একদম পোলাপান বেলায় বাসায় নিয়মিত কোন দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো না। বাবা যেদিন যা খুশী কিনতেন, কোনদিন কিনতেনও না। খবরাখবরের জন্য রেডিও ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সকালে একবার রাতে দুবার বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনা হতো। আজকে অবাক লাগলেও সত্তর দশকে দল বেঁধে, আয়োজন করে মানুষ রেডিও শুনতো। কাছাকাছি মানুষদের মধ্যে একমাত্র বড় মামা আর মেজ চাচার বাসায় দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত ছিল। বড়মামা সরকারী কর্মকর্তা। তার বাসায় সবসময় ইত্তেফাক রাখা হতো, মামা এত বেশী ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন যে আমি ভাবতাম ইত্তেফাক বোধহয় সরকারী পত্রিকা। এমনকি বড় হয়েও মামার বকা শুনতাম -তোরা কী ছাতামাতা পত্রিকা রাখিস, ইত্তেফাক রাখবি, ইত্তেফাক সবচেয়ে ভাল পত্রিকা (তখন আজকের কাগজ নতুন বেরিয়েছে আমি তাই রাখতাম)। আমার ইত্তেফাক পছন্দ ছিল না, ওটাকে আমার চিরকাল দালাল পত্রিকা মনে হতো। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মামা ইত্তেফাক ভক্ত ছিলেন।
মেজচাচা ব্যবসায়ী মানুষ, বাম রাজনীতি করতেন। তিনি রাখতেন 'সংবাদ'। এটাও আমার চোখে 'সুন্দর' লাগতো না। ছাপাগুলো কেমন ছেড়াবেড়া, ছবিগুলো ঝাপসা। সেদিক থেকে ইত্তেফাক অনেক পরিচ্ছন্ন ছিল। তবে ইত্তেফাকের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল বিজ্ঞাপনের হিবিজিবি আর প্রথম পৃষ্টায় প্রত্যেক খবরের দুলাইনের পর '৮ম পৃষ্টায় দ্রষ্টব্য' লেখাটি।
নিজে প্রথম নিয়মিত পত্রিকার গ্রাহক হই ১৯৮৩ সালে, 'কিশোর বাংলা' নামের একটা ছোটদের পত্রিকা। ভীষন প্রিয় পত্রিকা ছিল আমার। তখন ঢাকার পত্রিকা চট্টগ্রামে পেতে পেতে বিকেল হয়ে যেত। ভোরে উঠে চায়ের কাপের সাথে দৈনিক পত্রিকা শুধু গল্প উপন্যাসের বিষয়। 'কিশোর বাংলা' পেতাম বিকেল চারটার পরে। আরো কিছুদিন পর চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী রাখা শুরু করি কিশোর বাংলার পাশাপাশি। তারও কিছুদিন পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা। আজাদীর ছাপাটাও পুরোনো লাগতো বলে বন্ধ করে দেই একসময়। আমি তখন থেকেই দৃষ্টিনন্দন পত্রিকার পিয়াসী ছিলাম। কিন্তু মনমতো একটাও ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক পূর্বকোন যখন প্রথম প্রকাশিত হয় (সম্ভবতঃ ১৯৮৬ সালে) সেই প্রথমবারের মতো ঝকঝকে ছাপা একটা পত্রিকা হাতে পাই। ফটোকম্পোজ নামের আধুনিক প্রযুক্তির আমদানী ঘটেছিল তখন ছাপাখানায়। আমি পুর্বকোন রাখা শুরু করি।
কলেজে উঠে যায়যায়দিনের সাথে পরিচয়। ৩ টাকা দামের ভিন্ন আঙ্গিকের ৩২ পাতার পত্রিকাটি হারিয়ে দিলো বিচিত্রা-রোববারের মতো ৬৪ পৃষ্টার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাকে। আশির দশকের বিশাল অংশের আধুনিক তরুনের চিন্তাভাবনার ধারক বাহক হয়ে ওঠে যায়যায়দিন। আমরা যাযাদি বিপ্লবে সামিল হলাম। শফিক রেহমান তখন আমাদের আইডল (আজকের নষ্ট শফিক রেহমানকে যখন দেখি, নক্ষত্রপতনের কষ্ট পাই)। ত্রিশ সেট অলংকার কাহিনীতে যায়যায়দিন নিষিদ্ধ হলে আমার ম্যাগাজিন কেনা বন্ধ। তবু প্রতি সপ্তাহে পত্রিকার ষ্টলে গিয়ে খোঁজ নিতাম কোন সুখবর আছে কিনা। নিষেধাজ্ঞা উঠেছে কিনা। কিন্তু এরশাদের কোপানলে পড়েছে যাযাদি। ছাড়পত্র মেলে নি। সেই সময় বাজারে ৩২পৃষ্টার আরেকটি বিপ্লবী পত্রিকা চলছিল -মিনার মাহমুদের 'বিচিন্তা'। আপোষহীন রাগী তারুন্যের পত্রিকা। বিচিন্তার গ্রাহক হলাম। এটা নেয়া শুরু করতে না করতে কিছুদিন বাদে এটিও এরশাদের কোপানলে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো।
তারও কিছুদিন পর মোজাম্মেল বাবু সম্পাদিত 'পূর্বাভাস' নামের একটা ঝকঝকে সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখা গেল হকারের থালায়। দাম পাঁচ টাকা, সেই বত্রিশ পাতাই, কিন্তু কাভারটা অফসেটের ঝকঝকে ছাপা। প্রথম সংখ্যা কিনেই বিমুগ্ধ ভক্ত। যাযাদির সমকক্ষ হতে পারে পত্রিকাটি। কিছুদিন পর এটিও এরশাদের চক্ষুশলে পরিনত হলো। শিশিরের অসাধারন কার্টুনের সাথে পরিচয় হয় এই পত্রিকা দিয়েই। প্রিয় পত্রিকাগুলো একের পর এক নিষিদ্ধ হওয়াতে নতুন পত্রিকার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতাম। সেই সাংবাদিককুলের কাছে আমি আজো কৃতজ্ঞ দিনের পর দিন নিষেধাজ্ঞার খাড়া মাথায় নিয়ে যারা একের পর এক পত্রিকা উপহার দিয়ে চলেছিল। পত্রিকা প্রকাশের সাথে বানিজ্য ব্যাপারটা তখনো তেমন করে যুক্ত হয়নি।
প্রতিদিন ঘুরঘুর করতাম পত্রিকার ষ্টলের আশেপাশে। যদি নতুন কিছু চোখে পড়ে। অদ্ভুত নামের একটা পত্রিকা চোখে পড়লো একদিন। দুর থেকে লেখা দেখলাম 'কাগজ'। সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান। ছবি বিহীন, প্রায় বিজ্ঞাপন বিহীন অনেকটা ভাবগন্ভীর পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বিশ্বাস জন্মালো এটি আমার নতুন পত্রিকা হবে। আমি খবরের কাগজের পাঠক হয়ে গেলাম সেদিন থেকে। কিন্তু বেশীদিন নয়। কয়েকমাস পরেই সামান্য একটা প্রতিবাদী কবিতা ছাপানোর জন্য নিষিদ্ধ হয় খবরের কাগজ। এরশাদের পুরো সময়টা ছিল আতুরঘরে সংবাদপত্র হত্যার কাল। এরশাদের প্রতি আমাদের প্রজন্মের ঘৃনার হার সবচেয়ে বেশী এই কারনেও। তবে এখন ভাবি সেই নির্যাতনগুলো ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয়েছিল। তরুন সাংবাদিকদের পত্রিকা প্রকাশের চেতনাকে জিদকে আরো অনেক বৃদ্ধি করেছিল। বিপরীত অর্থে সংবাদজগতের জন্য মঙ্গল বয়ে এনেছিল। মেরুদন্ডহীন সাংবাদিকতার যুগের অবসান ঘটিয়ে সংবাদপত্রের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল এরশাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারনে। নিষেধের বেড়াজালে তারুন্য আরো বেশী শক্তিমান হয়।
এরশাদ পতনের পর যেদিন জানতে পারলাম 'খবরের কাগজ' সাপ্তাহিকটি আজকের কাগজ নাম নিয়ে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পাবে, সেদিন আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এই পত্রিকাটা আমার নিয়মিত পত্রিকা হবে। পত্রিকা হাতে পেয়ে আমার বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হলো। নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর, তথ্যসমৃদ্ধ, বিজ্ঞাপন উৎপাত বিহীন একমাত্র পত্রিকা ছিল আজকের কাগজ। আজকের কাগজকে আমি বলবো সংবাদপত্র জগতের 'একুশে টিভি'। আজকের সবগুলো টিভি চ্যানেলের আতুরঘর যেমন 'একুশে টিভি', তেমনি আজকের সবগুলো আধুনিক পত্রিকার আতুরঘর 'আজকের কাগজ'।
প্রিয় ম্যাগাজিন আর পত্রিকাগুলো ঘাটতে ঘাটতে আমি ততদিনে চিনে গেছি কে কোথায় লেখে, কোন কলামিষ্ট কোত্থেকে এসেছে। পত্রিকায় যারা লেখেন, কাজ করেন তাঁরা বোধহয় জানেন না, আমরা সাধারন পাঠকেরা দুর থেকে কিভাবে পত্রিকা কর্মীদের অনুসরন করি। পত্রিকা খুলে খবর পড়ার আগে প্রথমে কর্মীতালিকায় চোখ বুলানো আমার দুই যুগের অভ্যেস। এমনকি কম্পিউটার গ্রাফিকস এর দায়িত্বে কে আছেন সেটাও খেয়াল করতাম। কোন পত্রিকায় কে কোন বিভাগ দেখে সব মুখস্ত ছিল। ফলে কোন ছোটখাট নড়নচড়নও চোখ এড়াতো না। সাংবাদিক লেখকরা কোথাও ভুল করলে আমরা দুর থেকে বলে দিতে পারি। কিন্তু পাঠকের উপায় থাকে না সেই ভালোমন্দগুলো সেই লেখক সম্পাদক বা কলামিষ্টকে জানানোর। অনেকে পত্রিকায় লেখা পাঠাতো। আমি কখনো লিখতাম না। নিখাদ পাঠক ছিলাম আমি। পড়ার খিদে বরাবর বেশী। এখনো।
পত্রিকা কখনো ভাঙ্গতে পারে জানা ছিল না। প্রথম অভিজ্ঞতা হলো আজকের কাগজ দিয়ে। পত্রিকায় ভাঙ্গন পাঠকের মনে কিরকম আলোড়িত করে তা পত্রিকার মালিক বা কর্মীদের জানা নেই। আজকের কাগজের ভাঙ্গন আমাকে কষ্ট দিল। ভেঙ্গে একাংশ বেরিয়ে যাবার পর পত্রিকার মান ধপ করে নীচে নেমে গেল। এতে বোঝা যায় পত্রিকা মেশিনে ছাপা হলেও এর প্রধান কারিগর পেছনের মানুষগুলো। নতুন সম্পাদক আগের 'আজকের কাগজ' ফিরিয়ে আনতে পারলো না। আজকের কাগজ আমার নজর হারালো। পত্রিকা রাখা ক্ষান্ত দিলাম। কদিন পর ভোরের কাগজের খবর পেলাম। সম্পাদকীয় লাইন, ছাপা আর লেখা দেখে মনে হলো এটা আজকের কাগজের বিকল্প হতে যাচ্ছে। আমি ভোরের কাগজের গ্রাহক হলাম। একসময় ভোরের কাগজও ভেঙ্গে গেল। আবারও হতাশা। ভোরের কাগজের মান পড়ে গেছে। পত্রিকা নেয়া বন্ধ করলাম আবার।
খবর পেলাম প্রথম আলো আসছে। প্রথম সংখ্যাটা হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হলো। ভোরের কাগজের সাদাকালো নীতি বাদ দিয়ে রঙিন পত্রিকা। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে সেই কারিগরেরা আছে যাদের আমি গত দশ পনের বছর ধরে অনুসরন করে আসছি নানান পত্রিকার মাধ্যমে। সেই অদেখা মানুষগুলো। প্রথম আলোর বিমুগ্ধ পাঠক ছিলাম অনেকদিন। তারপর আরো অনেক পত্রিকা এলো বাজারে। সমকাল ছাড়া অন্যগুলো তেমন টানতে পারেনি।
এক সময় আবিস্কার করলাম সবগুলো পত্রিকা কোন না কোন ব্যবসায়ীক গোষ্টীর প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রায় উঠে গেছে। আবারও আশাভঙ্গ। এবার পত্রিকার ভাঙ্গন নয়, কিন্তু পত্রিকার ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি, বিশেষ গোষ্টীপ্রীতি, স্বার্থকলুষ সম্পাদকীয় নীতির কারনেই হতাশা হলাম। সাদাচোখে যতটুকু ধরা পড়ে আর কি। আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম পত্রিকার প্রতি। আর কোন পত্রিকা টানতে পারে না আমাকে। পত্রিকা পড়ার নিয়মিত অভ্যেস চলে যাওয়া শুরু করেছে। দৈনিক তিনটা পত্রিকা রাখা হলেও একটাও ভাল করে পড়া হয় না। শুধু অভ্যেসবশতঃ রাখা।
পত্রিকার জগত থেকে দুরে সরে এসে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে পড়ি। স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করি। পত্রিকাপাঠক আমি হয়ে যায় ইন্টারনেট পাঠক। দৈনিক অন্ততঃ আটঘন্টা ইন্টারনেটে থাকা হয়। পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশী পড়া হয় ব্লগ। পত্রিকার স্থান অনেকাংশে দখল করে নেয় ব্লগ। মাঝে মাঝে এখানেও ভাঙ্গন দেখি। কিন্তু এই ভাঙ্গন থেকে চোখ সরিয়ে রাখার সহজ উপায়ও আছে। অন্তর্জালে আছে শত কোটি বিকল্প তথ্যভান্ডার। এক জায়গা ভালো না লাগলে অন্য জায়গায় চলে যাই। একেকটি ওয়েবসাইট একেকটা জগত। ডুব দিয়ে পুরো দিন হারিয়ে যেতে পারি ওই জগতে। এই স্বাধীনতা আমি উপভোগ করি। এই স্বাধীনতা আমার অধিকার।
মন্তব্য
এ তো পুরো ইতিহাস লিখেছেন! ভালো লাগলো পড়ে।
শফিক রেহমান নিয়ে একটা লিঙ্ক দিন না, এঁর কথা কিছুই জানা নেই।
শফিক রেহমান সম্পর্কে লিংক আপাততঃ দিতে পারছি না। তরুন প্রজন্মের একটা বিরাট অংশকে বিভ্রান্ত করে ডিগবাজি খাওয়া সবচেয়ে খান্দানী সাংবাদিক তিনি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চমৎকার অবজারভেশন।
হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!
স্বাদু ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখে ফেল্লেন!
হুম!
দারুণ অবজারভেশন।
আমাদের বাসায়ও ইত্তেফাক রাখা হতো। টারজানের একটা কমিক স্টীপ দিতো, ওইটা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম।
বুঝতে শেখার পর জনকন্ঠ, ভোরের কাগজ, তারপর প্রথম আলো।
হুমম....এডগার রাইজ বারোজ এর কমিক ছিলো সম্ভবতঃ আমিও, শুধু পড়তামই না; সাদা কাগজে মোম মেখে সেটা ঐ কমিক স্ট্রিপের ওপর বসিয়ে কলম দিযে ঘঁষতাম। এর ফলে নিউজপ্রিন্ট কাগজ থেকে আমার সাদা কাগজে কমিকের একটা প্রিন্ট উঠে আসতো। সেগুলো অনেকদিন সংগ্রহ করেছি।
লেখাটিকে দুটো এক তারায় পুরস্কৃত করেছেন অজানা দুই হিতাকাংখী। দুটোকে নিয়ে একটা দোতারা বানিয়ে নিলাম। হে অচেনা ধন্যবাদ আপনাদের দুজনকে, যদিও জানিনা এত ভাল কি লিখলাম
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমি নিজে ভোরের কাগজ ভেঙ্গে প্রথম আলো হতে দেখেছি। পাঠক হিসেবেই। তবে আপনি যত তাড়াতাড়ি ভোরের কাগজের মান পড়ে যাওয়ার কথা বলছেন, তত তাড়াতাড়ি মনে হয় মান পড়ে যায়নি। প্রথম আলো বাজারে আসার কিছুদিন পর পর্যন্ত ভোরের কাগজ তার মান ধরে রাখতে পেরেছিল। যদিও পরে আর পারেনি। সে কারণে ভোরের কাগজের বেশিরভাগ পাঠকই প্রথম আলোয় যায়। তাছাড়া আলপিনের মতো বেশ কিছু নতুন আইডিয়া দিয়েও প্রথম আলো নতুন পাঠক তৈরি করে।
আর হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, প্রথম আলো'র পরবর্তীতে যেসব পত্রিকা বের হয়েছে এর মধ্যে একমাত্র সমকাল-ই চেহারাসুরতে প্রথম আলো'র অনেক কাছাকাছি গেছে। কিন্তু নিউজ আর স্ট্র্যাটেজিতে অনেক অনেক পিছিয়ে ছিল, এখনো আছে বলেই ধারণা।
আহ্, ইত্তেফাকের সিনেমার বিজ্ঞাপনের কথা এখনো মনে পড়ে। খুব আগ্রহ নিয়ে সেই বিজ্ঞাপনগুলো দেখতাম।
ভোরের কাগজের মান নিয়ে যেটা বলেছি ব্যাপারটা আপেক্ষিক। আমার চোখে যে পরিবর্তনটা পড়েছিল সেটা হয়তো সেটা আপনার চোখে লাগেনি।
প্রথমতঃ ভোরের কাগজের নিয়মিত কলামিষ্টরা প্রায় তাৎক্ষনিকভাবেই কলাম লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ গেট আপ। কেন যেন ভোরের কাগজে ভাঙ্গন লাগার সাথে সাথেই গেট আপের চরম অবনতি ঘটে। আজকের কাগজের ক্ষেত্রেও একই দশা হয়েছিল। গেট আপ অত্যন্ত বাজে হয়ে গিয়েছিল। যেটা আজো পুনরুদ্ধার করা যায়নি। এতে বোঝা যায় পত্রিকা চালানোর ক্ষেত্রে মেশিনের চেয়ে মানুষের ভুমিকা অনেক বড়।
ধন্যবাদ আপনার বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
গেট আপের চরম অবনতি? না, মনে হয়। ভোরের কাগজের গেটআপ অনেক দিনই আগের মতো ছিল। তবে তাৎক্ষণিকভাবে কলাম লেখকরা কলাম লেখা বন্ধ করেছিল কী'না তা মনে করতে পারি না আজ।
শুধু গেটআপ না। নিউজের মানটাও ধরে রেখেছিলো ভোরের কাগজ। সেটা অনেকদিনই ধরে রেখেছিলো। আর ধরে রেখেছিলো আড্ডাটা। প্রথম আলোতে লেখা জমা দিয়ে অনেক্ই সেখানে যেতেন আড্ডা দিতে। এমনকি একবার বিখ্যাত এক লেখককে দেখেছিলাম নিজের পুরনো টেবিলে প্রথম আলোর জন্যে লিখছেন!
তবে কলামের দিকে মার খেয়েছিলো বিশাল। আর থাক্কা ছিলো শিশির-বিপুলের কার্টুনে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
প্রথম পর্যায়ের বাংলাবাজারটাও বেশ ছিল।
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
যায়যায়দিন দুই দফায় দৈনিক হিসেবে বেরিয়েছিলো।
আর ভোরের কাগজের মেক-আপ (প্রথম আলোর বেরোনোর পরবর্তী) কিছুদিন ভালো ছিলো।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
আমার পত্রিকা পাঠের ১০ স্মৃতিঃ
১) ইত্তেফাক দিয়ে পত্রিকা পড়া শুরু। টারজান কার্টুন থাকতো প্রতিদিন। সপ্তাহে একদিন কচিকাচার আসর, দাদাভাই। আর সিনেমার বিজ্ঞাপন। আম্মা নিয়মিত 'বেগম' পড়তো। সাইজে প্রস্থে বিশাল। কোনোদিন পড়ার আগ্রহ হয়নি বা পড়ে ভালো লাগেনি; মনে নেই।
২) বাংলার বাণী দেখা যেতো কালেভদ্রে। তবে হরফ গুলা ভালো লাগতো না।
৩) একবার স্বাধীনতা দিবসের দিন কোচিং'এ যাবো। ছোটোকাকা টাকা দিয়ে বললেন - ভোরের কাগজ আর সংবাদ কিনে আনতে। আমি কিনে এনেছিলাম ভোরের কাগজ আর সংগ্রাম। ঘরে ফিরে সংগ্রাম হাতে দিতেই দৌড়ানি শুরু। তখনো বুঝিনি সংবাদ আর সংগ্রামের পার্থক্য আছে
৪) ভোরের কাগজের মাধ্যমে আসল দৈনিক পড়া শুরু করি। 'মেলা' 'পাঠক ফোরাম' 'ইস্টি কুটুম' 'রংধনু' 'রঙ্গব্যাঙ্ক' আরও পরে 'অবসর'; দারুণ সব পাতা। শব্দজব্দ-শব্দজট; এগুলো কেবল ভোরের কাগজেই থাকতো...
৫) জনকন্ঠ সম্ভবতঃ রঙিণ করে সবার আগে। জনকন্ঠের ফ্যাশন পাতায় বিদেশী মডেলদের ছবি দিতো। পূর্ণাঙ্গ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস পড়েছিলাম জনকন্ঠে - মঞ্জু সরকারের 'নান্টুর মেলা দেখা'।
৬) প্রথম আলো আসার পরেও ভোরের কাগজ রেখেছি কিছুদিন। অনেক আগের টান...। তবে ভো-কা ছেড়ে প্রথম আলো ধরার একমাত্র কারণ ছিলো 'আলপিন'/বন্ধুসভা এবং দারুণ সব কলামিস্টের নিয়মিত লেখা।
৭) আলপিনের ফিচার 'এম পি হোস্টেলে কী হয়' এর ঘটনায় আনিসুল হক বা সুমন্ত আসলামকে বাদ দিয়ে আহসান কবিরকে কুরবানী দেয়ার ঘটনার পর থেকে প্র-আলো রাখা বন্ধ করেছিলাম। এর কিছু দিন পর বা কাছাকাছি সময়ে ভোরের কাগজ নতুনভাবে চালু হয় পুরনো সব ফিচার পাতা, আগের অনেক কলামিস্টের লেখা নিয়ে। আবার ভোরের কাগজ রাখা শুরু করি। কিন্তু, উঠতে পারেনি। আবার মিইয়ে গেছে। যেমন গিয়েছিল আজকের কাগজ, 'সেই নাঈমুল ইসলাম খান, সেই আজকের কাগজ' বিজ্ঞাপনেও কাজ হয়নি...
৮) কখনো কিনিনি - ইনকিলাব।
৯) পত্রিকার ১ম সংখ্যা সংগ্রহে রাখার শখ জাগলো একবার। স্টকে ছিলো - মানবজমিন, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল, প্রাইম, যায়যায়দিনপ্রতিদিন, দৈনিক অর্থনীতি, মাতৃভূমি, নয়াদিগন্ত, দৈনিক যায়যায়দিন, আজকালের খবর,আমার দেশ আর কিছু সাপ্তাহিকের সূচনা সংখ্যা।
১০) এখনো সবচে' বেশি ভালোবাসি ভোরের কাগজকে। কৈশোর সময়ের সকালের সংগী ছিলো এ পত্রিকা...
বাবা দৈনিক বাংলায় ছিলেন। ফলে ঘরে দৈনিক বাংলার ছড়াছড়ি ছিলো। সাথে বিচিত্রা, আর ঠিক যখন থেকে মেয়েদের দিকে আলাদা করে তাকিয়ে দেখার শুরু, তখন থেকে আনন্দ বিচিত্রা। তাই আমার জীবনের বড় একটা অংশ দৈনিক বাংলার সাথেই কেটেছে। এই গ্রুপ দিয়েই আমার শুরু। একেবারেই ছোটবেলা থেকে আমি পত্রিকা পড়ি খুব খুঁটিয়ে। সেই অভ্যাস এখনো আছে। যতো ব্যস্ততাই থাকুক, সকালের একটা বিরাট সময় যায় পত্রিকা পড়ে।
কৈশোরে কিশোর পত্রিকায় লেখার শুরু। কিন্তু রোজগেরে সাংবাদিকতার শুরু ইত্তেফাকে। নব্বুইয়ের মাঝামাঝি সেই সময়ে ইত্তেফাক তখনো হোমড়া চোমড়া পত্রিকা। ইত্তেফাকে রেগুলার লেখা ছাপা হয়- বন্ধু আত্মীয় মহলে হিরোত্বের স্বাদ দিলো। তাই এই পত্রিকাও আমার জীবনের একটা গঠনা।
ভোরের কাগজের টিমটা খুব প্রিয়। সঞ্জীবদার নেতৃত্বে আমরা সব একসাথে আড্ডাইতাম। পুরা চারতলা আমাদের বাড়িঘর ছিলো। টুশি, তাজিন, সুমন পাটোয়ারি, স্বরূপ, ওমর, শামীম শাহেদ, নওরোজ... একটা দারুণ সময় গেছে। লেখালেখির চেয়ে আড্ডাবাজীই বেশি হতো। আর শেখার সময়টা। সঞ্জীবদার কাছে কতো কী যে শিখেছি। মুনির রানা ভাই... কতো কতো নাম। আমার খুব আপন একটা জায়গা ছিলো।
কিন্তু কাজের জন্য আমার দৈনিক পছন্দ না। দৈনিকের লেখাগুলো শব্দ দিয়ে না, কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। লিখে আরাম পাই না। অঙ্ক গুণে লেখা যায় না।
তাই যেমন ইচ্ছে লেখালেখির জন্য বিনোদন পত্রিকা। আমি নিজে নাটকের লোক। সেই থেকে আনন্দভুবন। পৃথিবীর সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমরা যা খুশি তাই শুরু করলাম। শেখাশেখির একটা বড় কাজ হতে লাগলো। এক আদিত্য কবীরের কাছেই কতোকিছু শেখার আছে। আমাদের একটা দারুণ টিম হয়ে গেছিলো। গোলাম ফারুক, আদিত্য কবীর, পল্লব মোহাইমেন, জামিল বিন সিদ্দিক, মুম রহমান, তুয়া, সৈকত...
একই দুয়ারে দাঁড়িয়ে মুক্তকণ্ঠ হলো। খোলা জানালা...
প্রথম আলো যখন হচ্ছে তখন খুব একটা বাজে সময় গেলো। আমাদের এই ছোট্ট গোছানো টিমটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রথম আলো ভোরের কাগজ দুই দলই। দুই দল দুইদিকে চলে গেলো। আমি পত্রিকাই ছেড়ে দিলাম।
এখন পত্রিকা শুধু পড়ি। গন্ধ নেই না, অথবা পাই না।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বাংলাদেশের সংবাদ পত্রের ইতিহাস লেখায় এই লেখা রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে। ভাইজান গুনী লোক, কতো কিছু মনে রাখছেরে বাবা।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
অনেক কিছু মনে পড়ে গেল। আমাদের বাসায় শুরুতে দীর্ঘদিন ইত্তেফাক আর পরে প্রথম আলো- এ দু'টোর বাইরে আর কোন দৈনিক ঢোকে নি। পত্রিকা তো আর সাহিত্যপাতা নয়। নিরপেক্ষ সংবাদপ্রাপ্তিই ছিল আমাদের মূল চাহিদা। তাই অন্যান্য দলঘেঁষা পত্রিকাগুলোর (বা এর মালিকদের) ওপর ভরসা না করে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার আদর্শের ওপরই আমরা আজীবন ভরসা করে গেছি । ইত্তেফাকে সাধু ভাষার খবর পড়তে বিরক্ত লাগলেও চতুরঙ্গ, সুহৃদ ইত্যাদি ছদ্মনামের লেখকদের উপসম্পাদকীয়গুলো ছিল বেশ আকর্ষণীয়। প্রথম আলো বের হবার পরও কিছুদিন আমাদের বাসায় ইত্তেফাক ছিল। তারপর একদিন কোন এক বন্ধুর বাসায় প্রথম আলো চোখে পড়ল। দেখলাম প্রথম আলোর গেটআপের পাশে ইত্তেফাক খুবই ফকিরা গোছের। আম্মার সাথে ঘ্যান ঘ্যান করে সেবারই প্রথম পত্রিকা বদল করা হলো।
ম্যাগাজিনের মধ্যে রাখা হতো 'বিচিত্রা'। বিচিত্রার 'এখানে-সেখানে' বিভাগ ছিল নিয়মিত আকর্ষণ। আব্বা রাখত 'দেশ', কিন্তু আমার দেশ পড়ার অনুমতি ছিল না। যদিও 'অরণ্যদেব' পড়ার নাম করে আমি প্রায় পুরোটাই পড়ে ফেলতাম। 'পূর্ব-পশ্চিম', 'সাতকাহন' 'মাধুকরী' এগুলো ধারাবাহিকভাবে দেশেই প্রথম পড়া। আমাদের জন্য ছিল 'কিশোর বাংলা', 'শিশু', আর মাঝে মাঝে কেনা হতো 'আনন্দ মেলা'। বার্ষিকীর মধ্যে ছিল 'ধান শালিকের দেশ', আনন্দ মেলার পূজাসংখ্যা। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র 'আসন্ন' চালু করার পর 'আসন্ন'র গ্রাহক হয়েছিলাম। চট্টগ্রামে বিশ্বজিতদা নামে একজন ছিলেন বিসাকে প্রতিনিধি। ওনাকে স্কুলে আসন্ন কবে পাবো জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতেন- "আসন্ন, আসন্ন"।
এরশাদ আমলের ট্যাবলয়েডগুলো ছিল আসলেই দারুণ। 'পূর্বাভাস', 'বিচিন্তা', আরো ছিল কয়েকটা। আমি তখন বাসায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাইয়ার কাছে পড়ি। ওনার কাছ থেকেই এগুলো পেতাম। এর কোন একটাতে সম্ভবত তখন সিমোন দ্য ব্যুভোয়ার 'সেকেন্ড সেক্স' ধারাবাহিক ছাপানো হতো। পলিটিক্সের চাইতেও আমার কাছে তা পড়ার প্রতিই ছিল বেশি আকর্ষণ । পূর্বাভাসেই প্রথম মনে হয় আনিসুল হকের লেখা পড়ি। মিনার মাহমুদের তখন বেশ নাম-ডাক। পরে শুনলাম এরশাদের কাছে টাকা খেয়েই নাকি তিনি বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন। এরশাদ হারামজাদাকে গালাগালি করলেও সেদিন গুলো ছিল আসলেই দুর্দান্ত। তবে যায়যায়দিন আমার কখনোই তেমন ভাল লাগে নি। শফিক রেহমানকে আজীবনই লম্পট লাগতো। যাযাদির 'ভালবাসা সংখ্যা', মইন-মিলার কাহিনী ইত্যাদি শফিক মিয়ার লুচ্চামি ছাড়া স্পেশাল কিছু মনে হয় নি।
মিলে যায় অনেক গল্প।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অনেক গল্প মিলে যায় আসলেই।
মনে আছে রেহমান 'মৌচাকে ঢিল' নামে আরেকটা স্বল্পমেয়াদী পত্রিকা বের করেছিলেন। সেটাকে মিস করি। আর 'খোলা জানালা', আহারে।
নতুন মন্তব্য করুন