সম্প্রতি যে প্রসঙ্গটি গণমাধ্যমকে কয়েক সপ্তাহ ধরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেটি ইস্তাম্বুলে সৌদি দূতাবাসে সৌদি রাজপুরুষদের হাতে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগজির হত্যাকাণ্ড। আমার এ লেখাটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং জামাল খাশোগজির নামটি আমরা গণমাধ্যমে কীভাবে লিখছি, তার লেজ ধরে আরো দু'তিনটি প্রসঙ্গ নিয়ে।
ব্রিটিশ শাসন লম্বা সময় ধরে আমাদের সম্পদ ও সমাজ নিয়ন্ত্রণ করায় এখনও তাদের টিনের চশমা চোখে নিয়ে আমাদের সাক্ষর মানুষরা চলছেন, এ নিয়ে আমি টুকিটাকি লিখেছি। আমাদের উচ্চশিক্ষার স্বাভাবিক ঝোঁক একজন চলনসই ইংরেজিবোঝা ভোক্তা তৈরি করা, বাড়তি কিছু তার সাথে যোগ হলে আমরাই খুশি হই। সামগ্রিক মস্তিষ্ক এভাবে রাষ্ট্রভাষার বাইরে আরেকটা ভাষার কাছে বর্গা দিয়ে রাখার উপকার আর অপকার দুই-ই আছে নিশ্চয়ই। অপকারের দিকটা বোঝার চেষ্টা করলে হয়তো উপকারের দিকটাও নতুন আলোয় দেখা যাবে।
জামাল খাশোগজির টুইটার ঠিকানায় [সূত্র ১] আরবিতে তার নাম যা লেখা, তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ দাঁড়ায় জামাল খাশোগজি। আমাদের গণমাধ্যম যেহেতু ভিনদেশের খবরের জন্যে ইংরেজিভাষী সূত্রের ওপর প্রায় শতভাগ নির্ভরশীল, যে সংবাদকর্মীরা এ নিয়ে খবর টোকেন, লেখেন, এবং যাচাই করে ছাপেন, তারা নামটির ইংরেজি প্রতিবর্ণকে (KHASHOGGI) প্রামাণ্য ধরেছেন, এবং কেউ "খাশোগি" আবার কেউ "খাশোজ্জি" লিখে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে বাংলা মাধ্যমে সপ্তম ও অষ্টমশ্রেণীতে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের আরবি ভাষার ওপর পাঠ দেওয়া হয়, তাই ধরে নেওয়া অন্যায্য হবে না যে আরবি হরফে কারো নাম পড়ার সক্ষমতা গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে কারো না কারো থাকবে। নানা ডামাডোলে এ সক্ষমতা হারালেও কোনো সমস্যা নেই, আরবি শব্দ পড়তে পারেন এমন কোনো ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। কিংবা তারও প্রয়োজন নেই, আরবি লিপির উচ্চারণ কেমন, সেটা উইকিপিডিয়া থেকে দেখে নেওয়া যেতে পারে [সূত্র ২]।
খাশোগজির ঘটনায় আরো অনেকের নাম গণমাধ্যমে আসছে, এমনই একজন হচ্ছেন খাশোগজির বাগদত্তা হাতিজে জেনগিজ। আরবি খ তুর্কিতে এসে হ হয়ে যায়, দ হয়ে যায় ত, আ-কার হয়ে যায় এ-কার। পারস্য লিপিতে লিখলে হয়তো এনার নাম "খাদিজা" হিসেবে চেনা যেতো, কিন্তু তুর্কি ভাষা প্রায় নব্বই বছর ধরে সম্প্রসারিত লাতিন লিপিতে লেখা হচ্ছে, তাই হাতিজের নাম লাতিন লিপিতে HATICE CENGIZ, যেটাকে আমাদের গণমাধ্যম "হ্যাতিস চেঙ্গিস" বলে লিখে যাচ্ছে। কেন তুর্কিরা পারস্য লিপির "জিম"কে লাতিন C দিয়ে বোঝানোর সিদ্ধান্ত নিলো, তা আমি জানি না। কিন্তু এখানেই যে ব্যাপারটা গণমাধ্যম ছাড়াও আমাদের সবারই হৃদয়ঙ্গম করা উচিত, যেসব ভাষা লাতিন বা সম্প্রসারিত লাতিন লিপি ব্যবহার করে লেখে, তারা "ইংরেজি"তে লেখে না। ইংরেজি থেকে শুরু করে ফরাসি, জার্মান, স্পেনীয় বা তুর্কি, প্রতিটি ভাষায় লাতিন লিপির একটি নিজস্ব উচ্চারণকাঠামো রয়েছে, সেটি সবসময় আমাদের সুপরিচিত ইংরেজি উচ্চারণকাঠামো অনুসরণ না-ও করতে পারে। জার্মানে যেমন Z এর উচ্চারণ ৎস, ইংরেজি য নয়। ফরাসিতে H নিরুচ্চার্য, স্পেনীয়তে J দিয়ে হ আর খ এর মাঝামাঝি এক বিচিত্র ধ্বনি বোঝায়; এমন অনেকগুলো উদাহরণ টানা যেতে পারে। তুর্কি শব্দের ইংরেজি প্রতিবর্ণ কেমন, সেটা উইকিপিডিয়ায় আছে [সূত্র ৩]।
এমন আরো উদাহরণ টানা যায়। পাঠ্যবইতে "রোবট" শব্দের প্রণেতা হিসেবে কারেল চাপেকের উল্লেখ আছে "কারেল কাপেক" হিসেবে। চেক ভাষা সম্প্রসারিত লাতিন লিপির জন্যে যে উচ্চারণকাঠামো ব্যবহার করে, তাতে "চ" বোঝানোর জন্যে Č ব্যবহার করা হয়, যা আমাদের পাঠ্যপুস্তকপ্রণেতাদের মনোযোগ বা আগ্রহের ঘণ্টায় বাড়ি মারতে পারেনি। কিন্তু এই "শৃঙ্গবান সি"টি যে শিক্ষিত কিছু মানুষের মনে সামান্য প্রশ্ন বা কৌতূহল জাগাতে পারেনি, সে উপলব্ধি মোটেও স্বস্তিপ্রদ নয়। এই যে এখানে ভিন্ন কিছুর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে চেনা জিনিসকে গুঁজে দেওয়া হলো, এর মাঝে নতুনকে বা ভিন্নতরকে অস্বীকারের ইঙ্গিত আছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় পারিপার্শ্বিক পৃথিবীকে জানার আর বোঝার প্রস্তুতিগ্রহণ, আমরা সেখানে ব্যর্থ হচ্ছি।
সারা দুনিয়া জুড়ে অগণিত সংস্কৃতির অসংখ্য চরিত্র নিয়ে গণমাধ্যমকে খবর করতে হয়, তাই ইংরেজির টিনের চশমা এবং টিনের চোঙা পার হয়ে শব্দগুলো বাংলা লিপিতে আমাদের কাছে পৌঁছানোর পর সেগুলো খানিক চীনা ফিসফাসের ভেতর দিয়ে যাবে, এটা মেনে নিতে বলেন অনেকে। এখানেই প্রকট আলস্য আর প্রচ্ছন্ন প্রভুভক্তির কাছে আমাদের শিক্ষার পরাজয়। ভারতবর্ষের অনেক স্থান আর পাত্র নিয়ে ইংরেজিতে গবেষণা-লেখালেখি-বকাবকি হয়েছে, চেনা শব্দও অনেক সময় তার ঠ্যালায় অচেনা হয়ে যায়। এখানে ছাড়টুকু আমরা মূলত নিজেদের না দিয়ে ইংরেজিভাষীদের দিই, এবং ইংরেজির দাপট বাড়াতে ভূমিকা রাখি। ইংরেজের ময়লার ঝুড়ি থেকে এটা-সেটা টোকানোর সামর্থ্য অর্জনই কি আমাদের শিক্ষার দৌড় তাহলে?
আমাদের এই ভৃত্যোচিত মনোভাবের সুযোগ কিন্তু ভিনদেশের বাংলাভাষীরা পর্যন্ত নেন। পশ্চিমবঙ্গে যেমন কিছু পত্রিকা ও বইতে বাংলাদেশের মানুষের নাম (যা বাংলায় বানান করে লেখা থাকে বলেই তারা পড়ে জানতে পারেন) নিজেদের মতো করে আরেকদফা প্রতিবর্ণীকরণ করে নেন। আমাদের অনেকের নামই আরবি-ফারসি শব্দে রাখা, কিন্তু সেটার প্রতিবর্ণীকরণও আমরা বাংলায় করে নিয়েছি। সেটার আরেকদফা প্রতিবর্ণীকরণ করার পেছনে একটা অবজ্ঞা কাজ করে, নইলে আমাদের নিজস্ব প্রতিবর্ণীকরণকে বাতিল করে নামগুলোকে আবার আরবি-ফারসির আঙিনায় ঠেলে দিয়ে সেখান থেকে নিজের ছাঁচে নতুন করে ঢালা কেন? আমরা এসব কেন যেন মেনে নিই, কারণ না মানতে গেলে যে আনুষঙ্গিক বাড়তি খাটুনির ভার বইতে হয়, তাতে আমাদের আগ্রহ কম, কিংবা শূন্য।
পাঠক হয়তো ভাবছেন, খাশোগজিকে খাশোগি লিখলে কিছুই এসে যায় না। কিন্তু একটা জিনিসকে নিজে চেনার চেষ্টা মুলতুবি রেখে আরেকজনের মুখে শুনে তাকে চিনে গেলে একটা সময় নিজের চেনার সামর্থ্য আর থাকে না। অচেনারে চিনতে পথে নামলেই কেবল আপনারে চেনার কাজটা শুরু হয়।
মন্তব্য
আপনারে চেনার কাজটা স্বাক্ষর মানুষরা আগে সাক্ষর হয়ে তারপর নিজের নামটা স্বাক্ষর করে নিজের নামটা সর্বাগ্রে চেনার মাধ্যমে শুরু করলে ভালো হতো না?
****************************************
ধন্যবাদ, শুধরে নিলাম।
বাংলাদেশে জনপ্রিয় তুর্কি টিভি সিরিজ সুলতান সুলেমান-এ সুলতানের বোনের নামকে বাংলায় ডাব করে কি "হ্যাতিস" না "খাদিজা" বানানো হয়েছিল? মূল তুর্কিভাষী সিরিজে সুলতানের বোনের চরিত্রকে "হাতিজে" নামে সম্বোধন করা হত! বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমে যারা Hatice Cengiz-কে "হ্যাতিস চেঙ্গিস" বানিয়ে ফেললেন, তারা টিভি নাটক দেখার সময় নামের এই উচ্চারণ খেয়াল করেননি?
১।
প্রতিবর্ণীকরণের ক্ষেত্রে আসলে কী অনুসরণ করা উচিত? আমি যা বুঝি তা হচ্ছে -
(ক) শব্দটি যে ভাষা থেকে আগত সে ভাষায় এটিকে কীভাবে উচ্চারণ করা হয়?
(খ) ক-এর উত্তর জানার পর, সেভাবে উচ্চারণটি বাংলা বর্ণগুলো দিয়ে ঠিকঠাক প্রকাশ করা কি সম্ভব?
(গ) খ-এর উত্তর নেতিবাচক হলে মূল উচ্চারণের খুব কাছাকাছি কোনভাবে সেটি কি বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ সম্ভব?
(ঘ) গ-এর মীমাংসা হলে বাংলায় লেখা শব্দটি কি পড়া বা বলা সম্ভব? এই কথাটা বললাম এই জন্য যে, মহাকাশবিজ্ঞানী ৎসিয়লক্ভস্কী, গোর্কির চরিত্র ৎসিগানকের নাম বাংলায় লিখতে পারলেও পড়তে বা বলতে কি পারলাম? যদি পড়তে বা বলতে না পারি তাহলে সেভাবে বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করে কী লাভ?
কিছু বিদেশী শব্দ আছে যেগুলো বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করা সম্ভব নয়। যেমন, পোল্যান্ডের শহর Pszczyna বা Szczebrzeszyn - এমনসব বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম অনুসরণ করতে হবে তার কোন দিকনির্দেশনা তৈরি করা হয়নি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এগুলোকে ইংরেজি শব্দ ধরে নিলে বিষম আপদ মনে হবে। পোলিশ "CZ" ~ চ, "SZ" ~ শ, RZ ~ ফরাসি J এর মতো (প, ত, ক, খ এর পর বসলে আবার "শ")। কাজেই প্রথম শহরটা প্শ্চিনা, দ্বিতীয় শ্চেবজেশিন। দিকনির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে অবশ্যই, একটু ঘুরপথে [সূত্র]।
লেখার পর বলতে পারাটা জরুরি নিশ্চয়ই, কিন্তু "আমি নিজে পারি না, কাজেই কেউ পারে না" তো প্রতিবর্ণীকারীর চিন্তা হওয়া উচিত না। আর "ৎস" দেখতে যতো বিদঘুটে, বলতে ততো নয়, জিভ দাঁতে ঠেকিয়ে স বললেই হয়। ভ্লাদিমির পুতিনের নাম যিনি লিখছেন, তিনি কি কে এটা উচ্চারণ করতে পারলো বা পারলো না সে খতিয়ান নেবেন জনে জনে?
বহু নাম আছে, বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করা সম্ভব না (ইংরেজি measureও যেমন সম্ভব না), আমরা সেগুলো যতোটা কাছাকাছি পারা যায়, করতে পারি। সমস্যাটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারা বা না পারায় নয়, শব্দটাকে ইংরেজির টিনের চশমা দিয়ে দেখা বা না দেখায়।
উপরে আমি কিন্তু আমার অবস্থান পরিষ্কার করেছি এই বলে যে, শব্দটি যে ভাষা থেকে আগত সে ভাষায় এটিকে কীভাবে উচ্চারণ করা হয়। সুতরাং তৃতীয় কোন ভাষার চশমা ধার করার ব্যাপার এখানে নেই।
যে দিকনির্দেশনার কথা আপনি বললেন সেখানে আমার কিঞ্চিৎ দ্বিমত কেবল ঐ বলতে পারার প্রশ্নে। এটা একজন ব্যক্তির পারা না পারার ব্যাপার নয়, এটি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের পক্ষে স্বল্প আয়াসে বলতে পারা সম্ভব কিনা সেটা লক্ষ রাখা দরকার আছে। যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে, মোটামুটি জুতসই প্রতিবর্ণীকরণ করা গেলো কিন্তু বেশিরভাগ জনে জুত করে উচ্চারণ করতে পারলো না সেক্ষেত্রে একটু এদিক ওদিক করা যেতে পারে।
একটা উদাহরণ দেই। বাংলা শব্দ 'এটা'র ফারসী প্রতি শব্দ 'این است'। এটাকে বাংলায় 'আইন আস্ত' অথবা 'আইনাস্ত' করতে পারি, যেখানে বর্ণ বিচারে 'আইন আস্ত' ঠিক আর উচ্চারণ বিচারে 'আইনাস্ত' ঠিক। সমস্যা হচ্ছে শেষের 'স্ত' বা 'স্ত'কে নিয়ে। এটাকে যে কোমলভাবে একটা রেশসহ উচ্চারণ করতে হয় তা আমি কোন বাংলা/হিন্দী/উর্দুভাষী কণ্ঠে শুনিনি। এই তিন ভাষাভাষীর কেউ কেউ যে সেটা পারেন না তা নয়। তবে তারা সংখ্যায় অতি অল্প। বাকি সবাই বেশ জোরের সাথে 'স্ত' উচ্চারণ করেন। এখন বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করার সময় আমরা যদি 'আাস্-ত' লিখি তাহলে মনে হয় খুব অশুদ্ধ হবে না।
হ্যাঁ, তারপরেও অনেক অনেক বিদেশী শব্দ বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করা যাবে না। সেক্ষেত্রে মূল ভাষায় উচ্চারণের দ্বারস্থ হলে আগের অনুচ্ছেদে বলা লঘু ত্রুটিসহ প্রতিবর্ণীকরণ করা সম্ভব হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ ক পদ্ধতির পক্ষে বলেছেন। এই পদ্ধতির বিপদ আছে। ধরা যাক, একজন Köln (জার্মান ভাষার ö মানে ইংরেজি oe) শহরের নাম কোয়েল, কোলন, ক্যোলন্ ইত্যাদি। আরেকটা উদাহরণ Merkel। মার্কেল, ম্যারকেল, মেরকেল - সবগুলোই দেখা যায়। এভাবে একেকজন একেক বানান লেখায় একটা লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে। কোন বানান পরীক্ষক বানানো সম্ভব না এভাবে। এর একমাত্র সমাধান একটা প্রধান ভাষাগুলোর স্টান্ডার্ডাডাইজড প্রতিবর্ণীকরণ নিয়ম বানানো যেখানে লেখা থাকবে অমুক ভাষায় দ্বিতীয় অক্ষর e থাকলে সেটা কীভাবে বানান করে লিখতে হবে। এ কাজটা বাংলা একাডেমীর। তাদের মনে হয় এতো সময় নেই এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভাবার।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
- সহমত। তবে ঐ যে বললেন,
- সে কারণে এটা সহসা হবে না। একজন বাংলা ভাষাবিজ্ঞানী এটার একটা খসড়া প্রস্তাব নিয়ে বই লিখে ফেললে কিছু কাজ হতো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
২।
বাংলাদেশে ভাষা শিক্ষা দেবার পদ্ধতিটি ভুল। পদ্ধতির ভুলের কারণে আমরা স্কুলে পড়েও বাংলা, ইংলিশ সাথে আরবী/সংস্কৃত/পালী ভাষা শুদ্ধরূপে শুনে বুঝতে, বলতে, পড়তে ও লিখতে পারি না। স্কুলে, মসজিদে, মক্তবে, মাদ্রাসায় যারা আরবী শিক্ষা দেন তাদের আরবী ভাষা শিক্ষা দেবার পদ্ধতি ঐ ভুলের পরম্পরা বলে সেখানকার প্রডাক্টদের অতি সামান্যজন মোটামুটি আরবী জানেন, বাকিরা কিছুই জানেন না।
ঐতিহ্যগতভাবে আমরা ভাষার সঠিক উচ্চারণের ব্যাপারে উদাসীন। শিক্ষিত বাঙালীদের সিংহভাগ সামান্য 'আহ্বান' আর 'বিহ্বল' শব্দদুটো সঠিক উচ্চারণ করতে পারেন না। কীভাবে পারবেন! তাদেরকে যারা শিখিয়েছেন তারাই তো সঠিক উচ্চারণটি জানেন না। সুতরাং এই লোকজন যে অন্য ভাষাও ভুল উচ্চারণ করবে, ভুল প্রতিবর্ণী করবে এটাই কি স্বাভাবিক না!
আরবী ভাষার প্রথম বর্ণ স্বরচিহ্ন ব্যতীত হবার উপায় নেই। সুতরাং আরবীতে শুরুর বর্ণ া, ু বা ি-কার যুক্ত হবে। অথচ আমরা হরহামেশা রহমান, রহিম, খলিল ইত্যাদি বলে থাকি, প্রতিবর্ণী করে থাকি।
ফারসী, তুর্কীস্তানী ভাষাসমূহ (যদি নাস্তালিকে লেখা হয়), আফগান ভাষাসমূহ ও উর্দু'রও প্রথম বর্ণ স্বরচিহ্ন ব্যতীত হবার উপায় নেই। কিন্তু উচ্চারণের ক্ষেত্রে সেখানে প্রায়ই একটা অর্ধ া-কার উচ্চারিত হয়। একই ধরনের ঘটনা হিন্দীর ক্ষেত্রেও ঘটে। বাংলায় অর্ধ া-কার নেই বলে প্রতিবর্ণীকরণের কালে কেউ সেখানে পূর্ণ া-কার দেন, কেউ স্বরচিহ্নবিহীনভাবে রাখেন। এটার একটা সর্বজনমান্য সমাধান হওয়া উচিত।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তা বলে না। বাংলাদেশে আরবিতে বাহাস করতে পারার যোগ্য লোকের সংখ্যা ইংরেজিতে বাহাস করতে পারা লোকের সংখ্যার চাইতে বেশি হবে।
দ্বিতীয়ত, আমরা রাস্তা ঘাটে অনেক ভিনভাষার শব্দ ব্যবহার করি। এদের মধ্যে অনেক শব্দ এখন বাংলায় ঢুকে গেছে। সেগুলোর মূল উচ্চারণ করতে হবে এমনটাও নয়। আরে বিদেশী ভাষাও যখন আমরা বলবো, যেমন ইংরেজি, তখন ব্রিটিশ বা আমেরিকান উচ্চারণে বলবো এই দায়টাও আমার নেই। আমার মাতৃভাষার উচ্চারণের প্রভাব নিয়েই, আমরা যেটাকে অ্যাক্সেন্ট বলি, সেটা বলবো।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আমার মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলে। বিজনেস নেগোসিয়েশন মিটিং-এ কার্যকর দোভাষীর কাজ করতে পারবেন এমন আরবী জানা লোকের জন্য কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আরবী জানেন বলে দাবিকরা লোকজনের বেশিরভাগের অবস্থা ইংলিশ জানেন বলা লোকেদের চেয়ে খারাপ।
ধর্মীয় গ্রন্থগুলো থেকে মুখস্থকরা লম্বা লম্বা উদ্ধৃতি দিতে সক্ষম লোক অনেকে আছেন, কিন্তু ঐ উদ্ধৃতির কোন বিশেষ শব্দের মানে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে নিজস্ব মত দিতে তারা অক্ষম। বাংলাদেশে আরবী জানা (শুনে বোঝা, বলতে পারা, পড়তে পারা, লিখতে পারা) লোক যদি ইংলিশ জানাদের চেয়ে বেশি হতো তাহলে আমরা আরব দেশগুলোতে ভালো চাকুরি, আরও বেশি চাকুরি পেতাম। মাদ্রাসা পাশ দেয়া লাখ লাখ বাঙালী আরব দেশে কাজ করেন। তাদের ভাষার অবস্থা অন্যদের চেয়ে খুব ভালো নয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমার প্রয়াত দাদার মুখ থেকে নিম্নোক্ত গল্প শুনেছিলাম; সত্যতা যাচাইয়ের কোন উপায় নেই!
১৯৫৭-র কাগ্মারি সম্মেলনে মিশর থেকে কয়েকজন অতিথি এসেছিলেন। তারা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। তাদেরকে বলা হয়েছিল মওলানা সাহেব যেহেতু খুব ভাল আরবী জানেন, সুতরাং আলাপের সময় কোন দোভাষী দরকার হবে না। তো তারা মওলানার সঙ্গে আরবিতেই কথা বললেন, মওলানাও আরবিতে উত্তর দিলেন, এবং কিছুক্ষণ পর জরুরী কাজ আছে বলে তিনি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। মিশরীয় দলের একজন সদস্য তাদের হোসটকে বললেন, "আমরা যে কথাই বললাম, মওলানা সাহেব তার উত্তরে কেবল কোরান তেলাওয়াত করে গেলেন!"
আগের দিনের অনেকেই নাকি আরবী ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। তো এসব পণ্ডিতদের কেউ আরবীতে কখনো বই/প্রবন্ধ/গল্প/উপন্যাস/কবিতা রচনা করেননি কেন? এখনো পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই দরকারী বা জনপ্রিয় আরবী বইগুলো তৃতীয় কোন ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়। ইসলামের দরকারী বইগুলো ভারতীয় ভাষ্যকারদের করা উর্দু অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়।
মওলানা ভাসানীকে নিয়ে অনেক মীথ প্রচলিত আছে। তার কোনটা যে সত্য তা কে বলতে পারবে!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
যতদূর জানতাম, আরবী নয়, বরং খাতুন মধ্য এশিয়ার তুর্কিক ভাষার শব্দ। ঐতিহ্যগতভাবে গোত্রপ্রধাণ (খান)-এর পরিবারের নারী সদস্যদেরকে খাতুন সম্বোধন করা হত।
তুর্কীস্তানী ভাষায় 'খান'-এর স্ত্রীলিঙ্গ স্থানভেদে 'খানুম'/'খোনিম'/'খানিম'। خاتون (খ্বাতুন) আরবী শব্দ, তুর্কীস্তানী নয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এখানে তো বলছে খাতুনের উৎপত্তি মধ্য এশিয়ায়...
৩।
দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের নাম প্রধানত আরবী অথবা আরবী শব্দের জাত অথবা আরবীর অপভ্রংশ। এ'কারণে আরবী 'সায়ীফ উদ্ দীন' (ধর্মের তরবারী) বাংলাদেশে এসে হয় 'সাইফুদ্দিন' আর পশ্চিমবঙ্গে হয় 'সৈফুদ্দিন'। সমস্যাটা সেখানে নয়, সমস্যা হয় যখন বিশেষ কোন নামের প্রতিষ্ঠিত বানানটি কতিপয় ইচ্ছা করে পরিবর্তন করা হয়। প্রেস নোটে বা অন্য কোথাও লিখিতভাবে দেয়া নাম 'ওবায়দুল কাদের' যখন 'ওঐদুল কাদের' বা 'ওয়াবাদুল কদর' হয় অথবা 'রেহমান সোবহান' যখন 'রেমান সুজন' হয় অথবা 'শমী কায়সার' যখন 'সোমি কাইজার' হয় তখন তাতে মূর্খের অবজ্ঞা প্রকাশিত হয়। একটা দেশের 'প্রধানমন্ত্রী'কে যখন 'মুখ্যমন্ত্রী' সম্বোধন করা হয় এবং তার ভুল ধরিয়ে দেবার পরেও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তার সংশোধন করা হয় না তখন মূর্খের মূর্খতা আরও বেশি প্রকাশিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা পড়লে মনে হয় ভাষা নির্বিশেষে বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করার সময় তারা হিন্দীতে উচ্চারণকে গ্রহন করেছে। যেমন, ইংলিশ love শব্দটির উচ্চারণ হচ্ছে lúv, এতে বাংলায় প্রতিবর্ণীকরন করলে সেটা 'লাভ্' হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা সেটাকে হিন্দীর কায়দায় 'লভ্' লেখে। বাংলায় যে অর্ধ া-কার বা তদানুরূপ উচ্চারণ নেই সেটি তাদের বিবেচনায় নেই। তাদের বিবেচনায় জিনিসটি হিন্দীতে কেমন সেটা দেখে বাংলায় তার নকল করতে হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পশ্চিমবঙ্গের এই দাদাগিরি পৌরাণিক। বাংলার যা হালত ওখানে তাতে কিছুদিন পর গোটা ভাষাটাই হিন্দিয়ান প্রভাবে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আমার একটা ভিত্তিহীন আশঙ্কা আছে। অচিরে ভারতে প্রচলিত সব ভাষা দেবনাগরী লিপিতে লেখার আবদার উঠতে পারে। ভারতে যেভাবে চাড্ডিকরণ বাড়ছে তাতে অমন আবদার অমূলক না। যদি কখনো অমন আবদার ওঠে তাহলে সেটা দক্ষিণে পাত্তা না পেলেও পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে অনেকে সেটা সাগ্রহে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে দেবনাগরী লিপিতে লেখা বাংলা দেখতে হবে। রূপের আগল খুলে গেলে তখন প্রতিশব্দ, ক্রিয়াপদ, সর্বনামের পথ খুলে যেতে সময় নেবে না। অলরেডি অনেক প্রতিশব্দ ঢুকে গেছে এবং আকছার পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা লোকের কথায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
অটঃ বাংলায় বা ইংলিশে প্রশ্ন করলে হিন্দীতে উত্তর দেয় এমন অনেক বঙ্গসন্তানের দেখা পেয়েছি। জিজ্ঞেস করেছি, আপনি বাংলায়/ইংলিশে উত্তর দিলেন না কেন? বিরক্ত মুখে উত্তর, ম্যয়নে যো ভি কহা, আপ্ সমঝ গয়্যা, হ্যায় না?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমি পশ্চিমবঙ্গের অবস্থার খোঁজ রাখার চেষ্টা করি। বাংলা যে হিন্দির আগ্রাসনের শিকার এটা প্রগতিশীলেরা মানতে চান না। তাদের মধ্যে এক ধরণের লিবারেলপনা কাজ করে। হিন্দিও ভাষা, সেটা আসলে ক্ষতি কি, দুটো হিন্দি শিখলে আখেরে লাভ ইত্যাদি। বাংলাপক্ষ নাম নিয়ে বাংলা নিয়ে যারা চেঁচামেচি করে তাদের দলনেতা যেহেতু তিনু সেহেতু সেকু-মাকুরা তাদের কোন কথা শুনতে রাজি না। বাংলাপক্ষের কিছু দাবিতে সমস্যার কারণে বাংলা আগ্রাসনের মুখে এটাও মানতে তাদের সমস্যা। বাংলাদেশে ফেলানি ইস্যু এরকম একটা ইস্যু। ফেলানি নিয়ে বেশি চেঁচিয়েছে জামাতিরা এই কারণে বাংলাদেশের প্রগতিশীলেরা বর্ডার হত্যাযজ্ঞ নিয়ে মুখ খুলতে পারেনি।
আর হিন্দি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি অক্ষরে বাংলার প্রাদুর্ভাব আছে। গত বইমেলাতে ইংরেজি হরফে বই বের হয়েছে কলকাতায়। একশত বছর আগেও এরকম কিছু বই লেখা হয়েছিল কিছু কলোনিয়াল দাসের হাতে। বাংলাদেশেও ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা হয়। তবে সেখানে কেউ বাংলা অক্ষরে লিখতে বললে দল বেঁধে ইংরেজি হরফ ডিফেন্ড করতে দেখা যায় না।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
১। আজকের পৃথিবীতে কোন ডিভাইসে রোমান হরফে বাংলা লেখার দরকার নেই। তবুও বিপুলসংখ্যক ভারতীয় বাঙালীদের দেখি রোমান হরফে বাংলা লিখতে। এই ব্যাপারে তাদের অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, উত্তরে তারা যা যা বলেছেন (সবার যুক্তি এক নয়) সেগুলি আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি। ওসব যদি সত্যি সমস্যা হতো তাহলে সেগুলো বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশীদের জন্যও হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে তো অমন হয় না!
২।
- একি কথা শুনাইলেন! সাড়ে তিনশ'-চারশ' বছর আগে লিসবনের বা গোয়ার ছাপাখানায় রোমান হরফে লেখা বাংলায় বই ছাপা হতো। তাহলে কি সেই দিন আবারও ফেরত আসতে যাচ্ছে!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
১।
বোধগম্য হবে আপনি অভ্রের কথা তুললে। বাংলা ভাষার সবচাইতে জনপ্রিয় কীবোর্ড কেন ব্যবহার করতে চায় না তারা সেটার ব্যাখ্যা খুব ইন্টারেস্টিং হবার কথা।
২।
তিন চারশ বছর আগে ইউরোপে যা ছাপা হয়েছে সেটা ক্ষমা করা যায় এই যুক্তিতে যে তখন যারা এর উদ্যোক্তা ছিলেন তারা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিলেন। একশত বছর আগেও কিছু লোক বাংলা লিপির বদলে ইংরেজি অক্ষরে লেখার পক্ষে ওকালতি করেছেন। এই মুহুর্তে সঠিক রেফারেন্স হাতে নেই। স্মৃতি থেকে লিখলাম।
এ বছর কলকাতা বইমেলাতে ইংরেজি কায়দায় সুকুমার রায়ের লেখাও ধর্ষণ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক আনন্দবাজারের একটা সম্পাদকীয় পড়ুন -
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
এ প্রসঙ্গে আপনার কিছু জানা আছে? আমি অত্যন্ত আগ্রহী জানতে!
****************************************
১। অভ্র তার যে ব্যবহার করেন না তা নয়। ওমিক্রনল্যাবকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে ভারতের কী পরিমাণ ইউজার অভ্র ডাউনলোড করেছেন। তবু তারা রোমান হরফে বাংলা লিখে যাবেনই। এর একটা কারণ হচ্ছে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে রোমান হরফে হিন্দী আকছার লেখা হয়ে থাকে। তাই একই পথ অনুসরণ করতে তারা সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
২। আনন্দবাজারদের প্রতিবাদ ক্রমেই ক্ষীণকণ্ঠ হতে থাকবে। বাজারে 'বেংলিশ বুকস্' জায়গা করতে থাকবে। বছর বারো আগে 'ঢাকা বইমেলা'তে দেখেছিলাম রবিবুড়া, সুকুমার রায় থেকে শুরু করে অনেকের শিশুতোষ বই সরল বাংলায় 'অনুবাদ' করা হয়েছে (স্মর্তব্য, সেবা প্রকাশনী থেকে আরও কয়েক দশক আগে 'কপালকুণ্ডলা'র সরল বঙ্গানুবাদ বের হয়েছিল)। বাংলাদেশেও সরল বঙ্গানুবাদগুলো 'বেংলিশ বুকস্' হয়ে যেতে পারে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্রতিবর্ণীকরণের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে, তাও আবার হিমুর এমন একটা ক্ষোভতপ্ত পোস্টে ইংরেজির টিনের চশমা এবং টিনের চোঙা পার করে বাংলা লিপিতে চীনা ফিসফাসের মতো প্রতিবর্ণীকরণ করলে চলবে?
আমার মনে হয় এটা --
-- বা এরকম কিছু হবে!
****************************************
- মন মাঝি
ইত্যাদির বৈচিত্র শুধু ইংরেজিতে উদযাপন না করে সভ্য হওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন
বুঝলাম না! ঘটে বুদ্ধিসুদ্ধি কম। একটু বুঝিয়ে বলবেন?
****************************************
ঠিক! 'লিসবোয়াঁ' লেখাটাই যুক্তিযুক্ত। তবে একটু ভেবে দেখুন, লিসবন (লিসবোয়াঁ), প্যারিস (পারী, মোটামুটি), রোম (রোমা), প্রাগ (প্রাহা) নামগুলো কয়েক শতাব্দীর ব্যবহারে কি বাংলা নাম হয়ে গেছে না!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পুরনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিবর্ণীকৃত শব্দগুলির ক্ষেত্রে আপনার সাথে কোনো দ্বিমত নাই আমার। তবে নতুন নতুন শব্দের ক্ষেত্রে হিমুর দৃষ্টিভঙ্গিও সমর্থন করি। তবে সেক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। নতুন বা অপ্রতিষ্ঠিত প্রতিবর্ণীকৃত শব্দগুলির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক (পত্রিকা, টিভি, স্কুল, সরকার, ইত্যাদি) উদ্যোগ বা ব্যাকিং প্রয়োজন। শুধু বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগতভাবে অল্পকিছু লোক এসব চর্চা করতে গেলে এর কোনো ইম্প্যাক্ট পড়বে বলে মনে হয় না, বরং নিজেকেই ঝামেলায় পড়তে হবে এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো ব্যাক টু টিনের চশমা এ্যান্ড টিনের চোঙা হয়ে যাবে!
****************************************
এ নামগুলোর "বাংলা" নাম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমার দ্বিমত আছে। ডাকাত এসে গেরস্তের বাড়িতে জাঙ্গিয়া ফেলে গেলে সেটা গেরস্তের জাঙ্গিয়া হয়ে যায় না। বরং গেরস্ত সেটা পরে বা মাথায় বেঁধে ঘুরে বেড়ালে "লোকটার সমস্যা আছে" বলা যায় বড়জোর। বাঙালির দলে দলে অনিংরেজিভাষী অঞ্চল ভ্রমণ এবং সেগুলো নিয়ে ঘন ঘন লেখালেখি বলাবলি নিতান্ত সাম্প্রতিক ব্যাপার, কাজেই কোনো স্থান বা পাত্রের নাম সেগুলোর প্রেক্ষিতে চেনার জানার এবং চেনানোর জানানোর জানালাটা খোলা রাখা যেতে পারে। "মস্কো"তে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করি ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে আমরা সবাই কিছু ছাতা খুলি সায়েবদের মুখে বৃষ্টির কথা শুনে। এই মজ্জাগত (atavistic) গোলামিটা না পাল্টালে দুনিয়ায় "তাহাই সত্য যা রচিবে সায়েব" হয়ে থাকবে।
বাংলা ভাষায় পর্তুগীজ শব্দের আগমন রবার্ট ক্লাইভদের ছড়ি ঘোরানোর অনেক আগের কথা। তাই 'লিসবোয়াঁ' নামটি 'লিসবন' হবার ব্যাপারটি মনে হয় আগেই ঘটেছে।
আমি জানালা/দরজা বন্ধ করে রাখার পক্ষে না। তবে কলোনিয়াল প্রভুদের প্রভাবের বাইরে যেসব বিদেশী নামের বাঙালীকরণ ঘটেছে সেগুলো অমনটা বলার পক্ষপাতি। যথাঃ ইংরেজরা কুয়াঙচৌ-কে ক্যান্টন, শা'মেন-কে অ্যাময়, চঙচিঙ-কে টংকিং, নানজিঙ-কে নানকিং বানিয়েছিল। আমি এই পরিবর্তনগুলো গ্রহন করতে রাজি না। তবে, কারো প্রভাব থাকুক আর না থাকুক মার্কিন, বিলাত, ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসী প্রভৃতি নামগুলোকে বাংলা বলেই গ্রহন করতে চাই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রেফারেন্স ১
রোমান হরফে বাংলা বই উস্কে দিল বিতর্ক
রেফারেন্স ২
ইংরেজি অক্ষরে বাংলা বই প্রকাশ করে বিতর্কে মিত্র অ্যান্ড ঘোষ
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
বিদেশী শব্দ বা নাম, সেটা ইংলিশই হোক আর জার্মান, রাশান বা ফরাসীই হোক, বাংলা ভাষায় সেটা আত্তীকরনের ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে অনেকদিন ধরেই ইংলিশ ভাষার ব্যাবহার করতে করতে এখন তো তা আমাদের প্রায় মজ্জাগত হয়ে উঠেছে। এমনকি অনেক আরবী ফার্সী শব্দও ইংলিশ ঘুরেই আমাদের কাছে হাজির হচ্ছে। মজার ব্যাপার হল, বেশ কিছু ভারতীয় শব্দেরও এখন এমনভাবে ইংলিশীকরন হয়ে গেছে যে সাধারনভাবে আমরা তা বুঝতেও পারি না। এতে অসুবিধা কতটুকু আছে বুঝতে পারছি না, কিন্তু এতে এক ধরনের আমোদের বন্দোবস্থ নিশ্চিতভাবেই আছে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের অনেক নাম ও পদবীর ইংলিশীকরনের ফলে যে একটা অবস্থা হয়েছে, সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে হাসাহাসির একটা উপলক্ষ হতে পারে অনায়াসে।
তুর্কী হেতিজা যে আসলে আরবী খাদিজা, সেটা জেনে চমৎকৃত হলাম। তুর্কী হাতুনও যে আসলে আরবী খাতুন, সেটাও বোঝা যাচ্ছে, আচ্ছা, এ ক্ষেত্রে হাতুনটা হেতুন না হওয়ার রহস্য কী?
খাশোগজিকে খাশোগি অবশ্য আমরা বহুদিন থেকে, অর্থাৎ জামালের বাবা আদনানের আমল থেকেই বলে ও শুনে আসছি। তখন এ নিয়ে কথা তো ওঠেই নি, এমনকি আমরা জানতেই পারি নি যে আদনান খাশোগি আসলে আদনান খাশোগজি। পৃথিবীর প্রতিটি আলাদা আলাদা ভাষার এক একটি শব্দকে সঠিকভাবে প্রতিবর্ণীকরন করার মত যথেষ্ট উন্নত জাতি হিসেবে আমরা বোধ এখনও গড়ে উঠি নি, কিন্তু এখন কেউ কেউ জামালকে খাশোগজি হিসেবে অভিহিত করায় এটা কি বলা চলে যে আমাদের একটি সঠিক পথের সূচনা হচ্ছে?
আদনান জামালের বাপ না, চাচা।
- টুইটারে বা উইকিতে তার নাম আরবীতে লেখা আছে 'جمال خاشقجي'। আরবী উচ্চারণে তাহলে নামটা দাঁড়ায় 'জামাল খ্বাসুকজী'। আরবী বর্ণ 'ق'-এর উচ্চারণ বাংলায় 'ক' হবার কথা, 'গ' নয়। উত্তর আফ্রিকার আরবেরা 'ج'-এর উচ্চারণ 'গ'-এর মতো করে বলে তারা 'জামাল' না বলে 'গামাল' বলবে, কিন্তু 'ق' = 'ক'। তাহলে বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে তার নাম 'জামাল খ্বাসুকজী'-ই কি সঠিক হয় না?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
"বড় কাফ" এর উচ্চারণ সৌদি এলাকায় মনে হয় গ-ই। এখানে দেখুন।
জামালের দাদা হালিৎ খাশুক্চু তুর্কি। নামটায় পরে সৌদি চুনকাম লেগেছে মনে হচ্ছে।
এটাকে মনে হয় গ্রামবাংলায় 'ছোট কাফ' বলে। যাকগে, ছোট/বড় যা-ই হোক, এর উচ্চারণের ব্যাপারে উইকি যা বলেছে সেটা যদি সঠিক হতো তাহলে সৌদি আরবে রাসুলের বংশ 'قريش'-কে 'গুরাঈশ' উচ্চারণ করার কথা। এক্ষেত্রে উইকির ভাষ্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি।
তুর্কি 'চামচ বানানেওয়ালা' বা 'চামচওয়ালা' আরবে গিয়ে কী কী হতে পারে অত দূর এলেম আমার নাই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ছোটো কাফ এটা না? ক/গ ভেজালটা গাদ্দাফির নাম নিয়েও আছে।
আমার দেখা মতে, ق = ছোট কাফ (ক) আর ك = বড় কাফ (ক্ব)। এলাকাভেদে 'ক্বায়দা বাগদাদী' পড়ানো হুজুরেররা মনে হয় কোনটা বড় আর কোনটা ছোট সেটা হেরফের করে থাকেন।
আমরা যাকে গাদ্দাফি বলি তার নামের বানান হচ্ছে معمر محمد أبو منيار القذافي = মুয়াম্মার মুহাম্মাদ আাবু মিনইয়ার আল-কাজাাফি। তবে দেখতে পাচ্ছি 'ذ'-এর উচ্চারণ লিবিয়া এলাকায় 'দ'-এর মতো। সেক্ষেত্রে ওদের উচ্চারণটা 'কাাদাফি' ধরনের হবার কথা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পারস্য লিপির "গাফ" এর সাথে ك গুলিয়ে ফেলছেন না তো? এই কাফের ছোটো বড় খাতে আরবি স্যারের হাতে বহুৎ মাইর খাইছি। আবার খতিয়ে দেখেন। এত্তগুলি বেতের বাড়ি আজকে হালাল হয়ে গেলে তো সমিস্যা।
আজকে এর একটা হেস্তনেস্ত করার চেষ্টা করা যাক।
আরবী, নাস্তালিক, নাস্খ, শাহ্মুখী লিখন পদ্ধতিগুলোতে প্রতিটা বর্ণের কমপক্ষে চারটা রূপ থাকে — স্বাধীন, শব্দের শুরুতে, শব্দের মাঝখানে, শব্দের শেষে। লিখন পদ্ধতি যাই হোক, আরবী বর্ণের উচ্চারণ আরব দুনিয়ার খানবিশেক দেশের শ’খানেক জাতির মধ্যে ব্যাপক হেরফের হয়। এর প্রমিত উচ্চারণ বলে কিছু নেই। কারণ, এক দেশের ভাষাপণ্ডিতদের ভাষ্য আরেক দেশের ভাষাপণ্ডিতেরা মানতে নারাজ। বিশেষত, এটা নিয়ে হেযাজীদের সাথে মাগরেবীদের মতদ্বৈততা পুরনো ব্যাপার। আরব দুনিয়ার বাইরের মুসলিম দুনিয়ায় উচ্চারণ যার যার ইতিহাস ও স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বাঙালী শিক্ষকদের উচ্চারণ ও পাঠপদ্ধতি গভীরভাবে উর্দু ও ফারসী প্রভাবিত। লক্ষ করলে দেখবেন, আমরা উর্দু/ফারসীর মত করে যের-যবর-পেশ বলি, আরবীর মত করে ফাত্হা-দাম্মা-কাস্রা বলি না।
ق (কাফ্/কফ্):
এটা আরবী বর্ণমালার ২১-তম বর্ণ, এর
স্বাধীন রূপ = ق
শব্দের শুরুতে = قـ
শব্দের মাঝখানে = ـق
শব্দের শেষে = ـق
এর উচ্চারণ দেশভেদে সাধারণত ক, ক্ক, গ হয়। এর বাইরেও কিছু উচ্চারণ আছে সেটা আমার পক্ষে দুরুচ্চার্য।
ك (ক্বাফ্):
এটা আরবী বর্ণমালার ২২-তম বর্ণ, এর
স্বাধীন রূপ = ك (নাস্তালিকেک)
শব্দের শুরুতে = كــ (নাস্তালিকে کـ)
শব্দের মাঝখানে = ـ ـكـ (নাস্তালিকে ـکـ)
শব্দের শেষে = ـك (নাস্তালিকে ـک)
এর উচ্চারণ দেশভেদে সাধারণত ক বা ক্ক হয়।
گ (গাফ্):
এটা পারসী বর্ণমালার ২৬-তম বর্ণ, এর
স্বাধীন রূপ = گ
শব্দের শুরুতে = گـ
শব্দের মাঝখানে = ـگـ
শব্দের শেষে = ـگ
এর উচ্চারণ সাধারণত গ হয়। ভাষাভেদে গাফের আরও কয়েকটা চেহারা আছে –
ک-এর উপরে এক নুক্তা ݢ
گ-এর নিচে খাড়া দুই নুক্তা ڳ
ک-এর উপরে তিন নুক্তা ݣ
ک-এর নাকে নোলক ګ
ک-এর মাথায় রেফ ࢰ ইত্যাদি।
ছোট নাকি বড়?
মনে করলে দেখবেন ছোটবেলায় বেশিরভাগ তালেবে ইলম্ م ل ك ق ف -কে ফে-কাপ-কাপ-লাম-মিম পড়ে যেতো। বেত উঁচিয়ে হুজুর বলতেন, ফা-কাফ্-ক্বাফ্-লাম-মিম। এখন এই কাফ্ আর ক্বাফ্-এর পার্থক্য বেতের বাড়ি খেয়েও তালেবে ইলম্দের মাথায় ঢোকে না। তাই এর স্থানীয় সমাধান হিসাবে অবস্থানে আগে থাকায় হোক বা সাইজে একটু ছোট দেখায় বলে হোক ق-কে ‘ছোট কাফ্’ আর অবস্থানে পরের ও আকারে বড় দেখায় বলে ك-কে ‘বড় কাফ্’ বলা হলো। তালেবে ইলম্দের কাছে দেখনদারীতে এর একটা সমাধান হলো বটে, তবে তাদের অধিকাংশের কাছে উচ্চারনটা বাংলা ‘ক’-এর মতই থেকে গেল। এখন দেশের কোন কোন স্থানে কোন কোন হুজুর যদি আগেরটাকে ‘বড় কাফ্’ আর পরেরটাকে ‘ছোট কাফ্’ বলে থাকেন তাহলে সেটাকে ভুল বলার কোন কারণ নেই। ছোট/বড় কেবল মনে রাখার একটা কৌশল মাত্র।
বেতের বাড়িগুলো ‘হারাম’ই থেকে গেলো!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
রহিস্যিময় কুয়ান্টাম ক।
ভালো কথা মনে করিয়েছেন। কবিতাখেলাপী পেশাদার কবি খেলায়েত খাঁ অনেক দিন ধরে গায়েব। হোসনে বিবি তাকে আবার গুম-টুম করে ফেললো নাতো!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নতুন মন্তব্য করুন