প্রবাসে দৈবের বশে ০০৪

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বুধ, ১৯/০৯/২০০৭ - ৮:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কাসেলে আসা ইস্তক সুমন চৌধুরীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছি। চৌধুরী সাহেব ভোজনরসিক মানুষ, তাই তাঁর ল্যাংবোট হয়ে আমিও মাঝেসাঝে চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয় সাঁটিয়ে চলছি। শুরুতে দু'দিন খান সাহেবের বাড়িতে অতিথি হয়ে বিস্তর খানদানি খোরাকি কুক্ষিগত করেছি, সে কাহিনী খান সাহেবের ইজাজৎ ছাড়া বয়ান করা ঠিক হবে না। তবে খান সাহেবের রান্না করা মুসুরির ডাল যে খায়নি সে নিতান্তই হতভাগ্য।

কাসেলে গরুর মাংস কেনা হয় সাধারণত তুর্কি দোকান থেকে। তারা মাপমতো টুকরা করে রাখে, দেখে শুনে কিনে আনতে পারলেই হলো। ঘরে ফিরে সেই গবাংশকে নিজস্ব ছুরি দিয়ে নিজস্ব ছাঁটে নিজস্ব ঢঙে টুকরাটাকরা করে বিভিন্নভাবে রান্না করা যেতে পারে। সুমন চৌধুরী ফিকির খোঁজেন ল্যাটকা খিচুড়ি বা তেহরানি (বিরিয়ানির মশলাযোগে তেহারি) রান্না করার জন্য। সাথে খাওয়ার সময় সহপেয় হিসেবে শুকনো ওয়াইন। ওয়াইন সম্পর্কে আমার আকল নিতান্তই কচি ও কাঁচা পর্যায়ে ছিলো, চৌধুরী সাহেব শুরুতেই গেট্রেঙ্কেমার্কটে নিয়ে গিয়ে তিন মিনিটের একটি মনোজ্ঞ বক্তৃতা দিয়ে আমাকে তালিম দিলেন। খাওয়ার ফাঁকে গিলতে হলে শুকনো (ট্রকেন) ওয়াইন, আর খাওয়ার পর রয়েসয়ে গিলতে হলে লিবলিখ। মাংসের সাথে যাবে লাল ওয়াইন, মাছের সাথে যাবে সাদা ওয়াইন। আরো নানা ব্যকরণ আছে ওয়াইন পানের, সেগুলিও ধীরেসুস্থে শিখে ফেলবো মনে হচ্ছে। ঘরদোরের জিনিসপাতি কেনার সময় ওয়াইনের ছিপিউদঘাটক রীতিমতো তালিকার শীর্ষে চলে এসেছে শিক্ষা ও স্বাদ লাভের পর পর।

কাসেলে এসে নতুন যে খাদ্যদ্রব্যটি আমার মনহরণ করেছে, তা হচ্ছে ফোরেলে (ট্রাউট)। মন হরণ করার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ফোরেলে খাওয়ার উপযোগী করার জন্য বেশি খাটতে হয় না, প্যাকেট থেকে খুলে গরম পানিতে বরফ গলিয়ে পেঁয়াজরসুনআদাকাঁচামরিচ লেবুর রসে মাখিয়ে তার আগে থেকে চিরে রাখা পেটে গুঁজে লবণ ছিটিয়ে ফয়েলে মুড়ে চুলায় বেক করতে দিয়ে দিলেই মিনিট চল্লিশেক পর দারুণ সুস্বাদু এক মাল বেরিয়ে আসে। জার্মানির আরেক মাছ, লাখস (ফোরেলেরই জাতভাই, এরা সব স্যামন জাতীয়) আগে চেখে দেখেছিলাম, খুব একটা ভালো লাগেনি, ফোরেলে তার তুলনায় অমৃত।

প্রথম যখন জার্মানিতে আসি, তখন দারুণ উল্লসিত ছিলাম বিয়ার নিয়ে। জার্মান বিয়ারের গুণগান না করা আসলেই মুশকিল, আর মিউনিখে এক বোতল পানির দাম আর সম পরিমাণ এক বোতল বিয়ারের দামের প্রায় সমান। বিভিন্ন পাবে কাঠের ব্যারেল থেকে পরিবেশন করা হয় ফেনায়িত বিয়ার, বোতলের বিয়ারের চেয়ে দাম বেশি হলেও স্বাদে পরিস্কার পার্থক্য আছে। বিয়ারকে মোটা দাগে দু'ভাগে ভাগ করা যায়, সাদা (হেল) আর গাঢ় (ডুঙ্কেল), অথবা উৎস অনুযায়ী কয়েকভাগে, গম, ঈস্ট, ছত্রাক ইত্যাদি। এরডিঙ্গার, আউগুস্টিনার, পাউলানার, ফ্রানৎসিসকানার, লোয়ভেনব্রয়, হাকার-প্শর, বাঘা বাঘা সব ব্র্যান্ড। বিয়ারের বোতলে সাধারণত সাত-আট সেন্ট ফান্ড থাকে, বোতল ফিরিয়ে দিলে সে পয়সা ফেরত পাওয়া যায়।

কাসেলে মেদবহুলা ফ্লাইশহেনশেন না খেয়ে স্বল্পমেদিনী জুপেনহেনশেন খাওয়াটাই স্থির করেছি। মুরগির দাম এখানে ঢাকার মতোই, একেবারে তৈরি মুরগির দাম কেজিপ্রতি এক ইউরোর কাছাকাছি। নয়শোগ্রামের "দেশি" মুরগি আর তেরোশোগ্রামের "দেশি" মুরগির দাম সমান। যে দেশে মুড়ি আর মিছরির সমান দর, সে দেশে নাকি বেশিদিন থাকতে নেই, কথাটা মনে পড়ে গেলো। জন্টাগহান বলে এক বস্তু মেলে এখানে, তার আকার সেইরকম ঢাকাই সিনেমার নায়িকার মতো, রোববার ছুটির দিনে সবাই মিলে খাবার জন্য বড় করা খাসি মোরগ, তার দাম আম মুরগির চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। টার্কি বা পুটেনের মাংস স্বাদশূন্য প্লাস্টিকের মতো, রান্না করে না খাওয়াই ভালো, তবে পুটেনভুর্স্ট বা টার্কি সসেজ ভাজলে বেশ ভালো লাগে খেতে।

জার্মান চকলেট, দুধ বা আইসক্রীম অতীব স্বাদু জিনিস, ফলমূলও খারাপ না। আফগান এক দোকানের সুবাদে কাসেলে যাবতীয় দেশি মশলা পাওয়া যায়, যদিও আমি দেশ থেকে গরম মশলা কিছু নিয়ে এসেছিলাম সাথে। সব্জির দাম দেশের অনুপাতে বেশ চড়া, গোল বেগুনের দাম রীতিমতো ঢাকাই রমজান মৌসুমের কথা মনে করিয়ে দেয়। এক কেজি আলুর দাম একতিরিশ সেন্ট, সে তো কিছুদিন অপেক্ষা করলে বাংলাদেশেও দেখা যেতে পারে। জার্মানরা সূর্যমুখী আর বাদাম তেল খায় বেশি, তবে সয়াবীন আর সরিষার তেলও মেলে। ঘি এর কাজ মাখন গলিয়ে চালানো হচ্ছে, এখানকার মাখন বেশ। তবে ডিমের আকার রীতিমতো ছোট, মুরগিগুলি বোধহয় এখনও উপলব্ধি করতে পারেনি যে তারা জার্মান। কিংবা কে জানে কোন শুকনোপটকা বাঙালি মোরগ উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলো কি না!

আমার বিগত প্রবাস জীবনে উপলব্ধি করেছিলাম, আমি একজন খাঁটি ভেতো। ভাতের প্রতি আমার উদরের টান শুধু রজকিনীপ্রেম নিকষিত হেমের সাথে তুলনীয়। বিয়োগান্তক নয়, এ প্রেমের কাহিনী মিলনান্তক, যেখানে শেষমেশ পেটের সাথে ভাতের দেখা মেলে, জাবড়াজাবড়ি হয়। কাসেলে কয়েক পদের চাল পাওয়া যায়, বাসমতি চালেরই কয়েক কিসিমের দেখা মেলে, কমদামিটা রেঁধে খাচ্ছি। ভাত রান্নার সময় কয়েক দফা স্যাম্পলিং করি, তাই চাল বা জাউ কোনটাই না খেয়ে খাঁটি ভাতই চিবাই। জীবনে প্রথম ডাল রান্না করে আমি আমার রন্ধনপ্রতিভায় মুগ্ধ। তবে খাওয়াদাওয়ার পর মনে পড়লো হলুদ বা ধনিয়া বা ঐ গোছের গরম মশলা ছাড়াই ডাল রান্না করেছি। হাঙ্গার ইজ দ্য বেস্ট সস কথাটাকে আপ্তবাক্য ধরে নিয়ে চরম খিদের মুখে নিজের রান্না খেতে বসলে কোন সমস্যা দেখা দেয় না বলে আমার বিশ্বাস। আমার প্রতিবেশী জামুয়েল ডালে আদা-রসুন-পেঁয়াজের ফোড়নের ঘ্রাণ ও শব্দে রীতিমতো বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। তার বাপ-মা থাকে অজনাব্রুয়কে, সেপ্টেম্বর মাস ফুরোলে তবে সে আবার ভোওনহাইমে ফিরবে। যদিও সে বলে গেছে, পরীক্ষা শেষ বলে ক'টা দিন সে বাড়ি থেকে কাটিয়ে আসবে, কিন্তু আমার ধারণা আমার ডাল রান্নার শুভ মহরতই তাকে ঘরছাড়া করেছে। আকলমন্দের জন্য ইশারাই কাফি।


মন্তব্য

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

সুপার লেখা হইছে। চালায় যান!

ফ্রুলিক্স এর ছবি

মসলাপাতি অথবা বাংলাদেশি মাছের জন্য ফ্রাঙ্কফুট আসতে পারেন। বেগুনের দাম কয়েকদিন আগেও বেশ কম ছিলো। গতদিন রেভে'তে প্রতিটা বেগুন ছিল ২.৫০ ইউরো। তবে তার্কি, আলডি/লিডল এ কম দামে ভালো সবজি পাওয়া যায়। ভাগ্য ভালো যে আপনার মিটভনার চাঙ্কু পড়ে নাই তাহলে গন্ধে নিজেই ভাগতেন :)।

অরূপ এর ছবি

সুস্বাদু লেখা!
তবে প্রশ্ন হল কেন তুর্কি দুকান থন গোমাংস কিনা হয়?
ডাংকে চৌধুরী কি তাইলে হালাল দেইখা খায়?
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

হিমু এর ছবি

মোটামুটি টাটকা, দামে কিছুটা সস্তা আর বাড়ির কাছে। হারাম দ্রব্যাদি নিয়ে পোস্ট পরে আসবে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুমন চৌধুরী এর ছবি

যেই দোকানের বর্ননা দিছে সেইখানে দাম সবচেয়ে কম...জার্মান দোকান থিকা গরু কিন্তে গেলে পকেটের মৃত্যু নিশ্চিত...
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

সবজান্তা এর ছবি

আপনে তো তাও কত কিছু পারেন...... আমি তো বিদেশ গেলে না খায়া মরুম।

আমি একটা জিনিস ই রাঁধতে পারি, ফুটানো বিশুদ্ধ পানি।

-------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

বিদেশে রান্না করা আসলে দেশের চেয়ে অনেক সহজ। একটা জিনিসই দরকার, তাহলো কনফিডেন্স। ইচ্ছেমত জিনিসপত্র মিশিয়ে সিদ্ধ করলেই হলো, শুধু লবণটা 'পরিমাণমত'!

লিখা সুস্বাদু হইছে। অনেক কিছু জানলাম। হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- অই হালা, তুই কি কাসেল ট্যুরিজমের লোক নাকি? নাকি তোরে কাসেলের তেল,পেঁয়াজ, মরিচ ওয়ালারা পয়সা দিছে সচলে লেখার লাইগ্যা? হালা রোযা রমযানের দিন কইলাম একটু রইয়া-সইয়া তা না।
আর পিয়াল ভাই কইলো, তুই বলে ভাওতা দিতাছস। বাংলাদেশে বইসা থাইকা বলে কাসেলের গুণগান করতাছোস!
লোকজন রে বোকা বানাইস না এই রোযা রমযানের দিন।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

সুজন চৌধুরী এর ছবি

হুম!! তাইলে এইসব চলতাছে।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সুস্বাদু লেখা। সুমন চৌধুরীর ওয়াইনশালার ট্যুরের অপেক্ষায় থাকলাম!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ওয়াইন নিয়া এট্টু টিউটোরিয়ালের মতো ছাড়লে হইত।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

আরিফ জেবতিক এর ছবি

মুরগিগুলি বোধহয় এখনও উপলব্ধি করতে পারেনি যে তারা জার্মান। কিংবা কে জানে কোন শুকনোপটকা বাঙালি মোরগ উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলো কি না!

বাঙালি মোরগদের (!) হাত থেকে আল্লাহ জার্মান নাগরিকদের রক্ষা করুন।

দ্রোহী এর ছবি

চমৎকার লেখা।


কি মাঝি? ডরাইলা?

হাসিব এর ছবি

বুচ্ছি । নতুন নতুন তো এইলাইগাই এতো জার্মান খাবারের গপ্প । মাস ছয় যাউক । তারপর এক্কেরে পুরা ভেতো বাঙ্গালি ।

হিমু এর ছবি

ভেতো হওয়ার জন্য আরো ছয়মাস অপেক্ষা করতে হবে? ? মানি না মানবো না!


হাঁটুপানির জলদস্যু

অমিত এর ছবি

রোজা রমজানের দিনে এসব কি !! যাই হোক, এখানে তিন ধরণের জার্মান পেটে গেছে। ফ্রানসিসকানার, পাউলানার আর আরেকটা মনে হয় বিটবুর্গার। প্রথমটাই ভাল লেগেছে। তবে বেলজিয়ান একখান এল খাইছিলাম। ওহ সে স্বর্গ !!!

______ ____________________
suspended animation...

সুমন চৌধুরী এর ছবি

এরডিঙ্গার আর লোয়ভেনব্রয় খুব ভালো....
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

বিপ্লব রহমান এর ছবি

চমৎকার!... লেখাটা পড়তে পড়তে খুব খিদে লেগে গেলো। চোখ টিপি


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

সৌরভ এর ছবি

মানি না, মানবো না।
এইরকম লেখা ব্যান কর্তে হবে।
আমার ক্ষুধানুভূতি আহত হয়েছে।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।