পা এ সাগ বুসিদা মজনু
শখস এ পুশত --- ইয়ে চিস্ত
গোফত ইয়ে সাগ গাহে গাহে
রাহ এ লায়লা রফতাহ বুদ.১।
লাইলি ঘুম ভাঙার পর একেবারে বারান্দায় গিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। হাত উঁচু করে মাথার পেছনে নিয়ে কয়েকবার ডানে বামে শরীর মোচড়ায় লাইলি, তারপর চোখ বন্ধ করে কোমরে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড় বড় সশব্দ শরীরদোলানো শ্বাস নেয়। ইয়োগা। ওদিকে রাতে সে ঘুমায় একটা পাতলা নাইটি পরে। তাই ভোরবেলা লাইলিদের বাড়ির সামনে জগারদের ভিড় জমে। অনেক চিনাবাদামওয়ালা লাইলিদের বাড়ির সামনে ফুটপাতে চোঙা পেতে বসার জন্যে সেই ভোরবেলা এসে দখল নেয়। খেজুরের রস, আখের রস, চিরতার রস প্রভৃতি বিভিন্ন রসের রসিকরা তাদের গামছা ঢাকা পাতিল নিয়ে বসে যায় ফুটপাথের ওপর, লাইলির আড়মোড়াভঙ্গের নিয়মিত দর্শকরা দশ পনেরো মিনিট বাদাম চিবাতে চিবাতে অপেক্ষা করে, আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে লাইলি বারান্দায় বেরোলে সেই দৃশ্য মিনিট পাঁচেক রূদ্ধশ্বাসে অবলোকনের পর চোঁ চোঁ করে এই রস সেই রস পান করে ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরে যায়। ছেলে থেকে বুড়ো সকলেই আছে সেই স্বাস্থ্যপ্রেমী (নিজের স্বাস্থ্য এবং লাইলির স্বাস্থ্য) জনতার মাঝে। ছেলেরা আসে সহজাত টানে, বুড়োরা আসে, মরার-আগে-আরেকটু-দেখে-যাই কমপ্লেক্সে ভুগে। তবে সিরিয়াস ব্যায়ামচি কিংবা খেজুরের রসের একনিষ্ঠ ভক্ত কয়েকজন আছেন, ওঁরা লাইলিকে নিয়ে অত মাথা ঘামান না, ব্যায়াম করতে করতে কিংবা রস খেয়েই লাইলিদের বাড়ি পেরিয়ে যান। অন্যান্য লোকজন এঁদের সন্দেহের চোখে দ্যাখেন।
নিন্দুকেরা বলে, বাদামওয়ালা, রসওয়ালা এদের সাথে লাইলির বন্দোবস্ত আছে, নাহলে বাড়ির দরওয়ান কিছু বলে না কেন? অন্যেরা বলে, আরে বন্দোবস্ত থাকলে হয়তো দরওয়ানের সাথেই আছে, এর মধ্যে লাইলিকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া ক্যান? কিন্তু লাইলিকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার স্বপ্ন সবার মধ্যেই কাজ করে। লাইলি বলতে গেলে পাড়ার প্রাইম মুভার!
তবে ঘরে ফিরতে হয় সকলকেই, যখন লাইলি ঘরে ফিরে যায়। তাছাড়া লাইলির পাগলা বাপটার শটগানের লাইসেনস আছে নাকি, শটগানও থাকতে পারে দুয়েকটা, আর জানের ভয় তো সবারই আছে!
লাইলি আড়মোড়া ভাঙার সময়, বা ইয়োগা করার সময় নাকি চোখ বুঁজে থাকে, তাই হয়তো এই দর্শকের ভিড় তার চোখে পড়ে না। নিন্দুকেরা বলে, আরো ছোহ, ছেমরি মহা সেয়ানা!
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার আগে লাইলি আবার বারান্দায় আসে, এবার ঠিকমতো ঢেকেঢুকে, ছোট ছোট টবে মিষ্টি ফুলের গাছে পানি দিতে। ততক্ষণে বাড়ির সামনে রাস্তা সুনসান হয়ে যায়।
আজ পানি দিতে বেরিয়ে এসে লাইলি কী ভেবে রাস্তার দিকে তাকালো, আর অমনি ঘটে গেলো এক ঘটনা। লাইলির পেলব বুক ছ্যাঁৎ করে উঠলো!
বাদুড়কালা টিংটিঙে একটা ছেলে, লাল একটা গেঞ্জি পরে লাইলিদের বাড়ির সামনের রাস্তার ওপাশে গোড়ালিতে ভর দিয়ে বসে আছে, তার হাতে ধরা পাড়ার একটা কুকুরের সামনের একটি পা। ছোকরা নির্নিমেষ নয়নে কুকুরের পা দেখছে। কুকুরটার গায়ের রং বাদামী, বেশ তেজি চেহারা, সে জিভ বার করে হ্যাহ হ্যাহ করে হাঁপাচ্ছে।
লাইলি হুড়োহুড়ি করে কিছু টবে বেশি পানি আর কিছু টবে কম ... কয়েকটা টবে পানি না দিয়েই ঘরে ফিরে বারান্দার দরজা লাগিয়ে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজে থেকে বড় বড় শ্বাস নেয়, তার জনপ্রিয় বুক ওঠানামা করে শ্বাসের তালে।
সেদিন লাইলি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না, গুম হয়ে ঘরে বিছানায় বালিশ গুঁজে শুয়ে দিন কাটিয়ে দ্যায়।
পরদিন আবার ইয়োগা সেরে যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার আগে দুরুদুরু বুক নিয়ে লাইলি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। নাহ, আজকে সে ছোকরাকে আর দেখতে পায় না সে। লাইলি নিশ্চিন্ত মনে সব ক''টা টবে সুষম পানি দিয়ে নিচে নামে। আহ, কী সুন্দর একটা দিন!
কিন্তু রিকশা নিয়ে গলির মোড় ঘুরতেই লাইলির পীনোদ্ধত বুক হিম হয়ে আসে কী এক আশঙ্কায়! ঐ তো সেই ছোকরা, গলির মোড়ে, একটা কেলে কুকুরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কুকুরের ঠ্যাং হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বকছে, আর কুকুরটা জিভ বার করে কত্তজ্ঞ হাঁপাচ্ছে।
লাইলি রিকশা ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে আসে, তারপর দোর দেয়। সারাদিন একলা ঘরে গুম মেরে বসে থাকে।
এভাবেই চলতে থাকে কয়েকদিন। কখনো লাইলির বাড়ির সামনে, কখনো গলির মোড়ে, কখনো আরেকটু সামনে বা পেছনে, সেই ঘোর আবলুসবরণ কৃশ যুবাটি কুকুরের পা হাতে নিয়ে সৌম্য ভঙ্গিতে বসে থাকে পথের ওপর। আর লাইলি গুমরে মরে, তার আর বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া হয় না।
কিন্তু তারপর একদিন আর থাকতে না পেরে লাইলি রিকশা থেকে নেমে ছুটে যায় সেই ছোকরার কাছে, ছোকরা তখন একটা সাদা কুকুরের পা তুলে ঠ্যাকাচ্ছিলো নিজের মস্তকে, লাইলি ছুটে দাঁড়ায় তার সামনে গিয়ে।
''আমি জানি!'' ডুকরে ওঠে সে। ''আমি জানি, তুমিই মজনু! দিনের পর দিন ... তুমি লাইলির পথে হাঁটা সব কুকুরের পা ধরে সালাম করে চলেছো! কিন্তু এ হতে পারে না মজনু, এ হবার নয়!''
ছোকরা থতমত খেয়ে যায়, বলে, ''জ্বি?''
লাইলি ওড়না তুলে কান্না চাপে, ছোকরা হাঁ করে তাকায় অরক্ষিত অংশের দিকে। লাইলি বলে, ''তোমার আমার মিলন যে হবার নয় মজনু! আমাদের জীবনের কপালে যে শুধু বিরহ লেখা!''
ছোকরা ঢোঁক গিলে বলে, ''ইয়ে, আমার নাম তো মজনু না!''
লাইলি ধীরে ধীরে আবার ওড়না ঠিক করে। ''মজনু না?''
ছোকরার বোধহয় মন খারাপ হয়, ওড়না স্বস্থানে ফিরে যাওয়ায়, সে মনমরা হয়ে বলে, ''না! আমার নাম হিমু, আমি জীববিজ্ঞানের ছাত্র, শহুরে কুকুরের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছি ... এই যে দেখুন না, আপনাদের পাড়ার সব মিলিয়ে একুশটা কুকুরের ড্যাটা যোগাড় করে ফেলেছি ... আরো হাজার খানেক লাগবে, বুঝলেন ... কিন্তু আপনি মজনুর কথা কী যেন বলছিলেন?''
লাইলি আমতা আমতা করতে থাকে, রজ্জু ভ্রমে সর্পের মতো মজনু ভ্রমে গবেষক ... কিন্তু হিমু তার সাথে খাতির জমিয়ে ফ্যালে, এবং আশ্বাস দ্যায় যে তার অভিসন্দর্ভে লাইলির নামোল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে। এ উদ্দেশ্যে সে লাইলির জিমেইল অ্যাড্রেস ও এমএসএন আইডিটিও হস্তগত করে।
গল্প অনেকদিক দিয়েই শেষ করা যেতো, কিন্তু বেশি মিথ্যে কথা বলা ভালো নয়। হিমু লাইলির সাথে টুকটাক আলাপ করে মাঝেমাঝে, আর লোকমুখে লাইলির ব্যায়ামের খবর শুনে একদিন ভোরবেলা এসে এক ছটাক বাদাম ও পরবর্তীতে সব রসের এক গ্লাস করে পান করে, তারপর বাড়ি ফিরে অনেক ভেবে চিন্তে একটি বিরাট সিদ্ধান্ত নেয়।
সে তার গবেষণার ফোকাস পালেট ফ্যালে। কুকুরদের ছেড়ে সে মুগুরদের ধরে, মানে লাইলিদের পাড়ার ব্যায়ামচিদের মেটাবলিজমের ওপর বিরাট এক গবেষণা করবে বলে স্থির করে। হাজার খানেক কুত্তার পা ধরে সালাম করতে গেলে তার বছর লেগে যাবে, পক্ষান্তরে লাইলির বাড়ির সামনে হাজির আদমদের কাছ থেকে তার এক কাচ্চা ড্যাটা যোগাড় করতে দুই হপ্তাও লাগবে না।
মন্তব্য
পুরানা গল্প দিলে কেমনে কি?
কি মাঝি? ডরাইলা?
এ গল্প চিরনতুন। এ গল্প প্রতিদিনের।
হাঁটুপানির জলদস্যু
সেটা অবশ্য ঠিক!
কি মাঝি? ডরাইলা?
শেষটা যুত লাগল না।
এইটা গল্প নাকি।
আমিতো মনে করছিলাম, হিমু ভাই সত্যি সত্যি কোন লাইলির পাল্লায় পড়লো!
শেষে আবার দেখা যাবে, লাইলি বদখত গলা করে হিমু ভাইয়ের মোবিলিনি হয়্যা যাবে।
------ooo0------
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
শুরুটা যেমন ছিলো, শেষের দিকে এসে সেই টোনটা পাল্টে গেলো বলে খটকা লাগে। তবে যথারীতি আনন্দদায়ক পাঠ আগাগোড়া।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
নতুন মন্তব্য করুন