ছত্রাকের দৃশ্যমান অংশ দেখে টের পাওয়া যায়, আক্রান্ত অংশের কোথায় কতটুকু পুষ্টি আছে, কিংবা কোথায় নিয়মিত রোদ পড়ে। ভাষাও তেমনই, যেখানে তার পুষ্টির সংস্থান হয়, সেখানে সে বাড়ে, আর প্রবল বাধার মুখে শুকিয়ে যায়। আজ মহাকাশে নভোযানে চরিত্রদের গুঁজে দিয়ে জমজমাট কোনো কল্পবিজ্ঞান গল্প লিখতে গেলে কয়েক চরণ লেখার পরই হাত বাড়াতে হবে ইংরেজির ভাঁড়ারের দিকে, একটা দুটো শব্দ টোকানোর জন্যে। মহাকাশে বাংলা ভাষার পুষ্টির অভাবই এখানে একমাত্র কারণ নয়, মহাকাশ-সংক্রান্ত আলাপে বাংলা চর্চাও ইংরেজির রোদের আঁচে শুকিয়ে গেছে। পাঠক, আপনার পছন্দের পাঁচটি মহাকাশে-ঘটা গল্প নিয়ে লেখা বাংলা কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস খুলে ইংরেজি শব্দগুলো রাঙুনিতে* রাঙিয়ে নিয়ে অবস্থা যাচাই করে দেখতে পারেন।
রাঙুনি = মার্কার, হাইলাইটার। প্রয়োজনই উদ্ভাবনের প্রসূতি।
এখানে প্রশ্নটা বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার। লেখক চান না "বিদঘুটে" কোনো বাংলা শব্দ দিয়ে তাঁর পাঠককে বিচলিত করতে (শব্দটা বিদঘুটেতম ইংরেজি হলে কিন্তু সব ফকফকা, কোথাও কোনো সমস্যা নেই), তাই শব্দভাণ্ডার বাড়ে না, আবার শব্দভাণ্ডার সীমিত বলে পাঠকও নতুন শব্দপ্রাপ্তিকে সহজভাবে নিতে পারেন না। এভাবে পাঠক-লেখক পরস্পরের হাতে হাত ধরে মহাকাশে বাংলাকে বানানো-বেঁটে* বটগাছ করে রাখছেন। মহাকাশ থেকে আছড়ে মাটিতে নামিয়ে আনলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে না; খোদ বিভূতিভূষণও চাঁদের পাহাড় লিখতে গিয়ে ভৌগোলিক বর্ণনায় ইংরেজি এড়াতে পারেননি। প্রোফেসর শঙ্কু পর্যন্ত বাংলা হরফে লেখা নিম-ইংরেজি গল্প; বাংলা সেখানে প্রহ্লাদ আর অবিনাশবাবু হয়ে পেছনে চলে, বেড়াল নিউটন থেকে বন্ধু ক্রোল-সন্ডার্স সবাই সেখানে সায়েবি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা এদিক থেকে বেশ ব্যতিক্রমী; চুয়াল্লিশ বছর ধরে ঘনাদা পৃথিবীর বুকে ও বাইরে নানা কাণ্ড ঘটিয়েছেন বহুলাংশে বাংলায়। একেবারে ইংরেজির ছিটে লাগেনি ঘনাদার গায়ে, এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু ধারে আর ভারে ঘনাদা-বর্ণনা তুলনারহিত।
বানানো-বেঁটে = বনসাই। প্রয়োজনই উদ্ভাবনের প্রসূতি, কয়েছিলুম কি না?
স্থান ছেড়ে যদি কালের এ মাথা থেকে ও মাথায় যাই, অতীত- বা ভবিষ্যচ্চারী গল্প লিখতে গেলেও আমরা একই সমস্যায় পড়বো, কারণ আমাদের বর্তমানে গেরো আছে। অনূদিত গল্প-উপন্যাসে বাংলার অতীত- বা ভবিষ্যচ্চারণায় কমজোরির ব্যাপারটা সবচে স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রাচীন সামন্তকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে লেখা গল্পে যদি কোনো "ডিউক অফ তমুক" থাকে, চর্চার অভাবে একে বাংলায় বোঝানো দুঃসাধ্য (যেমন, এডিনবরার ভূঁইয়া বললে পাঠক হয়তো হাসতে হাসতে কাপড় ময়লা করে ফেলবেন, যদিও বাংলার ভূঁইয়ারা ডিউকই ছিলেন; কিন্তু ভূঁইয়ার মধ্যে ডিউকের সেই ইয়েটা কি আর পাওয়া যায়?)। জার্মান-ফরাসি-ইংরেজির মাঝে পরস্পর অনুবাদে এ সমস্যা নেই, যেহেতু ইয়োরোপে সামন্তব্যবস্থা কমবেশি অভিন্নচরিত্রের ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগের নাম আমরা জানি, কিন্তু হার্টগ শব্দটা হয়তো যথেষ্ট কৌতূহল আমাদের মাঝে জাগাতে পারেনি। ওলন্দাজ হার্টগ বা জার্মান হের্ৎসগের অর্থ সেই ভূঁইয়া, ডিউক। আবার যদি অতীত ফেলে "ভবিষ্যতে" যাই, মার্টি ম্যাকফ্লাইয়ের হোভারবোর্ডকে আমরা বাংলায় কীভাবে লিখবো বা বলবো? যা-ই বলি, প্রথম ধাক্কায় রসভঙ্গের সম্ভাবনা প্রবল। আর হোভারবোর্ডই যদি রেখে দিই, তাহলে বাংলা অনুবাদের দরকারটাই বা কী?
বাংলা গল্পে রোমাঞ্চরস (থ্রিল) বা উচ্চাটনরস (সাসপেন্স) যোগ করার জায়গাগুলোয় এসে বাংলা শব্দগুলো যদি খাপছাড়া শোনায়, এর অর্থ দাঁড়ায়, আমরা জীবনের ম্যাড়মেড়ে আলুনিভরা অংশটা বাংলায় যাপন করে নুন-মশলার জন্য ইংরেজির কাছে হাত পেতে আছি। ফলে যখনই রোমাঞ্চ-উচ্চাটনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে সায়েবি আয়োজনের অভাব চোখে পড়ে, আমরা সেটাকে ম্যাড়মেড়ে আলুনির সাথে সমীকৃত করে নাক সিঁটকাই। আমাদের দেশে এখনও পুলিশি বা আধাসামরিক/সামরিক অভিযানগুলোর নাম "অপারেশন সায়েবিশব্দ" কাঠামোয় রাখা হয়। দেশি বাহিনী গিয়ে দেশি বিটকেল প্যাঁদাচ্ছে, সে খবর দেশের লোকই পড়ছে-শুনছে, সায়েবি শব্দ এখানে কেন আসে কে জানে? যদি এসবের রাখা হতো "ধরতক্তা অভিযান" বা "মারপেরেক অভিযান", কিংবা আরেকটু কাব্যিক "অগ্নিমন্থন অভিযান" কিংবা "ঘূর্ণিবায় অভিযান", আদৌ কি কোনো সমস্যা হতো? সায়েবদের যদি সেসব জানানো খুব আবশ্যক হয়, তাহলে সায়েবিভাষী সাংবাদিকরা এসব অনুবাদ করে বন্ধনীর ভেতরে গুঁজে দিলেই তো পারেন। আজ নরওয়ে বা জাপানে কোনো পুলিশি/সামরিক অভিযান হলে তারা কিন্তু নিজ ভাষাতেই সেগুলোর নাম রাখবে, কারণ তাদের রইসপনা ইংরেজি ছাড়াই চর্চিত। এখানেও সেই বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার প্রশ্ন, কোনো বড়কর্তা অভিযানের শিরোনাম বাংলায় রাখার স্পর্ধা দেখাবেনই বা কেন?
কিন্তু এর পেছনে কি ভাষার লিখিত রূপেরও খানিকটা অবদান নেই? বাংলায় সবচে জবরদস্ত সশস্ত্র চরিত্র সম্ভবত মাসুদ রানা। প্রিয় কাজীদা বাঙালিকে চরবৃত্তির জগতে বাস্তবে না হলেও গল্পে অন্তত ধুন্ধুমার সব কাণ্ড ঘটানোর সুযোগ করে দিয়েছেন, পরিচিত অনেক সামরিক ও আইনপ্রযোক্তা* বাহিনীর কর্তারা মাসুদ রানা পড়ে বড় হয়েছেন, এবং কেউ তাদের বাহ্যরূপ বা কাজের সাথে মাসুদ রানার তুলনা দিলে তারা বেশ তৃপ্তি পান। মাসুদ রানার হাতে প্রচুর সুযোগ ছিলো বাংলা শব্দে রোমাঞ্চরস বা উচ্চাটনরস সঞ্চার করার। কারাতের শুতো-উচিকে ইংরেজি চপের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে কাজীদা অন্তত আমাকে "রদ্দা" চিনিয়েছেন, একইভাবে আরও অনেক শব্দকে বাংলার গণ্ডির ভেতরে এনে অন্তত তিন প্রজন্মের পাঠককে আত্মবিশ্বাস যোগানো যেতো। হয়তো "ধ্বংস পাহাড়" বা "ভারত নাট্যম"-এ পাঠক একটু ঘ্যানঘ্যান অনুযোগ করতো, কিন্তু "অকস্মাৎ সীমান্ত" নাগাদ এসে সবাই মুগ্ধচিত্তে সমর্পণ করতো সে শব্দমালার কাছে। আজ সামরিক/আধাসামরিক/অসামরিক বাহিনীর যে বড়কর্তারা অভিযানের নাম রাখেন বা অনুমোদন করেন, তাঁদের কৈশোর রঞ্জিত থাকতো মাসুদ রানার স্পর্ধা আর দুঃসাহসে, এমন অনুমান হয়তো ভুল হবে না; বাংলা শব্দও হয়তো আজ তাদের আত্মবিশ্বাসী মনে ভর করে বাস্তবে ডানা মেলতো।
*প্রয়োগকারী শব্দটা অকারণে লম্বা করা হয়েছে, সঠিক আঁটসাঁট শব্দটি হচ্ছে প্রযোক্তা। ক্রিয়ার সাথে অকারণে -কারী বসিয়ে এরকম আরও কিছু শব্দকে লম্বা করে কাগজ- ও কালিবণিকের উপকার করা হয়েছে; যেমন অপহরণকারী নয়, শব্দটা অপহর্তা; মধু-আহরণকারী নয়, মধু-আহর্তা (মৌয়াল বললেই চলে)।
নিজের ভাণ্ডার খুলে আত্মচর্চায় আত্মবিশ্বাসের এ অভাবটা সায়েবরা ভারতবর্ষ ছাড়ার পর থেকেই কিন্তু স্পষ্ট। "পুলিশ" শব্দটায় সেটা বেশ স্পষ্ট। ভারতভাগের পর একটা আলাপ চালু ছিলো, পুলিশ শব্দের বাংলা হিসেবে "আরক্ষা বাহিনী / আরক্ষক" রাখার। কিন্তু ইংরেজ-পুলিশের-মার-খাওয়া জনতা দেশি "আরক্ষক"কে পাত্তা দেবে না, এমন অজুহাতে পুলিশকে পুলিশই রেখে দেওয়া হয়েছে। তারপর অনেক চন্দ্রভূক অমাবস্যা এলো-গেলো, এ অবস্থান থেকে আমরা সরতে পারিনি। যদি এখনও বাঙালিকে সায়েবি শব্দের ভয় দেখিয়ে সোজা রাখতে হয়, নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এ আত্মোপলব্ধি আসা জরুরি: আমরা ঠিক কাজটা করছি না। সম্প্রতি পুলিশ শব্দের একটি বিকল্প বাংলা শব্দ দেখলাম, জনপাল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে সীমান্তরক্ষক অর্থে "অন্তপাল" উল্লেখ আছে, জনপাল সে ছন্দে বেশ লাগসই শোনায়। বাস্তবের বাংলাভাষী দুনিয়ায় হয়তো পুলিশ টিকে যাবে, অনুবাদ বা মৌলিক রচনায় জনপাল বাড়তে পারে অনায়াসে।
অবশ্য বাঙালি পুলিশ শব্দটার বাংলা বিকল্প নিজের মতো করে খুঁজে নিয়েছে, ঠোলা। পাখির খাঁচায় পাখিকে দানাপানি দেওয়ার ছোট্টো পাত্রটির নাম ঠোলা, এর সাথে পুলিশের সংযোগ খুঁজে পাওয়া ভার। সিলেটে স্কুলপড়ুয়ারা পুলিশকে দূর থেকে "কনাই" ডেকে খেপিয়ে এদিক-সেদিক দৌড় দিতো এককালে; কে জানে এর মানে কী?
যদি আরেকটু খতিয়ে দেখি, প্রশাসনিক আমলাদের পদের নামগুলো কমবেশি শ্রুতিমধুর বাংলায় রাখা গেছে, সম্ভবত সেগুলোর ইংরেজি সংস্করণগুলো সংক্ষিপ্ত বলে। জয়েন্ট সেক্রেটারির বাংলা যুগ্মসচিব শুনতে চমৎকার। কিন্তু জনপাল প্রশাসনে ইংরেজ আমলে সেই ১৮৬১ সালের ভারত আইনের আওতায় রাখা পদগুলো কমবেশি রেখে দেওয়া হয়েছে (সায়েবের দেশের পুলিশে কিন্তু এসব পদের নামগন্ধও খুঁজে পাবেন না, ওখানে সব অন্যরকম; এগুলো কালা আদমিদের জন্যে)। একুশে ফেব্রুয়ারি নাগাদ আমাদের মাতৃভাষা/রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে কাপড়ের নাজুক স্থানে সেলাই পরীক্ষা করার বেগ বাড়ে বলে অনেক কিছু বাংলা ভাষায় করার ব্যাপারে অনেকে সাশ্রুনয়নে অনেক কিছু বলেন। মূলত যা করা হয়, তা হচ্ছে ইংরেজি শব্দ থেকে Calque বা ঋণানুবাদ। ইংরেজিতে জয়েন্ট আছে? যুগ্ম করে দাও। সেক্রেটারি আছে? সচিব করে দাও। এ প্রক্রিয়ায় অ্যাডিশনাল ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পোলিসের বাংলা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ উপমহাপরিদর্শক। এ পদটা মুখে বলতে বলতেই চোর গেরস্তের সিন্দুক ফাঁকা করে পালিয়ে যাবে বহুদূর। বাস্তবে কেউ কি আদৌ মৌখিকভাবে এটা ব্যবহার করেন, নাকি অ্যাডিশনাল ডিআইজি বলে কাজ চালিয়ে দিতে উৎসাহ পান? যদি প্রথমাংশের উত্তরে না আর শেষাংশের উত্তরে হ্যাঁ বলি, তাহলে সম্ভবত বাংলা সংস্করণটা খাতায় ঠিক দেখালেও হাতায় বেখাপ্পা।
গল্পের রস বাস্তব থেকেই আসে, যেভাবে বাস্তবের রস যোগায় গল্প। ধরা যাক, একটি কাল্পনিক জগৎ বা নগরে ইতিবাচক নায়কোচিত চরিত্রে জনপালকর্তারা আছেন। ধরা যাক সেখানে জনপাল বাহিনীর একটি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত আছেন কোনো এক চরিত্র, তার নাম (উদাহরণের খাতিরে) ঠুকেমারি, তাঁর পদটি মোটামুটি অতিরিক্ত পুলিশ উপমহাপরিদর্শকের সমতুল্য। তিনি আবার দায়বদ্ধ আরেক জনপালকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মুখেমারির কাছে। গল্পটা কিন্তু এ দুই পদের নামের ওজনেই ঝুলে পাতালে নেমে যাবে। গল্পে বাস্তবের ছোঁয়াচ থাকবে, কিন্তু রসহানি ঘটবে, কারণ বাস্তবই এখানে শব্দরসবর্জিত। লেখক তখন বাধ্য হয়ে গল্পের জগতে জনপালপ্রশাসনকে নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হবেন। বাস্তব বাংলায় জনপালপ্রশাসনের মধ্যমস্তরে কর্তাদের পদের নামগুলো "সুপারিন্টেন্ডেন্ট/সুপার" শব্দটি বীজশব্দ হিসেবে ব্যবহার করে এর গোড়ায় তিনটি উপসর্গ জুড়ে সাজানো, আর উচ্চস্তরে বীজশব্দ হিসেবে আছে "ইন্সপেক্টর জেনারেল", সঙ্গে তিনটি উপসর্গ। মধ্যমস্তরের জনপালকর্তারা মূলত কর্ম সম্পাদনের দিকটা দেখভাল করেন, উচ্চস্তরে পরিকল্পনা আর দিকনির্দেশনাই মুখ্য। এ মূল ব্যাপারটা কাল্পনিক জগতে অক্ষুণ্ন রেখে বীজশব্দ হিসেবে দুটি আনকোরা নতুন শব্দ প্রণয়ন করা যায়: মধ্যমস্তরের জন্যে "কর্মা" আর উচ্চস্তরের জন্যে "কল্পক"। সে গল্পজগতে প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে একজন যুবক কর্তা বা যুবতী কর্ত্রী জনপালবাহিনীতে যোগ দেবেন সহকর্মা পদে, তারপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে উপকর্মা, কর্মা এবং অধিকর্মা হবেন (রবি ঠাকুর সুপারিন্টেন্ডেন্টের বাংলা করেছিলেন অধিকর্মা)। ভাগ্য ভালো থাকলে তিনি আরও ওপরে উঠে সহকল্পক, উপকল্পক, কল্পক এবং অধিকল্পক* হবেন। সহকল্পক ঠুকেমারি সেখানে সমাচার ঠুকবেন কল্পক মুখেমারির কাছে। পদের নামগুলো এখানে ছোটো-কিন্তু-ধারালো, সেইসাথে অনায়াসোচ্চার্য। পদের সাথে যে সম্মান জড়িত থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি, সেটা গল্পের চরিত্ররা যে যার কাজ দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন।
*বাস্তব কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য খুঁজতে গেলে: সহকর্মা = সহকারী পুলিশ সুপার, উপকর্মা = জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার, কর্মা = অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অধিকর্মা = পুলিশ সুপার, সহকল্পক = অতিরিক্ত পুলিশ উপমহাপরিদর্শক, উপকল্পক = পুলিশ উপমহাপরিদর্শক, কল্পক = অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, অধিকল্পক = পুলিশ মহাপরিদর্শক।
যদি এ অংশটুকু খুব বেশি কষ্টকল্পনা মনে হয়, পাঠক স্বল্প আয়াসে বিভিন্ন দেশে জনপালপ্রশাসনে পদের নামগুলো খুঁজে দেখতে পারেন গুগলের শরণ নিয়ে; বিশেষ করে আরব বিশ্ব, ইসরায়েল, ইরান বা থাইল্যান্ডের জন্যে। দেখবেন যথাক্রমে আরবি, হিব্রু, ফারসি বা থাইতে এ পদের নামগুলো রাখা; ইন্সপেক্টর, সুপার বা কমিশনার শব্দগুলোর নামগন্ধও পাবেন না। সবচে বড় কথা, এতে এদের কাজকর্মে ব্যাঘাত বা জনমনে এদের গ্রহণযোগ্যতার অভাব ঘটছে না। এ দেশগুলোও আমাদের মতোই উপনিবিষ্ট ছিলো বহু বছর। স্বাধীনতা মানে শুধু বাস্তবের জমিন থেকে দখলদারের প্রস্থান নয়, মনের জমিন থেকেও; এ উপলব্ধি অন্তত শব্দের জগতে সেখানে প্রতিফলন পেয়েছে।
অসামরিক আইনপ্রযোক্তা বাহিনী অর্থে পুলিশ শব্দটা খুব পুরনো নয়, শ'দুয়েক বছর বয়স হবে। লন্ডন মেট্রোপলিটান পোলিস (সংক্ষেপে মেট) বাহিনীর প্রবক্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট পীল প্রস্তাবিত আইনে খুব সতর্ক ছিলেন, যাতে লোকে জনপালবাহিনীকে আধাসামরিক বাহিনী ভেবে তটস্থ না হয়, সেজন্যে পদের নামগুলো সামরিক পদ (লেফটেন্যান্ট, ক্যাপ্টেন ইত্যাদি) থেকে ভিন্ন ও দূরবর্তী (কনস্টেবল, সার্জেন্ট, ইনস্পেক্টর, চিফ ইনস্পেক্টর, সুপার, চিফ সুপার, কমান্ডার ইত্যাদি) রেখে প্রস্তাব করেছিলেন। আগে ইংল্যান্ডে জোড়াতালি দেওয়া জনপালবাহিনীর নাম ছিলো "ওয়াচ", জনপালদের বলা হতো ওয়াচমেন। টেরি প্র্যাচেটের ডিস্কওয়ার্ল্ড যারা পড়েছেন, তারা হয়তো টের পাবেন, "পুলিশ" শব্দটা ব্যবহার না করেও প্র্যাচেট কী অসাধারণ মুনশিয়ানায় আঙ্খ-মর্পর্ক নগরে ওয়াচের দিবা- ও রাত্রিবিভাগ নিয়ে এক দারুণ জমজমাট আবহ তৈরি করেছেন। ওয়াচ শব্দটার প্রাচীনত্ব সেখানে যেন বাড়তি রং-রস-রক্ত যুগিয়েছে। আজ আমরা যদি নিজেদের মধ্যযুগের দিকে তাকাই, দেখবো এককালে একাধারে প্রধান অন্তপাল ও জনপালের ভূমিকা পালন করতেন ক্যাস্টেলান বা কোট্টপাল। প্রাচীন বাংলা ও ভারতবর্ষে নগর আর দুর্গের সম্পর্ক আঁতঘেঁষা বলে ক্রমশ নগরে আইন এবং/অথবা শৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের কাজটি চলে আসে কোট্টপালের কাছে, যার পদটিকে আমরা কোটাল হিসেবে চিনি (পশ্চিম ভারতে গিয়ে এটি কোতোয়াল হয়ে গেছে)। রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র কোটালপু্ত্রের গল্পের কোটাল মূলত পুলিশ কমিশনার। আজ যদি মহানগর পুলিশপ্রধানকে আমরা বাস্তবে বা গল্পে কোটাল বলি বা লিখি বা ভাবি, লোকে হয়তো খ্যাখ্যা করে হাসবে। সে হাসির স্বরগ্রাম যতো উঁচু, আমাদের মনে উপনিবেশের শেকড় ততোটুকু গভীর। উপনিবেশের কাজ এটাই, মানুষের মনে তার আপন সবকিছু নিয়ে লজ্জা রোপণ করা। হাতে অঢেল রত্নমাণিক্য নিয়েও মনে মনে যে নিঃস্ব আর উলঙ্গ, একটা ফুলপ্যান্টের বিনিময়েই তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া যায়।
পটারবিশ্বে জাদুসমাজে পুলিশ হিসেবে যারা নিয়োজিত, জে কে রোলিং তাদের জন্যে নতুন একটি শব্দই প্রণয়ন করেছেন, অরর (Auror)। রোলিং তাদের পদকাঠামো আর বিস্তার করেননি, কিন্তু ঐ একটিই শব্দেই আভাস আছে, আমরা যেন গল্পের প্রয়োজনকে নতুন একটি শব্দ দিয়ে মোকাবেলা করতে পারি, বাস্তবের সীমাবদ্ধতার অজুহাতে অমীমাংসিত না রাখি। ইংরেজিতে পুলিশ বোঝানোর জন্যে বেশ কয়েকটি শব্দ খোদ ইংরেজের ইতিহাসেই আছে, আরো কয়েকটি আছে তাদের প্রতিবেশীদের ইতিহাসে, গল্পে কল্পজগতেও আছে কিছু বিকল্প। রোলিং তারপরও নতুন একটা শব্দ গড়তে পিছপা হননি। এর পেছনে আছে গল্পের প্রতি গল্পকারের বিরাট দায়। এ দায় যদি বাস্তবে দেখা দেয়, পূরণ করার জন্যে একটা নতুন শব্দ গড়তে আমরা যেন পিছপা না হই। বাস্তব শেষ পর্যন্ত সে গল্পটাই, যা আমরা সবাই মিলে লিখে চলছি; কলম সেখানে খাপে গুঁজে না রাখলেও চলে।
কোটালের কার্যালয়ের একটা চমৎকার নাম ইতিহাস ঢুঁড়লে পাওয়া যায়, চবুতরা (কবুতরের বাসা বা Dovecote)। পাখি যেমন বিপদের মুখে আশ্রয় খোঁজে জনপদের চবুতরায়, বিপন্ন মানুষও তেমনি কোটালের চবুতরায় হাজির হয়। এই হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলো বাস্তবে ফিরুক না ফিরুক, এর মাঝে যে ব্যঞ্জনা আছে, সেটা ফিরে আসুক আমাদের জীবনে আর গল্পে।
মন্তব্য
১৯৪৮-এর আগে ইসরায়েল রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্ব ছিল না; এবং ইসরায়েলের জন্মই হয়েছে উপনিবেশস্থাপঙ্কারী রাষ্ট্র* হিসেবে! ইসরায়েল (এবং ইরান ও থাইল্যান্ড) কবে কার উপনিবেশ ছিল?
*কলোনাইজার ষ্টেট-এর সহজে ঊচ্চার্য বাংলা কী হতে পারে?
থাইল্যান্ড কখনও কোনো ইয়োরোপীয় শক্তির উপনিবেশ ছিলো না দেখলাম, ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। ইরানকে সরাসরি আরব, তুর্কি আর মঙ্গোলদের দখলদারিত্বে যাওয়া দেশ বলা যায়, উপনিবেশ কি না সেটা নিয়ে তর্ক চলতে পারে।
ইসরায়েলসহ পুরো ট্র্যান্সজর্ডানই এককালে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিলো। আপনার যুক্তি ধরে বলতে গেলে, ১৯৭১ এর আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না, কাজেই আমরাও কারও উপনিবেশ ছিলাম না। একইভাবে ভারত বা পাকিস্তানও ছিলো না।
উপনিবেশ থেকে বের হয়ে কি কোনো দেশ উপনিবেশক দেশ হতে পারে না? পাকিস্তান তো পেরেছে। স্পেনের খপ্পর থেকে বের হয়ে হল্যান্ডও পেরেছে।
আমার প্রথম মন্তব্য পেশ করার পরে মনে হয়েছিল ইসরায়েলের প্রশ্ন অন্যভাবে উপস্থাপন করলে ভাল হত; যেমন মধ্যপ্রাচ্যের ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চার ধারা মোতাবেক ইসরায়েলকে উপনিবেশ হিসেবে ধরা যায় কিনা। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তর-ঔপনিবেশিক ইতিহাস পড়ে যতটুকু বুঝেছি, তাতে ইসরায়েলকে আসলে উপনিবেশ হিসেবে মনে করা হয় না (স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার এই বোধ যেসব ইতিহাসলেখকের লেখা পড়েছি, তাদের নিজস্ব মতাদর্শ এবং সহানুভূতি দ্বারা প্রভাবিত; এবং প্যালেস্টাইন-ইসরায়েলের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তথ্যের চেয়ে তথ্য-ব্যাখ্যাকারির ভূমিকা হয়ত বেশী গুরুত্বপূর্ণ)। যাই হোক, বাংলা ভাষা এবং শব্দ-সংক্রান্ত এই পোস্টে ইসরায়েল (এবং প্যালেস্টাইন)-এর প্রসঙ্গ নিয়ে বেশী কথা বলা মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক।
উত্তর-উপনিবেশবাদী গবেষণার একটা বৈশিষ্ট্য (স্বেচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত - তা পরিষ্কার নয়) লক্ষণীয়ঃ দখলকারী শক্তি/জনগোষ্ঠী ইউরোপীয় এবং/অথবা শ্বেতাঙ্গ এবং দখলকৃত ভূমি/জনগোষ্ঠী অ- ইউরোপীয়/অশ্বেতাঙ্গ না হলে উত্তর-উপনিবেশবাদী গবেষকেরা তা নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখান বলে আমার মনে হয়নি। যেমন, মুঘলরা বাংলা দখল করেছিল ১৫৭৮ সালে, অথচ বাংলার ঔপনিবেশিক ইতিহাস গবেষণার সূচনাবিন্দু ১৭৫৭ সাল!
মুঘলদের ক্ষেত্রে তার একটা কারন হয়তো এই যে মুঘলরা পৃথক কোনো দূরদেশ থেকে ভারত শাসন করেনি, সম্পদ চুষে নিয়ে সেই দুরদেশে পাচার করেনি এবং শেষমেশ সেখানেই ফিরে যায়নি - তাদের জন্য ভারতবর্ষ "উপ"-নিবেশ ছিল না, এটাই তাদের "প্রধাণ-নিবেশ" বা "একমাত্র-নিবেশ" তথা স্বদেশ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা "ঔপনিবেশিক" শক্তি বা শাসক থাকেনি। এমনটা হতে পারে হয়তো।
****************************************
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে না হয় বুঝলাম কেন মুঘলদের "ঔপনিবেশিক" বলা যায় না; কিন্তু বাংলার সম্পদ কি তারা দিল্লিতে পাচার করেনি? আকবর থেকে আওরঙ্গজেব সারা জীবন যে যুদ্ধ করে গেলেন, সেই যুদ্ধের খরচ কিভাবে মেটানো হত?
আপনার যুক্তি মানলে যে কোন দেশের রাজধানীভিন্ন অন্য যে কোন এলাকা রাজধানীর উপনিবেশে পরিণত হয়। যথা, ভারতের সব রাজ্য নয়া দিল্লীর উপনিবেশ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব রাজ্য ওয়াশিংটন ডিসি'র উপনিবেশ। কারণ 'রাজস্ব' আদায়ের নামে এই রাজধানীগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের অন্য এলাকাগুলোকে শোষণ করে সম্পদ 'পাচার' করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক দশক ধরে চালানো যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর খরচ তো সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই নেয়া হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মোগলরা প্রজাকল্যাণ সাধনের জন্যে নিশ্চয়ই যুদ্ধ করে বাংলা দখল করেনি। করেছে খাজনার লোভেই। অন্যান্য দেশে খাজনার গন্তব্য নিয়ে খাজনাদাতার মতের খানিক মূল্য দেওয়া হয় বলে "উপনিবেশ" বলা যায় না। আগিলা দিনে দেশ দখল করে বা অঙ্গীভূত করে উপনিবেশের সামন্ত রূপটিরই কি চর্চা করা হতো না? উপনিবেশ বলতে আমরা সাধারণত যেটা বুঝি, উপনিবেশকের পণ্যের বাজারের একচেটিয়া সম্প্রসারণ এবং কাঁচামালের একচেটিয়া সংগ্রহের এলাকা, সেটা খাটে শিল্পবিপ্লবোত্তর যুগের ক্ষেত্রে।
আর মোগলরা বাংলায় "রয়ে" যায়নি। তাদের থানা বরাবরই দিল্লি থেকে আগ্রা। অঙ্গীভবনের পর মোগল দরবারে বাংলার "প্রতিনিধি"রা সংখ্যায় কেমন ছিলো, সে বিশ্লেষণও মনে হয় দরকার।
ষষ্ঠ পাণ্ডবের মন্তব্যের পিঠে যা বলতে চেয়েছিলাম (যেমন, প্রতিনিধিত্বভিত্তিক শাসন এবং রাজস্বব্যবস্থা), তা দেখলাম আপনি বলে দিয়েছেন! যাই হোক, বাংলায় মোগল দরবারের প্রতিনিধি (সুবাদার, নায়েব নাজিম, প্রমুখ)-র সঙ্গে ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল অথবা ভাইসরয়ের কোন মৌলিক, গুণগত পার্থক্য ছিল বলে আমি মনে করি না।
‘উপনিবেশ’-এর সংজ্ঞা যদি হিমুর ভাষ্য অনুযায়ী শিল্প বিপ্লবের আগে আর পরে অনুযায়ী ভাগ করে ফেলি এবং ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের শাসনের আগে এক শাসক কর্তৃক আরেক শাসককে উৎখাত করে রাজ্য (ক্ষেত্রফল নির্বিশেষে) দখলের মাধ্যমে সামন্ত প্রভুর পরিবর্তনকে ‘উপনিবেশ’ স্থাপন বলি তাহলে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের আগে বাংলাদেশের ইতিহাস ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস। হাজার দুই বছর আগে দেশ যখন শুঙ্গ, কাহ্ন ইত্যাদি রাজবংশগুলোর শাসনাধীন ছিল দেশ তখনও কেন্দ্রীয়ভাবে ‘বিদেশী’দের আওতায় ছিল। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এমন বহিরাগত তকমা পরের দুই হাজার বছর ধরে বা আগের দুই হাজার বছরে শাসন করা সবার গায়ে লাগানো যাবে। আর স্থানীয় সামন্তদের মধ্যকার খেয়োখেয়ি বিবেচনায় নিলে ‘শাসন মানেই বহিরাগতের শোষণ’।
মুঘলরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছে একথা সত্য। তাদের সাম্রাজ্য জুড়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপরের দিকের পদগুলোতে তুর্কীস্তানী/তুর্কী কাকারা বা পারসী/রাজপুত মামারা ছিল। এই প্রকার নিয়োগের পেছনের কারণ কুখ্যাত মুঘল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সংস্কৃতি। এই মামা-কাকারা ব্যাপক হারে লুটপাট করেছে এবং নিজেদের সুবিধা মতো জায়গায় নিয়ে আয়েশের বন্দোবস্ত করেছে। ফুর্তিফার্তা কেবল দিল্লী-আগ্রাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। মামা-কাকারা যে পরিচয়ে নিয়োগ পেয়ে থাকুক না কেন শেষমেশ ভারতীয় হয়ে গেছে।
আমি দেখি, হাজার হাজার বছর ধরে এদেশ শাসন-শোষণ করে গেছে ছোটবড় ডাকাতের দল। ছোট ডাকাতেরা সাধারণ নাগরিকদেরকে লুট করে রাজস্বের নামে বড় ডাকাতদের মাসোহারা দিয়ে গেছে। বড় ডাকাতরা আরও বড় ডাকাতদের মাসোহারা দিয়ে গেছে। এইসব ডাকাতেরা নিজেদের জন্য বড় বড় প্রাসাদ বানিয়েছে, নিজেদের পরকাল গোছানোর উদ্দেশ্যে সুরম্য উপাসনালয় বানিয়েছে। আমরা সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেখে নিজেদের ঐতিহ্য ভেবে গদগদ হই। এইসব ডাকাতরা কোন ঊচ্চ বিদ্যায়তন বানায়নি, চিকিৎসালয় বানায়নি, গবেষণাগার বানায়নি। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করেনি। জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, জননিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা, সার্বজনীন শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে ভাবেনি। জনগণ কেবল শোষণ আর অত্যাচারের শিকার হয়েছে। সামন্ততন্ত্র বলি, দেশী/বিদেশী রাজতন্ত্র বলি, ঔপনিবেশিক শাসন বলি – আমি কেবল অনিঃশেষ ডাকাততন্ত্র দেখতে পাই।
অন্য দেশের নাগরিক (দ্বিতীয়/তৃতীয় পাসপোর্ট) বা পারমানেন্ট রেসিডেন্ট ভিসাধারী, বিদেশে বাড়িঘর বানানো টাকাপয়সা সরানো, পড়াশোনার নামে বাচ্চাকাচ্চা বিদেশে স্থায়ীভাবে পাঠিয়ে দেয়া, বাচ্চাদের দেখাশোনার নামে স্ত্রী/স্বামীকে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া নেতা-আমলা’র সংখ্যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শতকরা হারে কতজন হবে? লুট করে নিয়ে ভেগে যাওয়া তো এখনো চলছে!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ইসরায়েল একটি 'নির্মিত' রাষ্ট্র। এর সাথে দুনিয়ার আর কোন রাষ্ট্র তুলনীয় নয়। এখানে অনেক কিছুর সাথে এর ভাষাটাকেও নতুন করে 'নির্মাণ' করা হয়েছিল।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
উপনিবেশকদের ছেড়ে যাওয়া জমিনে গজানো প্রতিটি দেশই নির্মিত রাষ্ট্র। ভারতবর্ষ ছাড়ার সময় ইংরেজ দেশটিকে সাড়ে পাঁচশো টুকরো করে রেখে গিয়েছিলো, "হিন্দুস্তান", "পাকিস্তান" এবং "প্রিন্সিস্তানস"। পোকায় খাওয়া পাকিস্তান নিয়ে জিন্নাহ কান্নাকাটি করলেও মূলত পুরো ভারতবর্ষই তা-ই ছিলো, নেহরু মাউন্টব্যাটেনের আনুকূল্যে এবং বল্লভভাই প্যাটেলের লৌহমুষ্ঠির কল্যাণে প্রিন্সিস্তানগুলোকে ভারত রাষ্ট্রে একীভূত করেন বলে আজকের নিরবচ্ছিন্ন ভারতের চেহারা আমরা দেখতে পাই। আফ্রিকার দেশগুলো দেখুন, অক্ষরেখা বা দ্রাঘিমাংশ বা পর্বতমালা বা নদী ধরে বাঁটোয়ারা করে রেখে গেছে উপনিবেশকরা, জনসীমানার তোয়াক্কা না করে। সেটার খেসারত ফোঁপরা উপনিবিষ্টেরা দিয়ে যাচ্ছে বছর বছর একে অন্যের সাথে লড়ে আর সে লড়াইয়ে লড়াইবাঁধানোরমূলকারিগর উপনিবেশককে মুরুব্বি মেনে।
ভারতবর্ষকে ইংরেজরা সাড়ে পাঁচশো টুকরো করে রেখে যায়নি, দেশটা আগে থেকেই অমন ছিল। ঐ টুকরো টুকরো ভারতবর্ষে এখনকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অবাধ চলাচল, সহজ মুদ্রা বিনিময় (অভিন্নের পরিবর্তে), অবাধ অভিবাসন, অবাধ কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল। ইংরেজরা প্রথম গোটা ভারতবর্ষকে এক কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনে। র্যাডক্লিফ আর তার ভায়রা ভাইরা মিলে সাবেক ঔপনিবেশিক দুনিয়ার মানচিত্রকে ছুরি দিয়ে কীরকম ফর্দাফাই করেছে সেটা আমরা জানি। সেটার সাথে ইসরায়েল দেশটার কী পার্থক্য সেটাও আমরা জানি। সেট-স্কয়ার দিয়ে আঁকা চেহারার পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বাইরের দুনিয়া থেকে 'ধর্ম' বিচার করে মানুষ জড়ো করে এনে বসানো হয়নি, বাইরে থেকে পুঁজি, জনশক্তি এনে সব গড়ে তোলা হয়নি।
একটু লক্ষ করলে দেখতে পাবেন আফ্রিকার দেশগুলোর বড় অংশ আসলে এখনো উপনিবেশ রয়ে গেছে। সেখানকার খনি, উর্বর জমি, সমৃদ্ধ বন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির আসল মালিক সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা। তাদের সশস্ত্র বাহিনীগুলো নানা নামে, নানা কায়দায় সেখানে উপস্থিত আছে। সেখানে দেশে দেশে যুদ্ধের চেয়ে গৃহযুদ্ধের পরিমাণ বেশি। কর্তারাই সেখানে এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের যুদ্ধ লাগিয়ে রাখে। তারা হোঁদল রাজার পেছনে আছে, বুদ্ধু রাজার পেছনেও আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মৃদু দ্বিমত করি। ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজন এবং সুবিধামাফিক জায়গা সরাসরি দখল করেছে কিংবা আবাসিক প্রতিনিধি পাঠিয়ে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আমাদের জানার কোনো উপায় নেই, উপনিবেশ না থাকলে খুচরো রাজ্যগুলো পরস্পর জুড়ে বড় কোনো রাজ্যের চেহারা নিতো কি না, কিংবা সেগুলোর চেহারা-চরিত্র কেমন দাঁড়াতো।
দ্বিমত আর কোথায়! ব্রিটিশ আবাসিক প্রতিনিধি পাঠিয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখাটার একটা পোষাকী নাম ছিল 'দ্বৈত শাসন', আরেকটা প্রচলিত নাম ছিল 'অধীনতামূলক মিত্রতা'। এই অধীনতামূলক মিত্রতাতে 'মিত্রতা'টুকু যে কেবলই লোকদেখানো সেটা সবাই বুঝতেন কেবল মুখে বলতেন না। আবাসিক প্রতিনিধির মুখ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্রিটিশ সরকার যা বলতো সেটাই আইন বলে পালিত হতো। কোন রাজা-গজা কোনদিন সাহেবদের আদেশের ব্যতয় ঘটিয়েছিলেন বলে শুনিনি।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
'চবুতরা' শব্দটা সম্ভবত 'চত্ত্বর' শব্দটার সাথে সম্পর্কিত। চবুতরা বলতে Plaza-কে বোঝাতো।
সকল সামরিক/অসামরিক উর্দিধারী সরকারী পদগুলো এক অনুক্রমে, এবং সকল অসামরিক প্রশাসনিক পদগুলো এক অনুক্রমে বাংলায় হওয়া উচিত। নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন, সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, বাণিজ্যিক জাহাজের ক্যাপ্টেন সমমর্যাদার পদ নয়, অথচ তাদের নাম এক। আবার মন্ত্রণালয়ের 'যুগ্ম সচিব' আর রাজস্ব বোর্ডের 'যুগ্ম কমিশনার' একই মানের বলে সন্দেহ হলেও বাস্তবে তারা মোটেও সমমানের পদ নয়। এইসব অহেতুক জটিলতা দূর হওয়া উচিত।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্লাজা তো চওক? চবুতরার সাথে চত্বরের সম্পর্ক থাকতে পারে, এটা ডায়াস অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তবে কোটালদপ্তর বোঝানোর জন্যে যে চবুতরা/চবুত্রা, সেটা পারাবতাবাস অর্থেই দেখেছিলাম।
আরব দেশগুলোতে সামরিক/আধাসামরিক/অসামরিক বাহিনীগুলোতে পদের নামগুলো সাধারণত একই থাকে। তবে এগুলো ভিন্ন থাকলেও সমস্যা নেই, যদি নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন (ন্যাটো ওএফ-৫) আর সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের (ন্যাটো ওএফ-২) কিংবা নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট (ন্যাটো ওএফ-২) আর সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্টের (ন্যাটো ওএফ-১) মতো প্যাঁচ না বাঁধে।
আমি শ'খানেক বছর আগের বাংলা সাহিত্যে প্লাজা অর্থে চবুতরা শব্দের ব্যবহার দেখেছি। গল্প/উপন্যাসের নাম মনে নেই। তাছাড়া সাধারণ মানুষের কথাতেও এর ব্যবহার দেখেছি। 'চওক'> চক শব্দটা সংস্কৃত 'চতুষ্ক' থেকে আগত। এটার অর্থ প্লাজা, চার রাস্তার জাংশান বা চৌরাস্তা হলেও বাংলায় এর বেশি ব্যবহার 'মার্কেটপ্লেস' অর্থে। কবুতর খেলানোর জায়গা হিসাবে 'চবুতরা' ব্যবহার বা যোগরূঢ়ার্থে কোটালদপ্তর বোঝানো হতেই পারে। যেহেতু শব্দটির এখন ব্যাপক ব্যবহার নেই তাই ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়কে ব্যবহারিক জীবনে 'চবুতরা' বললে বিভ্রান্তি হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
সামরিক/অসামরিক পদগুলোর নাম প্রস্তাব নিয়ে ভিন্ন পোস্ট দেন। আলোচনাটা সেখানে হোক। নয়তো দরকারের সময় খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সেবাস্তিয়েন মানরিকের স্মৃতিচারণে (হিস্পানিতে লিখিত) মেদিনীপুরের কোটালের চবুতরার কথা পেলাম:
একফোর্ড লুয়ার্ডের ইঙ্গানুবাদ থেকে অসীম কুমার রায়ের বঙ্গানুবাদে:
পুলিশকে ঠোলা ডাকার ব্যাপারটা সম্ভবত চট্টগ্রাম থেকে চালু হয়। চাটগাইয়া ভাষায় ঠোঙ্গাকে বলে ঠোলা। ঠোঙ্গার মৌলিক রঙ খাকি। পুলিশের খাকি রঙের পোষাকের কারণে ঠোলা নামটা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছিল। এই ডাকের কারনে গ্রেফতার করার নজিরও দেখেছি। ঠোলা ডাকের কারণে পরবর্তীতে পুলিশের পোষাকের উর্ধাংশ অ-খাকি করা হয়। তবু নামটা থেকে যায়।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
খুপ খ্রাপ। নিন্দা জানাই।
তবে এ রহস্যের কিনারা পেয়ে ভাল্লাগছে।
আমি যখন ৮০-র দশকের শুরুতে ঢাকা থেকে গিয়ে চট্টগ্রামের একটা স্কুলে ভর্তি হই, তখনই এই শব্দটা প্রথম শুনি। এর আগে ঢাকাতে এটা শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য আমি না শুনলেই বা মনে না করতে পারলেই যে এটা তখন ঢাকাতে অচল ছিল তা হয়তো নয়, কিন্তু সেক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রচলন হয়নি মনে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক! আমার বন্ধুরা বা অন্য ছেলেপুলেরা পুলিশ প্রসঙ্গ আসলেই এই শব্দটাই ব্যবহার কত প্রায় ব্যতিক্রমহীণভাবে। মনে আছে, স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় স্কুলবাস নিয়ে নিজেদের টীমের খেলা দেখে ফেরার সময় - নিজেদের টীম জিতে থাকলে আনন্দ, উচ্ছাস আর দুষ্টুমির আতিশয্যে স্কুলবাস ট্রাফিক সিগন্যাল ঘোরার সময় সিগন্যালে বা রাস্তার ধারে পুলিশ দেখে বাসের ভিতর থেকে অনেক 'পোলাপাইন' সমস্বরে "ঠোলা-ঠোলা' বলে চেঁচিয়ে উঠে ঐ পুলিশদের খেপাত। পুলিশরা খেপতো সাঙ্ঘাতিক! ভীষণ নিন্দনীয় কাজ নিঃসন্দেহে!
****************************************
শব্দটা বাংলাদেশে লেট সেভেন্টিজ থেকে প্রচলিত। শব্দটা ব্যবহার করে তৎকালীন জনপ্রিয় কিছু গানের প্যারোডিও ছিল। সেগুলো এখন মনেও করতে চাই না। কারণ, একথা মনে রাখতে হবে যে - মনে অপরাধ না থাকলে ভয়ের কিছু নাই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
- আমি এটা নিয়ে একেবারে ভিত্তিহীন একটা গল্প শুনেছিলাম। একবার নাকি এক বিশাল টেক্সটাইল মিলে রঙের হেরফেরের কারণে কাপড় সরবরাহের এক বিশাল অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। নিরুপায় মিল মালিক তখন বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য এক বিশেষ ভবনের এক বিশিষ্ট ভাইয়ার শরণাগত হন। বিশিষ্ট সে জন ভাবলেন কোন উর্দিধারী বিভাগে জিনিসটা গছিয়ে দিতে পারলে অসহায় মিল মালিক রক্ষা পাবেন, সেই সাথে ভবিষ্যতে নতুন কাজের অর্ডার পাবার রাস্তা খোলে। তাতে মিল মালিকের লোকসান পুষিয়ে গিয়ে নিয়মিত কাজের ব্যবস্থা হলো এবং বিশিষ্ট ভাইয়ার নিয়মিতভাবে 'ফিপ্টিন পার্সেন্ট'-এর বন্দোবস্ত হলো।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মূল গল্পটা ঠিক আছে। জনৈক ভাইয়া তার মামার জন্য প্রায় সবগুলো বাহিনীর ইউনিফর্ম পরিবর্তন করেছিলন। সময়টা ২০০০ এর আশে পাশে। বিখাকিকরণ তার অনেক আগের ঘটনা।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ঠোলা শব্দের উৎপত্তি চট্টগ্রাম কিনা এই বিষয়টা এতো সহজে নিষ্পত্তি করা ঠিক হবে না। হিন্দি বেল্টে এই শব্দটা চালু আছে। রাজনীতিবিদ কেজরিওয়াল, অভিনেতা আমির খান এই শব্দ বলে মামলা পর্যন্ত খেয়েছেন।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
হিন্দি ঠুল্লা শব্দ অভিধানে না পেয়ে হাকিম কেজরিওয়ালকে এর অর্থ জিজ্ঞাস করেছিলেন। এই মামলার সুত্র ধরে বি এন উনিয়াল একটা লেখা লিখেছেন। উনি ঠুল্লা শব্দটা একশ বছরে প্রকাশিত হিন্দি উর্দু প্রাকৃত সংস্কৃত কোন অভিধানেই পান নাই। রালফ টার্নারের ১৮৩১ সালে প্রকাশিত A comparative and etymological dictionary of the Nepali language থেকে শেষ পর্যন্ত ঠুল্লা আর ঠোলা দুইটা শব্দ পাইছেন। সংস্কৃত স্থুল থেকে শব্দ দুইটা আসছে, মানে একই, "বড়"। নেপালিতে জেঠাকে বলে "ঠোলা বুওয়া", মানে বড় বাবা। নেপাল থেকে গাড়োয়ালি হয়ে হিন্দিতে যদি ঠোলা আসতে পারে, বাংলাতেও গুরখা সৈন্যদের মারফত আসতে পারে।
লিঙ্কের আর্টিকেলটা পড়লাম। খুব স্থূল বিশ্লেষণ মনে হল। সংস্কৃত বই পত্র, ভদ্রলোক বামুনদের লেখা অভিধান বইপত্রের বাইরে অনেক স্থানীয় শব্দ আছে যেগুলো মুখে আছে কিন্তু কোথাও লিখিত আকারে নেই। সুতরাং লেখক যে পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেছেন সেটা যথেষ্ট নয়।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
সংস্কৃত "স্থূল" থেকে প্রাকৃতে (সেখান থেকে নেপালি আর বাংলায়) ঠোলা এসে থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশ অর্থে ঠোলা/ঠুল্লা পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহৃত হয় না (পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুদের সাথে আলাপ এবং পশ্চিমবঙ্গীয় গল্প-প্রবন্ধ পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)। যেহেতু কলকাতা এককালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি আর ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিলো, গুর্খাদের মাধ্যমে ছড়ালে কলকাতা পর্যন্ত ঠোলার ব্যবহার দেখা যাওয়ার কথা। নেপাল বা উত্তর ভারত থেকে শব্দটা গজালে পশ্চিমবঙ্গ এড়িয়ে পূর্ববঙ্গে শব্দটার প্রকোপের পেছনে একমাত্র রাজনৈতিক প্রাচীরকে (এবং প্রাচীরের ফোঁকরকে) চিহ্নিত করা যায় (অর্থাৎ পাকিস্তান আমল)।
পাকিস্তানেও সম্ভবত পুলিশের জন্যে অবজ্ঞাবাচক "টুল্লা" শব্দটা চালু আছে। দুটো কল্পদৃশ্য ফাঁদা যায়, যেখানে পাকিস্তানের দুটি টুকরোর মধ্যে ভাষাগত লেনদেন আছে বলে হয় পাকিস্তান থেকে এটি বাংলাদেশে এসেছে নয়তো বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে গেছে। চট্টগ্রামে ঠোঙা অর্থে গজালে চট্টগ্রাম-করাচি বন্দরযোগাযোগের সূত্রে এটা ছড়ানো অসম্ভব কিছু নয়, আবার পাকিস্তান থেকে এটা উত্তর ভারতে ছড়াতে পারে।
ব্রিটিশ/পাকি আমলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-দিল্লি-লাহোরের-স্মৃতিচারণমূলক লেখাগুলোয় ঠোলা শব্দটার উপস্থিতি/অনুপস্থিতি থেকে হয়তো আরো কিছু কল্পদৃশ্য ফাঁদা যাবে।
অন্য কোথাও ঠোলা শব্দ চালু আছে কিনা জানি না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতাটি একদম ব্যক্তিগত। আমরা যারা এরশাদের সামরিক শাসনের প্রথম ধাক্কার শিকার, আমরা পুলিশকে ঠোলা ডাকা শুরু করি ঠোঙ্গা রঙের কারণেই। কলেজের প্রথমদিনই আমরা ত্রিশজন গ্রেফতার হয়েছিলাম প্রায় বিনা কারণে। থানায় নিয়ে আমাদের যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল পুলিশকে কেন ঠোলা ডাকছি। কারণ ফাজিল পোলাপান গারদের ভেতর থেকেও পুলিশকে ঠোলা বলতেছিল। শব্দটা এরশাদের আমল থেকেই চালু হতে দেখেছি। তাই শব্দটা বিদেশ থেকে আমদানীকৃত বলে মনে করি না।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
উপরে হিন্দি বেল্টের দুটো উদাহরণ দিলাম। অন্য জায়গায় ঠোলা চালু আছে খুব ভাল করেই। আসামের দিকে ঠোলা মানে নারকেলের মালা দিয়ে চামচ বোঝে। গরুর চোখে ঠুলিকে বাংলাদেশের কিছু আঞ্চলিক উচ্চারণে ঠোলা বলে।
আশির দশকে ঠোলা শব্দটা ঢাকায়ও চালু ছিল। আমি তখন থেকেই এই শব্দটার সাথে পরিচিত। একটা দুইটা ঠোলা ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর সম্ভবত সেই সময়কার শ্লোগান। আমি তখন থেকে শুনছি শব্দটা এটা শব্দটা তখনই চালু হয়েছে এটা প্রমাণ করে না। কারণ আমার অভিজ্ঞতার বাইরে এই শব্দটার চল থাকতে পারে। প্রয়াত সচল মুহম্মদ জুবায়ের বলেছেন শব্দটা তিনি স্কুলে নিচু ক্লাসে পড়ার সময় শুনেছেন। তার মানে সেটা স্বাধীনতার আগের কথা। অর্থাৎ হিন্দি -> উর্দু -> বাংলা - এভাবেও শব্দটা আসতে পারে।
এদিক ওদিক থেকে বিদেশি শব্দ প্রায়ই ঢুকে পড়ছে বাংলা কথ্য ভাষায়। ঠোলা এরকম ভাবে কোথা থেকে এসেছে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
হিমুভাই আপনার লেখা পড়ার সময় ভাবি আপনার সৃষ্টি করা শব্দ গুলো কোথাও লিখে রাখবো। ভবিষ্যতে কোনদিন যদি “প্রস্তাবিত নতুন বাংলা (প্রতি)শব্দের অভিধান” একটা বের করেন তবে প্রথম ক্রেতা আমি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
তারচেও ভালো হয় যদি পছন্দসই শব্দগুলো নিয়মিত ব্যবহার করেন। শব্দের যেহেতু মালিকানা হয় না, আমি এগুলোকে "দবিরের/কবিরের/সগিরের সৃষ্টি করা শব্দ" হিসেবে না দেখে বরং "নতুন শব্দ" হিসেবে দেখতে চাই, অন্যকেও সেভাবেই দেখতে বলি। আমি বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিত অন্যদের লেখায় নতুন শব্দের খোঁজ করে যাচ্ছি, পছন্দ হলে আপন মনে করে অকাতরে ব্যবহার করি। আজ একটা লেখায় স্টার মার্কসের বাংলা দেখলাম "নক্ষত্রমান", বেশ পছন্দ হয়েছে, এটা এখন থেকে ব্যবহার করে যাবো।
লেখার সময় প্রায়ই মনে হয় প্রয়োজনীয় একটা শব্দ হিমুভাই আপনার লেখায় দেখেছিলাম কিন্তু না শব্দটা না লেখাটা কিছুই মনে আসেনা। তখন মনে হয় হিমুভাইয়ের একটা বই থাকলে বেশ হতো। কারো কারো নতুন শব্দ সৃষ্টির ক্ষমতা যেমনভাবে থাকে অন্যদের তেমন নয়। হিমুভাই আপনি একটা বই বের করলে সত্যিই ভালো হয়।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
শব্দগুলিকে চালু করতে গেলে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে। তার মানে অনেক লিখতে হবে। আর সেখানেই -
ঠোলা শব্দটি আমার কাছে নূতন। আমার ছোটবেলায় এটি শুনিনি। আমরা 'মামু' বলতাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আচ্ছা, ধরেন লেখালেখিতে বাংলা এই প্রতিশব্দের ব্যবহারের চেষ্টা করলাম। সেক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দটা বন্ধনিতে দেয়া দরকার না, অন্তত প্রথম প্রথম? নইলে বোঝাতে বোঝাতে জান কাবাব হবার সম্ভাবনা। বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহারের শুরুটা তো সচলেই করা যেতে পারে। আসেন যে যতটা পারি শুরু করে দেই। যথারীতি ঋদ্ধ হবার মতোই সিরিজ, সাথে মন্তব্যালোচনা। ধন্যবাদ বাঘাদা।
দিতে পারেন। শ'খানেক বছর আগের বাংলা সাময়িকী খুললে দেখবেন সে আমলের শিক্ষিতজনেরা বাংলা পরিভাষা প্রণয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন (সে সময়ে সংস্কৃতনির্ভরতার কারণে লেখ্য বাংলা অনেকটা "শিশু" বেনজামিন বাটনের মতো ছিলো) বন্ধনীর ভেতরে ইংরেজি শব্দ দিয়ে শিক্ষিত পাঠকদের পদে পদে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, তাঁর প্রণীত/প্রস্তাবিত বাংলা শব্দটার অর্থ কী। এ রীতি প্রতিশব্দ তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে।
আর যদি লেখায় সদ্যোদ্ভাবিত শব্দ অনেক থাকে, তাহলে অধ্যায়ের শেষে একটা নির্ঘণ্ট জুড়ে দিতে পারেন, কিংবা পাতার নিচে পাদটীকা। আমি এই লেখায় অভিক্রিয়া (experiment) হিসেবে এক একটা অনুচ্ছেদের নিচে সুপারস্ক্রিপ্টে পাদটীকা জুড়ে শব্দের ওপর মন্তব্য করেছি। যদি একটি শব্দ একবার কোথাও ব্যবহার করেন বা ব্যবহৃত হতে দেখেন, তাহলে যাদের বোঝাতে জান ওষ্ঠাগত, তাদের সুবিধার জন্যে সে উৎসের লিঙ্ক শব্দটায় গুঁজে দিতে পারেন (যেমন আর্ণব অর্থনীতি)। তাছাড়া আপনি এসবের বাইরে নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবন করে নিতে পারেন। বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে আপনার দায় যেমন বড়, সুযোগও তেমনই অবারিত।
আর এসেই যখন পড়েছেন, সাবস্ক্রিপ্ট আর সুপারস্ক্রিপ্টের বাংলা করে দুটো শব্দ আমাদের দিন। পাদলিপি আর শিরোলিপি বলা যায়, কিন্তু এরচে ভালো কিছু হতে পারে।
খাইছে! একি বিপদে ফেললেন ভাই 'পাদলিপি', 'শিরোলিপি' তো বেশ সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ। এরচে' ভালো কী হতে পারে
নিম্নলিখন, শীর্ষলিখন? নাহ্ শ্রুতিমধুর না মোটেও।
গতকাল মাংস রান্না করতে গিয়ে বেশি মজা করার জন্য মশলা বেশি দিয়ে পুরো ডিশটার বারোটা বাজিয়েছি!
পাদলিপি আর শিরোলিপির মতো স্পষ্ট, সহজ ও সুন্দর দু'টো শব্দকে আরও ভালো করতে গিয়ে না আবার আমার মাংস রান্নার মতই অবস্থা হয়! হা হা হা...
যাগ্গে, "এরচে ভালো" না হোক, শিরোলিপির বদলে একটা মজাদার শব্দ মাথায় আসলো -- টিকিলিপি। একবার কল্পনায় বিষয়টা চিত্রায়ন করুন - সুপারস্ক্রীপ্টকে স্বাভাবিক অক্ষরের মাথা থেকে বেরুনো একটা টিকির মতো লাগে না অনেকটা?
****************************************
টিকিলিপি বেশ ভালো। নিচে লহমাদাও দুটো ভালো বিকল্প প্রস্তাব করেছেন।
সাবস্ক্রিপ্ট = অবলিপি
সুপারস্ক্রিপ্ট = অধিলিপি
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এ দুটোও লাগসই। এক জায়গায় দেখলাম অবলিপি আর অধিলিপির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অক্ষরের টপলাইন আর বেজলাইনেরও বাংলা করেছে (শিরোসীমা আর পাদসীমা)। শিরোলিপি আর পাদলিপি ও দুটোর সঙ্গে যাচ্ছে ভালো।
কয়েক মাস আগে ইউটিউবে ফন্ট নিয়ে এক নকশাকারের বকান্তিস শুনছিলাম। ফন্ট নকশার সাথে কতো খুঁটিনাটি জড়ানো, জেনে তাক লেগে গেছে। এক একটা বর্ণের রৈখিক বৈশিষ্ট্য, মানরেখা (রেফারেন্স লাইন) ইত্যাদি মিলিয়ে কয়েক গণ্ডা বিশেষায়িত শব্দ চালু আছে এ শিল্পে। বাংলা বর্ণ যারা নকশা করেন (আমি এঁদের বাংলায় বর্ণিক বলে ডাকতে চাই), তাঁরা যদি বাংলায় তাঁদের কাজ নিয়ে লিখতেন, শব্দগুলো যেমন বাংলার ছাঁচে ফেলা যেতো, তেমনই এই মনোমুগ্ধকর কলা নিয়েও মানুষের মনে আগ্রহ জাগতো। বর্ণকলা (টাইপোগ্রাফি) নিয়ে যদি কোনো পাঠক কাজ করে থাকেন, দয়া করে হাতে কলম তুলে নিয়ে সাড়া দিন।
দারুণ!
হ্যাঁ,শিরোলিপি পাদলিপির সাথে শিরোসীমা পাদসীমা যুতসই লাগছে। মনমাঝি ভাইয়ের 'টিকিলিপি' নিয়ে যা বলেছেন সেটা ভেবে অট্ট হাসি দিলেম। মজারু শব্দটা। টিকির সাথে মিলিয়ে সাবস্ক্রিপ্ট- বাংলা প্রতি শব্দ কী তবে লেজুরলিপি হবে?
ফিওনা রস, পলাশবরণ পাল আর চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা বর্ণমালার নকশা নিয়ে নিবিড় গবেষণা করেছেন। তাঁদের কাজ অনুসরণ করে বাংলাভাষী সুইড বর্ণিক ইয়াকব থমাস বাংলা বর্ণালেখনে ব্যবহৃত পরিভাষা সংকলন করেছেন।
নতুন মন্তব্য করুন