বড় হইতে হইলে হয় অতীত ভুলিয়া গিয়া নবজীবন লাভ করিতে হয়, নতুবা অতীতের পশ্চাদদেশে পদাঘাত করিয়া সম্মুখে আগাইয়া যাইতে হয়। আমি দ্বিতীয়টা বাছিয়া লইয়াছিলাম। ফলাফল- ছিলাম নৌকার মাঝি, হইয়া পড়িলাম জাহাজের সারেং। পুরাতন মাঝিমাল্লা বন্ধুদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করিয়া নতুন জীবনের স্বাদ লইতে লইতে নিজের নাম আর বাপের নাম বাদে বাকী সব ভুলিয়া গেলাম। আমার এখন নিত্য ওঠাবসা জাহাজওয়ালাদের সাথে।
এই ক্ষণে ঘনিষ্ট এক মাঝিবন্ধু গতকল্য রাত্তিরে টেলিফোন করতঃ কর্নকূহরে কটুবাক্য প্রবেশপূর্বক জানাইলো যে জন্মদিনের শুভেচ্ছার জবাব না দেবার মতো অভদ্র কোন দিবস হইতে হইলাম। ঈষৎ লজ্জিত হইয়া ভুলবাক্য ব্যয়ে কি বলিয়াছিলাম মনে পড়ে না। তবু তাহাকে ও সকল মাঝি মাল্লা বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনপূর্বক একটি দুঃসাহসী রচনা লিখিবার সিদ্ধান্ত নেই।
যদিও এটি নেহায়েত সামান্য ব্যক্তিগত ঘটনা তবু উল্লেখ করিতেছি। কারণ কবি বলিয়াছেন,
"রাখিও না বেশীদিন গোপন কথা পেটের ভিতরে,
গ্যাষ্ট্রিক ব্যামোতে নাড়িভুড়ি হজম হইয়া যাইতে পারে"।
ঘটনাটি জন্মদিনের আগের রাতের। আগামীকল্য একটি বিশেষ দিবস সেই আনন্দে ৩ তারিখ রাত্রিতে নিদ্রাযাপনেরর প্রস্তুতি নিতেছিলাম। অকস্ম্যাৎ খেয়াল হইল যে কথকযন্ত্রটির দম ফুরাইয়া আসিয়াছে, আগামীকল্য বৈদ্যুতিক শুভেচ্ছাদি গ্রহন করিবার মতো শক্তি তাহার আর অবশিষ্ট নাই। জ্ঞাত কারণে কথক যন্ত্রখানাকে বৈদ্যুতিক সংযোগে যুক্ত করিবার পূর্বে রুদ্ধ বোতাম চাপিয়া নিদ্রার কোলে পাঠাইয়া দিলাম । তাহার পর নিজেও কখন যে নিদ্রার কোলে ঢলিয়া পড়িলাম বলিতে পারিব না।
প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গ হইবার পর দেওয়াল ঘটিকার দিকে নজর পড়িতেই হা-রে-রে-রে করিয়া উঠিলাম। মহা বিলম্ব ঘটিয়াছে। অফিসের গাড়ি নিশ্চয়ই এতক্ষণে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে । নিদ্রাপোষাক ছাড়িয়া জামাজুতা পরিধান করিতে যে সময় ব্যয়িত হইবে সেই সময়ের মধ্যে গাড়িখানা অফিসের দিকে অর্ধেক অগ্রসর হইয়া যাইবে। উপায়ান্তর না দেখিয়া দ্রুতহাতে কথকযন্ত্রটি হস্তগত করিয়া গাড়িতে অপেক্ষমান সহকর্মীদের বার্তা পাঠাইয়া বলিলাম, 'শরীরখানা বিশেষ ভালো লাগিতেছে না, আমার জাগ্রত হইতে দেরী হইবে, তোমরা আমাকে রাখিয়াই চলিয়া যাও আজকে।' এতটা সত্যভাষী সচরাচর মিলিবে না এই ঘোর কলিকালে।
উহারা চলিয়া গেলে আরেক দফা নিদ্রাগমন করিবার পূর্বে ভাবিতে বসিলাম- বিলম্বে নিদ্রাভঙ্গের হেতু কি?
'হাঁদারাম!' মনে মনে তিরস্কার করিলাম নিজেকে। খেয়াল হইলো যে আমার দুই দুইটি এলার্মের একটিও আজ প্রত্যুষে বাজে নাই। মোবাইল এলার্ম বাজে নাই উহাকে দম দেবার কালে নিদ্রার কোলে পাঠাইয়া ছিলাম বলে। তাহার দোষ নাই।
দ্বিতীয় এলার্ম আমার প্রাণাধিকা প্রিয় স্ত্রী যিনি পিত্রালয়ে গমন করিয়াছেন গতকাল দুপুরেই (যিনি স্বয়ং আমার মোবাইল এলার্মের শব্দে প্রত্যহ ভোরে জাগিয়া উঠেন এবং প্রাত্যকর্ম সম্পাদন করতঃ রান্নাঘর অভিমূখে রওনা দিবার প্রাক্কলে আমার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি বরাবর হেঁচকা টান মারিয়া 'টেবিলে নাস্তা তৈরী' জাতীয় একখনা নিখাদ মিথ্যা রেকর্ড বাজাইয়া দেন। অপ্রিয় সত্য হইলো, এই দ্বিতীয় এলার্মের শব্দটাই আমার নিদ্রার অবসান ঘটায় প্রতিদিন।) স্ত্রী পিত্রালয়ে অবকাশ যাপনকালীন অনাহারে না থাকিলেও সংসারের সমস্ত দায়িত্ব ভুলিয়া স্বাধীনতার সুফল অনুভব করি তাহাতে কোন সন্দেহ নেই। আমিও করিতেছিলাম।
যাই হোক, দ্বিতীয় দফায় নিদ্রাদেবী আমাকে আহবান করিতেছিল এমন সময় কথক যন্ত্রটি আচমকা চিৎকার করিয়া জানান দিল স্ত্রী পিত্রালয় হইতে আমার সন্ধান করিতেছে।
আমি সুললিত স্বরে 'হ্যালো' বলিতে না বলিতেই তীব্র ঝাঁজালো আক্রমনে কর্নদেশ শতছিদ্র হইয়া যাইবার দশা। কারণ সেই কন্ঠটি বজ্রনিনাদে জানান দিল, "মিনসে তুমি গতকল্য রাত্রি হইতে কথক যন্ত্রটি বন্ধ করিয়া স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করিতেছ? সারাটি রাত্রি ব্যাপিয়া তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাইবার জন্য খুঁজিয়া মরিতেছি আর তুমি কোন বান্ধবীর কোলে স্বর্গসুখের সন্ধান করিতেছিলে.........." এরকম আরো বহুবিধ অশ্রাব্য বাক্যসমূহ ঝড়ের বেগে নির্গত হইতেছিল।
শুনিয়া আমার কন্ঠনালী শুকাইয়া কাষ্ঠ হইয়া গেলে আলজিবের মাধ্যমে মৃদু প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিলাম, "আমার স্বাধীন সময়ে আমি যাহা ইচ্ছা করিবার অধিকার রাখি।"
তীব্র কন্ঠটি আমাকে নাকচ করিয়া আবারো গর্জিয়া উঠল, "তোমাকে স্বাধীনতা দিয়াছি, কিন্তু তোমার কথকযন্ত্রের স্বাধীনতা দেয়া হয় নাই। উহাকে রুদ্ধ করিবার সাহস কে দিয়াছে তোমাকে?"
বুঝিলাম ভারী অন্যায় হইয়াছে। ভুলিয়া গিয়াছিলাম কথক যন্ত্রের স্বাধীনতার ভার আমাদের হাতে নেই উহাদের জন্য কথকেশ্বর নিয়োজিত আছেন উর্ধাকাশে। আপোষ করিবার উপায় যোগাড় করিতে ব্যস্ত হইয়া গেলাম শীঘ্রই।
...................কিভাবে আপোষ করিলাম জিজ্ঞাসা করিয়া বিব্রত করিবেন না, শুধু এইটুকু বলি, সন্ধ্যাবেলা সস্ত্রীক সানন্দা জুয়েলার্সে গিয়া গয়নাগাটির দরদাম দেখিয়া টের পাইতে বিলম্ব হইল না পঞ্চম দশকে পদার্পন সহজ কার্য হইলেও তাহা ভুলিয়া যাওয়ার খেসারত মোটেও সহজকর্ম নহে।
মন্তব্য
আপনার জন্মদিনে ভাবী বাপের বাড়ী কেন? তীব্র প্রতিবাদ। লেখা ভাল হয়েছে।
"কথকেশ্বর" শব্দটা দারুন হয়েছে। আর পুরো গল্প অতি
শেষ লাইনটা দুর্দান্ত---
কথকযন্ত্রের প্রতি আমাদিগের সমবেদনা জানাইবেন! একটুখানি ঘুমাইবার স্বাধীনতা তাঁহার নাই, কথকেশ্বরী তাঁহাকে প্রয়ান করেন নাই, তাঁহার প্রতি সমবেদনা না জাগিয়া কাহার প্রতি জাগিবে!
ধরাগমন দিবস পালনকালে স্বাধীনরূপে দিনানিপাত করিতে পারিয়াছেন, ইহা আপনার সৌভাগ্য। এইরূপ ভাগ্য আপানার জীবনে পূণঃ পূণঃ ফিরিয়া আসুক, ইহাই শুভকামনা!
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
) জন্মদিনের শুভেচ্ছা ।
বড়ই সত্যভাষণ।
চাপাবাজি ট্যাগ পছন্দ হইসে
..................................................................
#Banshibir.
বাডডের শুভকামনা রৈলো।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
এককথায় চমৎকার । পোস্টে
ডাকঘর | ছবিঘর
পাঁচতারা লেখা।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
নতুন মন্তব্য করুন