টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম কদিন। দৃশ্যগুলো সহ্য হবার নয়। কংক্রিটের পিলারের মাঝে কোমর পর্যন্ত আটকে থাকা এক আলতাফের আকুতিভরা বাক্য 'ভাই আমারে বাঁচান' আমাকে ঘুমোতে দেয়নি দুদিন। এত শত মানুষ মরেছে নির্মমভাবে, কিন্তু আলতাফের আটকে থাকার দৃশ্যটাই আমার চোখে আটকে গেছে। কারণ পরদিন সকালে উঠে জেনেছি আলতাফ চলে গেছে।
আমি নিজেকে আলতাফের আটকে থাকা জায়গাটায় নিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করেছি শেষ মুহুর্তে আমি কার মুখ মনে করতাম। কাকে দেখার তৃষ্ণা থাকতো আমার চলে যাবার মুহুর্তে। আমার দুই প্রিয় সন্তানের কথা মনে হলো। রাতে ঘুমোবার সময় পৌনে চার বছরের শিহান গলা জড়িয়ে ধরে দাবী জানায়, 'বাবা তুমি কালকে অফিতে দাবে না, ঘুম থেকে উতে তোমাকে দেততে আমাল ভালো লাগে।' আমি শেষ মুহুর্তে হয়তো ওর কথাই ভাবতাম, ওকে দেখার জন্য কষ্টে ভরে যেতো আমার বুক। আমাকে আর কখনো ফিরতে না দেখে ওর কেমন লাগতো ছোট্ট শীর্ণ বুকটাতে। আলতাফও কি তেমন কোন প্রিয় মুখের কথা ভাবছিল?
আমি আবারো টিভিতে ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখতে শুরু করি আজ সকাল থেকে। দুপুরে জানলাম শাহীনূরের কথা। শাহীনুরের সাথে থাকা আরো তিন জন। বিকেলে জানা গেল বাকী তিনজনের সাড়া মিলছে না। কেবল শাহীনুর। আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম বিকেল থেকে। শাহীনুরকে উদ্ধার করার কাজ চলছে। আশায় বুক বাঁধে মানুষ। এই এক শাহীনুর যেন আমাদের মুখে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। পারলে বাঁচাও আমাকে। দেখি কত ক্ষমতা তোমার।
সাতটা আটটা নটা পেরিয়ে দশটা বাজলো। হঠাৎ টিভি পর্দায় উত্তেজনা। আগুন লেগেছে উদ্ধার সুরঙ্গে। প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসছে উদ্ধারকর্মীরা। আমরা চরম উৎকন্ঠা নিয়ে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে। একজন বললো স্ট্রেচারে করে কাউকে বের করা হলো এইমাত্র। শাহীনুর? আমাদের মন নেচে উঠলো বিজয়ানন্দে। আমরা পেরেছি। আরো একটা প্রাণ বাঁচলো অবশেষে।
কিন্তু না। কয়েক মিনিট পর দেখা গেল মৃতের সংখ্যা ৩৭৭ থেকে বেড়ে ৩৭৮!। বিরাট একটা ধাক্কা। সত্যিকারের ধাক্কা খেলাম আমরা। তবে কি শাহীনুর? এ যেন ক্রিকেট খেলার শেষ বলে শেষ রান। ব্যাটে বলটা লাগলো ঠিকই, কিন্তু ব্যাটের কোনায় লেগে ক্যাচ উঠে গেল। আউট! আমরা হেরে গেলাম মাত্র ১ রানের জন্য। জিতে গেল মৃত্যুদুত। আমাদের ক্ষমা করো শাহীনুর। তোমাকে আলোর মুখ দেখাতে পারিনি আমরা।
[দায়মুক্তিঃ উদ্ধারকর্মীদের সবার প্রতি নতজানু শ্রদ্ধা, আপনারা প্রাণবাজি রেখে কাজ করছেন। অনেক প্রাণ বাঁচিয়েছেন। শাহীনুর বা তার সঙ্গী তিনজনকে নিয়ে আসতে পারেননি বলে আপনাদের কাউকে দায়ী করবে না কেউ। আপনারা যা করেছেন আমি ১০০ বার জন্ম নিলেও তা করতে পারতাম না]
মন্তব্য
আপনার দায়মুক্তির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। উদ্ধারকর্মীদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা....তারাও যেন সুস্থ এবং নিরাপদে থাকেন।
আল্লাহ, ভগবান বা ঈশ্বর এই নিরপরাধ মানুষগুলোর সাথে নাই, কেন নাই?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
কেন নাই? কেন নাই? কেন নাই?
যাদের জীবিত উদ্ধার করা গেছে, তারাই কি আসলে বেঁচেছে?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নামটি একেক জায়গায় একেক রকম লেখা হচ্ছে - সঠিক নামটি
শাহিনা
বা
শাহীনা
প্রথম আলো
dhakatribune
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
নতুন মন্তব্য করুন