সময়টা কি ১৯৮৮ নাকি ৮৯? ঠিক মনে আসছে না। তবে এই দুটো বছরের যে কোন একটা বছরে চট্টগ্রামে 'বিজয় মেলা' নামক একটা ব্যাপার চালু হয় সার্কিট হাউসের সামনের খোলা মাঠে। ওই মাঠটি তখন শিশুপার্ক হয়নি। সার্কিট হাউস তখনো জিয়া স্মৃতি যাদুঘর হয়নি। খোলা ময়দানটিতে আমার কোন কোন বিকেলে আড্ডা দিতাম। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকের এই মাঠে কিছু কাঠের চেয়ার টেবিল বসানো থাকতো দারুল কাবাবের পক্ষ থেকে। স্টেডিয়াম মার্কেটে চট্টগ্রামের একমাত্র কাবাবের দোকান। সেখান থেকে ট্রেতে করে ধোঁয়া ওঠা কাবাব পরোটা নিয়ে আসা হতো সার্কিট হাউসের সামনের ঢালু ময়দানে। আমাদের পকেটে সেই সময়ে কাবাব খাওয়ার পয়সা হয়নি। তাই আড্ডা দিতে দিতে কেবল গন্ধ শুঁকেই অর্ধভোজন সেরে মনে মনে বলতাম, দেখিস একদিন আমরাও।
আমাদের সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠের প্রাথমিক ভাগে, তারুণ্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল টগবগে সময়ে বিজয়মেলার সূচনা হয়। আমরা বিনাপয়সায় বিজয়মেলার আয়োজনে খাটতাম। কিন্তু সেই বেগার খাটুনীতেও কি তুমুল আনন্দ ছিল। সারা দেশে সেই প্রথম নতুন ভাবে বিজয়ের মাস উদযাপন করার শুরু হয়েছিল। তখন সারা দেশে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন চলছিল। ওই মেলাটি যেন পরিণত হয় স্বৈরাচার আর রাজাকার বিরোধী একটা মঞ্চে। সেই মঞ্চে বাংলাদেশের সকল শীর্ষ বুদ্ধিজীবি রাজনীতিবিদরা আসতেন ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে। বিজয়মেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণের যে অনুষ্ঠান হতো, সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য, সেই স্মৃতিচারণ শোনার জন্য বিশাল সেই মাঠে তিল ধারণের জায়গা থাকতো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি তখন অনেক বেশী উজ্জীবিত ছিল? এখনকার মতো সুশীল সমাজ রাজাকার চেতনার মানুষ তখন আমরা চেরাগ দিয়েও খুঁজেও পেতাম না। আমি জানি না দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেয়ে রাজাকার চেতনার চাষবাসে এতটা বাম্পার ফলন কি করে হলো? সেই আশির দশকের শেষভাগকে, আন্দোলনকে উৎসবে পরিণত করার সবচেয়ে স্মরণীয় কাল বলতে হবে।
মানুষের চেতনাকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পেরেছিল বলে সেই বিজয়মেলা অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। একসময় সেই বিজয়মেলা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যায়। বর্তমানে সারাদেশে যত বিজয়মেলা হয় তার আদি জননী চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের মাঠের সেই প্রথম বিজয়মেলা। আজকে চট্টগ্রামে যারা দায়সারা চেহারার দারিদ্রে জর্জরিত বিজয়মেলা দেখছেন তারা, এমনকি গত দশ বছর ধরেও যারা দেখছেন তারাও কল্পনা করতে পারবেন না সূচনার সেই বিজয়মেলাটার চেহারা কতটা মহিমাময় ছিল, কতটা মুগ্ধকর ছিল। শাহবাগে প্রথম দুই সপ্তাহে যে স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্য দেখেছি আমরা, প্রথম কয়েক বছর চট্টগ্রামের বিজয়মেলাটাও সেরকম স্বতঃস্ফূর্ততা আর সৌন্দর্য আর মহিমা নিয়ে ছিল। দলমত নির্বিশেষে স্বৈরাচার বিরোধী চেতনার সব মানুষ জড়ো হতো সেই মাঠে।
তখনো বিজয়মেলার রাজনীতিকরণ করা হয়নি। রাজনীতিবিদরা তখনো কেবল অতিথি। বিজয়মেলা পরিচালনা করতেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সাধারণ বিশিষ্টজনেরা। প্রথম কয়েকটা বছর সেরকমই চলছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে বিজয়মেলা কমিটিতে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বাড়তে বাড়তে বিজয়মেলা একসময় পুরোপুরি রাজনীতিবিদের দখলে চলে যায়। দলাদলির এক পর্যায়ে বিএনপি আলাদা বিজয়মেলা করার ঘোষণা দেয়। আউটার স্টেডিয়ামের পাশে তারাও আরেকটা মেলা চালু করে এক বছর। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয় সঙ্গত কারণেই। পরে তারা বিজয়মেলা জিনিসটাকেই নাজায়েজ মনে করতে থাকে হয়তো।
বিএনপি প্রথমবার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর সার্কিট হাউসকে জিয়া স্মৃতি যাদুঘর বানানো হয়। সামনের মাঠটিতে শিশুপার্ক তৈরী হয়। সবকিছুই বিজয়মেলাকে উৎখাত করার জন্য। কিন্তু বিজয়মেলা জায়গা থেকে উৎখাত হলেও বন্ধ হয়নি। সার্কিট হাউস মাঠ থেকে সরে যায় পাশের আউটার স্টেডিয়ামে। স্মৃতিচারণ মঞ্চ আর মেলা আলাদা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে মেলায় ধুলোবালির সাথে নানান উৎপাত যুক্ত হতে থাকে। একসময় বিজয়মেলা তার সাংস্কৃতিক চরিত্রটা হারিয়ে হয়ে গেল যেন তেন একটা মেলা। দায়সারা একটা অনুষ্ঠান মাত্র। যে বিজয়মেলায় সারাদেশ থেকে বিচিত্র সব পণ্যের সমাহার ঘটতো, সেই বিজয়মেলা বাজারী পণ্যের মেলা হয়ে গেল। এখনো বিজয়মেলা হয় প্রতিবছর। কিন্তু এই বিজয়মেলা একটা সাইনবোর্ড মাত্র। বিজয় মাসের কোন আমেজ তাতে নেই, সেই চেহারা, সেই গন্ধ, সেই ভাষা, সেই চরিত্র কিছুই নেই।
আমি ২০১৩ সালের বিজয় দিবসের প্রায় সন্ধিক্ষণে সেই আদি বিজয়মেলাকে খুব বেশী মিস করছি। কারণ ডিসেম্বরের পরাজিত শত্রু জামাত শিবির হায়েনাদের তাণ্ডবে এই বছর বিজয়ের গন্ধ কলুষিত হয়েছে রক্ত আর মাংসপোড়া গন্ধে। আমি আশংকায় আছি মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ক্ষমতায় থেকেও যে দুঃসাহসে মাথা তুলেছে এই দানবের শক্তি, রাষ্ট্রক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের শক্তির অভাবে সেই দানব কতটা লাঞ্ছিত করবে কতটা পদপিষ্ট করবে এই বাংলাদেশকে?
মন্তব্য
এই রিয়েলাইজেশন দেশের বেশিরভাগ মানুষের থাকলেই দেশটা বেঁচে যেতো।
শব্দ পথিক
আহা! আবার হোক...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনার মত শঙ্কা আমারও যে , স্বাধীনতার পক্ষের এই শক্তি এখন ক্ষমতায় থাকতেই যেভাবে এই জামাত শিবির ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে না জানি এই শক্তির অনুপস্থিতিতে এরা কতটা পৈশাচিক আর অমানবিক আচরণ করতে শুরু করে!
চেরাগের আলো জায়গা মত পড়েনি আসলে। পড়লে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যেত কারা কিংবা কোন মানসিকতার মানুষগুলো মুক্তিযুদ্ধকে 'গণ্ডগোল' বলছে। দুষ্টু ছেলের কাণ্ডে মা-বাবার আশকারা দেবার মত ব্যাপারটিকে না দেখে তখনই যদি এসব মনোভাবকে অগ্রাহ্য না করে গুড়িয়ে দেয়া যেত তবে আজকে তাদের বাম্পারফলনটা দেখতে হতো না। আমাদের উদাসীনতার জন্যই আজকে বাংলাদেশে এইসব নষ্ট ভ্রষ্ট মানুষ নামের জানোয়ারগুলো তাণ্ডব চালাচ্ছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই এরা নিজেদের কাজের বলয়টা জারি রেখেছে সেটা না বরং দেশের সীমা ছাড়িয়েছে এদের বংশধরেরা। আমরা নিজেরা যে যার মত করে দেশটাকে ভালোবাসলেও 'এরা' একভাবেই ঘৃণা করে, ঘৃণা ছড়ায়। এদের তাল লয় সব এক স্কেলে মাপা। আমরা যখন নিজেদের ইগো, বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাঙনে জড়াই। তখনও বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাবের এই কীটগুলো একাট্টা থাকে। আমাদের দুর্বলতাই ওদের শক্তি দিয়েছে। আজকে দেশজুড়ে যে তাণ্ডব চলছে তাতে জানোয়ারগুলো দেখছে নিজেদের উন্নতি। শক্ত হাতে এদের রুখে দিতে পারলেই 'আবার জমবে মেলা বটতলা হাটতলা' গ্যারান্টি!
নীড় দা,
আপনিতো আশি'র দশকের উজ্জ্বল দিকটা দেখালেন। বড় শহরগুলোতে মুক্তবুদ্ধির পরিচলণ বন্ধ করার সাহস বা সামর্থ্য সে সময় কারো ছিলোনা। কিন্তু আশির দশকের মফস্বল?
আমরা যারা মফস্বলে জন্মেছি আশির দশকে তারা যেই পটভূমিতে বেড়ে উঠেছি তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আজকের সময়। বাংলা বইয়ের বীরশ্রেষ্টর গল্প ছাড়া আমাদের জীবনের কোথাও তখন মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব ছিলো না। আশপাশের সবার মুখে শোনা যেত গন্ডগোলের বছর। ক্লসের ইতিহাস বইতে আর টিভিতে শুনতাম হানাদার বাহিনী আর তার দোসর। স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে শুধু সিনেমা দেখাতো "জীবন থেকে নেয়া", কখোনো "আলোর মিছিল"। একটা মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগের পটভূমি, একটা অনেক পরের। আওয়ামী লিগ ক্ষমতায় আসার আগে কখনো ৭ মার্চের ভাষন শুনিনি। হানাদাররা যে পশ্চিম পাকিস্তান তথা পাকিস্তানী, আর তার দোসররা যে জামাত তা বুঝতে অনেক বড় হতে হয়েছে। এক বড় ভাইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে না থাকলে "একাত্তরের দিনগুলি" পড়তে স্কুল জীবন পার হয়ে যেত।
প্রোপাগান্ডা ছিলোঃ
* শেখ মুজিব ভারতের কাছে দেশ বিক্রির চুক্তিপত্র তৈরী করে ফেলেছিলো। চুক্তি সইয়ের আগের দিন তাকে দেশপ্রেমীকেরা হত্যা করে।
* ২৫ মার্চ শেখ মুজিব ইচ্ছা করে ধরা দেয় যেন সে নিজে আর পরিবার নিরাপদ থাকে।
* জিয়া শুধু স্বাধীনতার ঘোষকই না মুক্তিযুদ্ধ আসলে সেই পরিচালনা করেছে।
* নজরুল ইসলামের হিন্দু বউ তার কবিতা চুরি করে রবীন্দ্রনাথকে দেয়াতেই নজরুলের নোবেল ফস্কে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছে। বাংলা বইয়ের কবি পরচিতি কিন্তু খুব কম ছাত্রছাত্রীই পড়তো। তা অনুধাবন যে কয়জন করার চেষ্টা করতো তা বোধহয় আংগুলে গুনে বলা যায়
* "ঘাদানিক" আসলে ভারতের দালাল চক্র। "ঘাদানিক" কি সেই ধারণাই তো অধিকাংশের ভিতর ছিলো না।
* জিয়ার খাল কাটা হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নতিকল্পে রাখা সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান
আর মনে পড়ছে না এখন। বড় শহরগুলোতে হয়তো ভিন্ন পরস্থিতি ছিলো কিন্তু মফস্বল শহর এবং গ্রামগুলোতে প্রোপাগান্ডাগুলোই বেশী চলতো। ইনকিলাব ছিলো সবচাইতে জনপ্রিয় পত্রিকা। চারিদিকে এন্টি-আওয়ামী হাওয়া।
৯১ তে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ৯৪/৯৫ এ গোলাম আজম বাংলাদেশে ফিরে গোটা দেশ সফর দেয়। স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা ফিতা নেড়ে স্লোগান দেয় "গোলাম আজমের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম"। এটা কিন্তু কাদের মোল্লার ভি দেখানোর চাইতেও অনেক বড় অপমান ছিলো। খানকীর ছেলে ভেবেছিলো আহঃ কি পেলাম। কিন্তু সেই প্রথম স্কুল কলেজের ছাত্র সমাজের বড় অংশ জনলো রাজাকার কি, এবং তাদের সর্দার কে ছিলো। এবং রাজাকারকে ঘৃণা করতেও শিখলো। তার পরেও মফস্বলে আওয়ামী বিরোধীতা কমেনি। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তার কারণে জেতেনি, জিতেছে বিএনপির অজনপ্রিয়তার কারণে।
এবার আসি শিবির প্রসংগে। মফস্বলে শিবিরকে সে সময় জামাতের সাথে মেলানো হতো না। শিবির করা ছাত্ররা ছিলো মেধা ও ভাল ব্যবহারের দৃষ্টান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা জানতো শিবির কি চিজ, কিন্তু মফস্বলের স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছে তারা আদর্শ বড়ভাই। আর যেই ছেলেরা পড়াশুনার বদলে গুন্ডামীতেই নিজেদের ক্যারিয়ার দেখতো তারা জানতো শিবির করলে অস্ত্র পাওয়া যায়। হ্যাঁ রে ভাই ওরা স্কুল্লের এইট নাইনে পড়া ছেলেদের পাইপগান দিত, কলেজের ছেলেদের কাটা রাইফেল। বিশেষ টার্গেট বড়লোকদের বখাটে ছেলেরা। অন্যরা চিন্তা শুরু করারও আগে থেকে শিরির এতো রূট লেভেলে জাল বিস্তার শুরু করে।
সেখান থেকেই তো আজকের প্রজন্মের উঠে আসা। স্বাধীনতার পক্ষের তরুণপ্রজন্ম যত বলিষ্ঠ হয়েছে, এই শুওরের বাচ্চারা তার থেকেও নিজেদের মোটাতাজা করেছে। আপনার নিজের তাগিদে ব্লগে ফেসবুকে লিখেছেন, জামাত পয়সা খরচ করে লেখাচ্ছে। একটাই ভরসা মফস্বলে এখন আর শিবিরের প্রতি মানুষের সেই মোহ নেই। এখন তারা যানে, তাদের কলেজে গন্ডোগোল হলে শিবির সিলেট, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম থেকে ক্যাডার নিয়ে আসে। এখন শিবির শুধুই রগকাটা পার্টি। তাই তাদের নজর এখন মাদ্রাসার এতিম এবং দুনিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ কিশোরদের দিকে
আহ! শুরুর দিকের কয়েক বছরের সেই বিজয় মেলা। সেদিনের চট্টলাবাসী ছাড়া কাউকে বলে বোঝানো যাবে সেই মেলার আবেদন কতখানি ছিল।
বিজয়মেলা সমগ্র বাংলাদেশে চালু হোক।
শহরের এ বিজয়মেলা আস্তে আস্তে উপজলা সদরগুলোয় ছড়িয়ে গিয়েছিলো।
সারাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় মেলা উদযাপন হোক।
নতুন মন্তব্য করুন