মিতুন বড় জেদি। কোনকিছুতে জেদ চেপে গেলে সে আর হাল ছাড়ে না।
মিতুনদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছে দুলি। দুলি আগে কখনো শহরে আসেনি। এই প্রথম সে গ্রাম থেকে এসেছে। তার কথায়, চেহারায়, শরীরে তার ফেলে আসা গ্রাম কুসুমপুরের ছবি এখনো দেখা যায়।
দুলির বয়স মিতুনের চেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু দুলি রান্না করতে পারে। মিতুন পারে না।
মিতুন কিন্তু শুরুতেই খুঁত ধরলো। সে তার মা-কে বললো, "মা, দুলি এক হাবা কেন? শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সবকিছুর দিকে?"
মিতুনের মা মুখ টিপে হাসেন। বলেন, "দুলি তো নতুন এসেছে, তাই ও সবকিছু দেখে অবাক হয়ে গেছে। কিছুদিন পর ও আর হাঁ করে সবকিছু দেখবে না।"
তা-ই হলো। দুলি আস্তে আস্তে সবকিছু দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। সে মাথার ওপর জোরে পাখা ঘুরতে দেখলে আর অবাক হয় না, ফোন বেজে উঠলে ভয় পায় না, টিভি ছাড়লে কাজ ফেলে ছুটে আসে না।
কিন্তু মিতুন খুঁত ধরতে ছাড়ে না। সে তার মা-কে বলে, "মা, দুলি এভাবে টেনে টেনে কথা বলে কেন?"
মিতুনের মা হেসে ফেলেন। বলেন, "দুলি তো এতদিন গ্রামে ছিলো, ওখানে সবাই এভাবে কথা বলে।"
মিতুন তবুও দুলির অনেক খুঁত বার করতে থাকে। দুলি শুধু শুধু দাঁত বের করে হাসে, জোরে জোরে কথা বলে, রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে কাঁদে। দুলির অনেক খুঁত।
দুলি কিন্তু মিতুনকে খুব ভালোবাসে। মিতুন কিছু করতে বললে সে ছুটে ছুটে এসে করে দেয়। মিতুন যদি বলে, দুলি আমাকে ওটা এনে দাও, সে তক্ষুণি ছুটে ওটা এনে দেয়। মিতুন যদি বলে, দুলি আমাকে সেটা করে দাও, দুলি তক্ষুণি সব কাজ ফেলে সেটা করে দেয়।
তবুও মিতুন ক্ষেপে থাকে দুলির ওপর।
একদিন মিতুন রাতে খেতে বসে খুব অনর্থ করলো। তার ডাল খেতে খুব ভালো লাগে। দুলি মুসুরের ডাল রান্না করেছে। মিতুনের মা আর বাবা ডাল দিয়ে চুপচাপ ভাত মাখছিলেন, মিতুন ডাল মুখে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, "ডালে এতো লবণ কেন? ডালের রংটা এমন পানসে কেন? কোন ঝাঁঝ নেই কেন ডালে?"
মিতুনের বাবা মিতুনের মায়ের দিকে তাকান গম্ভীর চোখে।
মিতুনের মা বলেন, "খেয়ে নাও সোনা, কাল তোমাকে মজার ডাল রান্না করে খাওয়াবো নাহয়।"
মিতুন রাজি হয় না, সে বলে, "এই দুলিটা কোন কাজ ভালোমতো পারে না, এটা কোন ডাল হলো? পঁচা ডাল এটা, এটা আমি খাবো না! এরচেয়ে ভালো ডাল তো আমিই রান্না করতে পারি!"
দুলি রান্নাঘরে চুপ করে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে।
মিতুন খাবার ফেলে দুড়দাড় করে উঠে চলে যায়।
মিতুনের বাবা খুব রাগী লোক। তিনি পরদিন অফিস থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে মিতুনকে ডাক দেন, "মিতুন!"
মিতুন তার বাবাকে ভয় পায়, সে এসে বলে, "জ্বি বাবা!"
মিতুনের বাবা মিতুনের হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে যান। "তুমি আজকে ডাল রান্না করবে। আমরা রাতে খাবো।"
মিতুন খুব ঘাবড়ে যায়। বলে, "আমি কেন ডাল রান্না করবো?"
মিতুনের বাবা বলেন, "কেন, তুমিই তো কালকে বললে, তুমি দুলির চেয়ে ভালো ডাল রান্না করতে পারো? আজকে তাই তুমি রান্না করে আমাদের খাওয়াবে।"
মিতুন তারা বাবার দিকে তাকিয়ে খুব ভয় পায়। সে শুকনো মুখে ডাল রান্না করতে শুরু করে।
কিন্তু মিতুন তো আর ডাল রান্না করতে জানে না, কিভাবে কি করতে হয়, কিছু সে জানে না। কিন্তু মিতুন ভীষণ জেদি, সে ঠিক করে, বাবাকে সে ডাল রান্না করে খাওয়াবে। সে মায়ের ঘর থেকে একটা রান্নার বই এনে সেটা খুলে বই পড়ে পড়ে রান্না শুরু করে।
প্রথমে সে ডাল সিদ্ধ বসায়। ডাল পানিতে টগবগ করে যখন ফুটবে, তখন কিছু ভাজা মশলা দিতে হয়। মিতুন একটা সসপ্যানে তেল ঢালে। তারপর একটা পেঁয়াজ নিয়ে কুচি করতে বসে। পেঁয়াজ কুচি করতে গিয়ে তার চোখে ঝাঁঝ লাগে, দরদর করে পানি পড়তে থাকে চোখ দিয়ে। রসুনের খোসা ছাড়াতে গিয়ে তার রীতিমতো আঙুল ব্যথা হয়ে যায়। আদা কুচি করতে গিয়ে মিতুন হাতের নখে ব্যথা পায়। মিতুনের বাবা চুপচাপ সব দেখে যান।
তেল গরম হলে মিতুন তাতে হড়হড় করে সব কুচি ঢেলে দেয়। অমনি গরম তেল ছিটকে এসে লাগে ওর হাতে আর জামায়। মিতুন হাউমাউ করে ওঠে। মিতুনের বাবা রান্নাঘরের বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে তাতে মিতুনের হাত ধুইয়ে দেন। মিতুন এক হাতে চোখ ডলতে থাকে।
পেঁয়াজ-রসুন-আদা ভাজা ভাজা হয়ে আসার পর মিতুন সেটা ডালে ছেড়ে দেয়। তারপর একটু লবণ দেয়। কয়েকটা মরিচ কুচিয়ে দেয় ডালে, যেভাবে বইতে লেখা আছে। তারপর কুকিং প্যানে ঢাকনা দিয়ে চুলার আঁচ একটু কমিয়ে দেয়।
রাতে খেতে বসে ডাল মুখে দিয়ে মিতুন চুপ করে যায়। একটুও মজা হয়নি খেতে। পানসে হয়ে গেছে ডাল। ইশশশ, তাড়াহুড়োয় তখন হলুদ আর জিরা দেয়া হয়নি। লবণও হয়নি ডালে। ডালটাকে দেখাচ্ছে তরকারি ধোয়া ময়লা পানির মতো।
মিতুনের বাবা বলেন, "মিতুন, মা, ডাল তো মজা হয়নি।"
মিতুনের মা বলেন, "হুঁ, পানসে হয়ে গেছে ভীষণ।"
দুলি কিন্তু রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে, "না চাচাজান, ডাইল মজা হইছে খুব!"
মিতুনের বাবা কিছু বলেন না।
সেদিন রাতে ঘুমের ঘোরে দুলি কেঁদে ওঠে, হয়তো স্বপ্নে সে দ্যাখে তার ফেলে আসা গ্রামকে, তাদের গ্রামের পুকুরগুলিকে, সেখানে ভেসে বেড়ানো হাঁসগুলিকে, তাদের গ্রামের গাছগুলি, গাছের ওপরে আকাশকে, মেঘকে, তার আদরের ছোট ভাইটাকে, তার বাবাকে, মা-কে। দুলি ঘুমের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে তার মা-কে ডাকে, "মা, ও মা, মা!"
মিতুন ছুটে যায় বিছানা ছেড়ে। সে দুলিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলে, "দুলি, কাঁদছো কেন? স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছো?"
মন্তব্য
ভাল হচ্ছে গল্পগুলো। থাম্বস আপ।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
জটিল হচ্ছে।
হিমু
নামে এবং বেনামে (!!) আপনি যতগুলো লেখা ওয়েবে প্রকাশ করেছেন তার বেশীরভাগই পড়ার সুযোগ হয়েছে। আপনার লেখা পড়লে আমি বেশীরভাগ সময়ই তীব্র ঈর্ষাবোধ করি - আপনার মত করে লিখতে পারি না দেখেই!
আপনার লেখা শিশুতোষ গল্পগুলো কেন জানি আমার খুব ভালো লাগে। দয়া করে শিশুতোষ গল্প লেখা হঠাৎ করে বন্ধ করে দিবেন না।
কি মাঝি? ডরাইলা?
আমার নামে বেনাম চাপানোর এই অপচেষ্টায় লিপ্তদের দলে আপনি বহুদিন ধরেই নাম লিখিয়েছেন দেখে আমি ক্ষিপ্ত!
হাঁটুপানির জলদস্যু
পুরো বিষয়টি নিয়ে আসলেই একটি যৌথবাহিনীর ইনভেস্টিগেশন জরুরী হয়ে গেছে।
অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে দুদকের নোটিশ সার্ভ করা হোক।
এটা খুব ভাল হয়েছে রে।
শেষে এসে কেমন কান্না পেয়ে গেল।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
ভাল আছি, ভাল থেকো।
এককথায় দারুণ।
------
হিমু ভাইয়ের নামে ও "বেনামে" যেসব গল্প লেখা হচ্ছে, তার মধ্যে বাচ্চাতোষ গল্পগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে।
কারণ এর মধ্যে "কামড়ানোর" ব্যাপারটা থাকে না এবং মানী(!) ব্যক্তিদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করা হয় না।
বাংলাভাষী শিশুদের প্রতিনিধি হিসেবে আমার সবিনয় নিবেদন, আগামী বইমেলায় হিমু ভাইর একটা বাচ্চাতোষ বই প্রকাশ করা হোক।
আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি
আবার লিখবো হয়তো কোন দিন
সহমত সৌরভদা।
হিমু ভাই, এই সিরিজ বন্ধ করলে "উগাবুগার কসম, ঠাডা পড়বো, ঠাডা!"
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
কেন জানি এখনো বাচ্চাদের গল্পগুলোই আমাকে বেশি টানে। কে জানে... হয়ত এখনো বাচ্চাই রয়ে গিয়েছি!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
বড়ো বিষাদময় গল্প হিমু, দুলিদের গল্প অবশ্য বিষাদের-ই হয়, তাইতো হওয়ার কথা। আচ্ছা মিতুন "পঁচা" বলে কেন? ও কি আল্হাদী? তাই কথায় কথায় অযথা "ঁ" বসায়?
নতুন মন্তব্য করুন