কেউ কেউ চরম অপরিণামদর্শী। ভাগ্য নিয়ে কাবাডি খেলতে পারে কেউ কেউ। সদরুল বাশার ঠিক সেরকম না হলেও কাছাকাছি। কেরাণীহাট থেকে শহরমুখী কোষ্টার সার্ভিসে ওঠার সময় সদরুল বাশার তার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ভাসমান অমাবস্যাই দেখছিল। শহরে তার পরিচিত দুয়েকজন আছে ঠিকই, কিন্তু রাতে থাকার মতো কেউ ঘনিষ্ট কেউ নেই। দূর সম্পর্কের এক খালাতো ভাই আছে তার মেসে ওঠা যেতে পারে খুব দায়ে ঠেকলে। ঠেকায় সে ইতিমধ্যে পড়ে গেছে। বাবার সাথে তুমুল ঝগড়া করে বেরিয়ে এসেছে ঘর ছেড়ে।
মেট্রিক পাশ করে সে তিন বছর ধরে পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিদেশ যাবার নাম করে। পড়াশোনা করে দুই পয়সার মাষ্টার/কেরাণী হতে চায় না সে। বরং পড়াশোনা না করেও পাশের গ্রামের হাড়ি ডোমের ছেলেপেলেরাও বিদেশ ঘুরে এসে গ্রামে পাকা দালান তুলেছে সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বাপকে নিবৃত করে রেখেছিল তাকে পড়াশোনার চাপ দেয়া থেকে। কিন্তু তিন বছরেও বিদেশে যাবার কোন রকম ব্যবস্থা করতে না পারার ফলে বাপ তাকে আবারো কলেজে ভর্তি হবার জন্য চাপ দিতেই মাথাটা গরম হয়ে যায়। শুধু কলেজে ভর্তি হবার চাপ দিলে এতটা আগুন জ্বলতো না।
জ্বলেছে ‘বসে বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করবি আর কদিন, এবার নিজের কামাই খা!’, এই বাক্যটা শুনে। এটা কোনমতেই হজম করতে পারলো না সে।
আসার আগে গরমে গরম বলে এসেছে বাপকে, 'তোমার অন্ন তুমি পিঠা বানিয়ে খাও। আমি শহরে গিয়ে আমার নিজের অন্নের সংস্থান করবো'।
জেদের বশে বলা কথাটা কত ভুল কাজ হয়েছে সেটা বহদ্দারহাট নেমেই পকেটমারের কাছে সব কিছু হারিয়ে টের পেল। কিন্তু বাশার অত সহজে ভাঙ্গে না। জেদ সে রাখবেই। মরে গেলেও বাড়ী ফিরবে না। হেঁটে হেঁটে সেই খালাতো ভাইয়ের মেসে গেল। থাকার ব্যবস্থাটা ওখানেই হয়ে গেল। একটা কাজ দরকার বললো সে।
কিন্তু শিক্ষা দীক্ষা নাই, তাকে কি চাকরী দেবে? চিন্তায় পড়লো খালাতো ভাই। আপাততঃ তাকে একটা বেকারীতে লাগিয়ে দিল সেলসম্যান হিসাবে। একবেলা খাওয়া ফ্রী। বেতন চারশো টাকা। কিন্তু কয়েকমাস যাবার পর চাকরীতে মন উঠে গেল। ব্যবসা করতে মন চাইল। এমনকি একটা পানের দোকান। ভাইকে উদ্দেশ্যটা বলাতে ধমক খেল- 'বিদ্যাবুদ্ধিপুঁজি এইসব যার নাই তার জন্য ব্যবসা নাই।'
খালাতো ভাইয়ের কথা শুনে নিরাশ হলেও হাল ছেড়ে দিল না বাশার। একদিন পরিচয় হলো পুরোনো বইখাতার ফেরিঅলা বুড়ো নজির মিয়ার সাথে। লোকটা পাড়ায় ঘুরে ঘুরে শিশিবোতল থেকে পুরোনো বই, ডেকচি পাতিল সব কেনে, কিনে বিক্রি করে বাংলাবাজারের এক বড় দোকানে।
নজির মিয়া অনেক বছর এই কাজে। বাশারকে কথায় কথায় বললো কোন কোন দিন তার দৈনিক লাভ পঞ্চাশ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। পঞ্চাশ টাকা!! গুন করে দেখলো মাসে দেড় হাজার। গুল্লি মারি বেকারীর চাকরামি। দেখে শুনে নজির মিয়ার সাথে খাতির করে বাশারও লেগে গেল সেই ব্যবসায়।
বিদ্যার জোর কম হলেও বুদ্ধির কোন ঘাটতি ছিল না মাথায়। রেলওয়ের পরিত্যক্ত জায়গায় নিজেরই একটা ভাঙারির দোকান গড়ে উঠলো কিছুদিনের মধ্যেই। খালাতো ভাইকে ছেড়ে আলাদা মেসে বাসা নিল।
দিন যেতে থাকলে শিশিবোতলের পাশাপাশি মাঝে মধ্যে জাহাজের পুরোনো মালামালও আসতে থাকে। আস্তে আস্তে শিশিবোতলের জায়গাটা সম্পূর্ণভাবে দখল করে পুরোনো স্ক্র্যাপ জাহাজের নানান মালামাল।
জাহাজের স্ক্র্যাপ মালামাল কেনাবেচা করতে গিয়ে একদিন জাহাজ কোম্পানীর একজনের সাথে পরিচয় ঘটে যায়। বেসরকারী জাহাজের পারচেজ অফিসার কবির সাহেবের সাথে পরিচয়টা তার জীবনের অতীতের সকল আদম সুরত পাল্টে দেয়। জাহাজে স্টেশনারী সরবরাহের কাজ দিয়ে শুরু করে কয়েক বছরের মধ্যে ট্যাংকারে তেল সরবরাহের কাজে এসে স্থিত হয় বাশার।
তেল সরবরাহ করার এই মজার ব্যবসাটা সাধারণ মানুষের একদম অগোচরে। একটা জাহাজে কতো পরিমান তেল লাগে, কত পরিমান তেলের টেন্ডার হয়, কতো পরিমান তেল ভরা হয়, এই বিষয়গুলো যারা জানে জাহাজ কোম্পানীর সেই বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে আগ্রাবাদ হোটেলে নিয়মিত কয়েকটা বৈঠক হবার পর বাশারের নিয়মিত বার্ষিক আয় কোটি টাকা পেরিয়ে যায়। গুনিতক হারে এই অংকটা বেড়ে পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে তাকে ঈর্ষনীয় অবস্থানে নিয়ে যায়। তবু থামে না বাশারের অগ্রগতি। কোন পত্রিকায় তার নাম উঠে না, কোন মিডিয়া তাকে চেনে না, কিন্তু নগদ টাকা লেনদেনকারী সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জানে বাশারের টাকার ক্ষমতা।
বাশারকে আড়ালে সবাই 'তেলচোর' বললেও তাকে বাদ দিয়ে জাহাজ সংক্রান্ত কোন লেনদেন এই শহরে হয় না।
টাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতাটা যে কতো জরুরী সেটা জেনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ কিনে নেয় বাশার। সেই সদস্য পদের অভিষেকটাও হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাবান জ্যৈষ্ঠ সন্তানের চট্টগ্রাম সফর কালে। নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করে যুবরাজ সদলে তার মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টারে নিমন্ত্রন গ্রহন করলে নগরবাসী আরেকদফা টের পায় বাশারের ক্ষমতার সুতো কতদূরে পৌঁছে গেছে।
দেশের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হতেও সমস্যা হয় না আর। শোনা যায় বাংলাদেশের প্রধান দুটি শহরে তার ১২৮টির মতো বাড়ি আছে। যার সবগুলো সে নিজের চোখেও দেখেন নি। এত বেশী বাড়ীর মালিক বাংলাদেশে আর কেউ আছে কিনা জানা নেই। তবে তার নিজের আবাসটি নগরীর যে অভিজাত পাড়ায়, সেখানকার কেউ এর আগে এত বিলাসবহুল প্রাসাদ দেখে নাই। বাশার এখন এই শহরের অন্যতম ধনী ব্যক্তিত্ব।
সেদিন নগরীর একটা সাংবাদিক সংগঠন কক্সবাজার গেছে পিকনিকে। অফ সিজন বলে ৫০% ডিসকাউন্টে একটা বিলাসবহুল হোটেল পাওয়া গেল। সবগুলো রুম বুক করা হলো হোটেলের। বাংলাদেশে কক্সবাজারের মতো জায়গায় এত আরাম আয়েশের হোটেল আছে দেখে অনেকের চোখ কপালে উঠলো। দুপুরে লাঞ্চের সময় ডাইনিং হলে আরো একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।
সংগঠনের একজন নবীন দাতা সদস্য সম্মানিত সকল সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু মার্জিত বক্তব্যে বিনয়ী কন্ঠে জানালেন তিনি স্বয়ং এই হোটেলের মালিক। আজ এতজন সাংবাদিককে তার হোটেলে একসাথে পেয়ে তিনি অত্যন্ত গর্বিত। তাদের সেবা করতে পেরে সম্মানিত। এই বিশেষ দিনকে মনে রাখার জন্য এই সংগঠনের সকল সাংবাদিকদের জন্য দুদিনের সকল থাকা খাওয়া সহ হোটেলের সমস্ত সেবা ফ্রী ঘোষনা করলেন। এই শেষ নয়, বছরের যে কোন দিনে এই সংগঠনের যে কোন সদস্য বিনামূল্যে তার হোটেলের সেবা গ্রহন করতে পারবেন।
প্রবল অবিশ্বাস, বিস্ময় ও করতালির সাথে এই মহান ঘোষনা শেষ হলে হলজুড়ে ফিসফিসানি। গতকাল থেকে এত বড় মানী লোক তাদের খাওয়ার তদারকি করছে টেবিলে টেবিলে এসে। কেউ তাকে চেনে নাই। সংগঠনের দাতা সদস্যের সাথে বেশীর ভাগের আলাপ পরিচয় নেই। এনাকেও চিনেনি কেউ। তাই সবাই জানতে চাইল কে এই মহীরূহ? কার এমন দয়ার সাগর? মহান ব্যক্তির নাম কি?
ওই ফিসফিসানির অনুনাদের ভেতরই হলঘরের সবার জানা হয়ে গেল ইনিই নগরীর নব্য ধনী যাদুর কাঠির মালিক সদরুল বাশার।
নগর প্রশাসন আর রাজনীতিবিদ আগেই কেনা হয়ে গিয়েছিল তার। মাত্র কটা সাংবাদিক কেনা বাকী ছিল। এবার সেটাও সুসম্পন্ন হলো।
মন্তব্য
প্রথমে ধরতে পারিনি কোন দিকে যাচ্ছেন।
সেইরকম একটা প্লট!
প্লটের সমাপনীটা পূর্বনির্ধারিতই ছিল, কিন্তু সূচনাটা দূরূহ ছিল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
গল্প পড়ার জন্য
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
দ্রুত ধনী হবার প্রক্রিয়াটি কম বেশি এমনই অপরাধময়! গল্পে ।
বিশ্বাসযোগ্য একটি গল্প।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এটি কী সত্যি ঘটনা? বাস্তবেও কত সদরুল পাশা যে আছেন বাংলাদেশে! ব্লগরব্লগর (গুড়) হয়েছে।
সত্যের মতোই প্রায়
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
সদরুল বাশার তো দেখছি জটিল মাল।
লেখা চমৎকার হয়েছে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
জটিলতর। পড়ার জন্য ধন্যবাদ!!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চেনা গল্প তবে পরিবেশন ভালো হয়েছে ।
চেনাগল্প?
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নীড়দা' আপনার এই রকম কয়েকটা গল্প, যেগুলো পড়তে পেয়েছি, সেগুলোকে জোড়া লাগালে কিন্তু একটা দারুণ উপন্যাস হয়ে যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার মতো শব্দের ঝুড়ি আর গল্পের হাত থাকলে কবেই লিখে ফেলতাম
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
গল্পটা ভাল লাগল।
সেইরকম চাঁটগাইয়া সওদাগরের কাহিনী হইসে!!!......বেশি ভাল লাগসে কেরানিহাট,বহদ্দারহাট,বাংলাবাজার এই জায়গাগুলোর নাম উঠে আসায়। এরকম আর লেখা আসুক নিয়মিত...শুভেচ্ছা রইল
গল্পে
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন