পিচ্চিতোষ গল্প ০৪: বুলুদের বারান্দায় চড়ুইগুলি

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০৯/২০০৭ - ৮:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুলুদের বারান্দাটা বেশ বড়। বুলু বারান্দায় অনেক ছুটোছুটি করে, একা একাই। বিকেলের আগে তার বাইরে যাওয়া বারণ।

বারান্দায় রেলিং এর ওপরে কাঠের আস্তরণ দেয়া। বুলু এখনো ছোট, সে পায়ের পাতায় ভর করেও রেলিঙের ওপর দিয়ে কিছু দেখতে পায় না। সেই রেলিঙের ফাঁক দিয়ে সরু একটা পৃথিবী দেখা যায়, সেটা বুলুর পছন্দ নয়।

বুলু একদিন একটা মোড়া এনে তাতে চড়ে বারান্দার ওপাশে মাঠ দেখতে চাইছিলো, বুলুর মা হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন।

"বুলু তুমি কি করছো? তুমি তো পড়ে যাবে!" এই বলে তিনি বুলুকে কোলে নিয়ে মোড়াটা সরিয়ে নিয়ে গেলেন। বুলু ভারি ব্যাজার হয়ে আবার বারান্দায় ঘুর ঘুর করতে লাগলো।

অবশ্য পড়ে গেলে বুলু অনেক ব্যথা পাবে। দোতলার বারান্দা থেকে পড়ে গেলে তাকে হাসপাতালে যেতে হতে পারে।

বিকেল হলে বুলু খেলতে মাঠে নামে, বারান্দায় বসে বুলুর মা বই পড়তে পড়তে বুলুর দিকে চোখ রাখেন। বুলু মাঠে ছোটাছুটি করে, পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়, আবার উঠে ছোটাছুটি করে।

কিন্তু বারান্দায় বসে মাঠটা দেখার মজা অন্যরকম। বুলু শুধু ভাবে সে কবে আরেকটু লম্বা হবে, তখন সে সারাদিন বারান্দায় বসে শুধু মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকবে। মাঠের এক কোণে একটা বাচ্চা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে, আর দূরে আছে একটা অনেক উঁচু কৃষ্ণচূড়া গাছ। বুলু ভাবে, ঐ বাচ্চা কৃষ্ণচূড়া গাছটাও নিশ্চয়ই ভাবে, কবে সে বুড়ো গাছটার মতো অনেক উঁচু হবে!

বুলুদের বারান্দার ঘুলঘুলিতে কয়েকটা চড়ুই থাকে। তারা দিনভর কিচিরমিচির করে, ঠোঁটে খড় নিয়ে উড়তে উড়তে আসে, এসে ঢোকে ঘুলঘুলির ভেতরে, তারপর আবা ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যায়। বুলুর খুব ভালো লাগে চড়ুইগুলিকে।

অবশ্য চড়ুইপাখি ধরা খুব কঠিন। তারা প্রায়ই বারান্দায় এসে বসে, নাচতে নাচতে লাফাতে লাফাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়, আর মানুষের সাড়া পেলেই উড়ে চলে যায়। অথচ বুলু কিন্তু পাখিগুলোকে ধরে মারবে না, সে শুধু একটু হাতে নিয়ে দেখতে চায় কাছ থেকে। পাখিগুলি এ কথা বুঝতে চায় না।

একবার বাইরে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে পাশের বাড়ির টিনের চালে, আর সোঁ সোঁ বাতাস চালাচ্ছে, তখন একটা চড়ুই পাখি হঠাৎ বুলুদের ঘরে ঢুকে পড়লো। ঘরের ভেতর কয়েকজন মানুশ, তার ওপর আবার ফ্যান চলছে, বাইরে ঝড় হচ্ছে, পাখিটা নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়েছিলো। বুলুর বাবা সাথে সাথে ফ্যানটা বন্ধ করে দিলেন, পাখিটা কিছুক্ষণ ঘরের ভেতর উড়তে উড়তে শেষটায় ফ্যানের ওপরে গিয়ে বসলো। বুলু বাবার কাছে বায়না ধরেছিলো, পাখিটা ধরে দিতে, কিন্তু বুলুর বাবা সব আব্দার রাখেন না। তিনি বুলুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "পাখি ধরতে হয় না। পাখি মারতে হয় না। পাখি শুধু দেখতে হয় আর শুনতে হয়।"

বুলুর তবুও ইচ্ছা করে একট চড়ুই পাখি হাতে নিয়ে দেখতে। সে তো আর পাখি মারবে না।

সেদিন বিকেলে হঠাৎ করেই খুব অন্ধকার হয়ে গেলো একদিকের আকাশ, বুলুর বাবা তখনও ঘরে ফেরেননি। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি, সাথে আবার শিল পড়ছে। বুলুর মা ঘরের ভেতর থেকে ডাকলেন, "বুলু, বারান্দা থেকে চলে এসো, বৃষ্টিতে ভিজে যাবে!"

বুলু ঘরের ভেতরে যাবার আগেই থপ করে একটা শব্দ হলো। বুলু দেখলো, একটা খয়েরি চড়ুই পাখি মাটিতে পড়ে আছে!

বুলু দৌড়ে গিয়ে পাখিটাকে হাতে তুলে নিলো। কী ছোট্ট, নরম একটা পাখি, তিরতির করে কাঁপছে, একটু ভেজা ভেজা তার পালকগুলি, কেমন একটা ধূলা ধূলা গন্ধ তার গায়ে!

পাখিটা বুলুর হাতে পড়ে কিচমিচ করে উঠলো। বুলু পাখিটাকে দু'হাতে সাবধানে নিয়ে মায়ের কাছে ছুটে গেলো। "মা, দ্যাখো চড়ুই পাখি! বারান্দায় পেয়েছি!"

বুলুর মা পাখিটাকে হাতে নিয়ে বললেন, "আহারে পাখিটা, বাতাসে উড়তে গিয়ে চোট পেয়েছে। যা ঝড় হচ্ছে বাইরে!"

বুলু খুব উৎসাহ নিয়ে বললো, "ওকে কি তাহলে আমরা পুষবো?"

বুলুর মা বললেন, "ওকে এখন কাপড়ের ঝুড়িতে রেখে দিচ্ছি। তোমার বাবা ফিরলে জিজ্ঞেস করো পুষবে কি না।"

বুলুর মা চড়ুই পাখিটাকে যত্ন করে পুরনো কাপড়ের ঝুড়িতে ভরে রাখলেন।

একটু পরে বুলুর বাবা ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলেন। বুলু ছুটে গিয়ে বাবাকে চড়ুই পাখিটার খবর দিয়ে দিলো।

বুলুর বাবা একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললেন, "চলো, আমরা পাখিটাকে ওর ঘরে রেখে আসি।"

বুলু অবাক হয়ে বললো, "কোন ঘর?"

বুলুর বাবা বললেন, "কেন? ওরা তো সবাই ঐ ঘুলঘুলিটার ভেতরে বাসা বানিয়ে থাকে।"

বুলুর বাবা একটা উঁচু টুল এনে ঘুলঘুলিটার কাছে দাঁড়ালেন। বুলু কাপড়ের ঝুড়ি থেকে চড়ুই পাখিটাকে মুঠোয় ভরে নিয়ে এলো বাবার কাছে। বুলুর বাবা পাখিটাকে সাবধানে ধরে ঘুলঘুলির ভেতরে ছেড়ে দিলেন। সেখানে আরো কয়েকটা পাখি কিচকিচ করে উঠলো।

বুলু বললো, "ওরা আমাকে দেখলে উড়ে চলে যায় কেন?"

বুলুর বাবা বুলুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, "পাখিরা এমনই। ওদের সাথে ভাব জমাতে হবে এখন থেকেই। একদিন দেখবে ওরাই তাহলে উড়ে উড়ে এসে তোমার খোঁজ নিয়ে যাবে।"


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

অসাধারণ...... অতি চমৎকার লেখা।


কি মাঝি? ডরাইলা?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

খুব ভাল লাগলো। বাচ্চাদের গল্পের খুব অভাব। লেখা চলতে থাকুক।

মাশীদ এর ছবি

ভাল লাগল। তোর অন্য গল্পের থেকে অন্যরকম।

আমাদের বুয়েটের বাসার ঘুলঘুলিতে থাকা চড়ুইপাখির একটা বাচ্চা একবার পড়ে গিয়েছিল। অনেক বাঁচানোর চেষ্টা করেছি, ওদের বাসায় তুলেও দিয়েছিলাম, কিন্তু বারবার পড়ে যাচ্ছিল। তারপর ক'দিন বেঁচে থেকে আর পারল না। আমি খুব আদর করতাম। আঙুল দিয়ে মুখের ভিতর ভাত ঢুকিয়ে খাওয়াতাম। এমন মায়া পড়ে গিয়েছিল আমার, সাথে বাসার সবার! কিন্তু জখম বেশি থাকায় বেশিদিন বাঁচল না। আমার হাতেই একদিন টুপ করে মরে গেল। খুব মন খারাপ হয়েছিল। মনে আছে, হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। আমি ছোট ছিলাম না, বেশ বড়ই ছিলাম, বুয়েটের থার্ড ইয়ার হবে। তবে ওটাই আমার প্রথম ও শেষ পেট ছিল। তোর লেখা পড়ে মনে পড়ে গেল।


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

সৌরভ এর ছবি

কী সুন্দর!
আনপি জিয়িনাস। (মানে বুইঝা নিয়েন)

বাচ্চাদের জন্যে বড় কিছু একটা হাতে নেন তো এবার।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অর্ক এর ছবি

নাহ...।।তর সইছে না...।তাড়াতাড়ি পরের তা পড়ি...।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভাল হয়েছে। পিচ্চিতোষ গল্পের বড় বড় পাঠক। চলতে থাকুক ..

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।