২২শে অগাস্ট

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বুধ, ২২/০৮/২০০৭ - ৭:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ অফিসে যাবার পথে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। প্রতিদিনের মতোই তপ্ত সকাল, ভাঙা রাস্তা, ক্যাব-স্ক্যুটারের যাত্রায় অসম্মতি, রিকশায় করে সিয়েনজি-শিকার ...।

অফিসে অবশ্য আজ কাজে কারো মন নেই। ডেইলি স্টারের পাছার পাতায় ছাপা হওয়া ছবি দেখে অনেকের চক্ষুস্থির। জনৈক উর্দিধারীর পেছনে শূন্যে পদাঘাতক এক ব্যক্তি, সেনাটি পশ্চাদপসরণ নীতি অবলম্বন করেছে। ছবিটা দেখে হর্ষবোধ করিনি। নিজের দেশের বীর সেনাদের এমন ছবি দেখতে চাইনি কখনো। পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশে বাস করি আমরা। কিন্তু ছবিটি একই সাথে মনে করিয়ে দেয় গতকাল ঢাবি-র ছাত্রদের ওপর পুলিশের হামলার কথা, যার কারণ কোন এক মাথামোটা সেনার উদ্ধত আচরণ।

আরো মনে হলো, সেনাবাহিনীর প্রতি ছাত্রদের এমন রুষ্ট মনোভাবের পেছনে দায়ী কে? কোন স্পর্ধায় একজন সেনা একজন স্নাতক পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কলার চেপে ধরে তাকে মারধর করে? "বেসামরিক জনগণের প্রতি সদাচরণ" কেন সেনাদের প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না?

আরো খারাপ লেগেছে সারিবদ্ধ গাড়ি ভাঙচুরের দৃশ্য দেখে। আমি গাড়ির মালিক নই, কিন্তু গাড়ি ভাঙা, গাড়ি পোড়ানোর দৃশ্যে উৎফুল্লবোধ করিনি কখনো। আমি চাই না আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয়, কোন কলেজ বা কোন স্কুলের ছাত্ররা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গাড়ি ভাঙাকে জনপ্রিয় করে তুলুক। এটা একটা ধ্যাষ্টামো। গায়ের ঝাল অন্য লোকের গাড়ির ওপর ঝাড়া ছাত্রসুলভ কাজ নয়।

কিন্তু গতকাল রাতে পুলিশের লাঠিপেটার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, এমন মার খেলে ছাত্রদের আর সুবুদ্ধির অবকাশ থাকে না। আমাকে কেউ এমন গরুর মতো প্রহার করলে আমি হয়তো জাহাজ ভাঙতাম।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে খালি মারপিটের খবর পাচ্ছি। টীমের সদস্যরা ফোনে জানাচ্ছে একই কথা, "বস, ভাঙচুর হচ্ছে ...", "ভাইয়া, গন্ডগোল চলছে ..."। সর্বত্র বিক্ষোভ।

এরপর জানতে পারলাম কারফিউয়ের কথা। অফিস কিছুটা আগে ছুটি হয়ে গেছে। বেরিয়ে দেখি রাস্তাঘাটে শুধু পায়ে হাঁটা মানুষের ঢল। গাড়ি চোখে পড়ছে, ক্যাব বা স্ক্যুটার নেই, রিকশাও নেই।

বহুদূর হেঁটে এসে দেখি একটা বাস, তাতে হিংস্রভাবে চড়ছে মানুষ। এ ওকে মেরে গুঁতিয়ে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। একটা রিকশার ওপর হামলে পড়ছে দশজন লোক। আমি মাথা নেড়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেলাম, এভাবে পোষাবে না, দরকার হলে হেঁটেই যাবো।

ভাগ্য প্রসন্ন ছিলো, আরেকটু এগিয়ে দূরে এক গলির সুদূর চিপায় এক ঝলক সবুজ চোখে পড়লো। চা খাচ্ছিলেন সিয়েনজিয়েরো চাচামিয়া, আমি মধুরতম সম্ভাষণে তাঁকে অনুরোধ জানালাম আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে, তিনিও মিনিট পাঁচেক আলোচনার পর, ঐ পথে যে কী ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছে তার বিবরণ শোনানোর পর রাজি হয়ে গেলেন। আর কিমাশ্চর্যম, তিনি মিটার অনুযায়ীই ভাড়া নেবেন, জানালেন, বাড়তি কিছু আমি যদি দিই তা আমার সেন্স অব ইনসাফ।

বেশ নির্বিঘ্নেই বাড়ি ফিরেছি, কিন্তু গোটা পথে ভাঙা কাঁচের টুকরো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে টায়ারের ভস্ম থেকে ভেসে আসছে ভারি ঘ্রাণ। গোটা পথে পথিকস্রোত।

ভালো লাগেনি, গোটা ঘটনা যেদিকে গড়ালো, একদম ভালো লাগেনি।


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

হুমম।
সারাদিন কামলা খেটে রাতে এসে স্বভূমির এই খবর দেখে বিব্রতবোধ, অস্বস্তি ও আশাহীনতার মিশ্রণে একটা অদ্ভূত বোধ অনুভব করতে বাধ্য হচ্ছি।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সেনাবাহিনীর প্রতি এহেন আচরণে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। কিন্তু এর মূল কোথায় সেটাও দেখতে হবে। যে নিজের সম্মান নিজে ধরে রাখতে পারেনা, তার সম্মান কে রাখবে?

অমি রহমান পিয়াল এর ছবি

থমথমে আঁধার, সকাল না হলে বলা যাচ্ছে না কিছু


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

কার সম্মান যে কে রাখে!
জবাবদিহিতাবিহীন ক্ষমতা সবসময় সর্বোনাশ ডেকে আনে। নাহলে গণতন্ত্র নয়, একনায়কতন্ত্রই সমাদৃত হত দেশে দেশে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অমিত আহমেদ এর ছবি
অয়ন এর ছবি

ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি ভাঙ্গাকে কোনভাবেই সমর্থন করিনা, কিন্তু তার চেয়ে বেশী ক্ষুদ্ধ হয়েছি ছাত্রদের জিমনেশিয়াম ভাংচুর দেখে। কত বড় নির্বোধ হলে নিজেদের জিমনেশিয়াম নিজেরা ভাঙ্গতে পারে।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

নিজেদের জিম আর নিজেদের গাড়ি ভাঙার অভ্যাস অনেক পুরানো। এবারের ঘটনা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নয় তা হয়তো অনেকেই বুঝে উঠতে পারেনি।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমাকে কেউ এমন গরুর মতো প্রহার করলে আমি হয়তো জাহাজ ভাঙতাম।

আশংকার কথা এই যে সব গাড়িই হয়তো ছাত্ররা ভাঙছে না। আরো নৈরাজ্য তৈরি করা গেলে সব দোষ ছাত্রদের ঘাড়ে চাপিয়ে ফায়দা ঘরে ওঠানোর ধান্দা থাকা খুবই সম্ভব।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হিমু এর ছবি

সহমত।

২০০২ সালে একবার পলাশীর মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী (চমন আরা চম্পা) বাসের নিচে চাপা পড়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্ররা তৎক্ষণাৎ পলাশীর মোড়ে কর্তব্যরত মোটরসাইকেল আরোহী সার্জেন্টকে গিয়ে সেই বাসকে পিছুধাওয়া করে পাকড়াও করার অনুরোধ জানায়। সার্জেন্ট ফরাসী কায়দায় শ্রাগ করে বলে, এটা তার কাজ নয়। উত্তেজিত ছাত্ররা সার্জেন্টকে লাঠ্যৌষধি শাসনের উদ্যোগ নিলে সে মোটর সাইকেলে চড়ে চম্পট দেয়। খানিক বাদে পলাশীর মোড়ে এক গাড়িতে চড়ে পুলিশের বড়কর্তারা হাজির হন। আমি নিজেও সে ভিড়ে উপস্থিত ছিলাম শতাধিক ছাত্রের মধ্যে। ছাত্ররা প্রবল উত্তেজিত হয়ে থাকলেও মারধর বা ভাঙচুর শুরু করেনি। ভিড়ের ফাঁক থেকে জনৈক উৎসাহী মুদি দোকানদার কোত্থেকে ইয়াব্বড় এক বাটখারা এনে ধাম করে মেরে বসলো পুলিশের গাড়ির কাঁচে। ছাত্ররা ভাবলো এ তাদেরই একজনের কাজ হয়তো। তারাও বিপুল হইচই শুরু করলো, ধর ধর ধর ...। পুলিশের কর্তারা গাড়ি নক্ষত্রবেগে চালু করে পলায়ন করলেন এবং যথারীতি পনেরো মিনিটের মাথায় দাঙ্গা পুলিশ এসে ছাত্রদের তাড়া করলো। পলাশীর মোড়ে ইঁট পাটকেল পাওয়া সহজ নয় বলে পাল্টাধাওয়ার ব্যাপারটি আর ঘটেনি।

যা বলতে চাইলাম এই স্মৃতিচারণে, তা হলো, অছাত্র কেউ যদি ভাঙচুর শুরু করে, উত্তপ্তমস্তিষ্ক ছাত্ররাও তাতে যোগ দিয়ে ফেলে। পত্রিকা-টিভিতে সেসব ধৃত হয়। ছাত্রদের ঘাড়ে দোষারোপ করা সহজ হয়।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ঠিক। হয়তো দেখা যাবে রাজনৈতিক দলের সুযোগসন্ধানীরা, পুলিশ, সেনা সবাই ভাঙচুর করছে দোষ হচ্ছে ছাত্রদের।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ছাত্ররা অসহনশীল, এই ট্যাগ লাগিয়ে রাতের আঁধারে না আবার হলে হলে আক্রমন শুরু হয়।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

সুজন চৌধুরী এর ছবি

গাড়ী ভাংগা সভ্যলোকের কাম না ঠিক,কিন্তু না ভাংলে সভ্যলোকের
ঘুম ভাঙ্গে না। আমার চারুকলার ১৪বছরে বহুবার দেখছি এই ঘটনা।

____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

পুরুজিত এর ছবি

বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি সেনাবাহিনীর এই আচরণ মোটেই অপ্রত্যাশিত কিছু না। ইতিমধ্যেই আমাদের নৈতিক উন্নতি সাধনে তাদের প্রচেষ্টা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাদের নৈতিক হামবড়া ভাব যদিও সাধারণ উর্দিপড়া জওয়ানের ভালমন্দ চুলের দৈর্ঘ্যেই সীমাবদ্ধ। আমি ব্যক্তিগতভাবে এক পাতি সেনা কর্মকর্তাকে চিনি যিনি ব্লাডি সিভিলিয়ান বলা ছাড়া সিভিলিয়ানদের নিয়ে কথাই বলতে পারেন না। তাই কোন এক মাথামোটা সেনার আচরণ বলতে চাই না এটাকে, এটাই ওদের স্বাভাবিক আচরণ।

আসিফ দিপঙ্কর এর ছবি

মন খারাপ করে দেয়া লেখা। সকাল থেকেই আস্থির হয়ে আছি । এক অদ্ভুত অসহায়ত্ত। নিরাপদে থেক।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

গাড়ি ভেঙে অনেকেই পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। কিন্তু হকার বলেন আর যাই বলেন, তারা প্রতিশোধের আগুনে মত্ত। পেটে ভাত না থাকলে আর কিসের কী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।