-এক থাপড়ে চোপা খুলে ফেলবো হারামজাদা বেয়াদ্দপ কুনহানকার!!!
-এক্ষন তোরে ঘাড় চাইপা ধইরা লাত্থি দিমু মাঙ্গের পো, তোর বাপের দিন্না আসমান পাইসস? যা সর সামনে থেক্যা!!!!
- যা ব্যাটা! আমি সরুম কা? তোর দরকার হইলে উপর দিয়া চইল্যা যা, নইলে নীচে দিয়া হান্দা, আমার এহানে প্যাসেঞ্জার নামবো.....
- ঐ.....তুই কি চউখের মাথা খাইছস? দেহস না জানোয়ারের সন্তান রেক্সিকার বাচ্চা পাছা বাইর কইরা কোনাকুনি খাড়ায়া আছে মাথার উপ্রে,
- হ হের লাইগ্যা বাহাদুরি না কইরা আমার লগে? পারলে রেক্সিকার পাইলটরে ক পাছা সরাইতে....
- হুরো ব্যাডা, মাতা ঠিক আছেনি, ওই হালায় বাম্পারে সিকিউরিটি পাংখা লাগাইছে। কাছে ঘেঁষতে গিয়া আমার গ্যাসের টাংকি ফুটা হয়া গেছিল হেইদিন
ফার্মগেটের আকাশে সন্ধ্যের মুখে মুখে এরকম হল্লা গালিগালাজ গুলো নিয়মিত।
সবগুলো টেপখাওয়া ভাঙাচোরা আকাশ টেম্পু এখানে ধাক্কাধাক্কি করছে। বিকেল পাঁচটা বাজে প্রায়। শীতকাল বলে সূর্য আগেই পাটে বসেছিল, এখন গোধুলি আলোয় এই আকাশযানগুলি নানান ফ্লোরের অফিস যাত্রীদের তোলার জন্য দেড়শো দুশো তলা দালানের ল্যান্ডিং স্টেশানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। এই দুটো আকাশ টেম্পু সবচেয়ে পুরোনো মডেলের। ২২৩০ সালের বাহন এই ২২৮০ সালে এসব একদম অচল, তবু তার মালিক বিদেশ থেকে পুরোনো মাল এনে জোড়াতালি দিয়ে কোনমতে আকাশ ট্রাফিকে যুক্ত করে দিয়েছে। তবে দিনের বেলা এরা চলতে পারে না যতক্ষণ ট্রাফিক ফ্লায়ারগুলো সচল থাকে। দশ বিশ হাজার টাকার দুয়েকটা নোট পকেটে গুঁজে দিলেও কাজ হয় না। তবে পাঁচটার পর থেকে ট্রাফিক ফ্লায়ারের ডিউটিতে ভাটা পড়ে। ওরা তখন চাকরী থেকে ব্যবসায়ে। সারাদিন এদিক সেদিক থেকে যা কামাই করে পাইলটদের কাছ থেকে, তা নিয়ে ভাগবাটোয়ারা শুরু করে তখন।
এই সুযোগে এই আকাশ টেম্পুগুলো যাত্রীর সন্ধানে নামে। কিন্তু এদের জন্য যন্ত্রনা হয়ে দাঁড়ায় দানাবাকৃতির রেক্সিকাগুলো। চার ইঞ্জিনের এই বিশাল উড়ান বাহনে প্রায় শখানেক লোক বসতে পারে কিন্তু দাঁড়িয়ে ঝুলে আরো অন্তত আড়াইশো। বিশ একুশ শতকের দিকে এরকম সাইজের আকাশযান দিয়ে দেশ বিদেশে মানুষ বহন করা হতো। তবে তখন ওগুলো অনেক উপরে উড়তো। এগুলো এত বড় যে রকম একটা দাঁড়ালে ল্যান্ডিং স্টেশানের পুরোটা দখল করে নেয়। ভাড়া বেশী হলেও নিরাপত্তার কারণে ওগুলোই পছন্দ দুরের যাত্রীদের।
ফলে আকাশ টেম্পুগুলোর তেমন বেইল নাই আজকাল। কেবল ফাঁক ফোকর দিয়ে প্যাসেঞ্জার ধরে। থাবড়া মারতে মারতে টেম্পুগুলোর বডি রং অনেক আগেই চলে গেছে, কোন মতে হুড়কা দিয়ে দরোজা বন্ধ করা যায়। জানালার গ্লাস একটাও অক্ষত নেই। এপার ওপার বাতাস হু হু করে। শীতে আর বর্ষায় বেশী কষ্ট। একটু উপরে উড়লে বর্ষাকালে ভেতরে মেঘ ঢুকে সব ভিজিয়ে দেয়। তাই সাবধানে নীচে নীচে চালাতে হয়। কিন্তু ২০০০ মিটারের নীচে নামতে পারে না, নামলেই জরিমানা। লাইসেন্স বাতিল।
বশিরের মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ।
মেহেরবানু গতকাল তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে নুবিদালীর সাথে। নুবিদালী তার টেম্পুর হেলপার ছিল বহুদিন। বিশ্বাসী লোক। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আশ্রয় দিয়েছিল তাকে। আপন ভাইয়ের মতো যত্নে রেখেছিল। মেহেরবানু বাপের বাড়ী গেলে সাথে দিয়েছে নুবিদালীকে। সেই নুবিদ্যা কখন যে তার কলিজার ধনে হাত দিয়ে বসে আছে সে কল্পনাই করেনি। রোজ কেয়ামতের নাকি আর বেশী বাকী নাই। বিশ পঞ্চাশ বছর পরে এই অঞ্চলটা পুরোপুরি পানি তলায় চলে যাবে। মানুষগুলো অবিশ্বাসী হয়ে গেছে আজকাল।
গালিগালাজ দেবার পর মনটা একটু যেন হালকা হলো। জীবনটা আর চলে না। একা থাকতে ইচ্ছা করে না এই পঞ্চাশ বছর বয়সে। শোনা যাচ্ছে তাদের টাওয়ার বস্তির দেড়শোতলা খুপড়িগুলো ভেঙ্গে দুই হাজার তলা দালান ওঠানো হবে। নীচের দিকে কেউ থাকতে চায়না। ভূমিতে মারাত্মক দুষন। মুষ্টিমেয় কৃষক ছাড়া আর কেউ নীচে থাকে না। সবার ঘরবাড়ী আকাশে। বড়লোকরা তো উপগ্রহ বানিয়ে বসবাস করে আজকাল। কেবল মধ্যবিত্তরাই এসব দুশো তলা দালানে আবাস গেড়ে আছে। কারণ তাদের স্যাটেলাইট বাড়ী করার মতো অর্থ নেই।
বশির ভাবলো টেম্পুটা জমা দিয়ে আজ বেরুতে হবে মেহেরবানুর খোজে। উনিশ বছরের সংসার তার। এক রাতে এভাবে হাপিস হয়ে যেতে পারে না। নুবিদালীর মতো অপদার্থ যুবকের সাথে পালিয়ে গিয়ে তার মান সম্মানের উপর বিরাট আঘাত দিয়েছে। বশির গতি বাড়িয়ে উড়াল দিল ফার্মগেট ছাড়িয়ে। ময়নামতিতে শেষ প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে ছুটে এসে সে কাঁচপুর সেতুর কাছটিতে এসে আকাশ টেম্পুটা জমা দিল সরফরাজের গ্যারেজে। কাঁচপুর সেতুটা স্মৃতি হিসেবে এখনো আছে কিন্তু ওটা দিয়ে কেউ পারপার করে না। নীচ দিয়ে যে নদীটা গেছে সেটি বিষাক্ত তরলে পরিপূর্ণ। ওখানে মশাও জন্মায় না এতটাই জঘন্য।
টট্টরে শব্দের ব্যক্তিগত জীর্ণ ফ্লায়ারটা নিয়ে বশির খানিক উড়ে গিয়ে বসলো জিসি টাওয়ারের ১৩৮ তলায় নেয়ামতের চা দোকানে। এই টাওয়ারটা বহু পুরোনো। পরিত্যক্ত হতে যাচ্ছে শীঘ্রি। এখানে যারা বাস করতো সবাই নদীভাঙা মানুষ। আশ্রয় নিয়েছিল সাময়িক। কিন্তু কদিন আগে এই টাওয়ারও ভেঙ্গে ফেলার নোটিশ এসেছে। এটি নাকি শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। ২১৭০ সালে বানানো। এখানে একটি দেড় হাজার তলার টাওয়ার তোলা হবে যাতে সংকুলান হবে কয়েক লাখ মানুষের। দশ কোটি মানুষের এই শহরে বসবাসের একটু খানি ফোকর বের করা কঠিন কাজ আজকাল।
নেয়ামতের চায়ের সাথে দুটো বিস্বাদ বিস্কুট খেয়ে একটা লাল ফিল্টারের সিগ্রেট ধরিয়ে রাতের তারা গোনার দিকে মন দিল সে। ভাবছে মেহেরবানু কোথায় যেতে পারে। সিটি কাউন্সিলে অভিযোগ করলে মুশকিল আছে, বিয়ের ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য রেজিস্ট্রি করেনি। জানতে পারলে সোজা জেলের ঘানি টানতে হবে। তার ১৯ বছরের সংসার অবৈধই বলা চলে আইনতঃ। আজ বউ হারিয়েও কাউকে অভিযোগ জানাতে পারছে না তাই।
টুলে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছে সে ধোঁয়ার টানে। লাল ফিল্টার বেচা বিক্রি অবৈধ, ভেতরে নেশার বড়ি দেয়া আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ধরার কে আছে? কয়েকটা সুখটান যাবার পর ভাসতে ভাসতে কার যেন ঠোঁটের একটা উষ্ণ স্পর্শ পেল কানের লতির ঠিক নীচে। কে? মেহেরবানু? না, এতো মেহেরবানু নয়। একটা হলুদিয়া পাখির মতো যে হাসছে তাকে গলা জড়িয়ে ধরে, তাকে আগে কখনো দেখেনি।
বাহ্ এই পাখিটা বড় চমৎকার তো! মেহেরবানু হারিয়ে গেলে কি আসে যায়, এটা তো মেহেরবানুর চেয়েও অনেক সুন্দর, আর মায়ামতী। কিন্তু কথাবার্তা ছাড়া তাকে হঠাৎ কোথ্থেকে এসে জড়িয়ে ধরে আদর করছে, এটা অবিশ্বাস্য লাগলেও খারাপ লাগলোনা একটুও। বরং মেহেরবানুর জন্য জমানো মনখারাপগুলো বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে শুরু করেছে। নুবিদালীর উপর বরাদ্দ আক্রোশটা খুনখারাবি থেকে নেমে এসে সামান্য কিল ঘুষিতে নির্ধারিত হলো।
পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস আনতে প্রেমের কোন বিকল্প নেই। এই অচেনা মেয়েটি তাকে সেই প্রেমের আকাশেই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বশিরের খুব ইচ্ছে হলো একে নিয়ে ফ্লায়ারের উপর বসিয়ে দক্ষিন দিকের কোন শহরে চলে যেতে যেখানে সাগর এসে মিশে গেছে বালুকাবেলায়। ভাবনা আসা মাত্রই মেয়েটার গালে একটা পাল্টা চুমু খেয়ে ফ্লায়ারের হেলমেটটা তুলে নিয়ে মাথায় পড়লো আর জড়িয়ে ধরলো হলুদিয়াকে।
চলো পাখি উড়ে যাই.....বুকে করে নিয়ে যাই...... ছন্দে ছন্দে দুলতে চাই........এরকম কাব্যমালা গাথাঁর মাঝেই হেলমেটের ফিতা ধরে কে যেন টান দিল পেছন থেকে আর সে ধপাস করে ফ্লায়ারের সীট থেকে পিছলে পড়ে গেল, পেছনে জড়িয়ে থাকা মেয়েটিও পিছলে যাচ্ছে। তাকে ধরার জন্য পেছন ফিরতে গিয়েই ঠক করে মাথাটা ঠোক্কর খেল একটা পিলারে। আর দেখলো ঠা ঠা করে আকাশ কাঁপিয়ে হাসছে নেয়ামত।
স্বপ্ন দেখছিল সে এতক্ষণ? এত সব আনন্দ এক ফুৎকারে কোথায় কোন নীহারিকায় উড়ে গেল। মেজাজ টাং করে উঠলো আবারো।
নাহ মেহেরবানুকে খুঁজে বের করতেই হবে। নুবিদালিকে করা একটু আগের ক্ষমাটা তুলে নিয়ে কিল ঘুষি থেকে আবারো খুন খারাবিতে ফিরে গেল বশির। ফ্লায়ারে ভটভট শব্দ তুলে উড়াল দিল দক্ষিণে।
মন্তব্য
ওরেব্বাপ!!!
ডুবে নাই তাহলে!!
মচৎকার!
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
পুরাই কোপজ।
মজা!
.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা
এতো দিনেও ঢাকার টেম্পো বেঁচে আছে! সত্যি, শরৎবাবু, আপনি অতুলনীয়!!
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
ভালো লাগলো পড়ে।
বাহ, কল্পনা তো চমৎকার পাখা মেলেছে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
২২৮০ সালেও টেম্পু দেখতে হলে তো সমস্যা। আমি স্বপ্ন দেখলে পোলাও কোর্মা-ই খাওয়ার পক্ষে তবে গল্পের গরুতো গাছে চড়তেই পারে।
কল্পকাহিনী এমনিতেই ভালো লাগে, আপনারটিও ব্যাতিক্রম নয়।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
কল্পকাহিনীর ঘটনাস্হল ঢাকা বলেই মজার ভাগটা পাতে একটু বেশিই পেলাম!
- আয়নামতি
শুরুটা দেখে তো ভয়-ই পেয়ে গেছলুম...
মোটের ওপর ভাল লেগেছে...
নতুন মন্তব্য করুন