খবরের কাগজের আড়ালে গোয়েন্দা বিভাগের দারোগা কিংকর্তব্যবিমূঢ় চৌধারি ফিসফিস করে বললেন, "স্যার, এটা কোন দেশের খবরের কাগজ?"
উপমহাদেশের সবচে মারকুটে গোয়েন্দা, যার সাথে আপনহাতি ছবি তোলার জন্যে বড় বড় কোটাল-সালাররা মুখিয়ে থাকেন, সেই গোয়েন্দা ঝাকানাকা খবরের কাগজটা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে উল্টে ধরে ফিসফিসিয়েই বললেন, "জানি না। মনে হয় প্রাচীন মিশরের। অক্ষরগুলো হিয়েরোগ্লিফ মনে হচ্ছে।"
কিংকু চৌধারি পাতা উল্টে কিছুক্ষণ মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করে নিম্নস্বরে বললেন, "স্যার, প্রাচীন মিশরেও কি মোটর সাইকেল ছিলো? এ পাতায় একটা মোটর সাইকেলের বিজ্ঞাপন দেখতে পাচ্ছি। একটা হাফনেংটুশ মেয়ে মডেল চালাচ্ছে। হাওয়ায় তার বাকি জামাকাপড় উড়ি-উড়ি করছে। একটা মুশকোমতো ছোকরা মডেল সিটের পেছনবাগে বসে মেয়েটাকে জাপটে চিপকে ধরে রেখেছে বলে বেচারি আব্রু নিয়ে চলতে-ফিরতে পারছে। নইলে কী যে হোতো!"
ঝাকানাকা নিজের খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে কিংকু চৌধারির পড়া পাতায় সওয়ার মালবালার[১] ছবিখানা মন দিয়ে খানিক দেখে নিয়ে গলা আরো নামিয়ে বললেন, "থাকতেই পারে। ওরা পিরামিড বানাতে পেরেছে, আর মোটর সাইকেল পারবে না?"
[১] মালবালা = নারী মডেল
কিংকু চৌধারি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই নাপিতখানার বাকি লোকজন গুজগুজ থামিয়ে কেমন যেন সন্দিহান চোখে নরসুন্দরের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে সুন্দর নর হওয়ার সারিতে অপেক্ষমান ছদ্মবেশী ঝাকানাকা আর কিংকু চৌধারির দিকে ফিরলো। ঝাকানাকা কিংকু চৌধারির পাঁজরে কনুই মেরে ফিসফিসিয়ে বললেন, "ফোঁসফাঁস না করে বাবুরাম সাপুড়ের সাপগুলোর মতো চুপ থাকুন, কান পেতে কথাবার্তা শুনুন।"
আলতামাশ ক্ষৌরসভার নামটা যেমন ভারিক্কি, ভেতরের চালচলনও রাশভারি। এখানকার হালচাল আর দশটা চুলকাটার সেলুনের মতো নয়। মস্ত জায়গা নিয়ে দোকান হাঁকানো হয়েছে, প্রাচীন গ্রিসের অ্যামফিথিয়েটারের আদলে উঁচু পাট[২] বানানো, সেখানে আজ ঝাকানাকা আর কিংকু চৌধারি ছাড়া আর আছেন মোটে তিনজন। মঞ্চের ওপর একটা বাহারি আসন, মক্কেল সেখানে বসে ধন্য হন। চাকা লাগানো কতোগুলো কাঠামোয় গাঁথা আয়না মক্কেলকে ঘিরে সাজানো, আর পেছনে ধবধবে সাদা আংরাখা-পরা মায়েস্ত্রো নাপিত, আলতামাশ ক্ষৌরসভার মালিক ও সভাপতি, মিশেলিন পাঁচতারা কেশকৌশলী আলতামাশ নরুণিয়া হরেক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজে ব্যস্ত।
[২] পাট = গ্যালারি।
"... যা বলছিলাম", সরু চোখে কিছুক্ষণ যেন খবরের কাগজ ফুঁড়েই ওপাশে কিংকু চৌধারির আড়াল করা মুখটা দেখে নিলেন নরুণিয়া। কেশপ্রসাধনের ফাঁকে বিস্তর বকেন তিনি। লোকে বলে আলতামাশ নরুণিয়ার টাকার অভাব নেই, কেবল বকবকিয়ে পেট হালকা করার জন্যেই সেলুন খুলেছেন তিনি, রোজগারের আশায় নয়। কয়েক দশক ধরে সারা পৃথিবী চষে আর চেঁছে বেড়িয়েছেন তিনি, টাকা তার ব্যাংকে আর মুড়ির টিনে পড়ে পড়ে ছত্রাকের ভোগে যাচ্ছে। চাইলেই নাকি বাকিটা জীবন তিনি হেসেখেলে ফুর্তি লুটে আজ বাহামা কাল হাভানা পরশু কোপাকাবানা করে কাটিয়ে দিতে পারেন আলতামাশ। তেমনটা যে তিনি নিকট অতীতেই করে এসেছেন, তার প্রমাণও মেলে আলতামাশ ক্ষৌরসভার অন্দরসজ্জায়। ছাদ থেকে ঝোলা তিব্বতি ঢঙের টঙ্গায় আঁকা দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, কোনো এক সুনীল সাগরে একটি আব্রুভোলা ঢলোঢলো যুবতীকে কাঁখে নিয়ে নায়ের বাদাম তুলছেন তিনি। দেয়ালে টাঙানো তাঁতছবিতে[৩] দেখা যাচ্ছে, সন্ধ্যার সৈকতে লাকড়ির আগুন ঘিরে ওরকম একাধিক যুবতীর কোমর জড়িয়ে নেচে বেড়াচ্ছেন আলতামাশ। এমনকি ছাদও রেহাই পায়নি তাঁর এই প্রদর্শনমুখী স্মৃতিচারণের হাত থেকে, মেঝেতে লুকোনো সম্পাতযন্ত্রের দাপটে ছাদে আচমকা আচমকা ভেসে উঠছে এক একটি আলোকচিত্র, সেখানে কোনোটায় আলতামাশ নরুণিয়া জাঙ্গিয়া পরে লাল কম্বল আর দুটো দাঁতখিলাল সম্বল করে গোল বালুভরা মাঠে ক্ষ্যাপা-গোদা-রক্তাক্ত ষাঁড়ের মুখোমুখি হয়েছেন, কোনোটায় হেঁসোঠ্যাং[৪] পরে পানির নিচে মস্ত এক শ্বেতহাঙরের মুখে সস্নেহে কাপাই পরাচ্ছেন, কোনোটায় আবার গোল এক জানালা দিয়ে উদাস মুখে চেয়ে আছেন কুচকুচে কালো মহাকাশে ভেসে থাকা সুদূর নীল পৃথিবীর দিকে। আর মক্কেলের আসনখানাও এমনই কায়দায় পাতা, ছাদ ছাড়া আর কিছু দেখাও মুশকিল।
[৩] তাঁতছবি = ট্যাপেস্ট্রি।
[৪] হেঁসোঠ্যাং = ফ্লিপার্স।
মক্কেল বেচারা ঘাড়খানা কেমন যেন আড়াই-প্যাঁচ দিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে ছিলেন নরুণিয়ার কাঁচির নিচে, তিনি গোঁ-গোঁ করে বললেন, "ঘাড়টা একটু সোজা করি স্যার?"
কিংকু চৌধারি চমকে উঠে ফিসফিসিয়ে বললেন, "স্যার, এ কেমন সেলুন? মক্কেল এখানে নাপিতকে স্যার বলে!"
ঝাকানাকা করুণাভরে একটা নীরব হাসি ফোটালেন মুখে। "গোড়া বেঁধে কাজ করতে আর কবে শিখবেন? একটু খোঁজ নিতে কী সমস্যা? এ কি আপনার পাড়ার চুলকাটা গোঁপছাঁটার আখড়া পেয়েছেন নাকি? আলতামাশ নরুণিয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিওলা লোক। ওঁকে নোবেল দেওয়া নিয়ে নোবেল কমিটির রসায়ন উপকমিটি আর পদার্থ উপকমিটির অপদার্থদের মাঝে কুড়ি বছর ধরে ঝগড়া চলছে। কী নিয়ে যেন রাগ করে উনি আত্মজীবনী লিখবেন না বলে গোঁ ধরেছেন, তাই সাহিত্যে নোবেল-বুকার-হিউগো-নেবুলাওয়ালারা সবাই বছর বছর দিস্তা দিস্তা চিঠি লিখে মাপ চেয়ে বেড়ায়। বছরদশেক আগে উনি রাস্তায় কলা দরদাম করছিলেন, দূর থেকে আলটপকা সে দৃশ্য ক্যামেরায় পাকড়ে এক বাটপার মহিলা আরেকটু হলেই অস্কার পেয়ে যাচ্ছিলো...।"
কিংকু চৌধারি হাল ছাড়লেন না, হিয়েরোগ্লিফে মুখ ঢেকে বললেন, "কিন্তু এই যে লোকে বলে, কাশটোমার ইজ কিং...?"
ঝাকানাকা গম্ভীর মুখে বললেন, "তা বটে। ওনার এ ক্ষৌরসভায় এক বিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য কতো রাজাগজা একে-ওকে ধরে, সে খোঁজ রাখেন?" কিংকু চৌধারির চেহারা ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে উঠছিলো ফিসফিসে ফিরিস্তি শুনে, তার শেষ ভরসাটুকু যেন এক ফুঁয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন ঝাকানাকা, "তাছাড়া উনি নাইটহুড পেয়েছেন গতবছর। শুনেছি ওনার খালুও ওনাকে স্যার ডাকেন।"
আলতামাশ নরুণিয়া রক্তচক্ষু মেলে ওদিকে মঞ্চের ওপর খদ্দেরকে নরম গলায় বললেন, "হুঁ, আপনি ঘাড় সোজা করুন আর আমার হাতের কাজটা মৃগেল হোক! যেভাবে কেৎরে পড়ে আছেন, সেভাবেই থাকুন।"
খানিক দূরে পাটে বসা দুই অপেক্ষমান ভদ্রলোক নিজেদের মাঝে গুজগুজিয়ে উঠলেন, "এই রে, দিলো চটিয়ে!"
নরুণিয়া বাকি খদ্দেরদের দিকে একবার বিষদৃষ্টি মেলে বললেন, "... কী যেন বলছিলাম? ওহ। হুম। আর্ট। নিজের আর্ট কোনোদিন অন্যের হাতে বর্গা দেবেন না। দিছেন তো মরছেন হালায়। নিজে ভি মরবেন, দুইন্যারে ভি মারবেন। এ পৃথিবীতে যদি সবচে ভয়ানক কোনো ব্যাপার থাকে, সেটা হচ্ছে কাঁচা লোকের হাতে পাকা কাজের আদ্ধেকটা গিয়ে পড়া।"
খদ্দের করুণ কণ্ঠে বললেন, "স্যার, গর্দানটা সোজা করে সিটটা বেঁকিয়ে দিলে হয় না?"
নিজেদের পালার অপেক্ষায় থাকা ভদ্রলোক দু'জন আঁতকে উঠে মুখে হাত চাপা দিলেন।
আলতামাশ নরুণিয়া আনমনে কাঁচিটা বাতাসে খচখচিয়ে যাচ্ছিলেন, এবার তিনি কাঁচি থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। "শুনুন জনাব!" হেঁকে উঠলেন তিনি। "পিসার হেলানো মিনার যদি সোজা করা হয়, কেউ ওখানে ছ্যাপটাও ফেলতে যাবে?"
খদ্দের বাঁকা ঘাড় নিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, "য়্যাঁ... য়্যাঁ... কী জানি? না মনে হয়।"
আলতামাশ নরুণিয়া মাটিতে পা ঠুকে গর্জে উঠলেন, "আর আইফেল টাওয়ারটা যদি আজকে বেঁকিয়ে দিই, ওটার নিচে কেউ যেতে সাহস পাবে?"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের অসহায় মুখে বাকি খদ্দেরদের দিকে ফেরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঘাড়ের কারণে পারলেন না।
আলতামাশ একটা টগবগে গরম পানির বালতিতে কাঁচি ছুড়ে ফেলে হাতে জীবাণুমারা আরক মাখতে লাগলেন, "নামুন এই হটসিট থেকে। আপনার চুল আলতামাশ নরুণিয়া ছাঁটবে না। যান কোনো আমনাপিতের কাছে, গিয়ে তাকে ফরমায়েশ দিন। বলুন চীনের দেয়াল দশফুট নিচু করে বানাতে, কিংবা মোনালিসার কানের লতি বড় করে আঁকতে। হালায় চুল ভি কাটাইবেন আবার গর্দান ভি সিধা রাখবেন, ফাইজালমকি পাইছেন ত!"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, "এবারের মতো মাফ করে দেন স্যার। ভুল হয়ে গেছে।"
আলতামাশ নরুণিয়া টগবগিয়ে উঠলেন একেবারে, "পিকাসোকে গিয়ে বলতে পারবেন, ব্রাশ সোজা ধরে ইজেল ব্যাঁকা করতে? রবি শংকরকে গিয়ে বলতে পারবেন, সেতার সোজা ধরে ঠ্যাং ব্যাঁকা করতে? সানি লিওনিকে বলতে পারবেন...?" হঠাৎ থেমে গিয়ে আশপাশটা দেখে নিলেন তিনি। "তাহলে আমাকে কোন সাহসে ঘাড় সোজা করে সিট বেঁকাতে বলেন?"
এক বুড়ো খদ্দের খনখনিয়ে উঠলেন, "স্যার ওকে ঘাড়ে ধরে বের করে দিন। আমরা বসে আছি অনেকক্ষণ।"
আলতামাশ নরুণিয়া গর্জে উঠলেন, "আপনি থামুন স্যার! আমাকে আমার শিল্প বুঝতে দিন। আইনস্টাইনকে বলতে পারবেন, ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি-স্কোয়্যার্ড ইকুয়েশন থেকে এম বের করে দিতে? পুতিনকে বলতে পারবেন, ট্রাম্পকে বের করে দিতে? সানি লিওনিকে বলতে পারবেন...?" আবারও হঠাৎ থেমে গিয়ে আশপাশ দেখে নিলেন তিনি। "আমাকে আমার শিল্প বুঝতে দিন। ফরমায়েশ কপচাবেন না।"
কিংকু চৌধারি ফিসফিসিয়ে বললেন, "স্যার, এ তো মহা রগচটা লোক দেখছি! ডানে গেলেও বকে, বামে গেলেও বকে!"
ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে হিয়েরোগ্লিফ পড়ে যাচ্ছিলেন, তিনি আনমনে বললেন, "হুমম। শিল্পী মানুষ। কী আর করা।"
আলতামাশ নরুণিয়া গজগজ করতে করতে ফের কাঁচি হাতে নিয়ে খচখচাতে লাগলেন, "ঘাড়টা আরেক প্যাঁচ দিয়ে বসুন। ওরকম ছলোছলো চোখে চেয়ে কোনো লাভ নেই। আমি আপনাকে ডেকে এনেছি? আপনি দেড় বছর আমার আপিসে ঘ্যানঘ্যানিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন, আমার হাতে চুল ছাঁটিয়ে রাষ্ট্রদূত হবেন বলে। এখন এসে উল্টো ফরমায়েশ দিচ্ছেন, আপনার জন্য আইফেল টাওয়ার বেঁকিয়ে দিতে হবে। ...নড়বেন না।" কিছুক্ষণ খচাখচ চুলে কাঁচি চালালেন তিনি নেচে নেচে। "আপনার মতলবই হচ্ছে আমার কাজটা মৃগেল করা।"
কিংকু চৌধারি শুধালেন, "স্যার, তখন থেকে শুনছি, এই মৃগেল করা... মৃগেল এখানে এলো কোত্থেকে?"
ঝাকানাকা চিন্তিত মুখে বললেন, "সম্ভবত উনি মৃগেল হকের প্রসঙ্গ তুলে খোঁটা দিচ্ছেন।"
কিংকু চৌধারি বললেন, "সে কী স্যার, ঐ যে চিত্রকর মৃগেল হকের কথা হচ্ছে এখানে? ঐ যে যিনি ধুন্ধুমার ইয়াব্বড় সব পোরট্রেট এঁকে পথেঘাটে ঝুলিয়ে দেন?"
ঝাকানাকা মাথা ঝাঁকালেন, "ইনডিড। কিন্তু আপনিই তো এই কেসের ফাইলটা আমাকে দিলেন। নিজে পড়ে দেখেননি কিছু? আলতামাশ নরুণিয়া আর মৃগেল হক... দে হ্যাভ আ কালারফুল হিস্ট্রি অফ এনমিটি বিটুয়িন দেম। নথিতে সব আছে।"
ফিসফিসের মধ্যে যতটুকু মিনমিন করা যায়, ততটুকু মিনমিনিয়ে কিংকু দারোগা বললেন, "তাড়াহুড়ো করে পড়েছি স্যার, দু'চারপাতা মনে হয় ফস্কে গিয়ে থাকবে। মৃগেল হক আলতামাশের সাথে কী করেছে?"
ঝাকানাকা মুখে আঙুল তুলে চুপ থাকার ইশারা করে মঞ্চের আলাপে মন দিতে বললেন, একতরফা গজগজানিকে যদি আলাপ বলা যায়।
আলতামাশ নরুণিয়া মক্কেলের মাথার চুল এক গোছা কেটে বাতাসে কাঁচির খনৎকার তুলে বললেন, "...শিল্পের ওপর হুকুমদারি চলে না। জবরদস্তি চলে না। ফরমায়েশ চলে না। গুণ্ডাগার্দি চলে না। পাম্পার দিয়ে ফুটবল ফোটানো যায়, কিন্তু গোলাপ ফোটাতে লাগে সাধনা। ধমক শুনে কি আমের বোল রাতারাতি ফুলেফেঁপে আম হবে? নো স্যার।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের ফের আলতামাশের হাতে চুল ছাঁটানোর সুযোগ পেয়ে খানিক আগের সবকিছু বোধহয় গুলে খেয়েছেন, তিনি পিনপিনিয়ে বললেন, "কিন্তু স্যার, কার্বাইড দিয়ে যে কলা পাকায়? তারপর তারপর ধরেন ঐ যে মৌসুমের আগেই আগাম আম পাকায়? তারপর ধরেন আমার বড় শালার ছোট মেয়েটা কোরিয়ান নাটক-সিনেমা দেখে দেখে কেমন যেন পেকে ত্যাঁদড় হয়ে গেলো কচি বয়সেই...।"
আলতামাশ নরুণিয়া এবার কাঁচি খাপে গুঁজে একজোড়া রবারের দস্তানা পরে নিলেন, তারপর বজ্রমুষ্ঠিতে প্রসাধনার্থী খদ্দেরের কান পাকড়ে ধরে একটা ছোটো কাঁচি দিয়ে জুলফি ছাঁটা শুরু করলেন। "বটে?"
খদ্দের চেঁচিয়ে উঠে বললেন, "স্যার কানটা মলবেন না এভাবে! ...সরি সরি। সরি স্যার। টকশো করি তো, মুখে মুখে কথা বলার বদভ্যাস হয়ে গেছে।"
নরুণিয়া ঘোঁৎকার তুলে বললেন, "চুল ছাঁটাবেন কিন্তু কানমলা খাবেন না, তা কি হয়? অমলেট খেতে চাইলে ডিম ভাঙতে হবে। কান বাঁচিয়ে চুল ছাঁটাতে এসে আমার শিল্পকর্ম মৃগেল করার ধান্ধায় আছেন আপনি।"
খানিক আগে ধমক-খাওয়া বুড়ো অপেক্ষমান খদ্দের খনখনিয়ে বললেন, "এ ব্যাটা নির্ঘাত মৃগেল পার্টির লোক। বেহুদা তর্ক করে আমাদের সময় খাচ্ছে উদুলটা।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের আসনে বসেই হেঁকে বললেন, "দেখুন মুরুব্বি, জবান সামালকে। এটা টকশো পাননি যে মুখে যা আসে বলে যাবেন আর আমি সহ্য করবো। দেড়টি বছর সাধনা করে নরুণিয়া স্যারের খাতায় নাম তুলেছি। ওনাকে ওনার শিল্প বুঝতে দিন।"
আলতামাশ নরুণিয়া একটু যেন সন্তুষ্ট হলেন, কান ছেড়ে দিয়ে এবার খদ্দেরের থুতনি ধরে জুলফি ছাঁটতে ছাঁটতে বললেন, "ব্রাভো! এই তো আস্তে আস্তে শিল্পের ব্যাপারটা ধরতে পারছেন।" মেঝেতে কোথায় যেন পা ঠুকলেন তিনি, অমনি ঘর ঝনঝনিয়ে নাইনথ সিম্ফনির সম্বাদ্য বেজে উঠলো। "মোট কথা, নদীকে আপন বেগে পাগলপারা হয়ে ছুটতে দিতে হবে। মাঝপথে এটা বাঁকা করে দাও ওটা সোজা করে দাও বলে বলে ঘ্যানালে নদীটা মৃগেল হবে।"
বুড়ো খদ্দের দূর থেকে খনখনিয়ে উঠলেন, "স্যার, ওর মাথায় চুলই আছে কুল্লে দুই মুঠি। এত অল্পে কি মহৎ শিল্প সম্ভব? ও তো এসেছেই সলিড মৃগেল হয়ে। ওর পেছনে জ্বাল দিলে শিল্পেরই অপচয়। তারচে আমার ওপর কাজ শুরু করে দিন স্যার। ভিসি হওয়ার জন্যে আমারই ডিপার্টমেন্টের দুটো বিটকেল ধুন্ধুমার লবিইং করে বেড়াচ্ছে। দেরি হলে যে আমার ক্যারিয়ারটাই মৃগেল হয়ে যাবে স্যার।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের আড়াই-প্যাঁচে মোচড়ানো ঘাড় নিয়েই তড়পে উঠলেন, "তাতে স্যারের কী? হ্যাঁ? শিল্প বুঝতে না পেরে কেউ যদি ভিসি হতে না পারে, তাতে স্যারের কী এসে-যায়?"
আলতামাশ নরুণিয়ার মুখে ভারি খুশির হাসি ফুটলো। তিনি এবার টগবগে গরম পানিতে একটা তোয়ালে চুবিয়ে নিংড়ে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের মুখটা রগড়ে মুছে দিলেন। "গুড ম্যান। এই যে, এভাবে কেৎরে পড়ে থাকলে আক্কেলটা খোলে। কিন্তু কথা সেটা নয়। কথা হচ্ছিলো নিজের আর্ট অন্যের কাছে বর্গা দেওয়া নিয়ে।" অদূরে ঝোলানো প্রকাণ্ড তিব্বতি টঙ্গাটার দিকে আঙুল তুললেন তিনি। "দেখুন, ঐ যে ঐ থাঙ্কাটা দেখুন একবার। ...আহা, আবার ঘাড় সোজা করছেন কেন? চোখটা ক্যামেলিয়নের মতো ঘুরিয়ে দেখতে পারছেন না? পারছেন না?" ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের অসহায় চেহারা দেখে ফের চটে উঠলেন তিনি, "আপনারা সুরৎ পাল্টে রাষ্ট্রদূত হবেন ভিসি হবেন এম্পি হবেন ডিজি হবেন কিন্তু চোখটা মাথার পেছনে টেরিয়ে ঘোরানোর খাটনিতে যাবেন না। যতসব আলসে লোকজন।" হাতের কাছে এক সচক্র দাঁড়ে ঝোলানো একটা আয়না টেনে আনলেন তিনি। "নিন, এই যে এটায় চোখ রেখে দেখুন। আলতামাশ ক্ষৌরসভায় শুধু ঘাড়ের রোঁয়া কেমন ছাঁটা হলো, সেটা দেখে পার পাওয়া যায় না, হুঁহুঁ।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের আয়নায় চোখ রেখে একটু চমকে উঠলেন। "বাহ... ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে স্যার। আপনার কাঁখে যিনি চড়েছেন, উনি কি আমাদের ভাবী?"
কিংকু চৌধারি ফিসফিস করে বললেন, "স্যার, অপেরা গ্লাসটা আমাকেও ধার দেবেন কিন্তু।"
ঝাকানাকা অপেরা গ্লাসে চোখ রেখে টঙ্গাটা দেখতে দেখতে বললেন, "আপনি একটু আশেপাশে চোখ রাখুন।"
আলতামাশ নরুণিয়া আয়নাটা ঠেলে দূরে হটিয়ে দিলেন, "দ্যাট'স নান অফ ইয়োর বিজনেস। ...বাহামায় ছুটিতে সেইলিং করতে গিয়ে তুলেছিলাম ছবিটা।" কাঁচিটা আনমনে খচখচালেন তিনি। "আহ, সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি। ...কিন্তু কথা সেটা নয়। দেশে ফেরার পথে ভাবলাম, এসব স্মৃতি তো আর আমলোকের কায়দায় ছাপালে চলে না। চলে গেলাম তিব্বতে। এক গুম্ফায় সাধুরা বছরভর বসে বসে থাঙ্কা আঁকে, সেখানে গিয়ে সদর দরজায় ঘা দিলাম। প্রথমটায় ওরা আমায় হাঁকিয়ে দিচ্ছিলো, যখন শুনলো, কালাই লামা আমাকে ছাড়া কারো হাতে চুল ছাঁটান না, তখন নিমরাজি হয়ে দোর খুলে দিলো...।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের একটু যেন কিলবিলিয়ে উঠলেন, "কিন্তু স্যার, কালাই লামার মাথায় তো চুল নেই...।"
আলতামাশ নরুণিয়ার চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো, তিনি এবার তোয়ালেটা ফের টগবগে পানিতে চুবিয়ে না নিংড়েই ঠেসে ধরলেন ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের তালুতে। "কেন নেই? হুঁ? নেই কেন? কালাই লামার চুল কি বাতাসে পড়ে? হ্যাঁ? একটিবার জীবনে নিজেকে কখনো শুধিয়ে দেখেছেন, কালাই লামার চুল কে কামালো? হ্যাঁ? এই বুদ্ধি নিয়ে রাষ্ট্রদূত হবেন আপনি? আরে, আপনাকে মৌরিতানিয়ায় চাকরি করতে পাঠালে ওরা উটে চড়ে এসে আমাদের দেশে খেজুরের ডাল দিয়ে হামলা করবে!"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের ছটফটিয়ে ককিয়ে উঠলেন, "সরি স্যার সরি স্যার... একদম বুঝিনি যে কালাই লামার মাথায় আপনিই শিল্প করেছেন... খুব ভুল হয়ে গেছে।"
বুড়ো খদ্দের হেঁকে উঠলেন, "স্যার, এর পেছনে যতোগুলো মিনিট খর্চা করবেন, সব মৃগেল হবে। তারচে আমার ওপর কাজ শুরু করে দিন স্যার।"
আলতামাশ নরুণিয়া ঘোঁৎ করে উঠলেন, "হুঁ, সেরকমই তো মনে হচ্ছে! মন খুলে দুটো কথা কইবার মুডটাই মৃগেল করে দিচ্ছেন ইনি। ... যা বলছিলাম, গুম্ফায় গিয়ে ছবিখানা দেখিয়ে ওদের থাঙ্কা-আঁকিয়ে লামাকে বললাম, পাকা কাজ কখনও কাঁচা লোক দিয়ে হয় না। তিব্বতি থাঙ্কা তো আর পাহ্রি-বার্সেলোনায় গিয়ে আঁকানো যায় না। এলাম তোমার কাছে, তুমিই আঁকো। সে ব্যাটা সমানে খোরলো... যাকে বলে প্রেয়ার হুইল... ঘোরায় আর আড়ে-আড়ে একবার আমাকে দেখে, আরেকবার ছবিটা দেখে, আর গুমগুম করে কী যেন মন্ত্র জপে।"
পাটে বসা অন্য দুই অপেক্ষমান খদ্দের ভক্তিভরে বলে উঠলেন, "ওঁ মণিপদ্মে হুম!"
নরুণিয়া আড়চোখে তাদের দিকে চেয়ে বললেন, "দুটোদিন সে ওরকম গোঁ-গোঁ করে কাটিয়ে দিলো। আমি মনে মনে ভাবি, হালার মতলবডা কী? শেষে আড়াই দিনের মাথায় সে খোরলো সাফ করতে করতে আমায় বললো, আচ্ছা করে দেবো। চলো রোদে গিয়ে বসি। আমি হাঁপ ছেড়ে ভাবলাম, যাক, ব্যাটা তবে খোঁড়া অজুহাত দিয়ে আমার চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারটা মৃগেল করে দেবে না। গেলাম তার সঙ্গে, গুম্ফার বাইরে, খোলা আকাশে কটকটে রোদের নিচে। লামা ইয়া বড় এক পেয়ালায় মাখন দিয়ে চা ঘুঁটে একটা কাঠামোয় বনাত চড়িয়ে ধুপধাপ আঁকা শুরু করে দিলো। সুড়ুৎ-সুড়ুৎ তিব্বতি চা খায়, তুলি চালায়, রং গোলায়, আর মাঝেমধ্যে খোরলো ঘুরিয়ে গুমগুম মন্ত্র জপে। আমি তো খুশি। শিল্প তো এমনই হওয়া উচিত। সবকিছু খাঁটি হতে হবে। সেতার শুনতে চাইলে লংপ্লে ছাড়লে চলে? যেতে হবে ওস্তাদ সেতারুর চরণতলে। অঙ্ক কষতে চাইলে খাতা-বিস্কুট নিয়ে যেতে হবে লাইবনিৎসের সমাধিতে। বন্ধুর শোকে মোম জ্বালাতে চাইলে বুনো মৌমাছির চাক থাপড়ে ভেঙে মোম বের করতে হবে দক্ষিণরায়ের মতো।" দেরাজ থেকে ক্ষুর বের করে চামড়ার ফিতের ওপর ঘষে শাণ দিতে লাগলেন তিনি।
কিংকু চৌধারি ফিসফিসিয়ে বললেন, "স্যার, অপেরা গ্লাসটা?"
ঝাকানাকা চোখ রাঙিয়ে ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখলেন। নরুণিয়া ক্ষুর দিয়ে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের তালুর ওপর ঝুঁকে পড়লেন, "ওরকম কিলবিল করবেন না, শেষে পুরো তালুর ছাল উঠে আসবে। মাথার ছাল তোলার শিল্পটা রপ্ত করতে ছ'টা মাস কাটিয়েছি সিউদের সাথে, তারপর একবছর আজারবাইজানে ওয়ার্কশপ করেছি শক আমলে তালু ছালানোর বিলুপ্ত কায়দাটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়। কাজেই হুঁশিয়ার। ... শুনুন তারপর কী হলো। তিব্বতের সেই কটকটে নির্মেঘ আকাশে গুম্ফার উঠোনে বসে বসে মাখন-চায়ে একেকটা নীরব চুমুক দিচ্ছি আর থাঙ্কা-আঁকিয়ে লামা ভদ্রলোকের কাজ দেখছি। হঠাৎ কী শয়তান এসে কানে মুতে দিয়ে গেলো, মনের মধ্যে কুবুদ্ধি চিড়বিড়িয়ে উঠলো। লামাকে বললাম, তা লামা ড্যুড, এই যে তুমি সমুদ্রসমতল থেকে এতো উঁচুতে এই ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুরে গুম্ফায় বসে নির্বাণের লালচে বছরভর রাতদিন ডুগডুগি ঘোরাচ্ছো আর অংবং জপছো, একটিবার কি ইচ্ছে করে না সমুদ্রে নেমে ওরকম একটা ডবকা ছেমরিকে কোলেকাঁখে জাপটে ধরে মাস্তুলে পাল তুলতে?" একটু মনমরা হয়ে কী একটা বোতামে চাপ দিলেন তিনি, অমনি ঘর কাঁপিয়ে মিতা লঙ্গেশকরের গান বেজে উঠলো, "বাহামা যাতি হুঁ ওয়াহি চলে আতে হো, চোরি চোরি মেরে দিল মে সামাতে হো, ইয়ে তো বাতাও কে তুমমমমমমম মেরে কৌন হো?"
বুড়ো খদ্দের কেশে উঠলেন, "স্যার, এই গানটায় কথাটা একটু মৃগেল মেরে গেছে মনে হচ্ছে!"
আলতামাশ নরুণিয়া চোখে জহুরির ভারিক্কি চশমা এঁটে নিলেন, তাতে কয়েক পরত কাচের কোরক[৬] বসানো। "উঁহু স্যার, এ খোদ মিতা লঙ্গেশকরেরই গাওয়া। প্রথম যেবার বাহামা গেস্লাম, সেবার ছুটি শেষে বম্বে হয়ে ফিরলাম। লঙ্গেশকরজি অনেকদিন থেকেই বলছিলেন, ওনার চুল একটিবার ড্রেস করে দিতে। আমার শিল্প দেখে উনি এমনই খুশি হলেন, একেবারে গোঁ ধরে বসলেন, একটা গান তিনি আমার জন্যে গাইবেনই। কী আর করা, বললাম এটা গেয়ে দিন তবে। ... যা বলছিলাম, তো প্রশ্নটা শুধানোর ফাঁকেই যেই না সানস্ক্রিনের বোতলটা খুলে এক খাবলা হাতে মুখে মাখলাম, অমনি লামা ব্যাটা কেমন যেন ছটফটিয়ে উঠে খোরলো ফেলে গুমগুমানি থামিয়ে তুলি খাপে গুঁজে চায়ের কাপে কড়কড়াৎ চুমুক দিয়ে আমায় বলে, "দ্যাখো মান, আমি বাহামারই লোক। সেই ছোকরাবেলা থেকে ছেমরিদের ঘাড়ে নিয়ে সেইলিং করতে করতে শেষটায় স্পন্ডিলাইটিস হয়ে গ্যালো, মান। তিতিবিরক্ত হয়ে শেষে ঠিক করলাম, আর না, তিব্বত চলে যাবো, মান। তারপর এই গুম্ফায় বসে বসে, মান, থাঙ্কা আঁকছি গত কুড়িটি বছর ধরে।" তারপর সে আমায় চোখ রাঙিয়ে বলে কী, শুনুন। "যদি আমায় দিয়ে থাঙ্কা আঁকাতে চাও, এই সানস্ক্রিনের বোতল এই গুম্ফার বাইরে ফেলে দিয়ে গা ধুয়ে এসো। নো মান, আই কান্ট স্ট্যান্ড দিস স্টেঞ্চ। সেই ছেলেবেলা থেকে দেশি-বিদেশি ছেমরিদের গায়ে সানস্ক্রিনের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমার আত্মাটাই পইচ্যা শ্যাষ, মান।" তারপর সে আবার খোরলো ঘোরাতে ঘোরাতে গুমগুম করে উঠলো। তখন আমি খুউপ ঠাহর করে শুনে দেখি, ওটা মণিপদ্মে হুম নয়, বরং হ্যারি বেলাফন্টের জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল। বুঝুন অবস্থা!" কেমন যেন রাগ-রাগ মুখে ক্ষুর দিয়ে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের মাথায় সূক্ষ্ম নকশা কাটতে লাগলেন তিনি। "যে আমি কখনও পাকা শিল্প কাঁচা লোকের হাতে দিতে চাই না, সে আমিই কেমন ঠকে যাচ্ছিলাম! দিনকাল যা পড়েছে, সবকিছু মৃগেল হচ্ছে।" ওদিকে মিতা লঙ্গেশকরের গানটা ফুরোলো, নতুন গান বেজে উঠলো, "বাহামা চলে আআআআওওওও, হো হামসে সনম কেয়া পর্দা, হোওওওও হামসে সনম কেয়া পর্দা।"
[৬] কোরক = লেন্স।
বুড়ো খদ্দের বললেন, "মিতা লঙ্গেশকর দেখছি আপনার জন্যে গান গাইতে খুব তৎপর, স্যার!"
আলতামাশ নরুণিয়া চোখ থেকে জহুরির চশমা খুলে কটমটিয়ে চেয়ে বললেন, "এ গানটা মিতা লঙ্গেশকর গাননি! শুনেও বুঝতে পারছেন না, এটা ওঁর গান মৃগেল করে হালের কোনো ছুকরি গেয়েছে? এই বুদ্ধি নিয়ে আপনি ভিসি হবেন? আরে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে তো গরুগাধাও পাশ করে যাবে!"
বুড়ো খদ্দের গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "সে তো বহু আগে থেকেই যাচ্ছে। একটা গাধাকে চিনি, পাশ তো সে করেছেই, এখন রাষ্ট্রদূত হবে বলে সুরৎ খোলতাইয়ের চেষ্টায় আছে।" ঘাড়বাঁকা খদ্দেরকে ছটফটিয়ে উঠতে দেখে মিটিমিটি হাসলেন তিনি, "সিস্টেমটা গোড়ায় মৃগেল করা স্যার। তবে আপনি যদি দয়া করে এই চুলের ফকির লোকটাকে জলদি বিদায় করে আমার দিকে একটু নেকনজর দিতেন, হয়তো একটা ফাইটিং চান্স কাজে লাগালেও লাগাতে পারবো। একেবারে খোল-নলচে...।"
ক্ষৌরসভার পেছনদিকের দরজায় বাইরে থেকে কে যেন দুমদাম ঘা মারলো।
আলতামাশ নরুণিয়া ক্ষুর খাপে পুরে বিরক্তমুখে উপনিবেশ আমলের সায়েবি কেতায় হেঁকে উঠলেন, "এন্টার!"
রঙের বালতি আর তুলি হাতে ওভারল-পরা ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক লোক দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে বললেন, "কাজ হয়ে গেছে, স্যার। একটু যদি দেখে দিয়ে সইটা করে দিতেন...?"
আলতামাশ নরুণিয়া জহুরির চশমার আড়াল থেকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, "সিসিটিভিটা চেক করেছেন তো? নাকি শুধু সাইনবোর্ডে পোঁচ মেরেই চলে এসেছেন?"
বাবরিচুল কাঁচুমাচু মুখে বললেন, "সিসিটিভি তো স্যার সপ্তায় সপ্তায় এসে দেখে যাচ্ছি, কোনো সমস্যা নেই। আর সাইনবোর্ড স্যার... ঠিক করে দিয়েছি।"
আলতামাশ হাতে কিল মেরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, "গোয়েন্দা ঝাকানাকাকে সুপারি খাইয়েছি! এবার ধরা পড়বিই পড়বি! ...আর একবার যদি ধরতে পারি, কোন সে রাস্কেল সপ্তায় সপ্তায় এসে আমার নামের শেষে আ-কার এঁকে আমার সাধের ক্ষৌরসভার সাইনবোর্ড মৃগেল করে... হাড্ডি-গোস্তো আলাদা করবো! হাড্ডি যাবে চিরুনির কারখানায়, গোস্তো যাবে মাছের ঘেরে!" মঞ্চ ছেড়ে দুপদাপ করে পেছনের দরজা দিয়ে বাবরিচুলের পিছু পিছু বেরিয়ে গেলেন তিনি।
কিংকু চৌধারি ফিসফিসিয়ে বললেন, "স্যার, এই যে কে বা কাহারা আলতামাশের শেষে আ-কার ঠুকে আলতামাশা বানিয়ে যাচ্ছে... আলতামাশা নামটা কি খুব খারাপ?"
ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে গোঁফে তা দিয়ে বললেন, "যার নাম, সে-ই ভালো জানবে। এখন চুপ করে আড়ি পাতুন।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের ঘাড় সোজা করে উঠে বসতে গিয়ে ককিয়ে উঠলেন, "বাপ রে! ঘাড়টা মনে হয় পাকাপাকি বাঁকা হয়ে গেলো।" রক্তচক্ষু মেলে বুড়ো খদ্দেরের পানে চাইলেন তিনি। "সেই তখন থেকে আমাকে হটিয়ে সিটে বসতে চাইছেন দেখছি! আপনার সমস্যাটা কী?"
বুড়ো খদ্দের উঠে গিয়ে খানিক দূরে রাখা কফির যন্ত্র থেকে কাগজের খোলে কফি গড়িয়ে নিচ্ছিলেন, তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, "বয়স। সময় নেই হাতে। যে কোনো সময় পড়ে মরে যেতে পারি। এখন এই অসময়ে লাইনে দাঁড়াতে গেলে ঐ হতচ্ছাড়া আলতাব নিউটন আর ইসরাফিল পাস্কেল, দুই বিটকেলের যে কোনো একটা আমায় টপকে ভিসি হবে।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের আসনে বসে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে ফের ককিয়ে উঠলেন, "তা ভিসি হয়ে কী এমন হাতিঘোড়া মারবেন আপনি?"
বুড়ো খদ্দের আসনে বসে পায়ের ওপর পা তুলে নাচাতে নাচাতে বললেন, "বললাম না, খোল-নলচে পাল্টে দেবো একেবারে?" কফির খোলে গগনবিদারী এক চুমুক দিলেন তিনি। "সেদিন লাউঞ্জে ঢুকেই দেখি, নিউটন তার এক চামচার সাথে বসে বসে খুবসে বেলা বিস্কুট চাবাচ্ছে চায়ে চুবিয়ে। আমি সাথে সাথে রসায়নের প্রফেসর বিসমাথ জেরিনের আড়ালে চলে গেলাম। আমি যেমন তালপাতার জেনারেল, তিনি তেমনি দশাসই। বিসমাথ ম্যাডামের আড়ালে চলতে চলতে নিউটন গদিচোরার কাছে গিয়ে কান পেতে শুনি, বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে সে। ভিসি হলে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের খোল-নলচে পাল্টে দেবে সে। তার ফন্দি শুনে আমি হেসেই খুন!"
বাকি দুই অপেক্ষমান খদ্দেরের একজন সাগ্রহে শুধালেন, "কী ফন্দি? কী ফন্দি?"
বুড়ো খদ্দের সন্দিহান চোখে তাদের দিকে চেয়ে নীরবে কফি পান করলেন খানিকটা, তারপর বললেন, "আর এই তো সেদিন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি সিঁড়ির নিচে ইসরাফিল পাস্কেল দুটো সাগরেদ জুটিয়ে তিনমাথা এক করে ফিসফিস ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। পরিসংখ্যানের মাউড়া লেকচারার মিদিয়ান মোদী যাচ্ছিলো পাশ দিয়ে, হতভাগা একে কচিমুখো তার ওপর মাকুন্দ, ছাত্রদের সামনে রাশভারি ভাব নিতে সে নকল গোঁফদাড়ি পরে ক্লাসে আসে... আমি তখন তার পরদাড়িটা ধার নিয়ে ছদ্মবেশ ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনি, পাস্কেলের সে কী অ্যামবিশাস পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা... ভিসি হয়ে সে নাকি খোলনলচে পাল্টে ফেলবে। তার ফন্দি শুনে হাসির চোটে আরেকটু হলেই ছদ্মবেশ খোয়াচ্ছিলাম আর কী!"
সেই দুই খদ্দেরের অপরজন ছটফটিয়ে উঠলেন, "কী ফন্দি? কী ফন্দি?"
আলতামাশ নরুণিয়া এ সময় ফের ঢুকলেন মঞ্চে। "এ কী!" গর্জে উঠলেন তিনি, "আপনি উঠে বসেছেন কোন সাহসে? য়্যাঁ? মাঝশিল্পে এভাবে উঠে বসার অর্থ কী?"
বুড়ো খদ্দের কফির কাপ নামিয়ে গর্জে উঠলেন, "স্যার ওর যতটুকু চুল আছে, ধরে বার করে দিন!"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের আলোর বেগে ফের ঘাড় মুচড়ে আসনে হেলান দিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, "সরি স্যার, সরি স্যার... খুব ভুল হয়ে গেছে! আসলে প্রথম এসেছি তো... কতকিছু জানা বাকি!"
অপেক্ষমান দুই খদ্দেরের একজন অনুযোগের সুরে বললেন, "ওনাকে গত দেড়টা বছর ধরে আমাদের কোচিং সেন্টারের প্রস্পেক্টাস দিয়ে আসছি স্যার। উনি কিছুতেই ভর্তি হবেন না, এমনই হাড়কঞ্জুস!"
ঝাকানাকা একটু চমকে উঠে বললেন, "কোন কোচিং সেন্টারের লোক এরা?"
কিংকু চৌধারি এবার খানিক বেশি জানার আনন্দে ফুলেফেঁপে উঠে বললেন, "এই যে স্যার, পেছনের গলিতে কোচিং খুলেছে ওরা... আলতামাশ ক্ষৌরসভায় ভর্তি কোচিং। ক্ষৌরসভায় অ্যাডমিশন পেতে ভর্তি পরীক্ষা হয়, সেটার ওপর কোচিং হয় এখানে।" কাগজের আড়াল থেকে আঙুল তুললেন তিনি। "ঐ যে, ডানের জন কোচিঙের কোচ, বামের জন নবিশ, হালচাল সরজমিন শিখতে এসেছে।"
ঝাকানাকা চিন্তিত মুখে বললেন, "আই সি! খুব কড়াকড়ি দেখছি। যাদের খুঁটির জোর নেই, তারা খেটেখুটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তবে চুল ছাঁটাতে আসে?"
কিংকু চৌধারি সবেগে মাথা নাড়লেন। "খুঁটির জোর যাদের আছে, তারাও আসে স্যার। কোনো নুড়িই ওল্টাতে বাকি রাখে না আর কি।"
আলতামাশ নরুণিয়া এবার একটা ভোঁতা ক্ষুর বের করলেন দেরাজ থেকে। "ঈশ্বরকে ঈশ্বরের জিনিস, সিজারকে সিজারের জিনিস, আর কোচিং সেন্টারকে কোচিং সেন্টারের জিনিস দিতে শিখুন স্যার। দেড়টা বছর ফোনে-ইমেইলে-চিঠিতে-টেলিগ্রামে আমার সেক্রেটারিকে নাহক না জ্বালিয়ে যদি কোচিং করতেন, কবেই রাষ্ট্রদূত হয়ে বাহামা চলে যেতে পারতেন।" আয়নাটা ফের ধরে তিব্বতি টঙ্গাটা ঘাড়বাঁকা খদ্দেরকে দেখালেন তিনি।
ঘাড়বাঁকা খদ্দের শিহরিত হয়ে বললেন, "দোয়া করুন স্যার। আরেক্টু দয়াও করুন। আপনার শিল্পই এখন ভরসা।"
বুড়ো খদ্দের হেঁকে বললেন, "...যা বলছিলাম স্যার, খোলনলচে পাল্টে দেবো! আলতাব নিউটন খুব মতলব কষছে, ভিসি হলে সে মেয়রদের সাথে বসে পুরো শহরে উল্টোপথে ভার্সিটির বাস চালানোর অনুমতি আদায় করে ছাড়বে। আর ইসরাফিল পাস্কেল ভিসি হয়ে বিপ্লবে প্রক্সির ব্যবস্থা চালু করতে চায়। রেজিস্টার্ড মিছিলিয়া আর বন্ধনীয়া থাকবে, তারা ছাত্রদের হয়ে মিছিল-মানববন্ধন করে বেড়াবে। কী হাস্যকর!" কফির খোলে শেষ চুমুক দিয়ে খোলটা মেঝেতে ছুড়ে ফেললেন তিনি।
আলতামাশ নরুণিয়া হালচাল-অজ্ঞ ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের কানের পেছনটা কামাতে কামাতে বললেন, "আর আপনি যেন কী করতে চাইছিলেন? নয় টাকায় এককাপ চা, একটা শিঙাড়া, একটা চপ আর একটা সমোচা খাওয়াবেন?"
বুড়ো খদ্দের গর্ব-লজ্জায় রেঙে উঠে বললেন, "আর একটা ফরচুন কুকি!"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের নাক সিঁটকে বললেন, "লেখাপড়া-গবেষণার জন্যে কিছু করবেন না? নাকি ওগুলো মৃগেল হয়ে থাকবে?"
বুড়ো খদ্দের গর্জে উঠলেন, "এহ, নিজে যেমন খুব লেখাপড়া-গবেষণা করে উল্টে ফেলেছিলেন, হ্যাঁ? খালিপেটে কোনোকিছুই ভালোমতো হয় না স্যার! পেট ভরা থাকলে আমাদের মেকানিকরাও ওসব কোয়ান্টাম-ফোয়ান্টাম করে ফাটিয়ে ফেলতো।" বসার ধরন পাল্টে এবার অন্য পা নাচাতে লাগলেন তিনি। "রাষ্ট্রদূত যদি হতে পারেন এ জন্মে, সায়েবসুবোদের সামনে গিয়ে এই আমার অজর কীর্তিকেই তুলে ধরতে হবে আপনাকে।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের বুড়োকে আর পাত্তা না দিয়ে আহ্লাদি সুরে বললেন, "তারপর কী হোলো স্যার তারপর কী হোলো? আপনি তখন কাকে দিয়ে থাঙ্কা আঁকালেন?"
আলতামাশ নরুণিয়া গরম পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফের খাপ থেকে ক্ষুর বের করলেন, "সেই বাহামার লামাকে দিয়েই। প্রথমে মেজাজটাই বিগড়ে গেস্লো, কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম... তিব্বতে জন্মে তিব্বতে থেকে লামা হওয়া যতোটা সোজা, বাহামায় জন্মে বাহামার মায়া কাটিয়ে তিব্বতে এসে লামা হওয়া ততোটাই কঠিন। এ ব্যাটার মধ্যে সাধনা আছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সানস্ক্রিনের বোতল বোঁচকায় ভরে হাজারখানেক ফুট নিচে নেমে এক সরোবরে গোসলটোসল করে ফিরে গেলাম গুম্ফায়।" টঙ্গাটার দিকে তৃপ্ত মুখে ক্ষুর হাতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন তিনি। "গুম্ফার হেড লামার কাছে বিদায় নিতে গিয়ে যখন এ উপলব্ধির কথা খুলে বললাম, ব্যাটা শুধু মুচকি মুচকি হাসে। হাত তুলে আশীর্বাদ করে জ্যাঠালামা বললেন, "তোমার অন্তর্চক্ষু আছে। অন্য কেউ হলে রাগ করে চলে যেতো পাহ্রি কিংবা বার্সেলোনা, গিয়ে কোনো ভেজাল লামাকে ফরমায়েশ দিতো। খাঁটি লামা ছাড়িয়া যে নেয় নকল লামা, সে জন লামা চেনে না।" বাহামার লামার খুব সুনাম করলেন তিনি। বললেন, তিব্বতে এখন প্রকৃত সাধকের বড় আকাল। আগে যে লামা থাঙ্কা আঁকতো, সে হঠাৎ একদিন রাস্তাফারিয়ান হয়ে বাহামা চলে গেছে।" বজ্রমুষ্ঠিতে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের চুল পাকড়ে ধরলেন তিনি। "নড়বেন না, এখন খুব ক্রিটিকাল কিছু টান দেবো।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের থুতনি কাঁধে গেঁথে গেলো যেন, তিনি গোঁ গোঁ করে বললেন, "ছাদের ছবিগুলো... বন্ধ করে দেওয়া যায় না স্যার? যতবার দেখি, বুকটা কেমন যেন ধুকপুক করে ওঠে।"
আলতামাশ নরুণিয়া ক্ষুর চালানোর ফাঁকে বললেন, "না। এ ক্ষৌরসভায় যখন যা চলে, চলতে থাকবে। সবই এক বৃহৎ শিল্পের অংশ।" আড়চোখে ছাদে ভেসে ওঠা ছবিটা দেখে নিলেন তিনি। "আহ, কোপাকাবানা! ওপাড়ার লোকজন বড় ভালোবাসতো আমায়, বিশেষ করে মেয়েলোকজন।" ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের চুল তার ঝাপটায় এলোমেলো হয়ে গেলো। "কবে যেন একবার গেলাম... সেভেন্টিথ্রি নাকি সেভেন্টি ফোরের শুরুতে... রাতভর নাচগান হল্লাফুর্তি চিকেনকোকেন শিল্পটিল্প উড়িয়ে সেনিয়োরা আলাদিনিঞোর সরাইতে কখন যেন ফিরে চিৎপাত হয়ে ঘুমাচ্ছি, বিকেলের দিকে বুড়ি এসে দরজা খটখটানো শুরু করেছে, উঠুন দম নরুনিঞো, ছেলেপেলে দেখা করতে এসেছে। আমি কোনোমতে উঠে একটা খবরের কাগজ পরে বের হয়ে দেখি, কতগুলো চ্যাংড়া ছোকরা আর একটা টুপি পরা ধেড়ে লোক নিচে উঠোনে দাঁড়িয়ে। কারো হাতে ফুল, কারো হাতে বোতল, কারো হাতে পুরিয়া... সবাই কেমন হাতজোড় ছলোছলো খুশিখুশি। আমি হাত নেড়ে হ্যালো বলতে না বলতেই ছোকরার দল ডুকরে উঠলো। কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, আর কী যেন শোরগোল করে। শেষে পেছনে দাঁড়ানো ধেড়ে লোকটা টুপি খুলতেই দেখি ও মা, বুড়ি আলাদিনিঞোর কথাই সত্যি, দশটা ছেলের সাথে এ যে পেলে!" ঘাড়বাঁকা খদ্দের হাউমাউ করে উঠতেই তিনি বিরক্ত মুখে পচনরোধী মলম আর বাঁধুনির বাক্স বের করলেন দেরাজ থেকে।
বুড়ো খদ্দের সোৎসাহে নড়েচড়ে বসলেন, "স্যার এ ছিঁচকাঁদুনেটাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিন। আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে!"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের ফুঁপিয়ে উঠলেন, "বাহামায় পোস্টিং পেলে স্যার এক-দুই কাপ রক্ত বেরোলেও ক্ষতি নেই। তারপর কী হোলো স্যার?"
খদ্দেরের তালুতে ব্যান্ডেইড সেঁটে নরুণিয়া খানিক পিছিয়ে এসে খদ্দেরের আসনটা এদিকসেদিক ঘুরিয়ে নিজের শিল্পকর্ম খানিক দূর থেকে দেখে নিলেন। "যা হয় সচরাচর। পেলে পাকা লোক, আবেগ সামলে আমার দস্ত পাকড়ে বললো, "দম নরুণিঞো! তুমি দুনিয়াকে ব্রাজিল চিনিয়েছো সেনিয়োর!" পেলের মুখে এ কথা শুনে তো আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। মৃদু প্রতিবাদ করলাম, কিন্তু ছেলে আর পেলে সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলো। পেলে রুমালে চোখ মুছে বললো, "বছরখানেক আগেও কোপাকাবানার সৈকতে গেলে মনে হতো আমাজনের জঙ্গলে ঢুকেছি। তোমার শিল্প আজ এ মহল্লার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। ধন্য তুমি, ধন্য তোমার ব্রাজিলি মোমকলা!" আরেক ছোকরা তো কেঁদে আকূল, "আকাশের মতো উদার তোমার মন, দম নরুণিঞো! নইলে এ মোমশিল্পের নাম তুমি নিজের নামে না রেখে ব্রাজিলের নামে চালাবেই বা কেন, আর আমাদের জীবনটাই বা ফুলেফলে ভরে তুলবে কেন?" আরেক ছোকরা বলে, "রোম ওয়াজন্ট বিল্ট ইন আ ডে... কিন্তু এখন পাঁচ মিনিটেই রোমান অসভ্যতার জড় উপড়ে ফেলা যায়। মুইতো অব্রিগাদো সেনিয়োর, মুইতো অব্রিগাদো!" পেলে সবাইকে ধমকে ভাগিয়ে জোর করে আমার হাতে এক তোড়া টিকেট গছিয়ে গেলো। শিল্পের চাপে ফুরসৎ পাইনি বলে সেভেন্টিফোরের বিশ্বকাপটা আর দেখা হয়নি।"
কিংকু চৌধারি ফিসফিসিয়ে শুধালেন, "স্যার, এ কোন মোমকলার কথা হচ্ছে? মাদাম তুসোর মতো কিছু নাকি?"
ঝাকানাকা খুব গম্ভীর মুখে বললেন, "রোমের কথা উঠেছে যখন... আয়াম অ্যাফ্রেইড, এ মোম সে মোম নয়।"
আলতামাশ নরুণিয়া ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "নিন্দুকেরা বলে, আমার ব্রাজিলি মোমকৌশলের কারণেই নাকি সেবার ব্রাজিলে ফুটবলে মড়ক লাগে। পেলে তো অবসরেই গেস্লো, ছেলেদেরও ফুটবলে তেমন মন বসেনি আর। কোপাকাবানাতেও এরপর উটকো লোকের ভিড় এমন বাড়লো, দশ-বারো বছর আর ওদিকটায় যাইনি।" ফের কাঁচি হাতে নিলেন তিনি। "ব্রাজিলমোমের ঘোর কাটতে খোদ ব্রাজিলের ফুটবলারদেরই কুড়িটা বছর লেগে গেলো। পরের বিশ্বকাপ জিতেছে তারা নাইন্টিফোরে।" সলজ্জ হাসি ফুটলো তার মুখে। "চ্যালেঞ্জিং টাইমস পত্রিকায় হেডলাইন হয়েছিলো, Waxing Gibbous in the Brazilian Sky।" নাক সিঁটকালেন তিনি। "এইটিএইট বা নাইনের দিকে আর্জেন্টিনা গেস্লাম, ব্রাজিলি মোমকলার ওপর একটা কর্মশালা করাতে... বাকিটা ইতিহাস।"
কিংকু চৌধারি রূদ্ধশ্বাসে বললেন, "স্যার... তবে কি... তবে কি...?" ঝাকানাকা খুব গম্ভীর হয়ে ঠোঁটে তর্জনী রাখলেন।
কিন্তু কিংকুর মন থেকে যেন প্রশ্নটা ছিনিয়ে নিয়ে উত্তর যোগালেন আলতামাশ নিজেই, "সেজন্যেই হারাধন মারাদোনাটা সেই নব্বই সাল থেকেই আমার ওপর চটা। আগে মাঝেমধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হাইহ্যালো ওলামিআমিগো হোতো, কিন্তু নব্বইয়ের পর...," চিরুনি দিয়ে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের চুল আঁচড়ানোর ফাঁকে গুনগুনিয়ে উঠলেন তিনি, "টগবগ টগবগ ঘোড়ায় চড়ে রাজার কুমার এলো...।"
অমনি বুড়ো খদ্দের আর কোচিং সেন্টারের দুই শিল্পরসিক তিনজন মিলে তিন সুরে সংগীতি মিলিয়ে গেয়ে উঠলেন, "...রাজকুমারী তোমার মাথায় এত চুল কে দিলো?"
কিংকু চৌধারি আর ঝাকানাকা দু'জনই চমকে উঠলেন। কিংকু দারোগা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, "স্যার, এখানকার হালচাল তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওরকম ডুকরে ওঠার মানে কী?"
ঝাকানাকা নিজের খবরের কাগজটা কিংকু চৌধারির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দু'হাতে নিজের গোঁফ টানতে লাগলেন, "নাপিতচৌরাগ... যাকে বলে বারবারশপ কোয়ার্টেট। মনে হয় এ ক্ষৌরসভায় এটাই রীতি।"
খদ্দেরদের পরিবেশনায় তুষ্ট হয়ে নরুণিয়া হাসিহাসি মুখে কাঁচির খচৎকারে মঞ্চ কাঁপিয়ে তুললেন, "কিন্তু কথা সেটা নয়। বলছিলাম যে নিজের কলা কখনও অন্যের হাতে তুলে দেবেন না। দিলেই সে ছুলে সে কলা আধেক ন্যাংটো করে রাখবে। কলাভুনা যেবার পিকাসো সংখ্যা ছাপালো, আমার কাছে এসেছিলো আর্ট নিয়ে দুটো কথা টোকাতে। প্রশ্নের ছিরি শুনুন, "আপনার চোখে আর্ট কী, বুঝিয়ে বলুন?" আমি সরাসরি বলেছি, কলা যেমন বোঁজানো যায় না, তেমনই বোঝানোও যায় না। আর্ট বোঝানো মানে পাকা হাতের আর্টের ভার কাঁচা মাথায় তুলে দেওয়া। ব্যাটারা সেই কথা হুবহু ছাপলো ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে আমার এক পোরট্রেট জুড়ে দিলো পৃষ্ঠা জুড়ে। আর সেটা কার আঁকা? মকবুল ফিদা? ব্যাঙ্কসি? রিখটার? আমার মাপের কেউ? নো স্যার। আপনাদের মৃগেল হক।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের ডুকরে উঠলেন, "স্যার চিরুনিটা তালুতে কামড়াচ্ছে!"
নরুণিয়া গর্জে উঠলেন, "চিরুনির দাঁত আছে, কামড়াবে না তো কি চুমো খাবে? ...কই মাছের মতো ওরকম ঘাই মারবেন না। মৃগেইল্লার সেই আলেখ্য ছড়িয়ে গ্যালো সবখানে, সবখানে, সবখানে। চ্যালেঞ্জিং টাইমস পত্রিকা যেবার কলাজগতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার স্বীকৃতি দিয়ে আমাকে আরসন অফ দ্য ইয়ার ঘোষণা করলো, তারা কোথাকার কোন ময়লার ডিপো ঘেঁটে বের করে আনলো মৃগেল হকের সেই পোরট্রেটখানাই। আমি ওদিকে ফ্লোরেন্স বিয়েনালে গিয়ে পড়েছি লজ্জায়। বন্ধু শিল্পীরা এসে আমায় চ্যালেঞ্জিং টাইমসের পাতা খুলে দেখিয়ে বলে, আরে এ বছর আরেক বদসুরৎ আলতামাশ আরসন অফ দ্য ইয়ার হয়েছে, শুঞ্ছো নাকি? আমি না পারি তাদের দুষতে, না পারি জোরগলায় "আমিই সেই আলতামাশ" বলতে।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের কেমন যেন গদোগদো গলায় বললেন, "কিন্তু কলাভুনার রামকিঙ্কর সংখ্যায় দেখলাম ওরা হকসাহেবকে "মৃগেলাঞ্জেলো" ডাকছে।"
সূচপতন নীরবতা নেমে এলো অ্যাম্ফিথিয়েটারে।
তর্জনগর্জন শুরু হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করে কিংকু চৌধারি ফিসফিসিয়ে শুধালেন, "স্যার, পত্রিকাটার নাম কলাভুনা? আংরেজিতে লেখা বলে আমি এতোদিন কালাভুনা বলে আসছি!"
ঝাকানাকা সন্দিহান চোখে কিংকু চৌধারিকে দেখে নিয়ে বললেন, "আপনি কলাভুনা পড়েন নাকি?"
কিংকু চৌধারি লাজুক মুখে বললেন, "আমি তো স্যার চোরডাকাত পেঁদিয়ে ন'মাসে ছ'মাসে একবার পড়াটড়ার সময় পাই, তাই ষান্মাসিক পত্রিকাগুলোই পড়া হয় বেশি। গাড়ি জামে আটকালে বসে বসে পড়ি। যা পাই তাই পড়ি স্যার... দৈনিক কচুবনের "কিশোরকচু", পক্ষী সংসদের "বুনো আউল বাঘা ফাউল", ফারুক সরোবর মুস্তফির "লিটনের ফ্ল্যাপ", আনন্দেবেজার গোষ্ঠীর "বংলা বনান বনফয়র"... কলাভুনাটা এতোদিন কালাভুনা ঠাউরে অনেক পড়েছি।"
বুড়ো খদ্দের ওদিকে হেঁকে মারমুখো নরুণিয়াকে উৎসাহ দিচ্ছেন, ঘাড়বাঁকা খদ্দেরও আসন আঁকড়ে খুব কাকুতিমিনতি করছেন, ঝাকানাকা সেদিকে মন না দিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন, "হুমম, ঐ পিকাসো সংখ্যা থেকেই আলতামাশ নরুণিয়া আর মৃগেল হকের রেষারেষি শুরু।"
কিংকু চৌধারি পত্রিকার পাতাটা উল্টে ফের ভোঁ-সওয়ার অর্ধাবৃতা মালবালার ছবিটা সামনে ধরে বললেন, "স্যার, যদিও সবাই মৃগেল সাহেবের ছবি নিয়ে হাসাহাসি করে, নিচে আলাদা করে লিখে না দিলে কিংবা পাশে একটা ক্যামেরা-পাশ ছবি জুড়ে না দিলে ওগুলো কার ছবি কীসের ছবি অনেক সময় বোঝা যায় না, কিন্তু একবার উনি আমাদের খাটনি কমিয়েছিলেন, মনে আছে?"
ঝাকানাকা নাক টেনে বললেন, "কোনবার যেন?"
কিংকু চৌধারি বললেন, "সেই যে স্যার, বদরু খাঁ যেবার চিত্রকরদের মডেল সেজে জাদুঘর থেকে প্রদর্শনীতে আসা দা ভিঞ্চির একটা চোথা চুরি করলো? ভুলে গেছেন? মৃগেল হকেরই নুড চিত্রবালা সেজে ছিলো বদরু হতভাগাটা। তো হকসাহেব খুব মুষড়ে পড়েছিলেন ঘটনাটার পর, বারবার টয়লেটে গিয়ে হাত ধুয়ে আসছিলেন...। যাই হোক, তখন তো আর সিসিক্যামের এমন ছড়াছড়ি ছিলো না, আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে বদরুর ছদ্মবেশের একটা আন্দাজ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তখন হকসাহেব এসে বললেন, উনি একেবারে পোরট্রেট এঁকে দেখিয়ে দেবেন বদরু দেখতে কেমন ছিলো।"
ঝাকানাকা বললেন, "আহ, দা ভিঞ্চির চোথা লুটে সেবার বদরু একেবারে বোলতার চাকে খোঁচা মেরেছিলো!"
কিংকু চৌধারি বললেন, "হ্যাঁ স্যার। বর্ডার টপকে পালাতে গিয়ে সত্যিই এক বোলতার চাকে খোঁচা দিয়ে বসেছিলো বিটকেলটা। যদিও একটা ডোবায় ডুব দিয়ে সারাদিন বসেছিলো বদরু, বোলতারা ঐ ফাঁকেই ঝাঁক বেঁধে হুল ফুটিয়ে ওর চোখমুখ ফুলিয়ে এমন বরবাদ করে দিলো... আর সেটা হুবহু মিলে গ্যালো মৃগেল হকের আঁকা পোরট্রেটের সাথে! ... ডোবা থেকে ওঠার পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিডিআরের হাতে সে বমাল ধরা পড়ে।"
ওদিকে মঞ্চে নরুণিয়া সমানে গর্জাচ্ছেন, "...মডেল খাড়া না করে মৃগেইল্লা কিছুই আঁকতে পারে না, জানেন? ঐ যে লাইলী রোডের মোড়ে কাজীসাহেবের একটা পাঁচতলা উঁচু পোরট্রেট টাঙিয়েছে... সেটা সে এঁকেছে জামরুন্নেসা স্কুলের পেছনের গেটে বসে, এক ব্যাটাকে গরাদ ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে। প্রথমে একটা ফুচকাওলাও এঁকে ফেলেছিলো, পরে লোকজন ব্রিটিশ আমলে হাজতের ভেতরে ফুচকাওলা থাকতো না বলে আপত্তি তোলায় সেটা রং দিয়ে ঢেকেছে। আপনি জানেন, আহমদ ছফা বলেছেন যে প্রফেসর রাজ্জাক বলেছেন যে প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন যে "বজ্র-বিদ্যুৎ-ফুল এই তিনে নজরুল", কাজীসাহেবের ঐ পোরট্রেট দেখে সে কথা কারো মাথায় আসবে? ...কলাভুনা তাকে মৃগেলাঞ্জেলো বললেই হোলো?"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের ফুঁপিয়ে উঠলেন, "স্যার ক্ষুরটা একটু সরালে হয় না?"
বুড়ো খদ্দের ছটফটিয়ে উঠে বললেন, "এই হতভাগাটা নির্ঘাত আলতাব নিউটনের চর, আমার ক্যারিয়ারটা মৃগেল করতেই আজ অন্তর্ঘাত চালাতে এসেছে! দোহাই লাগে, ওকে সরিয়ে আমাকে বসান। ভিসির গদি আজ দু'দিন ধরে খালি, আমার মাথায় আপনার শিল্প বকেয়া হয়ে থাকলে যে কোনো মুহূর্তে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে...।"
বুড়ো খদ্দেরের কথা ফুরোনোর আগেই দরজায় দুমদাম ঘা পড়লো। নরুণিয়া হেঁকে উঠলেন, "এন্টার!"
মোগলাই চাপরাস পরা পাগড়িমাথা এক যুবক তশতরি হাতে দরজা খুলে বিরস কণ্ঠে বললো, "প্রফেসর আসমান কেপলারের নামে তার এসেছে হুজৌর!"
বুড়ো খদ্দের চমকে উঠে হাতছানি দিয়ে চাপরাসিকে কাছে ডেকে কম্পিত কণ্ঠে বললেন, "নির্ঘাত বড়সড় কিছু একটা ঘটেছে। হয় চ্যান্সেলর সাহেব আমাকেই ভাইস বানিয়েছেন, নয়তো ঐ হতচ্ছাড়া পাস্কেলকে! নিউটনের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না!" তশতরি থেকে একটা মামুলি খাম তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরে বিড়বিড়িয়ে পড়ে সেটার এক মাথা ফড়াৎ করে ছিঁড়ে ভেতরের চিরকুটটা তিনি একবার পড়লেন, দু'বার পড়লেন, তৃতীয়বার পড়ে ডুকরে উঠে বুক চেপে ধরে পাটের আসনে শুয়ে পড়লেন উপুড় হয়ে। "গ্যালো গ্যালো, সব গ্যালো!"
কোচিং সেন্টারের নবিশ সোৎসাহে শুধালো, "ভিসি কে হলেন তাহলে?"
আসমান কেপলার তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের দিকে মুঠি পাকিয়ে লাফাতে লাগলেন, "এই বেলেহাজ কথার ঝুড়িটার জন্য আমার দেরি হয়ে গ্যালো। আর এই ফাঁকে সর্বনাশ হয়ে গ্যাছে!" কোটের কোণা তুলে চোখ মুছতে লাগলেন তিনি।
ঘাড়বাঁকা খদ্দের কেমন যেন পুলকিত কণ্ঠে বললেন, "অন্য কেউ ভিসি হোলেন নাকি? হ্যাঁ? হ্যাঁ? ...দুঃখ করবেন না স্যার। মনে করুন বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা গিয়ে পড়েছে। সেদিন বিটিভি খুলে দেখি কী একটা সিনেমায় যেন এটিএম শামসুজ্জামানের সাথে ববিতার বিয়ে হয়ে গ্যালো, আর তাতে জসিমের কী পিঠ ফুলিয়ে কান্না! ...শিট হ্যাপেন্স মুরুব্বি। আর ধরুন গিয়ে এদেশে প্রকৃত শিক্ষারই যেখানে কদর নেই, সেখানে আপনিই বা ভিসি হবেন কেন? আপনাদের ওখানে ভিসির গদি তো ধরুন গিয়ে রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা, তার ওপর যিনি বসবেন রাজা... ঐ তো ঘুরেফিরে ঠোঙাভরা বাদামভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না হবে। ...আহাহা কাঁদবেন না স্যার, একটু বার্লি খেয়ে চাঙা হয়ে নিন। কালপরশু একটা মানববন্ধন করে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন নাহয়।"
কিংকু চৌধারি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, "স্যার, এই যে আলতামাশ ক্ষৌরসভায় মুঠোফোন জমা দিয়ে ঢুকতে হয়... এটা মোটেও ভালো কিছু নয়। ফোন ছাড়া এতক্ষণ একটা সুস্থ মানুষ কী করে বসে থাকে বলুন? কে জানে ময়না লাইল ফেসবুকে নতুন কোনো ছবি টাঙালো কি না?" ঘড়ি দেখলেন তিনি, "ওপার বাংলায় এখন গোসলের সময়, মিমি চক্রবৃদ্ধি নির্ঘাত তোয়ালে পরে ভিডিও টাঙিয়েছেন। নরুণিয়ার বকরবকর শুনতে গিয়ে আমার যুবক বয়সটাই স্যার ফসকে যাচ্ছে।" প্রাচীন মিশরের খবরের কাগজের ঊনশেষ[৭] পাতায় আরেকটু কম জামা পরা আরেক মালবালার ছবি খুঁজে পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন তিনি।
[৭] ঊনশেষ = পেনাল্টিমেট।
ঝাকানাকা আড়চোখে প্রথমে কিংকু চৌধারির অস্তায়মান যুবক বয়স, তারপর কিংকুর হাতে ধরা পাতাটা দেখে নিয়ে বললেন, "হুমম। ...ঐ যে, মুঠোফোন থাকলেই লোকে সরাসরি সম্প্রচার করতে থাকে। দু'চারটা অস্কার, দু'চারটা পামদোর, দু'চারটা সিনেকচু পুরস্কার তাতে জুটবেই। নরুণিয়া এসবের বিরুদ্ধে। উনি খেটে খাওয়া ঘরানার শিল্প ছাড়া বাকি সবকিছু জব্দ করার পক্ষে।" নাক টানলেন তিনি।
আসমান কেপলার ওদিকে অশ্রুভেজা গালে বলে চলছেন, "...ছ্যাঁচড়ামির যুগ এটা। আলতাব নিউটন কী করে আমার মহাপরিকল্পনা ঘাপিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে? বুঝলাম তার মুণ্ডুজোড়া টাক, কিন্তু বুকে কি দুইগাছা লোমও নাই? এমনই বুজদিল বেদরদ বর্বর এই আলতাইব্যা!" টেলিগ্রামের চিরকুটটা ফের তুলে ধরে করুণ সুরে পড়লেন তিনি, "ওগো কাম শার্প স্টপ ফরগেট চুল স্টপ আলতাব প্রেস কনফ স্টপ ভার্সিটি খোলনলচে চেঞ্জ স্টপ ওয়ান টি ওয়ান চপ ওয়ান সিংগারা ওয়ান সামোসা ওয়ান ভাগ্য-নিমকি ওয়ান এন্টাসিড ওয়ান আমলকি টু পুদিনা ট্যাবলেটস ফর বেশরম কাপলস ফর এইট টাকাজ ঔনলি স্টপ ওগো হোয়াট উই গনা ডু ইরোটিম[৮] ইরোটিম বেগম নিউটন রিসিভড এফবি লাইকস অ্যামপারস্যান্ড[৯] লাভস ফ্রম টপ পিপল অ্যামপারস্যান্ড গেইভ হাহা অন মাই লাস্ট ওয়ালপোস্ট স্টপ হোল বডি বার্নিং দাউদাউ স্টপ ব্রিকস অ্যামপারস্যান্ড বিমস উইল ফল ইন মিয়াবাড়ি স্টপ ডু সামথিং মিনসে স্টপ ব্রিং নানরুটি অ্যামপারস্যান্ড নেহারি ফ্রম জবরলাল নেহারি[১০] স্টপ। বেগম চানতারা কেপলার-চৌধুরানি।"
[৮] ইরোটিম = প্রশ্নবোধক চিহ্নের নাম।
[৯] অ্যামপারস্যান্ড = এবং-চিহ্নের নাম।
[১০] পুরান ঢাকার মশহুর নেহারির দোকান "জবরলাল নেহারি" নিয়ে বিস্তারিতের জন্য "গোয়েন্দা ঝাকানাকা ও রাহুল কুবের রজ্জবীর অন্তর্ধান রহস্য" দ্রষ্টব্য
কিংকু চৌধারি কুর্তার আড়ালে গোঁজা বেতারযন্ত্রে সন্তর্পণে কানচোঙা[১১] গেঁথে বোতাম ঘুরিয়ে ফিসফিসিয়ে বড় আপিসে খোঁজখবর নিয়ে ঝাকানাকার দিকে ফিরলেন, "না স্যার, ভিসির গদি এখনও খালি আছে। তবে ভিসি হয়ে কী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলনলচে পাল্টে দেবেন, সেটা নিয়ে প্রফেসর আলতাব নিউটন সংবাদ সম্মেলন করেছেন।"
[১১] কানচোঙা/কানচোং = ইয়ারপিস। ইয়ারপিসের শরীর আর তারের সংযোগস্থলকে কানচোংজঙ্ঘা বলা যেতে পারে।
আসমান কেপলার ওদিকে মঞ্চে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের দিকে মুঠো পাকিয়ে তেড়ে যাচ্ছিলেন, কোচিঙের ওস্তাদ-নবিশ মিলে তাঁকে ধরে রেখেছে। কেপলার গর্জাতে লাগলেন, "এখনও ভিসির গদি খালি আছে! জসিম স্টিল হ্যাজ আ ফাইটিং চান্স! সিট ছাড় বাটপার!"
আলতামাশ নরুণিয়া মন দিয়ে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের ঘাড় কামাচ্ছিলেন, তিনি নাখোশ সুরে বললেন, "আহ, গোল করবেন না! ...এভাবেই সবকিছু মৃগেল হয়, বুঝলেন স্যার? আপনার পাকা মতলব আরেকজনের কাঁচা হাতে পড়লে এমনটাই হয়। তা আপনি এখন কী করবেন? সাত টাকায় খোলনলচে পাল্টানো যাবে না?"
কেপলার একদম ভেঙে নেতিয়ে পড়লেন কোচিং সেন্টারের ভদ্রলোকদের আলিঙ্গনে। "নো স্যার! এগারো টাকা থেকে নয় টাকায় নামতে গিয়েই ভাণ্ডারে টান দিয়েছি আমি। বেতন-বোনাস-ভাতা-আপ্যায়ন-সভাদক্ষিণা-আয়োজন কিছুই এক পয়সা বাড়ানোর জো নেই, কমানো তো দূরের কথা! আমি জানি না নিউটন হতচ্ছাড়াটা কোন আপেলগাছের নিচে বসে আমার নয়টাকাকে ডিঙিয়ে আটটাকায় নামার হিসাব মিলাতে পেরেছে!" কোচিঙের কোচ-সাগরেদরা তাঁকে বহুকষ্টে নিজেদের আলিঙ্গনছাড়া করে ফের আসনে বসিয়ে দিলো। কিন্তু পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠলেন তিনি, "ইসরাফিল পাস্কেলের সাথে একটা বোঝাপড়ায় আসতে হবে আমাকে!" নিজের আসন সারিতে ঘুরপাক খেয়ে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। "পাস্কেল আর নিউটনের মধ্যে সেই পাকিস্তান আমল থেকে রেষারেষি চলছে। যদিও মুখোমুখি ফ্ল্যাটে থাকে দু'জন, কিন্তু মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই! যদি দরকার হয়," তালুতে কিল বসালেন তিনি জ্বলজ্বলে চোখে, "পাস্কেলের ঐ সালভাদুরে গোঁফ আমি নিজের হাতে মোম ডলে পাকিয়ে চৌরস করবো, কিন্তু ফন্দিচোরা নিউটনকে ভিসি হতে দেবো না!"
কিংকু চৌধারি হাতে ধরা নথি উল্টে বললেন, "আলতাব নিউটন আর ইসরাফিল পাস্কেলের কী একটা কেস যেন সেদিন আমাদের হাতে এসেছিলো না স্যার?"
ঝাকানাকা ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবছিলেন, তিনি আনমনে বললেন, "উঁ! দাঁড়ান। ব্যাপারটা মনে হচ্ছে ধরতে পারছি।"
কিংকু চৌধারি বললেন, "কোন ব্যাপারটা স্যার? আটটাকায় কী করে খোলনলচে পাল্টানো যায়, সেটা?"
ঝাকানাকা বললেন, "মমম? উঁহু। কে বা কাহারা সিসিটিভি এড়িয়ে আলতামাশ ক্ষৌরসভার নামফলকটায় ক'দিন পরপর আ-কার গুঁজে আলতামাশা বানিয়ে দিয়ে যায়, সেটা। দাঁড়ান, একটা জিনিস মিলছে না, মিলিয়ে নিই।"
কিংকু চৌধারি একটু হাঁপ ছেড়ে বললেন, "ওহ, এখানে এসে ক্ষৌরসভার হালচাল ধরতে গিয়ে আসল রহস্যটাই গিলে ফেলেছি স্যার।"
নরুণিয়া ওদিকে কেমন যেন একটু রহস্যময় হেসে বললেন, "বটে? বেশ বেশ। ...কিন্তু কথা সেটা নয়। আপনার পাকা আর্ট কাঁচা লোকের হাতে পড়ার পর আসল গেরোর শুরু। সেই কাঁচা তখন আপনাকে ল্যাং না মেরে ভাত খাবে না। কলাভুনার কান্দিনস্কি সংখ্যায় মৃগেল কী সাক্ষাৎকার দিয়েছিলো, জানেন তো? হতভাগা বলে কী, আলতামাশ নরুণিয়া আর মৃগেল হক আর নট সো ডিফরেন্ট। বুঝুন অবস্থাটা! প্রথমে কিছু বলিনি। ফলবন্ত গাছেই তো বাঁদর আসে। কিন্তু এরপর একে একে দালি সংখ্যা, হিচকক সংখ্যা, বড়ে গুলাম সংখ্যা... সে এই ফাটা ঢাক বাজিয়েই চললো! তখন বাধ্য হয়ে কেলুচরণ সংখ্যায় আমি মুখ খুললাম। বুঝিয়ে বললাম, কলা কী, কলাকার কে, আর বাঁদরই বা কী করে মাথায় চড়ে। ও মা, এরপর রন জেরেমি সংখ্যায় দেখি মৃগেইল্লা সাক্ষাৎকারের নামে খিস্তি বকে পাতা ভরিয়ে রেখেছে! বলে, কাটা চুল সাতদিনের মধ্যে গজায়। চুল কেটে কলাচর্চা করা কলার সাথে তামাশারই নামান্তর। যে কলা সাতদিনে কেঁচে যায়, তাকে কাঁচকলা না দেখানোই পাপ। ...আর তার পর থেকেই কে বা কাহারা আমার ক্ষৌরসভায়, আমার কেশকলার সাধের অলিম্পাসের সাইনবোর্ডে সমানে আ-কার এঁকে আলতামাশা বানিয়ে যাচ্ছে। রংমিস্ত্রি ডাকিয়ে সেটা সাফ করে কূল পাচ্ছি না। দারোয়ান বসালাম, থানাপুলিশ করলাম, সিসিক্যাম বসালাম, দোকানের উল্টোদিকের গাছে মাচান বেঁধে আমি নিজে জিম করবেটের মতো পরপর দু'রাত বন্দুক হাতে পাহারা দিলাম, কিন্তু কিছুতেই ধরা পড়ছে না, কোন বিটকেল কী কায়দায় এ কেলো করে যাচ্ছে!"
আসমান কেপলার কেমন যেন স্মৃতিকাতুরে মুখ করে গালে হাত দিয়ে বললেন, "এমনটা অনেকদিন ধরেই হয়ে আসছে স্যার। সবসময় যে গুণী লোকের সাথেই এমনটা হয়, তা নয় কিন্তু। এই যে ধরুন আমার সহকর্মী ও দীর্ঘদিনের সুহৃদ জনাব ইসরাফিল পাস্কেলের আপিসে দরজার বাইরে নেমপ্লেটে বেচারা সেই লেকচারার হয়ে জয়েন করার পর থেকেই কে বা কাহারা যেন পাস্কেলের পি-এর নিচে আধখানা গোঁফ এঁকে ওটাকে রাস্কেল বানিয়ে যাচ্ছে... এখনও চলছে এসব।" আড়চোখে সবাইকে দেখে নিলেন তিনি। "আমার সন্দেহ আলতাব নিউটনকেই। বারান্দা ধরে আরেকটু এগোলেই তার আপিস।"
দরজায় ফের দুমদাম ঘা পড়লো। "এন্টার!"
চাপরাসি ফের তশতরি হাতে ঘরে ঢুকলো। "প্রফেসর আসমান কেপলারের নামে আরেকটা তার এসেছে হুজৌর!"
কেপলার কম্পিত শরীরে উঠে দাঁড়ালেন। "আবার! নির্ঘাত আচার্য সাহেব একটা ভুল করে বসেছেন!" টেলিগ্রামের খাম ছিঁড়ে ভেতরের চিরকুট তিনি একবার পড়লেন, দু'বার পড়লেন, তৃতীয়বার পড়ে ফের লুটিয়ে পড়লেন উৎসুক আলুপোড়ারসিক কোচ-নবিশের হাতে। "নো! নো! জসিমের পিঠে তুই এভাবে ছুরি মারলি পাস্কেল?"
কোচিং সেন্টারের নবিশ সস্নেহে আসমান কেপলারের হাত থেকে চিরকুটটা কেড়ে নিয়ে গলা খাঁকরে পড়তে লাগলেন, "ওগো কাম শার্প স্টপ বার্ন চুল স্টপ পাস্কেল রিসিন্ডেড ক্যানডিডেসি স্টপ কনসিডেড গদি টু নিউটন'স প্ল্যান স্টপ চিউয়িং বেলা বিস্কুট অ্যামপারস্যান্ড স্মাইলিং স্টপ বেগম নিউটন মুভিং ফার্নিচার স্টপ ইউ রুইন্ড মাই লাইফ স্টপ সামবডি গিভ মি হেমলক স্টপ ডু মানববন্ধন স্টপ কল জাতিসংঘ স্টপ বিগ কনস্পিরেসি স্টপ ব্রিং আইসক্রিম স্টপ। বেগম চানতারা চৌধুরানি।"
কোচ সদয় আনন্দে দাঁত বের করে বললেন, "ম্যাডাম নাম থেকে কেপলার ছেঁটে দিয়েছেন মনে হচ্ছে!"
আলতামাশ নরুণিয়া আনমনে কোরকবসানো জহুরির চশমা পরে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের চুলে আণুবীক্ষণিক নকশা কাটতে লাগলেন। "গোয়েন্দা ঝাকানাকাকে লেলিয়ে দিয়েছি যখন, ধরা সে পড়বেই। আমি বরাবরই ক্ষুরকাঁচি নিজের হাতে আর আইন পুলিশের হাতে রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু আমার সাইনবোর্ড মৃগেলকারী ধরা পড়লে এবার একটু এদিক ওদিক হতে পারে।" নাক টানলেন তিনি। "...কিন্তু কথা সেটা নয়। আর্ট কেন চিরস্থায়ী হতে হবে? ব্যাঙ্কসির সাথে কয়েক বছর আগে হামবুর্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি হিহি ঠাণ্ডার মধ্যে, হঠাৎ সে বরফে ঢাকা এক নির্জন উঠোনে সাঁ-সাঁ করে হিসি করে আমাকে বললো, দৌড়াও! আমার কি আর দৌড়ঝাঁপ করে পোষায় এখন? ঠাণ্ডার মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে এক শুঁড়িখানায় ঢুকে দু'জনে দু'টো হুইস্কি নিয়ে বসলাম। পরদিন দেখি সব খবরের কাগজে বরফে আঁকা হলুদ চিত্রকর্মের ছবি। কীভাবে সেটা রক্ষা করা যায় তা নিয়ে বাঘা বাঘা মিস্ত্রি-আঁকিয়েরা মাথা চুলকে হয়রান। ব্যাঙ্কসি দু'টো কাগজ হাতে হেসে লুটিয়ে হোটেলে আমার কামরায় ঢুকে বললো, গরম পড়লেই আর্ট শেষ। বিয়ারের ঢেঁকুর তুলে সে বললো, আর্ট শুড বি ইফেমেরাল। সব শিল্পই হতে হবে এক দিনের সুলতান। যেদিন সৃষ্টি, তার পরদিন রোদে পুড়ে যাবে, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে, বাতাসে ভেসে যাবে, দুষ্টু মেয়েদের নখের আঁচড়ে ছিঁড়ে যাবে। লোকের কাছে কলাকর্ম উপভোগের মন্ত্র হতে হবে পরপর দুটো হাওয়াইদেশি "আলোহা", স্বাগত জানানোর পরপরই খুদাপেজ করে দিতে হবে। আমি বললাম, দ্যাখ ব্যাঙ্কসি তুই সাতটা দিন সময় আমার জন্য রাখ। সাতদিন পর কার চুল কত জলদি গজিয়ে আমার কলা হাপিস করে দেবে, তা নিয়ে আর মাথা ঘামাবো না। আর্ট শুড বি হেবডোমেইডাল। বিষুদে বিষুদে সাদ্দিন, তারপর বাদ্দিন।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে চশমা-ক্ষুর-কাঁচি-দস্তানা সব নামিয়ে রেখে আড়মোড়া ভাঙলেন তিনি, তারপর বৈদ্যুতিক হাঁড়িতে পানি ফোটাতে দিলেন।
দরজায় দুমদাম ঘা পড়লো আবার। নরুণিয়া কিছু বলার আগেই কোচিং সেন্টারের নবিশ হেঁকে উঠলো, "এন্টার!"
সেই ওভারলপরা বাবরিচুল ফের রঙের বালতি-তুলি হাতে ক্ষৌরসভায় উঁকি দিলো, "স্যার, আপনার খাজাঞ্চি আমাদের বিলটা শোধ করবে না বলে ধমকাচ্ছে!" বিলের কাগজটা তুলে ধরলো সে অন্য হাতে। "বলছে আপনার সইটা এমন ক্ষুদে, ওটা স্বাক্ষর না তেলাপোকার গু, বোঝা যাচ্ছে না।"
আলতামাশ নরুণিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "আহ, জুয়েলার'স গ্লাস পরা ছিলো চোখে। দাঁড়ান, আসছি।" মাথা নাড়তে নাড়তে ক্ষৌরসভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ঘাড়বাঁকা খদ্দের আয়নার দাঁড়টা কাছে টেনে নিজের আধছাঁটা ঘাড় দেখার ফাঁকে গুনগুনিয়ে বললেন, "আলতাব নিউটন স্যার কোনো এক ফাঁকে নরুণিয়ার দোকানে চুল ছাঁটিয়ে যাননি তো?"
আসমান কেপলার একটু যেন ভরসা ফিরে পেলেন, টাই তুলে নাক মুছে বললেন, "নাহ। বললাম না, চুলই নেই তার মাথায়। যখন লেকচারার হয়ে ডিপার্টমেন্টে ঢোকে, তখন থেকেই সে পুরো ভল্ডেমর্ট। ছাঁটানোর মতো উশকোখুশকো চুল আছে বরং ইসরাফিল পাস্কেলের মাথায়।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের এবার নিজের মাথার ডানদিকটা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, "আপনি দু'চারটা স্পন্সরশিপ যোগাড় করে একটা কঠিন ফাইট দিন না স্যার? টিফিনের দাম এক ধাক্কায় পাঁচ টাকায় নামিয়ে আনুন।" আয়নাটা আলগোছে ঘুরিয়ে উদ্বিগ্ন কেপলারের মুখটা দেখে নিলেন তিনি। "আপনার জায়গায় আমি হলে আরো আগ্রাসী ট্যাকটিক্সে যেতাম স্যার। টিফিন কিনলে খদ্দেরকে উল্টো দুটো টাকা সালামি দিতাম, অ্যাজ আ জেশ্চার অফ গুডউইল অ্যান্ড খান্দান। আপনি ওরকম কিছু করে দেখুন, চ্যান্সেলর সাহেব আপনাকে ভিসির গদিটা আমরণ লাখেরাজি দিয়ে দেবেন নির্ঘাত। তখন আপনাকে সরাতে চাইলে পোলাপানই দোকান-গাড়ি ভেঙেচুরে প্রোটেস্ট করবে।"
আসমান কেপলার খেঁকিয়ে উঠলেন, "আরে, সে চেষ্টা করিনি ভাবছেন? কতো খিড়কিতে গোপনে টোকা দিলাম। স্পন্সরদের বিরাট সব আবদার। এক মুঠোফোন পার্টি বললো, ছাত্র-শিক্ষক মেহফিলখানার ওপর তাদের নিয়ন সাইন লাগাতে হবে। আরেক ফর্সামলম পার্টি লাইব্রেরির বাইরের দেয়ালজুড়ে ব্যানার ঝোলাতে চায়, তাতে লেখা থাকবে "গায়ের রং কালা? দুনিয়াজোড়া জ্বালা।" এক ঢেউ টিন কোম্পানি আমার ডিপার্টমেন্টের নামের শেষে লাল রঙে তাদের নাম লেখার শর্ত দিয়েছে।" রুমালে চোখ মুছলেন তিনি। "পর্ষদে ওসব যদিও বা পাশ হয়, ছাত্র সাইক্লোনের ডেঁপোরা বিপ্লব করে গদি নড়িয়ে দেবে।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের এবার মাথার বাঁদিক বীক্ষণের ফাঁকে মুচকি হেসে বললেন, "আহা, দোকানির ক্যাশ থেকে টাকা তুলতে গেছেন কেন? নজর উঁচু করুন স্যার, কাঙালের ধনে হাত দিন।" একটু কেশে নিলেন তিনি, "পুরাতত্ত্ব বিভাগে অনেক বরাদ্দ পড়ে বরবাদ হয়। আপনাদের ভার্সিটি যদি বালেগ হয়ে থাকে, মানে যদি বয়স বারো বছর টপকায়, নিশ্চিন্তে পুরাকীর্তি খাতে দরখাস্ত ঠুকে বিশ-ত্রিশ কোটি টাকা আদায় করে নিতে পারেন কিন্তু।" ফের আড়চোখে আসমান কেপলারকে মেপে নিলেন তিনি, "এমন তো না যে জমানার হালের সাথে তাল ঠুকতে পারবেন আর। পিছিয়েই পড়েছেন যেহেতু, আই সাজেস্ট কয়েকশ বছর পেছান। লোকে বলে মরা হাতি লাখ টাকা, কিন্তু আধমরা ঐতিহ্য একবার বুরোক্রেসির বাজারে তুলতে পারলে কয়েকশ কোটি টাকা দাম পাবেন স্যার। কিপ হার্পিং অন দ্যাট পয়েন্ট।"
আসমান কেপলারের মুখে কেমন যেন এক আশারুণ স্বপ্নাতুর কাঁপা-কাঁপা হাসি ফুটলো। "বাহ, বুদ্ধিটা তো খারাপ দেননি ভাইটু!" পকেট থেকে নোটবুক আর পেন্সিল বের করে নোট নিতে লাগলেন তিনি। "আহ, কতোদিন পর নতুন একটা বুদ্ধি নিয়ে কাজ করছি! সেই যে জেনারেল মমিন কুসুম ডাণ্ডাপাণির আমলে ক্লাসের জন্যে একটা লেকচার নোট টুকেছিলাম, তারপর আর লেখাপড়ার পেছনে বেগার ছুটে সময় নষ্ট করিনি।"
কিংকু চৌধারি চোখ গোল করে ঝাকানাকাকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ক্ষৌরসভার দরজা দড়াম করে খুলে নরুণিয়া ফিরলেন। "...কিন্তু কথা সেটা নয়। এই যে মৃগেইল্লা বছর বছর চারটা করে পোরট্রেট টাঙায়, আর বছর ঘুরতেই লোকজন বিপ্লব করে সেগুলো হয় নামায় নয় সরায়, সেটাই শিল্পের সাথে আসল তামাশা। শিল্পীর কলা সরাবে হয় সে নিজে, নয়তো মাদার নেচার। যে শিল্প ঠিকাদার ডেকে সরাতে হয়, সেটা আর্ট নয়, ইন্ডাস্ট্রি।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের বিগলিত হেসে বললেন, "জ্বি স্যার। ঠিক বলেছেন স্যার। খুব দামি কথা। আমার চুলের বাঁ পাশে আরেকটু শিল্প বাকি ছিলো স্যার।"
নরুণিয়া বড়সড় এক নারকেলের কড়ঙ্কে চাপাতা ঢেলে হাঁড়ি থেকে পানি গড়িয়ে নিলেন। "সেইজ হু? শিল্প বাকি আছে কি নাই, সেটার বিচার করে কে? নট ইউ স্যার। চুপচাপ মোচড়া মাইরা বয়া থাকেন, চা খাইতে চাইলে লইয়া খান।" চায়ের কাপে বিকট চুমুক দিলেন তিনি। "একবার রানি... নামটা না বলি... রানিরে কামাইতেছি, সে কয় মাস্টার নরুণিয়া লেটস পজ ফর আ মোমেন্ট অ্যান্ড হ্যাভ সাম টি, উই হ্যাভ ওয়ান্ডারফুল আসামিজ টি রাইট ফ্রম দ্য বেস্ট সোর্স। আমি কইলাম শোনো হার ম্যাজেস্টি, আসামি চায়ের ফুটানি আমাল্লগে করবা না। দ্যাশে আমার চা আসে ভূমৌলিবাজারের এক লম্বর আসামি চা গাছেত্তে, ঐ চা বাগানের মালিক-ম্যানেজার সবাই মামলার আসামি।" সরু চোখে কাগজের আড়ালে কিংকু চৌধারি আর ঝাকানাকাকে কিছুক্ষণ দেখে নিলেন তিনি। "এই তো গ্যালো সপ্তায় ফকিরুন্নেসা স্কুলের সামনে থেকে এক মৃগেলকর্ম সরানো হলো। হাউকাউ, মিটিংমিছিল, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, কতো নাটক।"
কিংকু চৌধারি ফিসফিসিয়ে ঝাকানাকাকে বললেন, "আসলেই স্যার। ঐ যে, রবি করে জ্বালাতন। বছরকয়েক আগে বসানো হয়েছিলো, রবিয়ালরা তখন আপত্তি করেনি, দেখে চিনতে পারেনি বলে। মাসখানেক আগে ভর্তি পরীক্ষার সময় এক রবিয়াল আন্টি জায়গা না পেয়ে ওটার গোড়ায় গিয়ে বসেছিলেন, সেলফি তোলার পর দেখা গেলো ছবির নিচে খুদি খুদি হরফে লেখা, "এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। না মানলে কচু খাও।" তারপর তো স্যার বিরাট গণ্ডগোল লেগে গ্যালো। রবিয়ালরা দাবি তুললো রবি ঠাকুরের এমন ফচকে ছবি হতেই পারে না, এটা নামাতে হবে। আর যতো আধবুড়ো কবিসাহিত্যিক আছে, সব পাল্টা গোঁ ধরলো, ছবি ওখানেই রাখতে হবে। বুড়ো কবিরা স্কুলবালিকাদের আশপাশে না থাকলে কোথায় থাকবে? অনেক হট্টগোলের পর শেষে ভাঙচুরো কোম্পানি এসে ছবি ভেঙেচুরে নিয়ে গেছে।"
ঝাকানাকা আনমনে বললেন, "হুঁ, মনে আছে। টিভিগুলো সারাদিন ধরে দেখাচ্ছিলো... সঙ্গে বিজ্ঞাপন।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের কী যেন বললেন গুনগুনিয়ে, আলতামাশ নরুণিয়া চায়ের কড়ঙ্ক ঠাস করে নামিয়ে রেখে আড়মোড়া ভেঙে বললেন, "এবার তবে শিল্পের চূড়ান্ত টাচটা দিয়ে দিই, কী বলেন?" জবাবের অপেক্ষা না করে আঙুলের গাঁট ফুটিয়ে নিয়ে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের মাথা বানানো শুরু করলেন তিনি। "...কিন্তু কথা সেটা নয়। পাকা জিনিস কাঁচা হাতে যারাই ছাড়তে যায়, তাদের আমি বরাবর সতর্ক করে আসছি। শত্রুজিৎ রায়কে ছাঁটছিলাম একবার, উনি খুব করে ধরে বসলেন, ঝটিকচাঁদের স্ক্রিপ্টটা একটু দেখে দিতে। বললেন, দরকার হলে এটাও একটু ছেঁটে দিস রে নরু। আমি বললাম, দ্যাখো রতনদা, তোমার শিল্পে আমি বাঁ হাত দিতে চাই না। শরীরটা তোমার ভালো যাচ্ছে না, এ জিনিস শেষ করতে পারবে নাকি পাকা শিল্পের বাকি আদ্ধেকটা কাঁচা হাতে গিয়ে পড়বে? শত্রুজিৎ পাকা লোক, ইঙ্গিতটা বুঝে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, কথাডা তো তুই খারাপ কস নাই রে আলতামাইশ্যা। তারপর চা-চু খেয়ে সেদিন আর ঝটিকচাঁদের স্ক্রিপ্টে হাত না দিয়ে ফ্রানৎস লিস্ট আর আন্তোনিন দ্ভোরজাকের সুর নিয়ে দু'পশলা আলোচনা করে ফিরে গেলাম হোটেলে। তারপর কী হোলো, সেটা ভাবলে আজও কান্না পায়। কুতুবদিয়া রায় অনেক টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলো আমাকে, ঝটিকচাঁদ দেখতে পীড়াপিড়ি করে। একবার গ্লাসগোতে মাঝরাতে ফোন করে ঘুম থেকে তুলে বললো, নরুদা! বাবার সব কাজ এখন একটা একটা করে ডেভেলোপ করবো রে দাদো! ওগো বন্ধু, পাশে থেকো। আমি বললাম, কে ডেভেলোপ করে আর কে দেবে লোপ করে, সবাই বোঝে রে কুতু। তুই পাকা কাজে বাঁ হাত দিস্নে। সে খুব গরম নিয়ে ঠাস করে ফোন রেখে দিলো। তারপর থেকে চলছে। তারুদার গোয়েন্দাগিরি, ফেলিনিমেসোর অ্যাডভেন৪, নন্টে গজলচি ফন্টে তবলচি... সবকিছুর বারো বাজিয়ে সে এখন কী একটা বিজ্ঞানী চরিত্রের পিছু লেগেছে। রতনদাকে আমি নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম কিন্তু, রতনদা, আর যাই করো সঙ্গে নবিশ নিও না। নবিশ মানেই খবিশ। শিল্পের এক ছটাক শিখেই সে সটকাবে, তারপর আড়ত খুলে মণের কারবার ধরবে। শত্রুজিৎ আমায় উদাস হয়ে বললেন, শাটাপ।" এক মর্মান্তিক চাঁটি কষালেন তিনি ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের তালুতে।
আসমান কেপলার গুনগুনিয়ে বললেন, "বিজ্ঞানী চরিত্রটা মনে হয় প্রোফেসর মঙ্গু।"
আলতামাশ নরুণিয়া কিছুক্ষণ কাজ ফেলে ভুরু কুঁচকে ছাদের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, "ওটা প্রোফেসর মঙ্গু ছিলো? তাহলে মাথায় ওরকম ডায়না-ছাঁট চুল কেন? আর সে কাঁখে একটা ইঁদুর নিয়েই বা ঘোরে কেন? প্রোফেসর মঙ্গুর পোষা কাঠবেড়ালি আইনস্টাইন কোথায়?"
আসমান কেপলার একটু যেন উৎসাহ ফিরে পেয়ে বললেন, "ওটা ইঁদুর নয় স্যার, কাঠবেড়ালিই, কিন্তু আলতাব নিউটনের কিসমৎ নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে... পুরো গা ন্যাড়া বলে দেখে ইঁদুর মনে হয়।"
কুতুবদিয়া রায়ের ওপর যে ঝালটা ঝাড়তে চেয়েছিলেন আলতামাশ নরুণিয়া, সেটা ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের ঘাড়ে আর মাথার দু'পাশে ঝাড়ার ফাঁকে বললেন, "হুঁ। টেকো বিজ্ঞানী আর চুলো কাঠবেড়ালির বদলে কুতুবদিয়া বিটকেলটা রেখেছে চুলো বিজ্ঞানী আর টেকো কাঠবেড়ালি!"
কোচিং সেন্টারের কোচ গদোগদো গলায় বললো, "পাকা হাতের শিল্প কাঁচা হাতে পড়ে জিনিসপত্র মৃগেল হওয়ার ব্যাপারটা ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি স্যার। একবার ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখি, মামা বোর্ডের খাতা দেখতে বসেছেন, ইয়াব্বড়বড় খাতার বোন্দা ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ঘরে। আমরা ছোটোরা খেলতে গিয়ে সাড়াশব্দ করলেই মামা স্টিমারের ভেঁপুর মতো বোল তুলে ধমকায়। ভয়ের চোটে লুডুর ছক্কাটা পর্যন্ত কাঁথা বিছিয়ে ফেলতে হচ্ছিলো, যাতে শব্দ না হয়। তারপর একদিন একটানা খাতা দেখে কাহিল হয়ে মামা হাই তুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আমার কান পাকড়ে বললো, যা বাকি খাতাগুলো তুই দেখে দে। আমি ভয় পেয়ে বললাম, সে কী কথা মামুজান, আমি তো ক্লাস সিক্সে পড়ি, ইন্টারমিডিয়েটের খাতা আমি কী করে দেখবো? মামা মিটিমিটি হেসে বললেন, আরে বুদ্ধু, এটা বাংলা পরীক্ষার খাতা, হাতে-আঙুল-আছে এমন যে কেউ দেখতে পারে। বিঘৎ মেপে নম্বর দিবি। প্রতি বিঘতে এক নম্বর। এই বলে তিনি টিভি ছেড়ে ছায়াছন্দ দেখতে বসে গেলেন।" কেমন যেন স্মৃতিকাতুরে এক শ্বাস ফেললো সে। "সেবার বাংলায় কয়েকটা কলেজের ছেলেমেয়েরা ঘ্যাম নম্বর তুলেছিলো... অষ্টাশি-নব্বই অব্দি পেয়েছিলো কেউ কেউ। আমার বিঘৎ তখনও ছোটো ছিলো তো।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের নরুণিয়ার মালিশের ঘুমপাড়ানি অংশে ঝিমিয়ে পড়লেও খানিক পরপর ঘুমতাড়ানি চাঁটির দাপটে চমকে সজাগ হয়ে উঠছিলেন, তিনি করুণ গলায় বললেন, "আমার বড় শালি মনে হয় ঐ ব্যাচেই ছিলো। বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ঊননব্বই পেয়েছিলো। এখনও সে ঐ খাতে দেমাগ করে বেড়ায়। তার বাসার দেয়ালে মার্কশিটের একটা মস্ত কপি বাঁধাই করে রেখে দিয়েছে। একবার ঠাট্টা করে শুধিয়েছিলাম, তা বাংলা ফার্স্ট পেপারে তুমি সাঁইতিরিশ পেলে ক্যামন করে গো?"
আসমান কেপলার সমবেদনায় চুকচুক শব্দ করে বললেন, "তারপর কী হইল, জানে শ্যামলাল। তা ভাইটু, ডিপ্লোমেসি তো ঠিক আপনার কাপফ্টি মনে হচ্ছে না। আপনি রাষ্ট্রদূত না হয়ে আশপাশে কোনো ভার্সিটি ফাঁকা পেলে ভিসি হয়ে যান না। কিংবা কোনো ধমকদার এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টর?"
নরুণিয়া হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, "...কিন্তু কথা সেটা নয়।" সবাই চুপ করে গেলো। নরুণিয়া খবরের কাগজের মোড়ক খুলে এক দলা ফিটকিরি নিয়ে ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের মাথায় ঘষতে শুরু করলেন। "আমি বুড়োকে আগেই বলেছিলাম, শুরু করেছো ভালো কথা, শেষ করতে পারবে তো? সে মিটিমিটি হাসে। কিছুদিন তার খেল চলার পর একদিন টেলিগ্রাম করে বললাম, ওরে গালঝোলা ওল্ড ফেইথফুল, এখনও তো পুরান মালের ওপর ভর করে চলছে। কিন্তু তা ফুরাতে আর কয়দিন? নতুন কিছু নামাও। সে ফিরতি তারে মিটিমিটি হাসির ইমোটিকন পাঠায়। তখনই বুঝলাম, পাকা শিল্প কাঁচা হাতে পড়তে যাচ্ছে। যে কাঁচার হাতে গিয়ে জিনিসটা পড়বে, তাকেও একদিন টেলিগ্রাম করলাম। বললাম, দ্যাখো হে, গদির খেলা বড় কঠিন খেলা। সুতা একটু একটু করে ছাড়তে হয়, একটু একটু করে টানতে হয়। তুমি সেদিনের ছোকরা, তুমি এসবের কী বুঝবে? মহল্লায় পরিচিত কোনো কাকা-মামা থাকলে তাদের হাতে ভারটা দাও। সে ডেঁপো আমার কথা পাত্তাই দিলো না। তারপর কী হলো, তা তো দেখলেন সবাই। রক্তারক্তি খুনাখুনি জ্বালাওপোড়াও। দলবদলের মোচ্ছব। এ ওর পিঠে ছুরি মারে। দরকারের সময় কেউ কাউকে পাশে পায় না। ওদিকে সবকিছু বিপন্ন। সবার সব সম্বল হরিলুট আর কাঙালিভোজে লেগে যাচ্ছে। শেষমেশ কয়েকমাস আগে নবিশ ডেঁপোকে বললাম, বাবাজি তুমি য্যামনে পারো, বুড়ো আঙ্কেলকে ফিরত এনে তার হাতে সব ভার তুলে দাও। সবাই সব কিছু পারে না।" নাক টানলেন তিনি। "এখন শুনছি বুড়োই সামনের মৌসুমে বাকিটা দেখভাল করবে।"
কোচিং সেন্টারের নবিশ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, "আহাহা, মোবারেক চুন্নুকে সঠিক বুদ্ধিটা দিয়েছেন স্যার! থ্যাংকিউ স্যার! মাকাল হোসেন স্যার অভিজ্ঞ মানুষ, উনি ঠিক সবকিছু সামলে নেবেন। যা কিছু কাঁচা কাজ হয়েছে, ঘষেমেজে আবার আগের মতো টানটান করে তুলবেন...!" পাঁজরে কোচের সজোর গুঁতো খেয়ে থেমে গেলো সে।
ঘরের মধ্যে যেন বাজ এসে পড়লো। আলতামাশ নরুণিয়া কটমটিয়ে কিছুক্ষণ ক্ষৌরসভা কোচিংপড়ুয়ার দিকে চেয়ে থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, "আমরা কী নিয়ে কথা বলছি?"
নবিশ দরদরিয়ে ঘেমে উঠে ফ্যালফ্যাল করে একবার করে কোচ, আসমান কেপলার, আর ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের মহাবিরক্ত মুখ আর ঝাকানাকা আর কিংকু চৌধারির মুখের সামনে ধরা খবরের কাগজ দেখে নিয়ে রুমাল বের করে বললো, "না... মানে, বলছিলেন যে... ঐ যে স্যার... পাকা গদির খেলা কাঁচা লোকের হাতে গিয়ে পড়া... আমি ভাবলাম..."
আলতামাশ নরুণিয়া মাটিতে পা ঠুকে বললেন, "কী ভাবলেন? পলিটিক্স নিয়ে আলাপ করছি আমরা?"
আসমান কেপলার গর্জে উঠলেন, "আমরা গেম অফ থ্রোনস নিয়ে কথা বলছি, বেকুব কোথাকার!"
আলতামাশ নরুণিয়া হাত থেকে দস্তানা খুলে মাটিতে ছুড়ে মেরে দেরাজ খুলে একটা মোটা বই বের করলেন। কিংকু চৌধারি রুদ্ধশ্বাসে বললেন, "স্যার, অপেরা গ্লাসটা...?" ঝাকানাকা অপেরা গ্লাসটা নাক থেকে নামিয়ে নিচু গলায় বললেন, "ক্ষৌরসভার বিধিমালা ওটা। লক্ষণ তো সুবিধার নয়।"
নরুণিয়া আলখাল্লার জেব থেকে চশমা বের করে নাকে এঁটে পাতা ওল্টাতে লাগলেন, "এই যে... ধারা এক্সওয়ানবিফরটিন...! পাঁচশো ও এক হাজার ডলারের ভাঙতি নাই! ...না, এটাতো নয়...," পরের পাতা ওল্টালেন তিনি, "এক্সওয়ানএফসেভেন... ব্যবহারে বংশের পরিচয়... না, এটাও তো নয়... কই গ্যালো?" কটমটিয়ে কোচিং সেন্টারের কোচের দিকে চাইলেন তিনি। কোচ ফ্যাকাসে মুখে ঠোঁট চেটে বললো, "স্যার, আমার যে ঠিক খেয়াল নাই...?"
আসমান কেপলার ডুকরে উঠে বললেন, "স্যার, এবারের মতো মাফ করে দিয়ে আমার মাথাটা একটু শিল্প করে দিন। ক্যারিয়ারটা মৃগেল হয়ে যাবে স্যার...!"
নরুণিয়া পাত্তা না দিয়ে পাতা উল্টে বললেন, "সংবিধানের বাইরে আমি চলি না।" ভুরু কোঁচকালেন তিনি। "পাকা লোককে দিয়ে নিয়মকানুন লিখিয়ে আনার এই একটা হ্যাপা... এত্ত ধারা-উপধারা গুঁজে রেখেছে... এক্সজিরোডিথ্রি... আলতামাশ নরুণিয়াই ক্ষৌরসভার সকল ক্ষমতার উৎস... হুমম, তা তো বটেই... এক্সনাইনপিফাইভ... বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না... এক্সটুজেওয়ান... এখানে মৃগেল হকের চুল ছাঁটানো হয় না কারণ তার মাথায় চুলই নাই... হাহা, দ্যাট ওয়াজ আ গুড ওয়ান...," একটু প্রসন্ন হয়ে উঠলো তাঁর মুখে, "এই যে... পেয়েছি, এক্সজিরোকিউনাইন... আলতামাশ ক্ষৌরসভায় রাজনীতি ও পলিটিক্সের আলাপ নিষেধ!" চোখ থেকে চশমা নামিয়ে ফটাশ করে বইটা ফের বন্ধ করে দেরাজে পুরলেন তিনি। "জেন্টলমেন, প্লিজ ভ্যাকেইট দ্য প্রেমিসিজ ইমিডিয়েটলি।"
আসমান কেপলার হাউমাউ করে উঠলেন, "স্যার, রাস্তাঘাটের উটকো লোকের কারণে দোকানের পয়মন্ত খদ্দেরকে ভাগিয়ে দিচ্ছেন? মাথায় একটা শর্ট-টার্ম শিল্প করে দিলেও তো একটা ফাইটিং চান্স থাকে আমার! উইন্টার ইজ কামিং যে!"
ঘাড়বাঁকা খদ্দেরের মাথার শিল্পকর্ম শেষ, তাই আসন ছেড়ে তোয়ালে দিয়ে নিজের গা নিজেই ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি তৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, "কার সাথে ফাইটের কথা হচ্ছে? নিউটন স্যার না চানতারা ভাবী?"
কোচিং সেন্টারের কোচ আরেকটা কড়া গুঁতো বসালো তার নবিশের পাঁজরে। নবিশ মিনমিনিয়ে বললো, "স্যার, গালঝোলা শুনে আমি কনফিউশনে পড়ে গেস্লাম... চোখের সামনে কেন যেন ঐ একটি মুখই ভেসে উঠলো... জর্জ আর আর মার্টিনের কথা আর খেয়ালই ছিলো না... ভাবলাম নির্ঘাত চুন্নু পার্টির নির্বাচনী হালচাল নিয়ে কথা হচ্ছে... এবারের মতো মাফ করে দিন স্যার...।"
আলতামাশ নরুণিয়া আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ আরেক দরজা খুলে ক্ষৌরসভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আসমান কেপলার ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠে তেড়ে গেলেন কোচিং সেন্টারের নবিশের দিকে, ঘাড়বাঁকা খদ্দের আর কোচ মিলে তাকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। ঝাকানাকা হাই তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "সব মিলে গ্যালো। চলুন, বেরোই।"
কিংকু চৌধারি হাঁপ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "চলুন স্যার। ফোনটা যত জলদি হাতে পাই, তত ভালো। ...কিন্তু ক্ষৌরসভায় ঐ আ-কারসন্ত্রাসটা কে চালাচ্ছিলো স্যার?"
ঝাকানাকা মারপিটে ব্যস্ত আসমান কেপলার আর নবিশের দিকে করুণাভরা দৃষ্টি এক ঝলক হেনে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। "কে আবার, মৃগেল হক।"
ঘাড়বাঁকা খদ্দের আর কোচ মারপিট থামানোর চেষ্টা না করে নিজেদের মধ্যে বাজি ধরে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে গুণছে, কিংকু চৌধারি সে দৃশ্য খানিক দেখে নিয়ে ঝাকানাকার সঙ্গ ধরলেন ফের। "কিন্তু আমরা তো সিসিক্যামের ফুটেজ তন্নতন্ন করে খুঁজলাম স্যার। ঐ সাইনবোর্ডে একমাত্র রংমিস্ত্রি ছাড়া আর কেউ হাতই দেয়নি। একবার একটা কাক এসে বসেছিলো, তখন মাচান থেকে নরুণিয়া সাহেব গুলি করে ওটার পালক উড়িয়ে দিয়েছেন। আমার কাছে এটা নিয়ে খুব জাঁকও করলেন, বললেন... আলতামাশের গুলি, যেন পিকাসোর তুলি।"
ঝাকানাকা গোমড়ামুখো রিসেপশনিস্টের হাতে টোকেন তুলে দিয়ে ফোন ফেরত নিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, "সেই ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা মহান রংমিস্ত্রিই তো?"
কিংকু চৌধারি হুড়োহুড়ি করে নিজের ফোন খুলে ফেসবুকে ঢোকার ফাঁকে বললেন, "হ্যাঁ স্যার! ঐ ব্যাটাই। ছ'সাত দিন পরপর এসে সাইনবোর্ডের কথাবার্তা মেরামত করে দিয়ে যায়।"
ঝাকানাকা ক্ষৌরসভার বাইরে বেরিয়ে বিনীল[১২] রঙের ওপর সাদায় লেখা সদ্য মেরামত করা "আলতামাশ ক্ষৌরসভা" লেখাটার দিকে উদাস চোখে চেয়ে বললেন, "মেরামতটা সে কীভাবে করে, সেটা কি সিসিক্যামের ফুটেজে দেখার জো ছিলো?"
[১২] বিনীল = ডার্ক ব্লু।
কিংকু চৌধারি রুদ্ধশ্বাসে মিমি চক্রবৃদ্ধির তোয়ালে পরা ভিডিও দেখছিলেন, তিনি ঢোঁক গিলে বললেন, "য়্যাঁ? ...না স্যার! মেরামতের আবার রকমফের কী? আ-কারটাকে মুছে দিয়ে যায়, নাকি?"
ঝাকানাকা কোটের পকেট থেকে চুরুটের খোল বের করে বিরসমুখে সেটার ভেতর থেকে চানাচুরমাখা হাতে ঢেলে নিয়ে বললেন, "রাস্তাঘাটে চুরুট টানলে শুনেছি পুলিশে ধরে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা করে। যত্তোসব! ...তা আ-কার কী করে মোছা হয়, সেটা ধরতে পেরেছেন তো?"
কিংকু চৌধারি রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে দ্রুত ফোনে আঙুল ডলে পরের ভিডিও খুললেন, "মিমি চক্রবৃদ্ধি আজ দু'বার গোসল করেছেন স্যার! একবার পদ্মরং সাবান দিয়ে, আরেকবার চুলবুলে শ্যাম্পু দিয়ে। দুটো তোয়ালেপরা ভিডিও এসেছে তাই। ...কী বলছিলেন যেন? ওহ... ধরতে না পারার কী আছে স্যার?" সাইনবোর্ডের দিকে হাঁ করে চাইলেন তিনি। "ঐ যে পটভূমির যে নীল রংটা আছে, সেটার এক পোঁচ আ-কারের ওপর মেরে দিলেই তো মোছা হয়ে যাবে।"
ঝাকানাকা আঙুল উঁচিয়ে বললেন, "সঠিক! পটভূমিকে সামনে আনলেই দৃশ্য গায়েব। এ যেন মঞ্চে যবনিকা ফেলে রোমিও-জুলিয়েটের উদ্দাম চুম্বনদৃশ্য ছাঁটা। এ যেন রাতের বেলা তামিল ছায়াছবি চলার সময় ঘরে বাচ্চারা ঢুকে পড়লে চ্যানেল পাল্টে টক শো ধরা। এ যেন পেছনের চুল টেনে সামনের টাক ঢাকা।" কিংকু চৌধারির মুখটা একটু কালো হয়ে উঠলো, কিন্তু দেখেও না দেখার ভান করে বলে যেতে লাগলেন তিনি, "এ যেন অতীতের শাক দিয়ে ভবিষ্যতের মাছ ঢাকা।"
কিংকু চৌধারি বিরস মুখে ভিডিওটা আরো কিছুক্ষণ দেখে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ফোন ফের জেবে পুরলেন। "কিন্তু তাতে কী সমস্যা স্যার?"
ঝাকানাকা কচমচিয়ে চানাচুরমাখা চিবানোর ফাঁকে বললেন, "এখন মনে করুন, এই যে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান রংমিস্ত্রি এসে ফি হপ্তায় সংশোধনী পোঁচ দিয়ে আ-কার ঢাকছে, এ পোঁচটা যদি পাকা রঙের না হয়? ধরুন রংটা যদি নরুণিয়ার আর্টের মতোই হেবডোমেইডাল হয়? যদি সাত দিনের মাথায় গিয়ে রংটা আপনাআপনি উবে যায়?"
কিংকু চৌধারি কিছুক্ষণ চোখ গোল করে সাইনবোর্ডের দিকে চেয়ে থেকে অস্ফুটে বললেন, "তেমন রংও হয় নাকি স্যার?"
ঝাকানাকা নাক টেনে বললেন, "আলবাত হয়। আর ওরকম রংই মৃগেল হকের আর্টের বিশেষত্ব।" বিরসমুখে কিংকু চৌধারির বাড়ানো হাতে সন্তর্পণে চুরুটের খোল থেকে আধমুঠো চানাচুর মাখা ঢেলে দিলেন তিনি। "এই যে নানা পথের মোড়ে, দালানের গায়ে, ধুধু চরের মাঝে মাসকয়েক পরপর মৃগেল হকের নানা ছবির মোড়ক উন্মোচন হয়, তখন কিন্তু কেউই তেমন আপত্তি করে না। কারণ তখন ছবি দেখে রবি চেনা যায়, আলাদা করে নিচে লিখে না দিলেও চলে। কিন্তু!" ঢেঁকুর তুললেন ঝাকানাকা, "কিছুদিন পর তার ছবি থেকে রং উবে যেতে শুরু করে। তখন কে নজরুল আর কে ফজলুল, সেটা দেখে আর চেনা যায় না, পাশে আলাদা করে আলোকচিত্র টাঙিয়ে রাখতে হয় শনাক্ত করার জন্যে।"
কিংকু চৌধারি কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, "কিন্তু কেন স্যার? ইচ্ছে করে শিল্প বিগড়ে দিয়ে শিল্পীর কী লাভ?"
ঝাকানাকা খোল ঝাঁকিয়ে ভেতরে চানাচুরমাখার শেষ দানাটাও করায়ত্ত করে বললেন, "লাভ আর লাভ। যে শিল্প হাজার বছর টেকে, তার শিল্পী না খেয়ে মরে যায় বছরকয়েকের মধ্যে। পিরামিডের শিল্পী না খেয়ে মরার পর থেকেই বাকি শিল্পীরা সাবধান হয়ে গেছে। মৃগেল হক যদি তার শিল্প বিগড়ানোর দায় মাদার নেচারের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে, আঁকার জন্যে রং কেনার পয়সাই থাকবে না তার ট্যাঁকে। ওদিকে আলতামাশের সাথে কাইজ্যা দিয়ে তার শিল্পীজীবন শুরু। দু'জনে বছরের পর বছর কলাভুনায় ঝগড়া করে যাচ্ছে। মৃগেল বলে, চুল ফেলে আঁটি বাঁধাই আলতামাশের শিল্প, তো আলতামাশ বলে, উই আর নট সো ডিফরেন্ট, মৃগেল অ্যান্ড আই!" কিংকু চৌধারির সাদা পোশাকের আস্তিনে আনমনে চানাচুররঞ্জিত হাতটা মুছে নিলেন তিনি। "মৃগেল হক তাই চিরশত্রু আলতামাশের সাথে পাল্লা দিতে স্বল্পায়ু শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে। শিল্পের গোড়াতেই সে একটা কালকাঠি[১৩] নেড়ে রাখে। তার রঙের মশলাতেই রঙের আয়ু ছেঁটে রাখা। কোনোটা সাতদিন, কোনোটা দু'মাস।" গোঁফে তা দিলেন তিনি হাসিমুখে, "কলাভুনা পত্রিকা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখে, মৃগেল হক সস্তায় নগরের রূপসজ্জা করে বেড়াচ্ছে। সত্যি কথা। ছবি সে টাঙায় মোটামুটি সস্তায়। কয়েক লাখ টাকার মধ্যেই হয়ে যায়, তাতে হয়তো তার রঙের দামটা কোনোমতে ওঠে। কিন্তু, মাসকয়েক পর যখন তার শিল্প বিগড়ে যেতে শুরু করে, তখন সবাই হট্টগোল শুরু করে। বলে, এ ছবি নামাতে হবে। আর সেখানেই মৃগেল হকের শিল্প লাভের ডিম পাড়া শুরু করে।"
[১৩] কালকাঠি = টাইমার।
কিংকু চৌধারি চোখ গোল করে বললেন, "কিন্তু কীভাবে স্যার?"
ঝাকানাকা পকেট থেকে একটা রসিদ বের করে কিংকু চৌধারিকে দেখালেন, "এই যে দেখুন, রংমিস্ত্রির বিলের কপি। রিসেপশনে ডেস্কের ওপর পড়ে ছিলো। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা আপনার গদোগদো হাসি দেখে ভড়কে গিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরানো মাত্র হাতিয়ে নিয়েছি। দেখুন, কোম্পানির নামটা কী লেখা?"
কিংকু চৌধারি অস্ফুটে বিলটা পড়লেন, "কেবিএইচ বিল্ডার্স অ্যান্ড ডেমোলিশার্স... উই ফিক্স, অ্যান্ড নিক্স অ্যাজ ওয়েল... স্যার, এরাই তো কয়েক মাস পরপর নানা মোড় থেকে মৃগেল হকের ছবিগুলো ভেঙেচুরে সরিয়ে নিয়ে যায়! শহরের চার টুকরোর চার নগরপালের[১৪] সাথেই এসব জঞ্জাল সরানো বাবদ কোটি কোটি টাকার চুক্তি আছে এদের!"
[১৪] নগরপাল = মেয়র।
ঝাকানাকা বললেন, "ইনডিড। আর্ট যদি কয়েক মাস পরই জঞ্জাল হয়ে যায়, তবে লাভ কার?"
কিংকু চৌধারি ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন, কিন্তু ভাবনা বেশিদূর এগোনোর আগেই ঝাকানাকা বললেন, "এবার এটা দেখুন।" কোটের ভেতর পকেট থেকে ষান্মাসিক কলাভুনার একটা কপি তিনি বাড়িয়ে ধরলেন কিংকু চৌধারির দিকে, "প্রকাশকের নামটা দেখুন।"
কিংকু চৌধারি পড়লেন বিড়বিড়িয়ে, "কেবিএইচ পাবলিকেশন্স... লাইফ ইজ শর্ট বাট আর্ট ইজ লং... এ কী স্যার, এরাই কি তবে...?"
ঝাকানাকা মাথা ঝাঁকালেন, "কালিবাউশ হক গ্রুপ অফ কোম্পানিজ। কিছু বুঝলেন?"
কিংকু চৌধারি হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, "স্যার, মৃগেলে-কালিবাউশে কেমন যেন একটা মাসতুতো ভাইয়ের গন্ধ পাচ্ছি।"
ঝাকানাকা আস্তিন থেকে টোকা দিয়ে একটা পোকা সরিয়ে দিয়ে বললেন, "হুমম। একেই লাতিনে বলে, Ars gratia fratris।"
কিংকু চৌধারি মাথা চুলকে বললেন, "কী দুষ্টু!" কী ভেবে কেমন যেন আশামাখা কাঁপা হাসি ফুটলো তার মুখে, "স্যার, ওদের কি কোনো তোয়ালে কোম্পানি আছে যেটার সুতো ধরুন হঠাৎ একদিন সব খুলে গিয়ে তোয়ালে একদম ঝুরঝুরে স্বচ্ছ হয়ে যাবে?"
ঝাকানাকা কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে চেয়ে থেকে কিংকু চৌধারির হাসি শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে বললেন, "থাকতেও পারে, কিছুই অসম্ভব নয়।"
কিংকু চৌধারি হাতে কিল মেরে বললেন, "চলুন স্যার, ঐ রংমিস্ত্রিটাকে ধরে নিয়ে প্যাঁদাই, মৃগেল হকের সব বৃত্তান্ত স্বীকার না করা পর্যন্ত।"
ঝাকানাকা গাড়ির দিকে পা বাড়ালেন, "তার দরকার পড়বে না। ঐ রংমিস্ত্রিটাই মৃগেল হক, সেটা এতক্ষণেও বোঝেননি?"
কিংকু চৌধারি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, "কিন্তু... কিন্তু...।"
ঝাকানাকা গাড়ির দরজার হাতল পাকড়ে বললেন, "সমস্যাটা আপনার একার নয় অবশ্য। আলতামাশ নরুণিয়াও আপনার দলেই পড়ে। খেয়াল করে তার বকবক শুনলেই টের পেতেন, সে সবাইকে চেনে চুল দেখে। ব্রাজিলে সেনিয়োরা আলাদিনিঞোর সরাইয়ের গল্পটা মনে আছে? পেলের মাথায় টুপি ছিলো বলে সে প্রথমটায় চিনতেই পারেনি তাকে। লামাদের মাথা কামানো থাকে বলে তিব্বতে গিয়ে সে চিনতে পারেনি, লামা তিব্বতের স্থানীয় লোক নাকি বিদেশি। কুতুবদিয়া রায়ের সিনেমা দেখেও প্রোফেসর মঙ্গু আর তার পোষা কাঠবেড়ালি আইনস্টাইনকে চিনতে পারেনি, কারণ তাদের মাঝে যার চুল থাকার কথা তার নেই, আর যার টেকো হওয়ার কথা তার মাথাভর্তি চুল।" দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, "নিজের শিল্পে আকণ্ঠ ডুবে আছে বেচারা নরুণিয়া। বাদবাকি দুনিয়া তার কাছে হিটলারের কানের লতির মতো।"
কিংকু চৌধারি বললেন, "হিটলারের কানের লতিতে কী আছে স্যার?"
ঝাকানাকা গাড়ির ভেতর এক পা ঢুকিয়ে বললেন, "আই রেস্ট মাই কেইস। মৃগেল হকের ব্যাপারটা আদৌ নরুণিয়াকে জানাবো কি না, ভাবছি। শিল্পীদের শিল্পে নাক যত কম গলানো যায়, তত ভালো। যা বুঝতে পারছি, এ দু'জনের ঝগড়ার গুড় কালিবাউশ হকের তবিলে ঢোকে। তারচে বরং চলুন, এবার বদরুকে নিয়ে কী করা যায়, ভাবি।"
কিংকু চৌধারি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, "বদরু? বদরু খাঁ? বদরু এর মাঝে কোত্থেকে এলো স্যার?"
ঝাকানাকা ফের গাড়ি থেকে পা বের করে কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললেন, "আপনি কি এখনও ধরতে পারেননি যে আসমান কেপলারের প্রতিদ্বন্দ্বী ঐ আলতাব নিউটন আর ইসরাফিল পাস্কেল যে একই লোক... আওয়ার ওল্ড ফ্রেন্ড অ্যান্ড কনজেনিটাল বেলাবিস্কুটখোর বদরু খাঁ? আপনি এখনও বোঝেননি সে বছরের পর বছর ধরে ছদ্মবেশ নিয়ে প্রোফেসরদের জন্যে বরাদ্দ কমপ্লেক্সে মুখোমুখি দুই ফ্ল্যাট আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই আপিস দখল করে তার পেজোমি চালিয়ে যাচ্ছে? আপনি এখনও বোঝেননি যে টাকমাথার আলতাব নিউটন একটা উশকোখুশকো পরচুলা আর সালভাদর দালিমার্কা গোঁফ পরে ইসরাফিল পাস্কেল সাজে? আপনি এখনও ধরতে পারেননি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলতাব নিউটন ডোরাকাটা দলের গোদা আর ইসরাফিল পাস্কেল ফোঁটাকাটা দলের গোদা, যাতে করে যে কোনো ভোট হলে সবসময় বদরুই জেতে? আপনি এখনও ধরতে পারেননি যে বদরু খাঁ তার বিটকেলপনার স্কুলে পড়ার সময় ছদ্মবেশের কোর্সে লিখিত পরীক্ষার বদলে হাতে-কলমে পরীক্ষা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সাথে দু'জন শিক্ষকের পদ বাগানোর প্রোজেক্ট জমা দিয়েছিলো? আপনার মনে কি কখনও খটকা জাগেনি যে টকশোগুলোতে সবসময় আসমান কেপলারের সাথে হয় আলতাব নিউটন নয় ইসরাফিল পাস্কেলের ঝগড়া-মারামারি হয়, কিন্তু কখনও আলতাব নিউটন আর ইসরাফিল পাস্কেলকে মুখোমুখি দেখা যায় না?"
কিংকু চৌধারি প্রশ্নের তোড়ে একেবারে ভড়কে গিয়ে খাবি খাচ্ছিলেন, তিনি কোনোমতে সামলে নিয়ে বললেন, "কিন্তু স্যার... এ তো জানা কথা... দু'জনের মাঝে অনেক মনোমালিন্য... একজন আরেকজনের মুখ দেখেন না... একসাথে কোথাও যান না... ওহ...!" ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভীষণ ভ্রুকুটি হেনে চুপ করে গেলেন তিনি, তারপর ডুকরে উঠলেন, "কিন্তু স্যার... বিশ্ববিদ্যালয়েরই বা এ কেমন তরিকা? তারা কি নিয়োগ দেওয়ার আগে লেকচারারদের চুল আর গোঁফ একটু টেনে দেখতে পারে না, দবিরই কবির সেজে ফের আরেকটা পোস্ট বাগিয়ে নিচ্ছে কি না?"
ঝাকানাকা কাঁধ ঝাঁকালেন, "হু আর উই টু জাজ দেম?"
ক্ষৌরসভার ভেতর থেকে চাপরাসপরা দু'জন লোক এবার ঠেলতে ঠেলতে আসমান কেপলার আর কোচিং সেন্টারের সেই নবিশকে বাইরে বের করে নিয়ে এলো। দুজনেরই চোখমুখ ফুলে আছে, আসমান কেপলারের টাইটা নবিশের হাতে, নবিশের টিশার্টের একটা ফালি কেপলারের দাঁতে। তাদের পিছুপিছু বিরসমুখে বেরিয়ে এলেন সেই ঘাড়বাঁকা খদ্দের আর কোচ।
ঝাকানাকা গাড়িতে চড়ে বসলেন, "চলুন দারোগা সাহেব। বদরু খাঁ উপাচার্য হয়ে বসলে কী হতে পারে, সেটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে আমাদের। এমনও হতে পারে, ভিসির গদিখানা আসমান কেপলারের নিচে না গিয়ে বদরুর নিচে গেলেই বরং আখেরে দেশের-দশের লাভ হবে।"
কিংকু চৌধারি গাড়ির দরজা ধরে মনমরা মুখে বললেন, "কিন্তু স্যার... বেগম পাস্কেল আর বেগম নিউটন তো ফি হপ্তায় নিজেদের মধ্যে একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে ঝগড়াঝাঁটি করেন... তবে কি বদরু...?"
ঝাকানাকা গলা খাঁকরালেন, "লেটস নট ডেল্ভ ইনটু ঠু মাচ ডিঠেইলস। ওটা নারীপুরুষের নিজস্ব বখেড়া, আনলেস বেগম পাস্কেল অর বেগম নিউটন প্রেসেস চার্জেস অ্যাগেইনস্ট বদরু। আর বদরু সেই স্কুল আমল থেকেই প্রোজেক্ট-অ্যাসাইনমেন্ট-হোমওয়ার্ক খুব মন দিয়ে করে আসছে। প্রোজেক্টে লেটার মার্ক তোলার জন্য ছদ্মবেশ নিয়ে বছরতিরিশেক ধরে দুটো সংসার সামলানো তার জন্যে কোনো ব্যাপারই না।"
কিংকু চৌধারি গাড়িতে উঠে গোমড়ামুখে চাবি ঘোরালেন। "স্যার, মিছিমিছি দু'ঘণ্টা মোবাইল ছাড়া বসে নরুণিয়ার বকবকানি শুনলাম। এখন তো মনে হচ্ছে, আপনি এই কেসের একদম শুরুতেই বুঝে গেছেন, এই আ-কার নিয়ে বিটকেলপনার পেছনে কে আছে। তাই না?"
ঝাকানাকা উদাস হেসে পকেট থেকে ফোন বের করে খানিক ঘেঁটে আলতামাশ ক্ষৌরসভার বিকৃত সাইনবোর্ডের ছবিখানা খুঁজে বের করে কিংকু দারোগাকে দেখালেন। "এটা দেখার সাথে সাথেই। মৃগেল হক ছাড়া আর কার আঁকা আ-কার দেখতে এ-কারের মতো হবে, বলুন?"
[শেষ]
মন্তব্য
(১) ঝাকানাকা-কে ফিরে পাওয়ার জন্য কয়েক গোছা
(২) গল্প কোনদিকে যাচ্ছে এখনও ধরতে পারিনি। আর, মালবালা = নারী মডেল ... এই সমীকরণটাও ধর্তারিনাই
(৩) সচলে লেখার নদী এখন যেমন ধীরে বয়, তাতে চা-চু হয়ে যাওয়ার সময়-টা মনে হয়, ঠিকমতন-ই খাপ খেয়ে যাবে
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
(২) মালের উছিলা যে বালা ইতি মালবালা। পুরুষ মডেল হবে মালপুরুষ।
না না না! এ হতে পারে না! মালপুরুষ শুনে মায়াপুরুষের কথা মনে পড়ে, অন্য নাম দেন!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আরে-আরে কই পালান? আয়েন, আয়েন, আমার লগে চা খান - একদম গরমাগরম চা! চা শেষ হওয়া মাত্রই আবার গল্প নিয়ে বসা যাবে! আমি আছি কুনো চিন্তা নাই, আমি আপনারে সচলায়তনের রাস্তা চিনায়া দিমুনে, দরকার হইলে এক্কেবারে পৌঁছায়া দিয়া আমুনে। ঠিক আছে না?!!
****************************************
চায়ের কাপটা পুরোপুরি ভরুক, কী বলেন ?
এই কাপটা আমার জন্য। আপনারটা ভরা হয়ে গেছে এবং পাশেই আছে । তাড়াতাড়ি আসেন, আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
****************************************
লেখার বাকি অংশ কবে দিবেন হিমু ভাই ?
এখন।
গল্পের গতিবিধি এখনো আঁচ করতে পারিনি। তবে ঝাকানাকা ইজ ব্যাক এই আনন্দেই আপনার হয়ে এক্কাপ লেবু চা খেয়ে ফেললাম। আপনার চা চু না খেলেও চলবে
হেঁসোঠ্যাং শব্দটা দারুণ
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
আসলে ঝাকানাকার বেশ কিছু নতুন গোবদা গল্প লিখে ফেলে রেখেছি, ভেবেছিলাম আরেকটা বারোশিঙা বই বের করবো। কিন্তু তারপর কেন যেন আর আগ্রহ পেলাম না। নতুন করে আবার কিছু লিখবো, দেখি।
নতুন করে যা লিখবেন সেগুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তা করবেন। আর যে গোবদা গল্পগুলো লিখে ফেলেছেন ওগুলো নিয়ে আগামী মাসে বই অথবা ইবই বের করুন। বই বের করতে ইচ্ছে না হলে প্রতি সপ্তাহে একটা করে গল্প সচলে পোস্ট করে দিন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পুরনোগুলো বরং থাকুক। নতুন করে লিখলে আমারও আড় কাটবে।
খাডাই খাবি পুরানোগুলি দিয়া?
আপনহাতি = স্বহাতি কর। ভাল্লাগবে।
আর, আমার ক্যামেরা কইরে পাপিষ্ঠ? ওইটা দিয়া স্বহাতি ছবি তুলুম।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
এতো অতি গভীর জলের কাহিনী দেখা যাচ্ছে, চা চ্চু খাওয়ার বিরতি অবধি বেশ খানিকটা হাবুডুবু খাওয়া হল।
গল্পের গরু গাছে উঠে গেছে।
গোয়েন্দা ঝাকানাকা দেখে শনিবারের জন্য জমায় রেখে দিলাম, ভাবছিলাম ঝাকানাকিয় হাতিপোস্ট লিচ্চয়। তারপর পড়তে এসে পুরাই প্রপঞ্চ, চাইর মিনিটে খতম। আগে একটা গল্প না লিখছিলেন যেইটা দুই চাইর ঘন্টা পরপর সাইজে বাড়ত, এইটা কি সেইরকম কিছু?
..................................................................
#Banshibir.
হাঁ। এটা একটু পরপর এক এক কাপ চা খেয়ে এসে লিখে যাবো।
..................................................................
#Banshibir.
ঘ্যাচাং
চা-চু এর ফাঁকে ফাঁকে লেখা বেড়ে যাওয়া আর তার মধ্যে ছবি জুড়ে ফেলাটা বেশ মজার হয়েছে।
ছবিদুটো অত্যুত্তম!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
শুভেচ্ছা স্বাগতম গোয়েন্দা ঝাকানাকার প্রত্যাবর্তন! মেলাদিন পর ঝাকানাকা কে দেখে অনেক খুশি হলেম। পোস্ট নীচে নামার অপেক্ষায় না থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় চা পানের সাথে গল্পটাও বাড়তে থাকুক। ঝাকানাকা কে ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাপক ধইন্যা।
প্রচ্ছদটা আপনার করা হিমুভাই?
নাহ, সুজনদার আঁকা ঝাকানাকার সাথে বাকিটা জুড়েছেন এক দুর্ধর্ষ গুণী শিল্পী বন্ধু। মৃগেল হকের সৃষ্টি ছবিগুলো আমি তুলে ধরার চেষ্টা করছি অলংকরণে।
ছবির জন্য গল্পের আকর্ষণ একশ গুন বেড়ে গেছে হিমুভাই , কি আর কমু ।
হিমুভাই গোয়েন্দাগিরি কি শেষ হয়েছে নাকি মৃগেল করা হবে শেষমেষ ?
বাহারে! ছবি আর লেখায় দেখি ভরপুর অবস্হা। বিপ্লবী ছবিটা দেখে সচল রণপদীম বসু'দার কথা মনে পড়ে গেলু! ঝাকানাকার বর্ধিত অংশ পড়ে নেয়া যাক পটাং করে....
প্রচ্ছদের ছবিঃ এই ধৌতি (wash painting) ধরনের চিত্র দেখলে একটু মন খারাপ হয়। ঝাকানাকার গল্প যেমন তাতে বাহারী রঙে রঙিন ছবি না হলে পোষায় না।
বিদ্রোহীঃ লোকটা কি জেলের ভেতরে না বাইরে? ভেতরে হলে তাকে ঠিক কয়েদী বলে মনে হচ্ছে না; আর বাইরে হলে তার চেহারায় 'চুরমার কইরা ফালামু' ভাব ভালো ফুটে ওঠেনি।
রবি করে জ্বালাতনঃ এটা ঠিক মৃগেলীয় হয়েছে!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ঝাকানাকা আঁকা পাকা না হলে কি চলে? সুজন্দা একটু অবকাশ পেলে আবার কিছু ছবি আসবে আশা করি। আমি আঁকতে গেলে সেটা মৃগেলায়নের চূড়ান্ত হবে।
সেলফি-র বাংলা আমি প্রস্তাব করলাম -
আমার কাছে এটা সেলফি-র মতই সংক্ষিপ্ত এবং দ্রুত ও সহজে উচ্চার্য মনে হচ্ছে। উপরন্তু, শব্দটা শুনলে অর্থের হদিশটাও প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই পাওয়া যায়, অর্থ নিয়ে মাথা ঘামানো লাগে না!
আপনার কি মনে হয়?
****************************************
আপনছবি ভালো।
আমি আপনহাতি ছবি বলি কারণ নিজের ছবি নিজের হাতে তোলা ব্যাপারটার মধ্যে যে মরিয়া অসহায়ত্ব আর স্বয়ম্ভরতার স্পর্ধা আছে (সেলফি শব্দটার মধ্যেও এ ব্যাপারটা আছে), সেটা হাত বাদ দিয়ে বললে মনে হয় যেন ঠিকমতো ফুটলো না। আপনহাতির মধ্যে "থাকিতে নিজের হস্ত হবো না পরের দ্বারস্থ" গোছের একটা ঘোষণা শুনতে পাই আর কি। আপনহাতি অবশ্য শুধু ছবিই না, ধরুন নিজের বই নিজের ছাপানোকেও আপনহাতি বই বলা যায়, কিংবা নিজের বাড়ি নিজেই বানালে সেটা আপনহাতি বাড়ি।
আরেকটু যদি খুঁটিয়ে দেখি, এখন ভ্রমর (Drone) দিয়ে "আপনছবি" তোলা যায়, কিন্তু সেটা ঠিক "আপনহাতি" ছবি হয় না। ভ্রমরে তোলা ছবিতে আপনার হাতে স্বয়ম্ভরতার সুযোগ আছে, কিন্তু ওর মধ্যে আপনহাতি ছবির করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে মরিয়াভাবটা নেই।
সেলফি’র প্রতিশব্দ হিসাবে একদা “নিজস্বী” শব্দটি প্রস্তাবিত হয়েছিল বোধহয়!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ইয়ে, এই ঝাকানাকার একটা লিংক কী কোনমতে মৃগেল হকের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
গল্পের কাল্পনিক চরিত্রের কাছে কি আর এসব পৌঁছায়? যে জীবন দোয়েলের মৃগেলের, মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা।
হাহাহাহা। অনেকদিন পর ঝাকানাকা পড়ে একেবারে আপাদমস্তক আনন্দ পেলাম।
নরুণিয়া সেইরকম বাণী দিচ্ছে ---
প্রতিবার পড়তে এসে দেখি গল্প আর ছবি একটু করে বাড়ছে, একেবারে জীবন্ত গল্প, চলুক।
ও - ভয় দেখাতে 'আয় মৃগেল করাই" এর সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
ঝাকানাকা আর কিংকু কোন রহস্যের সুলুক সন্ধানে এই ক্ষৌরসভায় এসেছে তা এ পর্বের প্রথম অর্ধেকে বা মাঝামাজি আসলে ভাল হত।
মার্গারেট আর্টউড যেমন বলেন, শুরুতেই একটা লাশ ফেলে দিতে হবে নইলে পাঠক পাতা উলটাবে কেন?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
- 'সুপারি দেয়া' বা 'সুপারি খাওয়ানো' phrase-টা কি বাংলা ভাষায় আগে থেকেই ছিল নাকি এটা ইদানীং অন্য ভাষা থেকে adopt করা হয়েছে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নিশ্চিত না। হিন্দি থেকে এসে থাকতে পারে।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বড় আকারের গল্প এভাবে দফায় দফায় একই পোস্টে দেয়াটা সমর্থন করি। এতে আগের লিংক(সমূহ)-এ বার বার ফেরত যাবার সমস্যা থাকে না। কোন পাঠক পুরোটা এক দফায় শেষ করতে চাইলে এক পোস্ট পড়েই তা সম্ভব হবে। সমস্যা হচ্ছে এতে পোস্টটা নীড়পাতা থেকে সরতে সরতে বহু পেছনে চলে যায়। ফলে গল্পটা পরে আসা পাঠকদের চোখে পড়ার আর সহজ উপায় থাকে না। এই প্রকার ধারাবাহিকের জন্য নীড়পাতায় একটা সাময়িক লিংক ঝুলানোর ব্যবস্থা কি করা যায়?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভালো আইডিয়া, কিন্তু এটার স্বয়ংক্রিয়করণে একটু জটিলতা হতে পারে। লেখকরা যদি অতিরিক্ত চা-সেবনের বদভ্যাস থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে পারেন, তাহলে বরং অনেক লেখা সচলের পাতা সরার আগেই পাওয়া যাবে।
চা খুব কম খেলেও ধাপে ধাপে বাড়তে থাকা লেখা নীড়পাতা থেকে দুম করে সরে যেতে পারে যদি দশ জন লেখক অল্প সময়ের মধ্যে তাদের লেখা পোস্ট করে বসেন। শুরুতে একটু জটিলতা তো হবেই। লেখার আকার বিবেচনায় এবং লেখকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মডুরা নীড়পাতার ডানে-বাঁয়ে কোথাও একটা লিংক ঝুলিয়ে দিতে পারেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সচলের কিছু কলকব্জা ঘষামাজা বকেয়া পড়ে আছে। ঘষামাজার সময় এই কায়দাটা কাজে লাগানো যেতে পারে। সমস্যা হচ্ছে ডেভু মহারাজও চায়ের মজা পেয়ে গেছে। যে দুরাত্মা এই চায়ের অপসংস্কৃতি চালু করেছে তাকে কিলাতে হবে।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
মনের মুকুরে বা ইংরেজি সেকশন-এর মতো "চলমান গল্প" শিরোনামে একটা সেকশন বা লিংকবার/ন্যাভবার সৃষ্টি করা যেতে পারে মনের মকুরের উপরে বা নীচে।
****************************************
আপনি আর ষষ্ঠ পাণ্ডব চলমান গল্প লেখা শুরু করে দিন। দুয়েকজন চা-পিশাচের জন্য আস্ত একটা খিড়কি বানালে কি চলবে?
মিমি চক্রবৃদ্ধি এক দিনে দু'দু' বার করে চান করে দু'দু'খানা ছবি আপলোড করলেন আর অলঙ্করণ শিল্পী এর কোন অলঙ্করণ করলেন না - এটা কি ঠিক হলো? অনতিবিলম্বে এই অপরিপূর্ণতা দূর করা হউক!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
এমনও তো হতে পারে যে অলংকারী সে চেষ্টা করতে গিয়ে মাঝপথে উদাস হয়ে গেছেন?
উদাস ভাব কাটলে তিনি আবার চেষ্টা করুন। যেপ্রকার নিয়মিত চেষ্টায় রোমান অসভ্যতা দূর করতে হয়, সেপ্রকার নিয়মিত চেষ্টায় উদাস ভাব দূর করতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আচ্ছা, আবার দেখেন তাহলে।
ধন্যবাদ। মোটামুটি চলে। আরও মক্শো করা লাগবে। বাঁক নাই, চক্রবৃদ্ধি নাই এমন মিমি লইয়া দর্শক-পাঠক সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
লেপ্টপ ওরফে কোলকম্পুখান কাত করে ধরে দেখবেন আরেকবার ?
পরের গল্পের প্রচ্ছদ:
গল্প কি তাহলে ধূম + আয়ুধ নিয়ে?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বাঁচতে হলে জানতে হবে,
জানতে হলে পড়তে হবে,
পড়তে হলে আসতে হবে
স-চ-লে!
নতুন মন্তব্য করুন