আমাদের লুকোনো সম্পদ, আমাদের সমৃদ্ধির আশ্বাস

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: মঙ্গল, ১৮/০৮/২০০৯ - ৫:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বলিভিয়ার লবনভুমি সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি - এই শিরোনামে বিবিসির গতকালের একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল আজ। পুরোটা পড়ে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলাম। বলিভিয়া পৃথিবীর অর্ধেক লিথিয়াম খনিজের মালিক। সারা বিশ্বে আগামীতে জ্বালানী শক্তির মস্ত সংকট ধেয়ে আসছে। তেল গ্যাস ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বিকল্প জ্বালানীর সন্ধানে উন্নত বিশ্ব ব্যস্ত। সেই সংকটে লিথিয়াম হয়ে উঠতে পারে দারুন এক বিকল্প। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে লিথিয়াম ব্যাটারির জোয়ার চলছে। আগামীতে গাড়ীও চলতে পারে রিচার্জেবল ব্যাটারি দিয়ে। বিপুল পরিমান লিথিয়ামের মজুদে বলিভিয়া তখন হয়ে উঠতে পারে বিশ্বশক্তির আধার। কেউ কেউ এরই মধ্যে বলিভিয়াকে লিথিয়ামের সৌদি আরব বলা শুরু করেছে। যদিও বলিভিয়ার খনিজসম্পদ মন্ত্রী Luis Echazu-র তাতে দ্বিমত আছে। তিনি লিথিয়াম রপ্তানীর চেয়ে লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনে আগ্রহী বেশী।

গায়ানার পরেই বলিভিয়া দক্ষিন আমেরিকার দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ। বাংলাদেশের মতো এটিও হরেক সমস্যায় জর্জরিত। সম্পদের সুষম বন্টন নেই এখানেও। ধনী দরিদ্রের বিশাল ব্যবধান। সুনামের চেয়ে বদনাম বেশী। তবু বলিভিয়া মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। মাথা তুলে দাঁড়াবার এই স্বপ্নটা বলিভিয়া দেখা শুরু করেছে যখন ২০০৬ সালে আদিবাসী বংশোদ্ভুত নেতা Evo Morales ক্ষমতায় আরোহন করলেন। সেই থেকে বদলে যেতে শুরু করে বলিভিয়ার দারিদ্রের পুরোনো চিত্র। নতুন স্বপ্ন দেখানো শুরু করেছে মোরালেস। দারিদ্রের ক্ষমতায়ন বিষয়টি কেবল কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করেছে তার নতুন সরকার। স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের মতো জাতীয়করন করা হচ্ছে তেল গ্যাস সহ দেশের গুরুত্বপূর্ন শিল্পগুলো। মূল্যবান খনিজগুলো যাতে দেশের জনগনের মঙ্গলের কাজে ব্যবহৃত হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছে।

এবং সবচেয়ে চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে লিথিয়াম বিষয়ে। লিথিয়াম রপ্তানী করে তাৎক্ষনিক বড়লোক হবার চেয়ে লিথিয়ামের তৈরী ব্যাটারী রপ্তানী করতে তাদের আগ্রহ বেশী।বলিভিয়ার বর্তমান সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর করালগ্রাস থেকে শিল্প ও সম্পদকে রক্ষা করার আন্তরিক প্রয়াস। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে শিক্ষনীয় বিষয় হতে পারে এটি।

আমাদের কক্সবাজার মহেশখালী সেন্টমার্টিন হাতিয়া সহ উত্তরে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র বেসিনে লক্ষ লক্ষ টন তথাকথিত কালো সোনা স্তুপীকৃত হয়ে পড়ে আছে কয়েকযুগ ধরে। কালোসোনাগুলোর বাহারী নাম হলো ইলেমনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট ইত্যাদি। বিদেশী কোম্পানীগুলো মাঝে মধ্যে গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলে আসে খোঁজ নিতে। তখন সরকার একটু নড়ে চড়ে বসে। তারপর আবার শীত ঘুম। এই করে করে চলছে দেড়যুগ। ও এইচ কবির নামে আধপাগল এক অবসরপ্রাপ্ত পর্যটন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একা একা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এই সম্পদের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করতে, এই সম্পদকে বিদেশী কব্জা থেকে রক্ষা করতে। তিনি নিজে গবেষনা করে চমকপ্রদ কিছু তথ্য আবিষ্কার করেছেন। সেই আবিষ্কারকে তিনি দেশের কাজে লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলো তিনি ও তার আবিষ্কার নিদারুনভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। বারবার উপেক্ষিত হতে হতে এই মানুষটি প্রচন্ড অভিমানে তার গবেষনা ধ্বংস করে ফেলারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু শুভাকাংখীদের জন্য পারেননি। ২০০২ সালের দিকে সাপ্তাহিক ২০০০ এর রিপোর্টে এই কালো সোনার বৃত্তান্ত পড়ে আমি খুব আশাবাদী হয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলাম সরকারের ঘুম ভাঙানোর কাজে। কয়েক লক্ষ কোটির উপর মূল্য হতে পারে শুধু কক্সবাজার অঞ্চলের খনিজ আহরন করতে পারলে। দেশের বাকী অংশের কথা বাদই দিলাম।

আমাদের সমস্যা হলো সেই খনিজ পরিশোধনের প্রযুক্তি আমাদের নেই। যতটুকু আছে তাতে হয়তো ৮৫-৯০ভাগ পরিশুদ্ধ করা যায়। কিন্তু জানা গেছে ইলেমনাইট যদি ৯৯% পরিশোধন করা না যায় তার দাম আসলের ১ শতাংশও পাওয়া যাবে না। ৯৯% পরিশুদ্ধ হবার জন্য বিদেশী প্রযুক্তি অবশ্যই দরকার। টাকা দিয়ে প্রযুক্তি ভাড়া করে আনা যায়। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় কমিটি করা যায়। সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।

কিন্তু সরকার সেই পথে না হেটে সোজা গোটা সম্পদের পাহাড়ই তুলে দেবার চেষ্টা করেছিল বিদেশী কোম্পানীর কাছে। অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানী ইন্টারন্যাশনাল টাইটানিয়াম কর্পোরেশান সেই সময় বেশ কিছুদিন কাজ করেছিল। ওখানেই আমাদের প্রবল আপত্তি ছিল।

তাই সাপ্তাহিক ২০০০-এ যিনি রিপোর্টটি লিখেছিলেন সেই সাংবাদিক আসাদুর রহমানকে নিয়ে আমার ঢাকাস্থ এক বন্ধুর সহায়তায় ঢাকায় একটা গোলটেবিল বৈঠকে একত্রিত করেছিলাম বুয়েটসহ বাংলাদেশে এই লাইনের সকল দেশীয় বিশেষজ্ঞকে। ও এইচ কবির সাহেবও উপস্থিত ছিলেন অন্যন্য বিশেষজ্ঞের সাথে। আরো আমন্ত্রন করেছিলাম তৎকালীন খনিজসম্পদ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ সাহেবকে। ভেবেছিলাম সরকারের ভেতর একটা জোর ধাক্কা দিয়ে জানানো যাবে আমাদের কী সম্পদ-সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে দেশের পেটের ভেতর। কিন্তু অন্য সবার বক্তব্যে আশাবাদী সুর আসলেও মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্য শুনে আমি প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম এই রকম মন্ত্রী বাংলাদেশে যতদিন থাকবে ততদিন আমি আর কোন কাজে সরকারের ঘুম ভাঙাতে যাবো না।

গোলটেবিল বৈঠকে এরকম জনগুরুত্বপূর্ন বিষয়ে তিনি যা বলেছিলেন, তাতে তার জ্ঞানবুদ্ধি মন্ত্রী হবার যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ দেখা যায়। সেরকম প্রেসনোটধরনের বক্তৃতা যে কোন সরকারের আমলে রেডিও বা বিটিভির খবরে প্রতিদিন কয়েকবার বলা হয়। তাই সেই সাফল্যগাথার বয়ান দিতে রুচি হচ্ছে না এখানে। সরকারের ঘুম ভাঙাতে দারুনভাবে ব্যর্থ হলাম আমি ও আমার সঙ্গীরা। বিফল মনোরথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম সবাই।

কয়েকমাস আগে সেই নাছোড়বান্দা গবেষক ভদ্রলোক ও এইচ কবির সাহেব আরেকটা লেখা লিখেছেন নিউ নেশানে। এবার জানতে পারলাম এই সরকারও নাকি প্রিমিয়ার মিনারেল কোম্পানী নামে সিঙ্গাপুর-অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক আরেকটা বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করতে যাচ্ছে আমাদের কালো সোনা। সরকারের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টায় আমি হাল ছেড়ে দিলেও ছাড়েন নি ও এইচ কবির। তার নিউ নেশানে ছাপা লেখাটা তাই বলছে।

ভাবছি আবারো যোগাযোগ শুরু করবো কিনা, এই সরকারের ঘুম কি ভাঙাতে পারবো? সরকার কি আসলে ঘুমায়, নাকি জেগে ঘুমায় সেটাও বিরাট একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশকে নিজেদের সম্পদ নিজেদের কাজে ব্যবহার করার মতো শক্তি পেতে আর কতযুগ অপেক্ষা করতে হবে? বলিভিয়ার মতো একজন Evo Morales কবে আরোহন করবে বাংলাদেশের সিংহাসনে?


মন্তব্য

মামুন হক এর ছবি

অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং তথ্যবহুল লেখা!!

ভেরিফিল্মিবয় এর ছবি

এ বিষয়ে ব্লগ থেকে একটা প্রচারণা চালানো যেতে পারে। সবাইকে জানিয়ে দেয়া হোক বিষয়টি

অরন্য এর ছবি

ও এইচ কবিরকে শ্রদ্ধা তার কাজের জন্য। এ ঘুম ভাঙাতে হবে, যত শীঘ্র সম্ভব

ফরিদ এর ছবি

বলিভিয়ার সেই সল্ট প্লেইন শ্বাসরুদ্ধকর রকমের সুন্দর। ম্যাট হার্ডিং এর ড্যান্সিং ভিডিওর সম্ভবত দ্বিতীয়টির প্রথম শট ছিল ম্যাট হেঁটে চলছে অদ্ভূত স্বপ্ন স্বপ্ন এক যায়গায়। দেখে মনে হয় মেঘের ওপরে হাঁটছে।

কোয়ান্টম অফ সোলেস দেখেছেন কেউ? বলিভিয়া? পানি? মনে পড়ে? আমার মনে হয় পরিচালক এক্কারে লিথিয়াম নিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর সাহস পাননি। বহুদিন ধরে বলিভিয়া আর লিথিয়ামের ওপরে কিছু লিখব মনে করেছিলাম গুছিয়ে আনা হয়নি মন খারাপ

পাইসি লিঙ্কটা, দেখি এমবেড হয়কিনা। দেশের থেকে হলেও প্রথম ত্রিশ সেকেন্ড দেখলেই বলিভিয়া পায়া যাবেন।

ফুট্টুস [অতিথি] এর ছবি

এই ব্যাপারটাকে সবার নজরে আনা দরকার......

>>>

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

দরকারী লেখার জন্য ধন্যবাদ অনেক।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
_____________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

আমরা ম্যাঙ্গো পাব্লিক অনেকেই জানিনা আমাদের কী কী রয়েছে এবং সেগুলোর ব্যবহারিক উপায় কী হতে পারে। যেমন এ কালো সোনা যেটা বললেন, এ বিষয়ে আমি অন্ধকারে ছিলাম। এখন জানলাম, কিন্তু এটা জানিনা যে এটার উপযোগিতা কী এবং কোথায়।

এ ব্যাপারে আরেকটু আলোকপাতের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আর ব্লগ প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু হোক এ সম্পদ রক্ষার প্রচেষ্টা। কি স্ট্র্যাটেজি হলে এ সম্পদ আমরা নিজেরাই উত্তোলন ও পরিশোধন করে নিজেদের ডিমান্ড তৈরী ও মেটাতে পারব, সে ব্যাপারেও বিস্তারিত জানতে চাই।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

‍‌আমি প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তগুলো গুছিয়ে নিয়ে দেবো পোষ্টে।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তানভীর এর ছবি

টপিকটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আমাদের কক্সবাজার মহেশখালী সেন্টমার্টিন হাতিয়া সহ উত্তরে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র বেসিনে লক্ষ লক্ষ টন তথাকথিত কালো সোনা স্তুপীকৃত হয়ে পড়ে আছে কয়েকযুগ ধরে।

উত্তরে থাকার কোন সম্ভাবনা দেখছি না। সময় পেলে এ বিষয়ে একটা পোস্ট দেব ভাবছি।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

‍‌উত্তরের ব্যাপারটা আমি বছরখানেক আগে জেনেছি। এবং শুনেছি ওখানকার মজুদ নাকি দক্ষিনের চেয়ে বড়ও হতে পারে। আমি রেফারেন্সটা খুজে পেলে জানাবো। সম্ভবত সাপ্তাহিক ২০০০ বা প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল রিপোর্টটা।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

দারুণ লেখা বস চলুক চলুক চলুক
বিষয়টা পুরা অজানা ছিলো। আফসোস, আমাদের পত্রিকা গুলা এই বিষয়ের খবর গুলো যেনতেন ভাবে প্রচার করে- আর আম্রাও চোখ দিইনা, যতক্ষণ আমাদের স্বার্থে ঘা না পড়ে...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

ভুতুম এর ছবি

ধন্যবাদ এমন একটা বিষয় সামনে তুলে ধরার জন্য।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

এনকিদু এর ছবি

বলিভিয়ার মতো একজন Evo Morales কবে আরোহন করবে বাংলাদেশের সিংহাসনে?

হমম ... একটা স্পার্টাকাস দরকার ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।