ি দিয়ে গড়া ঘাটে এসে বজরা ভেড়ার পর দুলালের মুখের দিকে আর তাকানোই যাচ্ছিলো না। দুলারি আর সইতে না পেরে চাপা গলায় সারেঙের সামনেই ধমকে দিয়েছে তাকে, “একটা লুক বড়লুক হৈলে তুমার কী সমিস্যা? কুন গিয়ানজাম করবা না খাবাদার কৈলাম!”
দুলাল মিনমিন করে তবুও বলেছে, “চৌধুরীর আগে নক্র ক্যান?”
দুলালের কালো মুখ আরো কালো করে দিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে উর্দি পরা বেয়ারা বেরিয়ে এসে (তার হাতে ঘড়ি আর পায়ে বাটার জুতো কেন? গোস্বা দুলালের) আমাদের ভ্রমণজীর্ণ গাঁটরি-বোঁচকা যখন একে একে নিয়ে যাচ্ছিলো বাড়ির ভেতর, তখন দুলালের হীনমন্যতার মড়াটাকে দুরমুজ করার জন্যেই যেন খাঁড়া হয়ে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির ভেতরে সুড়কিবাঁধাই এক সরু সড়ক ধরে এসে হাজির হয়েছেন আমাদের মেজবান মহাশয়, সাইফুল্মুল্ক নক্রচৌধুরী।
তবে নাটক-সিনামায় যেমনটা দেখা যায়, পুরোদস্তুর ইয়োরোপীয় ঘোড়ায় চড়ার জামা পরে জমিদারের নাতিপুতিরা হাজির হয়, এঁর বেশভূষা তেমন নয়। পা পর্যন্ত আঁটো পায়জামার ওপরে একটা কোমর অব্দি গোটানো ঢোলা আলখাল্লা পরা, মাথার ওপর আবার সেই আলখাল্লার সাথে বোনা ঘোমটা টানা। অভ্যুত্থান-করে-গদিচড়া জেনারেলদের মতো গাঢ় রোদচশমা চোখে, হাতে সাদা চামড়ার দস্তানা। আমি যেভাবে অনায়াসে সকালে খাট থেকে মেঝেতে নামি, তিনি ঘোড়া থেকে নামলেন তেমনি ঢঙেই, যেন একটা জ্যান্ত আলখাল্লাই আচমকা কোমর থেকে গোড়ালিতে নেমে এলো। দুলালের চোখমুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না বলে দুলারির দিকে চেয়ে দেখি সে মুগ্ধ চোখে হাঁ করে চেয়ে দেখছে নক্রচৌধুরীকে। সাইফুল্মুল্ক অবশ্য কোনো ছ্যাবলামো করলেন না দুলারির সাথে, গভীর তাজিমের সাথে একটা খাটো কুর্নিশ করে শুধু বললেন, “খুব ভালো লাগছে তোমাদের স্বাগত জানাতে পেরে।” |
তারপর কী হলো তা তো শুরুতেই বললাম।
নক্রচৌধুরী দুলালের ফোঁসফাঁসকে যেন পাকা বেদের মতোই সামলে নিলেন, “আমি বয়সে মুরুব্বি যে? কিন্তু মুরুব্বিয়ানা করবো কার ওপর, সারা বছর তো একরকম ফাঁকাই পড়ে থাকে এ হাভেলি। তাই তো আমার দোস্ত চৌধুরীর কথা শুনেই রাজি হয়ে গেলাম তোমাদের সঙ্গ পেতে।”
দুলারি দুলালের বাহুতে একটা রামচিমটি কাটলো, নক্রচৌধুরীর সাথে করমর্দনের পর দুলাল দ্বিতীয়বারের মতো ডুকরে উঠলো, “উহু!”
নক্রচৌধুরী আমার দিকে ফিরে হাসিমুখে বললেন, “পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
আমি গদোগদো হেসে বললাম, “না না না না, কোনো সমস্যা হয়নি।”
এক সহিস কোত্থেকে যেন ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয়ে ঘোড়াটাকে লাগাম ধরে হাঁটিয়ে বাড়ির থেকে দূরে কোথাও নিয়ে চললো। নক্রচৌধুরী আকাশের দিকে ক্ষিপ্র দৃকপাত করে বললেন, “আজ দিনটা ভারি সুন্দর। কিন্তু রোদ উঠে যাচ্ছে, চলো ভেতরে যাই।”
ভদ্রলোক এখনও চোখ থেকে রোদচশমা খোলেননি বলে একটু খটকা লাগছিলো আমার। আলাপীর কাছ থেকে চোখ আড়াল করে রাখা অভদ্রতা, কোথায় যেন শুনেছিলাম, কিন্তু জমিদারের নাতিপুতিদের এসব দোষত্রুটি ধরতে নেই, বিশেষ করে তারা যদি মেজবান হয়। দুলাল গজগজ করে উঠলো, “হ রৈদ লাগলে গায়ের চামড়া কালা হৈয়া যায়।”
সাইফুল্মুল্কের মুখের খানিকটা চামড়া কেবল দেখা যায়, তিনি খুবই ফর্সা, কয়েক পুরুষ ধরে জমিদারের ঘরে ফর্সা মেয়েরা বউ হয়ে আসার জ্যান্ত ইতিহাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুলালের কথা শুনে তিনি চাপদাড়ির ফাঁকে দাঁত বের না করেই হাসলেন শুধু। “ইন্ডিড!”
দুলারি ইচ্ছা করেই একটু পিছিয়ে পড়লো দুলালকে নিয়ে, তার ইশারা পেয়ে আমি নক্রচৌধুরীর সামনে জোর কদম বাড়িয়ে বললাম, “আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না আপনি আমাদের চেয়ে বয়সে মুরুব্বি।”
নক্রচৌধুরী দুলারিকে একান্ত দূরত্ব ছেড়ে দিয়ে আমার চেয়েও জোর কদমে খানিক দূরে তিনতলা বাড়িটার দিকে এগোলেন। “শুধু তোমরা কেন, বয়সে আমি চৌধুরীরও মুরুব্বি।”
আমি একটু পিছিয়ে পড়লাম কথাটার ধাক্কায়। প্রৌঢ় চৌধুরীর মুরুব্বি হতে গেলে কমসেকম দাড়িটা তো পাকতে হবেই। অবশ্য সাইফুল্মুল্ক ঘোড়া ছাড়াই যেন ঘোড়ার বেগে হাঁটছেন সাঁইসাঁই করে, আমার বয়সী হয়েও তাঁর লগ ধরতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে আমাকে। অবশ্য জমিদার বংশের লোক, হয়তো পূর্বপুরুষ ভেজাল ছাড়া দুধ-ঘি আর কীটনাশক মুক্ত কলাটা-মূলাটা-কচুটা খেয়ে বড় হয়েছেন শ’দেড়েক বছর ধরে, ওঁর সাথে হেঁটেও কি আমি কুলাতে পারবো?
সাইফুল্মুল্ক ইতিমধ্যে অনেকখানি পিছিয়ে পড়া দুলারি আর দুলালের দিকে একবার ফিরে আবার চকিত নজর বুলালেন আকাশের দিকে। “বেচারি ভারি চটেছে স্বামীর ওপর। বোকাচোখা বলে গালি দিচ্ছে।”
দুলালের কানের কাছে ফিসফাসে ব্যস্ত দুলারির দিকে চেয়ে আমার খটকাটা আরেকটু গাঢ় হলো। জমিদার বংশে বেড়ে উঠলে কি কানও বেশ জোরালো হয়ে ওঠে? অবশ্য এখানে নগরের কোলাহল, গাড়ির ভেঁপু, গাড়িওলার বকাবকি, ফেরিওলার ডাকাডাকি বা মাইকে মৌলবির গগনবিদারী হুমকিধামকি নেই। বরং মৃদুমন্দ বাতাসে ছায়াবৃক্ষের পাতার নিক্কণ, পাখির কলতান...।
খটকা লাগলো আচমকা। পাখির কলতান নেই আশেপাশে, কান খাড়া করে কেবল বোঁ-বোঁ শব্দ শুনতে পেলাম একটা। কান খাড়া করার শ্রমের নিউটনীয় প্রতিক্রিয়ায় আরেকটু পিছিয়ে পড়লাম নক্রচৌধুরীর কাছে। তিনিও এবার থমকে দাঁড়িয়ে আমাকে তাঁর পাশে হাঁটার সুযোগ করে দিলেন, তাঁর হাতটা কেবল বাতাসে ঝাপসা একটা ছোবল দিয়ে কী যেন টিপে ধরলো, বোঁৎকার থেমে গেলো সহসা।
“অনেক ছায়ালো গাছ এখানে।” গলা খাঁকরে দুলারির-আলাপ-সাইফুল্মুল্ক- কী-করে-শুনলেন রহস্যটা ধামাচাপা দিয়ে গুমোট পরিস্থিতি একটু সহজ করার চেষ্টা করলাম। “ওটা শিরীষ মনে হচ্ছে। প্রাঙ্গনে মোর শিরীষ শাখায় ফাগুন মাসে কী উচ্ছ্বাসে... ওটা কী? কদম? বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল... আর ওটা নিম...,” নিম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কোনো গান-কবিতা জানি না বলে একটু ছন্দপতন হওয়ায় আবার একটু কেশে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম, “এটা তো পিপুল?” রবি ঠাকুরের ওপর আচমকা মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, “আহা শামশাদ বেগমের সেই গান... পিপুল ঝুমে মোরে আঙ্গনা ঠাণ্ডি ঠাণ্ডি ছাও রে...। ওটা অর্জুন গাছ না? গোড়ায় বাকল ছাড়ানো দেখেই চিনেছি হুঁহুঁহুঁ... অর্জুন গাছ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে, শুনেছেন হয়তো, অর্জুউউউন তুমি অর্জুউউউন...।”
নক্রচৌধুরী হঠাৎ যেন ভারি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন আমার বেসুরো গান শুনে, “তুমি রবীন্দ্রনাথের বেশ ভক্ত দেখছি।”
গুমোট বাতাবরণটা কাটানো গ্যালো তবে, ভেবে আমিও খুশি হয়ে উঠলাম। “হ্যাঁ, তা তো বটেই...।”
নক্রচৌধুরী এবার যেন দাড়ির ফাঁকে ঝকঝকে দাঁত বেশ খানিকটা বের করেই হাসলেন, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।”
আমি যেন পরের বকুল গাছটার মগডাল থেকে মাটিতে পড়লাম কথাটা শুনে। এভাবে পিঠে মিছরির ছুরি চালিয়ে দিলো লোকটা? জমিদারের নাতিপুতিরা এমনই হয় তবে?
আমাকেও দুলালের মতো গোমড়া হয়ে উঠতে দেখে নক্রচৌধুরী বললেন, “এটা বকুল গাছ। ওরে বকুল, পারুল, ওরে শাল-পিয়ালের বন... পড়েছো কবিতাটা? আর এটাকে বলে বালম ক্ষীরা...,” আকাশমণির মতো একটা গাছ দেখিয়ে বললেন তিনি, “এটা রবি ঠাকুর লাগিয়েছিলেন বটে, কিন্তু অনেক অনুরোধের পরও এটা নিয়ে কোনো গান লিখলেন না। এত করে বলার পরও...,” এই প্রথম নক্রচৌধুরীর মুখে একটু গোমড়া ভাব ফুটতে দেখলাম। কিন্তু পিঠ বরাবর চোর ডেকে অপমানের ছুরি মারলে পেটে ঠিক খটকাও যেন সয় না। আমি নীরস গলায় বললাম, “রবি ঠাকুর এ গাছটা লাগিয়েছেন? মানে, এই যে এই গাছটা, এটা? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের হাতে লাগিয়েছেন? মানে ঐ যে আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকেবাঁকে যিনি লিখেছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ?”
নক্রচৌধুরী ভুরু কুঁচকে আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটছিলেন, আচমকা যেন একটু চমকে উঠলেন। “কী? ...হ্যাঁ, উনিই, শিলাইদহের জমিদার। উনিই লাগিয়েছিলেন। কোত্থেকে যেন চারা পেয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। গাছপালা ভারি ভালোবাসতেন, আমার মতোই। এখানে ফাঁকা জায়গা পেয়ে বললেন, সয়ফুল একটা খুরপি বোলাও ভাই। বালম ক্ষীরার এই চারাটি লাগিয়ে দিয়ে যাই।”
এমনই তাক লেগে গেলো আমার, করঞ্জ গাছটার ঘন ছায়ার নিচে পৌঁছে থমকে দাঁড়ালাম একেবারে। “রবীন্দ্রনাথও ওরকম আনন্দেবেজার গোষ্ঠীর মতো সাইফুলকে সয়ফুল বলতেন?”
নক্রচৌধুরী একটু যেন বিরক্ত হলেন। “হুঁ। কিন্তু কতো করে বললাম ওঁকে, গুরুদেব, একটা কোবতে লিখে দিন গাছটা নিয়ে। দিলেন না তো দিলেনই না। মুচকি মুচকি হেসে কেবল বললেন, গাছটার নামটা হিন্দি, একটু কেমন যেন। যখন বললাম, আপনি তো কতো গাছের নামই বদলে দিলেন, তা এটাকেও দিন না। উনি তখন অট্টহাসি হেসে বললেন, বালম ক্ষীরা হাহাহা হাহাহা বালম ক্ষীরা।”
করঞ্জ গাছের নিশ্ছিদ্র ছায়ার নিচে দাঁড়িয়েও দরদরিয়ে ঘেমে গেলাম কেন যেন। কথাগুলো যেন ঠিক মিলছে না। ক্রিসেনথিমমকে হিন্দিতে গুলদাউদি ডাকে বলে যে রবি ঠাকুর খাড়ার ওপর ওকে চন্দ্রমল্লিকা বানিয়ে দিলেন, টগরকে বানিয়ে দিলেন মহাশ্বেতা, বোগেনভিলিয়াকে বাগানবিলাস, সে রবীন্দ্রনাথ হাতের কাছে বালম ক্ষীরা পেয়েও লাগসই একটা বাংলা নাম না রেখে পাশ কাটিয়ে যাবেন?
বিশ্বাসই করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না, কিন্তু জমিদারের নাতিপুতির প্রাসাদোপম বাড়িতে বেড়াতে এসে তার গুলগল্পে খোঁচ ধরা অভদ্রতা হতে পারে ভেবে চুপ করে রইলাম। ক’টা দিন পেটপুরে খেয়েদেয়ে হাতিঘোড়া-বজরাপানসি চড়ে, রাতের বেলা ডোঙায় চড়ে হ্যাজাকের আলো দেখতে উঠে আসা বোয়াল-মৃগেল ট্যাঁটা দিয়ে মেরে, বয়াতি-বাউলদের গান শুনে ফের ঢাকার ছেলে ঢাকায় ফিরে যাবো, তারপর ইচ্ছামতো ফেসবুকে নানা ছবি-দৃশ্য আপ করে শয়ে শয়ে লাইক কামাবো। কী দরকার শত্রু বাড়িয়ে?
দুলারি আর দুলাল একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে দাঁত খিঁচিয়ে কী যেন ফিসফিস করতে করতে এগিয়ে আসছে, এমন সময় আচমকা এক ফালি রোদ কোত্থেকে যেন বড়দের বৈঠকখানায় অবাধ্য শিশুর মতো আচমকা এক ছুটে ঢুকে পড়ে চারদিক ঝলমলে সবুজে রাঙিয়ে তুললো। চক্ষুপেয় সে দৃশ্য প্রাণ ভরে শুষে নিয়ে সাইফুল্মুল্ককে যেই না শুধাতে যাবো, নক্রচৌধুরী নামটার তাৎপর্য কী, ঘাড় ফিরিয়ে তাঁকে আশপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না। মাটিতে কোথাও তাঁকে না পেয়ে শেষটায় ওপরপানে করঞ্জ গাছের ডালের ভেতরে তাঁকে খুঁজছি, এমন সময় সেই বোঁচকাবাহী চাকর, বা তারই মতো উর্দি পরা অন্য চাকর, হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে বললো, “মালিকে আফনারারে অন্দরো ডাকরা।”
কোন ফাঁকে ছুট লাগিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো লোকটা? এখনও তো বেশ খানিকটা দূরের পথ। লোকটা দেখি ঘোড়ার মতো হাঁটেই না, ছোটেও। বিস্ময় চেপে রেখে চুপচাপ বাকি দু’জনের সঙ্গে পা মেলালাম। দুলারির মেজাজ চড়ে আছে অনেক, সে হুঙ্কার থেকে বেশ কয়েক ডেসিবেল ছেঁটে বলছে, “বোকাচোখার মতো কথা কৈবা না তো! এই এহন চুপ যাইবা, তারপর এক্কেরে রাত্রে মুখ খুলবা!”
বাড়িটা এক কথায় দারুণ। ইঁটের দেয়াল, কাঠের বরগা আর লালচে মর্মরের থাম বিচিত্র নকশা জুড়েছে বাইরের দিকে। বারান্দায় পা দিয়ে আরও তাক লেগে গেলো। প্রথম তলাটা প্রায় দুই মানুষ সমান উঁচু, দরজা প্রকাণ্ড, বিশাল সব পেতলের হুড়কো লাগানো তাতে, দীর্ঘ ফাঁকা বারান্দা চলে গেছে এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। ওখানে কোথাও একটা ইজিচেয়ার থাকলে মানানসই হতো। দরজার দিকে পেছন ফিরে ফেলে আসা সিংহদ্বারের দিকে চেয়ে আবারও মুগ্ধ হয়ে গেলাম। জায়গাটা আসলেই সুন্দর। তবে বড় বেশি ছায়াঢাকা। আর পাখি কেন ডাকে না এখানে, কে জানে?
বেয়ারাটা আবার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে একটা ঘরের দরজার হুড়কো খুলে আমাদের ভেতরে ঢোকার বিনয়ী ইশারা করলো। ভেতরে ঢুকে আবারও তাক লেগে গেলো। পুরনো দিনের নকশার ভারি কেঠো আসন ছড়ানো ঘরে, মেঝেতে পুরু গালিচা, দেয়ালে কিছু গম্ভীর নারী-পুরুষের হলদেটে ছবি - আঁকা আর তোলা - ঝুলছে, কয়েকটা ছবি দেয়াল থেকে সরিয়ে ফেলার পর শূন্যস্থানটুকু খানিক ফ্যাকাসে রং নিয়ে অতীত আড়ালের সাক্ষ্য দিচ্ছে। ছাদ থেকে নেমে এসেছে ঝাড়বাতি, তাতে মোম জ্বলছে বেশ কয়েকটা, ঘরের ভেতরে আলোর উৎস বলতে সেগুলোই। প্রথমে মনে হয়েছিলো ঘরে কোনো জানালা নেই, কিন্তু উল্টো দিকের দেয়াল একটু খতিয়ে দেখে বুঝলাম, জানালাগুলো বাইরে থেকে ইঁট তুলে বুঁজিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেয়ালে গরাদসহ দেহলিটা আছে কেবল।
দুলারি দুলালকে ঝাড়া বাদ দিয়ে ভারি আহ্লাদি হাসি মুখে নিয়ে ঘরের ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। “আল্লাগো... দেক্সোনি কী সোন্দর সব ফিটিংস... ঝাড়বাত্তিটা মনে হয় রূপার... এই ছবিগুলি পেইন্টার ডাকায়া আকাইছে মনে হয়... শোপিসগিলি দেক্সো? আরে এই মুখুশ তো পিরামিডের তলেত্থে বাইর কর্ছে...! ফার্নিচারগিলি মনে হয় সিরাজুদ্দুল্লার আমলের...।”
দুলাল কাশি আর গর্জনের মাঝামাঝি একটা কিছু দিতেই দুলারি দেঁতো হেসে একটা আসনে হেলান দিয়ে বসে পড়লো, “তুমার কথা আমি ভুলিনি জনাব! এইবার আরাম কৈরা বহো।” নিজের পাশে ফাঁকা আসনটায় চাপড় দিলো সে। বেয়ারা কোন ফাঁকে দরজা ভিড়িয়ে উধাও হয়েছে, টের পাইনি, বাইরে থেকে হুড়কো লাগানোর শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। ঘাড় ফিরিয়ে মুখ খুলতেই দেখি নক্রচৌধুরী ঘরের ভেতরে হাজির। পোশাক পাল্টেছেন তিনি, আরেকটা আলখাল্লা পরা, এটা আরেকটু জমকালো সুতার কাজ করা, আর ঘোমটা নেই। বেশ বাহারি ঢেউ খেলানো কালো চুল ওনার মাথায়। এ লোক মুরুব্বি হতেই পারে না। জমিদার বংশের সুবিধা তুলে গুল দিচ্ছেন উনি।
“খানা, পিনা, স্নান, আড্ডা।” নক্রচৌধুরী যেন গড়িয়ে এসে বসে পড়লেন একটি পিঠতোলা আসনে। “কোনটা কীসের পরে হবে?”
দুলালকে থামিয়ে দিয়ে দুলারি কলকল করে উঠলো, “একটু চা আর আড্ডা হোক। তারপর গোসল কৈরা খানাপিনা।”
সাইফুল্মুল্ক হাসিমুখে কী যেন একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে কান পেতে কী যেন শুনলেন, তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে ঘর কাঁপিয়ে হেঁকে বললেন, “তুরফান আলি!”
খানিক দূর থেকে ধুপধাপ ছোটার আওয়াজ ক্রমশ কাছে এসে অন্দর দরজা গলে ঘরের ভেতর ঢুকলো, ছুটের মালিক সেই বেয়ারা ফ্যাকাসে মুখে চোখ কপালে তুলে কী যেন বলতে যাচ্ছিলো, নক্রচৌধুরী আঙুল তুলে শুধু বললেন, “দরজা বাইরে থেকে লাগাও। যখন ডাকবো, খুলে দিও। আর কাজের কাজ জলদি করো।”
তুরফান আলি জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে কেমন যেন হাঁপ ধরা গলায় বললো, “কিন্তুক মালিক, গুমস্তা সাপে সুনামগঞ্জ তাকি সব ইন্ডিয়ান লশুন খিনিয়া আনিলছইন। ইতা লশুন খুনঅ খামরঅউ নায়। আমরা বিয়ান তাকি লশুনর মালা ডান্ডাত বান্দিয়া ফুশি টাখুরর ফিছে ফিছে গুররাম। কিন্তুক হি বেটিয়ে খুনঅ ফাত্তাউ দিছে না আমরারে...।”
আমরা তুরফান আলির দিকেই চেয়ে ছিলাম, আচমকা চোখের কোণে যেন একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলো। চোখ মিটমিটিয়ে দেখলাম, সাইফুল্মুল্ক নক্রচৌধুরী তুরফান আলির নাকে প্রায় নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেমন যেন চাপা, অন্যরকম নিচু কণ্ঠে তিনি ভারি মোলায়েম করে বললেন, “তুরফান?”
তুরফান আলি আঁতকে উঠে প্রায় কেঁদে ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগালো। দরজাটা বাইরে থেকে দড়াম শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলো, এর পরের ঘটাংঘট শব্দ শুনে মনে হলো বেশ অনেকগুলো ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগানো হচ্ছে। শব্দগুলো ফুরোলো তুরফান আলির হুঁকহাঁক হাঁপ ধরা ডাক আর ভারি কাঠের একটা কিছু ধাতব কোনো কিছুর ওপর দু’বার পড়ার বোল দিয়ে।
নক্রচৌধুরী ফের আসনে এসে বসেছেন, মুখে ভারি উজ্জ্বল হাসি, যেন কিছুই হয়নি। দুলাল মিনমিন করে বললো, “দরজা বাইরেত্থে লাগায় দিলে পিশাবপাই... উহু!”
যাত্রাপালায় মোহাম্মদী বেগ যেভাবে সিরাজুদ্দৌলার পিঠ থেকে ভোজালি টেনে বের করে, দুলারি সে ঢঙে তার ক্ষণচৌকস কনুইটিকে দুলালের পাঁজর থেকে বের করে হাসি মুখে বললো, “না না, ঠিকি আছে, একটু নিরিবিলি আড্ডা মারন যাইবো। কিন্তু ঘটনাটা কী ভাইয়া?”
ভাইয়া ডাক শুনে নক্রচৌধুরী যেন একটু বেসামাল হয়ে পড়লেন। খানিক চুপ থেকে একটু ধরা গলায় তিনি বললেন, “কতোদিন ভাইয়া ডাকটা শুনি না। আজকালকার মেয়েরা শুরুতেই আঙ্কেল ডেকে ফেলে। আমি মুরুব্বি হতে পারি, কিন্তু আঙ্কেল নই।”
দুলাল চুপচাপ পাঁজর ডলতে লাগলো, দুলারির দিকে বিষদৃষ্টি হেনে। দুলারি ছটফটিয়ে উঠে বললো, “চৌধুরী ভাইয়া বলতেছিলো, এই বাড়িতে আপনে নাকি একলা থাকেন। কিন্তু কেন? ভাবী কুথায়?”
নক্রচৌধুরী এবার আসনের হাতায় ভর দিয়ে যেন বহুকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে হাত পেছনে বেঁধে অদৃশ্য চাকায় গড়গড়িয়ে দেয়ালে ঝোলা হলদে হয়ে আসা একটা আঁকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তার কাঠা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ছবিতে খর চেহারার এক অলঙ্কারভূষিতা যুবতী কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন দর্শকের পানে, তার পরনের শাড়ি-ব্লাউজের চল সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ফুরিয়েছে।
“লম্বা গল্প। সবই লম্বা গল্প।” নক্রচৌধুরী নিজেকে সামলে নিয়ে নাগরা লটপটিয়ে ফের এসে বসলেন তাঁর আসনে। “কিন্তু যে প্রশ্ন সবাই করে, সেটাই নিশ্চয়ই তোমরা করতে চাও শুরুতে। আমার নাম নক্রচৌধুরী কেন? ওয়েল, এর ব্যাখ্যা খুব সরল। আমরা এককালে সিংহচৌধুরী ছিলাম। আমার পূর্বপুরুষ, মরহুম কৃষ্ণডাহুক সিংহচৌধুরী অন্য এলাকা থেকে এসে এ অঞ্চলে জমিদারি বন্দোবস্ত নেন। ভাটি অঞ্চলে সিংহ বেশ বেমানান বলে স্থানীয় পণ্ডিতদের সাথে শলা করে তিনি নিজের সন্তানদের নাম নক্রচৌধুরী নাম রাখেন। নক্র মানে কুমীর, জানো তো?”
“বাংলাদ্যাশে কুত্থাও কুন সিংহ কুনদিন আছিলো না।” দুলাল হেঁকে উঠলো একেবারে, পাঁজরটাকে অনেকদূর সরিয়ে। “ব্যাঘ্রচৌধ্রি কিম্বা মহিষচৌধ্রি হইলেও একটা কথা আছিলো...।” দুলারি শব্দ না করে কী যেন বলতেই দুলাল চুপ করে গেলো।
সাইফুল্মুল্ক ঠোঁট মুড়ে কুর্নিশের ঢঙে হাত নেড়ে বলেন, “সঠিক। তোমার সাথে কৃষ্ণডাহুকের খুব বনতো নির্ঘাত। তিনিও সবসময় খাপে খাপ সঠিক থাকার চেষ্টা করতেন। সে কারণেই ডাকাতির টাকায় জমিদারি কেনার আগে কাল্লু ডাকু থেকে নাম পাল্টে কৃষ্ণডাহুক হয়েছিলেন। যাকগে সে কথা। সেই যে নক্রচৌধুরী হলাম আমরা, নামটা আর ছাড়িনি। বা নামটা আমাদের ছাড়েনি। বন্ধু-স্বজন অনেকে এ নিয়ে অনেক কথা বলেছে, কেউ কেউ তো নাম পাল্টেও ফেলতে বলেছে।” আচমকা যেন একটু ক্ষেপে উঠলেন তিনি। দেয়ালের এক চৌকোনা ফ্যাকাসে অংশের দিকে বিষদৃষ্টিতে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “নোবেল পেয়ে একেকজন গাছে উঠে গেছে আর কী!”
আমি দুলারির সাথে দৃষ্টি বিনিময় করি। দুলারি ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে কী যেন বলে, সম্ভবত “শান্তি”, আমি জবাবে যতোটা ভদ্রভাবে পারা যায় ঠোঁট নেড়ে বিনা আওয়াজে “অর্থনীতি” বলে নিজের আশঙ্কাটা জানাই।
দূরে কোথায় যেন একাধিক কণ্ঠে চাপা আর্তচিৎকার শোনা গেলো তখনই। কতগুলো পা দুড়দাড় ছুটে গেলো দূরে, তারপর ক্রমশ আবার কাছিয়ে এলো, এবার মাথার ওপরে। নক্রচৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি এখনও রাগ কাটিয়ে ওঠেননি। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি সপ্রতিভ হেসে উঠে বললেন, “বাড়িতে মেহমান এলে একটু ছুটোছুটি শোরগোল তো হবেই। বহুদিন পরপর মেহমান আসে এখানে, কাজের লোক একটু বেশিই খুশি হয়ে ওঠে। তোমাদের শোবার ঘর গোছানো হচ্ছে বোধহয়।”
বহুদূর থেকে যেন তুরফান আলির কণ্ঠটাই শুনলাম, “আল্লাগো মারি লাইলো গো! ইগুর শইল্ল আল্লা এত্ত জুর দিছইন খিতাল্লাগি? আর গুমস্তা সাপ আফনের নাকশার ফুক্কা বায়দি খিতা বাথাশ ডুকে না নি? গন্দছাড়া লশুন আফনে খিনিয়া আনছইন খেগুর লাগি, আফনে আমারে বুজাইয়া কউক্কা। ইন্ডিয়ার লশুনর আবাদীন্তর গরে খিতা বাইঅর ফুরি বিয়া দিছলাইন্নি?”
দুলাল গলা খাঁকরে বলে, “মনে হৈতাছে রসুন একটা বড় ইস্যু।”
নক্রচৌধুরী তাঁর ঢেউ খেলানো চুলে আঙুল চালিয়ে বললেন, “হাওরের তাজা কালিবাউশ মাছ রান্না হচ্ছে। রসুন তো একটু লাগবেই।”
সাইফুল্মুল্কের হাত দস্তানার বাইরে প্রথমবারের মতো দেখে একটু চমকেই উঠি। বেশ বড়সড় নখ তাঁর আঙুলে, কিন্তু এমন ফর্সা হাত আগে কখনও দেখিনি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করেই যেন চট করে হাতটা আলখাল্লার জেবে পুরলেন তিনি।
“তা চৌধুরী তোমাদের একটু... যাকে বলে প্রস্তুতি দিয়ে পাঠিয়েছে তো?” কেশে মোলায়েম গলাকে আরো মোলায়েম করে তোলেন তিনি।
দুলাল গোমড়া মুখে বলে, “হ আমরা এক্সট্রা পাওয়ার ব্যাঙ্ক লগে আনছি। এইখানে বলে খালি কারেন্ট যায়গা।”
দুলারি ন্যাকামি করে বলে, “ভাইয়া, চৌধুরী ভাইয়া আমাদের বলছেন সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখতে। আমরা কি পানিতে ডুইবা যামু?”
আমি বলি, “প্রচুর ওরস্যালাইন আর মশার মলম এনেছি সাথে। যদি লাগে আর কি।”
নক্রচৌধুরী এবার যেন একটু বিরক্ত হন। তিনি বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “বেশ। কিন্তু চৌধুরী কি আমার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি তোমাদের? কিংবা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে? কিংবা নেতাজি সুভাষ বোস? অথবা বিচিত্রা সেন?” একেকটা নাম উচ্চারণের সাথে যেন দশ কেলভিন করে তেতে উঠলেন তিনি।
আমরা এবার পরম তাজ্জুব হয়ে একে অপরের দিকে চাইলাম। চৌধুরী হতভাগা ঘুণাক্ষরেও আমাদের এসব কিছু বলেননি। সপ্তাহান্তের আড্ডায় রান্নার ফাঁকে নক্রচৌধুরীর সাথে ফোনে কথা সেরে উদার হেসে হাত নেড়ে শুধু বলেছিলেন, “ঘুরে আসুন। বর্ষার শুরুতে হাওরের রূপ, বড় অপরূপ। আমার বন্ধু খুবই অতিথিবৎসল। অমন লোক এখন আর হয়ই না, কোটিতে গুটিক মেলে। একা একা থাকে বলে মাথায় একটু ছিট দেখা দিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কার মাথায় ছিট নাই বলেন? যাই হোক, দুলারি আপনি এবার আদাটা পাটায় ফেলে গায়ের জোরে বাটেন। মেয়েদের আদা বাটতে দেখতেও বড় ভাল্লাগে, বিশেষ করে সামনে থেকে।”
নক্রচৌধুরী একটু যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখে। দুলারির দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাতাসে নাক উঁচিয়ে কী যেন শুঁকলেন তিনি, তারপর বিড়বিড় করতে করতে বসে পড়লেন ফের, একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে তাঁকে। “চৌধুরীটা... সে যাই হোক। এখন না হয় আড্ডা মারি, আমাদের মাঝে জানাশোনা একটু বাড়ুক, তার পর নাহয়...।” থেমে গিয়ে এবার কান পাতেন তিনি। আমরা কোথাও কিছু শুনতে পাই না, কিন্তু একটু একটু করে তাঁর মুখে পাতলা একটা হাসি ফোটে। “চা হোক তোমাদের জন্যে, নাকি?”
দুলাল ফোঁসফোঁস করে সম্মতি দেয়। সাইফুল্মুল্ক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মুখ খুলে চায়ের ফরমায়েশ দেন, কিন্তু আমাদের চমকে দিয়ে কথাটা এ ঘরে না হয়ে একতলায় অনেক দূরে বাড়ি কাঁপিয়ে স্বনিত হয়, “আমাদের জন্য চা-চু দিও। তিনজনের জন্য চা, আর আমার জন্য চু।”
দুলারি দুলালের হাত জড়িয়ে ধরে গুটিশুটি হয়ে বসে, তার মুখ সাদা। আমি মুখ খুলেও বন্ধ করে ফেলি। সাইফুল্মুল্ক এবার বেশ তৃপ্ত মুখে হেসে বললেন, “যে কথাটা চৌধুরীর বলা উচিত ছিলো তোমাদেরকে, কিন্তু বলেনি সে, সেটা হচ্ছে, রবি ঠাকুর একজন ভ্যাম্পায়ার ছিলেন।”
দুলালের পর্যন্ত জবান বন্ধ হয়ে গেছে কথাটা শুনে, দেখতে পেলাম।
নক্রচৌধুরী মিটিমিটি হেসে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন। “যাকেই বলি কথাটা, সে-ই আমাকে গুলবাজ ভাবে। গুল মারে তুচ্ছ নশ্বর মানুষ। আমি চাপা মারি না।”
দুলারি কাঁপা গলায় বললো, “আপনেও কি...”, কিন্তু কথা শেষ করার আগেই ঝাড়বাতিতে কয়েকটা মোম এক এক করে নিবে গিয়ে ঘরটা একটু আঁধার হয়ে এলো। “হ্যাঁ, আমিও জমিদার। ছিলাম এককালে, রবি ঠাকুরের মতোই। দ্যাট ইনকরিজিবল ব্র্যাট। ওর জন্যে বাপের হাতে কতো বেত খেয়েছি, যদি জানতে। মদ খেয়ে বাপের মাথায় টেনশন উঠতো, আমি আবার কবিতা লিখি কি না। পেটানোর পর বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার পিতা, আফতাবেহেলাল নক্রচৌধুরী, আমায় কসম কাটতে বলতেন, না খেয়ে মরলেও যেন ঐ রবীন্দ্রের মতো না হই।” দূরে হেঁশেলে তাঁর গর্জন শুনি আবার, “কী রে চা-চু কখন দিবি?”
দুলাল বলে, “মা-মা-মা-মানে...।”
“মানে তো অবশ্যই লেগেছিলো। বাপ আমাকে কেন ওরকম কোবতেখোর ভেবেছিলেন, আই নেভার ফিগার্ড আউট। কিন্তু আমায় লাইনে রাখার জন্যে তিনি ফ্রান্স থেকে শারাব অ্যান্ড শাবাব আমদানির বন্দোবস্ত করেন। তিনি ভেবেছিলেন মদ্যপ এবং লম্পট হলে হয়তো শানশওকত বজায় রাখা সহজ হবে, এলাকার বেয়াড়া লোকে মুখে নিন্দা করলেও বুকে ভালোবাসবে, যেভাবে তারা তখনকার সায়েবদের এবং পরবর্তীতে জিন্না-আইয়ুব-ইয়াহিয়াকে বাসতো। কিন্তু ঐ যে, কুংফু পান্ডায় মাস্টার উগুয়ে যেমন মাস্টার শিফুকে বলেছিলেন, নিয়তি এড়ানোর রাস্তায় গিয়েই লোকে নিয়তির দেখা পায়, সেটাই ঘটে আমার ভাগ্যে। আমার বাপই আমায় খাড়ার ওপর মিস্টার টেগোরের মতো করে তোলেন এক রাতে।”
দরজার ছিটকিনি খিল বাইরে থেকে খুলতে শুরু করে একের পর এক। এবার আরেক খানসামা ট্রলিতে চাপিয়ে বাহারি তশতরিতে ধূমায়িত চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ফ্যাকাসে মুখে ঘরে ঢোকে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো সে, কিন্তু মালিকের দিকে চেয়ে তার চেহারা আরো ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে, তড়িঘড়ি করে তশতরিটা একটা চারপাইয়ের ওপর নামিয়ে রেখে সে ট্রলি নিয়ে উল্কাবেগে ঘর থেকে কেটে পড়ে। দরজাটা আমার চোখের সামনে আপনাআপনি লেগে যায়।
নক্রচৌধুরী তশতরির দিকে ইশারা করে বলেন, “তোমরা নিজেরাই চা ঢেলে নাও। আমি একটু চু খাই।” একটা কালো পিরিচ ছাড়া সরু কাপ তুলে নিলেন তিনি, তাঁর ফ্যাকাসে হাত ওটাকে যেন ইন-ইয়াং বানিয়ে ঘিরে ফেলে। “আই স্টিল রিমেম্বার দ্যাট ইভনিং।" আড়চোখে দুলারির দিকে তাকান তিনি। "আমরা সবাই অ্যাডাল্ট এখানে, সমস্যা নেই তো?"
দুলারি হাত নাড়লো, "ভাইয়া আমি চৌধুরী ভাইয়ার আড্ডার রেগুলার পার্টিসিপ্যান্ট। প্লিজ ডু ক্যারি অন।"
সাইফুলমুল্ক শ্বাস ফেলে হেলান দেন আসনে। "আই ওয়াজ প্রেটি ড্রাঙ্ক। ভেরি ফাইন কনিয়াক, সার্ভড টুগেদার উইথ আ ভেরি বিউটিফুল ইয়াং লেডি।” সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দ করে কাপ থেকে কী যেন চেটে খান তিনি, ক্ষণিকের জন্যে তাঁর দীর্ঘ গোলাপি জিভ দেখতে পাই। “দুঃখিত। মদের স্মৃতিটুকু বড় মধুর, বাংলায় বলে কেন যেন যুৎ পাই না। সায়েবদের বুলিতে যা-ই বলি, বললে মনে হয় যেন যেচে পড়ে দুনিয়ারই উপকার করছি, হোক সে মদ খাওয়া কি চুরি করা। তো যেটা ঘটে সে সন্ধ্যায়, বাপের পয়সায় খানিক কনিয়াক সেবন করে আমি একটু বেসামাল হয়ে পড়ি, এবং বাপের পয়সায় সংগৃহীত মোরাভীয় যুবতীটির জামাকাপড় খুলে তাকে কামড়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘটে উল্টোটা, মেয়েটিই আমায় কামড়ে দেয়। একেবারে দাঁত ফুটিয়ে।” আনমনে নিজের পেছনে হাত বুলান তিনি। “শি ওয়াজ আ রুকি ভ্যাম্পায়ার। সবে মাত্র দাঁত ফুটেছে, কর্তব্য-নাকর্তব্য নিজেও বুঝে ওঠেনি ঠিকমতো। বাট শি টার্নড মি ইনটু ওয়ান অফ... আজ, অ্যান্ড ড্র্যাঙ্ক অলমোস্ট আ পাইন্ট আউট অফ মাই ডেলিকেট পাছু। আই স্টিল রিমেম্বার, ইট ওয়াজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু... কীভাবে বলি... কিপ আ ম্যানলি বেয়ারিং আফটার সো মাচ কনিয়াক গেটিং ইন অ্যান্ড সো মাচ ব্লাড গেটিং আউট।” আবার সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে কাপ থেকে চু খান তিনি। “সরি, বাংলায় গল্পটা বলে কেন যেন যুৎ পাই না। বৃটিশ আমলের লোক আমি, ওল্ড হ্যাবিটস ডাই হার্ড।”
দুলারি মুগ্ধ-আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে, “আপনের বৃটিশ অ্যাক্সেন্টটা খুব্ভালো।”
বিষণ্ন তুষ্টি নিয়ে সাইফুল্মুল্ক প্রশংসাটুকু গ্রহণ করলেন, “ভোরবেলা ঘর ছাড়ার আগে এস্তার, দ্যাট ওয়াজ হার নেইম, এস্তার আমাকে ইশারায় বলে গেলো, দিনের আলোয় যেন আর বের না হই। বের হলে গোয়া জ্বলে যাবে।” কাপ নামিয়ে ভুরু কোঁচকালেন তিনি। “সি, ইটস নেভার দ্য সেইম ইন বেঙ্গালি। যাই হোক, এস্তার হাত-পা নেড়ে আরো বলে গেলো, মদ খেতে চাইলে যেন আগে কাউকে প্রচুর মদ খাওয়াই, তারপর তার রক্ত চুষে খাই।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাপ থেকে সুড়ুৎ করে কী যেন চেটে নিলেন তিনি, “কিন্তু সত্য কথা হচ্ছে, আমি ওর কথা কিছুই বুঝি নি। শি ওয়াজ আ মোরাভিয়ান হোর, ইংরেজি-বাংলা কিছুই জানতো না। যুবক-যুবতী ইশারায় অনেক কিছু করতে পারে বটে, কিন্তু ভ্যাম্পায়ার জীবনের প্রশিক্ষণ ইজ নট ওয়ান অফ দেম।”
দুলারি দুলালের কোলে আরেকটু ঘেঁষে কাঁপা গলায় বললো, “তারপর?”
নক্রচৌধুরী স্মৃতিভারাতুর চোখে চেয়ে রইলেন ছাদের দিকে। “এরপর তো সারাদিন খোঁয়ারির মধ্যে ডুবে রইলাম। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে দেখি পেট চোঁ-চোঁ করছে ক্ষুধায়, জিভ শুকিয়ে আছে তৃষ্ণায়। আই ওয়াজ ফ্যামিশড লাইক আ সিক্সটিনথ সেঞ্চুরি সার্ফ ইন সাসেক্স। কিন্তু মাছভাত বা শরবত কিছুই রুচলো না মুখে। বাধ্য হয়ে আবার এস্তারকে ডেকে আনলাম তার ঘর থেকে। দুর্বল শরীরে যতটুকু লাম্পট্য করা যায় আর কি। ভোরবেলা সে বেচারি আবার আমায় ইশারায় কী যেন বোঝাতে চাইলো, বুঝলাম না। শেষে সে বাধ্য হয়ে আমাদের এক চাকরকে ডেকে এনে তার রক্ত আদ্ধেকটা খেয়ে আমায় দেখালো, কী করতে হবে। বাকি আদ্ধেকটা খেয়ে আমি টের পেলাম, সে ভোর থেকে আমি আর মানুষ নেই...।” তাঁর কণ্ঠ রূদ্ধ হয়ে এলো, “...জমিদার হয়ে উঠেছি।”
আমি কোনোমতে বললাম, “কি-কি-কিন্তু...।”
সাইফুল্মুল্ক রুমাল বের করে চোখ মুছলেন, “আমি জানি। আধখানা চাকরের রক্তে কতোটুকুই বা পুষ্টি থাকে? সো আই হ্যাড টু প্রকিওর মোর দ্য নেক্সট নাইট। এস্তার ম্লেচ্ছ মাগী, জাতপাতের বিচার তার তেমন ছিলো না, গরম রক্ত পেলেই সে খুশিমনে চোঁ-চাঁ খেয়ে সাবাড়। কিন্তু আমি একজন জমিদারসন্তান, আশরাফ-আতরাফ বিচার করে আমায় খানাপিনা করতে হয়। আই হ্যাড ডেকোরাম টু মেইনটেইন। তো দিনদশেক এভাবে নিম্নমানের নিউট্রিয়েন্ট ইন্টেকের পর শরীরে একটু বল ফিরে পেয়ে আমি এস্তারকে ইশারায় বললাম, ভাগ এখান থেকে। আমার এস্টেটের আশেপাশে দেখলে ধরে পুলিশে দেবো। শি গেইভ মি আ ন্যাস্টি লুক, কিন্তু গ্যাঞ্জাম না পাকিয়ে সে উধাও হয়ে যায়।”
আমি বহুকষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বলি, “রবীন্দ্রনাথ...।”
কয়েকটা মোম একসাথে দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেলো। চু খেয়ে যেন একটু বল পেয়েছেন সাইফুল্মুল্ক, তিনি ঠাঠা করে হেসে উঠে বললেন, “দ্যাট হাম্বাগ! কী হোলো শোনো, আমি তো আর জানি না যে রোদে গেলে জ্বলে যাবো। আই ওয়োক আপ ওয়ান মর্নিং উইথ মাই কার্টেইনস ওপেন ওয়াইড। হ্যাড আ ভেরি ফেইটাল বার্ন আপন মাই ডেলিকেট লর্ডলি পাছু, অ্যান্ড ফিগার্ড আউট দ্য রেস্ট ভেরি কুইকলি। ডেলাইট ওয়াজ নট মাই কাপ অফ চু এনি মোর। অ্যান্ড আই সারেন্ডার্ড টু দ্য নাইট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আই অলসো সাকাম্ড টু দিস ডায়ার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। হু অ্যাম আই? হোয়াট অ্যাম আই? আ ম্যান? আ ফোটোফোব জমিদার? আমি কে? কী?”
দুলারি ভয়ে ভয়ে হাতে কিল মেরে বললো, “কিন্তু আপনে তো ভ্যাম্পায়ার...?”
নক্রচৌধুরী কাপ থেকে এবার এক গভীর সুড়ুৎ টানলেন। “আহ, বোকা নারী। এটা বহু আগের কথা। ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা তখনও কলকেতা-ঢাকায় আসে নাই, ময়মনসিংহ তো দূর অস্ৎ। আমরা পড়তাম সায়েবি জং ধরা মাল: আধা সের শেক্সপিয়ার, এক মুঠ ডিকেন্স, এক চিমটি বায়রন-শেলি-কিটস-কোলরিজ। রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম একটু-আধটু। মেয়েরা পাঠক ভাড়া করে শরৎচন্দ্র পড়িয়ে শুনতো। ড্রাকুলা আমাদের সমাজে ঢুকেছে বহুৎ পরে। সানি লিওনের মতোই সে বাঙালিকে জয় করেছে দেরিতে, কিন্তু হাড়েমজ্জায়।”
দুলাল কম্পিত কণ্ঠে বললো, “আপনে সানি লি-লি-লি...।”
সাইফুল্মুল্ক এবার দু’পা আর দু’পাতে কাপটা চেপে ধরে চুকচুক করে একেবারে তলানি পর্যন্ত চেটে খেয়ে কাপটা ছুড়ে ফেললেন তশতরিতে, সেটা আছড়ে চুরমার হওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে কেমন করে যেন ভেসে উঠে আলতো করে নামলো। “উত্তর হচ্ছে, না। কিন্তু পোড়া পাছু নিয়ে বাদুড়ের মতো সারাদিন ঘরে লুকিয়ে দু’পেগ রক্তের জন্যে সারারাত উদভ্রান্তের মতো জমিদারির এক মাথা থেকে আরেক মাথা যখন চষে ফেলছি, তখন অল আই ওয়ান্টেড অ্যাজ আ সাইড ডিশ ওয়াজ মাই আইডেন্টিটি। কে আমি? কী আমি? কী আমার পরিচয়? আমার একটা শব্দ দরকার ছিলো নিজেকে চেনার আর চেনানোর জন্যে। কিন্তু পেটে ক্ষুধা নিয়ে বিদ্যা চর্চা হয়?” কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। “আমার হয়নি।” জেব থেকে একটা বিড়ির বোন্দা আর দেশলাই বের করলেন তিনি। “সো আই টার্নড টু দ্য গ্রেট ম্যান অফ লেটারস হিমসেল্ফ।”
এবার সব যেন মিলে যায়। রূদ্ধশ্বাসে বলি, “রবীন্দ্রনাথ...?”
নক্রচৌধুরী বেজায় বিরক্ত হন। “ঠাকুর? হেল নো। আমি সিলেটে আমার স্কুলের হেডপণ্ডিতকে টেলিগ্রাম করি। বলি, মোস্ট রিভিয়ার্ড স্যার, আলাপ আছে। কাম শার্প।” তিনি ময়মনসিংহে আসেন, এক সন্ধ্যায় আমার সব জিজ্ঞাসা মন দিয়ে শোনেন, তারপর পরামর্শ দেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে যোগাযোগ করতে। তিনিও জমিদার, আমিও জমিদার, রক্তপিপাসার ব্যাপার তিনিই ভালো বুঝবেন। এই বলে তিনি দ্রুত এলাকা ত্যাগ করেন।” কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে তিনি বলেন, “পণ্ডিতদের রক্তেও পুষ্টি নাই। ঐ যে সৈয়দ মুজতবা আলী যে লিখেছিলো না একটা গল্প, পাদটীকা, পণ্ডিতের পরিবার সায়েবের কুকুরের কয় ঠ্যাঙের সমান... খুবই সত্য।”
দুলারি দুলালকে জড়িয়ে ধরে। নক্রচৌধুরী জিভ দিয়ে চপচপ শব্দ করে বলেন, “কই তোমাদের চা ঠাণ্ডা হচ্ছে তো। আমি আরেক কাপ চু দিতে বলি।” দূরে আবার বজ্রনির্ঘোষ শোনা যায়, “অ্যাই চু দিস তো আরেক কাপ!”
আমি কাঁচুমাচু হয়ে যা শুধাতে গেছিলাম, আমায় থামিয়ে দিয়ে সেটাই বলতে শুরু করেন সাইফুল্মুল্ক, “ময়মনসিংহ শহরে আমাদের হাভেলি ছিলো, তো সেখান থেকে আমি রবীন্দ্রনাথকে খৎ লিখি। ততোদিনে তিনি নোবেল পেয়ে গেছেন, সবাই তাঁকে চেনে। মান্যগণ্য লোক তিনি, কাজেই সবাই আড়ালে তাঁকে গালি দেয়। আমার চিঠির জবাব সহসা পাবো, সে আশা করিনি। কিন্তু তাঁর চিঠি আসে দুই সপ্তাহের মাথায়। তিনি সংক্ষেপে শুধু আমায় শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানিয়ে লেখেন, ওয়েল্কাম টু দ্য ক্লাব। ডোন্ট ফরগেট টু ব্রিং আ হেলদি গোট অ্যালং। অ্যান্ড নাউ দ্যাট সারকামস্ট্যান্সেস আর ডিফরেন্ট, কনসিডার চেইঞ্জিং ইয়োর নেইম টু নক্তচৌধুরী। নক্ত মিনস রাত অ্যান্ড বাদুড় অ্যাট দ্য সেইম টাইম।” কাপটায় নখর দিয়ে টোকা দিলেন তিনি। “কতোবড় ইয়ে, বাপ-দাদার ধারার নাম পাল্টে ফেলতে বলে!”
দুলারি অস্ফুটে বলে ওঠে, “আপনে রবীন্দ্রনাথের লগে চিঠি চালাচালি করতেন? রিয়েলি?”
নক্রচৌধুরী হঠাৎ ফুঁসে ওঠেন, “দ্যাট ফেলো ওয়াজ আ রিয়াল ব্যাড্যাস! ভ্যাম্পায়ার সমাজের কলঙ্ক উনি। শান্তিনিকেতনে গিয়ে পৌঁছানোর পরদিনই শুনি তিনি অন্য শিক্ষকদের সাথে মর্নিং ওয়াক নিয়ে আলাপে ব্যস্ত। স্বদেশী পণ্ডিত, সায়েবসুবো পণ্ডিত, সবাই তার সাথে প্রাতভ্রমণে বের হয়ে এটাসেটা নিয়ে আলাপ করে। কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় নিরিবিলি পেয়ে তাকে বললাম, গুরুদেব, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি মুচকি হেসে আমায় বললেন, “তোমার মাপে হয়নি সবাই তুমিও হওনি সবার মাপে।” এই বলে তিনি হঠাৎ খাতা টেনে পদ্য লেখা শুরু করলেন। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো, বুঝলে? চিমটি কেটে বুঝিয়ে দিলেন, যদিও আমরা দু’জনই জমিদার, কিন্তু একজন একটু বেশি জমিদার... যাই হোক, শুধালাম, আমরা আসলে কী? বাড়ির পেছনেই আমার ছাগলটা বাঁধা ছিলো তমাল গাছের গোড়ায়, এক শান্তিপোড়ো সেটাকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াচ্ছিলো কারক-বিভক্তি আওড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে, তো তিনি ওদের দেখিয়ে বললেন, “এই যে ব্যাকরণে ব্যস্ত দুটি প্রাণী, ওরা স্তন্যপায়ী। আর আমরা অন্যপায়ী।””
দুলাল বললো, “বুড়াটা...।”
দ্বিতীয় কাপ চু নিয়ে খানসামা ঘরে ঢুকলো, একটা আলখাল্লার ঝড় যেন তার তশতরি থেকে কাপ তুলে নিয়ে আসনে ফিরে এলো। “বদমাশ। যখন বললাম, কিন্তু যদি আমিও অন্যপায়ী হই, আর আপনিও অন্যপায়ী হন, তাহলে আপনি কী করে প্রাতভ্রমণে বের হন, আর আমার কেন রোদে গা পুড়ে যায়? জবাবে উনি বললেন, “আকাশ তবু সুনীল থাকে মধুর ঠ্যাকে ভোরের আলো।” তারপর ছাতামাথা পদ্য লিখে আমার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “যার যার ছাগল সাবধান।” তারপর ঘর থেকে আমায় ভাগিয়ে দিলেন।” কাপে চুমুক দিলেন সাইফুল্মুল্ক। “ব্যাটার গায়ে দারুণ জোর ছিলো। মাথায় বুদ্ধিও ছিলো। দেখতে ভালো ছিলো। কিন্তু অন্তরে কোনো মায়াদয়া ছিলো না। আমি তিনটা বছর বোলপুরে বাসা ভাড়া করে থেকে এক ছটাক করে ছাগলের রক্ত পিয়ে কতো সন্ধ্যা ওনার পিছে পিছে ঘুরলাম, কিন্তু কী করে তিনি দিনে-দুপুরে ঘুরে বেড়ান, সে গোমর তিনি ফাঁস করেননি।”
দুলারি সোজা হয়ে বসে শুধালো, “কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কার রক্ত খাইতেন?”
নক্রচৌধুরী কাঁধ ঝাঁকালেন। “আই ডোন্নো। চারপাশে লোকজন। শিক্ষকে-ছাত্রে গিজগিজ করছে। এই কলকেতা যাচ্ছেন, এই ইয়োরোপ যাচ্ছেন। যখন যাকে খুশি রদ্দা মেরে বেহুঁশ করে এক-আধ পাইন্ট মেরে দিতে পারতেন, তাই না? তবে যারা কাছের লোক, তাদের রক্ত উনি নিজে সচরাচর পান করতেন না, এটা বলতে পারি। একবার কী এক নতুন বাংলা শব্দ নিয়ে বিধুশেখর শাস্ত্রী একটু তর্ক লড়িয়েছিলেন, মনে হয় মশাকে তিনি মধুপের আদলে “রক্তপ” বলে বসেছিলেন, আমার ঠিক মনে নেই, মোদ্দা কথা সেটা গুরুদেবের পছন্দ হয়নি। তোমাদের রবি ঠাকুর সে সন্ধ্যায় আমায় বারান্দায় ডেকে বললেন, সয়ফুল, এ কথাটা জানি, শাস্ত্রী মশায় বড় মানী, কিন্তু কথাটা সিধে, আজকে দুপুরে বিধে খেয়েছেন ভেজি-বিরিয়ানি। তারপর আমায় একটা চোখটিবি দিয়ে ফের আড্ডায় ফিরে গেলেন। ডন কর্লিয়নি ফেল!”
আমি শুধালাম, “আপনি... বিধুশেখর শাস্ত্রীর রক্ত খেলেন তারপর?”
নক্রচৌধুরী মুখ বিকৃত করলেন, “ঐ একবারই। পণ্ডিতদের রক্তে কোনো স্বাদ নাই ভাই। মনে হচ্ছিলো বাসি সেভেনাপ খাচ্ছি।”
দুলারি ছটফটিয়ে উঠলো, “কিন্তু রবি ঠাকুর রৈদে বাইর হৈতেন ক্যাম্নে?”
দুলাল বিজ্ঞের মতো বলে, “আলখাল্লা।”
নক্রচৌধুরী গর্জে ওঠেন, “আলখাল্লায় সব ঢাকে না বোকচোপ!” আবার কিছুক্ষণ কাপ চাটলেন তিনি। “আই পন্ডার্ড অন দিস ফর আ ফিউ ডেকেইডস। অনেক পরে কিছু চিঠি হাতে আসার পর আটে আটে ষোল মিলে গেছে: আচার্য জগদীশ ওয়াজ বাহাইন্ড দিস ট্রিক। উনি গাছ নিয়ে গবেষণার ফাঁকে কোনো একটা কোবরেজি কায়দা বের করেছিলেন, সাম সর্ট অফ ভেজেটেবল অয়েন্টমেন্ট অর সামথিং। একা রবীন্দ্রনাথ না, ঐ আমলের অনেক বড় বড় ভ্যাম্পায়ার জগদীশ বোসের মলম মেখে দিনের বেলা যে যার ধান্ধায় বের হয়েছেন। অথচ আমি আর আমার মতো যারা ছিলো, দে ওয়্যার ডিনাইড অ্যান এগজিস্টেন্স আন্ডার দ্য সান।”
দুলারি ভয়ে ভয়ে শুধালো, “আর কোন ভ্যাম্পায়ার রৈদে বাইর হৈতো?”
উত্তরটা আমি আঁচ করে ফেলি। নক্রচৌধুরী ঢেঁকুর তুলে বলেন, “গান্ধীজি। অলওয়েজ টুক হিজ গোট উইথ হিম হোয়্যারেভার হি ওয়েন্ট। লোকে বলে উনি ঐ ছাগলের দুধ পান করতেন। বল্ডারড্যাশ! আমি রবীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম করে বললাম, হাউ ডাজ গান্ধীজি ট্র্যাভেল খালিগা জিউরিং দ্য ডে? উনি জবাবে লিখলেন, প্লিজ ডোন্ট ট্রাই দিস অ্যাট হোম। ইফ ইউ ডু এনিওয়ে, প্যারেন্টাল সুপারভিশন রেকোমেন্ডেড। তখন আমার ফুটদাঁত কিড়মিড় করেছিলাম শুধু, বাট নাউ আই নো, গান্ধীজি ইউজড জগদীশি মলম। বাট হি পুশড দ্য লিমিট টু ফার আই থিঙ্ক।”
দুলাল বললো, “আর?”
নক্রচৌধুরী একটা চুমুক দিলেন, “জিন্না, অফকোর্স। থার্স্টি ফেলো। উনি তো পাততাড়ি গুটিয়ে বিলাত চলে গিয়েছিলেন। ওখানে কী করেছিলেন জানি না, হয়তো দুয়েকটা সায়েব ক্লায়েন্টের ঘাড় ফুটিয়েছিলেন, কিন্তু সায়েবরা হন্তদন্ত হয়ে লিয়াকত আলিকে বিবিসহ ওনার কাছে পাঠিয়ে মহাযুদ্ধের আগে আগে দেশে ফিরতে রাজি করায়। সায়েবদের রক্ত সায়েবরা চুষবে, নেটিভের রক্ত নেটিভ চুষবে, এরকম কোনো বন্দোবস্ত হয়েছিলো মনে হয়।”
দুলারি বলে উঠলো, “সুভাষ বসুর কী হইছিলো?”
নক্রচৌধুরী একটু অস্থির হয়ে উঠলেন যেন, “মাথাগরম লোক। উনি যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ করবেন বলে গা ঢাকা দিলেন, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। হি প্রেফার্ড ডার্ক কর্নারস আফটার দ্যাট। সাবমেরিন খুব পছন্দ ছিলো ওনার, টানেলও। যদিও লোকে বলে প্লেন ক্র্যাশ হ্যানো ত্যানো, আমি বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা খুঁজলে ওনাকে ঠিকই ইয়োরোপের কোনো পুরোনো সুড়ঙ্গ বা ক্যাথেড্রালের চিপায় পাওয়া যাবে।” ঘরের ভেতরে পায়চারি শুরু করলেন তিনি, সবে সেটা পুরোটাই মেঝেতে নয়, দেয়াল এবং ছাদেও। “মুজতবা আলী একবার আমার সাথে এ নিয়ে আলাপ করতে এসেছিলো। সে তো ইয়োরোপে ফিরে গিয়েছিলো বসুজিকে খুঁজতে। আমি তাকে বললাম, সৈয়দ, কেন খামাকা এই রিস্ক নিতে যাবা? তুমি সসেজ-বিয়ারের ভক্ত, কোন অন্যপায়ী তোমার রক্ত ভালো না বাসবে? বসু যদি বেঁচেও থাকেন, যদি তোমায় ধরে এক পাইন্ট রক্ত টেনে খেয়ে নেন? সৈয়দের পো সে কী খুশি। সে একসঙ্গে কয়েক ভাষায় হড়বড়িয়ে বলে, পুকোয়া পা? ভারুম নিখট? চেয়ারা কে না? বসুর সঙ্গে বসে বিয়ার খাওয়ার সুযোগ এলে, কেন নয় হে ব্লুটজাউগার?” ডিগবাজি খেয়ে ফের আসনে ফিরে এলেন সাইফুল্মুল্ক।
দুলাল শুধালো, “সব পাওয়ারফুল লোক ভ্যাম্পায়ার কেন? গরিবদুঃখী ভ্যাম্পায়ার নাই কেউ?”
নক্রচৌধুরী খানিক ভেবে বললেন, “আছে তো বটেই, কিন্তু তারা বেশি দিন টেকে না। লজিস্টিক্সের কারণেই টেকে না।” তুড়ি দিলেন তিনি, “মনে করো তুমি গরিব ভ্যাম্পায়ার, লঞ্চে উঠলা, রাতে রাতে ঢাকা থেকে বরিশাল যাবা। তোমার লঞ্চ মাঝপথে চরে আটকায় রইলো দুইদিন। সূর্যের আলোয় সারাদিন না পারবা কম্বল মুড়ি দিয়ে থাকতে, আর বের হলেই সেকেন্ড ডিগ্রি বার্ন। বড়লোক হলে এসব ম্যানেজ করা সোজা। নিজেই অন্ধকার বজরা নিয়ে চলে যাবা যেখানে যাওয়ার। নয়তো কভার্ড ভ্যান চার্টার করবা। আরো বড়লোক হলে জেট, ইয়ট। গরিব তাই ভ্যাম্পায়ার হলেও লাভ নাই,” নাক টানলেন তিনি, “তার পেছন দিয়ে সবসময় গাছের গুঁড়ি যাবে। দেয়ার ইজ আ টার্ম ফর ফিনানশিয়ালি চ্যালেঞ্জড ভ্যাম্পায়ারস, জানো না হয়তো। উই কল দেম চুকচুকি। ওরা ঐ চুকচুক শব্দ করে একটু রক্ত খায় ক’দিন, ব্যস, তারপর ট্যাঁফোঁ না করে, দুনিয়ার গলাপানিতে কোনো ঢেউ না তুলে, জ্বলে খাক হয়ে যায়।”
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, “আর বিচিত্রা সেন?”
এবার সাইফুল্মুল্ক প্রথমবারের মতো লজ্জা পেলেন, খানিকটা রক্ত উঠে এলো তাঁর ফ্যাকাসে গালে, যেটাকে ফর্সা রং ভেবেছিলাম শুরুতে। হাতের নখরে চুল পাট করতে করতে লাজুক ও বিব্রত কণ্ঠে তিনি বললেন, “ঐ যে, কবিগুরুই আমার হবিগুরু। উনিই আমায় শিখিয়েছিলেন, সত্যরে লও সহজে। অন্যপায়ী জীবনের হালচালও অন্যরকম, এটাই সত্য, টেইক ইট ইজি। যদিও উনি সবকিছু খুলে বলেননি, আকারে-ইঙ্গিতে, টুকরো টাকরা মিলিয়ে, হেঁয়ালির জট ছাড়িয়ে ওঁর পরামর্শের পাঠোদ্ধার করতে হয়েছে। যদি নিমকি খেতে চাই, শিকারকে ধরে নোনাপানি পিলিয়ে দিতে হবে। মিষ্টি খেতে চাইলে, তাকে চিনি খাওয়াতে হবে ঠেসে। চর্বি খেতে চাইলে ওঁৎ পাততে হবে বিরিয়ানির দোকানের আশেপাশে। রক্ত থেকেই খেতে হবে যা কিছু খেতে মনে চায়। তো এক সন্ধ্যায় দুই হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে চলে গেলাম বিচিত্রা সেনের বাড়িতে। পূর্ববঙ্গ থেকে মিষ্টি নিয়ে এসেছি বললেই তখন কাজ হতো। বিচিত্রা সেন মিষ্টির বড় সমঝদার রসিকা ছিলেন। ওঁর সাক্ষাৎঘরে গিয়ে বসতেই তিনি এলেন হন্তদন্ত হয়ে, জানতে চাইলেন মিষ্টি কোন ময়রার, কবে পাকানো, কখন এসেছি কলকাতায়। সব শুনেটুনে তিনি আমার সামনে বসেই দুই হাঁড়ি ফাঁকা করে দিলেন। লোকে ওনার অভিনয় দেখে হয়রান, কিন্তু ওনাকে মিষ্টি খেতে দেখেছে কয়জন? আহ, তুলনাহীনা রে!” রুমাল বের করে চোখ মুছলেন সাইফুল্মুল্ক। “তারপর যা হয় আর কি সচরাচর। সুদর্শন যুবক ভ্যাম্পায়ার আর সুন্দরী মধ্যযৌবনা শিকার... নাটকসিনামায় দেখো নাই?”
দুলাল বোকচোপটা এ বিপদের মধ্যেও ফস করে বলে বসলো, “টোয়াইলাইট?”
মনে হলো একটা বোমা ফাটলো ঘরের মাঝে। নক্রচৌধুরী বনবন করে ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলেন, মোমগুলো জ্বলতে আর নিভতে লাগলো আপনাআপনি। একটা আসন তুলে পাটকাঠির মতো মটমট করে ভেঙে ফেলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে আলখাল্লার ভেতর থেকে জাঙ্গিয়া পরা ফ্যাকাসে সাইফুল্মুল্ক বেরিয়ে এলেন, “টোয়াইলাইট? এত্ত বড় সাহস তোমার, তুমি আমারে-বিচিত্রারে কও টোয়াইলাইট? আমার বন্দুকটা কই? কে আছিস নিয়ে আয় টোটা-বন্দুক-চাবুক-ডালকুত্তা-হুইসেল-ছিপনাও-শরাব-আর-বাঈজি!” এক জায়গায় ঘুরপাক খেয়ে বাড়ি কাঁপিয়ে গর্জে উঠলেন তিনি, “অলিউডর কুন ফুঙ্গার নাতি ই টুয়াইলাইট বানায় বে? আন দরিয়া ইগুরে আমার সামনে।”
আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। নক্রচৌধুরী কিছুক্ষণ রক্তিম চোখে দুলালের দিকে চেয়ে আচমকা জিভ কেটে তাড়াতাড়ি আবার আলখাল্লাটা পরে নিয়ে বললেন, “সরি। ভুলেই যাই, আমি ভ্যাম্পায়ার, জমিদার নই আর। সরি ড্যুড। ফরগেট ইট। ওয়াটার আন্ডার দ্য ব্রিজ, হেঁহেঁ। চা খাবা?”
দুলাল দুলারির বুকে মাথা গুঁজে ডুকরে উঠলো, “ভাতরুমে যামু!”
দুলারি দুলালের কপালে চুমু খেয়ে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে রুষ্ট চোখে নক্রচৌধুরীর দিকে চেয়ে শুধালো, “বিচিত্রা স্যানরে আপনে ভ্যাম্পায়ার বানায় ফালাইছেন তারপর?”
সাইফুল্মুল্ক লাজুক হেসে বললেন, “কী করবো, আমি যে মিষ্টির পাগল। কিন্তু সে সন্ধ্যায় কী থেকে কী হয়ে গেলো, দু’তিন ছটাক রক্ত টানার পর...,” দেয়ালে টাঙানো এক ফ্যাকাসে শূন্যস্থানের দিকে চাইলেন তিনি। “শি ওয়াজ... অন্যরকম। বাট ইট রুইন্ড হার ক্যারিয়ার।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসনের হাতা হাতাতে লাগলেন তিনি। “নট দ্যাট শি ওয়েন্ট আউট মাচ, স্টুডিওর ভেতরেই তো যা কাজ, কিন্তু ঐ যে, কড়া আলো। ইউ নো,” বিড়িতে সাবধানে আগুন ধরালেন তিনি, একটু বেশিই সাবধানে, “ভ্যাম্পায়াররা আসলে এক ধরনের আলোকবিষের শিকার। চামড়ায় ফোটোটক্সিসিটি হয়ে যায়, তাই বেচারারা আর অতিবেগুনী রশ্মি নিতে পারে না। শুটিঙের কড়া আলোয় ঐ অতিবেগুনী থাকে অনেক, অলমোস্ট লাইক সানলাইট। বিচিত্রা এরপর আর বেশি ছবি করেনি, জানো তো। বাইরেও তেমন বেরোতো না, দিনেও না রাতেও না। আমি ছাগল কিনে কুরিয়ার করে পাঠিয়েছি বেশ কয়েকবার, আর পূর্ববঙ্গ থেকে দর্শনার্থীরা তো ধর্না দিতোই... অন্তত খাওয়ার কষ্ট যে হয়নি সেটা নিশ্চিত।” নিজের চুলে হাত বোলালেন তিনি। “সিনেমার নায়িকা ভ্যাম্পায়ার হয়ে গেলে, সে এক দুঃখের ব্যাপার। অনন্তযৌবন পেয়েও শুটিং লাইটের কাছে হেরে যেতে হয়।” হঠাৎ তাঁর চোখ জ্বলে উঠলো, “স্পিকিং অফ সিনেমা, তোমরা টোয়াইলাইটকে দশে কতো দিবা?”
আমরা একসঙ্গে তিনরকম উত্তর দিলাম, “শূন্য!” “মাইনাস দশ!” “মাইনাস এক লক্ষ!”
সাইফুল্মুল্ক খিকখিক করে হেসে উঠলেন। “ক্লেভার কিডস! যাই হোক... এবার তাহলে চা খাও, বেশি সময় নেই হাতে।”
আমার বুক দুরদুর করে উঠলো। দুলাল নিমেষে একেবারে জবজবে ঘেমে উঠে বললো, “কীসের সময় নাই? কী আছে সামনে?”
নক্রচৌধুরীর হাসি মিলিয়ে গেলো। “কী আছে সামনে মানে? তোমরা এখন চা খাবা। তারপর আমি তোমাদের রক্ত খাবো। কতোদিন ঠিকমতো চা-কফির স্বাদ পাই না জানো? ক্যাফেইনের জন্য আমার শরীর চাবাচ্ছে! জলদি খাও!”
দুলারি ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে বললো, “আপনে ক্যান আমাগো ভ্যাম্পায়ার বানাইতে চান? আমরা কী ক্ষতি করছি আপনার? আপনের মনে লয় তো গিয়া কোনো নাইকার রগ চাবান না!”
সাইফুল্মু্ল্ক একটু যেন বিভ্রান্ত হয়ে গিয়ে বললেন, “হোয়াট? চোপ, কানবা না! তোমাদের ভ্যাম্পায়ার বানাবো কোন দুঃখে? এহ, শখ কতো! ভ্যাম্পায়ার হওয়া সস্তা পাইছো নাকি?”
দুলাল কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আপনে আমাগোর রক্ত খাইলে আমরা ভ্যাম্পায়ার হইয়া যামু তো।”
নক্রচৌধুরী আবার উঠে হাত পেছনে বেঁধে পায়চারি করতে লাগলেন। “আই ক্যান্ট বিলিভ দিস শিট! এইসব বুলশিট কে ছড়ায়, কেন ছড়ায়?” হিসহিসিয়ে তেড়ে এলেন তিনি চারটা চোখা দাঁত বের করে, “অ্যাই বলদ, অ্যাই! যদি তোর রক্ত খেলে তুই ভ্যাম্পায়ার হবি, তাহলে দুনিয়ায় আজ কতো ছাগল ভ্যাম্পায়ার হয়ে ঘুরতো, জানিস? মশা এসে তোকে কামড়ালে কি তুই মশা হয়ে যাস, স্টুপিড কোথাকার?”
আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম, “তাহলে আপনি কী করে ভ্যাম্পায়ার হলেন?”
নক্রচৌধুরী কিছুক্ষণ দুলালের গলা থেকে ইঞ্চিকয়েক দূরে দাঁত বের করে বসে থেকে আচমকা ফের মাড়ি বুঁজিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি? মানে, আমি কেমন করে হলাম? কেন, যেভাবে বিচিত্রা সেন... ঐ যে, এস্তারের গল্প বললাম না...?” আচমকা লাফিয়ে উঠলেন তিনি, “শিট, তোমরা জানো না যে এই ভ্যাম্পায়ারাইটিস একটা যৌন রোগ? তোমাদের টোয়াইলাইটে নাই এইসব?” এবার লাফাতে লাগলেন তিনি। “কাঠবলদ! তোমরা একেকটা কাঠবলদ। বেসিকই তো জানো না, যতোসব কালা আদমি কোথাকার! সর্বনাশ, চৌধুরী এগুলি কাদের রক্তে চা খায়? কাদের সে পাঠাইলো আমার কাছে? এদের রক্ত খেলে তো আমার চুনাহাগা হবে! ক্ষুরারোগ হবে এই বলদগুলির রক্তে চা খেলে!” হেঁকে উঠলেন তিনি দোতলায়, “আমার ফোনটা কই? চৌধুরীকে ফোন লাগাও।”
আমি দুলারির দিকে চাইলাম, দুলারি শব্দ না করে ফিসফিস করলো, “রবি ঠাকুর?” দুলাল বোকচোপটা সব কূটনীতির ওপর পিশু করে দিয়ে ফস করে শুধালো, “তাইলে রবীন্দ্রনাথ ক্যামনে ভ্যাম্পায়ার হইলেন?”
নক্রচৌধুরী বিড়বিড় করছিলেন, প্রশ্ন শুনে সাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালেন, “হোয়াট? আর ইউ অ্যাস্কিং মি অর অ্যাকিউজিং মি? আরে ঐ ব্যাটা, তোর কী ধারণা আমি রবি ঠাকুররে ভ্যাম্পায়ার বানাইছি রে? আমি কিলান কৈতাম তাইন কিলা ভ্যাম্পায়ার অইছইন? রেস্পেক্ট হিজ প্রাইভেসি, ইউ ব্লিদারিং বাবুন! উনি তোমার জন্য তালগাছ ছড়া লিখেছেন, ঐটা নিয়া খুশি থাকো।”
দুলাল তারপরও ভ্যা ভ্যা করে ওঠে, “কিন্তু গান্ধী? আর জিন্না? আর আর সুভাষ বসু?”
সাইফুল্মুল্ক আবারও হাঁ করলেন, কিন্তু এবার বিস্ময়ে। “আমি জানি না, ড্যুড! তুমি এমন বাটহোল কেন? কেন এসব জিগাও? চা খেতে বললাম চা খাও।” দুলারির দিকে আঙুল তুললেন তিনি, “ইউ আর ইন আ রিয়েল ডেঞ্জার হিয়ার, সিস্টার। তোমার দোস্তো বাটহোলেরা নিরাপদ, বুঝলা? চা খাও।” আমার দিকে ফিরে চোখ রাঙালেন তিনি, “চৌধুরীর মতো চৌকস লোক ঠিক কীভাবে তোমাদের শুষে চায়ের মজা নেয়, আই ওয়ান্ট টু নো। না, ভুল বললাম, না... আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু, বাট আই নিড টু। ফর মাই স্যানিটি অ্যান্ড সারভাইভাল। দিস ইজ ডিজগাস্টিং। হি শুড বেটার হ্যাভ আ ভেরি প্লজিবল এক্সপ্ল্যানেইশন।”
আমার মাথায় এবার একটা ঘণ্টা বেজে ওঠে। চৌধুরী কেন আমাদের শুষে চায়ের মজা নেবে? দুলালের দিকে চেয়ে দেখি সেও আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি মাথা হাত চোখ সব নেড়ে ওকে জিভ কেটে নিষেধ করি, কিন্তু এবার দুলারি বলে বসে, “চৌধুরী ভাইয়া আমাগো শুষবো ক্যান? উনি কি ভ্যাম্পায়ার নাকি?”
সাইফুল্মুল্ক ভুরু কুঁচকে বললেন, “চৌধুরী নিখিল বঙ্গ এক্সজমিদার সংঘের সভাপতি। কতো বাঘা বাঘা ভ্যাম্পায়ারকে তলে ফেলে সে নির্বাচিত হইছে, তা জানো?” দুপদাপ করে দরজা খুলে কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে ঢোকা এক প্রৌঢ়ের হাত থেকে পুরনো দিনের নকিয়া ফোনসেট ছিনিয়ে নিলেন তিনি। “আমাদের ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিনও সে। আর তুমি বলো... ওয়েট...,” ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি ফোন জেবে পুরে, “এ কথা বললে কেন? চৌধুরী তোমাদের চা খাইয়ে তারপর তোমাদের রক্ত শুষে ক্যাফেইনের ঘাটতি মেটায়নি কখনও?”
দুলাল ডুকরে ওঠে, “না! কখনও না!”
প্রৌঢ় কম্পিত কণ্ঠে বললো, “ছার একটা কথা আছলো ছার...!”
নক্রচৌধুরী শিউরে ওঠেন, “মানে কী? চৌধুরী... চৌধুরী তাহলে সিভিলিয়ান?!” গালিচার ওপর থুক করে থুতু ফেললেন তিনি। “সে তাহলে শুধু এক্সজমিদার, অন্যপায়ী নয়?”
চৌধুরীর ক্ষতি এখানে আমাদের কতোটুকু লাভ, বুঝতে না পেরে আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার পাছু বাঁচানোর চেষ্টা করি, “না না, দুলাল বোকাটা বোঝে নাই। চৌধুরী প্রায়ই আমাদের রক্ত খায়।” গত মাসেও বদমাশ লোকটা আমাকে দিয়ে গরু মঙ্গোলভুনা রান্নার জন্য চর হান্নানমারা থেকে শুধুঘাসখোর বকনা গরুর মাংস কিনিয়েছে, কথাটা তাই পুরোপুরি মিথ্যা নয়।
প্রৌঢ় এবার কেঁপে উঠলো, “ছার খইরাম খিতা... একটু হুনুক্কা..।”
নক্রচৌধুরী আমার দিকে চেয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “বেশি পাকনামি করলে একদম ছিবড়ে বানিয়ে মাছের ঘেরে ফেলে দেবো।” পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। “চৌধুরী তবে অন্যপায়ী নয়, হুমম? হাহা, তাহলে তো নেক্সট ইলেকশনে জামানৎ তো যাবেই, জামাটাও থাকবে না ওর। হাহাহা, হাহাহাহা! বালম ক্ষীরা বানিয়ে ছাড়বো শালাকে, হাহাহা। থ্যাঙ্কিউ গুরুদেব, নামটা থুয়ে যাওয়ার জন্যে। বালম ক্ষীরা!”
প্রৌঢ় লোকটা ফের মুখ খোলার আগেই দূরে কোথাও বিকট ম্যাঁও ম্যাঁও শব্দ উঠলো, তার কিছুক্ষণ পর ধুপধাপ শব্দ তুলে তুরফান আলি এসে ঘরে ঢুকলো প্রৌঢ়কে ঠেলে, “হুজুর, ফুশি টাখুর যে দৌড়ানি দিছে আমরারে! বাছাউক্কা!”
নক্রচৌধুরী জিভ দিয়ে ছিক করে একটা আওয়াজ তুলে বললেন, “তোমরা একটা বিলাইকে খাঁচার মধ্যে ভরে রাখতে পারো না? ছাগলের দল।”
প্রৌঢ় ফুঁপিয়ে উঠলো, “ইগু কিতা নরমাল বিলাই নি? আইজ বিয়ানঅউ আমারে দরিয়া হাফ লিঠার রক্ত চুইয়া লইছে।”
দুলাল ফুঁপিয়ে উঠলো, “এইটা কেমন বিলাই?”
নক্রচৌধুরী কেমন যেন আনমনা হয়ে বললেন, “শি ইজ মাই পেট ক্যাট। পুসি ঠাকুর। কোয়াইট ফেরোশাস সামটাইমস।”
অদূরে এক ভয়ানক ম্যাঁও বোল উঠলো, নক্রচৌধুরী ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগে আমাদের দিকে নখরকরাল আঙুল তুলে বললেন, “চা খাও। হোয়েন আই গেট ব্যাক, আই উড নিড টি।” তারপর এক আলখাল্লার ঘূর্ণিঝড় তুলে যেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ম্যাঁও শব্দটার সাথে এক ভয়াল, তীক্ষ্ন, অপার্থিব ডাক ভেসে এলো বাইরে থেকে, “হিয়ার পুসি পুসি!” তারপর যেন দুটো বেড়ালের লড়াই মাইকে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। শোরগোলটা একটু একটু করে সরতে লাগলো বারান্দার দূরবর্তী প্রান্তের দিকে।
তুরফান আলি আমাদের প্রায় কলারে ধরে টেনে তুলে বললো, “আফনারা ইখানঅ বসিয়া কি করবেন? মরবেন? খিছিয়া মারইন দৌড়, সুজা লউকায় উঠিয়া সারেংরে গিয়া কইন, নাও ছাড়। আর হুজুর যদি ফিছে দৌড়ায়, মুবাইল দিয়া বিজলি মারইন যেন। আফনারার ফুনে বিজলি আছে?”
কাঁপা হাতে ফোনের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ অন করে তুরফান আলির ধাক্কা খেয়ে তিনজনই ঘর ছেড়ে ছুটে নেমে এলাম পথে। দুলারি ভোঁ দৌড় দিয়ে আমাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো অনেকদূর, দুলাল হাঁপাতে হাঁপাতে আমার পাশে ছোটার ফাঁকে ফুঁপিয়ে উঠলো, “বিলাইটা ভ্যাম্পায়ার হৈলো ক্যামনে?”
আমি জবাব না দিয়ে শুধু ছুটতে লাগলাম সামনে। এসব ভাবতে গিয়ে চুকচুকি বনবার কোনো ইচ্ছাই নেই আমার।
[সমাপ্ত]
মন্তব্য
আপনার দুটো গল্প পড়লাম আজকে। প্রথমটা লিখেছিলেন সম্ভবত চোদ্দ বছর আগে। প্রায় হাজার পাঁচেক শব্দের গল্পটিকে এখন আর খুঁজে পাচ্ছিনা কোথাও। মনের মুকুরে নতুন লেখা চলে এসেছে। দারুণ লেগেছিলো (শেষের অংশটা বাদ দিয়ে) ওই গল্পটি। কী দারুণ বর্ণনা, বাক্য গঠন, আর সংলাপ নির্মাণ! তুলনায় সাত হাজার শব্দের এই গল্পটি খুব সাধারণ লাগলো। তবে অনেক দিন পর আপনার গল্প পেলাম, দীর্ঘ একটি গল্প, সেই বা কম কিসের।
----মোখলেস হোসেন
বারো হাজার শব্দ গোণা তো ভারি কষ্টের কাজ, পড়ার কথা বাদই দিলাম। এতো কষ্ট করলেন, সেজন্যে ধন্যবাদ।
সচলায়তনের লেখার সাথে ফাও পাওয়া যায় পাঠকের মন্তব্য, লেখকের প্রতিক্রিয়া। শব্দের ব্যাপারটা আপনার আগের ওই লেখাটি পড়তে গিয়েই জেনেছি, আপনার জবানিতেই। এক টানে চার হাজার নয়শ সাতাত্তুর শব্দ লিখে থেমেছিলেন সেবার। সেই সূত্রেই কৌতূহলটা জাগলো। কপি করলাম, পেস্ট করলাম, শব্দ গুনে দিলো পেজ। ধন্যবাদ বরং আপনাকে, বড় লেখায় ফিরে এসেছেন বলে।
---মোখলেস হোসেন
জটিল!
'আনন্দেবেজার' শব্দখানা দারুণ পছন্দ হইছে।
মাস্টারপিস !!!! (মাস্টারপিসের বাংলা প্রতিশব্দ কি হবে হিমু ভাই?)
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
প্রভুখণ্ড
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
এই পিচ্চি গল্প বড়জোর মাস্টারপিশু হতে পারে।
চদ্রি সৈয়দের বাইরে যেসব চু খোর আছে তারার বিষয়ে কিছু কইলেন্না? তারাওতো নোবেল পাইছে। নাকি পায়নাই?
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ছোট্টো একটা গল্পে কি সবাইকে নিয়ে সবকিছু বলা যায়? আর নোবেলরাও তো মানুষ। কেন তাদের খামাকা গালাগালি করেন? আমি নোবেল পেলে কি আমার সাথে হুঁকা-পানি-সেলফি বন্ধ করে দিবেন?
হুকা পানি একটা প্রপঞ্চময় বিষয়। দুনিয়া গোল। নোবেল গোল। কেউ কাহারে নাহি ছাড়িবে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
চদ্রি সাহেবরে চিনতে পারলাম না যে
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চেনা দুনিয়ার কেউ সে নয়। নিছকই একজন সাদাসিধে এক্সজমিদার। গল্পটল্প বলে আর ভ্যাম্পায়ারদের সাথে পাল্লা দিয়ে ইলেকশন করে।
অনেকদিন পর একটা ভাল গল্প পড়লাম হিমু ভাই| যদিও অফটপিকঃ তবুও বলি, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটা লেখা দেওয়ার কথা ভাববেন নাকি ভাই?
ভাববো।
উহঃ দুর্দান্ত। সৈয়দ মুজতবা আলি, সঞ্জীবের পর এই প্রথম এধরনের একটা লেখা পরলাম। নিয়মিত লেখা চাই। শুভ কামনা।
বিঃ দ্রঃ আপনার কি কোন বই বের হয়েছে?
গল্প পরলে খুব বিপদ। ঝোড়ো হাওয়ায় বিপদে পড়তে হয়। গল্প পড়লে সাধারণত ঝামেলা হয় না। ধন্যবাদ।
বিঃ দ্রঃ হ্যাঁ।
গল্প কি লুঙ্গী যে 'পরলে' ঝোড়ো হাওয়ায় বিপদ হবে!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার কাছে মনে হয়েছে গল্পটার নাম 'অন্যপায়ী' হলে আরও জুত হতো। 'ভ্যাম্পায়ার'-এর বাংলা কী হয়? রক্তচোষা বা পিশাচ লাগসই মনে হচ্ছে না। 'মায়ানেকড়ে'র মতো একটা জুতসই বাংলা চাই।
সব প্রুষ ভ্যাম্পায়ারের অর্জিনাল নাম থাকলো আর নারীটার ক্ষেত্রে অর্জিনাল নাম থাকলো না। এক বাজারে দুই ভাও কেন?
শেষের ডিসক্লেইমারের ট্যুইস্টটা দারুণ হয়েছে।
আপনার এইপ্রকার গল্পগুলোর একটা সংকলনের কথা বিবেচনা করতে পারেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভ্যাম্পায়ারের বাংলা সম্ভবত শকসো, আমি নিশ্চিত না। রক্ত শুষে খাওয়ার ব্যাপারটা শকসোওয়ালা গল্পেই শুধু পড়েছি। তবে ইংরেজি গল্পের ভ্যাম্পায়ারের চরিত্রে যেমন পূর্ব ইয়োরোপীয় বনেদী প্রলেপ আছে, শকসোতে স্বাভাবিকভাবেই সেটা নেই, সে গ্রামের অলৌকিক ভ্যাম্পায়ার। এই ঘটনার লেজ ধরে আরো গল্প আসবে, দেখি আরো কয়েকটা নাম বের হয় কি না।
শকসো - শব্দটা অদ্ভুত, এর ব্যবহারটা কোথায় হতো গ্রামীন কোন সংস্কৃতিতে কি? নাকি এটা সংস্কৃত শব্দ?
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আমি সামান্য যেটুকু বুঝেছি - "শকসো" রক্তপায়ী, কিন্তু মানুষ বা মনুষ্যরূপী ভুত/পিশাচ কিছু না। কিন্তু ভ্যাম্পায়ার, বিশেষ করে এর পূর্ব-ইউরোপীয়/স্লাভিক ঘরাণা থেকে উদ্ভূত ও বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয়তম ভার্শানটি মনুষ্যরূপী। এর প্রধান বা মৌলিক তিনটি ফিচার -
১।এটা মানুষের বা মনুষ্যরূপী লাশ - যা গলে-পচে যায় না এবং সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত জীবিত হয়ে উঠে এবং দিনের বেলা আবার লাশ হয়ে যায়; একে "আনডেড"ও বলে।
২। এই ভ্যাম্পায়ার সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত জীবিত কালে রক্তপান করে থাকে। ইত্যাদি।
একমাত্র রক্তপান করা ছাড়া শকসোর সাথে এর কি আর কোন মিল আছে? দুয়েকটা গল্পের একটুখানি পড়ে শকসোকে আমার মানুষ বা মানুষরূপী মনে হয়নি, সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত জীবিত হয়ে উঠে এবং দিনের বেলা আবার লাশ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও কি আছে এর মধ্যে? নেটে একটু সার্চ দিয়ে মনে তো হল না।
আমিও একটু চিন্তা করে দেখলাম আমার এই প্রিয় চরিত্রটার বাংলা নাম কি হতে পারে। "রক্তপায়ী/চোষা জিন্দালাশ" বা শুধু "জিন্দালাশ"-এর চেয়ে ভালো কিছু মাথায় এলো না। প্রথমটা বেশি বড় লাগে, আর ২য়টা স্রেফ অর্ধেকটা অর্থ কাভার করে।
****************************************
তাহলে চুকচুকিই সই।
'শকসো' শব্দটা অভিধানে খুঁজে পেলাম না। অভিধানে ভ্যাম্পায়ারকে রক্তচোষা বলে চালিয়ে দিয়েছে, তাও আবার বাদুরের ওপর ভিত্তি করে।
বঙ্গীয় মৃতদের বিভিন্ন ভার্সান জীবিতের ঘাড় মটকায় বটে, কিন্তু রক্ত পান করে বলে শুনিনি। বঙ্গীয় মৃতরা কদাচিত 'জিন্দালাশ' (Zombie) হয় বটে, কিন্তু তারাও কারো রক্ত পান করে না। বঙ্গীয় মৃতরা জীবিতদের হাড়মাস চিবিয়ে খায়।
দৈত্য-রাক্ষস-খোক্কস ইত্যাদি জীবিত জীবেরা জীবিত মানুষের রক্ত পান করে, হাড়মাস চিবিয়ে খায়।
ডাকিনী-হাকিনী-শাখিনীরা জীবিত জীব। তাদের কেউ কেউ জীবিত মানুষের রক্ত পান করে, হাড়মাস চিবিয়ে খায় বটে তবে তাদের বেশিরভাগের টার্গেট যুবক পুরুষ - যাদের সাথে তারা শারিরীকভাবে মিলিত হয়ে জীবনীশক্তি শুষে নিয়ে অনন্তযৌবনা হয়।
পরী-অপ্সরা-গান্ধর্বী এদের টার্গেটও যুবক পুরুষ। তবে এরা দয়িতের জীবনীশক্তি শুষে নেয় না।
এই ছয় শ্রেণীর মধ্যে কেবল গান্ধর্বীর পুরুষ ভার্সান আছে - গন্ধর্ব, বাকিদের কোন পুরুষ ভার্সান নেই। এই অঞ্চলে ইসলামের আগমনের পর সেই ঘাটতিটা পূরণ করা হয়েছে জ্বীনদের দিয়ে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তাহলে চুকচুকিই সই।
'চুকচুকি' নামটা একটু আদুরে হয়ে গেলো না! ভীতিকর চেহারার একটা রক্তচোষা বদমাশকে এমন আদরের নামে ডাকাটা জুত লাগছে না। কাজ চালানোর জন্য আপাতত চুকচুকি চালাতে পারেন, তবে আরেকটু ভাবা দরকার।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হুমম ব্যাপারটা পুলিশকে ঠোলা বলার মতো হয়ে যায়।
ভ্যাম্পায়ারের বাংলা প্রতিশব্দ তাহলে কী হবে? চুকচুকি তো মজারু নাম। ভারিক্কি গোছের কিছু দিন না!
রসকদম্ব!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
দুর্দান্ত!
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
মুজতবা আলীর কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে ভালই করলেন। এই গল্পে সেটা খুবই প্রাসঙ্গিক হয়েছে। ১৯৭৪-এ তাঁর মৃত্যুর আগে ধানমন্ডি দুই নম্বরে তাঁর বাসায় দেখা হয়েছিল ওনার সাথে। তখনই তাঁর কাছে এইসব দিশী ভ্যাম্পায়ারদের কাহিনি শুনেছি। আরও যেটা শুনেছি, যা নক্রচৌধুরী জানতেন না, তা হলো - নক্রচৌধুরী থেকে বিচিত্রা সেনরা যেমন বঙ্গদেশীয় দিশী ভ্যাম্পায়ার, মুজতবা আলী তেমনি ছিলেন দিশী 'জোনাথন হারকার' - ভ্যম্পায়ার শিকারী! তবে উনি কোনো রহস্যময় কারনে সব ভ্যাম্পায়ার মারতেন না, বেছে বেছে মারতেন। সত্যি বলতে কি, অনেক ভ্যাম্পায়ার তো তার বন্ধুস্থানীয়ই ছিল, এমনকি রবীন্দ্র-ভ্যাম্পায়ার তো তাঁর গুরুদেবই ছিলেন। কে জানে, হয়তো এজন্যেই.... হয়তো ভাবতেন - চোর বাছতে বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার মতো ভ্যাম্পায়ার মারতে মারতে দেশটাই হয়তো উজাড় হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত। তার চেয়ে থাক না! তাই যেগুলির বেশি বাড় বেড়ে যেত, বেছে বেছে শুধু সেগুলিই মারতেন। উনি যে বসুজিকে খুঁজছিলেন, সেটা আমিও জানতাম। মনের কোনায় একটা কুটকুট সন্দেহ ছিল তাই - সুভাষ-ভ্যাম্পায়ারের অন্তর্ধানের পিছনে তাঁর কোনো হাত আছে কিনা। নক্রচৌধুরীর কাছে সুভাষের সন্ধানে সেজন্যেই গিয়েছিলেন কি? জিজ্ঞেসও করেছিলাম সেবার। কিন্তু না, হুইস্কির গেলাসের আড়াল থেকে একটা অর্ধ-লুকায়িত রহস্যময় মুচকি হাসি ছাড়া আর কিছু পাইনি। সন্দেহটা তাই থেকেই গেল!
ও হ্যাঁ, সেবার তাঁর ড্রইংরুমে সিলটিক হাকালুকিয়ামের তৈরি যে দিশী গজালগুলি দিয়ে উনি ভ্যাম্পায়ার হত্যা করতেন - সেগুলি দেখেছিলাম। সে এক বিরল সৌভাগ্য!
****************************************
উফফফফ! পুরা একটা গল্প ছাড়েন। এভাবে দুই টুকরা রসুন রেখে গেলে ছৈল্ত ন।
কি করবো বলুন, মুজতবা আলী এইসব কাহিনি প্রকাশ করার উপর ন্যূনতম ৫০ বছরের কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছেন। এটা শুধু ন্যাশনাল না - ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি ইস্যুও বটে। কে ভ্যাম্প্যায়ার, কে ভ্যাম্পায়ার না, কে খারাপ ভ্যাম্পায়ার, কে একটু ভালো ভ্যাম্পায়ার, কোন ভ্যাম্পায়ারকে মেরে কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছে, কে কার রক্ত খেয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি প্রকাশ পেয়ে গেলে সারা দেশ ও দুনিয়া জুড়ে তুলকালাম বেঁধে যাবে। ৩য় বিশ্বযুদ্ধ - বা আরও সাঙ্ঘাতিক - ইহ ও মধ্যলোকের মধ্যে ১ম সার্বিক যুদ্ধও লেগে যেতে পারে। তাই আপাতত এসব কাহিনি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ২০২৪-এ একটা রিভিউ হবে, তখন ভেবে দেখা হবে। আপাতত আদা-রসুন-পিঁয়াজই সই!
****************************************
এইটা নিয়া লেখা দিবেন কবে??
..................................................................
#Banshibir.
ভ্যাম্পায়ার-ট্যাম্পায়ার বাদ দিয়া আপনে এইডা নিয়া পরলেন ক্যান?!
****************************************
নতুন মন্তব্য করুন