সেই ছাত্রত্ব কালের কথা। এক সন্ধ্যায় পাড়ার ঝুপড়ি চা দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিছিলাম বন্ধুকে নিয়ে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পাশের টেবিলের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল বারবার। আধ ময়লা শার্ট পরা মাঝ বয়েসী একজন শ্রমজীবি মানুষ ওই টেবিলে বসা। কপালে ঘাম চিকচিক করছে তাঁর। লোকটা খুব মনযোগের সাথে যে কাজটা করছিন সেটাই দৃষ্টিকে টেনে নিচ্ছিল ওদিকে।
তাঁর হাতে একটা সিগারেট জ্বলছে। খানিক পরপর সেই সিগারেটের ছাইগুলো ঝাড়ছেন সামনে রাখা চায়ের কাপে। খালি কাপ না। চা ভর্তি কাপ। আবার সেই চায়ের কাপে চুমুকও দিচ্ছেন সুড়ুত সুড়ুত করে। সিগারেটের ছাই দিয়ে কাউকে চা খেতে দেখা সেই প্রথম। কৌতুহল দমন করতে না পেরে আমরা ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কি?
আমাদের কৌতুহল দেখে একটু আমোদই পেলেন যেন। হাসলেন। বললেন, অনেক দিনের অভ্যেস। এখন নেশা হয়ে গেছে। কতো বছর হবে? জানতে চাইলাম। বললেন, মুক্তিযুদ্ধের পরপর। 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটার উচ্চারণের দৃঢ়তার কারণেই বোধহয়, কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। এই শ্রেনীর মানুষ মুক্তিযু্দ্ধ শব্দটা ঠিক এভাবে উচ্চারণ করে না। আরো এগিয়ে গিয়ে জানতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কোথায় ছিলেন?
আমার প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুচকে গেল তাঁর। একটু অবাক সুরে বললেন - কোথায় আবার, যুদ্ধে ছিলাম।
“যুদ্ধে ছিলাম” শব্দ দুটো আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। কারণ নাটক সিনেমার বাইরে আমি কখনো কোন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা দেখিনি। এই প্রথম একজন মুক্তিযোদ্ধা দেখছি। এই সুযোগ হারাতে চাইলাম না। ধরে বসলাম যুদ্ধের গল্প শুনবো। একটু দোনোমোনো করেও শেষমেষ রাজী হলেন তিনি। বলছেন তিনি। শ্রোতা আমি আর বন্ধু।
যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে ঘন্টা পেরিয়ে গেল। মগ্ন হয়ে শুনছি ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার কথা। পাকি শিবির এমবুশ করার পর কচুরিপানার জঙ্গলে তিন দিন অনাহারে লুকিয়ে থাকার কথা। সঙ্গীদলকে পালাতে সুযোগ করে দিতে গ্রেনেড আর এলএমজি দিয়ে শত্রুর চোখে বিভ্রম তৈরী করা ইত্যাদি নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। তারপর সর্বশেষ অপারেশানে পিঠে গুলি খেয়েও শত্রুর কাছ থেকে বেঁচে ফিরে আসার কথা। বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো আমার যখন পিঠের জামা উল্টিয়ে দেখালেন যেখানে গৌরবের ক্ষতটা জ্বলজ্বল করছে কুচকানো চামড়ার মধ্যে।
গল্প শেষ হলে জানতে চাইলাম – যুদ্ধের পর থেকে কি করছেন?
বললেন, আগে চাষবাস করতাম, এখন ঠেলাগাড়ী চালাই।
শুনে অবাক না হলেও দুঃখিত হলাম। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি এলএমজি হাতে নিজের প্রাণটাকে তুচ্ছ করে যুদ্ধ করে লাল সবুজের পতাকাটা আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন, সেই মানুষটা পিঠে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে ঠেলাগাড়ী চালিয়ে জীবন কাটাবে এটাই নিয়তি?
ক্ষোভের সাথে বললাম - "আপনি দেশের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ করলেন, অথচ দেশ আপনাকে কিছুই দিল না? আপনার আফসোস হয় না?"
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা রমিজ হোসেনের জবাব আমার বিস্মিত হবার ক্ষমতাকেও হার মানালো।
“দেশ আমাকে কিছু দেবে কেন? শেখ সাহেবের ডাকে যুদ্ধে গেছি। দেশের জন্য যুদ্ধ করছি। যুদ্ধ শেষ, দেশ স্বাধীন হইছে। আমার কাজ শেষ। আমি দেশের কাছ থেকে আর কিছু চাই না। আমার কাজ আমি করি। যা আছে তাতেই খুশী”
আমি আর কথা বাড়াবার সাহস পেলাম না। ঘাড়টা আপনা আপনি নীচু হয়ে গেল আমার। দেশে এত আজীব মুক্তিযোদ্ধাও আছে!
×××××× ××××××× ××××××
গতকালের পত্রিকায় দেখলাম ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে কিছু লোক সরকারী চাকরীর সুবিধা নিয়েছে জালিয়াতি করে। খবরটা শোনার পর থেকে একজন সাধারণ ঠেলাওয়ালা রমিজ হোসেনের সেই কথাগুলো দেড়যুগ পাড়ি দিয়ে এসে মগজের ভেতর খট খট করছে।
মন্তব্য
আপনার কাছে উনাকে 'আজীব' লাগলো কেনো বুঝলামনা। আমি জীবনে যতোজন মুক্তিযোদ্ধাকে কাছ থেকে দেখেছি-মিশেছি তাঁদের প্রায় সবাইকেই দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ করার বিনিময়ে কোনো কিছু বা কোনো সুবিধা না চাইতে। তা নিজের জন্য হোক বা নিজের সন্তানদের জন্য হোক। তাঁদের অনেকেই হতদরিদ্রের জীবনযাপন করেছেন বা করছেন, তবু রাষ্ট্র বা জনগণের কাছে হাত পাতার কথা তাঁরা ভাবেননি। মুক্তিযুদ্ধ তাঁদের পুড়িয়ে এমন সোনাই বানিয়েছে, এমন আত্মমর্যাদাশীল - বিপরীতে আমাদের অকৃতজ্ঞতার প্রসঙ্গ ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবদানের কথা বলে ফেনা তুলে বিশেষ সুবিধা চাওয়াদের ব্যাপারে খোঁজ নিলে দেখবেন তাদের প্রায় সবারই মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা ধুসর।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
অমুক্তিযোদ্ধারাই যে দেশে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বের দাবী করে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কামড়াকামড়ি করে, সেখানে রমিজ হোসেনদের তো 'আজীব' বলেই মনে হয় আমার।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
এ ভ্রমণ, কেবলই একটা ভ্রমণ- এ ভ্রমণের কোন গন্তব্য নেই,
এ ভ্রমণ মানে কোথাও যাওয়া নয়।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার আশপাশে যতজন মুক্তিযোদ্ধা দেখেছি, সবারই বক্তব্য মোটামুটি একইরকম। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের কৃতিত্বের কথা কখনও মুখ ফুটেও বলেননা।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কখনই আগ বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দেন না, তাঁরা তাঁদের ত্যাগেই সুখ খুঁজে পান, কী পেলেন আর কী পেলেন না, এটা তাঁদের ভাবনাতেই আসে না। দেশের এইরকম এক মহান ইতিহাস যারা সৃষ্টি করেছেন নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে, পার্থিব কোন কিছু দিয়ে তার বিনিময় কি সম্ভব!
রমিজ হোসেনদের মত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
কথা সেটাই “আমার কাজ আমি করি।“
...........................
Every Picture Tells a Story
লেখাটাও।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
মুক্তিযোদ্ধা রমিজ হোসেনের জন্যে ,
আর ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা আর ভূয়া সার্টিফিকেট তো আজকে নতুন কিছু না, জানি না কি ভাবে এদের সায়েস্তা করা যাবে!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
নতুন মন্তব্য করুন