বন্যায় বিশুদ্ধ পানি

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: সোম, ০৬/০৮/২০০৭ - ১২:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


১.

বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার ধারণা কম। বন্যার কারণে একবার শ্রীমঙ্গলে আটকা পড়েছিলাম বহু বছর আগে, পরে খানিকটা বাস, খানিকটা নৌকা এমন করে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো। আবার '৯৮ সালের বন্যায় যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম নিচতলায়, তা রীতিমতো কবলিত হয়ে পড়েছিলো। বারান্দায় বসে দেখছি, বৃষ্টি পড়ছে সমানে, আর ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ বাড়ি খাচ্ছে, সামনের রাস্তায় গাড়ি চলছে, তার ধাক্কা এসে পড়ছে আমাদের বারান্দায়। পানি আরো বাড়ার আগেই কার্পেট গুটিয়ে ওপরে তুলে রাখতে হবে, এমন বিমর্ষ খাটনির চিন্তা করছিলাম বসে বসে। আমাকে নিশ্চয়ই তখন খুব প্রৌঢ় আর দেখাচ্ছিলো।

খবরের কাগজে বন্যার্ত একেকজন মানুষের চেহারায় আমি আমার নিজের সেই সময়ের ছাপ খুঁজে পাই। বাড়িঘর তলিয়ে গেছে পানির নিচে, "মুল্যবান" জিনিসপত্র কোঁচড়ে করে একেকটা পরিবার খোলা আকাশ কিংবা সামান্য ঝুপড়ির নিচে আশ্রয় নিচ্ছে। খাবার, সুপেয় পানি, ঔষধ, নিরাপত্তা ... সব কিছুর অভাব। আছে সাপের দংশনের ভয়, আছে দুর্বৃত্তের হাতে লুণ্ঠিত হবার ভয়। কী একটা বিকট অসহায় অবস্থা!

সুপেয় পানির সমস্যাটাই বড়। কিছু কম খেয়ে তা-ও টেকা যায়, কিন্তু দূষিত পানি মানেই রোগ। আর অল্প জায়গায় ঠাসাঠাসি করে অনেক মানুষ যখন আশ্রয় নিচ্ছে অপেক্ষাকৃত উঁচু কোন স্থানে, পানিবাহিত রোগ মূহুর্তের মধ্যে মহামারির স্তরে চলে যেতে পারে (স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কোন এলাকায়া প্রতি ১০,০০০ জনে ৪০০ জন মানুষ কোন রোগে আক্রান্ত হলে সেটাকে মহামারি ধরা হয়)।

বাজারে গত বন্যায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো কোন মাদারচোদ মজুদদারের কল্যাণে। এবার নাকি এই খানকির বাচ্চারা স্যালাইন হাওয়া করে দিয়েছে। কী আর বলবো।

২.

মাঠ পর্যায়ে সুপেয় পানির এই সমস্যাকে কিভাবে মোকাবেলা করা হয়, আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। যাঁরা জানেন, তারা আমাকে জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো।

নেট সংযোগ কিছু সময়ের জন্যে বন্ধ ছিলো বলে মাথার ভেতরে কাজ করে চলা একটা ছবি আঁকলাম বসে বসে।

প্লাবনপ্রবণ এলাকায় নিশ্চয়ই প্লাবনের সময় পানিসম্পদ বিভাগ জরিপ চালায়। প্লাবনকে আমরা দু'ভাগে ভাগ করতে পারি, স্বাভাবিক প্লাবন এবং অস্বাভাবিক প্লাবন। ধরে নিই, কোন একটি প্লাবন এলাকা স্বাভাবিক প্লাবনের সময় সে এলাকার ঘরবাড়ি দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত প্লাবিত হয়, আর অস্বাভাবিক প্লাবনের সময় জলসীমা ঘরের জানালা অতিক্রম করে। ভুল যদি না করি, আমাদের দেশে এক দশকে তিনবার স্বাভাবিক বন্যা আর একবার অস্বাভাবিক বন্যা হয়।

অস্থায়ী পাম্প, স্থায়ী স্থাপনা পদ্ধতি

একটি প্লাবন এলাকায় একটি স্থায়ী পাম্পস্থাপনা নির্মাণ করা যেতে পারে। এ স্থাপনায় থাকবে একটি উঁচু প্ল্যাটফর্ম, যা গত কয়েক দশকের অস্বাভাবিক প্লাবনসীমার ওপরে। প্ল্যাটফর্মটি ধারণ করবে কংক্রীট শেলে আবৃত একটি ৫ মিলিমিটার পুরুত্বের মাইল্ড স্টীলের পাইপ, যা প্রোথিত থাকবে মাটির নিচে পানির স্তর পর্যন্ত।

পাম্প স্থাপনায় কোন পাম্প রাখা হবে না, পাইপের মুখ সীল করে রাখা হবে। যখন বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেবে, তখন সরকারী স্টোর থেকে পাম্প, এনজিন ও সরবরাহ পাইপ রিকুইজিশন দিয়ে এনে এখানে সংযুক্ত করা হবে। পাম্পের জন্য জ্বালানি নিয়ে একজন পাম্পচালক নির্দিষ্ট সময় পর পর এসে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তা সরবরাহ করবেন স্বেচ্ছাসেবক জলসরবরাহকারী বিভিন্ন দলকে, যাদের কাজ হবে নিজ উদ্যোগ সে পানি বিভিন্ন বন্যার্ত জনপদে সরবরাহ করা। যদি বন্যার্তরা নিজেরা নৌকোয় করে পানি নিতে আসেন, তাহলে আরো সুবিধা।

এ পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা স্থবিরতা আছে, দশ বছরে চারবার ব্যবহৃত হবে এমন একটা জিনিস নির্মাণের প্রস্তাব আছে, কিন্তু বিপদের মুখে সুপেয় পানির নিরাপত্তা যোগানো বোধহয় সহজতর হতে পারে।

আমি জানি না, এ পদ্ধতি ইতিমধ্যে কার্যকর কি না। যদি কার্যকর হয়েও থাকে, তাহলে নতুন করে চাকা আবিষ্কারের লজ্জামেশানো আনন্দ নিয়েই নাহয় থাকবো।

সংযুক্ত ছবিটি কিছুটা সাহায্য করতে পারে পাঠককে।


১. প্লাবন অঞ্চলকে কয়েক শত প্লাবন এলাকায় ভাগ করা যেতে পারে, প্লাবনের তীব্রতা ও স্থায়িত্বের ভিত্তিতে। এক একটি প্লাবন এলাকা ত্রাণ ও সহায়তার জন্য প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে থাকতে পারে।


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

পড়েছি।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

হিমু এর ছবি

বস, আপনার থিসিসটার কী হবে? সে কি আংরেজি হয়েই পড়ে থাকবে?


হাঁটুপানির জলদস্যু

হাসান মোরশেদ এর ছবি

একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করিঃ
২০০৪ এর বন্যায় আমরা বন্ধুরা মিলে ত্রান বিতরন করেছিলাম গোয়াইনঘাটের ভারতীয় সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় । আগের তিনচার দিন ধরে শখানেক প্লাষ্টিকের জার জোগাড় করা হয়েছিলো । সোয়াবিন তেলের তিনচার কেজি ওজনের জার এ ক্ষেত্রে আদর্শ । ভালো করে পরিস্কার করে, পানি ভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । এটা হলো সাময়িক একটা ব্যাপার । শুকনো চিড়া,গুড়,বিস্কুট এর পানি আবশ্যক ।
পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট প্রয়োজনের সময় পাওয়া যায়না । এটা একটা আপদ । এ ক্ষেত্রে ফিটকিরি কিছুটা কাজ দিতে পারে ।

এটা বললাম বন্যাকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা । হিমু নিশ্চয়ই দীর্ঘমেয়াদী টেকসই প্রযুক্তির কথা ভাবছেন ।

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আড্ডাবাজ এর ছবি

পড়লাম। প্রযু্ক্তির সাথে কি অর্থায়নের গ্যারান্টি আছে?

হিমু এর ছবি

অর্থায়নের গ্যারান্টি একেবারেই নেই।

অন্য প্রসঙ্গে বলি। যে কোন দুর্যোগে দুর্গতদের ত্রাণ সহায়তা দেয়ার প্রক্রিয়াটিরও বিরোধিতা করি। আমি মনে করি, যে জনগোষ্ঠী দুর্গত হয়ে পড়ার আশঙ্কায় থাকে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাদের সর্বাগ্রে প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত।

উদাহরণ দেই, ধরা যাক সিরাজগঞ্জে বন্যা হয় উল্লেখিত ফ্রিকোয়েন্সিতে। বা বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় হয় অন্য কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে। সেক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে শিক্ষাক্রমের মধ্যে "বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশল" নামে একটি বিষয় থাকা উচিত। একইভাবে "ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশল" নামে একটি বিষয় থাকা উচিত বাগেরহাট অঞ্চলের স্কুল কলেজে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে, এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করবে যারা তাদের বিশেষ কোন সুবিধা দেয়া যেতে পারে। যখন বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় দেখা দেবে, তখন দুর্গতরাই নিজেদের সাহায্যে অনেকাংশে এগিয়ে আসতে পারবেন।

যে কোন দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ একটি কঠিন ব্যাপার, এ ব্যাপারটি সহজ এবং কার্যকর হতে পারে যদি দুর্গতদের মাঝে সুপ্রশিক্ষিত একটি কর্মীবাহিনী পাওয়া যায়।

সারাজীবনই বন্যার সাথে বসবাস করতে হবে বাংলাদেশকে। এ ব্যাপারটা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কি এখনো কেউ হৃদয়ঙ্গম করেননি? ত্রাণের বোঁচকা মারার সংস্কৃতি থেকে কি নেতা আর কেষ্টুবিষ্টুরা বেরিয়ে আসতে পারবেন না কখনো?


হাঁটুপানির জলদস্যু

দ্রোহী এর ছবি

আইডিয়া খারাপ না। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব না! প্রকল্পের সব টাকা খানকির পোলারা খেয়ে ফেলবে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

হিমু এর ছবি

সামনে আবার প্লাবন দেখা দিচ্ছে। আমার এই আইডিয়াটা মনে হয় এখনও প্রাসঙ্গিক।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।