এক. আবদুইয়ার মাথাটা সারাবছরই নড়বড়ে থাকে। আর শীতকাল আসলে তো একদম চরমে। তার মুখ দিয়ে যেসব শব্দ বের হয় সে তুলনায় রাস্তাঘাটে শুনতে পাওয়া দৈনিক খিস্তিগুলি নিতান্তই নিরীহ। আবদুইয়ার চোখে চোখে তাকালেই সে ধরে নেবে আপনি তার গালির খদ্দের এবং খদ্দের সন্তুষ্টির জন্য তেড়িয়া হয়ে উঠবে সে...... সুতরাং তার চোখে চোখে কেউ তাকায় না। নিরাপত্তার খাতিরে আবদুইয়াকে রাস্তার যেপাশে দেখি আমি তার বিপরীত দিকে চলে যাই।
আবদুইয়া মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ীর উল্টোদিকের কমিউনিটি সেন্টারের বারান্দায় রাত কাটায় যেখানে আমাকে অফিসের গাড়ীর জন্য দাঁড়াতে হয়। ভাগ্য খারাপ হলে বৃষ্টির দিনে বারন্দার ভেতরের দিকে চলে যেতে হয় যেখানে আবদুইয়া ঘুমিয়ে আছে এবং প্রতিমুহূর্তে আশংকায় থাকতে হয় না জানি আবদুইয়া জেগে উঠে। ভয়ে আমি মোবাইল পর্যন্ত সাইলেন্টে রাখতাম। যেদিন বাসা বদল করে অন্য পাড়ায় চলে যাই সেদিন সবচেয়ে স্বস্তি পেয়েছিলাম আবদুইয়ার কাছ থেকে পালাতে পেরেছি বলে। আজ হঠাৎ আবদুইয়ার কথা মনে পড়লো পত্রিকার সংবাদটা দেখে-
দুই.
নির্মান ব্যয়ে এতদিন যাবত এক নম্বরে থাকা ২০ বিলিয়ন ডলারের হংকং এয়ারপোর্ট শীঘ্রই হেরে যাচ্ছে ৮২ বিলিয়ন ডলারের দুবাইয়ের আল মাকতুম এয়ারপোর্টের কাছে।
এশিয়ার এয়ারপোর্টগুলো যদিও সাইজে আটলান্টা, ডালাস কিংবা শিকাগোর তুলনায় কিছুই না তবু সংবাদে নানা রকম রেকর্ডের খবর যেন একটু বেশীই আসে। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট, কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট, সাংহাই পুডং এয়ারপোর্ট, থাইল্যান্ডের সুবর্নভূমি এয়ারপোর্ট, সৌদি আরবের কিং ফাহাদ এয়ারপোর্ট, হংকং এয়ারপোর্ট কিংবা জাপানের কানসাই এয়ারপোর্ট সবসময় কোন না কোন কারনে আলোচিত, কোন না কোন কারণে বিখ্যাত। এশিয়ার সমৃদ্ধি নিয়ে গর্ব করতে ভালোই লাগে। এশিয়া তো আমারই মহাদেশ।
দুবাই এয়ারপোর্টের কাছে পরাজিত হওয়াতে হংকং, সিঙ্গাপুর, সাংহাই কিংবা কানসাই এয়ারপোর্টের কতোটা মন খারাপ হয়েছে জানি না, কিন্তু ঢাকার হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্টের খুব আঁতে ঘা লেগেছে।
তাই সরকারের কোন নাজিরের হঠাৎ মনে হলো, আমরা কি নিতান্তই পাঁচু গোপাল? আমাদের নাম কেন জ্বলজ্বল করবে না বিশ্বের দরবারে। একটা ঝাকানাকা এয়ারপোর্ট থাকলে দক্ষিন এশিয়ার হাব হতে আর কোন সমস্যা নাই। আমাদের শক্তি সামর্থ্য কি কম? ফুটবলে ভুটানের কাছে হিমশিম খেলেও ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডকে নাস্তানাবুদ করিনি? দারিদ্রের তালিকায় এক নাম্বার থাকতে না পারলেও দূর্নীতিতে পাঁচের মধ্যে থাকিনি? ঘরে ঘরে পাঁচকোটি মোবাইলের ডিজিটাল রিংটোন পৌঁছে দেইনি? দুনিয়া কাঁপানো একটা এয়ারপোর্ট তৈরী করা আমাদের জন্য কি অসম্ভব কাজ? জাপান যদি সাগর ভরিয়ে এয়ারপোর্ট তৈরী করতে পারে, সামান্য আড়িয়াল বিল খুঁড়ে একটা এয়ারপোর্ট তৈরী করা কি খুব কঠিন?
হুকুম হলো, ওই মোখলেস, যা একখান ফিজিবিলিটি রিপোর্ট বানায়ে আন আড়িয়াল বিলের উপর। পাঁচটার মধ্যে রিপোর্ট চাই, ছটায় মিটিং আছে।
বিশেষজ্ঞ মোখলেস একটা তড়িৎ রিপোর্ট বানিয়ে নিয়ে নাজিরের কাছে যায়, নাজির ওটাকে সই করে উজিরের কাছে গেল, উজির ওটাকে মন্ত্রীর টেবিলে ফেলতেই আহলাদে মন্ত্রী চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, হা হা হা, কি চমৎকার আইডিয়া..... হ্যাঁ এই আড়িয়াল বিলেই আমাদের এয়ারপোর্ট হবে এবং তা বঙ্গবন্ধুর নামেই হতে হবে।
মন্ত্রী অনতিবিলম্বে লেক্সাস হাঁকিয়ে গনভবনে ঢুকে কাঁচুমাচু হয়ে রিপোর্ট পেশ করে বলে, "মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী এ আমার সামান্য আবদারে আপনি কিছুতেই 'না' করতে পারবেন না। টাকাপয়সা হাতের ময়লা, জীবন দুদিনের বায়না। ৫০ হাজার কোটি টাকা ৮ বিলিয়ন ডলারেরও কম। পোঁদে লাথি খাওয়া দেশের ফকির মিসকিনেরাও মিডল ইষ্ট থেকে এর চাইতে বেশী পাঠায়। বঙ্গবন্ধুর নামকে স্থায়ী করতে আড়িয়াল বিলে একখানা এয়ারপোর্ট হতেই হবে, এট এনি কষ্ট্! মানি ইজ নো প্রবলেম, আই উইল..... সরি আপা!" শেষদিকে এসে একটু থতমত খেয়ে যায় অতিরিক্ত আবেগে ভেসে যাবার কারণে।
*************************************
তিন.
রাতারাতি বাংলাদেশ কতোটা ধনী হয়ে গেছে জানি না। দেশের প্রধান দশটা সমস্যার মধ্যে বিমানবন্দর একটা কিনা জানি না। কিন্তু নীচে এশিয়ার তুচ্ছ(!) কয়েকটা এয়ারপোর্টের নির্মান ব্যয় দেখে আজ আমার আবদুইয়ার কথা মনে পড়লো। ইচ্ছে হলো আবদুইয়া হয়ে চিৎকার দিয়ে বলি............... খা.......পো......দি!!!!!!
Kuala Lumpur International Airport = 3.5 billion dollars
Indira Gandhi International Airport = 1.5 billion dollars
Singapore Changi Airport = 3.05 billion dollars (in two phase)
Suvarnabhumi Airport Thailand = 3.8 billion dollars
Shanghai Pudong International Airport = 1.67 billion dollars (first phase)
ভূখা নাঙা বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ এখনো তিনবেলার খাদ্য যোগাড়ে হিমশিম খায়, যার মাথার উপর এখনো ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঋনের বোঝা, সেই দেশ যদি বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল বিমানবন্দরের মতো ধৃষ্টতাপূর্ন অপ্রয়োজনীয় স্বপ্নের কথা বলে তখন মাথা ঠিক রাখা সত্যিই দায় হয়ে যায়।
কেবল বিমানবন্দর তৈরী করেই সিঙ্গাপুর বা হংকং এশিয়ার বানিজ্যিক হাব হয়েছে বলে যাদের ধারণা, তাদের অবকাঠামোগত জ্ঞান নিয়ে সত্যিই খুব করুণা হয়।
চার.
সমুদ্র ভরাট করে জাপান ১৫ বিলিয়ন ডলারে (পরে ২০ বিলিয়নে উন্নীত) কানসাই এয়ারপোর্ট তৈরী করার সময় এক হিসেবে দেখা গিয়েছিল এক কাপ কফির দাম ১০ ডলার না রাখলে খরচ পোষাবে না।
বাংলাদেশের গবুচন্দ্রেরা এইসব জানে না বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু জেনে শুনে এত বড় অবাস্তব একটা প্রকল্পের কথা যারা মুখে আনে তাদের উদ্দেশ্য আর গত সরকারের নাজমুল হুদার ম্যাগলেভ ট্রেনের স্বপ্নের উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য পাওয়া যায় না বলেই কোন রকম আলোচনায় না গিয়ে আবদুইয়া হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
=========================
অতঃপর একটি লজ্জিত পাদটীকাঃ
ঢাকা এয়ারপোর্ট দিয়ে বছরে নাকি ৪০ লাখ যাত্রী আসা যাওয়া করে। খবরটা যাচাই করতে বেসামরিক বিমান কতৃপক্ষের ওয়েব সাইটে ঢুকলাম। কিন্তু ওখানে এয়ারপোর্টের নাম আর তাদের ভূতপূর্ব চেরমেনের তালিকা বাদে কোন রকম দরকারী তথ্যতো পাইনি বরং সাইটের চেহারা আর পরিবেশিত ইংরেজী পড়ে ভিড়মি খেয়েছি। চাইলে আপনিও একবার ঢুঁ দিয়ে আসতে পারেন। তরল মেজাজে পড়লে বিনোদন নিশ্চিত।
http://www.caab.gov.bd
মন্তব্য
মানুষ হিসেবে লজ্জিত ।
------------------------------------
সবুজ পাহাড়ের রাজা
আমি এই প্রকল্পের পানিসম্পদ ও পরিবেশগত দিক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম ব্লগে ও সংবাদপত্রে। এই প্রকল্পের আসলে সামগ্রিক ব্যবচ্ছেদ প্রয়োজন বিশেষত বিমানবন্দর তৈরীর অযৌক্তিকতা নিয়ে। আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা আশা করছি।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
হ্যাঁ আপনার লেখা পড়ে পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জেনেছিলাম। তারপর মনে হলো পরিবেশের কথা বাদ দিলেও এত বড় বাজেটের একটা বিমান বন্দরের কথা মুখে আনতে বাংলাদেশের মতো দেশের সাহস হয় কি করে? যে দেশ এখনো চারটি প্রধান শহরেই নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেবার ব্যবস্থা করতে পারেনি, যে দেশের প্রধান দুটো শহরে আসা যাওয়ার জন্য একটি ভদ্র গোছের হাইওয়ে নেই, যেদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এখনো গ্রহনযোগ্য সীমারও অনেক নীচে তখন সেই দেশ এরকম বিলাসী প্রকল্পের কথা মুখে আনলে ধৃষ্ঠতা কিংবা মূর্খতাই প্রকাশ পায়। সারা বিশ্ব যখন নিদারুণ অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে শংকিত, সেরকম সময়, ভিক্ষার টাকা দিয়ে এরকম বিলাসী প্রকল্পের কথা মুখে আনা ভিখারীর লেক্সাস কেনার আবদারের মতো লাগে না?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এই এয়ারপোর্টে লাভ দুটো - ১. শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইগো স্যাটিসফ্যাকশন ২. আওয়ামী লীগের পুরো কর্মীবাহিনীর সারাজীবনের হালুয়া রুটির ব্যবস্থা। সত নিয়ত থাকলে ঢাকা বা অন্য কোন এয়ারপোর্ট বড় করার উদ্যোগে যেতে পারতো এরা।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
কোন রকম স্টাডি ছাড়া এত বড় একটা অবাস্তব স্বপ্নের ঘোষনা করা কতো বড় দুঃসাহসের কাজ, প্রধানমন্ত্রীর নিজেরই শিউরে ওঠা উচিত। বাংলাদেশ কেমন আছে ওরা জানে না?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
জি এম কাদের এর নবুয়ত লাভটাও দেশের জন্য থুক্কু জাপা'র আখেরের জন্য খারাপ না।
পোঁদে লাথি খাওয়া দেশের ফকির মিসকিনেরাও মিডল ইষ্ট থেকে এর চাইতে বেশী পাঠায়। বঙ্গবন্ধুর নামকে স্থায়ী করতে আড়িয়াল বিলে একখানা এয়ারপোর্ট হতেই হবে, এট এনি কষ্ট্! মানি ইজ নো প্রবলেম.....
by--কাউসারআলম2020
সত্যি খুব দুঃখজনক।
আড়িয়ল বিল এ যাত্রা বেঁচে গেল। খবরে শুনলাম জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। -রু
নতুন মন্তব্য করুন