দীক্ষক দ্রাবিড়ের মন্তব্য, আড্ডাবাজের লেখা ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির সুলুক-সন্ধান

হীরক লস্কর এর ছবি
লিখেছেন হীরক লস্কর (তারিখ: রবি, ১২/০২/২০০৬ - ১০:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


নিরপেক্ষ ব্যক্তি নিয়ে বাংলাদেশে এখন সমস্যা দানা বাঁধছে। সমস্যার শুরু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা থেকেই। সামনে নির্বাচন তাই বিষয়টি আবার চলে এসেছে প্রচ্ছদে।এখানে আড্ডাবাজ এ নিয়ে লিখে ফেলেছেন দুটি লেখা। তার মতো অনেককেই নিশ্চয় ভাবাচ্ছে অস্থির ও অস্বস্তিকর রাজনৈতিক বাতাবরণ থেকে উদ্ধারের সুলুক।

শুরু করি তার শেষ লেখা দিয়ে। তার সব কথার সার বলেই কিনা তিনি তুলে দিয়েছেন প্রথম লেখায় করা দীক্ষক দ্রাবিড়ের মন্তব্য:

ক্ষমতাদখল যেখানে মুখ্য
দল-বদলের দিকে লক্ষ
সেখানে উধাও পক্ষ-বিপক্ষ
দল বদলায় বেটা নিরপেক্ষ

আড্ডাবাজ ঠিকই বলেছেন দীক্ষকের এই সারাংশ প্রতিটি বিষয়কে সংক্ষেপে তুলে ধরেছে। তার সার কথা হয়তো এটা যে নিরপেক্ষ বলে কেউ নেই বা থাকতে পারে না। কিন্তু বাকী সব পক্ষদের কথা আলোচনা না করলে তা খুব একটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে না।

প্রথম বাক্যটি হলো, ক্ষমতাদখল যেখানে মুখ্য। আসলে দীক্ষক, আমার বিবেচনায় এখানে প্রসঙ্গকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেখানে ক্ষেত্র হচ্ছে রাজনীতি, সরকার গঠন, দেশ পরিচালনা, ভোটে জয়লাভ। এ তো আর তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশের প্রতিভা নির্বাচনে বিচারকের বস্তুনিষ্ঠ থাকার নিরপেক্ষতা নয়। এখানে মূল আলোচনার সাথে জড়িত রাষ্ট্রক্ষমতা। রাষ্ট্রক্ষমতা একটি রাজনৈতিক বিষয়। গণতন্ত্রে জনগণ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে তাদের পছন্দের দল ও ব্যক্তিবর্গকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যরাও ভোট দেন তাদের পছন্দের রাজনৈতিক আদর্শের ব্যক্তি বা দলকে। আর যেখানে মানুষ কোনো আদর্শের প্রতি আস্থাবান থাকে তখন সে ঐ আদর্শের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণে যায় না। সে ভোট দেয় তার আদর্শের কারণে । যেমন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসীরা তাদের ধর্মের ভালো-মন্দ বিচারের চেষ্টা করেন না। তারা ধর্মের বিষয়ে থাকেন অন্ধ। আদর্শ বা কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা সমর্থকরাও তেমি্ন তাদের প্রিয় দলকে ভোট দিয়ে যান। তাদের কৃতকর্ম যাই হোক। এ ই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষতার সন্ধান অনেকটা মরীচিকার পেছনে জলের জন্য ছোঁটার মত বৃথাচেষ্টা।

দীক্ষকের দ্্বিতীয় বাক্যে দল-বদলের কথা উঠে এসেছে। যা প্রেক্ষাপটকে আরো স্পষ্ট করে তোলে। যেখানে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আদর্শ বিসর্জন, দল পরিবর্তন, আদর্শবিরোধী জোট গঠন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নানা রকম ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাকার বিভিন্ন বিষয় মূর্ত হয়ে ওঠে। সুতরাং কখন বি চৌধুরী রাষ্ট্রপতি থেকে নতুন দল খুলে বসবেন, কখন ড: কামাল আবার ভিড়ে যাবেন আওয়ামী জোটে, কখন ভারতপ্রেমের দোষে সরকারের মামলা জুজুতে ত্রস্তএরশাদ তালাক দেবেন বিদিশাকে এবং তিনি প্রধানকে নিয়ে খুলে ফেলবেন নতুন সাইনবোর্ডের দল, আবার গোপালের মত দলত্যাগী অমুসলিম ইসলামী জোটের রাজত্বকালে জিতে নেবেন সংসদের পদ--এর সবই অকল্পনীয়। দীক্ষক অল্প শব্দেই তুলে ধরেছেন এই প্রেক্ষাপট, ভোজ-বাজির মত জার্সিবদলের প্রচল প্রেক্ষাপটে কোথায়ই বা আমরা করবো নিরপেক্ষতার সন্ধান ।

তার তৃতীয় বাক্যে তা আরো বেশি স্পষ্ট ও আমার বিবেচনায় এখানেই লুকিয়ে আছে সমাধানের ইঙ্গিত ও ঘুমন্ত জনগণের প্রতি আলতো এক খোঁচা। তৃতীয় বাক্যে তিনি বলেন, যেখানে উধাও পক্ষ-বিপক্ষ। সত্যিই তো। পক্ষ যেখানে বিপক্ষের দলে হাজিরা দেয়, বিপক্ষ যখন পক্ষের তালে তাল মেলায়, সেখানে নিরপেক্ষের খোঁজ? আদর্শহীন দল ও আদর্শহীন রাজনীতি, বেহুদা নির্বাচনী মেনিফেস্টো, দলে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের করে রেখেছে নিজর্ীব পুতুল। আর পুরো বিষয়টিকে রাজায় রাজায় যুদ্ধ মনে করে সাধারণ জনগণ নিয়েছে ছুটি। মনে মনে তারা রাজনীতির বাপান্ত করে। কিন্তু এই সহজ সত্যটি বুঝে না রাজনীতিই রাষ্ট্রের নিয়ন্তা। এ তো আর এফডিসি নয়। যে বাংলা ছবি না দেখে স্যাটেলাইট চ্যানেলে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের নৃত্য দেখলাম। নিজের দেশ ও দেশের রাজনীতিকে অস্বীকার কি করা যায়। দীক্ষক তার উধাও শব্দটির ব্যবহারে স্পষ্ট করে তোলেন জনগণের সত্যিকার অংশগ্রহণের অভাবকে। তারা উধাও তাদের জীবন থেকে। নিজেদের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ থেকে। তারা নিবৃত্ত করছেন নিজেদের। এই নির্লিপ্ত জনগোষ্ঠীর জন্য, যারা তাদের পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়ে সজাগ ও সক্রিয় নয়, তাদের জন্য কে হতে চাইবে নিরপেক্ষ?

সুতরাং দীক্ষকের শেষ লাইনে বেচারা নিরপেক্ষের অস্তিত্ব বাঁচানোর প্রবৃত্তি ধরা পড়েছে। এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক অস্থিরতার আঙিনায় নিরপেক্ষতার ধারণায় তাই ধরা পড়ে গোড়ায় গলদ।

এই প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ ব্যক্তি তাই অন্তত: তিনটি বিপদের মধ্যে পড়ে:

1. নিরপেক্ষ ব্যক্তি অতি সহজেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। শক্তিশালী ব্যক্তি, দল ও ধারণার কাছে পর্যুদস্ত হয় তার মধ্যপন্থার সমাধান।

2. নিরপেক্ষ ব্যক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। তার কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই, নেই সমর্থক গোষ্ঠী, নেই রাজনৈতিক ভিত্তি। সুতরাং বিষয়ভিত্তিক বিতর্কের সময় সে হয়ে পড়ে একা। নির্বাসিত।অকার্যকর। সিদ্ধান্তহীন।

3. নিরপেক্ষ ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী পক্ষের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়। তার এজেন্ডা হয়ে পড়ে সেই মুখবাজ, চাপাবাজ শক্তির কার্যসূচির পুনরোচ্চারণ।

দীক্ষক যথার্থই তাই বলেছেন তখন তাঁকে রং বদলাতে হয়। আমি জানি না বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের কথা তার তখন মনে পড়েছিল কিনা। কিন্তু দীক্ষকের লেখা এই সার্বজনীন বাক্যে বুঝা যায় শাহাবুদ্দীনকেও পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষতার এই সন্ধান তাই এক ভ্রান্ত পথ-পরিক্রমা। একই কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাও হয়ে পড়েছে অকার্যকর। যেমন তা বাংলাদেশে, তেমনি তা লাইবেরিয়াতেও (দু:খিত লিংক দিতে পারছি না)।

রাজনীতিকে তার সমাধান খুঁজতে হবে রাজনীতির মধ্যে। যেমন দেখা গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। খুব একটা সফল হতে পারেননি ম্যান্ডেলা। কিন্তু নিরপেক্ষতার শিশুতোষ খেলায় জাননি তিনি। তিনি বরং সবপক্ষকে ডেকেছেন এক মঞ্চে। করেছেন জাতীয় সরকার। আজ বাংলাদেশ যে আলোকে হয়তো মুক্তির পথ খুঁজছে। আলোচনায় উঠে এসেছে সে কথা। বলছেন ড: ইউনুস, বলছেন ড: কামাল। হয়তো মনে মনে ভাবছেন অনেকেই। আরো অনেক আগেই বলেছিলেন, জাসদের ইনু। স্বাধীনতার পর পর বলেছিলেন সিরাজুল আলম খান ও তার ভাব-শিষ্যরা। জাতীয় সরকারে সব পক্ষই থাকে। তাতে তারা কোনো বিষয়েই একমত হতে পারে না। কিন্তুনিরপেক্ষ ব্যক্তির রং-য়ের খামতির অসুবিধা থেকে তারা মুক্ত। কিন্তু এ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় খিচুড়িই কি বিবদমান জনগণের একমাত্র ভোজ? তবে একথা বলা যৌক্তিক যে, নিরপেক্ষ ব্যক্তির সন্ধান, অন্তত: রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এক অর্থহীন কালক্ষেপন। কখনই কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় এই বর্ণচোরা ব্যক্তিত্বের সুলুকের সন্ধান।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।