রাবেয়া আখতারঃ
গার্মেন্টসের চাকরীটা চলে গেছে গতমাসে। জমানো টাকা প্রায় শেষ। নতুন এক জায়গায় চেষ্টা করছিল কদিন ধরে। আজকে যোগ দেবার কথা। ৩ বছরের ছোট ছেলেটাকে পাশের ঘরে রেখে বেরিয়েছিল। মাঝপথে বাসটা হঠাৎ চাকায় তীব্র আর্তনাদ করে থেমে গেল। বাসের উপর একের পর এক ইট এসে পড়তে লাগলো। যাত্রীরা আতংকিত। প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। চালক জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়েছে। বাসের সবগুলো জানালা ভেঙ্গে ফেলেছে। ইটের আঘাতে বেশ কজন আহত। পেছনের জানালা ভেদ করে এটা ইটের টুকরো তার মাথায়ও এসে পড়লো। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। বাসের মধ্যে আগুন দেখা গেল। কোনমতে লাফ দিয়ে পড়লো বাস থেকে। ফাটা মাথা নিয়ে আধখানা জীবন নিয়ে দৌড়ে পাশের ফুটপাতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আর কিছু মনে নেই। রাবেয়ার ফাটা কপাল জোড়া লাগতে মাস খানেক লেগেছে। আসলে জোড়া লাগেনি। স্বামী পরিবার সহায়সম্বলহীন রাবেয়ার চাকরীটা পাওয়া হয়নি। মাথার চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমানো টাকা শেষ। ছেলেটার জন্য দুধ কেনা হয়নি এই এক মাস, আর কখনো কেনা হবে কিনা জানে না সে। জমানো টাকা শেষ হয়ে কর্জের শুরু। এরপর ভিক্ষা করতে হবে, নইলে শরীর বেচতে হবে। কোনটা সহজ রাবেয়া এখনো জানে না।
আলেয়া বেগমঃ
মা খুব অসুস্থ। সরকারী হাসপাতালে ভর্তি আছে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছে সেটা নাকি কলাবাগান লাজ ফার্মা ছাড়া কোথাও নাই। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ওষুধটা না দিলে মারাত্মক কিছু হয়ে যাবে। সে হাসপাতাল থেকে দ্রুত বেরিয়ে বাসে উঠে পড়েছিল। গাড়ির সামনের দিকে বসেছিল। হঠাৎ আক্রমনের মুখে পড়ে বাস। ইটের প্রথম আঘাতটা তার জানালাতেই পড়ে। ইট পাশ কেটে ড্রাইভারের দিকে চলে গেলেও, ভাঙ্গা কাঁচের খোঁচা লেগে হাতের চেটো কেটে গেছে। আরো ইট আসতে থাকায় সে প্রাণপনে লাফ দিয়ে পড়েছে গাড়ি থেকে। ছুটে ফুটপাতের দিকে যেতে না যেতেই দেখলো আগুন জ্বলছে বাসে। মায়ের ওষুধ কেনার কথা ভুলে গেল কিছুক্ষণের জন্য।
সুফিয়া খাতুনঃ
বোনের বাচ্চা হয়েছে গতরাতে। সিজারের বাচ্চা। ভগ্নিপতি সারারাত হাসপাতালে ছিল। সকাল থেকে ওকে ডিউটি দিতে বলেছিল। তাই সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাঝপথেই আক্রান্ত হলো বাস। ভাগ্যকন্যা সে, নামতে গিয়ে ধাক্কার আঘাত ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। মীরপুর যাবার উপায় উপায় খুঁজতে থাকলো আতংকিত হয়ে।
জয়নাল আবেদিনঃ
দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আগেও কয়েকবার এসেছে সে। নানান কাজের ধান্ধায় ঘুরেছে এদিক সেদিক। এখানে থাকার কোন জায়গা নাই তার। পরিচিত দুয়েকজন আছে তাদের ঘরে কোনমতে মাথা গুঁজে। ঢাকা এত বড় শহর যে রাস্তায় বেরুলেই ভয় করে। হারিয়ে যাবার ভয়। প্রতিবার আসলে রাস্তাগুলো অচেনা লাগে। এত মানুষ চারদিকে। যেখানেই যায় সেখানেই মানুষের ভীড়। এই শহরে কোন খালি জায়গা দেখেনি সে। রাস্তায়, গাড়িতে, ফুটপাতে, মার্কেটে, সবখানেই গিজগিজ করছে অসংখ্য মানুষ। আজকে মানুষ কম ছিল বলে বাসটা দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে উঠে গিয়েছিল। হাতের মুঠোয় ধরা ছিল দুটো নোট, একশো আর দশ টাকার নোট। লুঙ্গির উপর শার্ট পরা থাকলেও শার্টের পকেটে টাকা রাখে না পকেটমারের ভয়ে। বাসের রড ধরে দাঁড়িয়েছিল, বাসটা ছুটতে ছুটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। আচমকা বাসের গায়ে এসে পড়তে লাগলো আধলা ইট, আস্ত ইট। মুহুর্তে কেয়ামতের চিৎকার। লোকজন সবাই যে যেদিকে পারলো হুড়মুড় করে নামতে শুরু করলো। সে বুঝতে পারলো না কি ঘটছে। কিন্তু পাগলের মতো সেও জানালার ফাঁক দিয়ে লাফ দিতে গিয়ে কাঁচের আঘাতে হাত কেটে ফেললো। কাটা হাত নিয়েই ছুট দিল অন্ধের মতো। পেছনে তাকাবার সাহসও করলো না। অনেকদূর যাওয়ার পর ফিরে দেখলো বাসটিতে আগুন জ্বলছে। বেঁচে গেছে সে। কাটা হাতের দিকে তাকিয়েও খারাপ লাগছে না তাই। তবে ভয় পেয়েছে সে ভীষণ। নাহ এই শহরে থাকা যাবে না। কাজও পাওয়া গেল না। গ্রামে ফিরে যাবে আজই। শহরের কাজের গুষ্টি মারি। কোনদিকে যাবে রাস্তা খুঁজতে গিয়ে খেয়াল হলো হাতটা খালি। টাকাগুলো কোথায় পড়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। এখন তার বাড়ি ফেরার কি হবে? এই জায়গা থেকে বাস টার্মিনাল যাবার উপায় কি? মাথা ঘুরে উঠলো তার। খিদায় দুশ্চিন্তায়।
রফিকুল ইসলামঃ
অবসর গ্রহনের দশ বছরের মধ্যে শরীরের অসুখবিসুখ চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে। ডেমরায় এক কবিরাজের কাছ থেকে ওষুধ আনতে যাচ্ছিলেন তিনি। খালি বাস পেয়ে উঠে বসেছিলেন। ঢাকা শহরে মাঝপথে সিট পাওয়া সাত আসমানের ভাগ্য। গন্তব্য অনেক দূর, ভাগ্য লুফে নিয়ে তিনি চোখ মুদে বসে থাকলেন সীটে। এটা তার অফিস জীবনের অভ্যেস। বাসে সিট পাওয়া যেতো তখন। উঠেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কখনো কখনো গন্তব্য পার হয়ে যেত। তখন ফিরতি বাস ধরতে হতো। এখনো অভ্যেসটা আছে। হঠাৎ কি হলো বুঝলেন না। গাড়ির কাঁচ ভাঙতে শুরু করলো ঝনঝন করে। বাসে কেউ আক্রমন করেছে। আজ তো হরতাল না, এমন হচ্ছে কেন। ভাবনার অবকাশ পেলেন না, একটা ইট তাঁর পাশের জানালায় এসে পড়লো, কাঁচ ভেঙ্গে ইটের টুকরোটা সরাসরি আঘাত হানলো ঘাড়ে। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কোন এক সহযাত্রী তাকে টান মেরে বাস থেকে নামিয়ে আনলো। টেনে হিচড়ে রাস্তার একপাশে ছুড়ে ফেললো। চশমা খুলে পড়ে গেছে, চোখের সামনের দুনিয়াটা ঝাপসা লাগছে। চশমা ছাড়া অচল মানুষ তিনি। যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বুঝতে পারলেন বাসটিতে আগুন জ্বলছে।
এতক্ষণ যাদের কথা শুনলেন এরা সবাই যাত্রাবাড়ি পরিবহনের যাত্রী। গাড়িটায় আরো বেশ কিছু যাত্রী অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছে। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গল্প আছে। সবার কথা বলার মতো জায়গা এখানে হবে না।
আমরা বরং এবার যাত্রাবাড়ি পরিবহনের মালিক আবদুল আলীর গল্পটা শুনিঃ
বাসটিতে যাত্রী খুব বেশী ছিল না। আজকাল রাস্তাঘাটে বের হতে ভয় পায় লোকজন। কখন কি শুরু হয় কেউ জানে না। যেখানে সেখানে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ। কোন পূর্বঘোষিত কর্মসূচী ছাড়াই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সারপ্রাইজ নাশকতা সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে জামাত শিবির। বড় দল বলে পরিচিত বিএনপিও ছোটভাই জামাতের পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। নাশকতায় বিএনপির পারদর্শীতা নাই জামাতের মতো। তবু সে প্রাণপন চেষ্টা করে যায়। অন্ততঃ রানার্স আপ তো হতে হবে। এসব আশংকা সত্ত্বেও রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে না।
আগামী তিনদিন হরতাল। আজকে যদি কিছু কামিয়ে নেয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে বের হবার অনুমতি দিয়েছিল যাত্রাবাড়ি পরিবহনের মালিক আবদুল আলী। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই পুরোনো বাসটা কিনেছিল সাড়ে এগারো লাখ টাকায়। যার মধ্যে ব্যাংকের ঋন সাত লাখ টাকা। সেই সাত লাখের মধ্যে এখনো তিন লাখ টাকা বাকী। মাসে যত আয় হয় তার অধিকাংশ চলে যায় ব্যাংকের কিস্তি দিতে। দৈনিক আয়ের অর্ধেকটা স্টাফের বেতন ভাতায় চলে যায়। গাড়ির পার্টস বদলানো মেরামত ইত্যাদি খাতে প্রতিমাসেই ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আলগা খরচ লাগে।
সুতরাং এইসব খরচ বাদ দিয়ে গাড়ি থেকে যে আয়টা আসে তাতে পাঁচজনের পরিবারটা খুব কষ্ট করে চলে। কোন কোন মাসে চলে না। ধারকর্জ করে চালাতে হয়। পরিশোধ করা হয়নি তেমন ধারের পরিমান বাড়ছে প্রতি মাসেই। বউ কয়েকবার বলছে এই গাড়িটার খোরাক যোগাতেই সব টাকা শেষ। গাড়িটা বিক্রি করে দাও। কিন্তু আবদুল আলী গাড়িটা বিক্রি করতে রাজী হয়নি। তার বিশ্বাস আল্লাহ একদিন সুদিন দেবেই। গেলবার ধানের শীষ হেরে যাওয়াতে খুব আফসোস লেগেছিল। লোকে বলে জামাতের সাথে জোট করার জন্যই ভরাডুবি হলো। তবে এবারের খেলা বুঝতে পারছে না আবদুল আলী। গতবার ধানের শীষের পিছনে ঘুরেছে পাল্লা, এবার পাল্লা আগে ধানের শীষ পিছে। ব্যাপারটায় তার বিরক্ত লাগছে। অস্বস্তি লাগছে। দাড়িপাল্লার লোক আল্লার কথা বললেও সে জানে এরা একাত্তরে কি করেছে ধর্মের নামে। তবু নৌকার উপর বিরক্ত হয়ে ধানের শীষেই ভোট দেবে এবারও। নৌকার সরকার ডুবোডুবো প্রায়। দুপুরে খেতে বসে মাছের বাটি থেকে ঝোল নিতে নিতে ভাবছিল বেশীদিন নাই আর, মাত্র এক বছর পরেই দিন বদল শুরু হবে।
কিন্তু এক বছর লাগলো না। আবদুল আলীর দিনটা দশ মিনিটের সামান্য এক ঝড়েই বদলে গেল। সোমবার দুপুরবেলা ড্রাইভার শুক্কুর মিয়া ফোন করে জানালো তার গাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছে জামাত-শিবিরের ঝটিকা কর্মীরা। আবদুল আলী স্তব্ধ হয়ে গেল শুনে। তারপর মাছের ঝোল মাখানো গরম ভাত ফেলে উঠে গেল মনে মনে 'কুত্তার বাচ্চা' 'শুয়োরের বাচ্চা' 'খানকি রাজাকারের বাচ্চা' গালি দিতে দিতে। আগামী এক বছর টিকে থাকার মতো আর কোন সম্বল রইলো না তার। কোন শুয়োরের বাচ্চা এখন তার পাশে এসে দাঁড়াবে না।
==================
এটি সম্ভবতঃ বাংলাদেশে গত এক মাসে ঘটা কয়েকশো নাশকতার সবচেয়ে কম সহিংস ঘটনা। এখানে মাত্র একটা বাস পুড়েছে, কয়েকজনের মাথা ফেটেছে, মালিক সহ কয়েক যাত্রীর কপাল পুড়েছে। সর্বমোট আর্থিক ক্ষতির পরিমান দশ লাখের বেশী হবে না। এখানে কোন মানুষ খুন হয়নি, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়নি কাউকে, কুপিয়ে ফালা ফালা করা হয়নি কারো মুখমণ্ডল। ভাগ্যবান যাত্রীরা পোড়া কয়লা হবার আগেই বাস থেকে নেমে যেতে পেরেছিল। উত্তরার সেই ব্যাংক অফিসারের কথা মনে আছে? ভুলে গেছেন বলে দোষ দেবো না, ওটাকে ভুলিয়ে দিয়েছে আরো আরো অনেক ভয়াবহ ঠাণ্ডা মাথার নাশকতা। বাঁশখালী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালি, গাইবান্ধা কিংবা সাতকানিয়ার ঘটনা লেখার মতো শক্তিশালী কলম নেই আমার। তাই লিখছি না। আর কেউ লিখুক। আমি শুধু বলি, বাংলাদেশ পুড়ছে। যারা পোড়াচ্ছে তারা বাংলাদেশকে নিজের দেশ মনে করে না। অবশ্যই মনে করে না। নইলে ভয়াবহ বিদ্যুত সংকটে পতিত একটা দরিদ্র দেশের বিদ্যুত কেন্দ্র পুড়িয়ে দেবার মতো ঘটনা কোন মানুষ ঘটাতে পারে না। চল্লিশ হাজার মানুষ অন্ধকারে দিন কাটাবে আরো বহুদিন।
এভাবে সমগ্র বাংলাদেশকে যারা আরো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিংবা ঠেলে দেবার পরিকল্পনা করছে তাদেরকে ভালোবাসবে বাংলাদেশের মানুষ? সেই সব অন্ধকারের জীবদের যারা বুকে করে প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদেরকে ভালোবাসবে বাংলাদেশের মানুষ? জিজ্ঞেস করুন আবদুল আলী কিংবা রাবেয়া, আলেয়া, সুফিয়া, জয়নাল আর রফিকুল ইসলামকে। জিজ্ঞেস করুন আতংকিত দুর্ভোগে পড়া লাখ লাখ মানুষকে। উত্তর পেয়ে যাবেন।
=====================
অতঃপর সহিংসতাপ্রবণ ইসলামী দলগুলোর প্রতি-
ইসলাম একটা শান্তির ধর্ম বলে প্রবাদ শুনি। কিন্তু আজকাল ইসলামী দলের মিছিল দেখলে দোকানপাট বন্ধ করে রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে যায় কেন? কোন শান্তির আশ্বাসে? ভয় দেখিয়ে বোমা ফাটিয়ে গনজাগরণ মঞ্চে লোক সমাগম কমাতে চেষ্টা করতে পারেন আপনারা, কিন্তু মানুষের বুকে জায়গা পাবেন? শাহবাগে লাখ লাখ মানুষ শান্তিপূর্ন অবস্থান করেছে দিনের পর দিন, তাদের কেউ জোর করে ডেকে আনেনি। শাহবাগের লাখো মানুষের এত বিক্ষোভে কোথাও আতংক সৃষ্টি করেনি। বরং সেই জনজোয়ারে আনন্দের ছাপ উৎসবের ছাপ ছিল। কিন্তু আপনাদের কয়েকশো মানুষের মিছিলও সৃষ্টি করে তীব্র আতংকের। কেন করে, বুঝতে পারেন? তারা এখন আর মাঠে নাই তার মানে এই না যে তারা শাহবাগের সেই দাবী বুক থেকে মুছে আপনাদের দাবিকে বুকে তুলে নিয়েছে। তারা সবাই বাড়ি ফিরেছে ঠিক, কিন্তু তারা আবারো মাঠে নামতে পারে যে কোন সময়।
সুস্থ মানুষ মাত্রেই জানে ইসলামের কলংক এই জঙ্গীবাদ। আপনারা যখন তখন যাকে তাকে নাস্তিক ডাকছেন মুরতাদ ঘোষণা করছেন। কিন্তু কে কতটা আস্তিক কতটা নাস্তিক সেটা তার আল্লাহ জানে। তার বিশ্বাসের পাপপূন্যের হিসাব সে-ই দেবে শেষ বিচারের দিনে। আপনি না। আপনাদেরকে কেউ নিয়োগ দেয়নি তার ঈমানের দায়িত্ব নিতে। আপনারা নিজের ঈমানের দায়িত্ব নিয়ে থাকলেই ভালো করবেন। আমি একজন সাধারণ মুসলমান কিন্তু আমি কোন জঙ্গী সার্টিফায়েড মুসলমান হতে চাই না। হাজার বছরের মিলিত সংস্কৃতির দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এই সংস্কৃতির সাথে ইসলামের ঘোরতর কোন বিবাদ ঘটেনি কোনকালে। ধর্ম আর সংস্কৃতি এখানে পাশাপাশি বহমান। একাত্তরের চেতনা বলে যে জিনিসটা বলি, সেটার সাথেও ধর্মের কোন বিরোধ নেই। এমনকি মদিনা সনদেও একটা সহনশীল সমাজের কথা বলা হয়েছে। যারা পড়েননি তাদের জন্য একটা কপি দিলাম এখানে।
**মদীনা সনদের মূল বিষয়বস্তু:
১) সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে।
২)হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন।
৩) কোন সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদীনা বা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনরুপ সাহায্য-সহযোগীতা করতে পারবে না।
৪) মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৫) মদিনার উপর যে কোন বহিরাক্রমণ কে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে। এবং সেই আক্রমণ কে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে।
৬) রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
৭) অসহায় ও দূর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
৮) সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদীনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে।
৯) কোন লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায় কে দায়ী করা যাবে না।
১০) মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরষ্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।
১১) রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক।
১২) মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১৩) মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্মীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।
এই সনদের কোথাও সহিংসতা আর জঙ্গীবাদের অবকাশ আছে? নাই!
বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম। এই ইসলাম তালিবান স্টাইলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যতদূর জানি এই দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রবর্তিত হয়েছে সুফীবাদের মাধ্যমে, এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে ধারণ করেই। তালেবান স্টাইলের ইসলাম আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের কি দশা করেছে এবং করছে সারা বিশ্ব দেখছে। আবার ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর দিকে তাকান। সেখানেও তালিবানি স্টাইলে ইসলাম প্রবেশ করে নাই। এর মানে হলো জঙ্গীবাদ দিয়ে কখনো কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, যায়না। তাছাড়া বাংলাদেশে নতুন কোন জাতের ইসলামের দরকার নাই। বাংলাদেশকে আপনারা নতুন করে মুসলমানী করানোর চেষ্টা করলে তার ফল ধ্বংসের দিকেই নেবে আপনাদেরকে, বাংলাদেশকে। অতএব সময় থাকতে বিভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলেন। শান্তির পথে থাকেন। মানুষের সাথে থাকেন।
পাদটীকাঃ-
১) চট্টগ্রামের বিভিন্ন মসজিদ আর আলেম সমাজের আলোচনার প্রতি ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে অধিকাংশ আলেম সহিংসতার বিপক্ষে। নাস্তিকতার বিপক্ষে কঠোর অবস্থান থাকলেও চট্টগ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী আলেম সমাজের কোন সমস্যা নেই শাহবাগের গনজাগরণ নিয়ে। তাদের অনেকে সংহতি প্রকাশও করেছে গনজাগরণের পক্ষে। এমনকি সুন্নী আলেমদের প্রতিপক্ষ বলে পরিচিত হেফাজতে ইসলামকে জামায়াত আমারদেশ পত্রিকার বিভ্রান্তিকর প্রচারণা দিয়ে বিভ্রান্ত করে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে।
২) মদিনা সনদের উইকিসুত্রঃ
**http://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%...
মন্তব্য
বস্, আপনি যে মহানগরে গোটা জীবনটা কাটালেন সেখানে কোনদিন 'হেফাজতে ইসলাম' নামের কোন দলের কথা শুনেছেন? সম্ভবত না। তাহলে আজকে তারা কোত্থেকে এতো শক্তি নিয়ে উদয় হলো? হয়তো বলবেন, এটা একটা ছদ্মাবরণ মাত্র। হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে এই ছদ্মবেশীদের পাশে কিছু সাধারণ মানুষও আছে। যাদেরকে বোঝানো গেছে - দেশে আজ ইসলাম বিপন্ন।
এভাবে ধর্মের নামে সহজেই বোঝানো যায় এমন মানুষের সংখ্যা বিপুল। বিপদের কথা এই যে, বিনা উষ্কানীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর-উপাসনালয় পুড়িয়ে দেয়া, তাদেরকে হত্যা করা, ধর্ষণ করা হচ্ছে সেটা এই বুঝদারদের চোখে পড়েনা, তাদের বোধেও আসেনা।
আমি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশের volatile চরিত্র সম্পর্কে অবগত, ভোট দেবার সময় তাদের অদ্ভূত আচরণ সম্পর্কে অবগত, বিচারের সময় ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মাপের স্কেল ব্যবহার করা সম্পর্কে অবগত, ধর্মের নামে তাদের অন্ধত্ব সম্পর্কে অবগত। আশা ছেড়ে দিয়ে গলায় দড়ি দেবার দলের মানুষ আমি না, তবে এদেরকে নিয়ে কোন আশাও আমি করি না। আমার আশার জায়গাটা খুব মুষ্টিমেয় মানুষের ওপর, যারা এখনো মানুষ আছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
হেফাজতে ইসলাম দলটির জন্ম যখনই হোক তার অস্তিত্ব আমরা হঠাৎ করে টের পাচ্ছি শাহবাগ ইস্যুতে। শাহবাগ আন্দোলনের একমাত্র প্রতিপক্ষ হবার কথা ছিল জামাতে ইসলামী। হেফাজতে ইসলামী এখানে কোন পার্টি না, কিন্তু তারা যেন জোর করে নিজেদেরকে শাহবাগের প্রতিপক্ষ বানাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। খামাকাই শাহবাগের গণজাগরন মঞ্চের চট্টগ্রাম আগমন ঠেকাবে। কারণ তারা শাহবাগ নাস্তিকতার আন্দোলন করছে, শাহবাগ থেকে মহানবীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে। অবাক হয়েছি যখন টিভির এতগুলো চ্যানেলে লাইভ দেখানো হচ্ছে শাহবাগের আন্দোলন সম্পর্কে, সেখানে কি করে এত বড় একটা মিথ্যায় বিশ্বাস স্থাপন করলো ওই্ মানুষগুলো? তারা কি একটাও নজির দেখাতে পারবে যে শাহবাগ থেকে ইসলাম বিরোধী কোন শ্লোগান দেয়া হয়েছে? আমি ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবো তারা কখনোই প্রমান দেখাতে পারবে না! তবু তারা জামাতের চোরাই বুদ্ধির জালে আটকা পড়ে মিথ্যে চিলের পিছনে ছুটে নিজেরা বিভ্রান্ত হচ্ছে, মানুষকেও বিভ্রান্ত করছে।
তবে এটা ঠিক ধর্মের কথা বলা এইসব দুর্বল ঈমানের লোকজন দেখে হতাশ লাগে। তারা চাঁদে সাঈদীকে দেখে, শাহবাগে নাস্তিক দেখে দেশজুড়ে লংকাকাণ্ড ঘটায়। কিন্তু নিজেরা চোখটা খুলে ভালো করে তাকায় না কোনটা সাদা কোনটা কালো। আফসোস!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চমৎকার লেখা। অসাধারন বলেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই লেখাগুলো আমরা নিজেরা নিজেরাই পড়ছি। যাদের পড়ার দরকার তারা তো এদিকে চেয়েও দেখছে না। আবার তাদের মধ্যে কেউ যদি পড়েও তবে তার ধৌত-করা ঘিলুর ভেতর এগুলো ঢুকবে না। ওরা উন্মাদ, ফ্যানাটিক। ওর এত কিছু বুঝে না। ঈমানী দায়িত্ব পালন, দলের আদেশ তাদের কাছে সব কথার শেষ কথা। এ এমন এক সমস্যা যার সমাধান আমাদের হাতে নেই। ইদানিং এমনই মনে হচ্ছে।
সামি
দুঃখের বিষয় হল, এই নোংরা কাজটি করেনি এরকম রাজনৈতিক দল কম আছে (বাম বাদে)।আ
"টাকার নৌকা নাকি পাহাড়ের উপর দিয়ে চলতে পারে !"
বেপরোয়া জামাত-শিবিরের চলমান প্রচেষ্টাকে বৈধতার আবরণ দিতে প্রাণপণ সচেষ্ট আলজাজিরা, সিএনএন ইত্যাদি প্রভাবশালী মিডিয়াগুলার আচরণ দেখলে উল্লিখিত বাক্যের আর বিশেষ বিশ্লেষণ দরকার হয় না। মানবসভ্যতার এই চরম আবিস্কার "টাকা" ভাড়াখাটা জাঁদরেল (!) বৈদেশিক সাংবাদিক, আইনজীবি ছাড়াও ভিন্ন ধর্মের মানুষদের দিয়া জামাত-শিবিরের প্রশংসাসুলভ মানপত্র রচনা করাচ্ছে !
সবকিছু মনে লয় নষ্টদের অধিকারেই যাবে !
___ বিজন কথক
নতুন মন্তব্য করুন